তোর মনপাড়ায় পর্ব ১৯

#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৯

— “ঈর্ষা মা। তুই কি এই বিয়েতে রাজি নস। দেখ মা; আমি তোর উপর কোনোদিন কোনোরুপ জোর করি নি, আর আজও জোর করবো না।” ( ঈর্ষার সামনে বসে শাহিনুজ্জামান)

ভয়ংকর চমকালো ঈর্ষা। সাহেল কে সে এখনো নিজের ভাইয়ের চোখে দেখে উঠতে পারেনি। সর্বদা ভার্সিটির প্রফেসর ভেবে এসেছে। আর এখন। মাথা ধরে উঠেছে তার।‌ রীতি শাহিনুজ্জামানকে শর্ত দিয়েছে, তার ছেলে সাহেলের সাথে ঈর্ষার বিয়ে দিলেই একমাত্র বাবা ছেলেকে আলাদা করবে না। তবে এটা সে, ঈর্ষার বাবার সম্পত্তির জন্য করছে, সেটা বুঝতে বাকি নেই ঈর্ষার। তবুও কিছু বলবো না সে। মাথা নিচু করে জবাব দিলো.

— “মামা আমাকে কিছুটা সময় দাও! আমি তোমাকে কালকে জানাচ্ছি।”

শাহিনুজ্জামান কিছুক্ষণ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইলো ঈর্ষার দিকে। কিছুটা অস্বাভাবিক কন্ঠে বলল.

— “ঈর্ষা তুই কি কাউকে ভালোবাসিস। যদি ভালোবাসিস সেটাও বল আমাকে? আমি কখনো চাইবো না; আমার মেয়েটা কষ্ট পাক।”

ঈর্ষারউত্তর দিলো না শাহিনুজ্জামানে কথার। শাহিনুজ্জামান ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে ঈর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দরজাটা বিড়িয়ে রেখে গেলেন। শাহিনুজ্জামান যেতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ঈর্ষা। কি করবে খুঁজে পেল না। নয়ন গ্ৰথণ করলেই চক্ষু দর্পনে সাদাফের সাথে কাটানো বিষয়ে দিনগুলোর কথা ভেসে উঠছে। সে চেয়েছিলো, অতি শ্রীঘ্রই সাদাফ কে তার মনের ভেতরে গচ্ছিত রাখা কথাগুলো বলে দিবে। বড্ড দোটানায় আটকে গেছে সে।
________________
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করতে করতে এগারোটা বত্রিশ ছাড়িয়েছে। রঙিন আলোয় সেজেছে ক্লাবের মধ্যখানটা। রং চং ঘেরা আলোয় ক্রমাগত নেচে চলেছে সাহেল। একান্ত নিরিবিলিতে সময় কাটাতে সাহেলের সাথে ঈর্ষাকে পাঠিয়েছে রীতি। ঈর্ষাও বাধ্য মেয়ের মতো সাহেলকে নিয়ে এসেছে।
ঈর্ষা এলোমেলো মনে এক কোণে বসে আছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে চৈত্রী, স্পৃহা, রবিন, মাহিন। চৈত্রী ঈর্ষাকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল.

— “দোস্ত গাধার মতো চুপ মেরে না থেকে, কি হয়েছে বলবি তো। হুট করে তোর মামাতো ভাই এলো কিভাবে। সে আরো কেউ নয়, আমাদের ভার্সিটির প্রোফেসর। হাউ ইজ প্রসেবল?”

মুখে হাত রেখে কেশে উঠলো ঈর্ষা। টেবিলের উপর থাকা সফ্ট ডিংঙ্কের গ্লাসটা হাতে তুলে নিল। অন্য মনষ্ক হয়ে চুমুক বসালো সেই গ্লাসে। চিবুকের সাথে ধাক্কা লেগে খানিকটা পড়ে গেল শার্টের উপর। দাঁড়িয়ে গেল ঈর্ষা। রুমাল দিয়ে মুছে নিল সেই অংশটুকু। পূর্নরায় ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল। নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে গেল চৈত্রী। গ্লাসটা ছুড়ে ফেলে দিল অদূরে। কাঁচের ভাঙার ঝনঝনানি শব্দ হলেও মিউজিকের সাথে স্পষ্ট শুনালো না। এবার বেশ চেঁচিয়ে বলল চৈত্রী..

— “আই সেইড, তোর মামাতো ভাই এখানে কি করছে??”
নতসুরে উত্তর দিলো ঈর্ষা।. — “ওর আমার মামাতো ভাই না। আমার উডবি!”

বিজলী খেয়ে গেল পরিবেশে। সবাই একই ধ্বনিতে মুখরিত করলো..– “ওয়াট! কিভাবে.

নয়ন যুগল ছলছলিয়ে উঠলো ঈর্ষার।উপরের অধর দিয়ে নিজের অধর চেপে কিছুক্ষণ লোচনের সাথে যুদ্ধ করলো। নিজেকে কোনোরকম সামলে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল.
— “জানি না। কিছুই জানি না আমি। আমি কি করবো কিছু জানি না। মামনি এসে হুট করে শর্ত দিলো, একমাত্র আমার সাথে সাহেলের বিয়ে হলেই তিনি মামার সাথে আবার সংসার করবেন। শুধুমাত্র আমার জন্য তাদের সংসারটা ভেঙ্গেছিলো। বুঝতে পারছিস তোরা! আমি বিয়েতে অমত করলে, মামা আবার একা হয়ে যাবে! যেই মানুষটা আমার সুখের জন্য নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়েছে আমি কিভাবে তাকে ফিরিয়ে দিবো। আ’ম হেল্প ল্যস।”

স্পৃহা এবং চৈত্রী ঈর্ষার পাশে বসলো।‌ দুজনে ঈর্ষাকে নিজের বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। দুজনের শান্তনায় নিজের সংযত করার বিপরীতে ফুঁপিয়ে উঠলো ঈর্ষা। কাঁদতে কাঁদতে বলল.

— “আমি! আমি সাদাফ-কে ভালোবাসি চৈত্রী। জানি না, কিভাবে সম্ভব হয়েছে। তবে হাজার কথার মাঝে এটাই সত্যি।”
আলতো হাতে ঈর্ষার চোখ মুছিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো দুজনে। কোমড়ে হাত রেখে বলল.

— “আজ এই উল্লুকের একদিন আর আমার যে কয়দিন লাগে।”

অস্ফুট স্বরে ঈর্ষা বলল.– “কি করবি তোরা।”

— “দেখতেই পাবি। আজ ওর ঘাড় থেকে বিয়ের ভুত নামাবো।”

সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে সাহেলের দিকে এগিয়ে গেল দু’জনে। ঈর্ষা টেবিলের উপর হাত রাখল। হাতের উপর চিবুক রেখে সামনে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। কি করতে চলেছে ওরা। বোঝার চেষ্টা করল। চৈত্রী আর স্পৃহা সাহেলকে দুদিক দিয়ে ঘিরে ধরলো। ডান্স করার তালে তালে সাহেল কে মেরে চলেছে। কখনো হাঁটুর উপর, কখনো পেটের উপর। সাহেল মাঝে মাঝে হাত রাখছে ব্যাথার্থ স্থানে। সাহেল আগে থেকেই ডিংঙ্ক করে ভুত হয়ে আছে। তারপর দুজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ক্লান্ত হয়ে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়লো মাঝখানে। এতো কিছু দেখার পর থেমে রইলো না ঈর্ষা। দৌড়ে গেল ওদের দিকে। দুজনের মাঝখানে থেকে সাহেলের পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো। সাহেল নিভু নিভু চোখে তাকালো ঈর্ষার দিকে। ঈর্ষা সেই দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে টেনে সাহেলকে উঠে বসালো। একহাত রাখলো নিজের কাঁধে। সাহেলকে ধরে উঠালো অতি সাবধানে। চৈত্রী আর স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলল.– “সেইম অনিয়ম দোস্। বেচারা অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে। এবার বাড়ি ফেরা যাক।”

চৈত্রী এগিয়ে এলো দুজনের দিকে। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল.– “তোর কি মনে হয়। একে এই অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে গেলে তুই আস্তো থাকবি? তারচেয়ে একটা কাজ কর, পাশের রুমে রেখে আয়। নেশা কেটে গেলে বাড়ি যাস।”

চৈত্রীর কথায় যুক্তি খুঁজে পেল ঈর্ষা। ক্লাব থেকে বেরিয়ে না গিয়ে উল্টো দিকে এগিয়ে গেল। আসার আগে রবিনকে লেবু রস নিয়ে আসতে বলেছে। ফাঁকা রুমে সাহেলকে শুইয়ে দিলো। তদানীং সেখানে এসে পৌঁছেছে রবিন। গ্লাসটা নিয়ে ধীরে ধীরে সাহেলকে খাইয়ে দিতে লাগল। আজ পর্যন্ত কোনো মুমুর্ষ রোগীর সেবা করে নি আর আজ তাকে নেশাক্ত ছেলের সেবা করতে হচ্ছে। পুরোটা খাইয়ে দিয়ে গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখলো সে। ফিরে আসার জন্য পা বাড়াতেই থেমে গেল সে। পেছনে সাহেল বমি করে পুরো শার্ট বিছানা ফেলেছে। বর্তমানে ইচ্ছে করছে তার, সাহেল কে এক লাথি দিয়ে ছুড়ে ফেলতে। সেই ভয়ংকর কাজটি সে করলো না। নাক চেপে সাহেলের দিকে এখানে গেল সে। হালকা ঝুঁকতেই সাহেল নিদ্রা ঘোরে তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। হাত দিয়ে দূরত্ব বজায় রাখলো দুজনের মাঝে। কিন্তু অসহায় একটা ছেলের থেকে নিজের ক্রমশ ছাড়াতে ব্যর্থ হলো ঈর্ষা। তখনই আবির্ভাব হলো সাদাফের। ঈর্ষাকে টেনে সাহেলের থেকে সরে নিয়ে এলো সে। কপাট রাগ দেখিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসালো ঈর্ষার সাথে। ঈর্ষা গিয়ে ঠেকলো দেয়ালের সাথে। গালে হাত রেখে দেয়াল ঠেসে নিচে বসে পড়লো সে। তাতেও শান্ত হলো না সাদাফ। কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো। দরজার অতিশয় দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো ঈর্ষার সঙ্গি সাথিরা। তীব্র আওয়াজে এগিয়ে আসলো তারা। ঈর্ষা আর সাদাফ কে এমন অবস্থায় দেখে ভেতরে এগিয়ে গেল তারা। ঈর্ষাকে টেনে বেডের উপর বসিয়ে দিল। সাদাফ ঈর্ষাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চেঁচিয়ে বলল.

— “কি এমন কমতি ছিল আমার ভেতরে বল! টাকা পয়সা, নাম প্রতিপত্তি সবই ছিলো। তাহলে কেন এতো নোংরা খেলায় মেতে উঠলি বল!( পরের কথাগুলো বের করুন শুনালো)
আমার কথা একবার ভাবলি না, তোর হাতটা কেউ ছুলে আমি সহ্য করতে পারি না। শরীরের প্রতিটি শিরা দাঁড়িয়ে যায়। আর এমন অবস্থায় দেখে আমি সহ্য করবো কিভাবে প্লীজ বল.

ঈর্ষা নিজের নয়নজোড়া সাদাফের নয়নে বন্দী করলো। ঈর্ষাকে হারানোর ভয় ভীতি প্রদর্শিত হচ্ছে সাদাফের চক্ষুজুড়ে। কিছু বলার উদ্দেশ্য অধর জোড়া নাড়ালো ঠিকই কিন্তু বাক্য ধ্বনি উচ্চারিত হলো না। সাদাফের চোখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু ভ্যানিশ হয়ে গেল। সাদাফ শুনলো না ঈর্ষার কথা। ধাক্কা দিয়ে ঈর্ষাকে সরিয়ে দিয়ে ধপাধপ পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল সে। হিতাহত জ্ঞান শূন্য হয়ে উঠলো ঈর্ষা। পরক্ষণেই ছুটলো সাদাফের পিছু পিছু। পেছনে ফিরে সকলের দিকে তাকিয়ে একটা কথা উচ্চারণ করল.

— “সাহেলকে তোরা বাড়িতে পৌঁছে দিস। আমার কথা জিজ্ঞাসা করলে বলবি, আমি এক জায়গায় গিয়েছি। আমি এবার আসছি.

(চলবে)

আগামী দুই পর্বেই সমাপ্তি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here