#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব : ৪৭ এবং শেষ
৮১.
তপসী কোথায় যেন শুনেছিল, অসুস্থ মানুষ মারা যাওয়ার আগে সুস্থ হতে শুরু করে। তপসী যেন আজ সেই কথার সত্যতা খুঁজে পাচ্ছে৷ তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না মাত্র শোনা কথাটা৷ এমন ও হতে পারে?
,
সুহানা খানিক সুস্থ হওয়া শুরু হতেই সুহানার বাবা মা তপসীর সাথে জোর করেই সুহানাকে তাদের বাসায় নিয়ে গিয়েছে। এক্সিডেন্টের পর বাড়ির বউ দাবি করে তপসী এক প্রকার জোর করেই সুহানা কে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে এসেছিল।
তপসীর উদ্দেশ্য ছিল সুহানা কে সেবা শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তুলে নিজের আত্নগ্লানি কমানো। সুহানার বাবার বলা কথাগুলোর পর তার নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছিলো।
বাড়ির সবার বিপক্ষে গিয়ে সুহানাকে তপসী বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। সবাই এক পর্যায়ে মেনে নিলেও রনিতের মা তপসীর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে নি। তাই সে আজও তপসীর সাথে রাগ করে কথা বলে না।
কিছুদিন আগেই সুহানা যখন একটু একটু সুস্থ হতে শুরু করেছিল তখনই তার বাবা এসে তাকে নিয়ে গিয়েছে। কেউ মানাও করে নি৷
,
তপসী সুব্রত কে ফোন করলো। অবস্থা তার বেগাতিক। বুঝতে পারছে না কি করবে। সুব্রত ফোল তুললো না। এই ভর দুপুরে ফোন তোলার কথাও না।
তপসী দৌড়ে গেল শ্বাশুড়ির ঘরে। তিনি তখন কোনো একটা বই পড়তে ব্যস্ত। তপসী কে এমন দৌড়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
—— কি হয়েছে তোমার? এমন দৌড়াচ্ছো কেন?
তপসী হাঁপিয়ে উঠেছে৷ বললো,
—— মা, সুহানা দি,,,,
—— কি হয়েছে ওর? সুস্থ হয়ে গেছে একবারে?
—— না মা, সুস্থ হয় নি। সুস্থ আর হবেও না। মারা গেছে মা, সুহানা দি মারা গেছে৷
তপসীর কথা বুঝতে তার কয়েক মুহূর্ত দেরী হলো। বুঝতে পেরে চুপসে গেল। তপসী ততক্ষণে কান্নায় পর্যবাসিত হয়েছে৷ তার নিজেরও কান্না পাচ্ছে। মেয়েটা কে এতোগুলো মাস বাড়িতে দেখে মায়া তো জন্মেছিলই একটু। এমন ভাবে মারা যাবে কে জানতো!
৮২.
কথায় আছে না, সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময় ঠিকই বয়ে গেছে, জীবনের স্রোত ও অপেক্ষা করে নেই। মাঝে পাঁচটা বছর কেটে গেছে। সুহানার কথা পরিবারের সবাই অনেকটাই ভুলে গেছে।
এ কথাও সত্য মৃত মানুষের চেয়ে হারানো অর্থের শোক বেশি৷ সময়ের ধারায় মৃত সুহানার কথা কারোরই মনে করার সময় নেই।
সুব্রত তপসীর জীবনও থেমে নেই। তাদের ছোট্ট ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে। সুহানা মারা যাওয়ার এক বছর পর ছেলেটা হলেও, আশ্চর্যজনক ভাবে সুহানা যেদিন মারা গেল সেই মাস তারিখ মিল রেখেই ছেলেটা পৃথিবীতে আসলো । সুব্রতই সুহানার নামের অর্থ ঘাসের উপরের শিশিরের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রেখেছে শিশির৷
শিশির ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলো। তপসীর জীবন আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। এখন তার পরিচয় হয়েছে অনেক। সে এখন শুধু আর্মি মেজর সুব্রত ধরের স্ত্রীই নয়, একজন ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক, সর্বোপরি একজন মা।
কর্মজীবন এর পাশাপাশি ছেলে, সংসারের দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সে কখনো হাঁপিয়ে যায় না। যে আক্ষেপ টা তার নিজের বাবা মায়ের প্রতি রয়ে গেছে, সে চায় না একই আক্ষেপ শিশিরের মনে থেকে যাক।
৮৩.
সুব্রত এবার খুব বেশি দেরী করেই বাড়ি এসেছে। প্রায় দেড় বছর হবে। সুব্রত ঘরে প্রবেশ করতেই শিশির দৌড়ে এসেছে তার কাছে।
সে সুব্রতকে বাবা বলে ডেকে উঠেছে।
সুব্রত শিশিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে তপসীর দিকে তাকালো। তপসী লেবুর শরবত এগিয়ে দিল সুব্রতের দিকে৷
সুব্রত স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলো,
—— ও আমায় মনে রেখেছে, তপসী!
তপসী শিশিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
—— সব সময় তো শুনেই আসলাম আর্মি অফিসার ছুটিতে বাড়ি আসলে তার ছোট সন্তান তাকে চিনতেই পারে না, আমি অবশ্যই এমনটা হতে দিতে চাই নি। আর এমনিতেও ওর স্মরণ শক্তি ভালো, নিজের বাবা কে মনে রাখার মতো সামর্থ্য ওর আছেই।
—— আমার ছোট বাবাটা একদম মায়ের মতো হয়েছে বুঝি তার?
তপসী চোখ টিপে বললো,
—— মাত্র তো এসেছো, ছেলের সাথে থাকলেই বুঝে যাবে সে কার মতো হয়েছে।
সুব্রত ছেলের দিকে তাকালো। কতোকক্ষণ এক নজরে চেয়ে থেকে বললো,
—— উমম, দেখতে তো একদম আমাদের কম্বিনেশন প্যাক। এইযে নাকটা তোমার মতো, চোখ গুলো আমার মতো।
তপসী হাসলো। সুব্রত যে কিছুদিনের জন্যই বাড়িতে আসে তার হার্ট বিট সারাক্ষণই বেড়ে থাকে। আজও এর ব্যাতিক্রম হচ্ছে না। সুব্রতকে দেখেই তার হৃদ স্পন্দন বেড়ে গেছে। নাম না জানা কিছু পাখি হয়তো তার মনের মধ্যে এসে বসে পড়েছে। যেগুলো কে সে অনুভূতি নামে চিনে। অনুভূতি গুলো বিশেষ। বিয়ের এতো বছরেও সেই অনুভূতি বদলায় নেই৷
তপসী আনমনেই শিশিরকে কোলে নিয়ে রাখা সুব্রতকে জড়িয়ে ধরলো। সুব্রত তপসীর কপালে চুমু খেয়ে বললো,
—— তোমাদের দুইজনের শরীর থেকে পরিবার পরিবার গন্ধ আসছে!
শিশির এবার বললো,
—— কিন্তু মা, আমি তো স্নান করেছি, গন্ধ বের হচ্ছে কেনো? বাবা তুমি কিসের স্মেল পাচ্ছো?
তপসী হেসে ফেললো। সুব্রতও যোগ দিলো তপসীর সাথে।
,
সুব্রত শিশিরের সামনে বিছানায় ভ্রু কুঁচকে বসে আছে। তপসী ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আসতেই সুব্রতের ভ্রু আরো কুঁচকে গেল।
তপসী জিজ্ঞেস করলো,
—— এমন কুঁচকানো লতা সেজে বসে আছো কেন মি.সুব্রত?
সুব্রত বললো,
—— আমি তোমায় যখন বিয়ে করেছিলাম, তখনও তোমার কথা বার্তা, অভ্যাস এই ছেলের চেয়ে বেশি বাচ্চা বাচ্চা লাগতো।
—— আহা, কি করেছে ও? এইভাবে বলছেন কেন?
শিশির মায়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বললো,
—— চকলেট ফেলে দিয়েছি মা। তাই বাবা রাগ করেছে।
তপসী হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। সুব্রতের নজরে তা এড়ালো না। সুব্রত জিজ্ঞেস করলো,
—— আমার এইটুকু বাচ্চা ছেলএ চকলেট তো খেলই না, আমায় আরো বললো, ফেলে দিতে। আমি না ফেলাতে সে নিজে গিয়ে ফেলে দিলো বারান্দায় গিয়ে। আর তুমি হাসছো?
শিশির আবার বললো,
—— মা, বাবা জানে না ক্যাভেটি হবে যে।
সুব্রত তপিসীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—— তুমি শিখিয়েছো ওকে এগুলো? ও মেইবি প্রথম বাচ্চা, যে চকলেট না খেয়ে ফেলে দিতে বলে৷ আ’ম শকড।
তপসী জোরে হেসে বললো,
—— আমি কেন শিখাবো? ও নিজে নিজেই এমন পারে। এই বয়সে বাচ্চারা এতো কথাও বলতে শিখে না, ও শিখে গেছে। আমি তো নিজেই প্রথমে অবাক হয়েছিলাম, এরপর মা আমায় বললো, এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ ব্যাটা তো বাপের মতোই হয়েছে।
তপসী আবার হাসিতে ফেটে পড়লো। সুব্রত আরো ভ্রু কুঁচকে ফেললো। বললো,
—— আমি মোটেও ছোট বয়সে এমন জ্ঞানী বাবা ছিলাম না।
—— একদম ছিলে। শুধু শুধু আমার ছেলের উপর দোষ চাপাবে না, সে পুরোটাই তোমার মতো হয়েছে, সব দোষ তোমার।
সুব্রত কপাল চাপড়ালো। এই চার বছরের বাচ্চা এমন জ্ঞানী জ্ঞানী কথা কি সত্যিই বলতে পারে! তপসীর হাসির আওয়াজে সুব্রত তপসীর দিকে তাকালো। তপসীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
—— ওকে, দ্যান আই শুড প্রাউড ওফ হিম। আমার ছেলেও বড় হয়ে আমার মতোই রোমান্টিক হবে।
—— চুপ, অসভ্য ও একদম হবে না।
—— অবশ্যই হবে। কার্বন কপি হবে আমার। আহা, এখন শান্তি লাগছে, আমার পরিবার মন মতো হয়ে গেছে৷
সমাপ্ত।
(কিছু কথা,
আরো অনেক বড় করার ইচ্ছা ছিল। যেহেতু আপনাদের ভালো লাগছে না তাই আর বড় করলাম না। আর অনেক খানি কেটেকুটে ছোট করবো কিভাবে ভেবে পাচ্ছিলাম না, তাই অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ জানি আপনাদের মন মতো আমি শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারি নি, তবুও এতোটা পথ আমার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ৷)