# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১১
তারপর রাগে দুদিন আর ওদের বাসায় যাই নি। কিন্তু যার ওপর রাগ করেছি সে জানেও না আমি তার ওপর রেগে আছি। একটা ফোন পর্যন্ত করে নি। আমিও করি নি। কেন করবো? আগে ও করবে। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে যাচ্ছিলাম। ড্রয়িংরুমে আন্টির গলার আওয়াজ পেয়ে দেখতে গেলাম কি হচ্ছে।
ধ্রুব ভদ্রছেলের মত আন্টির পাশে বসে আছে। ওর পরনে খয়েরি রংয়ের একটা পাঞ্জাবি আর কালো জিন্স। পাঞ্জাবির হাতা একটুখানি গোটানো। হাতে কালো ঘড়ি। চুল গুলো জেল দিয়ে ফেরানো। এই বেশে দুর্দান্ত লাগছিলো! বাবা ওর সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছিলো।কিন্তু কি নিয়ে সেটা বুঝতে পারলাম না। ওর এত সেজেগুজে আসার কারণও বুঝতে পারছিলাম না। এদিকে আন্টির পরনেও নতুন শাড়ি। তাদের মুখোমুখি বাবা আর বড় ফুপা বসে আছেন। আন্টি আমাকে দেখে কাছে ডাকলেন। ধ্রুব খুব মনোযোগ দিয়ে বাবার কথা শুনছিলো। আমাকে দেখে আড়চোখে একবার তাকিয়ে পুনরায় আলোচনায় মনোযোগ দিলো। আমার বুঝতে বাকি রইলো না কি হচ্ছে। আমার পরনে তখন আমার সবচেয়ে পুরোনো সুতির জামাটা। যেটা পরতে পরতে একেবারে ত্যানা ত্যানা হয়ে গেছে। গরমে আরাম লাগে বিধায় প্রায়ই গায়ে দেই। চুলগুলো পাখির বাসা। চোখজোড়া রসগোল্লার মত ফুলে আছে।
আন্টি আমাকে ডেকে তার পাশে বসালেন। ধ্রুবর ওপর আমার এত রাগ হচ্ছিলো যে বলার বাইরে। সে আমাকে একটা বার জানালে কি হতো? আন্টি আমাকে যতই ভালোবাসুক। তিনি তো মেয়ে দেখতে এসেছেন? আমাকে এই ফকিন্নির বেশে দেখানোটা কি ধ্রুবর উচিৎ হলো? আড়চোখে তাকাতেই দেখলাম নরাধমটা মিটমিট করে হাসছে। আমি মনে মনে তাকে জীবনেও মাফ না করার প্রতিজ্ঞা করে একবার মায়ের প্রতি অগ্নিবর্ষণ করলাম। মায়ের তো একবার আমাকে জানানো উচিৎ ছিলো?
ধ্রুব আর আন্টি চলে গেলে আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম আমাকে জানানো হয় নি কেন? মা অপরাধির মত মুখ করে বললো,” তোর মন মেজাজ ভালো ছিলো না। তাই জানাতে চাই নি। কিন্তু তোর আন্টি নিজেই তাড়া দিলেন। ওদিকে ধ্রুবকে তোর বাবারও খুব পছন্দ। ছেলেটা ভালো! তোর বাবা সব খোঁজখবর নিয়েছে..।” আমি মাকে পুরোটা শেষ করতে না দিয়ে বললাম,”সেসব ঠিক আছে। কিন্তু আন্টি যে আমাকে দেখতে আসছেন তা তো আমাকে একবার বলা উচিৎ ছিলো।” মা আমার রাগ দমন করার চেষ্টা করে বললো,” তুই ঘুমাচ্ছিলি শুনে তোর আন্টি তোকে ডিস্টার্ব করতে বারণ করেলো।” আমি শীতল কন্ঠে বললাম,”যতই বারণ করুক। তুমি তো দেখেছো আমি কি জামা পরে শুয়েছিলাম। তোমার তো আমাকে ডেকে দেওয়া উচিৎ ছিলো।”
—“তো কি হয়েছে? তোর আন্টি তো তোকে
রোজই দেখেন।”
মাকে কি করে বোঝাই রোজ দেখা আর আজকে দেখা আর নয়। আজকের দেখাটা আমার জন্য অনেক বেশি স্পেশাল! আমি রাগে দরজা বন্ধ করে ধ্রুবর নাম্বারে ডায়াল করলাম। দুবার রিং হতেই ধ্রুব ফোন রিসিভ করলো। ওকে হ্যালো বলার সুযোগ না দিয়ে আমি এক নিশ্বাসেই বলতে শুরু করলাম,
—“তুমি এত খারাপ কি করে হতে পারলে ধ্রুব? কি করে আমার সাথে এমন করতে পারলে? তোমার একটুও খারাপ লাগলো না।”
—“কি করেছি আমি?”
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ওপাশ থেকে হাসি চেপে রাখার জোর চেষ্টা চলছে। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিলো। দাঁতেদাঁত চেপে বললাম,”কি করেছো তুমি জানো না? তোমার একটুও মায়া হলো না?”
ধ্রুব মিথ্যে সান্ত্বনার সুরে বললো,” আচ্ছা, এটা নিয়ে মন খারাপ করার কি আছে? মা তো তোমাকে রোজই দেখেন।”
—“রোজ দেখা আর আজকের দেখা কি এক হলো? আর রোজই যদি দেখে তাহলে আজকে এলে কেন দেখতে?”
—“আমি আসি নি। মা জোর করে নিয়ে এসেছে।”
—“মা জোর করে নিয়ে এসেছে। তোমাকে আমি চিনিনা ভেবেছো? তুমি ইচ্ছে করে এমন করেছো!”
—“সিরিয়াসলি আমি সত্যিই জানতাম না। আর যদি ইচ্ছে করেই করে থাকি তো সমস্যা কি? তুমি তো আমাকে বিয়ে করবে না বলেছো?”
দাঁতেদাঁত চেপে বললাম,”না করবো না। জীবনেও করবো না। তুমি আমার পা ধরে কান্নাকাটি করলেও আমি তোমাকে বিয়ে করবো না মনে রেখো।”
রাগে দুঃখে আমার কেঁদে ফেলার অবস্থা। ফোনের ওপাশ থেকে আমার ফোঁপানোর আওয়াজ পেয়ে ধ্রুব বললো,”একি নিশাত তুমি কাঁদছো? আরে বাবা এটা তো জাস্ট একটা ফর্মালিটি। এর জন্য বুঝি কান্নাকাটি করা লাগে।”
—“থাক গরু মেয়ে জুতো দান করতে হবে না। লাগবে না তোমার সান্ত্বনা। ”
—“আমি সত্যি বলছি আমি জানতাম না। মা হুট করেই প্ল্যান করেছে। ঠিক আছে তুমি কাঁদো!আমি রাখছি বায়।”
ফোন কেটে দিলো অসভ্যটা। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফোনের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার কান্না থামানোর একটু চেষ্টাও করলো না? আবার ফোন দিলাম। ফোন রিসিভ করেই বলল,”আবার কি?”
—“তুমি ফোন কেটে দিলে কেন?”
—“আমি ভেবেছিলাম তোমার কথা শেষ।”
—“না শেষ হয় নি। আমার অনেক কথা আছে। খবরদার ফোন রাখবে না তুমি।”
—“আচ্ছা রাখবো না। বলো কি বলবে?”
—“বাবার সাথে কি কথা বলছিলে তুমি?”
ধ্রুব হেসে উঠে বললো,”তোমাদের বাড়িটা হাতিয়ে নেওয়ার প্ল্যান করছিলাম।”
—“এই যে আবার…?”
—“আচ্ছা সরি। তেমন কিছু না তোমার বাবা আমাকে তার লাইফ হিস্ট্রি শোনাচ্ছিলেন। আমার কথা তোমাকে কিছু বলেছে?”
—“না। সেটা জানতে হলে আআপাতত ধৈর্য ধরতে হবে। আগামীকাল আরেকটা ছেলে দেখার কথা আছে। সব যাচাই বাছাই করে যদি তোমাকে বেস্ট মনে হয় তবে… ”
ধ্রুব আমার কথায় পাত্তাই দিলো না। বললো,”এই শোনো, আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো। আর্জেন্ট। রাখি?” ধ্রুব খুব সিরিয়াস সিরিয়াস ভাব নিয়ে কথাগুলো বললেও ও যে আমাকে রাগানোর জন্যই বলেছে সেটা ওর চাপা হাসির শব্দ আমার বুঝতে বাকি রইলো না। মেজাজ বিগড়ে গেলো। বললাম,”
—“তোমার কি মনে হচ্ছে না ধ্রুব, আমি যতই শান্ত থাকার চেষ্টা করছি তুমি ততই আমাকে রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছো। কেন?”
ধ্রুব হাসতে হাসতে বললো,”কি আশ্চর্য নিশাত আমি ওয়াশরুমে যাবো না!”
—” তুমি আমাকে আর জীবনেও ফোন দেবে না অসভ্য ছেলে।”
আমি ফোন কেটে দিলাম। পাঁচমিনিট বাদে ধ্রুব আবার ফোন করলো। কেটে দিলাম। ও আবার কল করলো। আমি আবারো কেটে দিলাম। শেষে মেসেজ দিলো,”ফোন রিসিভ না করলে কিন্তু তোমাদের বাসায় এসে তোমাকে চুমু খেয়ে যাবো।” মেসেজটা সিন করতেই রাগের মাঝেই হেসে ফেললাম। সব রাগ পানি হয়ে গেলো। অসভ্যটা আমাকে রেগে থাকতে দেবে না। কিন্তু আমার যে রাগ পড়ে গেছে সেটা ওকে বুঝতে দিতে চাইলাম না। কল রিসিভ করেই ঝাড়ি শুরু করে দিলাম,
—“বারবার কেন আমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছো? কি চাই তোমার?”
—“তুমি কি একবার নিচে আসতে পারবে?”
—“না।”
—“আসো না।”
—“বললাম তো পারবো না।”
—“আসো না, প্লিজ।”
—“না।”
ধ্রুব আমাকে রাগানোর জন্য বললো,”ঠিক আছে। আর কোনদিন এসো আমাদের বাসায়। তোমার একদিন কি আমার একদিন। তুলে আছাড় না মারবো একদম। ”
—“ঠিক আছে আসবো না।”
—“আসবা না তুমি?”
—“বললাম তো আসবো না। আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?”
ধ্রুব ফোন কানে রেখে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। আমি চুপ করে রইলাম। দুজনেই চুপচাপ। ধ্রুব হাল ছেড়ে দিলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনুরোধী গলায় বললো,”আসো না প্লিজ!”
—“একটু আগে কি বলেছিলে?”
—“সরি।”
—“লাগবে না আমার সরি।”
—“আসো না প্লিজ!”
—“আচ্ছা ঠিক আছে আসছি। কিন্তু মাকে কি বলবো?”
—“বলো জামাইয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছো।”
—“বাজে কথা বললে ফোন রেখে দেবো কিন্তু।”
—“এই না না,দাঁড়াও। আমি মাকে বলছি তোমাকে ডেকে পাঠানোর জন্য।”
—“আন্টি কি ভাববেন?”
—“কিচ্ছু হবে না। মা খুব ফ্রি।”
—“তুমি কি আন্টিকে সব বলে দিয়েছো?”
—“হুম।”
—“কি করে বললে? তোমার লজ্জা করলো না?”
—“লজ্জা করবে কেন?”
—“করবে না কেন? লজ্জা শরম নেই তোমার?”
—“আছে। প্যান্টের নিচে।”
ধ্রুবর কথা শুনে আমার তো গালে হাত। ওর মুখে কিছুই আটকায় না। বিরক্ত হয়ে বললাম,”ছি! ছিঃ! ধ্রুব! এসব কি?”
—“যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর! তুমি বোকার মত প্রশ্ন করলে কেন?”
—“আমি বোকার মত প্রশ্ন করেছি?”
—“অফকোর্স তুমি বোকার মত প্রশ্ন করেছো! মা না জানলে তরুর সাথে বিয়েটা ভাঙ্গতো কি করে?”
—“আমি মাকে জানানোর কথা বলছি না। তুমি একটু আগে কি বলেছো?”
ধ্রুব ইনোসেন্ট টাইপ হাসি দিলো। যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানে না সে। বললো,”কি বলেছি?”
—“অসভ্য! আমি বলতে পারবো না।”
ধ্রুব হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বললো,” মাকে বলছি তাহলে?”
—“ঠিক আছে বলো।”
ধ্রুব ফোন কেটে দেওয়ার কিছুক্ষন পর মা এসে জানালো আন্টি আমাকে নিচে যেতে বলেছেন। আমি স্কার্ট বদলে গোলাপি রঙয়ের একটা জামা পরে নিলাম নিচে যাওয়ার জন্য।
.
.
.
চলবে