#দখিনের_জানলা (পর্ব-১৩)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
২৬.
চমচমের এইচএসসি পরীক্ষ চলছে। পরীক্ষা শুরুর চারদিন আগেই সায়ন পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছিল। চমচমেরও ইংরেজীর দুর্বলতা কে’টে গিয়েছিল। সায়নের প্রতি চমচমের বাবা-মা খুব কৃতজ্ঞ। অল্প কয়েকদিনের জন্য ছুটি কাটাতে ছেলেটা দেশে এসেছিল তারপরও চমচমকে সময় দিয়ে পড়িয়েছে প্রতিদিন। চমচমের পরীক্ষা শুরুর এক সপ্তাহ পর সায়ন বিদেশে চলে গিয়েছে আবার। তবে তার আগে একদিন সায়নের পরিবারের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায় চমচমরা। আব্রাহামদেরও বলা হয়েছিল কিন্তু তারা সেদিন তাদের গ্রামের বাড়ি যাবে বলে আসেনি।
নিগার খানম চমচমের বাবার উপর ক্ষি’প্ত। সায়নকে না ডেকে তার ছেলেটাকে কেন ডাকল না চমচমকে পড়ানোর জন্য এটা ভেবেই সে রা’গ। চমচমের বাবা-মাও সেটা বুঝতে পেরেছেন। চমচমের মায়ের ব্যাপারটায় খা’রা’প লাগলেও চমচমের বাবা পাত্তা দিল না। তার মেয়েকে সে কার কাছে পড়তে দিবে সেটা তার ব্যাপার। কে রা’গ করল নাকি গোসা করল সেটা নিয়ে তিনি ভাবছেন না।
চমচমের পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগেই খবর আসে আব্রাহামেরও রেজাল্ট বের হয়ে গিয়েছে এর মধ্যে। সে খুবই ভালো করেছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপের আবেদনও করে রেখেছে।
চমচমের পরীক্ষা শেষ হলো তার আটদিন পর। পরীক্ষা শেষ হতেই সে মু’ক্ত, স্বাধীন পাখির মতো অলি গলি ঘুরে বেড়ানো শুরু করল। একদিন নিজের সাইকেলটা নিয়ে বের হয় বিকেলে। বহুদিন তার সাইকেল চালানোর মুড ছিল না। হুট করেই ইচ্ছে করল সাইকেলটা নিয়ে ছুটতে। সে প্রথমেই তাদের খেলার মাঠের দিকে গেল। বাম্পা আর চয়ন জানালো আজকে ক্রিকেট খেলবে। যদিও চমচম খেলবে না তারপরও গেল।
মাঠে তেমন কেউ নেই। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলোকেই দেখা যাচ্ছে। চমচম সাইকেল নিয়ে যেতেই বাম্পা বলল,
-‘তোমার সাইকেল না ন’ষ্ট?’
-‘না। ভালোই তো।’
-‘এতদিন যে তবে চালাওনি?’
-‘এমনিতেই। মন চায়নি। তোরা কি করছিস?’
-‘ভেবেছিলাম ক্রিকেট খেলব। কিন্তু কারো এখন আর ভালো লাগছে না।’
-‘ওহ! তো কি করবি?’
-‘জানিনা, সবাই বসে আড্ডা দিব ভাবছি। তুমিও চলো।’
-‘না না। এখন কোথাও বসব না। তোরা গল্প কর।’
চমচম সাইকেল ঘুরিয়ে চলে আসতেই রাস্তায় দেখা হলো সাদের সাথে। চমচমকে দেখে সে মিষ্টি করে হাসল। চমচমও একটু হাসে।
-‘কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?’
-‘মেডিকেলে!’
-‘এখন?’
-‘হ্যাঁ! একটু দরকার পড়েছে।’
-‘আপনি কি এখন অপারেশন করেন নাকি?’
সাদ হেসে বলল,
-‘আরে না না! সেসব কিছু না। আমি সবে মাত্র ইন্টার্ন করছি। সিনিয়র ডাক্তারদের সাথে সাথে থাকি। টুকটাক শিখছি। এখনও পুরোপুরি সবকিছু বুঝতে মাসকয়েক লেগে যাবে।’
সাদকে বিদায় দিয়ে চমচম ভাবল তেঁতুলতলা থেকে ঘুরে আসবে। যদিও জায়গাটা একটু নির্জন! অনেকে বলে ভূ’ত আছে। সে সেসবে পাত্তা দেয় না। কত ঘুরেছে! কখনো কিছুই হয়নি। আজও সেদিকে গেল। যাওয়ার সময় মুদি দোকানদার রফিক সাহেবের সাথে দেখা হলো তার। তিনি চমচমকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,
-‘কোথায় যাইতেছেন আম্মা?’
-‘তেঁতুলতলা চাচা!’
কথাটা শুনেই রফিক সাহেবের মুখের রঙ বদলে গেল। বলল,
-‘না না। যাইবেন না এখন। এই সময় ভালো ন। মানুষ জনও নাই। তাছাড়া আইজকা ঝড় উঠব। এখন বাড়ির দিকে যান আম্মা।’
চমচম আকাশের দিকে তাকালো। একটু মেঘলা মেঘলা লাগছে। তারপরেও সে হেসে বলল,
-‘কিছু হবে না। আমি এই যাব আর আসব!’
রফিক সাহেবকে আর কিছু বলতে না দিয়ে এক ছুটে চলে গেল সে সেইদিকে। তেঁতুল তলার রাস্তাটা অসম্ভব সুন্দর। রাস্তার দুই দিকে সাড়িবদ্ধ ভাবে কয়েকটা তেঁতুল গাছ সহ আরো নানান প্রজাতির গাছ আছে। সংখ্যায় যেহেতু তেঁতুল গাছ বেশি তাই সবাই তেঁতুল তলা নামটাই দিয়েছে জায়গাটার। সাইকেল চালাতে খুব মজা পাওয়া যায়। কি সুন্দর বাতাস এসে চুল উড়িয়ে দেয়। চমচমের তখন গুনগুনিয়ে গান গাইতে ভালো লাগে।
চমচম যখন রাস্তার একদম মাঝপথে চলে এলো তখনই বাতাসের গতি বেড়ে গেল। চারিদিকে তীব্র বাতাসে সব ল’ন্ডভ’ন্ড হয়ে যাবে এমন অবস্থা শুরু হলো। গাছের ছোট, ঝরঝরে ডালগুলো ভেঙে পড়তে লাগল। বালু উড়তে লাগল। চমচম বুঝতে পারল ঝড় উঠবে। সে দ্রুত সাইকেল ঘুরিয়ে নিল। উফ! চোখ মেলেও তাকাতে পারছে না ঠিক মতো। কোনো মতে কিছুটা এগিয়ে আসতেই তার চোখের পাতায় টুপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ল। সে আরো দ্রুত সাইকেল চালাতে থাকল, তন্মধ্যে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কোনো রকমে চমচম তেঁতুল তলা পেরিয়ে আসল। তবে সে কিছুটা ভিজে গেছে। তেঁতুল তলার রাস্তাটায় গাছ গাছালি বেশি থাকায় সরাসরি বৃষ্টির পানি কম পড়েছে তার গায়ে। এদিকে মেঘ ডাকছে শব্দ করে। আর এই একটা জিনিসই চমচমের মন ভ’য় আনতে সক্ষম। মেঘ ডাকলে, বা’জ পড়লে চমচম সবচেয়ে বেশি ভ’য় পায়। চমচম এই মেঘ গুড়মুড় করা পরিবেশে সাইকেল চালানোর আর শক্তি পেল না। সে দ্রুত মনিরের চায়ের দোকানের সামনে সাইকেল থামিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। যদিও জায়গাটা ছোট। বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগছে তারপরেও সে দাঁড়ালো। মনির চা তৈরি করছিল। চমচমকে দেখে বলল,
-‘আপু আপনে নাকি তেঁতুলতলায় গেছিলেন?’
চমচম ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বলল,
-‘তোমাকে কে বলল মনির ভাই?’
-‘খবর তো পাড়া ছড়াইছে। রফিক কাকা নাকি দেখছে যাইতে। শুইনা তো আপনার আব্বা তো খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিসে। এর মইধ্যে শুরু হইল বিষ্টি। আয়মান ভাই আর আপনার আব্বা বাসায় গেছে গাড়ি নিয়ে বাইর হওয়ার জন্য। আব্রাহাম ভাই তো এখানে আছে ওইতো ভেতরে বসছে। চা খায়।’
চমচম উঁকি দিল ভেতরের দিকে। আব্রাহাম, ইমরান, মাহমুদ সহ অনেকে বসে আছে। চমচমকে উঁকি দিতে ইমরান দেখে ফেলল। তারপর বলে উঠল,
-‘ওই তো চমচম!’
আব্রাহাম চমকে উঠে সামনে তাকিয়ে দেখল চমচম দাঁড়িয়ে আছে। সে টুল থেকে উঠে এসে চমচমের পাশাপাশি দাঁড়ালো। চমচমকে একটা ঠা’স করে চ’ড় লাগাতে পারলে তার ভালো লাগত বোধ হয়। রা’গে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। চমচম এমন অবস্থা দেখে একটু হাসল। আব্রাহাম তার মুখের দিকে তাকিয়েই পকেট থেকে ফোন বের করল। তারপর আয়মানকে কল দিল।
২৭.
চায়ের কাপ হাতে নিতেই চমচমের মুখে হাসি ফুঁটে ওঠে। কয়েকবার ফু দিয়ে চুমুক দেয়। তারপর মন জুড়ানো স্বাদের চা খেয়ে তার মুখের হাসি আগের চেয়ে আরেকটু প্রশস্ত হয়। আব্রাহাম এখনও রা’গী চোখে চমচমকে দেখছে। বলা চলে দীর্ঘ দুই মাস পর তার চমচমের সাথে দেখা হয়েছে। এতদিন কোনো দেখা, সাক্ষাৎ হয়নি। সেই যে রা’গ করে চমচমদের বাসা থেকে ফিরেছিল আর সেই মুখো হয়নি সে। এক সপ্তাহ পরই বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার, রাঙামাটি তারপর দেশ এর বাহিরে কাশ্মীর পর্যন্ত ট্যুর দিয়ে এসেছে। বাসায় থাকলেও যখন তখন বের হতো না। বের হলেও মেইন রোডের দিকে গিয়ে আড্ডা দিতো। সে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে চমচমকে এড়িয়ে যাওয়ার। কিন্তু আজ যখন শুনল চমচমকে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর কিছুটা খোঁজাখুঁজির পর আবার রফিক সাহেব যখন বলল যে চমচম তেঁতুলতলায় গেছে তখন তো শুনে সে রীতিমত দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। বাহিরের এত ঝড় বৃষ্টিতে সে কোথায় কীভাবে আছে এই ভেবেই সে পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছিল। চমচমের বাবা যেমন মেয়ের চিন্তায় অ’স্থি’র হয়ে উঠছিল, তেমনিই সেও ব্যাকুল হয়েছিল চমচমের জন্য। তাই তো সব রা’গ, অভি’মান ভুলে সে আয়মান আর চমচমের বাবার সাথে বের হলো।
আয়মানকে আব্রাহাম কল করে বলে দিয়েছে চমচমকে পাওয়া গেছে। তাই তারা তাদের দোকানে অপেক্ষা করতে বলেছে। গাড়ি নিয়ে আসছে। এই ফাঁকে চমচম চায়ের অর্ডার দিয়ে দিল।
চা খাওয়ার এক পর্যায়ে বি’ক’ট শব্দে মেঘের গ’র্জ’ন শোনা গেল সেই সাথে আকাশে বড় ফাটল ধরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। চমচম ভ’য়ে কেঁ’পে উঠে আব্রাহামের হাত ধরে ফেলল। আব্রাহাম বিস্মিত হয়ে একবার চমচমের দিকে তাকালো আরেকবার আকাশের দিকে তাকালো। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সে মুঁচকি হাসল। চমচম বলল,
-‘উফ! খুব ভ’য়’ঙ্ক’র ছিল। জানো! আমি না অনেক ভ’য় পাই এসবে।’
-‘তুই ভ’য় পাস?’
আব্রাহামের কন্ঠে কৌতূক মেশানো ছিল। চমচম বলল,
-‘তো! পেতে পারি না?’
-‘না না! পারিস। কিন্তু যে মেয়ে একা একা তেঁতুলতলায় ঘুরতে যায় সেই মেয়ে মেঘের গ’র্জ’নে ভ’য় পায়?’
চমচম বি’র’ক্ত হয়ে বলল,
-‘তোমরা শুধু শুধু তেঁতুলতলা ভ’য় পাও। জায়গাটা কত সুন্দর। সুন্দর পাকা রাস্তা, দুই পাশে গাছ গাছালি, মৃদু ম’ন্দ বাতাস। একটা শান্তি এনে দেয় মনের মধ্যে।’
-‘তো ওইখানেই থাকতি।’
চমচম আব্রাহামের দিকে রা’গী দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
-‘হ্যাঁ থাকব। একটা ঘর বানিয়ে দাও আমাকে ওইখানে। ঘর ছাড়া তো আর রাস্তায় থাকা যায় না।’
-‘আমার তো আর কাজ নেই তোকে ঘর বানিয়ে দিব!’
-‘সে তো আমি জানি। কিন্তু কাজ না, অকাদ ই নেই তোমার ঘর বাড়ি তৈরি করার।’
-‘কি বললি?’
-‘অকাদ! যোগ্যতা।’
-‘আমার যোগ্যতা নেই ঘরবাড়ি তৈরি করার?’
-‘না।’
আব্রাহামের ইচ্ছে করছিল এবার সত্যিই একটা ঠা’স করে লাগিয়ে দিতে চমচমের গালে। বহু ক’ষ্টে নিজের ইচ্ছেটাকে আ’ট’কে রেখে বলল,
-‘আমার যোগ্যতা সম্পর্কে তোর কোনো আইডিয়া নেই।’
-‘আমার তো খাই দাই কাজ নেই তোমার যোগ্যতা নিয়ে আইডিয়া রাখার। ফুট!’
-‘চমচম!’
চমচম ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে চা টা শেষ করল। ততক্ষণে আয়মান গাড়ি নিয়ে এসে পড়ে। চমচমকে গাড়িতে উঠতে বলতেই সে বলল,
-‘আমার সাইকেলের কি হবে?’
-‘ওটা থাকুক। পরে নেওয়া যাবে।’
-‘না না, সাইকেল ছাড়া যাব না। কেউ যদি চু’রি করে।’
-‘আরে এখানে সবাই চেনা জানা কে নিবে?’
-‘কেউ না কেউ নিয়ে দৌঁড় মা’রবে যখন তখন তোমার খ’ব’র করে দিব আমি!’
-‘আচ্ছা, তবে আমি নেমে যাই। বৃষ্টি থামলে তোর সাইকেল নিয়ে ফিরব।’
আয়মান নামতে নিলেই আব্রাহাম বলল,
-‘তুই ওকে নিয়ে যা। আমি সাইকেল নিয়ে যাব যাওয়ার সময়।’
-‘আচ্ছা। এই চমচম, এবার ওঠ!’
চমচম কথা বাড়ায় না। গাড়িতে উঠে পড়ে তাড়াতাড়ি। গাড়িটা চলে যাওয়ার পর আব্রাহাম কিছুক্ষণ সেদিকেই চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর চমচমের আর তার খাওয়া চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে সে বৃষ্টির মধ্যেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
#চলবে।
(এরপরের পর্বগুলোতে অনেক কিছু বদলে যাবে। পাঠক প্রস্তুত?)