#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১১
#লেখিকা_Esrat_Ety
সবাই রোদেলা এবং তাশরিফের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা তাশরিফের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে আবারো প্রশ্ন করে,”এখানে কি করছেন আপনি?”
তাশরিফ থ হয়ে গিয়েছে। এটা কি কাকতালীয়? নাকি নাটকের কোনো স্ক্রিপ্ট ঢুকে গিয়েছে তার জীবনের গল্পে। প্রকৃতি কি কোনো না কোনোভাবে তাশরিফের সাথে রোদেলাকে জুড়ে দিতে চাইছে? নইলে আজ এভাবে রোদেলার মুখোমুখি কেনো হবে সে? রোদেলার পরিবর্তে যে কেউ থাকতে পারতো এখানে।
তাশরিফ নিজের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে মিনমিন করে বলে,”আদিল আমার ছোটো ভাই।”
আদিলের পেছন থেকে রাফসান ফিসফিসিয়ে বলে,”এই দেখেছিস তোর ভাইয়াও রোদেলা আপুর সাথে মিনমিন করে কথা বলছে। সেও ভয় পেয়েছে এই মহিলাকে।”
রোদেলা তাশরিফের কথা শুনে একবার আদিলের দিকে তাকায়। চেহারায় বেশ মিল দুজনের। এজন্যই আদিলকে দেখে প্রথম তার খুব চেনা চেনা লেগেছিলো। কয়েক পলক দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কঠিন করে ফেলে সে।
কন্ঠে ক্ষোভ নিয়ে বলে,”আপনার এই অসভ্য ভাই আমার বোনকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করেছে। একে আমি পুলিশে দেবো।”
তারপর বৃষ্টির কাছে গিয়ে আদিলের থেকে বৃষ্টির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,”চল আমার সাথে। বাসায় যাবি।”
বৃষ্টি নিজের যায়গা থেকে একটুও সরেনি। রোদেলা মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। বৃষ্টি কাতর কন্ঠে বলে,”আপু ওকে খুব ভালোবাসি।”
রুহুল আমিন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘলা চেঁচিয়ে ওঠে,”তুই এভাবে বাবাকে,আমাদের না জানিয়ে এতো বড় কাজটা করতে পারলি! এভাবে আমাদের কষ্ট দিলি!”
বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে বলে,”তোমরাই তো আমাকে ভুল বুঝেছিলে, তোমরাই তো বলেছিলে ও নাকি আমাকে কখনো বিয়ে করবে না,তাই তোমাদের দেখানোর জন্যই বিয়ে করেছি।”
রোদেলা পুনরায় স্বশব্দে বৃষ্টির গালে একটা চড় মেরে দেয়। তাশরিফ চমকে ওঠে। এ কোন ভয়ংকরীকে সে পছন্দ করেছে!
আদিল গিয়ে এইবার রোদেলার সামনে দাঁড়ায়। গম্ভীর হয়ে বলে,”অনেক হয়েছে। আপনি আমার বৌকে এভাবে মারতে পারেন না।”
রোদেলা ঠাস করে আদিলের গালেও একটা চড় বসিয়ে দেয়। গালে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আদিল। তাশরিফ নিজের ভাইকে চড় খেতে দেখে কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর আর চুপ থাকতে পারে না, রোদেলার দিকে এগিয়ে এসে বলে,”আমরা একটু বসে কথা বলি চলুন।”
রোদেলা তাশরিফের কথা গায়ে না মেখে বৃষ্টির হাত ধরে টানছে। বৃষ্টি একটুও নড়ছে না যায়গা থেকে। আদিল বৃষ্টিকে আগলে রেখেছে। রোদেলা আবারো গিয়ে আদিলকে আরেকটা চড় মারতে যাবে অমনি তাশরিফ রোদেলার হাত ধরে ফেলে,”আপনি এভাবে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়েকে মারধোর করতে পারেন না।”
রোদেলা তাশরিফের দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে চায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে থাকে,”আমার হাত ছেড়ে দিন নয়তো আপনাকেও চড় মারবো আমি।”
তাশরিফ সাথে সাথে রোদেলার হাত ছেড়ে দেয়। এই ভয়ংকরী তাকে চড় মেরে দিতেও পারে। বিয়ের আগে সে হবু বৌয়ের হাতে চড় খেতে ইচ্ছুক না।
রোদেলা মাথা ঘুরিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকায়।
“তুই যাবি না?”
_আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে আপু।
দৃঢ় ভাবে বলে বৃষ্টি।
রোদেলা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,”ঠিক আছে। তুই থাক । আমিও দেখবো এই নেশা খোরের সাথে ঠিক কদিন সংসার করতে পারিস তুই।”
তাশরিফ গলার স্বর কিছুটা উঁচুতে তুলে বলে,”আমার ভাইকে আপনি নেশা খোর বলছেন কেনো? ওর মতো মেধাবী একটা ছেলেকে আপনি নেশা খোর বলছেন ! নেশা তো দূরে থাক, কখনো একটা সিগারেট খেয়ে দেখেনি আমার ভাই!”
আদিল লজ্জিত ভঙ্গিতে ভাইয়ের দিকে তাকায়। ভাইয়া একটু বাড়িয়ে বলে ফেললো, সে তো সিগারেট খায়। ভাইয়া আর সে একসাথে বসেই তো প্রায়ই সিগারেট খায়।
রুহুল আমিন নীরবতা ভেঙে রোদেলাকে ডেকে ওঠে,”রোদেলা। এতো চেঁচামেচি করিস না। লোকজন হাসছে। চল বাড়িতে চল।”
বৃষ্টি তার বাবার দিকে তাকায়। রোদেলা এসে রুহুল আমিনের হাত ধরে। রুহুল আমিন বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”ভালো থাকিস মা।”
বৃষ্টির চোখ দুটো ভিজে ওঠে। তার ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে বাবার পায়ে পরে যেতে।
রোদেলা বৃষ্টির দিকে তাকায়। কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে মেঘলাকে বলে,”আপু চলো। এখানে আমাদের থেকেও ওর অনেক আপনজন হয়েছে। আমাদের এখানে আর থাকার প্রয়োজন নেই।”
তাশরিফ রোদেলাকে আটকায়,”শুনুন। বাচ্চা মানুষ ওরা, ঝোঁকের মাথায় ভুল করেছে। তাই বলে আমাদের কি মুখ ফিরিয়ে থাকা উচিত বলুন? চলুন আমরা বসে কথা বলি।”
_আপনি অফিসে আমার বস হতে পারেন, এখানে না। তাই আমাকে কোনো জ্ঞান দিতে আসবেন না। আপনাদের বাড়ীর বৌ আপনারা নিয়ে যান।
তাশরিফ চুপ হয়ে যায়।
রোদেলা দ্রুত পায়ে হেঁটে বাইরে বের হয়। মেঘলা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। রুহুল আমিন মেঘলাকে বলে,”চল মেঘলা।”
***
সবাই বেরিয়ে গেলে কান্নায় ভেঙে পরে বৃষ্টি। আদিলের ইচ্ছে করছে বৃষ্টিকে একটু জরিয়ে ধরে শান্তনা দিতে কিন্তু ভাইয়া এখানে দাঁড়িয়ে আছে,ওর পক্ষে এই কাজ করা অসম্ভব। সে ভয়ে ভয়ে তাশরিফের দিকে তাকায়। তাশরিফ রাগী চোখে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। আদিল তোতলাতে তোতলাতে বলে,”ভুল হয়ে গিয়েছে ভাইয়া। আর এমন ভুল হবে না।”
_যা করার তো করেই ফেলেছিস, এখন সামনে কি করবি সেটা চিন্তা কর। মাকে কিভাবে ম্যানেজ করবো সেটা ভেবেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
কথাটি বলে তাশরিফ বৃষ্টির দিকে তাকায়। নরম গলায় বৃষ্টিকে বলে,”কান্নাকাটি করো না। নতুন বৌ এভাবে কাঁদলে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। নতুন বৌয়ের মুখে হাসি থাকবে। দুজনে ভালোবেসে বিয়ে করেছো।”
শাফিন এসে খুশি খুশি গলায় বলতে থাকে,”আমি তো রোদেলা আপুর কাঁচুমাচু মুখ টা দেখে খুব মজা পেয়েছি। বেচারী এতো হম্বিতম্বি করেও কিছু করতে পারলো না।”
তাশরিফ ওদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,”শেষমেশ কাঁঠাল টা তো আমার মাথায় ভেঙে দিলি সবাই। আমি মাকে কিভাবে ম্যানেজ করবো আল্লাহ জানেন।”
_যেভাবেই হোক ভাইয়া। আপনার কথা আন্টি শুনবে। বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা আপনাকেই বাঁধতে হবে। আমরা আপনার পেছনে আছি।
কথাটি সুহানা বলতেই সুহানার দিকে তাকিয়ে তাশরিফ হাসে।
তারপর বলে,”চল এখন বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। নতুন বৌ এভাবে কাজী অফিসে বসে বসে কাঁদছে,এটা তো মানা যায় না।”
তারপর আদিল আর বৃষ্টির সব বন্ধু বান্ধবদের উদ্দেশ্য করে বলে,”তোরা কি যেতে চাস আমাদের সাথে?”
_অবশ্যই ভাইয়া। এতদূর পর্যন্ত যখন ওদের পাশে থেকেছি তখন ওদের বাসরের খাট সাজিয়েই দিয়ে আসি চলুন।
দাঁত বের করে রাফসান বলে কথাটি, কাজী অফিসে চাপা হাসির রোল পরে যায়। আদিল চোখ গরম করে রাফসানের দিকে তাকায়।
_কেউ তো বোধ হয় কিছু খাসনি? আর বাড়ি গিয়ে আজ যে আমার মায়ের হাতের খাবার কপাল জুটবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। চল আগে খাওয়া দাওয়া সেরে নেই। অনেক সার্কাস দেখিয়েছিস কাজী অফিসে, এবার এখান থেকে বের হ।”
তাশরিফের কথায় সায় দিয়ে সবাই কাজী অফিস থেকে বের হয়। আদিল আর বৃষ্টি সবার পেছনে। বৃষ্টি তখনো কেঁদে যাচ্ছিলো। আদিল নরম গলায় বলে,”দেখলে তো,বলেছিলাম না আমার ভাইয়া খুবই ভালো। দেখবে মাকেও ম্যানেজ করে নিয়েছে। ভাইয়া খুবই ভালো মনের মানুষ। তোমার আপুর মতো নয়।”
বৃষ্টি রাগী চোখে আদিলের দিকে তাকায়। আদিল ভয় পেয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,”সরি বৃষ্টি।”
***
“মেয়ে মানুষের মতো কেঁদো না তো বাবা, ওর জীবন ও বেছে নিয়েছে। ওর যা হবার হোক। তুমি কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে যেও না প্লিজ।”
রোদেলা রুহুলের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত ভাব নিয়ে কথাটা বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রুহুল আমিন বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। মেঘলা তার বাবাকে ধরে রেখেছে।
“বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে রে রোদেলা। অবুঝ মেয়েটা নিজের কোন বিপদ ডেকে নিলো। আমার দমটা যে বেরিয়ে যাচ্ছে।”
রোদেলা বাবার কাঁধে মাথা রাখে। রুহুল আমিন বলতে থাকে,”ও সংসারের কি বোঝে! জেদের বশে এতো বড় একটা কান্ড করে ফেললো,এখন সারাজীবন ভুগতে না হয় মেয়েটার। ওকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো রে রোদেলা।”
রুহুল আমিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার দুই মেয়ে তাকে দুই পাশ থেকে ধরে রেখেছে। কান্নার গতি থামিয়ে বলে,”সবসময় মা বাবা দুজনের ভালোবাসা একসাথে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এতো করেও মেয়েটার সাথে মানসিক দূরত্বটা কমিয়ে আনতে পারলাম না রে রোদেলা। তোরাই বল,তোদের আমি কখনো কোনো কিছুতে বাধা দিয়েছি? ও একবার ও ভাবলো না ওর জীবনে ওর বাবা আছে। কোনো কিছু না ভেবেই বিয়ের মতো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো আমাকে না জানিয়ে। একবার ও ভাবলো না আমার কথা?”
রোদেলা রুহুল আমিনের কথার উত্তর না দিয়ে সিএনজির জানালায় দৃষ্টি রাখে। বড্ড ক্লান্ত দুটি চোখ শূন্যে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। নাটকীয়তায় ভরা জীবনে নাটক যেন শেষ ই হচ্ছে না। একটার পর একটা মোড় নিচ্ছে সেই নাটকের।
***
“খাচ্ছো না কেনো বৃষ্টি? খাও”
আহ্লাদী গলায় বৃষ্টিকে খাবারটা খাওয়ার জন্য তাগাদা দেয় আদিল। বৃষ্টি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। যেন আদিলের কথা সে শুনতে পায়নি।
তারা এসেছে একটি নামকরা রেস্তোরাঁয়। বৃষ্টি খাচ্ছে না দেখে আদিল নিজের খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বসে আছে।
তাশরিফ আদিলকে বলে ওঠে,”ওর মন খারাপ। ধীরে সুস্থে খাক। তুই তোর খাবার টা খা। এতক্ষণ তো দু’জন চড় খেয়ে খেয়ে পেট ভরেছিস।”
তাশরিফের কথায় বিব্রত হয়ে আদিল নিজের গালে হাত দেয়। সত্যিই খুব জোরে লেগেছে চড় টা,এখনো জ্বলছে গালটা। মনে মনে সে বদ দোয়া দিতে থাকে,ওই সিমেন্ট আপুর কপালে যেন খুব বাজে একটা লোক জুটে যায়। যে তাকে কথায় কথায় চড় মারবে।
সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। তাশরিফ হঠাৎ করে বলে ওঠে,”এই রোদেলা আমিন মানে বৃষ্টির বড় বোন তোকে নেশা খোর টাইপ ছেলে বলছিলো কেনো বারবার? ব্যাপার কি?”
আদিল খাওয়া থামিয়ে ভাইয়ের দিকে চায়। কন্ঠে রাগ নিয়ে বলে,”অতি সন্দেহবাতিক মহিলা ভাইয়া। চুল টা একটু বড় রেখেছি আর অমনি আমি নেশা খোর হয়ে গেলাম।”
তাশরিফ উচ্চশব্দে হেসে ফেলে। আদিল বলে,”তুমি হাসছো ভাইয়া? জানো না কতটা ভয়ংকর এই মহিলা, একশো জন পুরুষ লোকের তেজ নিয়ে চলে।”
কথাটি বলেই আদিল বৃষ্টির দিকে তাকায়। বৃষ্টি কান্না থামিয়ে তার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে। আদিল একটা ঢোক গিলে বলে,”না মানে, বলতে চেয়েছি অনেক সাহসী নারী ভাইয়া।”
তাশরিফ আনমনে হেসে ফেলে। শাফিন বলে ওঠে,”আচ্ছা ভাইয়া এই রোদেলা আপুকে আপনি কিভাবে চেনেন?”
_আমার কলিগ।
সবাই খানিকটা অবাক হয়ে যায়। তাশরিফ টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে বলে,”এবার তাহলে ওঠা যাক! সামনে যে ভূমিকম্প হতে চলেছে তার জন্য সবাই মানসিক ভাবে প্রস্তুত হও। আর আদিল তুই শারীরিক মানসিক দুইভাবেই প্রস্তুত হ কারন মা তোকে কি করবে আমি জানি না। তবে চিন্তা করিস না, বৃষ্টির কোনো অসম্মান আমি হতে দেবো না। ওর দায়িত্ব আমি নিলাম। তুই শুধু মুখ বুজে মায়ের দুটো চড় থাপ্পড় সহ্য করে নিস।
***
খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হতেই সবাই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আদিলের বুক ধুকপুক করছে। তাশরিফ একপলক আদিলের দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে নেয়। দরজা খুলে দেয় তাশরিফ আর আদিলের বাবা আফতাব হাসান। একটা লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার হাতে একটা সাইকোলজির বই। বইটা পড়তে পড়তেই এসে দরজা খুলেছে সে। ইদানিং ধরে হিউম্যান সাইকোলজি সম্পর্কিত বইয়ের প্রতি তার খুব আগ্রহ বেড়েছে। দরজার বাইরে এতো জনকে দেখে তাকে তেমন বিচলিত দেখালো না। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,”সিনেমা দেখতে গিয়েছিলি নাকি সবাই? আয় ভেতরে আয়।”
তাশরিফ মৃদু স্বরে বলে,”মা কোথায় বাবা?”
“এইতো আমি। কি হয়েছে?”
একটা তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে তাহমিনা এসে দরজার কাছে দাড়ায়। আদিল সাথে সাথে তাশরিফের পেছনে গিয়ে লুকায়। তাহমিনা ভ্রু কুঁচকে সবাইকে দেখতে থাকে। সব কটা আদিলের বন্ধু, তাহমিনা চেনে ওদের। হঠাৎ বৃষ্টির দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়। শাড়ি পরা বৌ বৌ সাজে এই মেয়েটি কে!
সে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ও কে তাশরিফ?”
তাশরিফ ইতস্তত করতে থাকে। তাহমিনা আতংকিত হয়ে বলে,”বলছিস না কেনো? মেয়েটি কে? ওকে তো আগে দেখিনি? আদিলের বন্ধু? তোর পরিচিত? ও এভাবে বৌ বৌ সেজে আছে কেনো? ”
তাশরিফ একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়। তারপর বলে,” বলছি। আগে ভেতরে আসতে দাও।”
তাহমিনা বৃষ্টির দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। আফতাব হাসান হাত থেকে বইটা নামিয়ে একটা টেবিলের উপর রেখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশরিফ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”এসো ভেতরে।”
বৃষ্টি তাশরিফের পিছু পিছু ভেতরে ঢোকে। তাদের পিছু পিছু ঢোকে আদিল এবং তার বন্ধুরা।
তাহমিনা দরজা লাগিয়ে দিয়ে তাশরিফের দিকে ঘুরে তাকায়,”এখন বল। এই মেয়ে কে?”
তাশরিফ গলা খাঁকারি দিয়ে ধীরে ধীরে বলে,”তোমার বৌমা!”
তাহমিনা আঁতকে উঠে দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। তারপর চেঁচিয়ে বলে,
“বৌমা মানে? ফাজলামি করছিস? নাকি আমাকে বোকা বানাচ্ছিস? দেখ তাশরিফ এই ধরনের মজা আমি পছন্দ করি না তা তুই খুব ভালো করেই জানিস।”
_আমি সত্যিই বলছি। ও তোমার ছেলের বৌ।
তাহমিনা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,”এতো বার করে বলেছি তোর পছন্দ থাকলে বল আমাকে, তখন তো কিছু বলতি না আজ কোথা থেকে যাকে তাকে ধরে এনে ও তোমার বৌমা? মা বাবাকে না জানিয়ে বিয়েটা করতে হলো কেনো? জবাব দে আমাকে।”
চেঁচিয়ে ওঠে তাহমিনা । বৃষ্টি ভয়ে গুটিয়ে আছে।
তাশরিফ বিব্রত হয়ে পরে। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি বিয়ে করি নি মা।”
তাহমিনা রাগে কাঁপতে থাকে,”বিয়ে করিসনি তাহলে ওকে আমার বৌমা বলছিস কেনো?”
_মা ও তোমার ছোটো ছেলের বৌ। ওর নাম বৃষ্টি। আজ সন্ধ্যায় ওদের বিয়ে হয়েছে।
আদিল তাশরিফের পেছন থেকে কচ্ছপের মতো মাথা বের করে তাহমিনার দিকে তাকায়। তাহমিনা একবার তাশরিফ, একবার আদিল, একবার বৃষ্টির দিকে তাকায়। আফতাব হাসান হতভম্ব হয়ে তাশরিফের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তাশরিফ এসে মায়ের হাত দুটো মুঠি করে ধরে ফেলে,”মা ওদের কিছু বলো না। ওরা দু’জন দু’জনকে খুব ভালোবাসে, প্লিজ মেনে নাও।”
তাহমিনা দুলছে। তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। তাশরিফ আদিলকে চোখ দিয়ে ইশারা করে।
আদিল এসে তাহমিনার পায়ে পরে যায়,”মা প্লিজ তুমি আমাদের মেনে নাও। প্লিজ মা।”
তাহমিনা একবার আদিলের দিকে তাকায়। কয়েক মুহূর্ত পরে ধপ করে সে পরে যেতে নিলে তাশরিফ তার মাকে ধরে ফেলে।
চলমান…..
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১২
#লেখিকা_Esrat_Ety
“এই ছাড় আমাকে, ছাড় বলছি।”
এক ঝটকায় তাশরিফের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় তাহমিনা। তার পায়ের কাছে বসে থাকা আদিলের থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে এক লাফে পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাগে সে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। আদিল উঠে দাঁড়ায়। তাহমিনা বৃষ্টির দিকে তেড়ে যায়,”এই মেয়ে,তুমি কোথা থেকে এসেছো? জবাব দাও।”
তাশরিফ মাকে পেছন থেকে ধরে রাখে,আদিল গিয়ে বৃষ্টির সামনে দাঁড়ায়। তাদের সব বন্ধুরা আতংকে এক কোনায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
তাহমিনা তাশরিফের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আদিলকে একটা চড় মেরে দিয়ে চেঁচাতে থাকে,”অসভ্য ছেলে। ঘরে বড় ভাই অবিবাহিত। নিজের এখনো দুধের দাঁত পরেনি। পড়াশোনা শেষ হয়নি,দুই পয়সা কামানোর মতো যোগ্যতা হয়নি। সে বৌ নিয়ে চলে এসেছে। বেড়িয়ে যা। এক্ষুনি বেড়িয়ে যা এখান থেকে।”
তাশরিফ মায়ের হাত টেনে নিয়ে বলে,”মা মেরো না ওকে এভাবে। ওর স্ত্রী পাশে দাঁড়িয়ে আছে।”
_কে স্ত্রী? এই মেয়েকে আমি স্বীকার করবো না। কখনোই না।
কান্নায় ভেঙে পরে তাহমিনা। বৃষ্টি ধীর পায়ে তাহমিনার কাছে চলে আসে। তাহমিনার হাত ধরে বলে,”মা। আপনার ছেলে আর আমি আপনি যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেবো। তবুও আমাদের দূরে সরিয়ে রাখবেন না প্লিজ মা।”
তাহমিনা বৃষ্টির থেকে নিজের হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে যায়, ঘরে ঢুকে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
আদিল গিয়ে দরজা ধাক্কাতে থাকে। দরজা খোলার জন্য তার মায়ের কাছে অনুনয় করতে থাকে। তাহমিনা কোনো সাড়া দেয় না।
বৃষ্টি মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টি কখনো কল্পনাতেও আনেনি তাকে আর আদিলকে এতোটা ভোগান্তি পোহাতে হবে,তাহলে হুট করে বিয়ের কথাটা মাথায় আনতোই না।
আফতাব হাসান চিন্তিত ভঙ্গিতে তাশরিফকে বলে,”কি হচ্ছে এসব। এসব কিভাবে ঘটে গেলো তাশরিফ?”
_বলবো বাবা,পরে সবটা বুজিয়ে বলবো।
তারপর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তাশরিফ বলে,”উনি তোমার শশুর।”
বৃষ্টি মাথায় ঘোমটা টেনে ঝুঁকে আফতাব হাসানের পায়ে হাত দিতে নিলে তাশরিফ বাঁধা দেয়,”আরে কি করছো। মুখে সালাম দাও বৃষ্টি।”
বৃষ্টি তবুও আফতাব হাসানের পা ছুঁয়ে সালাম করে। আফতাব হাসান ইতস্তত করতে থাকে। তারপর বৃষ্টির মাথায় হাত রেখে বলে,”থাক মামনি।”
এতক্ষনে সে বৃষ্টির মুখটা ভালো করে দেখে। বৃষ্টিকে দেখে তার মন ভরে যায়। চাপা স্বরে তাশরিফকে বলে,”এই পরী টাকে তোর ভাই কোথায় খুঁজে পেলো ? কি আশ্চর্য!”
তাশরিফ হেসে ফেলে তার বাবার কথা শুনে, তারপর বলে,”তা তো জানি না বাবা।”
বৃষ্টির শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে তাশরিফ বলে,”ভয় পেয়ো না। আমার মা প্রচন্ড রাগী, কিন্তু খুব দ্রুতই তার রাগ পরে যায়। তখন তিনি তোমার জন্য কলিজাটাও কেটে দিয়ে দেবে। একটু ধৈর্য্য ধরো।”
আদিল দরজা ধাক্কাতে থাকে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার বন্ধুরা অনুরোধ করতে থাকে তাহমিনার কাছে। তাহমিনা দরজা খোলে না।
আদিল ক্লান্ত হয়ে পরে, দরজায় মাথা ঠেকিয়ে কাতর কন্ঠে বলে,”মা। তুমিই তো বলো তোমার একটা মেয়ে নেই, মেয়ের জন্য খুব আফসোস হয় তোমার। তোমার জন্য একটা মেয়ে এনেছি আমি। বৃষ্টি খুব ভালো মেয়ে মা, খুবই লক্ষী একটা মেয়ে। তুমি এভাবে মুখ ফিরিয়ে থেকো না আমাদের থেকে। দুজনে ভালো থাকার জন্য বিয়ে করেছি, তোমার দোয়া ছাড়া কিভাবে ভালো থাকবো মা? ওকে তুমি একটু দেখো তো মা, কি ভীষণ লক্ষী মেয়ে তুমি ভাবতেও পারবে না। ভাইয়ার আগে বিয়ে করেছি বলে তুমি আমায় শাস্তি দাও কিন্তু ওকে এভাবে অবহেলা করো না,সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছে এখানে ও।”
তাশরিফ এসে আদিলকে সরিয়ে দিয়ে বলে,”দেখি আমায় দেখতে দে।”
তারপর তাহমিনাকে বলে,”মা। তোমার দরজা খোলার দরকার নেই। ওদের আমি বাসা থেকে এক্ষুনি নামিয়ে দিচ্ছি। যেখানে খুশি সেখানে যাক। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরুক। দুদিন কোনো বন্ধুর বাড়িতে কাটিয়ে দেবে না হয়। তারপর দুজন টিউশন করাতে শুরু করবে, একটা এক রুমের টিনশেড বাসা ভাড়া করে থাকবে। মাসের ছাব্বিশ দিন আলু সেদ্ধ আর পাতলা ডাল দিয়ে ভাত খাবে। চিন্তার কিছুই নেই। একটা কিছু করে ঠিক চালিয়ে নেবে জীবন। তুমি আরাম করো মা, ওদের এক্ষুনি বাসা থেকে বের করে দিচ্ছি। তোমার দরজা খোলার দরকার নেই।”
দুমিনিট পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। তাহমিনা চোখের পানি মুছে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। আদিলের ঠোঁট প্রস্বস্ত হয়ে যায় হাসিতে। তাশরিফ ভান করে বলতে থাকে,”এক্ষুনি বের করে দিচ্ছি ওদের। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো মা।”
তাহমিনা ঘরের বাইরে এসে বৃষ্টির দিকে তাকায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে বৃষ্টিকে দেখে, তারপর তাশরিফকে বলে ওঠে,”ওকে ওর স্বামীর রুমটা দেখিয়ে দে কেউ।”
আদিল আর বৃষ্টির দুইজন বান্ধবী সুহানা এবং মিম প্রায় দৌড়ে এসে বৃষ্টিকে ধরে। আনন্দিত গলায় বলে,”চলো।”
বৃষ্টি তাহমিনার কাছে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করে। তাহমিনা অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো, একপলক বৃষ্টিকে দেখে বলে ওঠে,”বেকার ছেলেকে বিয়ে করেছো,দেখেছো গলায় একটা ইমিটেশনের মালাও জোটেনি।”
বৃষ্টি মাথা নিচু করে আছে। তাহমিনা নিজের ঘরের দিকে যায়। পাঁচ মিনিট পরে একটা বক্স নিয়ে ফিরে আসে। বক্স থেকে একটা সোনার চেইন আর দুটো বালা বের করে। বৃষ্টির হাতে বালা দুটো পরিয়ে দেয়,একটু বড় বড় লাগছে বৃষ্টির হাতে বালা দুটো। এই বালা দুটো সে তাশরিফের বৌয়ের জন্য বানিয়ে রেখেছিলো। চেইন টা বৃষ্টিকে পরিয়ে দিতে দিতে বলে,”তোমার স্বামীর জন্মের পরে ওর নানা বাড়ি থেকে দিয়েছিলো চেইনটা, তুমিই রাখো তোমার স্বামীর জিনিস।”
আদিল একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে তাহমিনাকে জড়িয়ে ধরে, চেঁচিয়ে বলে,”থ্যাংক ইউ মা। থ্যাংক ইউ,থ্যাংক ইউ,থ্যাংক ইউ। আমার লক্ষী মা তুমি।”
_ছাড় আমাকে। তুই একদম ধরবি না আমাকে।
আদিলকে সরিয়ে দেয় তাহমিনা।
তাশরিফ মাকে বলে,”মা। তুমি এমন করো না প্লিজ। একটু তুমি তোমার ছেলের বৌকে দেখো। তোমার তো গর্ব করা উচিত তোমার বাঁদরের মতো দেখতে ছেলে একটা পুতুলের মতো বৌ এনে দিয়েছে তোমাকে।”
_চুপ কর তুই। লাই দিয়ে দিয়ে এভাবেই ওকে নষ্ট করেছিস তুই। আচ্ছা তোর লজ্জা লাগছে না এখন? ছোটোভাই বৌ নিয়ে এসেছে তোর আগে, লজ্জা লাগছে না?
_না। আমার তো আরো খুশি লাগছে মা।
আফতাব হাসান বলে,”এখন বল। কিভাবে হলো এসব?”
_বলবো সব। একটু সময় দাও।
তারপর আদিলের বন্ধুদের চোখ দিয়ে ইশারা করে সে। ইশারায় কিছু একটা করতে বলে। তারা মাথা নেড়ে আদিলের ঘরের দিকে যায়। আদিলের ঘরটা সুন্দর করে সাজিয়ে দেবে তারা।
বৃষ্টিকে ধরে সুহানা নিয়ে যায় আদিলের ঘরে। তাহমিনা বসার ঘরের সোফায় চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকে। আদিল দূরে দাঁড়িয়ে মাকে দেখছে। তাশরিফ এসে মায়ের পাশে বসে। তাহমিনা বলে ওঠে,”মেডিকেলে চান্স পেলো না। ভার্সিটি এডমিশনের রেজাল্ট এখনো দেয়নি। জীবনের কোনো গতিপথ খুজে পায়নি। এরই মধ্যে নিজের জীবনের সাথে আরেকটা জীবন জরিয়ে ফেলেছে। বিয়েটা যে শুধু বিয়ে না,একটা আজীবন মেয়াদী দায়িত্ব সেটা তো ও জানেইনা। দুদিন পরে হুঁশ ফিরবে ওর। তখন বুঝতে পারবে।”
তাশরিফ মায়ের কাঁধে হাত রাখে,”মা এভাবে বলছো কেনো? ওরা ওদের মতো ওদের জীবন গড়তে থাকবে না হয়। আমি আছি তো,বাবা আছে তো ! ভালোই তো হয়েছে,আমার একটা বোন হয়েছে।”
_এই তুই সিনেমার ডায়লোগ কপচাবি না খবরদার। এটা সিনেমা নয়, বাস্তবতা। কাল যখন তোর বৌ আসবে,এসে দেখবে ভাই আর ভাইয়ের বৌয়ের পেছনে কাড়ি কাড়ি পয়সা খরচ করছিস তখন কি হবে? বল আমাকে?
তাশরিফ লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। অস্ফুট স্বরে বলে,”এমন কাউকে আমি বিয়েই করবো না মা।”
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আদিল মিনমিন করে মাকে বলে,”আমি টিউশনি করিয়ে ওর খরচটা চালিয়ে নেবো মা তোমার চিন্তা করতে হবে না।”
তাহমিনা কয়েক মুহূর্ত আদিলের দিকে তাকায়। তারপর পা থেকে ঘরে পরার স্যান্ডেল খুলে হাতে নেয়। আদিল দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
তাশরিফ হাসছে। তাহমিনা তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”বৌকে কি এক কাপড়ে নিয়ে এসেছে ও?”
_হু।
_কান্ডজ্ঞান দেখেছিস? এক কাপড়ে বৌ এনেছে। এই ছেলের সাপোর্ট করছিস তুই আবার।
_টাকা ছিলো কোথায়। জমানো সব টাকা মোহরানা হিসেবে দিয়ে দিয়েছে বৃষ্টির হাতে। আর এতো টেনশনের মধ্যে ছিলাম,আমার মাথা থেকেও বেরিয়ে গিয়েছিলো। কাল কেনাকাটা করবো।
তাহমিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে,”মেয়ের পরিবার সম্পর্কে জানিস কিছু? ওর পরিবারের লোক জানে?”
_জানি কিছুটা, শিক্ষিত পরিবার। তারা সবটা জানে,কাজী অফিসে এসেছিলো। নতুন জামাই বৌকে চড় থাপ্পড় মেরে দিয়ে চলে গিয়েছে। মেনে নেয়নি।
তাহমিনা আফতাব হাসানের দিকে তাকায়, তারপর তাশরিফকে বলে,”এই লোকটাকে দেখ। একটা অপদার্থ জন্ম দিয়ে এখন যেন কিচ্ছুটি বোঝে না। লেজ গুটিয়ে বসে আছে। তাড়াতাড়ি কিছু ক্যাশ দাও,ছেলের বৌয়ের জন্য কেনাকাটা করতে বের হবো। আর তাশরিফ তুই সুহানা নয়তো মিমকে ডেকে দে। ওদের একজনকে নিয়ে যাই সাথে করে, ওরা দেখেশুনে কিনতে পারবে।”
তাশরিফ তার মায়ের হাত দুটো মুঠি করে ধরে চুমু খায়। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলে,”তুমি এতো ভালো কেনো মা!”
***
আদিলের ঘর গোছাতে ব্যস্ত সবাই। বৃষ্টিকে আদিলের ঘরে এক কোনায় একটি চেয়ারে বসিয়ে রেখে সবাই হাতে হাতে ঘরটা গুছিয়ে দিচ্ছে। আদিল ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। রিপ্তি চোখ মুখ কুঁচকে বলে,”ঘরটাকে তো আস্তাকুঁড়ের মতো লাগছে। এর মধ্যে কিভাবে বাস করিস তুই।”
_সমস্যা নেই। ওর ঘর গোছানোর লোক এসে গিয়েছে। এখন থেকে আর এই ঘরে ঢুকে তোদের চোখ কপালে তুলতে হবে না।
শাফিন হাসতে হাসতে বলে। রাফসান শাফিনের কথা শেষ হতে না হতেই বলে,”ভাই আমি কনফিউজড আসলে। এখন থেকে আদিলকে দুলাভাই ডাকবো নাকি বৃষ্টিকে ভাবী ডাকবো?”
সুহানা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”খুব সোজা। মেয়েরা আদিলকে দুলাভাই ডাকবি,ছেলেরা বৃষ্টিকে ভাবী ডাকবি।”
সবাই হাসতে থাকে। শাফিন বলে,”মিম কে নিয়ে আন্টি কোথায় গেলো এই রাতে বলতো?”
_কি জানি, বলেনি তো কিছু। আচ্ছা মিমকে বলে দিয়েছিলি কিছু ফুল নিয়ে আসতে?
_হু,বলেছি । তবে এতো রাতে কোনো ফুলের দোকান খোলা থাকার কথা না,আর খোলা থাকলেও তাজা ফুল পাওয়ার কথা না।
শাফিন বলে ওঠে,”ওদের কপালে বাসি ফুল দিয়ে বাসর লেখা আছে। এটাও ওদের সৌভাগ্য। আমি তো ভেবেছি ওদের আজ রাতটা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে।
রাফসান বলে,”আন্টিকে যতটা কঠোর ভেবেছিলাম আন্টি ততটা না। আমি তো ভীষণ অনুপ্রাণিত হলাম ভাই, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা এতো সহজ! আমার তো ইচ্ছে করছে মুনতাহাকে কালকেই বিয়ে করে ফেলি!”
রিপ্তি ভেংচি কেটে বলে ওঠে,”তোর কি তাশরিফ ভাইয়ার মতো ভাই আছে ? নেই তাই না? তাহলে তুই এই রিস্ক নিস না। মাফ কর আমাদের।
সবাই হাসতে থাকে রিপ্তির কথাতে। বৃষ্টি মনমরা হয়ে বসে থাকে শুধু। আদিল আড়চোখে দেখতে থাকে তার বৌকে।
***
“রোদেলা”
বোনের কাঁধে হাত রেখে ডাকে মেঘলা। খানিকটা চমকে উঠে নিজের চোখের পানি মুছে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় সে। মেঘলা বোনের পাশে বসতে বসতে বলে,”কাদছিস তুই।”
_না আপু।
মেঘলা চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পরে নীরবতা ভেঙে বলে,”আমার খুব টেনশন হচ্ছে রোদেলা। আল্লাহ জানেন ওই মানুষ গুলো কেমন। যদি আমার বোনটাকে অযত্নে,অবহেলায় রাখে? যদি মাইনুলদের পরিবারের মতো হয় ওরা? খুব ভয় করছে আমার।”
রোদেলা গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”তুমি টেনশন করো না। যার জীবন সে বুঝে নিবে। দুইটা চড় থাপ্পড় মেরেছি বলে তেজ দেখিয়ে বিয়ে করে নেবে? আমরা যেন কিছুই না। ওই দুই দিনের ছেলেটাই সব হয়ে গিয়েছে। যা হবার হোক ওর। আমার কিছু যায় আসে না।”
_কিছুই যদি যায় না আসে তাহলে এভাবে কাঁদছিস কেনো?
_কাদছিলাম না। বাবা ঘুমিয়েছে?
_না, মাথায় হাত দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তুই ঘুমিয়ে পর। এভাবে রাত জাগিস না। একদিন ধপ করে অসুস্থ হয়ে পরে যাবি তুই দেখিস।
_আজ আর ঘুম আসবে না আপু। মেয়েটা খুব আনন্দে আছে এখন বোধ হয় তাই না? নতুন বৌ। চোখে লাল নীল সংসারের স্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত এখন। ও ভুলেই গিয়েছে ওর একটা জীবন এই আমাদের কাছে ফেলে রেখে গিয়েছে। ওর নতুন জীবন নিয়ে মগ্ন হয়ে আছে ও।
মেঘলা বোনের মাথায় হাত রাখে।
“ঘুমো এখন । কাল নতুন বাসায় উঠতে হবে আমাদের। অনেক কাজ।”
মেঘলা উঠে চলে যায়। রোদেলা তার ফোনের দিকে তাকায়। এখন কোথায় আছে বৃষ্টি! কেমন আছে ! খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওর। এই তাশরিফ হাসান বলে লোকটার ফোন নাম্বার তাদের অফিসের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আছে। ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবে বৃষ্টির কথা?
ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে আবার রেখে দেয় সে । না না না, কিছুতেই না। যা ইচ্ছা করুক ও। রোদেলার কিছুই যায় আসে না ।
***
একপলক বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় আদিল। এখন রাত বারোটা বেজে চব্বিশ মিনিট। ঘন্টা খানেক আগে তাহমিনা মিমকে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করে এনেছেন বৃষ্টির জন্য। একটা গোলাপী রঙের বেনারসী কিনেছেন,যেটা বৃষ্টি এখন পরে বসে আছে। আদিলের মনে হচ্ছে এই মাত্র বাগান থেকে কেউ একটা তাজা গোলাপ ফুল ছিঁড়ে তার বিছানায় রেখে দিয়ে গিয়েছে। আদিলের খুবই নার্ভাস লাগছে। বাড়িতে বাবা,মা,বড় ভাই,বন্ধু বান্ধবী সবাই জেগে আছে। এভাবে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে তার অস্বস্তি হচ্ছে খুব। গায়ের পাঞ্জাবি টা ঘামে ভিজে গিয়েছে পুরোপুরি। আলমারি থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করে ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে পাল্টে নেয়। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আরো একবার বৃষ্টির মুখের দিকে তাকায়। চোখের পানি গালে শুকিয়ে লেপ্টে আছে। এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় একপাশে বসে আদিল। বিছানায় কিছু গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রেখেছে ওরা। কোনো ফুলের দোকান খোলা পাওয়া যায়নি অত রাতে। শেষমেশ তাহমিনার গোলাপের টব থেকে তিনটা ফুল ছিঁড়ে এনে পাপড়ি খুলে ছড়িয়ে দেয় বিছানায় সুহানা।
বৃষ্টি মাথা নিচু করে রেখেছে। আদিল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”খারাপ লাগছে তাই না?”
বৃষ্টি চুপচাপ। বৃষ্টির থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আদিল ধীরে ধীরে বৃষ্টির হাতের উপর একটা হাত রাখে। আচমকা বৃষ্টি হাতটা সরিয়ে নেয়। আদিল কিছুটা ঘাবড়ে যায়,বিড়বিড় করে বলে,”এখন তুমি সিনেমার মতো এটা বলবে নাকি যে যতদিন তোমার পরিবার আমাদের মেনে না নিচ্ছে আমি যেন তোমায় স্পর্শ না করি।”
বৃষ্টি আহত চোখে আদিলের দিকে তাকায়। কান্না থামিয়ে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,”তুমি এমন অসভ্যের মতো কথা বলছো কেনো আদিল? দেখছো আমার মন খারাপ আর তুমি! ছিঃ, বিয়ে করেছো বলে মাথা কিনে নিয়েছো? আমার মন খারাপ দেখেও এইসব কথা ঘুরছে তোমার মাথায়?”
আদিল তোতলাতে তোতলাতে বলে,”রাগ করো না বৃষ্টি। আমি তো শুধু হাত ধরার কথাই বলছিলাম। অন্য কোনো কিছু মিন করিনি আমি।”
অভিমানী বৃষ্টি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আদিল বলে,”আচ্ছা ঠিকাছে। যাও,হাত ও ধরবো না। তুমি প্লিজ মুড ঠিক করো।”
বৃষ্টি চুপচাপ বসে থাকে। আদিল আবারো বৃষ্টির একটা হাত আলতো করে ধরে বলে,”এই বৃষ্টি।”
এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বৃষ্টি বলে,”যাও এখান থেকে। আমার ভালো লাগছে না কিছু।”
_কোথায় যাবো?
অবাক হয়ে জানতে চায় আদিল। তারপর আবার বলতে থাকে,”আমাদের এই বিশেষ রাতে তুমি কি আমাকে ঘর থেকে বের করে দেবে নাকি! এমন টা করো না বৃষ্টি,বাইরে বের হলে মা আমাকে আবার জুতাপেটা করবে। আচ্ছা ঠিকাছে, তুমি আরাম করে কাঁদতে থাকো। আমি তোমায় বিরক্ত করবো না। এই দেখো আমি ঘুমিয়ে পরছি।”
বলেই আদিল ওপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। বৃষ্টি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কোনো কথা বলে না। তারপর বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,”আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে আদিল। ও বাড়ির কথা মনে পরছে খুব,যন্ত্রনায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে,তুমি আমায় একটু জরিয়ে ধরবে প্লিজ।”
আদিল ভুত দেখার মত চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে বৃষ্টির দিকে চায়। উঠে বসে কয়েক মুহূর্ত বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে বৃষ্টিকে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। বৃষ্টির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে বৃষ্টি।”
চলমান…..