তোর মনপাড়ায় পর্ব ৩

#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৩

ভার্সিটিতে পা রাখতে কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে গেল ঈর্ষা। ঈর্ষাকে এমন পরিস্থিতির দেখে চারদিকে ভিড় জমে গেল। কাছে আসার মতো সাহস হলো না কারো।
বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো ঈর্ষা। যার সাথে ধাক্কা খেয়েছে, আজ নির্ঘাত তার কপালে শনি আছে। শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে সামনে তাকালে নিমিষেই রাগ উধাও হয়ে গেল। পনেরো বছর বয়সের একটা ছেলে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে আরো কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স সেইম হবে। হয়তো বন্ধু হবে। পড়ে যাওয়ার কেপটা তুলে মাথায় দিয়ে এগিয়ে গেল সে।
পিঠ চাপড়ে কৌতূহলী কন্ঠে বলল..

— “দেখে তো মনে হয়। এইট নাইনে পড়িস। ভার্সিটিতে কি করছিস?”

ছেলেটা একহাত দিয়ে অন্য হাত কচলাতে কচলাতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল..

— আসলে আমরা ভার্সিটির ভেতরটা দেখতে এসেছি।

ব্যাপার-টা সামান্য তম অদ্ভুত লাগল ঈর্ষার। ছেলেটার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল..

— রিলেক্স! এতো কাঁপা কাঁপি করছিস কেন? জিন্স খুলে পড়ে যাবে ব্রো।
ভার্সিটি আবার দেখার কি আছে?

ভাব নিয়ে চুলগুলো ঠেলে পেছনে দিলো। কলার টেনে ঠিক করে বলল..

— আমি আদাফ। সবে নাইনে উঠেছি। স্কুল শেষ করে কলেজে উঠবো। কলেজ শেষ হলে ভার্সিটি। এখনও সাড়ে তিন বছর লাগবে। তাই শখ পূরণ করতে এসেছিলাম। কিন্তু..

ঈর্ষা আদাফের স্টাইল দেখে একদফা ক্রাশ খেল। পিচ্চি একটা ছেলে ভাব কি? কাঁধে হাত রেখে সামনে ভার্সিটিতে ভেতরে এগিয়ে গেল। চোখ দিয়ে আদাফের বন্ধুদের ভেতরে আসার জন্য ইশারা করলো। হাঁটতে হাঁটতে বলল..– কিন্তু কি ব্রো।

— এই ভার্সিটির সিনিয়র ছেলেরা ভেতরে যেতে বারণ করেছে। তাই ফিরে যাচ্ছি।(মন খারাপ করে বলল আদাফ)

ক্যাম্পাসের মাঝে আদাফ আর তার বন্ধুদের বসতে দিল। ইর্ষাকে দেখে এগিয়ে এলো সবাই। ঈর্ষা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল..

— দেখ তো ওদের ভার্সিটি থেকে ফিরে যেতে বলেছে কে?

ভুতুড়ে ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মাহিন। মাহিনের এমন ভঙ্গিমা কিছুতেই পছন্দ হলো না ঈর্ষার। এগিয়ে গিয়ে পাশের চেয়ারে বসে বলল.

— দুদিন পর নবীন বরণ অনুষ্ঠান। ভার্সিটির ভেতরে সকলে কাজে ব্যস্ত। পান থেকে চুন খসলেই ওদের নাম দিবে‌। তাই আমি ওদের যেতে বলেছে।

ভ্রু কুঁচকে মাহিনের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল ঈর্ষা। গ্লাসে পানি ঢেলে আদাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলল.

— শুনতেই তো পেলে ব্রো; কেন তোমাকে ভার্সিটির থেকে যেতে বলেছে?
সমস্যা নেই সামনে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে তুমি এসো। শুধু তুমি নয়, তোমার পুরো পরিবার নিয়ে এসো। আমি তোমাকে ভার্সিটি ঘুড়ে দেখাবো। কেমন।

রহস্যময়ী হাসি ফুটে উঠল আদাফের মুখে। যে হাসির মানে বুঝতে ব্যর্থ হলো সকলে। আদাফ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঈর্ষাকে হাক করল। গাল ধরে দুগালে চুমু খেল। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে আদাফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ঈর্ষা। মিষ্টি করে বাই বলে চলে গেল আদাফ।

আশে পাশে তাকিয়ে রবিনের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নিল ঈর্ষা। আসে নি। রবিনের মায়ের খোঁজ নেওয়াও হয়নি। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বলল..

— রবিনের মায়ের কোনো খবর জানিস তোরা।

সকলের নত ভঙ্গিতে ইশারা করতেই নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো ঈর্ষা। ব্রেসলেট বিহীন হাতটা কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখল। আজ ব্রেসলেটের জয়গায় সিলভার রঙের ঘড়ি পড়েছে। সবাই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে, আজ প্রথমবার ব্রেসলেট বিহীন এসেছে ঈর্ষা। চৈত্রী এগিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল..

— প্রাণের চেয়ে প্রিয় ব্রেসলেট-টা কোথায় তোর।

— কাল রাত থেকে পাচ্ছি না। হয়তো কোথায় একটা পড়ে গেছে। ভালোই হয়েছে ব্রেসলেটের বোঝা টানতে টানতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।

ঈর্ষার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। বাবার দেওয়া ছোট গ্ৰিফ্টটা কখনো চোখের আড়াল করেনি। আর আজ প্রিয় জিনিস টা হারিয়ে গেছে। তাতে বিন্দুমাত্র অনুসূচনা হচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মলিন কন্ঠে বলল..

— এখানে দাড়িয়ে না থেকে হসপিটালে চল।

________________________
স্কুটিতে উঠে চলে যেতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আদাফ ও তার বন্ধুরা। দূর থেকে ঈর্ষার দিকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে নজর কাড়ল সে। আদাফের এমন পাগলামী দেখে কনুই দিয়ে গুঁতো দিল অর্ক। হালকা ধমকে বলল..

— তোর মাথা ঠিক আছে আদাফ। তোর কর্ম কান্ড সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

স্কুটিটা চোখের আড়াল হতেই অর্কের দিয়ে তাকিয়ে বলল.

— আজ থেকে ঈর্ষা তোদের গার্লফ্রেন্ড আর আমার ভাবী। সরি বলতে চাইছি আমার ভাবী। ধ্যাত; তোদের ভাবী অর্থাৎ আমার গার্লফ্রেন্ড। সো সকলে সম্মান দিয়ে কথা বলবি।

ভেংচি কাটলো সাদিব। সাইকেলে চড়ে বসে বলল..

— মিষ্টি করে একটা কথা বললো আর অমনি তুই গলে গেছিস। বয়সের পার্থক্য দেখেছিস, মিনিমাম তোর ছয় বছরের বড় হবে।

কাঁধ থেকে স্কুল ব্যাগ নামিয়ে সাইকেলের সামনে রেখে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল

— সিনিয়রদের বিয়ে করলে, আদর ভালবাসা একটু বেশিই পাওয়ার যায়। তাছাড়া তুই আজব প্রেমের গল্প ফ্লিমটা দেখিস নি। শ্রাবন্তী পাঁচ বছরের বড়। আমাদের নাহয় ছয় বছর। আমি মেনেজ করে নিব।

— তোর বাবা মা মেনে নিবে তো‌। মানে তোর ভাই যা ডেন্জারাজ।

সাইকেল থামিয়ে সাদিবে কান ধরে টেনে দিল আদাফ। রাগী গলায় বলল

— বিয়েটা আমি করছি, ভাইয়া না। ভাইয়া মেনে নিলে নেবে, না-নিলে নেই। তাই বলে কি, ঈর্ষাকে ভাইয়ার সাথে শেয়ার করব।

— ভাই তোর যায় ইচ্ছে করিস। আপাতত চল।

___________________
রবিনকে কাঁদতে দেখে ভড়কে গেল সকলে। রবিনের পাশের চেয়ারে বসে কাঁধে হাত রাখলো। মৃদু হেসে অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে বলল..

— দোস্ত কাঁদছিস কেন? আন্টি খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে। তখন যদি দেখে তার ছেলে বাচ্চাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে; তিনি কষ্ট পাবে না।

কান্না থামার বদলে আরো কয়েকগুন বেড়ে গেল। দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বলল..

— ডাঃ নিহাল আমার মাকে ভুল মেডিসিন দিয়েছে। মায়ের কোনো সেন্স নেই। ডাক্তাররা ভেতরে মাকে দেখছে।

মুহুর্তের ঈর্ষার চোখজোড়া টকটকে লাল হয়ে গেছে।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল — ডাক্তার কোথায়?

— উনি চেম্বারের ভেতরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। কতোবার নক করলাম খুললো না। বাধ্য হয়ে অন্য ডাক্তাররা দেখছে।

ঈর্ষা কিছু না বলে চেয়ারটা হাতে তুলে নিল। চপল পা ফেলে ডাঃ নিহালের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেল। হসপিটালের সবাই কটু চোখে ঈর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈর্ষার বন্ধুরা সবাই ঈর্ষার পেছনে পেছনে ছুটল। আজ নির্ঘাত এই চেয়ার ডাক্তারের পিঠে ভাঙবে।

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ক্রমাগত দরজায় নক করে চলেছে ঈর্ষা। কিন্তু ভেতর থেকে খোলার না নেই। প্রচন্ড রাগে সর্বশক্তি দিয়ে দরজায় আঘাত করলো। চেঁচিয়ে বলল..

— ভালোয় ভালোয় দরজা খুলে বেরিয়ে আসুন। রবিনের মাকে সুস্থ করার ব্যবস্থা নিন। যদি আমার দরজা ভাঙতে হয়, তাহলে আপনার হাড় গোঢ় একটা আস্ত থাকবে না।

ভেতরে থেকেই কোনো আওয়াজ এলো না। হাতের ইশারায় সকলকে দরজা ধাক্কাতে বাঁধা দিল ঈর্ষা।

— এর জন্য অন্য ব্যবস্থা আছে। যখন নক করব, চেয়ারটা দিবি। আজ চেয়ারটা ওর পিঠে ভাঙব। খেয়াল রাখিস কেউ যেন ভেতরে যেতে না পারে!

কারো উত্তরের অপেক্ষা না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ঈর্ষা। যন্ত্রপাতি নিয়ে হসপিটালের পাইপ বেয়ে ডাঃ নেহারের চেম্বারের জানালার কাছে পৌঁছালো। গ্ৰিলের নাট খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। ডাঃ নিহাল তখন হেড-ফোনে গান শুনছে। নিঃশব্দে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে হাত এগিয়ে দিল। চৈত্রী চেয়ারটা এগিয়ে দিল ঈর্ষার হাতে। ঈর্ষা চেয়ার ভেতরে নিয়ে বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। বিকট শব্দে ধরফর করে উঠে দাড়ালো ডাক্তার। অসাবধানতায় হাত থেকে ছিটকে মুঠোফোন আর হেড ফোন নিচে পড়ে গেল।
.
থার্ড ফ্লোরের পাশ দিয়ে শান্ত মনে হেঁটে চলেছে সাদাফ। টানা চার ঘণ্টা পেসেন্ট দেখতে দেখতে হাঁফিয়ে উঠেছে সে। কোমড়েও ব্যথা অনুভব করছে। তাই হালকা হাঁটতে বেরিয়েছে। হাঁটার মাঝে কানে ভেসে এলো হট্টগোল আর কিছু মানুষের কন্ঠস্বর। পাশে তাকাতেই দেখতে পেল কিছু মানুষ জন ডাঃ নিহালের চেম্বারের সামনে ভিড় করেছে। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই চেম্বারের ভেতর থেকে উরুম ধুরুম আওয়াজ ভেসে এলো তার কানে। সকলে কানা খুসরা শুনে বুঝতে পারল ভেতরে কেউ ডাঃ নিহালকে মারছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here