#দূরত্ব!…..
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্ব- তিন এবং অন্তিম
নূরজাহানের হাতটি ধরে সরফরাজ নিয়েগেল পাশের রুমে। যেখানে সরফরাজের একটা আলাদা লাইব্রেরি আছে। পুরোনো এই বনেদি বাড়িটিতে অনেক কিছুই আছে। জমিদার বাড়ি, এই বাড়ির আশপাশের লোকজন ছাড়া তেমন কেউই নেই, সরফরাজের বড় দাদুরা দেশ ভাগের সময় ভারতের কলকাতায় চলেগেছেন। তার নিজের বাবা ও তো পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হতে চেয়েছিল। তবে সরফরাজের একবাক্য দেশ ত্যাগ সে করতে পারবে না কোন কালেই।
লাইব্রেরির থাকে থাকে সাজানো বই, বইয়ের পাশে আছে পত্রিকা। পুরোনো এক আলামারি থেকে কিছু চিঠি বেড় করলো সে। একটি চিঠি নূরের হাতে এসে পরল। নূর আগ্রহ নিয়ে চিঠিটা ধরেই অনেকটা অবাক হয়েগেল সেনাবাহিনীর সৈনিক পদ থেকে পদত্যাগ পত্র তাও আবার সরফরাজের নামে। আরও কিছু চিঠি যা ছিল উর্দুতে লেখা! উর্দু ভাষায় লেখা বলেই নূর তেমন কিছু বুঝেনি। চিঠিগুলোর দিকে একবার তাকায় তো একবার সামনে দাড়ানো সরফরাজের দিকে তাকায়। নূরজাহানের দৃষ্টি অনুকরণ করে সরফরাজ তাকে তাদের সে লাইব্রেরীর চেয়ারে বসতে বলে।
নূরজাহান বসা মাত্রই সরফরাজ বলতে শুরু করে
-” বাবা আমাকে নয় বছর বয়সে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। কেন নিয়ে যায় তা তুমি জানো নূর! তখন বাবার ব্যবসা খুব ভালো চলছিল, আমি ও রুমকি তখন খুব ছোট আমাদের দেখার মত তেমন কেউই ছিল না। ফুফি ও তখন শশুর বাড়িতে ব্যাস্ত, নতুন বউ আমাদের এসে দেখে যাবেন তেমন কোন ব্যাবস্থা ও ছিল না। বাধ্য হয়ে পাকিস্তানে স্থানান্তর হতে হয় আমায়। সেখানেই আমাদের দেখার জন্য বাবা কাজের লোকের ব্যাবস্থা করে দেন। আমরা বড় হতে লাগলাম আমির মিয়ার হাতে যিনি আমাদের লালন পালন করে বড় করেছিলেন সেই সময়।
পনেরো বছর বয়সে একটা অদ্ভুত কান্ড গঠিয়ে বসেন বাবা। তার পাকিস্তানি বন্ধু আমির নাওয়াজ খান পাঠানের মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেন। দুই বন্ধুর সম্পর্ক অটুট রাখতে আমার জুবাইদাকে বিয়ে করতে হয়। তবে আমাদের সম্পর্কে একটা শর্ত জুড়িয়ে দেন আমির চাচা, তা হলো বিয়ে হয়েছে ঠিক আছে তবে আমাদের চুড়ান্ত ভাবে সবকিছু ঠিক হবে যখন আমি কিছু করতে পারবো। বেকার ছেলের হাতে তিনি মেয়ে তুলে দিবেন না। তাই হয়তো আমায় এমন শর্ত দিয়েছেন, বাবা ও কিছু বলেননি। এরপর মাত্র সতেরো বছর বয়সে আমি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেই ১৯৭০ সাল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর সেই বছর আমি আবার বাংলাদেশে আসার সুযোগ পাই। তখন আমার নিজ ভূমির প্রতি একটা আলাদা টান পাই যেটা শুধু একজন মানুষের দেশের প্রতিই থাকে।
মায়ের কবর,নিজের গ্রাম, নিজের দেশ সবকিছুই তেই আমি আমাকে আপন করে যেন পেয়েছিলাম। তারপর কি হলো কে জানে আমি আর সেনাবাহিনীর চাকরিতে মনযোগ দিতে পারলাম না চলে এলাম বোন রুমকিকে নিয়ে বাংলাদেশে। চিঠিতে চিঠিতে বাবার সঙ্গে আমার অনেক তর্কাতর্কি হয়েছিল সেই বছর। জুবাইদার সঙ্গেও আমার চিঠিতে কথা হয় জুবাইদার সঙ্গে কথা বলে সে বছর আমি তাকে তালাক দিয়ে দেই। কারন আমির চাচা আমাকে বা জুবাইদাকে কখনোই পূর্ব পাকিস্তান আসতে দিবে না। তাই সেই বছর তার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক শেষ। জুবাইদাকে আর নিজের জীবনে ঠাই দিতে পারলাম না। সেই বছর তাকে ছেড়েই আমাকে আসতে হয়। যুদ্ধ থেকে এই এত বছর আমি আমার দেশেই ছিলাম।
নূরজাহান সব শুনে একদম যেন বাক্যহারা হয়েগেল।
মুখ দিয়ে তার কথা বন্ধ হয়েগেল প্রায়, ছলছল চোখে সরফরাজের দিকে চেয়ে আছে সে। সরবফরাজ নূরজাহানের চোখের পানিগুলোকে সযত্নে মুছে দিয়ে বলল
–” জুবাইদার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল শুধুই নামে মাত্র সম্পর্ক! তোমার সাথে হওয়া সম্পর্কটা আমার আত্মার সম্পর্ক! হাজারো বাধা বিপত্তি এলেও আমি তোমাকেই ভালোবেসে যাবো। ”
–” আমাকে ক্ষমা করবেন আমি আপনাকে ভুল বুঝেছি! আমার উচিৎ ছিল আপনার পুরো কথা শুনে নেও। আমি বুঝতে পারিনি।”
__________________
“সেইদিনের পর থেকে আমার নূরের জীবনটা সুখেরই ছিল। নূর কখনোই আমার সঙ্গে রাগ তেমন দেখাতো না তা বলবো না। মান-অভিমান সব সম্পর্কেই থাকে, আমাদের সম্পর্কেও ছিল তবে তা রাগ প্রকাশের উর্ধে গিয়ে একজন অন্যজনকে আঘাত করে কথা বলা নয়।নূর শুধু আমার স্ত্রী ছিল না ছিল একজন সঙ্গী যার মধ্যে আমি আমার জীবনের পূর্ণতা পেয়েছিলাম।”
বৃদ্ধ সরফরাজ কথা বলতে বলতে টিস্যু দিয়ে চোখের পানি মুছতে লাগলেন। দাড়িতে হাত বুলিয়ে তজবী নিয়ে বলতে লাগলেন-
-” নূরজাহান চলে যাওয়ার একুশ বছর আজ! দীর্ঘ একুশ বছরের জীবনের প্রথম দশবছর সন্তানেরা আমায় বিয়ে নিয়ে চাপ না দিলেও পরের দশ বছর কি হলো কে জানে তারা আমায় বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লাগল। তাদের নাকি নতুন মা নিয়ে কোন সমস্যা নেই, তাদের বাবা একা থাকবেন তা তারা সহ্য করতে পারবে না। রুমকি! আমার আদরের মা মরা বোন,ছোট্ট রুমকি! সেই রুমকি ও আমাকে বিয়ের কথা বলেছিল। যে রুমকি নূরের পরম বান্ধবী ও ছোট বোন ছিল। আমি ওকে বলেদিলাম-” বিয়ে মানেই জীবন নয়, ” রুমকি আমাকে বিয়ে দিতে অনেক চেষ্টা করেছিল। তাদের মতে আমার শেষ বয়সে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন। আমার সঙ্গীর প্রয়োজন ঠিক আছে, তবে আমার জীবন সঙ্গীকে আমি সারাজীবন চাই। নূর ছিল আমার সেই সঙ্গী, নূরকে আমি এক জীবনে নয় হাজার জীবন চাই। তোমাদের হয়তো প্রশ্ন থাকতে পারে স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে বিয়ে করা যায়েজ আছে, এটা ভুল নয় আমি অস্বীকার করি না। অবশ্যই করা যায়, এটা যার যার মত, আমার ইচ্ছে নেই তাই আমি বিয়ে করিনি এতটা বছর আমি একাই আছি।”
নাতি -নাতনিদের সঙ্গে এতক্ষণ বসে বসে বলছিলেন বৃদ্ধ সরফরাজ। ঘরে বসা সবার মাঝে একটা উৎকণ্ঠা ঝেকে বসেছে। বৃদ্ধ সরফরাজ ও তার নূরের গল্প সবার মাঝে যেন একটা আত্ম প্রশান্তি যোগ করেছে। সরফরাজ নূরের জন্য বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিবেন ঠিক এইভাবেই।
ক্যানসারে আক্রান্ত নূর হয়তো জীবনের কাছে পরাজিত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল। কিন্তু তার আরেকটি প্রাণ যেন রেখে গিয়েছিল পৃথিবীতে। ভালোবাসা শুধু নামেই নয় কাজে ও অনেকে দেখিয়ে দেন। নূর মারা যাওয়ার একুশ বছর পর ও সরফরাজ বিয়ে করেনি। নূরের জন্য তিনি প্রতি রাকাতে সেজদায় পরে পরে মোনাজাত করতেন। করতেন কবরে জিয়ারত, এখনও ঠিক তেমন ভাবেই কবর জিয়ারত করেন তিনি।নূরের স্মৃতিগুলো স্বরণ করতেই বৃদ্ধ সরফরাজের চোখ এখনো ভিজে উঠে।
সমাপ্ত।
গল্পটি কেমন হয়েছে বলতে পারবো না। হয়তো খুব একটা ভালো লাগেনি। প্রথম পার্ট হয়তো কারো কারো ভালো লাগলেও দ্বিতীয় পার্ট টা আমি গুছিয়ে লিখতে পারিনি। কারন গল্পটি কোন নাটকীয় জীবন কাহিনীর নয় একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশ প্রেমিক, এবং স্ত্রীর চরম প্রতি ভালোবাসার উদারণ স্বরুপ লেখলাম। তার সঙ্গে আমার যখনই দেখা হয় খুব সুন্দর ভাবে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেন। প্রতিবার তার মুখে স্ত্রীকে নিয়ে প্রসংশা তো আছেই সঙ্গে তিনি অন্যদের ও উপদেশ দিতেন সাংসারিক জীবনে কিভাবে চলতে হবে।আপনাদের মূল্যবান সময় হয়তো আমার গল্প ধারা নষ্ট হয়েছে তার জন্য ও আমি দুঃখিত। কারন সব গল্প যে সবার ভালো লাগবে না তাও আমি বুঝি তাই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।