দূর আলাপন পর্ব ১২

#দূর_আলাপন
পর্ব-১২
অদ্রিজা আশয়ারী
______________
নিনাদ জানিয়েছিল সে ফিরবে একমাস পর। এর মধ্যেই শিউলি বেগম নিনাদের বাড়ির তালা খুলে সেখানে উঠেছেন। এবার আর দেরি নয়। মেয়ে পছন্দ করাই আছে। তিনি এদিকে সব গুছিয়ে রাখবেন। নিনাদ এলে কোনরকম দেরি না করে তাকে তিন কবুল পড়িয়ে দেয়া হবে। শিউলি বেগমের সাথে এবারেও এসেছে আফরিন। নিনাদ ভাইয়ের বিয়ে অথচ সে থাকবে না। এমন কি হতে পারে কখনো!

শিউলি বেগম আর আফরিন ঢাকায় এসে একটু ধীর স্থির হয়েই ঠিক করলেন তিতিক্ষাদের ওখানে যাবেন। তিহার সাথে নিনাদের খাদহীন অসীম সখ্যতা তাদের অজানা নয়। নিনাদের বিয়ের ব্যাপারে তিহার পরামর্শ নেয়া তাই উচিতই বটে। এক বিকেলে তারা তাই তিহাকে খবর দিয়ে বেড়িয়ে পরলেন তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

___________________

তখন মধ্যদুপুর। জোহরের সালাত শেষে তিতিক্ষা কুরআন তিলাওয়াতে বসেছিল। বৈশাখের উত্তপ্ত দিনগুলো কেটে যাচ্ছে সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে। শিথিল সবকিছু। জীবন, জীবনের খেয়াল আর তার গতি। দুপুরের কড়া নীল রোদ হেলে পড়ে বারান্দায়। দোরে বসে থাকা তিতিক্ষার গায়ে মাঝে মাঝে সে রোদ ছুঁয়ে যায়। তিতিক্ষার সেদিকে মনোযোগ নেই। সে একমনে সুর তুলে পড়ে যায় কুরআন শরীফ। মাঝে মাঝে মুখ শুকিয়ে এলে কেবল দু’দন্ড থেমে একটু বাইরে নজর দেয়। দায়সারা ভাবে তাকায় বারান্দায় তিড়িংবিড়িং নেচে, অনবরত কিচিরমিচির করতে থাকা চড়ুই গুলোর দিকে। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার এই ভীষণ উপেক্ষা বোধহয় চড়ুই দলের পছন্দ হয় না। তারা আরও জোড়ালো ভাবে কিচিরমিচির চেঁচাতে থাকে। তিতিক্ষা আর ফিরেও তাকায় না সেদিকে। কি নিষ্ঠুর পাষাণ মন ওর!
একসময় পড়া বন্ধ করে ওপরে বইয়ের তাকে কুরআন শরীফ রেখে সে মেঝেতে এসে চুপচাপ শুয়ে পরে। ঠান্ডা মেঝেতে শরীর এলিয়ে দিয়ে খুব ধীরে ধীরে শ্রান্তির নিশ্বাস ছাড়ে। চোখ বুজে পরে থাকে অনেকক্ষণ। তিহা এসে তার এই অবিমিশ্র তন্দ্রার মাঝে বাঁধা দেয়। পাশে মেঝেতে বসে কোলের ওপর তিতিক্ষার মাথা তুলে নিয়ে মাথায় মৃদু হাত চালাতে চালাতে তাকে নিচু স্বরে ডাকতে থাকে। তিতিক্ষা চোখ তুলে তাকাতেই মাথার ওপর ঝুঁকে থাকা তিহার মলিন মুখে হাসি ফুটে ওঠে। হাতে থাকা ক্রিমটা সে লাগাতে শুরু করে তিতিক্ষার মুখের ক্ষতস্থান গুলোতে। তিতিক্ষা একটু নড়েচড়ে ওঠে।
-‘জ্বালা করছে?’ হাসিমাখা মুখেই তিহা জানতে চায়।
-‘না’
-‘আজ একটু বোনের বাধ্য হয়ে থাকতে হবে। একদম পাগলামি করা যাবে না। মনে থাকবে তো? ‘
তিতিক্ষার সারা মুখে একটা মৃদু হাসির আভা ছড়িয়ে পরে। ‘আমি তোমায় খুব অত্যাচার করি। তাই না বুবু?’
উত্তর না পেয়ে সে আবারও বলে,’ আমার জন্য তোমার অনেক… ‘
তিহা তাকে থামিয়ে দেয়। ‘এমন অত্যাচার তুই আমাকে সারাজীবন কর। তবুও তুই একটু ভালো থাক। আল্লাহ জানেন, এর বেশি আর কিছুই আমি চাই না কখনো। ‘
-‘তোমার আশা বোধহয় পূর্ণ হবে। কারণ যতদিন এভাবে তোমাকে আমি অত্যাচার করব ততদিন সুস্থ থাকব আমি। এ অত্যাচার শেষ হলে এই জীবনের কল ঘোরাও থেমে যাবে। ‘
-‘বাজে কথা বলবি না। কিছু হবে না তোর। আমি আছি না! তোর সব বিপদে দেয়াল হয়ে দাঁড়াব।’
-‘সে তো দাঁড়িয়েছই! দিনরাত লোকের এত শত নিন্দা, অপমান। আমার হয়ে সব একার ঘাড়ে নিচ্ছ। আমি পর্যন্ত পৌছানোর আগেই সব কটু কথাকে আটকে ফেলছ জালে। কিছুই তো বাদ রাখনি তুমি।’
তিতিক্ষা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে,’ তবুও কথাগুলো আমার কানে পৌঁছে যায়। কষ্ট হয়। মানুষ শুধু সেটুকুই বিশ্বাস করে যেটুকু তারা দেখে। অদেখা অনেক কিছুই যে সত্যি হতে পারে তারা সেকথা মানতে নারাজ। একসময় আমাকে তারা আর দশটা মেয়ের আদর্শ বলে স্বীকার করত অনায়াসে। যখন সব আধুনিকার মাঝে একা আমি ছিলাম অন্তঃপুরবাসিনী। এখন আমাকে তারা মেয়ে জাতের কলঙ্ক বলেও স্বীকার করে অনায়াসে। যখন তাদের সামনে অভিসারিণী বলে প্রমানিত হলাম আমি। হায়রে সমাজ! এই সমাজ, যাকে আমি কখনো পরোয়া করিনি আমার সুখের দিনে। তবে কি তারা ভেবেছে আমার দুঃখের দিনে আমি তাদের পা ধরে থাকব? কখনো না। সমাজকে আমি পরোয়া করি না আজও। আমার সুখও দ্বীন, আমার দুঃখও দ্বীন। এই সমাজে আমি শুধু আর পাঁচ দশটা উপাদানের মত একটা উপাদান মাত্র।
তুমি কখনো ভেবোনা বুবু, সমাজের ভয়ে আমি ভীত, তাই নিজেকে গুটিয়ে রাখি। সেই ভয় থাকলে লজ্জায়, অপমানে কবেই মরে যেতাম আমি! আমি শুধু আমার সেই আল্লাহরই ভয় করি। আমার গায়ে শত কলঙ্ক জড়ালেও যিনি জানেন আমি নিরপরাধ, পবিত্র।’
তিহা প্রচন্ড আবেগে বিগলিত হয়ে বোনের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। চোখ বেয়ে তার ঝরঝর করে পানি পড়ছে। সে চাপা স্বরে আদ্র ভাবে বলে,’ আমি জানি বোন। আমি জানি। আমার বনু সবার চেয়ে আলাদা। কে এমন আছে যে তার মত ভাবতে পারে? তার মত ধৈর্য, সংযম কার আছে? সেজন্যই আল্লাহ তোকে পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিচ্ছেন। আগুনে পুড়েই তো সোনা খাটি হয়। যেদিন তোর এই দুঃখ শেষ হবে, সব কষ্ট থমকে যাবে। সেদিন দেখবি তুই একজন দারুণ মানুষে পরিনত হয়েছিস। আজ যারা তোর নিন্দার সুতো বুনছে দিনরাত, তারা সেদিন তোকে দেখে হিংসে করবে। ‘
-‘এমন দিন আমি বেঁচে থাকতে কখনো না আসুক বুবু। দুনিয়ার জন্য আমার আর কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। দারুণ মানুষ আমি যেন শুধু আমার আল্লাহর বিচারে হতে পারি।’
তিহা বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। এত সুন্দর করে কথা বলা কোথা থেকে শিখেছে মেয়েটা? ছোট বেলা থেকেই তো সে ছিল ভয়ানক গম্ভীর। ছোট বেলায় সে যখন দিনরাত চুপচাপ বসে থাকত একা একা। একটি প্রশ্নের উত্তর শুধু একটি শব্দেই দিত। তখন মাঝে মাঝে এভাবেই খুব সুন্দর করে কিছু কথা সে বলত। তার সেসব অল্প কিন্তু আকর্ষণীয় কথা শোনার জন্য বাবা চাতক পাখির মত অপেক্ষা করে থাকতেন। সে কথা বললে বাবা চোখ বড় বড় করে তৃষার্তের মত সেসব কথা গিলতেন শুধু। আর বাবার চোখ বেয়ে পানি ঝরে পরত। বাবা যে তখন মায়ের পূর্ণ ছায়াই দেখতে পেতেন নিজের মেয়ের মাঝে। যেন তিনি মা’কেই দেখছেন।

কিন্তু তিতিক্ষার মাঝে মায়ের ছায়া এত প্রবল হল কি করে? কিছু বোঝার মত বয়স হবার আগেই তো সে হারিয়েছিল মা কে। তবুও মায়ের সেই দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা, সেই একগুঁয়ে স্বভাব, রেগে যাওয়া কপালের সেই বক্র ভ্রুকুঞ্চন! সবই পেয়েছে সে। পরিপূর্ণ ভাবেই পেয়েছে। তিতিক্ষা যখন রেগে যায়, তখন তাকে দেখে তিহার সত্যি ভয় হয়। কারণ তখন সে যে শুধু তিতিক্ষা থাকে না, সে হয়ে ওঠে তার মা আয়েশা রেহনুমার কায়া। যেই মা মারা যাওয়ার আগে তার কোলে আড়াই বছরের তিতিক্ষা কে তুলে দিয়ে বলেছিলেন,
‘ওকে তোর কাছে আমানত রেখে গেলাম। আজ থেকে তুই ওর মা। এতদিন যে স্নেহ দিয়ে আমি তোকে বড় করেছি, সেই স্নেহটুকু তুই ওকে দিস। আজ থেকে তোর দুটো সন্তান। এক তিতিক্ষা আর এক তোর বাবা। দুজনেই অবুঝ, দুজনেই নিরীহ। এতদিন আমি ওদের সামলে এসেছি। এবার তুই ওদের দেখিস।’
তিহার ভাবনার জাল ছিড়ে যায়। সে স্বপ্নাবিষ্টের মত তাকিয়ে থাকে তিতিক্ষার মুখের দিকে। তারপর একসময় চোখ সরিয়ে নেয়। ওপরের দিকে মুখ তুলে, বোনের মাথা কোলে নিয়েই সে হঠাৎ একসময় কাঁদতে শুরু করে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে অনবরত বলতে থাকে, ‘আমি পারিনি। আম্মা আমি পারিনি। তোমার আমানতের হেফাজত করতে আমি পারি নি। সব কিছু আমার চোখের সামনেই ঘটে গেছে। আমি থামাতে পারিনি। তুমি আমাকে মাফ করে দিও আম্মা। আমাকে তুমি মাফ করে দিও।’
তিতিক্ষা লাফিয়ে উঠে বসে। চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে তার বোনের দিকে। চোখের সামনে বোনকে হাউ মাউ করে কাঁদতে দেখে আবার গুলিতে যেতে থাকে তার মাথা। দেহ জুড়ে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। কান্নার শব্দের তীক্ষ্ণতা মাথায় গিয়ে আঘাত করে। সে অসহায় মুখে বোনের দিকে তাকিয়ে ব্যাস্ত স্বরে বলে, ‘কি হয়েছে তোমার বুবু? তুমি এভাবে কেন কাঁদছ? ওরা কি তোমাকেও বাজে কথা বলেছে? ওরা… ওরা তো সবসময় এমন বলে। তুমি কেঁদো না। আমাকেও তো রাতদিন বলে। কই, তাই বলে আমি কি কাঁদি সবসময়?’
কান্নার বেগে তিহার কথা হারিয়ে যায়। সে বোনকে দু’হাতে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে। মাথায় এলোমেলো চুমু খেয়ে বলে, ‘আমাকে মাফ করে দিস বনু। এত দামি সম্পদটা আমি হেফাজত করতে পারলাম না। তোকে আমি বাচাঁতে পারলাম না। আম্মা বেচে থাকলে কোনদিন তোর এত বড় সর্বনাশ হতে দিত না। আমি ব্যার্থ। আমাকে মাফ করে দিস। ‘

তিহা ফের কাঁদতে থাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। যে কথা বলতে সে এখানে এসেছিল তা আর বলা হয়ে ওঠে না। বিকেলে শিউলি বেগম আর আফরিন আসবে আজ। তিতিক্ষার এসব ব্যাপার কোনকিছুই তারা জানে না। তিতিক্ষা কে তাই বুঝিয়ে শুনিয়ে আজ বিকেল টা শান্ত থাকার জন্য বলতেই সে এসেছিল।

_____________________

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শিউলি বেগম ফের একবার নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখলেন। বিরক্তিতে কপাল কুচকে গেল তার। শিউলি বেগমের গায়ে জড়ানো কালো বোরকা , তার ওপর সুতির একটা সাদা ওড়না। হাতে কালো ঘড়ি। গ্রামের মেয়ে হলেও তিনি যথেষ্ট আধুনিকা। বিকেল তো প্রায় গড়িয়েই গেল। আর কখন যাওয়া হবে তিতিক্ষাদের বাড়ি? এদিকে আফরিনের সাজগোছ চলছেই। তাছাড়া ঢাকা শহর কতটুকই বা তিনি চেনেন। যেটুকু চেনেন, সন্ধ্যা নেমে গেলে অন্ধকারে সেটুকুও গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে। চরম বিরক্ত হয়ে শিউলি বেগম এবার আফরিনকে ডাকলেন। ফুআম্মার ডাক শুনে আফরিন এবার তাড়াহুড়ো করে চাবি হাতে বেরিয়ে এল। বাইরে বেরিয়ে এসে দরজায় তালা লাগাতে উদ্যত হল সে। শিউলি বেগম আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন আফরিনকে। গাঢ় নীল জমিনের ওপর সাদা, গোলাপি নকশা তোলা শাড়িতে মেয়েটাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। তার দুহাত ভর্তি সাদা নীল রেশমি চুড়ি। মাথার পেছন দিকে একটা নিখুঁত সুন্দর খোঁপা গাথা। সে মিটিমিটি হাসছে। যখন থেকে ওবাড়ি যাওয়ার জন্য সাজগোছ শুরু করেছে, তখন থেকেই সে এভাবে অনবরত মিটিমিটি হেসে চলেছে। নিনাদকে তার বিয়ের ব্যাপার টা ওবাড়ির কাউকে জানাতে বারন করেছিল সে। আজ আফরিন ঠিক করেছে নতুন বউদের মত খুব সেজে ওবাড়ি গিয়ে বিয়ের খবরটা সবাইকে জানিয়ে চমকে দেবে একদম।
শিউলি বেগম গম্ভীর হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘হইসে অত নিটকাইস না। বিয়াইত্তা মাইয়া। কোনো লাজ শরম নাই। নিজের বিয়ার খবর নিজে ঢাকঢোল পিটায়া কইবার খুশিতে নিটকাইতাসে কেমনে দেহো! পিড়িত কইরা তো মিনহাইজ্জার মাথাডা খাইসস। সাথে কি এহন নিজের লাজ শরমও গিইলা খাইসস? চল এহন।’
ফুআম্মার কাছে একটা রাম ধমক খেয়েও আফরিনের হাসি মুখ মলিন হল না। শিউলি বেগমের পিছু পিছু রাস্তায় বেরিয়েও সে তার নির্লজ্জ হাসি বহাল রাখল মুখে।

বাড়ির দরজায় শিউলি বেগমকে দেখে বহুদিন পর খুশিতে ভরে উঠল তিহার মুখ। আফরিনকে দেখে সে একঝলক হাসল। তারপর সালাম জানিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াল শিউলি বেগমের। তিনি তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
-‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছোছ তুই? তোর বুড়াটা কই?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। বুড়া কই আবার? আছে এখানেই। অনেকদিন পর এলেন তো। লজ্জা পাচ্ছে। তাই ভদ্রতা দেখিয়ে একটু আড়ালে আছে আরকি। লজ্জা ভাঙলে দুমিনিট পরেই দেখবেন কেমন লাফিয়ে মাথায় উঠে নাচবে! এখানে এসে বসুন ফুআম্মা। আফরিন ভেতরে এসো তুমি।’
আফরিন সলজ্জ হেসে শিউলি বেগমের পাশে সোফায় এসে বসল। তিহা তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল,’ বাহ আফরিন, তোমাকে তো একদম নতুন বউয়ের মত দেখাচ্ছে! বিয়ের রেশ বুঝি এখনো তোমার কাটে নি? ‘
আফরিন চমকে তাকাল তিহার দিকে। তার এত বারণের পরও নিনাদ ভাই তাহলে এদেরকে বলে দিয়েছে বিয়ের ব্যাপার টা! সে বাচ্চাদের মত ভ্রুকুটি করে গোমড়া মুখে বলল,’ ধ্যাৎ! আমি ভাবছিলাম সারপ্রাইজ দিমু আপনেগো। নিনাদ ভাই সমসময় এমন করে আমার সাথে। দেখছ চাচি। নিনাদ ভাই ঠিকি কয়া দিসে তাগোরে। আমি আর কথাই কমু না তার লগে। হুহ্! ‘
আফরিনের ছেলেমানুষী দেখে তিহা মনে মনে হাসল।’তুমি রাগ করো না আফরিন। নিনাদটা কেমন মাথা মোটা জানো না? ওর কি কিছু খেয়াল থাকে? ‘
নিনাদকে মাথা মোটা বলায় আফরিন সহসা অতন্ত্য আনন্দিত হল। ওপর নিচ মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক কইছেন আপনে। নিনাদ ভাইয়ের মাথা পুরাডাই গোবর পোড়া। আইচ্ছা থাউক। মাফ কইরা দিলাম তারে।’
শিউলি বেগম কটমট করে তাকালেন আফরিনের দিকে। ‘বেত্তমিজ মাইয়া চুপ কর। সামনে তো আমার নিনাইদ্দারে বাঘের মত ডরাস। আর পিছনে বয়া এমনে বেত্তমিজি করস? আয়ুক এইবারে নিনাইদ্দা। তোর অনেকটি মাইর জমছে এইবার। বিয়া অইসে দেইখা কি হইছে? মাফ পাইবি ভাবসস?’
শিউলি বেগমের শাসানিতে একটু ভয় পেল আফরিন। ছটফটানি বন্ধ করে সে স্থির রইল খানিকক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে আবার আগের রূপে ফিরে যেতে লাগল একটু একটু করে। ততক্ষনে ছোটনও এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। তিহা শিউলি বেগমকে ‘ আসছি আমি’ বলে পা বাড়াচ্ছিল রান্নাঘরের দিকে। আশেপাশে নিজের কৌতুহলী চোখটা বুলিয়ে নিয়ে শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে আফরিন তাকে পিছু ডাকল তখন ।’আপু শুনেন, ছোট আপু কই? ওনারে যে এহনো দেখলাম না?’

তিহার পা জোড়া থেমে গেল। সে জানত আজ অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। উত্তরও তার তৈরিই ছিল। সে ঘুরে দাঁড়াল।’তুমি বসো আফরিন। কি আর বলব বল। সেবার তুমি, ফুআম্মা এলে। তখনো তিতিক্ষা সুস্থ ছিল না পুরোপুরি। পা গেছিল মচকে। এবারেও সে পুরোপুরি সুস্থ নেই। কয়েকমাস আগে একটা এক্সিডেন্ট হল, তার ওপর বিয়েটাও ভেঙে গেল তখনই। শারীরিক মানসিক দু’ভাবেই সে খানিক অসুস্থ এখনো। একটু পর নিয়ে যাব তোমাকে ওর সাথে দেখা করাতে। তুমি বসো। আমি আসছি এখনি।’ শিউলি বেগম কিংবা আফরিন, কাউকেই আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে তিহা পালিয়ে বাঁচল সেখানে থেকে।

সেবার খুব ভাব হয়েছিল আফরিন আর ছোটনের মাঝে। সেই ভাবের রেশ ধরে এবারেও আড্ডা জমল তাদের। আফরিন তাদের বাড়িতে ঘটে যাওয়া নানান অদ্ভুত ভূতুড়ে ঘটনা বলতে লাগল ছোটনকে। শ্রোতা হিশেবে ছোটনও বেশ। অতএব তাদের কথা জমে উঠতে সময় লাগল না।
চায়ে চুমুক দিয়ে শিউলি বেগম তখন নিনাদের বিয়ে নিয়ে আলাপ জুড়েছেন তিহার সাথে। এ বিষয়ের আলোচনায় তিহারও প্রবল উৎসাহ। মারুফ সাহেব গেছেন বাজারে। নিজের ঘরে শুধু তিতিক্ষাই একা বসে। কিছুক্ষণের জন্য সে ছাড়া তারা সকলেই তখন ভুলে গেল যে বাড়িতে আরও একটি মানুষ রয়েছে। যে অহোরাত্রি নিজ গৃহে স্বইচ্ছায় বন্দিনী। তিহার হুশ ফিরল তখন, যখন ভেতরের ঘরে থাকা ফোনের রিংটোন তার কানে এসে লাগল। শিউলি বেগমকে বলে সেদিকে পা বাড়িয়েছিল সে। ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতেই ফের চলে যাচ্ছিল বসার ঘরে। সহসা তার নজর পরল তিতিক্ষার ঘরের দরজায়। দরজার ফাঁকে একটা কাপড়ের অংশ দেখা যাচ্ছে। ফোন কানে চেপেই সেদিকে এগোল তিহা। কাছে গিয়ে দেখল দরজায় হেলান দিয়ে তিতিক্ষা বসে রয়েছে মেঝেতে। তার দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। তার বসে থাকার স্থান থেকে বহু দূরে, বাইরের ওই উঠোনে, যেখানে আফরিন ছোটনের পাশে বসে অনবরত বলে চলেছে নানান কথা। ছোটনকে হাত নেড়ে নেড়ে কীসব বোঝাচ্ছে সে। মুখে তার একটা অনাবিল সুখের হাসি লেগেই রয়েছে।
তিহার কথা থেমে গেল। ওপাশে রওশান তখনো কীসব বলে চলেছে। কিছুই আর কানে গেল না তিহার। সে ফোন নামিয়ে ধীরে ধীরে বোনের পাশে এসে বসে পরল। হাতে মৃদু চাপ দিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কি দেখছিস অমন করে?’
তিতিক্ষা নিশ্চল মূর্তির মত স্থির চোখে সেদিকে চেয়ে সঙ্গিন স্বরে বলল,’ ওর দেহে এত প্রাণ, আমি একটু ধার নেব।’

তিহা একবার কেঁপে উঠল শুধু বোনের কথা শুনে। তার চোখ গড়িয়ে ঝরল জল। উফফ মরণ! আবারও সেই অভিশপ্ত জল!

চলবে………।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here