#দখিনের_জানলা (পর্ব-১৭)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
চমচমের আপনি বলাটা আব্রাহামের যেমন হজম হলো না তেমনই ফাতেমা বেগম, নিগার খানম, চিনির কারোরই হজম হলো না। সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আব্রাহাম আর চমচমের দিকে। চমচমের চোখে মুখে একটা কাঠিন্য প্রকাশ পাচ্ছে। আব্রাহাম মনে মনে হাসে। ঠিক আছে! তাকে তার মতোই জবাব দিতে হবে। সেও মুঁচকি হেসে বলল,
-‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
আব্রাহামের মুখ থেকে তুমি শুনে চমচমের কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছিল যেন! বাকিরা নিজেদের মতো হাসছে এমন কথোপকথন দেখে। চমচম অ’স্ব’স্তি নিয়ে মাথা নিচু করে বলল,
-‘আমিও ভালো আছি।’
আব্রাহাম এরপর আর দাঁড়ালো না। সোজা নিজের বাসার দিকে চলে গেল। চমচম যখন এসে পড়েছে তখন আরো অনেক সুযোগ পাবে তাকে দেখার। এখন বাসায় গিয়ে শাওয়ার নিয়ে একটা শান্তির ঘুম দিবে সে। অনেকদিন পর চোখ বন্ধ করে সে চমচমের মুখ দেখতে পাবে। চমচমের আগের চেহারাটাও হুট করে আজকেই আব্রাহামের মনে পড়ে গেল। কিন্তু এখন আর চমচমের আগের মতো কিশোরী ভাবটা নেই, লিকলিকে শরীরের গঠনটাও হারিয়ে গেছে। এখনকার চমচম আগের থেকেও আরো বেশি সুন্দর, সুন্দর তার শারীরিক গঠনও! তাছাড়া এখন তার মধ্যে রয়েছে একরকম গাম্ভীর্যতা, পরিপাটি, মানানসই সাজ-পোশাক পরিধানের রুচি! ছন্নছাড়া স্বভাবের, শার্ট-প্যান্ট, জাম্পস্যুট, কেডস্, স্নিকার্স পরা চমচম এখন শাড়ি পরতে শিখে গেছে, হিল জুতো পরছে, মুখে প্রসাধনী মাখছে, সবমিলিয়ে একদম টিপটপ চলছে। তারপরেও আব্রাহামের কেন যেন এটাও মনে হচ্ছে কিছু তো নেই। ভাবতে গিয়েই তার মনে পড়ল, আগের চমচমের প্রাণবন্ত হাসি ছিল, মুখে কথার ফুলঝুড়ি ছিল, তার কন্ঠে মিষ্টি মধুর হাম ভাইয়া ডাকটা ছিল, তুমি সম্মোধন ছিল! এখন সেসব নেই। আব্রাহাম হঠাৎ করেই আগের চমচমকে অনেক বেশি মিস করতে লাগল।
আব্রাহাম যখন চমচমের পাশ দিয়ে গেল তখন চমচম আব্রাহামের পারফিউমের ঘ্রাণে এক অন্যরকম অস্থিরতা অনুভব করে। তার বুকটা দুরু দুরু করতে থাকে। হাত পাও কেমন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল তার।
৩৪.
চমচম গাড়ি থেকে নিজের হ্যান্ড ব্যাগটা বের করে নিলো। রহমত উদ্দিন গাড়ির ডিকি থেকে চমচমের বড় ব্যাগ গুলো নামিয়ে দিলেন। চমচম চিনিকে বলল,
-‘চাচাকে এত দ্রুত পাঠালি কি কারণে? দুই ঘন্টারও বেশি সময় বসে ছিল।’
-‘বাবা পাঠিয়েছেন। বারবার বলে দিয়েছে চমচম যেন অফিস থেকে বের হতেই গাড়ি উপস্থিত পায়। এয়ারপোর্টেই পাঠিয়ে দিতো কিন্তু তোর অফিসের গাড়ি তোকে রিসিভ করবে বলেই পরে অফিসে পাঠালো।’
-‘বাবাও না!’
অনেকদিন পর বাসায় এসে চমচমের অন্যরকম প্রশান্তি লাগছিল মনের মধ্যে। তাদের বাসায় বেশ কিছু মেহমান রয়েছে। বলতে গেলে মেহমানে বাসা গিজগিজ করছে। চিনির মেহেন্দি উপলক্ষেই এসেছে সবাই, হাতে গোণা দুই তিন জন হয়তো থাকবে বাকিরা চলে যাবে। কিন্তু পরদিন হলুদে আবার আরো অনেকেই আসবে, তাদের অধিকাংশ থেকেও যাবে নাকি। শুনে চমচমের রা’গ হচ্ছিল। এত মানুষের উপস্থিতি চমচমের পছন্দ না। তার হৈ চৈ শোরগোল ভালো লাগে না এখন আর। একা থাকতে থাকতে একাকীত্বকেই ভালোবেসে ফেলেছে। ভার্সিটিতে পড়ার সময় হলে ছিল কিন্তু এরপর বাসা নিয়েছিল যখন সে চাকরিতে ঢুকে। প্রথমে একজন রুমমেট ছিল কিন্তু করোনায় সে বাড়ি চলে গেলে চমচম একাই পড়ে থাকে।
নিজের রুমে ঢুকে দেখল সব কিছু পরিপাটি আছে। এই রুমে নাকি চিনি কাউকে ঢুকতে দেয়নি। লক করে রেখেছিল। চমচম কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকায়। নিজের রুমে বাবা-মা, বোন ছাড়া আর অন্য কারো উপস্থিতি সে স’হ্য করতে পারেনা।
গোসল সেড়ে, নামায পড়ে চমচম ভাত খেয়ে নেয়। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে একটা ঘুম দেয়। সারাটা দিন খুব খাটুনি গেছে তার। এখন একটু বিশ্রাম না নিলেই হয় না। চমচমের খুবই বি’র’ক্ত লাগছে। এই মুহূর্তে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান তাকে সবচেয়ে বেশি বি’র’ক্ত করছে। চিনির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। কিন্তু বিয়েটা যখন হবে তখনই করোনা শুরু হলো। চারিদিকে তখন ভ’য়া’ব’হ অবস্থা, লক ডাউন জারি করা হয়েছিল। সামাজিক অনুষ্ঠান গুলো বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য তারপরেও বেশ কিছু মানুষ বিয়ে শাদির উৎসব পালন করেছিল। কিন্তু চিনি করেনি। সে সময় নিলো। এরপরও একটা বছর এমন ক’ড়াক’ড়ি ভাবে গেল। এর মধ্যে চিনির হবু বর আশফাককে কর্মসূত্রে একটা জরুরী ট্রেনিং গ্রহণের জন্য এক বছরের জন্য বিদেশে যেতে হয়েছে। সব মিলিয়ে আর সময় হয়ে ওঠেনি। আশফাক দেশে এসেছে এক মাস আগে। আর এরপরই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হলো। চমচমের জন্য এসব অপ্রত্যাশিত ছিল। বোনের বিয়ে হবে ব্যাপারটা সে মানতেই পারছে না। বোনকে সে সারা জীবন পাশে চায়। কিন্তু সে এটাও জানে যে সেটা সম্ভব নয়। জগৎ সংসারের কিছু বাঁধা ধরা নিয়ম থাকে। সেসব মানতেই হয়! না মেনে উপায় নেই। তাছাড়া চিনিরও তো শখ আহ্লাদ আছে সংসার পাতার! চমচমের জন্য তার সেই শখ বিসর্জন দেওয়ার কোনো মানে হয়?
চিনি একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে। তারই সাথে তার বাবার ব্যবসায় দেখছে। চমচমও টুকটাক দেখাশোনা করে কিন্তু সে দুই দিক সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায়। অথচ চিনি অবিচল। সব দিকটা সামলে চলছে সে। কর্মসূত্রে যেমন সে প্রশংসিত পারিবারিক আড্ডা মহলে, আত্মীয় স্বজন, পাড়া পরশীর কাছেও চিনি অত্যাধিক প্রিয়। এই এত কাজের চাপে পড়েও চিনি কোনোদিন টু শব্দ করেনি। এত শ’ক্ত, কর্মঠ চিনিকে দেখে মাঝে মাঝে চমচম ভাবুক হয়ে পড়ে। চিনির কি একটু হাঁ’প ছেড়ে বাঁ’চ’তে ইচ্ছে করেনা? চমচম যখনই এই ব্যাপারে কিছু বলে চিনি শুধু হাসে। তবে সেই হাসিতে চমচম কিন্তু অপ্রকাশিত বে’দ’না দেখতে পায়। অথচ চিনি মুখ ফুঁটে কিছু বলে না। চমচম ঠিক করেছে আর চিনিকে ক’ষ্ট করতে দিবে না। এবার বাবার ব্যবসায় সেও পুরোপুরি মনোনিবেশ করবে। তার বাবার ছেলে নেই তো কি হয়েছে? মেয়েরা আছে! মেয়েরাই সবটা সামাল দেবে।
সন্ধ্যার দিকে আজানের শব্দে চমচমের ঘুম ভাঙে। ফ্রেশ হয়ে ওযু করে প্রথমেই নামাযটা শেষ করে চমচম। তারপর রুম থেকে বের হতেই দেখে সবাই সেজেগুজে আছে। চিনি এসে বলল,
-‘কিরে? তোর কি শরীর খা’রা’প লাগছে? এতসময় ঘুমালি যে!’
-‘না একটু টায়ার্ড লাগছিল। তোমাদের অনুষ্ঠান শুরু!’
-‘আরে এই পা’গ’ল গুলো কীসের মেহেন্দি করার জন্য লাফালাফি করছে! বাবাও বলেছেন যা ইচ্ছা হয় করো। নিগার আন্টিও তাল মিলিয়েছে। দুপুরে আব্রাহাম ভাই বক্সে করে নানান সরঞ্জাম দিয়ে গিয়েছিল। এখন সাজানো হচ্ছে।’
-‘ওহ।’
৩৫.
ড্রয়িং রুমেই আয়োজন করা হলো সবকিছুর। যদিও চমচমের প্রথমে বি’র’ক্ত লাগছিল কিন্তু ধীরে ধীরে তারও ভীষণ ভালো লেগে গেল পুরো আয়োজনটা। চমচম একটু পর পরই চিনির দিকে তাকায় আর দেখে চিনির মুখটা খুশিতে জ্ব’লজ্ব’ল করছে। চিনির আনন্দ দেখে চমচমেরও ঠোঁটে হাসি ফুঁটে। পুরো অনুষ্ঠানে সে তৎপর হয়ে কাজ করেছে। নিজের দুই হাত ভরিয়ে মেহেদি লাগিয়েছে। তার প্রিয় আপুর বিয়ে তে সে আমোদ করবে না বুঝি?
মেহেন্দিতে কোনো ছেলেকে এলাউ করা হলো না। আয়মান বেশ তেঁ’তেছে এই নিয়ে। বাম্পা আর চয়নও দুই তিনবার এসে ঘ্যানঘ্যান করে গেছে। পরে চিনি বলল,
-‘ওরাও আসুক! এমন করছিস কেন?’
আয়মান এসে বলল সে মেহেদি লাগাবে হাতে। চিনির পাশে বসতেই চিনি বলল,
-‘কিরে? তুই বিয়েটা কবে করবি? আমাকে তো অনেক কথা শুনিয়েছিস। দ্যাখ আমারও পরশু বিয়ে। অথচ তোর খবর নেই।’
আয়মান হতাশার সুরে বলল,
-‘ভাইয়া না করলে আমি কীভাবে করি? এদিকে আমার বিয়ের বয়সও পার হচ্ছে। ধুর! এই তোর বোনটাকে বল তাড়াতাড়ি আমার ভাইকে বিয়ে করে নিতে।’
-‘তোর ভাইকে বল এসে প্রস্তাব দিতে।’
-‘তোর বোন মানবে?’
-‘না।’
চিনি হেসে ফেলল। আয়মান ক্রু’দ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর দূরে বসে সবার সাথে গল্পে মত্ত থাকা চমচমকে দেখল। মেয়েটা একটু যদি মান অভিমান ভুলে তার ভাইকে আপন করে নিতো!
পরদিন চমচম সকালের খাবার খেয়ে নিজের রুমে এসে নিশ্চিন্ত মনে চা খাওয়ায় মগ্ন ছিল। তখনই তার মামাতো বোন পারিজাত আর খালাতো বোন তারিন রুমে ঢোকে। তাদের হাতে দুইটা সাউন্ডবক্স। চমচম ভ্রু কুঁচকে বলে,
-‘এগুলো এখানে এনেছিস কেন?’
পারিজাত বলল,
-‘গান শুনব আপু।’
-‘এই অসময়ে?’
-‘বিয়ে বাড়িতে আবার সময় অসময় কি? যখন তখনই গান বাজনা বাজানো যায়।’
দুজনে সাউন্ডবক্স দুইটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চমচম তাদের থেকে চোখ ফিরিয়ে হঠাৎ করেই নিজের দখিনের জানলার দিকে তাকালো। কত দিন হলো তার দখিনের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে দখিনা বাতাস উপভোগ করেনা সে! আজ একটু মন আনচান করল। জানলাটা খোলার জন্য হাত নিশপিশ করছিল। সে উঠে জানলার সামনে দাঁড়ায়। অনেকদিন বন্ধ থাকায় ছিটকিনি বসে গেছে। ওঠাতে নিলেই ক্যাড়ক্যাড় করে শব্দ হলো। খুলে দেওয়ার পরই বাতাস এসে ছুঁয়ে দিল তাকে। পরম আবেশে চমচমের চোখটা বন্ধ হয়ে গেল আপনাআপনি।
আব্রাহাম অফিসের জন্য বের হচ্ছিল। বারান্দার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেই থাই গ্লাস ভেদ করে বাহিরের দৃশ্যটা দেখল। চমচমের জানলাটা খোলা। একজন শাড়ি পরিহিতা নারীর কোমরের অংশ দেখা যাচ্ছে। আব্রাহাম চিনে ফেলল মানুষটাকে। সে ধীর পায়ে গ্লাস সরিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করতেই দেখল চমচম দাঁড়িয়ে আছে জানলার পাশে। আর সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশপানে চেয়ে আছে। আব্রাহাম প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চমচমকে দেখতে লাগল।
হঠাৎ করেই চমচমের মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। সে চট করে আব্রাহামের বারান্দার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। কালো শার্ট প্যান্ট পরিহিত আব্রাহামকে দেখে তার বুকে মোঁ’চড় দিয়ে উঠল। সে জানলাটা বন্ধ করতে গিয়েও করল না। আজ তার মন বলছে কি দরকার বন্ধ করার? কত লু’কিয়ে থাকবে সে? আব্রাহামকে দেখে কেন এত সং’কো’চ হচ্ছে? তার অংশেই সে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম সা’হ’স নিয়ে চমচম দাঁড়িয়ে রইল। আব্রাহামও চমচমকে আজ জানলা বন্ধ করতে না দেখে মৃদু হাসে। চমচম খেয়াল করল সে জমে যাচ্ছে। না চাইতেও আব্রাহামের দুই চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আব্রাহামও চমচমকেই দু চোখ ভরে দেখছে। আকাশ মেঘলা হয়ে এসেছিল আরো আগেই। এখন বাতাস বইছে তীব্র বেগে। চমচমের খোলা চুলগুলো অবাধ্য হয়ে এদিক সেদিক উড়তে লাগল। চমচমের সেদিকে খেয়াল নেই। সে যেন আব্রাহামেই মত্ত। আর আব্রাহাম? সে তো এই যুবতী চমচমের রূপ সুধা মদির চোখে পান করছে। চমচমের রুমের ভেতরে সাউন্ডবক্সে জোরে গান বেজে উঠল তখনই। পারিজাত আর তারিন লীলাবালি গান বাজাতে গিয়ে একটা ইংরেজী গান ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু হুট করে মোবাইল হ্যাং মে’রে যাওয়ায় গানটা বদলাতে পারছে না। সাউন্ডবক্সের বোতাম টিপে যে বন্ধ করবে সেই উপায় নেই। সাউন্ডবক্স গুলো পুরোনো। বাম্পা কোথা থেকে যেন এনে দিয়েছে। একবার বন্ধ করলে আবার চালু করতে অনেক ঝা’মে’লা পোহাতে হয় তাই এখন আর বন্ধ করতে চাইছেনা সরাসরি।
গানের লাইন গুলো আব্রাহাম নিজের বারান্দা থেকে শুনতে পেল। শুনতে পেল চমচমও।
My heart like a planet, the sun forgot
Where now? Orbiting the light that I had lost
More than words, the silence teaches
How to see and to feel what is real
When sunlight reaches my soul
So, look in my mercy mirror
I need you more than I have known
So, look in my mercy mirror
‘Cause I’m not ready to let you go
Now I know, now I know
I’m not ready to let you go
Now I know, now I know
I’m not ready to let you go
#চলবে।
(গানটা ‘Mercy Mirror লিখে সার্চ দিলে পেয়ে যাবেন। শুনে ইচ্ছে হলে শুনে নিবেন। সুন্দর একটা গান!)