দূর আলাপন পর্ব ১১

#দূর_আলাপন
পর্ব-১১
অদ্রিজা আহসান
_______________
ভালোবাসা সর্বগ্রাসী! একটা মানুষকে কত অনায়াসেই না সে নিজের আসন থেকে টেনে হিচঁড়ে রাস্তায় নামিয়ে আনে। মানুষ ভুলে যায় তার মর্যাদা, আত্মসম্মান।
দীর্ঘ পাঁচমাস পর নিনাদ যখন নিজের তাগিদে তিহাকে কল করল প্রথম। তখন নিজেকে তার ভীষণ নির্লজ্জ, বেহায়া, বাজে লোক বলেই মনে হল। পুরো জীবন জুড়েই তার ভালোবাসার অপ্রতুলতা। তাই যেখানে একটু অনুরাগের ছোয়া সে পেয়েছে, কাঙালের মত সেদিকেই সে ছুটেছে সর্বদা। আজ এই ভালোবাসাবাসি হীন শুষ্ক খররৌদ্র দিনে তাই সেসব অনুরাগী দিনের কথা ভুলতে পারে না সে। নির্লজ্জের মত আগ বাড়িয়ে আবারও ছুটে যেতে চায় তার বেহায়া মন।

ফোন কানে চেপে নিনাদের কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। সে মনে প্রাণে চাইল ওপাশে কল যেন রিসিভ না হয়। রিং টা বেজে বেজে এভাবেই কেটে যাক!
মন কামনা তার পুরোপুরি ব্যার্থ করে দিয়ে তখনই তিহা দায়সারা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘হ্যালো। ‘
নিনাদ ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পরল। ইতস্তত স্বরে হেসে বলল, ‘ভালো আছিস? ওহ আসসালামু আলাইকুম। ‘
তিহা অস্ফুট হাসল, ‘ভালোই আছি। ওয়ালাইকুমুস সালাম। এতদিন পর যে? তাহলে অবশেষে মনে পরল আমাদের কথা? ‘
মনে তো তিহারও পরে নি। এই কয়েক মাসে কল করে নি সে একবারও। কিন্তু নিনাদ সেসব কথার ধার দিয়ে না গিয়ে সম্পুর্ন অপরাধ নিজের দিকে টানল, ‘ব্যাস্ততা অনেক বেড়ে গেছে এই কয়েক দিনে। যাইহোক অজুহাত দেব না আর। একটা কল করার মত সময়ও ছিল না এতটা বললে বাড়িয়ে বলা হবে। ভুল করেছি, মাফ করে দে।’
উত্তরে ওপাশ থেকে শুধু একটা অস্ফুট শব্দ ভেসে এল। সেই প্রাণহীন নিস্পন্দ হাসি।
নিনাদ এখন কি বলবে? কোন কথাই যে খুঁজে পাচ্ছে না সে। কিন্তু এভাবে চুপচাপ ফোন কানে চেপে ধরে তো থাকাও যায় না। তাই হঠাৎ ব্যাস্ত স্বরেই সে বলল, ‘ওদিকে সবাই ভালো আছে তো। ছোটন ভালো আছে? রওশান ভাই এখন কোথায়? ভালো আছে তো ওরা সবাই?’
-‘হু ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ। রওশান বান্দরবানেই আছে এখন। তুই ফিরবি কবে? এক বছর তো হতে চলল।’
-‘সে কথা জানাতেই কল করেছি তোকে। মাস দেড়-এক এর ভেতর ফিরব। ইচ্ছে করেই একটু দেড়ি করে ফিরছি। ফুআম্মা বলে রেখেছেন ঢাকা ফিরলেই আমার গলায় দড়ি পরাবেন। দড়ি যখন পড়তেই হবে তবে অত তাড়া কিসের? সেজন্যই ভাবছি…..। ‘
তিহা উৎসুক হয়ে বলল, ‘ ফুআম্মা কি তোর বিয়ে ঠিক করেছেন? কার সাথে? আফরিন?’
নিনাদ হেসে উঠল, ‘আফরিনের বিয়ে হয়ে গেছে। ফুআম্মাই বিয়ে দিয়েছেন। আমাদের গ্রামেরই এক ছেলের সাথে আফরিনের একটা সম্পর্কের মত ছিল।’
তিহা অবাক হল, ‘কি বলিস! ফুআম্মা না তোর সাথে ওর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন?’
নিনাদ হাসল, ‘বুঝিস না! সবাই-ই তো ফায়দা খোঁজে। তুই যেমন আমি দেশ ছাড়তেই সুযোগ পেয়ে বোনের শুভ কাজটা সেরে ফেললি, তেমনি ফুআম্মাও আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। তাছাড়া আফরিনের সাথে মিনহাজ। মানে ওর বরের অনেকদিন থেকেই একটা কিছু চলছিল…..।’
তিহা উত্তরে কিছু বলল না। হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেল সে। নিনাদ তাহলে সেকথা এখনো ভুলতে পারে নি! সুযোগ পাওয়া মাত্রই তাকে ঠিকি শুনিয়ে দিল। ভালোই তো করেছে। কিন্তু নিনাদ কিভাবে জানবে যে নিজের করা ভুলের মাশুল তিহাকে সেদিনই গুনতে হয়েছিল। গুনে হচ্ছে আজও।
উত্তর না পেয়ে নিনাদ বলল,’ কিরে, কি হল। রাগ করলি নাকি? বোকা মেয়ে। আমি তো এমনিই বলছিলাম। আমি কি আর বুঝি না! তিতিক্ষার সাথে আমার যায় কখনো? তিতিক্ষা ওর যোগ্য বর-ই পেয়েছে। আমি সত্যিই খুশি হয়েছি। আর আফরিনের ব্যাপার টা তো শুরু থেকেই কিছুকিছু জানতাম আমি। সেজন্যই তখন ফুআম্মার এত জেদের কাছেও বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকতে হয়েছিল। বুঝলি?’
এতসব কথার পরও তিহা কোন উত্তর করল না। অনেকক্ষণ নিরব রইল সে। নিনাদ ফের কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তিহা তাকে তখন থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ চাপা স্বরে বলল, ‘নিনাদ।’
-‘হু।’
আবার কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, ‘তিতিক্ষার বিয়েটা সেদিন হয়নি।’
নিনাদ কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না। ভ্রু কুচকে বলল, ‘কিহ’
তিহার গলার স্বর খাদে নেমে এল। দিনরাত মানসিক চাপে তার ভেতর বাহির সব জমে গেছে। দিনের পর দিন যায়, সে হাসে না, কাঁদেও না। আজ তার বাধ ভেঙে গেল। সে আদ্র স্বরে ফিসফিস করে বলল, ‘তিহার বিয়ে ভেঙে গেছে, ভেঙে গেছে রে।’
নিনাদ অবাক হল। বিয়ে ভেঙে যাওয়া এই যুগে কোন বড় ব্যাপার তো নয়। বিয়ে ভেঙে গেছে। আবার বিয়ে হবে। এতে তিহার এত ভাবনা কিসের? সে সঙ্গিন স্বরে বলল, ‘এই ব্যাপার! আরে বোকা, বিয়ে ভেঙে গেছে তো কি হয়েছে? আবার বিয়ে হবে। এজন্যই কি তোর এত মন খারাপ? তুই ভাবিস না। আমি এসে ওর ভালো জায়গায় বিয়ে দেব। তুই… ‘
কথার মাঝখানেই তিহা থাকে ফের থামিয়ে দিল, ‘নিনাদ, তিতিক্ষার আর কোনদিন বিয়ে হবে না রে। ও যে বেঁচে থেকেও মরে গেছে। ও আর কোনদিন বিয়ে করবে না।’
-‘কি হয়েছে তিহা? এভাবে কথা বলছিস কেন?’
-‘আমি বলতে পারব না নিনাদ। তুই কিছু জিগ্যেস করিস না আমাকে। আমি….’ বাকি কথাটুকু তিহা শেষ করতে পারল না। তিতিক্ষার পাগলামি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তার অশরীরির মত করুণ আর্তনাদ আর ভাংচুরের শব্দ দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে। তিহা আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিল। দৌড়ে গেল বোনের ঘরের দিকে। নিনাদ রাখতে পারল না। সে ফোন কানে নিয়ে অনবরত বলে চলল,’ হ্যালো, হ্যালো, তিহা কথা বল। কি হয়েছে আমাকে বল একটু। প্লিজ বল।’লাইন ততক্ষণে কেটে গেছে।

তিতিক্ষা পাগলের মত এটা ওটা ছুড়ছে আয়নার দিকে। ভাঙা আয়নার টুকরো সারা ঘরের মেঝেতে পরে আছে। এখানে সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে হাতে থাকা ফুলদানিটা এবার সে ছুড়ল আয়নার দিকে। আয়নার যেটুকু কাঁচ অবশিষ্ট ছিল সেটুকুও ভেঙে ছড়িয়ে পরল মেঝেতে। ছোটন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিল এই দৃশ্য। তার শরীর থেমে থেমে কেঁপে উঠছিল। তিহা দৌড়ে সেখান এসে দাঁড়াল। ছোটন কে কোলে করে সরিয়ে নিল দরজা থেকে। পাশের ঘরে তাকে রেখে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি ঢুকল বোনের ঘরে। তিতিক্ষার মাথার চুল এলোমেলো, নাকে, গালে খামচির স্পষ্ট দাগ, তার ফর্সা মুখ ছিড়ে চুইয়ে পড়ছে রক্ত। সে তখনো ঘরের কোণে বসে বসে হাঁপাচ্ছে, কাঁচের টুকরো আর রক্তে তা বসার জায়গাটা মাখামাখি। তিহা দৌড়ে সেদিকে গেল। উবু হয়ে বসেই দুহাতে জড়িয়ে ধরল বোনকে।
-‘কি করেছিস তুই? কি করেছিস এসব বনু? নাক, মুখ বেয়ে রক্ত ছুটছে। ‘
নিজের ওড়না দিয়ে তিতিক্ষার গাল মুছে দিতে দিতে তিহা কেঁদে বলল,’ কি হয়েছে আমার বনু। কেন এমন করেছিস? ‘
তিতিক্ষা তখনো হাঁপাচ্ছিল। চিৎকার করে করে তার গলা ভেঙে গেছে। সে কর্কশ ভাঙা স্বরে বলল,’ ওরা…. ওরা আমাকে বাজে মেয়ে, নষ্টা মেয়ে বলছিল। আমি কত বললাম, আমি কিছু করি নি। আমার কোন দোষ নেই। তবুও ওরা……. ওরা আমাকে বলে কিনা বে*।’ তিতিক্ষা হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। বলে চলল নানান এলোমেলো কথা।
তিহা তাকে বুকে চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল, ‘চুপ চুপ। কেউ কিছু বলেনি তোকে। তুই কত পবিত্র তা তুই নিজে জানিস না? কেউ কেন এসব কথা বলবে তোকে? ভুল শুনেছিস তুই।’
তিতিক্ষার সেসব খেয়াল নেই। নিজের মনে তখনো সে বলে চলেছে,’ ওরা আমাকে সবসময় এসব বলে। আমি কত করে বোঝাই, কিছু করি নি আমি। তবুও বারবার ওরা আমাকে….। আমি ওদের মেরে ফেলব। ওরা সবাই আমার শত্রু। সবাইকে মেরে ফেলব আমি।’
তারপর অনবরত কিছুক্ষণ চিৎকার চেচামেচি করে ক্লান্ত তিতিক্ষা ঢলে পরল বোনের গায়ে। তিহা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এই ঘুমের জন্যই অপেক্ষা করছিল সে। তিতিক্ষার এই ঘুম এখন আর সহজে ভাঙবে না। এসব পাগলামির অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ে সবসময়। তার সেই ঘুম তখন খুব প্রশান্তি দায়ক হয়।
তিহা গলা ছেড়ে আকবরের মা কে ঘর পরিষ্কার করতে ডাকল। দুজন মিলে তারপর তিতিক্ষাকে শোয়াল বিছানায় নিয়ে।
মাস চারেক হল আকবরের মা কে কাজে রাখা হয়েছে। তিতিক্ষার সেবাযত্ন একা করে সংসারের বাকি কাজ তিহা কুলিয়ে উঠতে পারে না। সেজন্যই নতুন লোক রাখা।
আকবরের মা বয়স্ক মহিলা। ষাটের ওপর বয়েস। তবুও এখনো যথেষ্ট মজবুত তার শরীরের গড়ন। তিনি তিতিক্ষার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আফসোস করে বললেন, ‘ কি করছে মুখটারে খামছাইয়া দেহেন। মাটির মধ্যেও থোকা থোকা চুল পইরা আছে। নিজের চুল নিজে ছিইড়া, নিজেরে খামছাইয়া কি পায় মাইয়া, হেই জানে! মা মরা মাইয়া, জীবনে কি হয়া গেল!’
কথা শেষ করে আকবরের মা তাকাল তিহার দিকে। দেখল তিহা অসহায়ের মত চেয়ে আছে বোনের দিকে। আর কি করবে সে? চেষ্টার কোন ত্রুটি তো সে রাখেনি। আর কি বাকি?

সেদিন সারাদিন নিনাদ অসংখ্য বার কল করল তিহাকে। তাকে না পেয়ে একসময় রওশানকেও কল করল। কেউ তার ফোন তুলল না।

মাঝরাতে নিনাদ তখন একা জেগে বসে। মনে নানা অশুভ ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। কি হতে পারে, কি এমন হতে পারে তিতিক্ষার?
তিহার কল এল তখন। প্রথমেই সে জিগ্যেস করল,’ এখনো জেগে বসে আছিস জানার জন্য? না? সেই আগের মত বেহায়াই রয়ে গেলি তুই। বলতে না চাইলেও…’
-‘ওসব কথা ছাড়। কি হয়েছে সেটা আগে আমাকে বল।’
তিহা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর বলতে শুরু করল তার জীবনের সবচেয়ে অপছন্দনীয় দুঃখ গাঁথা।

নিনাদ দেশ ছেড়ে আসার পর পরই তিতিক্ষার ভালো কিছু বিয়ের সম্মন্ধ এসেছিল। এর মধ্যে একটা সম্মন্ধ খুবই ভালো। মারুফ সাহেবের ভারি পছন্দ হল সেই ছেলে আর তার পরিবারকে। তিতিক্ষাও কি দেখে যেন রাজি হয়ে গেল বিয়েতে। ছেলে কলেজের প্রফেসার, বাবাও মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন এককালে। বাড়িতে শুধু ছোট অবিবাহিত এক বোন আর মা। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল। তিতিক্ষার ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়েটা ঘরোয়া ভাবেই হবে ঠিক হল। সবকিছু ভালোই চলছিল। গণ্ডগোল টা শুরু হল বিয়ের দিন সকালে। সব কাজের দায়িত্ব একা সামলাতে হচ্ছিল তিহাকে। তাই তিতিক্ষার দিকে নজর দেয়ার সময় সে পায় নি। বিয়ের দিন সকালে সবাইকে সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তিতিক্ষার ঘরে এসে সে প্রথম খেয়াল করল তিতিক্ষা ঘরে নেই। তার ফোন, বোরকা সবকিছু ঘরেই রয়েছে। কিন্তু তিতিক্ষার দেখা নেই কোথাও। তিহা বেশি ভাবল না। বোরকা ছাড়া তিতিক্ষার কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। অতএব সে আশে পাশেই হয়ত কোথাও আছে। এদিকে সব কাজকর্ম চলতে লাগল। তিহা এতবড় কথাটা ভুলে গেল কাজের চাপে। বেলা বাড়লে তার খেয়াল হল। তিতিক্ষার ঘরে এসে দেখল তখনো ঘর ফাঁকা। তিতিক্ষা আসে নি। সে ভয়ে ভয়ে মৃদু আশংকায় কথাটা বাবাকে জানাল। তারপর কাছের যে দু’একজন আত্মীয়স্বজন এসেছিল বিয়েতে, তারা শুদ্ধু খোঁজ চলল। পুরো বাড়ির কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তিতিক্ষাকে। তিহার ভেতর ভয় ঢুকে পরল। কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। অথচ কি হতে পারে তার ধারনা পর্যন্ত করতে সে পারল না। তার বুক কাঁপতে লাগল। তিতিক্ষা রোজ ফজরের নামাজের পর বাইরে হাঁটতে যেত। আজও গিয়েছিল। তিহার হঠাৎ মনে পরল ভোরে বাইরের দরজা খোলার শব্দ সে শুনেছিল। কিন্তু তারপর তিতিক্ষার ফিরে আসার আর কোন আওয়াজ বা ইঙ্গিত সে পায়নি।

দুপুর হয়ে এল। বরযাত্রীরাও চলে এল। তাদের সংখ্যা বেশি নয়। বর, তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন মিলে চল্লিশ জনের মত হবে।
মারুফ সাহেব আর তিহা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন শুধু। মেয়েটা এতক্ষণ ধরে নিখোঁজ। অথচ বিয়ে বাড়িতে বদনাম রটবে বলে পুলিশে পর্যন্ত জানাতে পারছেন না। তাছাড়া চব্বিশ ঘণ্টার আগে পুলিশও কোন ব্যাবস্থা নেবে না। আশেপাশেও সব জায়গায় খোঁজ করা হয়েছে। এখন তবে কি উপায়?

বরের মা, বোন যখন বারবার কনে কে দেখতে চেয়েও দেখতে পেলেন না, আর তারপর তিতিক্ষার নিখোঁজ হবার কথাটাও যখন আস্তে আস্তে একান সেকান হতে লাগল তখন তারা ব্যাপার টা গুরুতর ভাবেই নিলেন। জেরা করতে শুরু করলেন তিহা ও মারুফ সাহেবকে। ঠিক সেসময় বাড়ির সামনে একটা মাইক্রো এসে থামল। মাইক্রো থেকে প্রথম যে ব্যাক্তিটি নামল তাকে দেখেই তিহার সারা শরীর কেঁপে উঠল একবার। সে বুঝল এবার সব সম্ভব হতে পারে। তার বোনের খুন, অপহরণ, কিংবা এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু। সব এখন হতে পারে। এই ছেলেকে সে চেনে। রাজন স্কুল জীবন থেকে তিতিক্ষা কে কিভাবে হয়রানি করে আসছে সব তার জানা। কতবার নিনাদ শাসিয়েছে তাকে। কোন লাভ হয়নি।
তিহার নিজের ওপরই রাগ হল। রাজনের কথাটা কেন সে একবারও ভাবে নি। একে তো তিতিক্ষার বিয়ে দিতে যাচ্ছিল তারা, তার ওপর নিনাদ এখানে নেই। রাজন যে কিছু একটা করবেই, কেন এই কথাটা মাথায় আসে নি তাদের। এলাকার সমস্ত মারামারি, খুনোখুনি, যত অপরাধ সবকিছুতেই তো সবসময় সরব ছিল এই রাজন। তবুও রাজনকে কেন সে একটুও ভয় পায় নি।
রাজনের পর পরই গাড়ি থেকে নামলেন তার বাবা। তিনি একেবারে সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালেন। পেছন পেছন সুবিশাল দেহ, হিংস্র মুখ নিয়ে রাজন অপরাধীর মত মুখ করে এসে বাবার পেছনে দাঁড়াল। তারপর এল রাজনের বাবার জনাকতক চেলা ও এলাকার কিছু বিশিষ্ট জনেরা। রাজনের বাবা অত্র এলাকার মেয়র, অতন্ত্য ক্ষমতাশালী ব্যাক্তি। জনসমাগম তাই এত বেশি। তিনিই প্রথম কথা শুরু করলেন। নিরীহ মুখ করে মারুফ সাহেবকে বললেন, ‘মারুফ সাহেব, পুলাপানে তো ভুল ত্রুটি করবই। আমগর পিতামাতার কাজ হইল ক্ষমা কইরা দেওয়া। নিজের সন্তানের সাথে আমাগর কোনদিন বন্ধুত্ব হইতে পারে না বইলাই তারা ভুল পথ বাইছা নেয়। আমাদের দায়ও এইক্ষেত্রে অস্বীকার করা যায় না। তারা পুলাপান, বুঝে নাই, একটা ভুল কইরা ফালছে। আমার টারে আমি মাফ করছি, এইবার আপনের টারে আপনি মাফ কইরা দেন।’
মারুফ সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। তার ওমন মেয়ে কি এমন মারাত্মক ভুল করতে পারে তিনি ভেবে পেলেন না।
বরের বাবা-মা অনেকক্ষণ থেকেই একটা গুঞ্জরন শুনছিল। এবার তারা গর্জে উঠল। বরের বাবা বললেন, ‘কি বলছেন আপনি? ওনার মেয়ে কি ভুল করেছে?’
রাজনের বাবা ফের নিরীহ গলায় বললেন, ‘ও, আপনি বুঝি মারুফ সাহেবের হবু বেয়ান আছিলেন? তা কি কইবেন। বিয়াডা তো আর আপনাগো পোলার লগে হইল না। কি আর কমু ভাইসাব। পুলাপানের খেয়াল বুঝেন না? বাপে মাইয়ার মত না নিয়াই বিয়া ঠিক করছিল। মাইয়া মানতে না পাইরা রাইত বিরাইতে পালায়া আমার ছেলের কাছে গিয়া উঠছে। দুইজন দুইজনরে মহব্বত করে কিনা। আর আমার ছেলে, বুঝেন ই তো সেও পুলাপান মানুষ। তারা দুইজনে একটা ভুল কইরা ফালাইছে। যাক, এই বয়সে এমন ভুল অনেকেই করে। বয়সের দোষ। এহন কাজী ডাকায়া ওদের একটা বিয়া পড়ায়া দিলেই হয়।’
রাজনের বাবার কথা শেষ হওয়া মাত্র চারিদিকে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। মুহূর্তেই অসংখ্য খারাপ মন্তব্য ভেসে আসতে শুধু করল ভীর থেকে। সে সবই তিতিক্ষার নামে। তারপরের কথা বলাই বাহুল্য। বরপক্ষ মারুফ সাহেবের কোনোরকম কৈফিয়ত শুনতে নারাজ। তারা আজ নিজের চোখেই দেখেছেন মেয়ে নিখোঁজ, বাপ বোনেরও মুখে রা নেই। অতএব তারা বর কে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হল। তিহা চিৎকার করে বারবার সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করল এই সব নাটক। সবই সাজানো। তিতিক্ষা নিখোঁজ হয়েছে ভোর থেকে। তাহলে রাতে সে কিভাবে রাজনের কাছে যায়? কেউ শুনল না তার কথা। উল্টো তিতিক্ষার বদনামই বাড়তে লাগল ক্রমে ক্রমে। বরপক্ষ চলে যাচ্ছে, আশেপাশের শোরগোলও ক্রমেই বেড়ে উঠছে দেখে তিহা এবার হুশ জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত দৌড়ে গিয়ে রাজনের কলার চেপে ধরল। চিৎকার করে বলল, ‘আমার বোন কোথায়?’ রাজন মৃদু হেসে কলার থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে চলে গেল গাড়ির দিকে। ফিরে এল তিতিক্ষা কে নিয়ে। হাটার অবস্থায় সে নেই। টেনে হিচড়ে নিয়ে আসতে হল তাকে। তার সারা শরীরে অসংখ্য খামছি, আঁচড়ের দাগ, ছোপ ছোপ রক্তে মাখা জামাকাপড়। গায়ে ওড়নাটাও ঠিকমতো জড়ানো নেই। সেদিকে কেউ নজর দিল না । তাকে দেখে কেবল ক্রুদ্ধ জনস্রোত আরও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে লাগল। অসংখ্য নোংরা কথা আর অপবাদে ভরিয়ে দিতে লাগল তারা বিয়ে বাড়ির উঠোনকে। নিজেদের রাগের সবটুকু প্রকাশ করে অতঃপর তারা আস্তে আস্তে বাড়ি ছাড়ল।
রাজনের বাবা তখন বললেন, ‘তাইলে বিয়াটা….। ‘
তিহা বোনকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে বসে ছিল। সে চেচিয়ে বলল,’ আপনি আর আপনার ছেলেকে জেলের ভাত খাওয়াব আমি। যান এখান থেকে। আমি খুনোখুনি বাঁধানোর আগেই বেরিয়ে যান।’
সাথে সাথে নাটকীয় ভাবে মুখভঙ্গি পালটে গেল রাজনের পিতার। তিনি তাচ্ছিল্য ভরে হেসে উঠলেন। কথা না বাড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন। যাওয়ার আগে রাজনের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘এসে পরো রাজু। খেলা শেষ। তুমি যা চেয়েছিল তা তো পেয়েছই।’
বাবা চলে গেলে রাজন একবার সেদিকে দেখে নিয়ে তিহার দিকে ফিরল। তারপর হাটু গেরে বসল তিহার সামনে। তিতিক্ষার নিস্পন্দ মুখ একবার দেখে নিয়ে ফিসফিস করে তিহাকে বলল,’ তোর বোনকে বিয়ে দে এবার দেখি। সে তো এখন সবার কাছে একটা বে*। এখন না আমি তাকে বিয়ে করব আর না অন্য কেউ। ‘বলে বিকৃত একটা হাসি দিয়ে সে চলে গেল।
সেই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত তিতিক্ষা কাঁদছিল। নিজেকে নিয়ে রাজনের শেষ কথাটা শুনে সে একবার একটু কেঁপে উঠেছিল শুধু। তারপর নিস্তেজ হয়ে গেল। সেই থেকে আজও সে আর প্রাণ ফিরে পায় নি।

একবার এক গহীন বনমধ্যে লোকচক্ষুর আড়ালে স্বচ্ছ সরোবরে একটি পদ্মফুল ফুটেছিল। অহোরাত্রি হাজারো সর্প তাকে পাহারা দিত।কোনদিন কোনো মনষ্যচক্ষু তাকে দেখেনি। সেই পদ্মফুলের উজ্জ্বল কান্তিতে আলোকিত হত যেন অরণ্যপ্রভা। হঠাৎ একদিন কোথা থেকে এক হিংস্র শ্বাপদের আগমন ঘটলো। গভীর অরণ্য মধ্য হতে সে এসে পদ্মফুলের শোভা দেখে থমকে গেল। লোভে চকচক করে উঠল তার চোখজোড়া সেই উজ্জ্বল কান্তি পদ্মফুল দেখে। অতঃপর নিজের তীক্ষ্ণ ধারালো নখ দিয়ে সকল প্রহরিণী সর্পকে হত্যা করে সে অবশেষে নাগাল পেল পদ্মফুলের। দুমড়ে মুচড়ে বিধস্ত করে ফেলল সেই ফুল টিকে। একে একে সবগুলো পাপড়ি ঝড়ে পরল ফুলের। গহীন অরণ্য মধ্যে কি ঘটে গেল কেউ জানল না। কেউ কি আছে যে সেই পদ্ম ফুলের দুঃখ বোঝে? বুঝলে সে জানতো কেন মরনও সেই যন্ত্রণার চেয়ে বেশি কাম্য। যেমন তিতিক্ষা জানে।
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here