#তোমাতে-আসক্ত
নীলচুড়ি (রোকসানা)
পর্ব (১৩)
এমনি এক নিরব পরিবেশে অথৈকে বিয়ে করেছিলো মাহির। আজও এমনি এক নিরব পরিবেশে অথৈকে বিয়ে করতে যাচ্ছে আরমান। তফাৎ এতুটুকুই সেদিনে অস্থিরতা আর আজকের অস্থিরতার কোনো মিল খুজে পাইনি মাহির। সেদিন শূন্য বুকে কারো আসার অস্থিরতাই ভুগেছিলে আর আজ আবার বুক শূন্যহয়ে যাওয়ার অস্থিরতাই ভুগছে।
“”ভাইয়া তুমি অনেক ভালো। তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি?””
“”হুম।””
আরমান নিজের বুকটা মাহিরের বুকের সাথে মিলিয়ে নিলো। মাহিরও খানিকটা জোর দিয়ে জড়িয়ে নিলো। হয়তো কিছু সময় পর মাহিরের জায়গায় অথৈ এভাবে আরমানকে জড়িয়ে নিবে। আচ্ছে তখন দুজনকে কেমন দেখা যাবে? খুব সুন্দর লাগবে তাইনা? দুজনের ভালোবাসার মাখামাখিতে পুরো সৌন্দর্য বয়ে নিয়ে আসবে তখন আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন তো??
“”হয়ছে হয়ছে আর কান্না করতে হবেনা। তোমার পান্জাবীটা তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরে কিন্তু অথৈ তোমাকে বিয়েই করবেনা।””
আরমান দ্রুত মাহিরকে ছেড়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো
কোথাও কোনো ত্রুটি নাইতো? আমার অথৈ আবার সত্যি সত্যি যদি বলে দেয় বিয়ে করবেনা তখন আমার কি হবে?? আরমান আবার মাহিরের কাছে গিয়ে বললো,
“”ভাইয়া দেখ তো সব কিছু ঠিক আছে তো? আমাকে সুন্দর লাগছে তো??””
মাহির ভালো করে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। সাদা পান্জাবীতে বেশ ভালোই লাগছে। কিন্তু ঠোটটা যে আহত হয়েছিলো সেটা এখনো বুঝা যাচ্ছে। নিজেকে বেশ অপরাধীই মনে হলো। মাহির ঠোট প্রসারিত করে বললো,
“”হুম,এক্কেবারে শাহ রুখ খান লাগছে। এখন চলোতো কাজী কখন থেকে বসে আছে।””
“”হুম,চলো।””
নিচে নামতেই টকটকে লাল কালারের শাড়ী পড়া অথৈকে দেখতে পেলো মাহির। এই শাড়ীটা পড়েই মাহিরকে বিয়ে করেছিলো অথৈ আর আজ এই শাড়ীটা পড়েই আরমানকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। এটাইকি ছিলো তার নসীবে???
“”মাহির কি করতে যাচ্ছো বুঝতে পারছো?? নিজের বউকে অন্য কারো হাতে তুলে দিচ্ছো। এটা কি তোমার মাথায় ঢুকছেনা??””
“”খালু,আমাকে দুর্বল করে দিওনা প্লিজ।””
কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে লাগলো। মাহিরের মনে হলে এই পুরো পৃথিবীতে সে একা। চারপাশে অন্ধকার তাকে ছেয়ে গেছে। যেদিকে তাকাবে সেদিকে শুধুই কালো ধেয়া যেগুলো তাকে বন্দি করে রেখেছে। কিছু সময়ের জন্য মাথাটা ঘুরতে লাগলো। বুকের পা পাশটায় চিনচিন ব্যথা হতে লাগলো। কাজীর গলার স্বর শুনে মাহিরের ইচ্ছে হলো পাটা দিয়ে ওর মাথাটা বাড়ি দিয়ে থেতলিয়ে দিতে। হঠাৎ অথৈর দিকে তাকাতেই অথৈর চোখে চোখ পড়লো। ওর চোখ দেখে মনে হলো আনন্দে চোখের পানি চিকচিক করছে। মাহির সেখানে আর এক মুহুর্তও দাড়ালোনা। ধুম করে বের হয়ে গেলো।
“”কোথায় যাবেন স্যার?””
“”অথৈর বাসায়।””
ড্রয়িং রুমে অনেক্ষন ধরে মাহিরকে বসিয়ে রেখেছেন এনামুল হক। এখানে বসিয়ে রেখে কি করতে গেছেন উনি? মাহির সেখানে বসে থাকতে পারলোনা। উঠে পায়চারী করতে করতে এক পর্যায়ে এনামুল হকের রুমের উদ্দেশ্যে হাটা ধরলো। কিছুদুর এগুতেই অথৈর রুমটা চোখে পড়লে মাহির থমকে গেলো,হঠাৎই সেদিনের রেখে যাওয়া চিঠির কথা মনে পড়ে গেলো। মাহির আর এক মুহুর্তও দেরি করলোনা দ্রুত রুমে ঢুকে বিছানার নিচে হাত দিতেই চিঠিটা পেয়ে গেলো। রুমের দরজাটা হালকা চাপিয়ে দিয়ে বুকে হাত দিয়ে সাহস জুগিয়ে নিলো। তারপর চিঠিটা পড়তে লাগলো,
****আপনার কি মিনিমাম আত্মবোধ নেয়? আমার বাবা বললো বলেই আমাকে বিয়ে করতে চলে এলেন? একবার দেখারও প্রয়োজন মনে করলেননা? এতো শিক্ষিত মানুষ হয়ে এমন মুর্খের মতো কাজটা করতে কিভাবে রাজি হয়ে গেলেন? আমার সম্পর্কে আপনার কোনো আইডিয়া আছে??
আপনি জানেন আরমান আমাকে কতটা ভালেবাসে?? ওকে যদি বলি পচা পুকুরে গোসল করে আসো তাও করবে,যদি বলি সারারাত এক পা উচু করে কানে ধরে দাড়িয়ে থাকতে তাও করবে আর যদি বলি আপনাকে খুন করে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে সেটাও করবে। আপনি যদি খুন হতে না চান তাহলে এই বিয়েটা আটকিয়ে দিন।
আমি যে ওকে প্রমিস করেছিলাম ওর শেষ সময়টুকু পর্যন্ত ওর পাশে থাকবো,লাল রঙের শাড়ী পড়ে তিন বার কবুল বলবো আর ও বলেছে ১০০ বার কবুল বলবে।
আপনি প্লিজ বিয়েটা আটকে দিন। আমি ওর শেষ ইচ্ছেটা পুরন করতে চাই। ওকে খুশি মনে বিদায় দিতে চাই।
আমার বাবা আমার সব কথা মানলেও এ কথাটি কোনোভাবেই মানাতে পারিনি। আমাকে ভুলবাল বলে আপনার সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমার বাবার ধারনা ও একটা মানসিক রোগি। তাতে কি আমাকে তো ভালোবাসে এটাই বা কম কিসের? আমার বাবা এটা মেনে নিতে চায়না। আপনি আমার বাবাকে বুঝাবেন প্লিজ??
আপনিতো আমার মতো অনেক অথৈকে পাবেন কিন্তু আরমান আমার মতো অন্য কোনো অথৈকে ভালেবাসতে পারবেনা। ও আমাকে ছাড়া কিছু বুঝেনা। আমাকে ছাড়া এক মুহুর্তও থাকতে পারেনা। ওর শুধু আমাকে চায় আর কাউকে না। ওর এই একটা চাওয়া পুরন করার সুযোগ দিবেন প্লিজ? আমি আপনার কাৈ সারাজীবন ঋনি হয়ে থাকবো।দিবেন প্লিজ???*****
চিঠির ২পৃষ্ঠা পর্যন্তই আকুতি জানালেও বাকি ৪ পৃষ্ঠা শুধু প্লিজ লিখে ভরে ফেলে মিনতি জানিয়েছে অথৈ। মাহিরের নিজের উপর এতো রাগ হলো কেন সেদিন এই চিঠিটাকে না পড়ে অগ্রাহ্য করলো তাহলে হয়তো আজকের দিনটা এতটা কষ্টের হতোনা। হয়তো অন্যরকম দিন হতে পারতো।
“”মাহির তুমি এখানে??””
হঠাৎ এনামুল হকের কন্ঠস্বর পেতেই হাত থেকে চিঠিটা পড়ে গেলো। মাহির এনামুল হকের বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়লো।
“”বাবা,আপনিএমনটা কেন করলেন? আপনিতো সব জানতেন। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে বাবা,আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।আমার আম্মু আব্বুকে হারিয়ে ঠিক যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম এটা তার থেকেও বেশি মনে হচ্ছে।””
এনামুল হক মাহিরের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“”আমি যা করেছি তোমাদের ভালোর জন্যই,মাহির।””
মাহির সোজা হয়ে দাড়িয়ে কিছুটা রাগ নিয়ে বললো,
“”এটা আপনার ভালো মনে হলো? আপনার একটা ভুল ডিসিশনের জন্য তিনটা জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। আপনি তো জানতেন আমি আপনাকে কতটা সম্মান করতাম তাহলে আমার সাথে কেন এমনটা করলেন?? আর অথৈ? একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়ে যেতে পারলেননা?? আর আরমান? এই দুইদিনে ওকে দেখে আমি বুঝতে পারছি অথৈকে ও পাগলের মতো ভালোবাসে হয়তো আমিও কোনোদিন এমন ভালোবাসতে পারবোনা। তাহলে কেম সেদিন মানতে পারেননি??””
“”কারন ওর দুইটা কিডনি ড্যামেজ।””
“”মানে?””
“”আরমান যদি শুধু মানসিক রোগি হতো তাহলে আমার কোনো প্রভলেম ছিলোনা মাহির। কিন্তু যে ছেলেটা কিছুদিনের জন্য অতিথির মতো আমাদের মাঝে আছে, যার সময় ফুরিয়ে এলে চলে যাবে তার কাছে নিজের মেয়েকে আমি কিভাবে সমর্পন করবো? বাবা হয়ে মেয়েকে কিভাবে আগুনের মধ্যে জ্বলতে দিবো??””
“”আপনি এসব কি বলছেন””
এনামুল হক বিছানায় বসে পড়লেন।
“”তোমার সাথে যেদিন আমার হসপিটালে দেখা হয় সেদিন আমি আরমানের জন্যই ওখানে গিয়েছিলাম। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম আরমানকে সুস্থ করার জন্য কিন্তু খালি হাতে ফেরত আসতে হয়েছিলো। আর তখনি তোমার সাথে আমার দেখা। তোমাকে দেখার পর আমার মধ্যে লোভ জেগে গিয়েছিলো। নিজের মেয়ের ভালো ভবিষ্যতের আশায় সেদিন তোমার কাছে অন্যায় আবদার করে ফেলেছিলাম। আমি একবারও ভাবিনি এর ফলাফল কি হতে পারে। আমাকে ক্ষমা করে দিস, বাবা।””
এনামুল হকের মুখে ক্ষমা শব্দটা বের হতেই মাহির তার হাতদুটো নিজের মাথায় নিয়ে বললো,
“”স্যার, আমি অন্যায় করেছি,আপনার সাথে চোখ তুলে কথা বলেছি আমাকে শাস্তি দিন।””
এনামুল হক আর নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারেনি। মাহিরকে জড়িয়ে নিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
“”স্যার,খালামনির কল আসছিলো। এখনি হসপিটালে যেতে বলেছে। ইমিডিয়েটলি।””
চলবে