#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০৬
#Arshi_Ayat
আজকাল অহি আর অহর্নিশের মাঝে খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে।তবে অহর্নিশের অনুভূতিগুলো বন্ধুত্বে আটকে নেই।এ অনুভূতিগুলোর সীমানা কোথায় অহর্নিশ নিজেও জানে না।তবে মাঝেমধ্যে মনে হয় এই বক্ষপিন্জিরাটা দখল হয়ে হয়ে গেছে।এইখানে খুব যতনে কেউ বাসা বেঁধেছে।এই সাতাশ বছরের জীবনে এমনটা প্রথমবার হচ্ছে অহর্নিশের সাথে।এমন নয় যে সে এর আগে কাউকে ভালোবাসে নি।কিন্তু তখনকার অনুভূতি আর এখনকার অনুভূতিগুলো আলাদা।ওই সময়ের অনুভূতিগুলো মনটাকে ব্যাকুল করে তুলতো না কিন্তু এখন যে অনুভূতিগুলো সেগুলো ক্ষণে ক্ষণে ব্যাকুল করে তোলে অহর্নিশকে!
সময় রাত ১২ টা।অহর্নিশ ছাঁদের ওপর দোলনায় বসে কফি খাচ্ছে।আর চাদের দিকে চেয়ে আছে।আজ পূর্ণিমার দ্বিতীয় দিন।মানে কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয় রাত!কালকের চেয়ে আজকের চাঁদে আলো কম!তবুও আকাশটা ঝলমল করছে।কয়েকটা তারাও দেখা যাচ্ছে আশেপাশে।চাঁদ দেখতে দেখতেই অহর্নিশের মনে হলো দোলনাটা একটু দুলে উঠেছে।অহর্নিশ পাশে তাকাতেই অহিকে দেখলো।অহিও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।ওদের দৃষ্টি আবদ্ধ!এভাবেই ক্ষণকাল কেটে গেলো পলকহীন!ভাষাহীন!স্থির হয়ে।কি এক সম্মোহনী শক্তি কাজ করছে দৃষ্টিতে যেনো বছরের পর বছর এভাবেই তাকিয়ে থাকা যাবে।
পাশের বাসার ছাঁদ থেকে বিড়ালের মিয়াঁও,মিয়াঁও শব্দ আসতেই অহি সচেতন হয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সামনে।ততক্ষণে অহর্নিশও সামনে তাকালো।নিশ্চুপতার অবসান ঘটিয়ে অহিই প্রথমে বলল,’আজ মন খারাপ মনে হচ্ছে!’
অহর্নিশ একটা ম্লান হাসি দিয়ে বলল,’খারাপ ও না ভালোও না।মাঝামাঝি অবস্থায় আছি।’
‘মাঝামাঝি অবস্থায়!মানে নাতিশীতোষ্ণ?’
অহর্নিশ একটু জোরেই হেসে ফেললো।বলল,’হ্যাঁ,নাতিশীতোষ্ণ!’
‘আচ্ছা এই অবস্থায় অনুভূতি কেমন?মানে আমি কখনো এই অনুভূতির মুখোমুখি হই নি।’
‘এই অবস্থায় অনুভূতিগুলো খুব খারাপ।না তুমি হাসতে পারবে না কাঁদতে পারবে!একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা।’
অহির মাথার ওপর দিয়ে গেলেও অহি বুঝবার ভান করে দুই/তিনবার মাথা নাড়ালো।অহর্নিশ বুঝতে পেরেও কিছু বলল না।তারপর আবারও কিছুক্ষণ নিরব থেকে অহর্নিশ জিগ্যেস করলো,’আচ্ছা অহি তুমি কি চাও?এই জীবনটা?নাকি তোমার আগের জীবনটা?’
কিছু না ভেবেই অহি বলল,’আগের জীবনটাই চাই।হয়তো সেই জীবনে আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে!’
অহির শেষের বাক্যটা অহর্নিশের কলিজায় আঘাত করলো।আসলেই কি কেউ অপেক্ষা করে!তাহলে কি অনুভূতিগুলো মিথ্যে হয়ে যাবে?কেনো ওর অতীতে কেউ থাকতে হবে?কেনো কেউ অপেক্ষা করবে!এইসব দুর্বোদ্ধ্য প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর পোকার মতো কিলবিল করছে।অজান্তেই মনটা বারবার বলছে যেনো অহির স্মৃতি কখনোই না ফেরে!কখনো না।কিন্তু!কিন্তু আজ ডাক্তার আয়াজ যা বলল তাতে শঙ্কাগুলো ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
আজকে যখন নিউরো বিভাগের ডাক্তার ইয়াসমিন বললেন অহির স্মৃতি শক্তি তাড়াতাড়িই ফিরবে কারণ ওর ডেড সেলগুলো আবার রিকোভার হয়ে যাচ্ছে।ওগুলো রিকোভার হলেই পুরোপুরি ওর স্মৃতি শক্তি ফিরে আসবে কিন্তু পুরোনো স্মৃতি ফিরে পাওয়ার পর বর্তমানের কিছু মনে থাকবে কি না এটা নিয়েই সমস্যা কারণ এইসব ক্ষেত্রে অনেককিছুই ঘটার সম্ভবনা থাকে যেমন হয়তো আগের স্মৃতি ফিরে পেলে বর্তমান ভুলে যাবে তা নাহলে স্মৃতি আর কখনো ফিরবেই না আবার কখনো কখনো এমনও হয় অতীত বর্তমান দুটোই মনে থাক তবে এ ক্ষেত্রে দু’টোই মনে থাকার সম্ভবনা খুব কম।আর বর্তমান ভুলে যাওয়ার সম্ভবনা খুব বেশি।
ডাক্তারের এই কথাগুলো শোনার পর থেকেই অহর্নিশ ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে তবে অহি কাছে এটাই সবচেয়ে খুশীর সংবাদ আজকে।
সময়ের সাথে সাথে রাত ফুরচ্ছে দিন ঘনাচ্ছে!ঘনিয়ে আসছে বিষাদময় কিছু সময়!
ওরা প্রসঙ্গ পাল্টে কিছুক্ষণ কথা বলল তারপর নিচে চলে গেলো দুজনই।
আজ সকালে একটা ইমার্জেন্সি থাকায় অহর্নিশ খুব দ্রুত বেরিয়ে গেলো হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।অহির সাথে শুধু দু’একটা কথা হয়েছে।অহর্নিশ না থাকলে অহি সারাদিন বই পড়ে,নাটক,মুভি দেখে সময় কাটে।বাড়ির কারো সাথেই কথা হয় না।অহির এই জীবনট ভালো লাগে না।মনে হয় সবার অবহেলা,উপেক্ষার পাত্রী হয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।হয়তো ওর আগের জীবন খুব সুন্দর!হয়তো সেখানে মা বাবা সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করে অহির খুব ইচ্ছে করে স্মৃতিগুলো ফিরে পেতে কিন্তু এতকিছুর মাঝেও অহর্নিশকে বারংবার মনে পড়ে।ওর জন্যই মাত্র তিনমাসে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব হয়েছে।হাঁটাচলা সম্ভব হয়েছে।কিন্তু এছাড়াও অহর্নিশের প্রতি দিনদিন ছোটো-ছোটো অনুভূতিরা জন্ম নিচ্ছে।আস্তে আস্তে অনুভূতিগুলোর শাখা প্রশাখা বৃদ্ধি পাচ্ছে।আচ্ছা অহর্নিশেও কি এমন হয়?ওর চোখ কি কথা বলে?অনুভূতিরা কি ডানা মেলে?ছুটতে চায় বহুদূর?নাকি এখনো ওর মনে বসন্তদূত আসে নি!
অহর্নিশ চলে যাওয়ার পর এগুলোই ভাবছিলো অহি।হঠাৎ অহর্নিশের মা দরজায় নক দিয়ে বললেন,’আসবো?’
আচমকা কারো গলায় শোনায় অহি ছিটকে পড়ে তার ভাবনার জগত থেকে।চলে আসতে হয় বর্তমানে।দরজায় অহর্নিশের মা’কে দেখে অনেকটাই অবাক হলো কারণ এই পর্য়ন্ত ওনার সাথে হাতেগোনা কয়েকবারই কথা হয়েছে।তাও দুই একটা!তবে উনি হঠাৎ এখানে আসছে কেনো?অহি ওর মাথার চিন্তাগুলোকে দমন করে সৌজন্য হেসে বলল,’জ্বি আন্টি আসুন।’
মিসেস অনামিকা আসলেন।অহির বেডের একপাশে বসলেন।তারপর ফর্মালিটি অনুযায়ী জিগ্যেস করলেন,’কেমন আছো?’
‘এইতো আন্টি ভালো আছি।আপনি আর আঙ্কেল কেমন আছেন?’
‘আমরাও ভালো আছি।শোনো তোমার সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে।’
‘জ্বি আন্টি,বলুন।’
‘অহর্নিশের বাবা আর আমার একটা পছন্দের মেয়ে আছে।বাংলাদেশে থাকে।নাম সেঁজুতি।ওর সাথে আমরা অহর্নিশের বিয়ে দিতে চাই।কিন্তু!’
অহির ভেতর ভেতর খুব কষ্ট হলেও জোর করেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো।তারপর বলল,’কিন্তু কি আন্টি?’
‘কিন্তু আমার মনে হয় তোমরা একটু বেশিই করছো।আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।দেখো আমার ছেলেকে কিছু বললে ও শোনে না।এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়।কিন্তু তুমি প্লিজ একটু বোঝো ওকেও বোঝাও!’
‘জ্বি,আন্টি।আমি বলবো।’
‘আর শোনো ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখো।চেকআপ করো!দেখো কি বলে!তোমারও তো জীবন আছে তাই না?সারাজীবন কি আর অন্যের বাড়ি পড়ে থাকলে হবে!’
‘জ্বি,আন্টি।আমি চলে যাবো কিছুদিনের মধ্যেই।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে।আসি।ভালে থেকো।’
এটা বলেই মিসেস অনামিকা চলে গেলেন।উনি যেতেই অহি উঠে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে দরজার সাথেই বসে পড়লো।কি এক অসহনীয় অনলে দগ্ধ হচ্ছে বুকের ভেতরটা।কিন্তু আফসোস বাইরে থেকে পোড়াটা দেখা যায় না,পোড়ার গন্ধ আসে না।
আজ অহর্নিশের ফিরতে ১১ টা বাজলো।আজকে ৩ টা ইমার্জেন্সি ছিলো।সারাদিন প্রচুর ব্যস্ত ছিলো।একটা বারের জন্যও অহির সাথে কথা হয় নি।তবে আজ মনটা ফ্রেশ।আসার সময় দু’টো বেলিফুলের মালা এনেছে।অহিকে দিবে বলে।বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে অহির রুমে গিয়ে দেখলো অহি উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।বোধহয় মন খারাপ কিন্তু কেনো?সর্বপ্রথম এই প্রশ্নটাই মাথয় এলো অহর্নিশের।মৃদু স্বরে ডাকলো দিলে অহিকে?অহর্নিশের গলা পেয়ে অহি ফিরে তাকালো ওর দিকে।একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলল,’ওহ!কখন এলেন?’
‘এইতো একটু আগে।তোমার কি মন খারাপ?’
‘না তো!’খুব কষ্টে মিথ্যাটা বলল অহি।’
‘মনে হচ্ছে!আচ্ছা ছাঁদে চলো একটা সারপ্রাইজ দিবো।’
‘কি সারপ্রাইজ?’
‘আগে চলো তো!আর সারপ্রাইজ বলে দিলে কি আর সারপ্রাইজ থাকে নাকি!’
‘আমার না যেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘অহি,আমার মনে হয় তোমার মন আজকে অনেক খারাপ।কি হয়েছে আমাকে বলো?আম্মু,আব্বু বা অন্য কেউ কিছু বলছে?’
‘নাহ!কেউ কিছু বলে নাই।এমনিই।চলুন ছাঁদে যাই।’
এই প্রশ্নবাণগুলো এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এটাই একমাত্র পথ ছিলো।ছাঁদে এসে অহর্নিশ অহির হাতে বেলির মালাগুলো বেধে দিয়ে বলল,’দেখো ঘ্রাণটা অসম্ভব সুন্দর।’
অহর্নিশের কথা মতো অহি ঘ্রাণটা নিলো।আসলেই অনেক সুন্দর।কিন্তু সকালের কথাগুলো আবারও মনে পড়তেই অহি একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।তারপর গম্ভীর স্বরে বলল,’আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।’
‘হ্যাঁ বলো।’
‘আপনার কি মনে হয় না।আমাদের সম্পর্কটা এখন আর বন্ধুত্বে আটকে নেই।সেটা ক্রমান্বয়ে শাখা প্রশাখা বৃদ্ধি করছে?’
অহর্নিশ হাসলো।তারপর বলল,’তুমি এতো দেরিতে বুঝতে পারলে?এটা তো আমি কবেই টের পেয়েছি।শুধু তোমার জানার অপেক্ষায় ছিলাম।’
‘কিন্তু আমার মনে হয় না এটা ঠিক।’
‘কেনো?ঠিক মনে হয় না কেনো?’
‘কারণ আমার অতীত!আমার অতীতে কিন্তু আপনি নেই আর দিনশেষে আমাকে সেখানেই ফিরতে হবে।তাই এটাই ভালো না আমাদের অনুভূতিগুলো আর বাড়তে না দোওয়া।’
‘অহি,কি বলছো তুমি এসব!ডাক্তার তো বলে নি তুমি পুরোপুরিই আমাকে ভুলে যাবে!’
‘ডাক্তার তো এটাও বলে নি আপনাকে মনে থাকবে আমার।পুরোটাই অনিশ্চয়তা।অনিশ্চয়তায় সম্পর্ক আগানো ঠিক না।আর আপনি আপনার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে ওনার আপনার কাছে অনেক কিছুই ডিজার্ভ করে।প্লিজ তাদের ইচ্ছাগুলোও মূল্য দিয়েন।’
অহর্নিশ রাগে মাথার পেছনের চুলগুলো টানছে।এতক্ষণ না বুঝলেও এবার বুঝেছে হয়তো ওর বাবা মা কেউ অহির ব্রেইনওয়াশ করেছে তা নাহলে আজ সকালে পর্যন্ত তো সব ঠিক ছিলো!
চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ।)