#দখিনের_জানলা (পর্ব-১৪)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
২৮.
মাঝে কে’টে গেছে অনেকগুলো দিন। চমচমের এইচএসসির রেজাল্ট বের হয়, সে এ+ পায়নি তবে জিপিএ ৪.৯৪ পেয়েছে। একটুর জন্যই হাত ফসকে গেছে তার জিপিএ পাঁচ! বাবা-মা সহ পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবারই এটা নিয়ে আফসোস। আফসোস নেই চমচমের। রেজাল্টটা তার আশা অনুযায়ী বেশ ভালোই হয়েছে। পাবলিকে পরীক্ষা দেওয়ার মতো পয়েন্ট তো আছেই! ভর্তি পরীক্ষায় দেখা গেল চমচমের ঢাকা কোথাও হয়নি। সৌভাগ্য নাকি দু’র্ভাগ্য জানা নেই তবে তার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হলো। কিন্তু সে নিজেই বাসা ছেড়ে দূরে যাবে না। তার পরিবারও তাকে দূরে পাঠাবে না। তাই ঠিক করল প্রাইভেটেই ভর্তি করিয়ে দিবে। সেই আশাতেই এখন চমচম দিন গুনছে।
আজকে অনামিকাকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসবে। সকাল থেকেই আব্রাহামদের বাড়িতে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। এটা সেটা কাজে আব্রাহাম অতিষ্ট হয়ে উঠছে। এখনও বিয়েই ঠিক হলো না কিন্তু তার পরিবার এখন থেকেই জামাই আদরের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। রা’গ, বি’র’ক্তি দুটো মিলিয়ে তার এখন যাচ্ছে তাই অবস্থা।
চমচম এলো দুপুরে। নিগার খানমই বলেছিল আসতে। চমচম এসে অনামিকার রুমেই গেল। অনামিকা পায়ে আলতা লাগানোয় মত্ত ছিল। চমচম দেখল অনামিকা মনের সুখে গুনগুনিয়ে গানও গাইছে। আচ্ছা? অনামিকা কি আজকে খুব খুশি? বিয়ে হবে বলে তার মন কেমন করছে না? চমচম যত বিয়ের কনে দেখেছে এ যাবৎ কালে সকলকেই দুঃখী ভাব করতে দেখেছিল। কেউই বিয়ে করতে আগ্রহী ছিল না। যাক ভালো! অনামিকা যত খুশি থাকবে বিয়েতে ততো বেশি মজা হবে।
চমচম ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। একটু আগেই সোফায় একটু আলতা ছিটকে পড়েছিল। কালো সোফা হওয়াতে সেই আলতা দেখা গেল না। আর চমচমও দেখে বসল না। ফল শ্রুতিতে তার সাদা জাম্পস্যুটটায় আলতা লেপ্টে গেল। তারপরেও সেদিকে তার খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ অনামিকার সাথে বকবক করে সে রুম থেকে বের হয়ে গেল। অনামিকাও গভীর মনোযোগে আলতা লাগানোয় ব্যস্ত থাকায় চমচমের জামার দিকে খেয়াল করল না।
রুম থেকে বের হতেই চমচমের আব্রাহামের সাথে দেখা। চমচমকে দেখে সে এক মুহূর্তের জন্য একটু থামল। চমচমও আব্রাহাম দাঁড়িয়ে পড়ায় নিজেও হাঁটা থামায়। হেসে বলল,
-‘কি খবর হাম ভাই? সুইডেন যাচ্ছো কবে?’
আব্রাহাম স্কলারশিপ পেয়ে গেছে। অতি শীঘ্রই সুইডেন চলে যাবে। চমচম যখন জানতে পারল তখন বলল,
-‘এত পড়েও পড়া শেষ করতে পারো নাই? এখন আবার বিদেশে পড়তে যাবা? তুমি তো ডাহা আহাম্মক হাম ভাইয়া! ওইদিকে সাদ ভাইয়া এখন ডাক্তার হয়ে গেছে। তোমরা এক ব্যাচ ছিল না?’
আব্রাহাম সেদিন মুখ বুজে চমচমের কথাগুলো হজম করেছিল। এরপর থেকেই দেখা হলে চমচম বারবার বলে ‘সুইডেন কবে যাচ্ছো?’। আব্রাহাম চলে গেলেই যেন সে শান্তি পায়! আসলেই চমচম শান্তি পায়। এই যে কয়েক মাস টানা জানলাটা যখন তখন খুলতে পারছে না এই ক’ষ্টেই তো সে পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন রাতের বারোটায় ঘরের বাতি নিভিয়ে জানলাটা নিঃশব্দে খুলে চমচম দখিনা বাতাস উপভোগ করে। কত লু’কি’য়ে চু’রি’য়ে কাজটা করতে হয় তাকে! অথচ আগে তো মর্জি মতো ধুম ধাম শব্দ তুলে যখন তখন জানলা খুলে দিতো। শখ করে একটা ঝুনঝুনি লাগিয়েছিল সেই ঝুনঝুনিটাও এখন খুলে ফেলতে হয়েছে। এই এত এত ক’ষ্ট আর রা’গ তার কাছে ফিকে হয়ে যাবে যেদিন আব্রাহাম দেশ ছাড়বে সেদিন। তাই তো বারবার জিজ্ঞেস করছে কবে যাবে?
আজও এই কবে যাবে এর উত্তরটা আব্রাহাম দিল না। চমচমও জবাবের আশায় দাঁড়িয়ে না থেকে হেসে নিচে সিঁড়ি বেয়ে নামছিল আব্রাহাম হঠাৎ করেই চমচমের দিকে তাকিয়ে বিষম খেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ডাক দিল,
-‘চমচম দাঁড়া!’
চমচম দাঁড়িয়ে আব্রাহামের দিকে মুখ ফেরাতেই সে বলে উঠল,
-‘এদিকে তাকানোর দরকার নেই। যেভাবে আছিস সেভাবেই থাক!’
আব্রাহামের হাতের কাছে কিছু ছিল না। কি করবে বুঝতে পারছিল না। এই মেয়েটা কি পা’গ’ল? এতটা কান্ড জ্ঞানহীন হয় কেউ? নিচে কতগুলো বাহিরের মানুষ আছে! এখন যদি কেউ দেখে ফেলে? তাছাড়া মেয়েটা কি টের পাচ্ছে না? সে দৌঁড়ে গিয়ে চমচমের পেছনে দাঁড়ালো একদম গা ঘেসে। চমচম চমকে উঠে বলল,
-‘কি করছ?’
-‘তুই এক্ষুণি অনামিকার রুমে যাবি।’
-‘কেন?’
-‘কেন মানে! তোর দরকার আছে!’
-‘নেই দরকার। মাত্রই তো এলাম সেখান থেকে।’
-‘আমি বলছি তো তোর দরকার আছে!’
-‘আশ্চর্য! তুমি বললেই হলো?’
-‘চমচম তোর ভালোর জন্যই বলছি।’
-‘কচুর ভালোর জন্য বলছ।’
চমচম সিঁড়ি বেয়ে নামতে নিলেই আব্রাহাম তার হাত টে’নে ধরে। চমচমকে টা’নতে টা’নতেই উপরে অনামিকার রুমের সামনে নিয়ে আসে। চমচম হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
-‘তোমার সমস্যা কোথায়? সবসময় তুমি আমাকে জ্বা’লা’তন করো। তুমি একটু শান্তিতে থাকতে দিবে না আমাকে?’
আব্রাহামের রা’গ তখন নাকের ডগায় চলে আসে। অনামিকা চমচমের উঁচু স্বরের কথা শুনে দৌঁড়ে এসে দেখে তার ভাইয়ের সাথে ঝ’গ’ড়া করছে চমচম। সে বলল,
-‘কি হয়েছে?’
আব্রাহাম কিছু বলল না। চমচমও জবাব না দিয়ে চলে যেতে নিলেই অনামিকাও খেয়াল করল। সে ডাক দিল,
-‘চমচম দাঁড়া!’
চমচম দাঁড়ালো। আব্রাহাম তখন নিজের রুমের দিকে চলে যাচ্ছিল। অনামিকা ফিসফিস করে বলতেই চমচম চট করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দেখল। সে সাথে সাথেই বুঝে গেল আলতা লেগে এই অবস্থা হয়েছে। সে অনামিকার সাথে রা’গারা’গি করে অনামিকার নামাযের হিজাবটা পরে নিজের বাসায় চলে গেল।
২৯.
অনামিকাকে বিকেলে দেখতে আসে পাত্রপক্ষ। দেখে পছন্দও করে। দুই পরিবারই সম্মতি প্রকাশ করে বিয়ের জন্য। রাতে চমচমের পরিবারকেও ডাকেন নিগার খানম। তিনি আজকে চমচমকে আব্রাহামের জন্য চাইবেন। আব্রাহামটা বিদেশ চলে যাচ্ছে। আবার কবে আসে ঠিক নেই। চমচমের সাথে আকদটা করিয়ে রাখতে চান তিনি। চমচমের মাও ব্যাপারটায় সায় দিয়েছেন। এখন পুরুষরা কথা বলবে। তারপর যা ঠিক করার করবেন।
চমচম আসতে চায়নি কিন্তু চিনিও এসেছে। তাই আর না এসে পারেনি। অনামিকার হিজাবটাও সাথে নিয়ে এসেছে। চমচম আসার পর হিজাবটা দিতে গিয়েছিল। কিন্তু গিয়ে দেখে অনামিকা কাবার্ডের উপর কিছু রাখার চেষ্টা করছে। চমচম বলল,
-‘কি করছ?’
-‘একটা জিনিস রাখব। কাঁচের তো। নিচে থাকলে ভেঙে যাব। কাল থেকে মেহমান আসা শুরু করব। পিচ্চি পাচ্চা গুলোর উপর তো ভরসা নেই। কখন কি ঘটিয়ে ফেলে!’
চমচম বলল,
-‘আচ্ছা আমি রাখছি। দাও!’
চমচম ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলটা টে’নে এনে অনামিকার হাতের বক্সটা উপরে তুলে রাখল। অনামিকার শান্তি হচ্ছিল না, সে বলল,
-‘ঠিক ভাবে রেখেছিস?’
-‘হ্যাঁ।’
তারপরও সে ভরসা পাচ্ছিল না। চমচমকে নামতে বলে নিজে টুলে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। বক্সটা একটু ভেতরে ঠেলে দেওয়াতে প্রথমেই নজরে আসেনি। তাই সে লাফিয়ে দেখতে গিয়ে ধরাম করে কাবার্ডের কোণার সাথে বাড়ি খেয়ে মাথা ফা’টিয়ে ফেলে তারপর ফ্লোরে শব্দ করে পড়ে গেল। সেই সাথে সে গলা ফা’টিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে। পরিবেশ নিরব থাকায় সবাই বাহির থেকে শব্দটা শুনতে পেয়ে উপরে উঠে আসে। আব্রাহাম এসে দেখে অনামিকা ফ্লোরে পড়ে আছে, তার মুখটা র’ক্তে মাখামাখি করছে। আর চমচম পাশে তাকে তোলার চেষ্টা করছে। সে হুট করে চমচমকে হেঁ’চকা টা’ন দিয়ে চমচমকে দাঁড় করিয়ে সবার সামনে ক’ষে এক থা’প্প’ড় লাগিয়ে দিল।
আকস্মিক এমন কান্ডে সবাই হতবাক। আব্রাহাম জোরে চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
-‘এই মেয়েটা সবসময় গড়বড় করবে! কোনো কিছু এই মেয়ের জন্য ঠিক থাকে না। সবার ক্ষ’তি করতেই ভালোবাসে। বে’য়া’দ’ব কোথাকার!’
চমচমের চোখটা ছলছল করে উঠল। সে উপস্থিত সবার দিকে একবার তাকিয়ে দৌঁড়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। চমচমের বাবা শ’ক্ত করে ফেললেন মুখের ভাব। তারপরও তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। তার এখন একটা বড় কাজ করার বাকি আছে। চিনিও বোনের পেছন পেছন চাবি নিয়ে ছুটল।
অনামিকার ব্যান্ডেজ করানোর পর সে নিজেই বলল যে তার জন্যই দু’র্ঘ’টনাটা ঘটেছে। ব্যথর চো’টে তখন কিছু বলতে পারছিল না। তারপর নিজের ভাইয়ের সাথেও রা’গ দেখালো চমচমকে কেন মা’রল?
চমচমের বাবা সবটা জেনে নিজের বাসায় ফিরেন। চমচম নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বেশ অনেকক্ষণ কান্না করে। আব্রাহাম হয়তো তাকে বকাঝকা করত কিন্তু কখনো গায়ে হাত তোলেনি। অথচ আজ বিনা অ’প’রা’ধে সে সবার সামনে চমচমের গায়ে হাত তুলল! সে এটা ভেবেই কান্না আট’কে রাখতে পারছে না। তার এত ক’ষ্ট, এত অ’ভি’মা’ন আর কোনো দিনও হয়নি। সব দুঃখকে সে হাসি মুখে সয়ে গেছে কিন্তু আজকেরটা যেন তাকে শ্বা’স রো’ধ করেই মে’রে ফেলবে।
চমচম একসময় কান্না থামায়। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়। আনমনেই ফোনের মেসেজ ফোল্ডারটায় ঢুকে ঘুরাঘুরি করতে থাকে। তখনই তার নজরে আসল একটা মেসেজ। তার বন্ধু তানিয়া সেদিন জানিয়েছিল চট্টগ্রামের ভর্তির শেষ তারিখ কত তারিখে। চমচম দেখল আগামীকালই ভর্তির শেষ দিন। সাথে সাথেই সে অনেককিছু ভেবে নিল। সে আর থাকবে না এখানে। তার জন্য সবার অসুবিধে হয় তো? সে চলে যাবে। আর আসবে না। কখনো না। তাকে কেউ ভালোবাসে না। সে কেন। থাকবে এই মানুষগুলোর সাথে! আব্রাহাম যখন অ’ন্যা’য় ভাবে তাকে মা’র’ল কথা শুনালো তখন কেন কেউ আব্রাহামকে কিছু বলেনি? কেন? নিগার আন্টির সব ভালোবাসা মি’থ্যা। চমচমের জন্য এত দরদ অথচ সে আজ চমচমের হয়ে প্রতিবাদ পর্যন্ত করল না। চমচম তার বাবাকে গিয়ে জানালো সে চট্টগ্রামই পড়বে। কালকে ভর্তির লাস্ট ডেট। বাবাও সাথে সাথে সায় দিয়ে দিলেন। চমচমের মা বললেন,
-‘কি বলছ? ও এতদূর থাকতে পারবে?’
-‘পারবে।’
-‘আব্রাহামরা মানবে?’
-‘ওদের না মানার কথা উঠছে কেন?’
-‘তুমি কি ভুলে গেছ? কালকেই তো বিয়ের কথা পাকা করে এলাম।’
-‘ফাতেমা! আমি তাদের কোনো কথা দিয়ে আসিনি। আমার মেয়েকে আমি সেই ছেলের কাছে কখনোই বিয়ে দিব না। আমার উপস্থিতিতে আমার মেয়েকে বিনা অ’প’রা’ধে যে ছেলে মা’র’তে পারে সে আমার অনুপস্থিতিতে আরো বেশি ভ’য়া’ন’ক ঘটনা ঘটাবে না তার কি গ্যারান্টি? আমার চমচম পড়বে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নিজের পছন্দে বিয়ে করবে। এটাই আমার শেষ কথা! তুমি নিগার ভাবীকেও জানিয়ে দিও এই কথা।’
পরদিন সকালে চমচমকে নিয়ে তার বাবা এয়ার টিকেট কে’টে চট্টগ্রাম পৌঁছায়। ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে ফেরেন। কিন্তু ফেরার সময় চমচম জেদ ধরল সে এখন ঢাকা ফিরবে না। বড় মামা চট্টগ্রামে থাকেন সেখানেই কয়েকদিন বেড়াবে। এদিকে চমচমের আসার খবর শুনে বড় মামাও তাদের সাথে দেখা করতে ভার্সিটিতে চলে গেল। সেখান থেকে চমচমকে নিজের বাসায় নিয়ে গেল। চমচমের বাবাও আপত্তি করলেন না। চমচমকে থাকার অনুমতি দিয়ে দিলেন। এরপর চমচম তো থেকে যায় কিন্তু একেবারের জন্যই! কেননা এর পর সে আর ফেরেনি। যতদিন পর্যন্ত ক্লাস শুরু হয়নি ততোদিন সে বড় মামার বাসায় ছিল। তার দুইটা মামাতো বোন। তাদের সাথেই সে হেসে খেলে সময় কাটিয়ে দিয়েছে। যদিও তার মুখ দেখে তাকে সুখী মনে হতো কিন্তু মনে যে কতবড় ক’ষ্টের পাহাড় গড়েছিল সে নিজেই জানে আর জানে তার সৃষ্টিকর্তা।
#চলবে।
(এমনই হওয়ার ছিল। শুরু থেকে এমনই ভেবে রেখেছি। কথা হচ্ছে আমি খুব অসুস্থ। তাই ঠিকভাবে সাজিয়ে লিখতে পারিনি। পেটে ব্যথায় কাতর আমি। তারপরও লিখছি কারণ কথা দিয়েছি দিব তাই!)