তুমি_নামক_ব্যাধি পর্ব ১১

#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১১
______________

দরজায় টোকার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। হালকা পায়ে হেঁটে দরজা খুলে দেখি তিহাম ভাইয়া এক হাত প্যান্টের পকেটে,আরেক হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে আশপাশে তাকালাম।নাহ্!কেউ নেই।ঠাস করে আবার দরজা লাগিয়ে দিতেই তিহাম ভাইয়ার আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম। জড়ানো কন্ঠে বলছে,

—‘আমার হাত,আহ্!’

ধাড়াম করে দরজা খুলে ভয়ার্ত চোখে তাকালাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিহাম ভাইয়া এক পা রুমের ভেতর দিয়ে ছাগলের মতো একটা হাসি দিল। সকাল সকাল বেলা মেজাজটা তুঙ্গে উঠে গেল। দরজায় একটা লাথি দিয়ে ওয়াশরুমে গেলাম।

বেশ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হলাম।বেডের দিকে চোখ পড়তেই দেখি তিহাম ভাইয়া দুই হাত মাথার নিচে দিয়ে পায়ের উপন পা তুলে নাচাচ্ছে।দরজা খোলা।আমার বেডে অন্য কারো শোয়া তো দূরে থাক, বসা পর্যন্ত অপছন্দের। ঠান্ডা গলায় বললাম,

—‘এ বাসায় রুম এবং বেডের অভাব দেখছি না যে আমার বেডে শুয়ে পা নাচাতে হবে।’

তিহাম ভাইয়া একটা বালিশ দুহাত দিয়ে জড়িয়ে বলল,

—‘কিন্তু আমার তো এই রুম এবং এই বেডটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দের। ‘

—‘আমি আমার জিনিসে অন্য কারো স্পর্শ একদম পছন্দ করি না। গেট আপ!’

—‘তোমার জিনিস মানেই আমার জিনিস। আর আমি মোটেই অন্য কেউ নই।’

চিল্লিয়ে বললাম,

—‘গেট আপ!আই সে,জাস্ট গেট আপ। ভেরি ফাস্ট।’

—‘আই সে,লাভ মি!’

—‘হোয়াট?’

—‘বললাম যে, আমি উঠবোনা।তুমি পারলে উঠাও আমাকে। ‘

—‘তিন,তিন পর্যন্ত গুনবো আমি। এর মধ্যে আমার বেড প্লাস রুম না ছাড়লে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।’

—‘ট্রাই করে দেখতে পারো।’

—‘লাস্ট বারের মতো বলছি,গেট আউট!’

—‘হা হা হা।তোমাকে এখন যা লাগছে না!’

আমি দমে গেলাম।এর সাথে শক্তিতে পারবো না আমি।নিজের জোর দেখাতে গিয়ে উল্টো যদি কিছু করে বসে!আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত মুখে ছিপি দিতে রুম থেকে বের হতে উদ্যত হলাম।

হঠাৎ তিহাম ভাইয়া পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো। সামনের দুই হাত শক্ত করে ধরার ফলে কিছু করতে পারছি না।শুধু ছোটাছুটি করছি।ভয়ে বিস্ফারিত নয়নে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি।খোলা দরজা দিয়ে যদি হঠাৎ কেউ রুমে আসে?

পায়ের পাতা দিয়ে দিলাম এক গুঁতো।কিন্তু কিছুই হলো না।কারণ আমি খালি পায়ে আছি।উল্টো তিহাম ভাইয়া তার দুই পা আমার পায়ের উপর রাখলো।টেনে টেনে বললো,

—‘তুমি তো সিনেমার নায়িকাদের মতো অভিনয় করতে চাচ্ছো।বেশ ইনজয় করছি।’

দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

—‘জানোয়ার,ক্রেজি ব্রাট ছাড় আমায়।’

—‘ছি,ছি!নিজের ফিউচার স্বামী কে কেউ এসব বলে?লোকে শুনলে কি বলবে?’

—‘তুই আমায় ছাড়বি নাকি আমি চিৎকার দিব?’

—‘ওইটা তুমি পারবে না।কারণ সবাই যত দ্রুত জেনে যাবে,তত আমারি লাভ।আচ্ছা, একটা কথা বলো তো!আমি যে তোমার এত কাছে তোমার ভেতর অন্যরকমের কোনো অনুভূতি হচ্ছে না?আমাকে দূর থেকে দেখেই তো মেয়েদের কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায়, সেখানে আমি তোমার এত কাছে!’

তিহাম ভাইয়ার কন্ঠ কানে যেতেই হার্টবিট যেনো লাফালাফি শুরু করলো।আমি এতক্ষণ শুধু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম।অন্য কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না।আমাকে চুপ থাকতে দেখে তিহাম ভাইয়ার হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে গেল।দ্রুত সরে আসলাম।তিহাম ভাইয়া বললো,

—‘আমায় আজ একটু সময় দিতে পারবে?’

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ভাইয়া দ্রুত বললো,

—‘তুমি যা ভাবছো, তা না।আশপাশে কোথাও ঘুরতে যেতে পারবে আমার সাথে? ‘

আমি জোর গলায় বললাম,

—‘কস্মিনকালেও নয়।’

—‘কস্মিনকাল কখন আসে তা আমার জানা নেই। তুমি এখন এবং এই মুহূর্তে যাবে আমার সাথে। তোমাকে সবকিছু কেন ফোর্স করে করতে হয় বলোতো?’

আমাকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই বললো,

—‘আমি এখন বাইরে৷ বের হবো।রেডি হয়ে নিচে নামো।’

—‘আমি যাবো না।’ দৃড়কন্ঠে বললাম।

—‘বেশ,আমি নিচে গিয়ে সবাইকে বলছি যে আমি দিয়ামণিকে ভালোবাসি।ওকে বিয়ে করতে চাই। ‘

—‘থ্রেট দিচ্ছেন? ‘

—‘তাজবীর আজমাইন তিহাম কাউকে থ্রেট দেয় না।যা বলে তাই করে।জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ!’

সামনে আসা চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিহাম ভাইয়া বলল,

—‘তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করি বলে তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, না?না হওয়ারই কথা।দাঁড়াও তোমায় প্রমাণ দিচ্ছি।’

বলেই গটগট করে নিচে নেমে গেল। ভেতরে ভেতরে একটু ভয় হলো।ইমপালস্ এর উপর ভিত্তি করে মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে।দ্রুতপায়ে পেছনে পেছনে গেলাম।তিহাম ভাইয়া সোজা রান্না ঘরে গিয়ে মাকে বলল,

—‘আন্টি, খুবই সিরিয়াস একটা কথা বলবো।হেসে উড়িয়ে দিবেন না প্লিজ।আমি দিয়ানাকে ভা…………’

—‘বাইরে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। মা,ঘুরতে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। ‘

পেছন থেকে ঝটপট উত্তর দিলাম।তিহাম ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

—‘হুম।ঘুরতে যেতে চাচ্ছি।আসলে এই দিকে বহু বছর হলো ঘোরা হয় না।মাত্র তিন মাসের ছুটিতে এসেছি।তার মধ্যে এক মাস প্রায় শেষ হয়ে যাবে।’

মা একগাল হেসে বলল,

—-‘ঘুরতে যাবে অনেক ভালো কথা। দিয়ানা ও কোথাও যায় না তেমন।ভারত লাগবে।তার আগে সবাই খেয়ে নাও।ডাইনিং এ বসো আমি আসছি।’

—‘মা,ভাবী কই?ভাবী যাক আমাদের সাথে। ‘

—‘যাবে কিনা তা তো বলতে পারবো না।ওর তো জার্নির ধকল এখনো যায়নি।ভোরবেলা বলল,ভালো লাগছে না নাকি!চল,খাওয়া দাওয়া কর।’

______________________

ইচ্ছার সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ করে তিহাম ভাইয়ার সাথে বের হয়েছি।মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হলেও এটাই সত্যি যে সাথে কেউ আসেনি।শুধু আমি আর তিহাম ভাইয়া।

ভাবীকে অনেক অনুরোধ করার পরো সে আসলো না।বড় ভাইয়া আর বাবা কি একটা প্রোজেক্টের কাজে আজ শুক্রবারো পার্সোনাল মিটিংয়ে গেছে। আর আমার গুণধর ছোট ভাই! তারে এত ধমকা ধামকি করলাম,সে কিছুতেই আসলো না।সারা সপ্তাহ ক্লাস করে সে ক্লান্ত। তাই আজ ঘুমাবে সে।

তিহাম ভাইয়া গাড়ি নিয়ে আসেনি।তার নাকি ড্রাইভিং করতে মন চাচ্ছে না।আবার ড্রাইভার ও সাথে আনবে না।অগত্যা একটা রিক্সায় বসে আছি দুজন।

কোথায় যাচ্ছি জানা নেই আমার।জিজ্ঞেস করার মন মানসিকতা নেই। আড়চোখে একবার তিহাম ভাইয়ার দিকে তাকালাম।তাকে অনেক খুশি খুশি লাগছে।ইচ্ছে হচ্ছে চলন্ত রিকশা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই।

বেহায়া,বেয়াদব,বেশরম,বদের হাড্ডি, বদমাইশ, বজ্জাত পোলা কোথাকার!!

শুধুমাত্র “ব ” দিয়ে এতগুলো গালি দিতে পেরে অনেক ভালো লাগছে।মনোযোগ দিয়ে চারপাশে তাকালাম।আজ আকাশে রোদ নেই তেমন।আকাশ অনেকটা মেঘলা।মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে মাত্র ১১ঃ২৭ বাজে।

কিছুতেই মাথায় ঢুকলো না এই ভরদুপুরে কেউ ঘুরতে বের হয় নাকি!বিকালের দিকে হলে তাও একটা কথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একদম রিকশার কর্নারে চলে আসলাম। আমাদের মাঝে মোটামুটি এক ইঞ্চি দুরত্ব আছে।প্রথমে ভয় হয়েছিল তিহাম ভাইয়া হয়তো একদম ঘেঁষে বসবে।কিন্তু উনি তা করেনি।হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।

তিহাম ভাইয়ার কন্ঠ কানে গেল।বলল,

—‘তুমি এত এত গল্পের বই পড়ো,বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সব বই গোগ্রাসে গিলেছো,তবুও তুমি এত আনরোমান্টিক কেন?’

—‘আমি রোমান্টিক নাকি আনরোমান্টিক সেটা আপনাকে দেখাতে যাওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।’ ভ্রু কুঁচকে বললাম।

—‘চিন্তার বিষয়। কিন্তু কেন জানি আমার চিন্তা করতে মন সায় দিচ্ছে না।এখন বলো,কোথাও যাবে নাকি সারাদিন রিকশাতেই ঘুরবে?’

—‘বাহ্।শুনে অনেক খুশি হলাম যে আমার ইচ্ছের একটু হলেও দাম আছে আপনার কাছে। শুনতে চেয়েছেন তাতেই আমি ধন্য।’ অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম।

—‘তোমার ছোটবড় সকল ইচ্ছে আমার কাছে আমার জীবনের চাইতে দামী। তুমি কিছুই জানো না বলেই এভাবে বলতে পারো।তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে আমি নিজের জীবন ঝুঁকিপূর্ন করতেও দু’বার ভাববো না।তুমি শুধু একবার,জাস্ট একবার আমায় একটু বুঝার ট্রাই করো।প্লিজ একবার।’

তিহাম ভাইয়ার কথা শুনে আমি শুধু বললাম,

—‘আমি কফি খাবো।’

—‘এই ভরদুপুরে………. ‘এইটুকু বলেই তিহাম ভাইয়া রিকশাওয়ালা মামাকে বললো সামনে কফিশপ দেখে গাড়ি থামাতে।

ইদানীং মাথার উপর চিন্তার ঝড় বয়ে যায় যখন তখন। একটু রাগলেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়।এখন মাথাটা কেমন ভারী ভারী লাগছে।মাথা ব্যথার পূর্ব লক্ষণ।এখন কফি খেয়ে একটা ঘুম দিতে পারলে অনেক ভালো হতো।

রিকশা থামতেই নেমে পড়লাম।তিহাম ভাইয়া ভাড়া মিটিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো।একসাথে কফিশপে ঢুকে বসে পড়লাম কর্নারের দিকে একটা টেবিলে। চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে হঠাৎ করে।তিহাম ভাইয়া বললো,

—‘অসুস্থ লাগছে দিয়ামনি?’

মাথা নেড়ে না জানালাম।তিহাম ভাইয়া উঠে গিয়ে কফি নিয়ে আসলো দু কাপ।এক কাপ নিজের জন্য রেখে অন্য কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিল।আরাম করে কফির কাপে দিলাম এক চুমুক।সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে গেল।

কেমন কেমন মেডিসিন মেডিসিন গন্ধ! নতুন কোনো ফ্লেভার নাকি?ধীরে সুস্থে খেয়ে শেষ করলাম। মেডিসিনের গন্ধটা রিচেক করার জন্য তিহাম ভাইয়াকে আরেক কাপ কফি আনতে বললাম।দিলাম দ্বিতীয় কাপে চুমুক।নাহ্!কোনো গন্ধ নেই। বরং কফির স্বাদ অমৃতের মতো মনে হচ্ছে। যদিও অমৃতের স্বাদ কখনো খেয়ে দেখা হয়নি,তবুও এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে অমৃতের স্বাদ এর চেয়ে ভালো, সুস্বাদু হতেই পারে না।

তিহাম ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

—‘ভাইয়া, এর আগের কফিতে কেমন মেডিসিনের গন্ধ ছিল না?’

—‘প্রথমত,ডোন্ট কল মি ভাইয়া।নাম ধরে ডাকবে।দ্বিতীয়ত,প্রথম কাপে তোমার মাথা ব্যথার ট্যাবলেট মিক্স করা ছিল। আস্তে আস্তে ভালো লাগবে।’

—‘আমার মাথা ব্যথা হচ্ছে বুঝলেন কিভাবে?আর ট্যাবলেট কি সঙ্গে নিয়েই ঘুরেন সবসময়? ‘

—‘শায়লা আপুর কাছে শুনেছিলাম তোমার মাথায় নাকি সমস্যা আছে।তাই ট্যাবলেট সঙ্গে রেখেছি।’

চোখ পাকিয়ে বললাম,

–‘হোয়াট? ‘

তিহাম ভাইয়া হেসে বললো,

—‘না, মানে মাথায় সমস্যা বলতে আমি মাথা ব্যথাকে বুঝিয়েছি জাস্ট।’

কিছু বললাম না।সত্যিই মাথা টা কেমন হালকা হালকা লাগছে।কফির স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ধীরে সুস্থে আবার কফির কাপে চুমুক দিলাম।

পর পর পাঁচ কাপ কপি খেলাম।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৪ঃ৫৬ মিনিট।ইচ্ছে করেই এমন করেছি।আমার সাথে ত্যাড়ামি?এই দিয়ানাকে থ্রেট দিয়ে ঘুরতে নিয়ে আসা?বেশ হয়েছে। ঘোরাঘুরির পেটে ছুরি মেরে দিয়েছি।তিহাম ভাইয়ার দিকে তাকালাম।বেশ হাসিখুশি লাগছে।

(চলবে)

কিছু কথা!গল্পটা উত্তম পুরুষে লেখা।অর্থাৎ গল্পকথক নিজেই তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা করছে।এক্ষেত্রে সে ততটুকুই বলতে পারবে যতটুকু তার সামনে ঘটবে বা কেউ তার সামনে যা বলবে!

তাই তিহাম কি ভাবছে বা তিথির মনের গোপন কথা আমরা ততক্ষণ জানতে পারবো না যতক্ষণ না তারা মুখ ফুটে বলবে।হ্যাপি রিডিং!🥰🥰

আগের পর্বের লিংক, পর্ব–১০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here