দ্বিতীয় বসন্ত, পর্ব:১০

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ১০এবং শেষ
#Arshi_Ayat

ইশতিয়াক রেজাসহ ওনার পুরো ফ্যামিলি এসেছে আর না চাইতেও অহর্নিশকেই ওদের রিসিভ করতে হয়েছে।এদিকে অহির শরীর খারাপ।ঘুমালেই কিসব স্বপ্ন দেখে। ইমিডিয়েটলি ডাক্তার ইয়াসমিনের সাথে কথা বলতে হবে।আজই দেখা করার কথা ছিলো কিন্তু মাঝখান থেকে ইশতিয়াক রেজার আগমনে সব ভেজতে গেলো।তবুও আজই অহর্নিশ চেষ্টা করবে একবার ডাক্তার ইয়াসমিনের সাথে দেখা করার।

ওনাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে অহর্নিশ হাসপাতালে চলে গেলো।মিসেস অনামিকা যেতে না করেছিলো কিন্তু অহর্নিশ কাজ দেখিয়ে চলে যায়।হাসপাতালে সারাদিন ডিউটি করে ফেরার সময় ডাক্তার ইয়াসমিনের চেম্বারে গেলো অহর্নিশ।দুই একটা সৌজন্যমূলক কথা শেষ করে অহর্নিশ অহির সমস্যা গুলো বলল।সব শুনে উনি একটু উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,’আমার মনে হয় ওনার স্মৃতিগুলো আস্তে আস্তে মনে পড়ছে।এটা ভালো লক্ষ্মণ কিন্তু একটা শঙ্কা আছে।বর্তমান ভুলে যাওয়ার চান্স খুব বেশি।’

‘লক্ষ রাখুন ওনার ওপর আর কাল একবার নিয়ে আসবেন।’

‘আচ্ছা।’
অহর্নিশ চিন্তিত মুখে ঘরে এলো।অহি স্মৃতি ফেরার বিষয়টা বেশ পীড়া দিচ্ছে ওকে।শুধু বারবারই মনে হচ্ছে যদি ও ভুলে যায় সবকিছু!না চিনতে পারে অহর্নিশকে তখন?

সন্ধ্যার সময় বাসায় এসে প্রথমেই দেখলো বসার ঘরে সেজুতি আর ওর বাবা মা সাথে পূর্ব চৌধুরী আর মিসেস অনামিকাও আছেন।তাদের সকলেই গল্প মেতে উঠেছেন।অবশ্য বাল্যকালের বন্ধু বলে কথা!অহর্নিশ সবার দিকে তাকিয়ে একটু সৌজন্য হেসে নিজের ঘরে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে অহির ঘরে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই ওর ঘরে সেঁজুতি চলে এসেছে।সেঁজুতিকে দেখে অহর্নিশ ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না।একটা সৌজন্য হাসি দিয়ে বলল,’আরে সেঁজুতি কেমন আছো?’

‘এইতো ভালো তুমি?’

‘ভালো।তো পরীক্ষা কবে তোমার?’

‘সামনের মাসে বোধহয়।’

‘ওহ!হঠাৎ শিলিগুড়ি আসার কোনো কারণ আছে নাকি?’

‘হ্যাঁ তোমার বাবা মা’ই তো আসতে বলল।’

অহর্নিশ একটু অবাক হয়ে বলল,’আমার বাবা মা?’

‘হ্যাঁ তোমার বাবা মা’ই পাপাকে ফোন দিয়ে আসতে বলল।’

‘ওহ!আচ্ছা তুমি একটু বসো আমি আসছি।’
সেঁজুতিকে নিজের ঘরে বসতে বলে অহর্নিশ অহির ঘরে চলে এলো।অহর্নিশকে দেখে অহি বলল,’কখন আসলেন?’

‘এইতো একটু আগে।’

‘ওহ!আচ্ছা একটা লকেট আছে না আপনার কাছে যেটা আপনি আমায় দেখিয়েছিলেন।’

‘হ্যাঁ।’

‘সেটা একটু আনবেন?’

অহর্নিশ দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে অহিকে লকেট’টা এনে দিলো।অহি লকেটের ছবি দুইটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,’অহর্নিশ জানেন এই মহিলাটা আমার মা।’

অহর্নিশ প্রচন্ড বিষ্ময় নিয়ে অহির দিকে তাকালো।অহিও অহর্নিশের দিকে তাকিয়ে বলল,’হ্যাঁ ইনিই আমার মা।আজ দুপুরে জ্ঞান হারিয়েছিলাম হঠাৎ।তারপর জ্ঞান ফিরতেই সব মনে পড়লো।’

বিষ্ময়ে অহর্নিশের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।অহি লকেট’টা নিজের গলায় পরতে পরতে বলল,’আমি বাংলাদেশি।আমার নাম প্রিয়তি।আমার মা মারা গেছে।ছয়মাস হবে।আত্মহত্যা করেছিলো।বাবার দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারে নি।আমিও পারি নি।তবে মা বেশি আবেগপ্রবণ ছিলো সহ্য করতে পারে নি।অকালে আমায় ছেড়ে চলে গেছে।মা যাওয়ার পর পনেরো দিন খুব কষ্টে পার করছিলাম।তারপর ছোটো খালামণি বলল তাদের বাসায় যেতে।রাজি হলাম।ভাবলাম গিয়ে ঘুরে আসলে মন্দ হবে না।খালামণি খুব ভালোবাসে আমাকে।আমার খালার বাসা বান্দরবান।রওনা হয়েছিলাম সকাল সকাল তারপর হঠাৎ একটা বাস এক্সিডেন্টে আমার কিছু মনে নেই।কিভাবে এখানে আসলাম সেটাও কিছু জানি না।তারপর যা হয়েছে সব তো আপনি জানেন।’

এ পর্যন্ত বলেই প্রিয়তি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর বলল,’আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে।আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।’

অহর্নিশ এতক্ষণ কিছু বললেও এখন বলল,’তাহলে আমি?আমাদের ভালোবাসা?’

‘আপনাকে যে ভালোবেসেছে সে অহি।প্রিয়তি আপনাকে ভালোবাসে নি।প্রিয়তির জীবন এতো সহজ না।’

‘কি বলছো তুমি এগুলো?তুমি কি ভুলে গেছো আমাদের কাটানো সময়গুলো?’

‘মনে রেখে কি লাভ?এসব মিছে আবেগ।আপনি ভালো থাকবেন।আপনার ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর হোক।আমি বোধহয় কাল ফিরবো।’

‘অহি!আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।তুমি এতো সহজে সবকিছু ছেড়ে যেতে পারো না।’

‘অহি না প্রিয়তি।আমি প্রিয়তি।আর অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।আমার জন্য এতোটা করেছেন বলে তা নাহলে আমি হয়তো আজ বেঁচেই থাকতাম।আর হ্যাঁ আপনাদের এখান থেকে কিভাবে যেতে হয় আমি তো জানি না একটু ব্যবস্থা করে দিয়েন।’

অহর্নিশ তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেঁজুতি চলে এলো।প্রিয়তিকে দেখে বলল,’আপনি কে?’

প্রয়তি মৃদু হেসে বলল,’আমি?আমি প্রিয়তি।অহর্নিশের ফ্রেন্ড।আর আপনি?’

‘আমি ওর ফিয়ন্সে।’

‘ওহ!কংগ্রাচুলেশনস।বিবাহিত জীবনে সর্বোচ্চ সুখ কামনা করি।’

সেঁজুতির সাথে কথা বলে প্রিয়তি বাইরে আসতেই মিসেস অনামিকার মুখোমুখি পড়লো।ওনার সাথে দেখা হতেই প্রিয়তি বলল,’আন্টি আমি কাল চলে যাবো।আমার সব মনে পড়েছে।আপনাকে জানা অজানায় কোনো কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করবেন।’

মিসেস অনামিকা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললেন,’তোমার সত্যিই সব মনে পড়েছে?’

‘জ্বি আন্টি।’

আজকে সারারাত অহর্নিশ প্রিয়তির সাথে কথা বলার চেষ্টায় ছিলো কিন্তু পারে নি।প্রিয়তি কোনো সুযোগ দেয় নি।ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো আর দরজাও বন্ধ রেখেছিলো।অহর্নিশের প্রচুর কষ্ট হচ্ছিলো।এই সাতাশ বছরের জীবনে ও খুব কমই কান্না করেছে কিন্তু আজকে চোখের পানি উপচে পড়ছে।ভেবেছিলো হয়তো অহির স্মৃতি ফিরলে ওকে চিনতে পারবে না।

অবশেষে বিদায়ের সময় চলে এসেছে।অহর্নিশ কিছু না করলেও মিসেস অনামিকা প্রিয়তির যাওয়ার সব ব্যাবস্থা করে দিলেন।যাওয়ার সময় অহর্নিশের সাথে দেখা করে নি।কি দরকার শুধু শুধু দুঃখ বাড়িয়ে।অহর্নিশও অভিমানে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলো।আশা ছিলো শেষ বেলায় হয়তো মত পাল্টাবে।থেকে যাবে কিন্তু না, যার যাওয়ার সে যাবেই।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।প্রিয়তি নিজের সীটে হেলান দিয়ে বসে আছে।চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু বিনা দ্বিধায় গড়িয়ে পড়লো।

‘যেতে নাহি দিবো হায়,
তবুও ছেড়ে চলে যেতে হয়।’

১ সপ্তাহ পর……
অহর্নিশ ওয়ারড্রব থেকে একটা শার্ট বের করতেই সেখান থেকে একটা চিঠি পেলো।কৌতূহল বশত চিঠিটা হাতে নিলো।তারপর খুলতেই দেখলো ঝকঝকে হাতের লেখায় কিছু কথা।

অহর্নিশ,
আপনাকে প্রিয় বলে সম্বোধন করবো না।কারণ আপনাকে প্রিয় বলার অধিকার আমার নেই।আমি অবেলার অতিথির মতো আপনার জীবনে এসেছিলাম সেভাবেই চলে যাচ্ছি।আমাদের গন্তব্য আলাদা।আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য আলাদা।সেটা এক হতে পারে না।যেকারণে আমি আমার মা’কে হারিয়েছি সেই একই ঘটনা আমি আবার পুনরায় করতে পারবো না।সেঁজুতি মেয়েটা আপনাকে অনেক ভালোবাসে।আমি চাইনা আমার জন্য ওর রঙিন স্বপগুলো ভেঙে যাক।আমার জন্য ও নিজের ক্ষতি করুক।যেমনটা আমার মা করেছে।আমি চাই আপনারা ভালো থাকুন।
আপনাকে আমি সত্যিই খুব ভালোবেসেছি।আপনি আমার জীবনের দ্বিতীয় বসন্ত।আমার জন্ম পহেলা বসন্তে।আমার জীবনে ওটাই একমাত্র বসন্ত ছিলো কিন্তু এখন দ্বিতীয় বসন্ত আপনি।কারণ আপনি না থাকলে আমি হয়তো বেঁচেই থাকতাম না।আমার দ্বিতীয় বসন্ত হয়ে আপনি সারাজীবন আমার মনের মধ্যে বাস করবেন।ভালোবাসি আপনাকে!

ইতি অহি

চিঠিটা পড়ে অহর্নিশ হাসতে হাসতেই কেদে ফেললো।পেয়ে হারানোর ব্যাথা পাঁজরে পাঁজরে ছড়িয়ে পড়েছে।

সমাপ্ত.
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here