তোর নামেই শুরু পর্ব -০৪

#তোর_নামেই_শুরু
#তানজিনা_তিহা
#পর্ব_০৪

ভাইয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ড্রাইভ করছে। তার সাথে এক অজানা গন্তব্যে পাড়ি দিচ্ছি আমি। তাকে বলারও কোন গতি নেই। বললেই ফুঁসে উঠবেন। ভাইয়ার রাগ ধীরে ধীরে বাড়ছে সাথে গাড়ির স্প্রিডও ক্রমশই বাড়ছে। আমি বারবার আমার হাতটার দিকে তাকাচ্ছি। হাতে ভাইয়া পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে একদম লাল হয়ে গেছে হাতটা। ব্যাথা করছে হালকা হালকা। আমি চুপ করে বসে ভাইয়াকে পর্যবেক্ষণ করছি।

অবশেষে শহরের অনতিদূরে একটা নিস্তব্ধ নদী তীরে এসে ভাইয়া গাড়িটা থামিয়ে দিলেন। গাড়ি থেকে নেমে আমার পাশের দরজাটা এসে খুলে দিলেন। আমাকে এক টান দিয়ে গাড়ি থেকে বের করে একদম পাড় ঘেঁষে দাড় করালেন।

ভাইয়া আমার লাগছে।

বেশ হয়েছে লাগুক তোর। তোকে লাগার জন্যই দিয়েছি। খুব শখ না নিরবের সাথে পুকুর পাড়ে যাওয়ার? ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলতে খুব ভালো লাগে তাই না? আমার বরণ ভালো লাগে না। ওর সাথে কিসের এতো আলাপ?

বলেই ভাইয়া গাড়ির সামনের দিকটায় হাত দিয়ে জোরে আঘাত করলেন। প্রচুর শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠলো। আমি কানে হাত দিয়ে কান বন্ধ করে নিলাম। ভাইয়া আজ ভয়ংকর ভাবে রেগেছেন। নিরব ভাইয়া আমায় দেখা করতে বলেছে এটা ভাইয়া কিভাবে জানলো? কে জানালো? ভাইয়া আমাকে অন্যকারো সাথে সহ্য করতে পারে না কেন? তবে কি ভাইয়া আমাকে,,,

আমার ভাবনার মাঝেই ভাইয়া আমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিলো। আমি টাল সামলাতে না পেরে একদম তার সন্নিকটে চলে এলাম। ভাইয়া আমাকে তার আরো কাছে টেনে নিলেন। আমার কোমর চেপে ধরলেন তিনি। এবার আমার মুখোমুখি সে।

মেঘা! কেন বুঝিস না আমাকে তুই? আমাকে বোঝার একটুও চেষ্টা করিস না কেন?

কি বলছো ভাইয়া? হঠাৎ কি হয়েছে তোমার?

আমি কি শুধু তোকে বকাই দেই?

এবার অভিমান আমাকে চেপে ধরলো, হুম অনেক বেশি বকো তুমি আমাকে কারণে অকারণে। আমার দোষ না থাকলেও বকো। তুমি খুব পঁচা।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই পিছন ফিরে দেখলাম রিশান ভাইয়ার রক্তিম অক্ষিযুগল আমার দিকে ন্যস্ত। তাকে দেখে কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। ভাইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমার কাছে আসলেন।

তাই না? আমি তোকে খুব বকি খুব পঁচা আমি। আর তোকে বকবো না এবার খুশি?

আমি হা হয়ে গেলাম। রিশান ভাইয়ার ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন যেন আমার কাছে অবিশ্বাস্য। এমন কেন মানুষটা। আমাকে গাড়িতে বসতে বলে তিনি গাড়িতে গিয়ে বসলেন। আমি গাড়িতে উঠতেই ভাইয়া গাড়ি স্টার্ট দিলেন। গাড়িতে আমার সাথে আর কোন কথা বললেন না ভাইয়া। এমনকি একবার আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। তিনি তার মতো ড্রাইভ করছেন। তার চুপ থাকাটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার। তিনি কথা না বলায় কেমন যেন লাগছে খুব কান্না পাচ্ছে তাও চুপ করে রইলাম।

দীর্ঘ পথ পাড়ি জমিয়ে বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থেমে গেলো। গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে প্রবেশ করলাম। বাড়িতে প্রবেশ করেই রিশান ভাইয়া সোজা উপরে চলে গেলেন। ছোট মা এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন।

কিরে কি হয়েছে?

এবার আর চোখের নোনাজল গুলো কোন কথা মানলো না। হু হু করে কেঁদেই ফেললাম।

কি হয়েছে মামণি আমার। রিশান কিছু বলেছে? কি হয়েছে? বল আমাকে,,

ছোট মা ছোট মা রিশান ভাইয়া না,

কান্নার জন্য কথা বলতে পারছি না আমি। এরপরও ছোট মাকে সব বলে দিলাম। ছোট মা আমার কথা শুনে হাসছেন। আমি আশ্চর্য হলাম! তার ছেলে আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে আর সে হাসছে? মা ছেলে দুজনেই এক। অভিমান চেপে ধরেছে আমাকে। ছোট মায়ের দিকে এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থাপন করে চলে যেতে নিবো তখন তিনি বললেন,

ওরে মামণি টা রাগ করতে নেই। রিশানকে আমি বকে দেবো ঠিক আছে। আর কখনো ও এমন করবে না।

তোমার ছেলে বদের হাড্ডি। কখনো মানবে না সে, সে আমাকে কষ্ট দেবেই।

তাহলে সেরকম কাজ তুই কেন করিস? বল তো? যা ও সহ্য করতে পারে না তা কেন করিস?

মানে কি বলছো তুমি? আমি আবার কি করলাম?

নিরবের সাথে কথা বলার দরকার ছিলো?

আমি কোথাও বললাম সে তো নিজেই এলো।

উমম, আচ্ছা আমি দেখছি। সব ঠিক করে দিবো। এবার তুই যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। বিকেলে তোর ছোট চাচার বাসায় যাবো।

কি সত্যি! লিসার সাথে দেখা হবে অনেক দিন পর।

চাচ্চুর বাসায় যাওয়ার কথা শুনে মূহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল। অনেক দিন যাওয়া হয় না। যাবোই বা কি করে? চাচা নিতে চাইলেও ফুফু আর রিশান ভাইয়ার একই কথা একা যেতে দিবে না। ফুফু মাঝে মাঝে রাজি হলেও রিশান ভাইয়ার না মানে তো নাই। তিনি আমার উপরই সব ধরনের জোর খাটান। আমাকেই পেয়েছেন সব জারি দেওয়ার জন্য। তার ভয়ে আমার সব স্বাধীনতার জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে আমাকে।
অনেক দিন যাই না এরজন্য মন খারাপ হলেও যেতে তো পারবো এর জন্য অনেক খুশি হলাম। চটপট নিজের ঘরে চলে গেলাম।

মেঘপরি! আমি তোকে অনেক কষ্ট দেই তাই না? অনেক করে বকি তোকে। আমার প্রতি তোর অনেক রাগ অভিমান তাই না। কখনো তোকে কষ্ট দিবো এটা ভাবি নি। কিন্তু আমি কি করবো বল তুই তো আমাকে বুঝিস না। আমি যে তোকে ভালোবাসি মেঘপরি। নিজের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসি তোকে। তোর ভালোবাসার রঙে নিজেকে রাঙাতে চাই। তোর নামেই পথ চলতে চাই। আমার প্রতিটা প্রহরই হোক #তোর_নামেই_শুরু । তোকে ঘিরেই তো সব। তোকে ছাড়া আমি যে অচল। আমার কোন অস্তিত্ব নেই তুই ছাড়া। গভীর থেকেও গভীরভাবে জরিয়ে গেছি তোর মায়ায়। তোর শহরে নিজেকে হারাতে চাই আমি। কিন্তু বল কেন আমাকে বুঝিস না তুই? কেন আমার ভালোবাসা দেখতে পাস না? আমার বকা গুলো তোর মনে অভিমানের জন্ম দেয়? বকতে চাই না তোকে তারপরও হয়ে যায়। আমি যা চাই না তা কেন করিস? বলতো কেন এমন করিস? তোকে ঘিরে যে আমার পথ চলা এটা কি বুঝিস না তুই?

বিকেলে খাওয়া দাওয়া শেষে আমি আর ফুফু সোফায় বসে গল্প করছি। একটু পরেই বের হবো।

ওহ্! মেঘা আমরা যে তোর চাচার বাড়িতে যাবো রিশানকে তো বলা হয় নি।

ভাইয়াকে বললে ভাইয়া না করে দিবে। (কেঁদো কেঁদো কন্ঠে)

কিছু হবে না আমি দেখছি। তুই চল আমার সাথে।

না তুমি যাও তোমার ছেলে পড়ে আমাকে বকবে।

একদম না তুইও আয়। আমি আছি তো। ও বকলে ওর কানটা ছিঁড়ে দিবো।

ফুফু আমাকে একপ্রকার জোর করেই ভাইয়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। ভাইয়া বিছানায় অর্ধ শোয়া অবস্থায় ল্যাপটপে কি যেন করছেন। ফুফু গিয়ে ভাইয়াকে ডাক দিলেন।

রিশান আমরা তোর ছোট মামাদের বাসায় যাবো।

তো যাও।

আজকে ফিরবো না সকাল হবে আসতে।

আচ্ছা সমস্যা নেই।

ভাইয়া ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই ফুফুর প্রশ্নগুলোর ছোট ছোট জবাব দিচ্ছে। ফুফু এরপর বললেন,

রি,,রিশান শোন মেঘাও আমাদের সাথে যাবে।

ভাইয়া সাথে সাথেই আমার দিকে তাকালেন। হয় তো এই মূহুর্তে এই কথা তিনি আশা করেন নি। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে এরপর ফুফুর দিকে তাকালেন। এরপর ল্যাপটপটা বন্ধ করে পাশে রেখে দিয়ে বললেন,

মেঘার যাওয়া লাগবে না। ও বাড়িতেই থাকবে তুমি যাও।

তার কথা শুনে আমার চোখের নোনা পানিগুলো নিজেই ঝরতে শুরু করলো। আমি ওখান থেকে তৎক্ষণাৎ নিজের ঘরে চলে যাই। যত রাগ জেদ জারি সব আমাকেই দেয়। আমার প্রতি এতো অধিকার দেখাতে আসেন কেন উনি? আমার প্রতি জোর খাটান কেন? আমি কি ওনার? ঘরে গিয়ে দরজা আটকে কান্না শুরু করে দিলাম। আজ আর হয় তো যেতে পারবো না।

রিশান তুই মেয়েটার সাথে এমন করছিস কেন?

আমি আবার কি করলাম?

ওকে যেতে দিবি না কেন?

ও যাবে না মানে যাবে না মা। আর কিছু বলতে পারবো না।

ভালোবাসিস মেঘাকে?

রিশান তার মায়ের দিকে বিস্মিত নয়নে চেয়ে থাকলো। এরপর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

তো বলছিস না কেন?

সময় হলে বলবো।

কেন? মেঘা কি এখন ছোট নাকি? ও তো বড়ই হয়ে গেছে। ও যদি এই বাড়িতেই সারাজীবন থেকে যায় তাহলে মন্দ হবে না।

কিন্তু মা আমার না ভয় হয়।

কেন?

তুমি তো জানোই মা মেঘা কেমন। ও ভিতরের চাপা কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে না কখনো। আগে ওর সেই কষ্টগুলোর ভাগ নিয়ে নেই এরপর,

সেগুলো মনে করলে মেয়েটা একদম চুপ হয়ে যায়।

মা আমি তো ভালোবাসি সেই হাসিখুশি চঞ্চল স্বভাবের মেঘপরিকে।

মেঘাকে কষ্ট দিস না বাবা। দেখ না এতক্ষণে মনে হয় কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।

রিশান মুচকি হেসে বললো, আমি আসছি।

দরজায় কারো কড়াঘাত শুনে দরজা খুললাম। দরজা খুলে সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে খুব অভিমান হচ্ছে। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম।

অনেক রাগ করেছিস?

আমি কিছু বললাম না।

মেঘা,

নিশ্চুপ

কথা বলবি না? এই এদিকে ফিরে দেখ।

নিশ্চুপ,

কি হলো? কিছু বল,

নিশ্চুপ,

আচ্ছা যা আজকে মামাদের বাড়িতে যেতে দিবো। আমি তার দিকে ফিরে তাকালাম। রিশান ভাইয়া আমাকে যেতে দিবেন? সত্যি বলছেন উনি?

সত্যি যেতে দেবে?

উমম, হুম।

আমি খুশিতে আত্মহারা। ভাইয়া আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। আমার চোখ তা এড়ালো না কিন্তু এরপরও কিছু বললাম না। ভাইয়া হঠাৎ বললেন,

একদম দুষ্টুমি করবি না ওখানে গিয়ে। আর কোন ছেলেকে নিজের কাছে ভিড়তে দিবি না। সবসময় মায়ের আশেপাশে থাকবি। যদি উল্টো পাল্টা কিছু করেছিস তাহলে পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে দিবো। মাইন্ড ইট??

আমি ছোট করে বললাম, হুম।

ভাইয়া চলে গেলেন। আমি তো খুশিতে নাচতে শুরু করলাম। ভাইয়া আমাকে যেতে দিয়েছেন।

মেঘপরি! তুই হাসলে তোকে কতটা ভালো লাগে জানিস। আমাকে পাগল করে দিলি তুই। আমি কি বলতে পারবো ভালোবাসি তোকে? #তোর_নামেই_শুরু করতে পারবো নতুন পথ চলা? আমার হবি কি তুই?

চলবে………

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here