#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ৪৪
৭৫.
পরদিন খুব সকালেই সুহানার বাবা আসলো সুব্রতদের বাড়ি৷ তুলি এসে সুব্রতকে ডেকে দিলো। সুব্রত নিদ্রাগ্রস্থ চোখ দুইটি হাতে কচলাতে কচলাতে বিছানা ছাড়লো।
এতো ঝামেলা তার ভালো লাগছে না। কিছুদিন আগেও পরিবার টা তার গোছানো ছিল। সুহানা একদম উড়ো তুফানের মতো এসে পুরো পরিবারটাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে৷
সুব্রত সুহানার থাকার ঘরে গিয়ে দরজায় নক করলো। ভিতর দিকে অস্ফুট স্বরের এক বিশ্রী ধরনের গালি শুনতে পেল সুব্রত। বড়োই বিব্রত লাগছে তার, বাবা মেয়ে একসাথে থাকলে এমন গালি কি কারো দেওয়ার কথা?
সুহানা দরজার পাল্লা টেনে ধরে দাঁড়ালো। সুব্রতকে দেখে এক গাল হেসে বললো,
—— কি ব্যাপার? তোমাদের বাড়িতে থাকবো বলে কি যখন তখন চলে আসবে নাকি? আর হ্যাঁ, আমি তো এই বাড়ির বউ, আমার ঘরে যখন তখন মোটেও আসবে না৷
—— আমারও খুব শখ নেই। তোমার বাবা কেন এসেছে?
—— আমার কাছে এসেছে। তোমাকে কেন বলবো?
—— আমাকে বললে তো সহজে ব্যাপার মিটে যাবে, এই জন্যই বলবে না তো! কেন এসেছে বলো তো? এক প্লান ফেইল হওয়ায় নিউ কোনো প্লান বানানোর জন্য?
—— তোমার মতো এতোও নিচু না আমি। প্লিজ এখান থেকে যাও, আমি বাবার সাথে কথা বলছি। ডোন্ট ডিস্টার্ব।
সুব্রত ঘরের সামনে থেকে চলে আসলো। ঘরে গিয়ে তপসীকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
—— কাল রাতে বাবার ঘর থেকে এসেছো পর থেকে মুখ গোমরা করেই আছো। কি বলেছে বাবা?
—— বাবা তো অনেক কিছুই বলেছে।
—— বকেছে তোমায়?
—— আরেহ না। তবে,,,,
—— তবে কি?
—— আমার মাথায় একদমই ছিল না যে সুহানা দি ক্যান্টনমেন্ট চলে যাবে।
—— আমি কাল তোমায় একবার না করেছিলাম তো এই ব্যাপারটা এতো না ঘাটতে? শুধু শুধু ঝামেলা। এখন কি করবে?
তপসী চিন্তিত ভঙ্গিতে বিছানায় বসলো। দুই হাতে মুখ ঢেকে অনবরত বিরবির করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরেই রনিত আসলো ঘরে৷
রনিত কোনো ভনিতা ছাড়াই বললো,
—— ভাই শোন, বিয়ে করতে বলেছিস কোনো কারন না শুনেই বিয়ে করেছি৷ আর কয়েকদিন থাকবো বলে প্লান করেছিলাম কিন্তু এখন আর থাকার ইচ্ছে নাই। আমি টিকিট বুক করে ফেলেছি। পরশু বিকেলে ফ্লাইট আমার।
তপসী মুখ তুলে তাকালো। বড়োই করুণ দেখালো তার চোখের চাউনি। রনিত তপসীকে জিজ্ঞেস করলো,
—— কি হয়েছে তোমার?
—— আ’ম সর্যি রনিত দা। না বুঝেই অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি। এখন বুঝতেই পারছি না কি করবো! আমি সব গোলামাল করে দিলাম।
কথা বলতে বলতেই কান্না করে দিলো তপসী। তার নিজেকে পাগল লাগছে। এতো বড়ো ভুল করে ফেলেছে সে! সুব্রত কাছে এগিয়ে আসলো তপসীর। তপসীর পাশে বসে তপসীকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করল সে।
রনিত এক চিলতে হেসেই বললো,
—— সুহানা কে ভয় দেখাতে চেয়েছিল সেটা তো স্বার্থক। আর সুহানা বাড়ি থাকলেও আমি জানি তোমরা তার সাথে কখনই বাজে ব্যবহার করতে পারতে না। ভালো ব্যক্তিত্বের মানুষ চাইলেই খারাপ কাজ করতে পারে না। এটা তো স্বাভাবিক।
তপসীর কান্নার জোর আরো বেড়ে গেল। সুব্রত মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
—— ইট’স ওকে। এতো কান্না করতে হবে না। শুধু মাত্র এই নামমাত্র বিয়ের জন্য আকাশকুসুম কোনো সমস্যা হয়ে যাবে না।
—— বিয়ে কখনো নামমাত্র হয় না সুব্রত।
রনিত বললো,
—— ওকে বিয়ে হয়েছে তো? এখন ডিবোর্স দিয়ে দিলেই সব মিটে যায়, তাই না?
—— সুহানা দি যদি না দেয়?
—— অবশ্যই দিবে তপসী। এই মেয়ে কখন আমার সাথে সংসার করবে না। করতে চাইলেও কখনো পারবে না।
তপসী অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো রনিতের মুখ পানে। ছেলেটার জীবন হযবরল করার পিছনে তার হাতও আছে। এখন তার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।
৭৬.
দীর্ঘ পাঁচ মাস কেটে গেছে মাঝে। সবার জীবনের গতি আবার আগের মতোই হয়ে গেছে অনেকটা। রনিত নিয়মিত বাড়িতে ফোন করে। খোঁজ খবর নেয় সবার।
রনিতের সখ্যতা তপসীর সাথেই বেড়ে উঠেছে। অনেকটা ভাই বোনের মতোই। তপসীও নিজের বড়ো ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা করে রনিতকে।
রনিতের একটা প্রচন্ড বিশ্বাসের জায়গা তপসী। তাই তো রোজ যখন কারো কাছেই সুহানার স্বাস্থ্যের খবর জিজ্ঞেস করতে পারে না তখনও তপসীর কাছে ঠিকই জিজ্ঞেস করতে পারতে।
তপসীর হেসে জানায় সুহানার স্বাস্থ্য কতোটা উন্নতি করলো। ডাক্তার কি বলেছে, সবটা।
একদিন বিকেলে রনিত কল করলো তপসীকে। তপসী কল রিসিভ করেই বললো,
—— রনিত দা, আই হ্যাভ আ ভেরি স্পেশাল সারপ্রাইজ ফর ইউ।
রনিত হয়তো কিছুটা বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
—— কি সারপ্রাইজ বলো তো?
—— শোনো আজ দুপুরে সুহানা হাত নেড়েছে। আমার সামনেই।
—— বাহ বেশ উন্নতি করেছে তো!
—— হুম।
—— সুহানা সুস্থ হলে আমায় সবার আগে খবর দিবে কিন্তু। আমি সত্যিই ওকে ডিবোর্স দিয়ে মুক্ত করে দিবো। অনেক হয়েছে, আর পারছি না।
এই একটা কথা প্রায় প্রত্যেক দিনই তপসীকে বলে রনিত। তপসী খানিক হাসলো, এরপর বললো,
—— তুমি মাঝে মাঝে আমায় খুব মনে মনে বকো না?
—— বকার কোনো কারনই নেই। জানো কি মমে হয় মাঝে মাঝে? সুহানার এক্সিডেন্ট হওয়াটা খুব দরকার ছিল।
—— বাদ দাও ওসব কথা। কাকির সাথে কথা বলেছো আজ?
—— বলেছি। মা আজও তোমস্য দোষারোপ করে কেন বলোতো? ভাগ্য কি চাইলেই বদলে ফেলা যায়?
—— আমি দোষী তাই দোষারোপ করে। তোমার জীবন নাড়িয়ে দেওয়াটা তে আমার হাতও তো ছিল বলো। শুধু শুধু তো কিছুই হয় নি।
—— বাদ দাও। সুব্রতের কথা বলো। ও তো আমার সাথে কথা বলার সময়ই পায় না।
—— তোমস্র ভাই তো এত্তো ব্যস্ত। আমার সাথে একটু কথা বলে শুধু আর বাকি সময় খালি খালি বকে। আজও বকলো, আমি কেন পড়ি না। আরেহ আমি কি বাচ্চা যে সারাদিন পড়বো?
—— যেটা বলে সেটা তোমার ভালোর জন্যই বলে, বুঝলেন ফিউচার অধ্যাপক?
—— আচ্ছা আমি রাখছি। সুহানা দি’র মেডিদিনের টাইম হয়ে গেছে।
—— কেন? মেডিসিন তুলি দেয় না?
—— তুলি তো আজ সকালে ওর গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। কয়েক দিন থেক্র আসবে।
—— ওহ।
—— হুম, রাখো। টাইমলি মেডিসিন না দিলে সমস্যা হবে৷
,
,
তপসী মোবাইল ফোন বিছানার উপর রেখে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। সুহার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। যে ঘরটাতে আগে রনিত থাকতো, সেটাতে৷
সুহানার জন্য এখন আর তপসীর মনে কোনো রাগ নেই। নিজের উপর অবশ্য আছে। সুহানার ঘরের সামনে এসে খানিক থামলো। এরপর ভিতরে ঢুকে গেল। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সুহানা। তপসী সুহানা কে ধরে বসিয়ে দিলো।
নোট দেখে এক এক করে সব খাওয়াতে লাগলো সে।
সুহানার রূপ লাবন্য এখন কিছুই আর আগের মতো নেই। এখনো সে যে কারো চোখ ঝলসে দিতে পারবে, কিন্তু আগের সেই মোহনীয় সুহানা আর নেই। পাঁচ মাস আগে একটা কার এক্সিডেন্ট এর সম্মুখীন হয় সুহানা। গাড়িতে সে একাই ছিল। অনেকটা ক্ষত হয় আর অনেক রক্তক্ষরণও সেই সময়। মাথায় সিরিয়াস ইনজুরি ও হয়েছিল।
হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার রা জানায় রোগী
সিভিয়ার ডেমেজড এর কারণে ফুল বডি প্যারালাইজড হয়ে গেছে। বে সুস্থ হওয়ার চান্স আছে। তবে ক্ষীণ।
তপসীর এখনো সেদিন সকালের কথা । সেদিন সকালেও তো সুহানা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল।
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ৪৫
৭৭.
(পাঁচ মাস আগে)
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে রনিত পরিষ্কার জানিয়ে দিলো সে বিয়ে সম্পর্কিত আর কোনো অনুষ্ঠান চায় না। কেউ কোনো আরগ্যুমেন্ট করে নি, রনিতের কথাই মেনে নিয়েছিলো। কারো কোনো ইচ্ছা ছিলই না এই বিয়ে নিয়ে মাতামাতি করার।
রনিত যেদিন চলে যাবে সেদিন সকাল থেকে তার মায়ের মন আরো বেশি ভার হয়ে রইলো। সুহানা আসার পর থেকে সুহানার সাথে কেউই বেশি কথা বলেনি। সে নিজের মতো ঘুরছে ফিরছে, যা ইচ্ছা করছে।
সুহানা সেদিন সকালে নাস্তা করে লনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। বাড়ির কারোর সাথে কথা না বলার দরুণ সে জানতোই না যে রনিত চলে যাবে।
লনের পাশে তুলি বসে বসে ফুলের গোড়ার মাটি ঠিক করছিলো। সুহানা এগিয়ে গেল তার কাছে। অনেকটা গাম্ভীর্যের স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
—— এই মেয়ে, বাসায় কি কোনো কিছুর আয়োজন চলছে? সকাল থেকে দেখছি শুধু এটা রান্না করা হচ্ছে ওটা রান্না করা হচ্ছে!
তুলি মুখ তুলে তাকালো সুহানার দিকে। সুহানা কে তারও পছন্দ না। তবুও মুখে হাসির রেখা টেনেই বললো,
—— রনিত দাদাবাবু চলে যাবে তো, তাই তার পছন্দের খাবার রান্না করা হচ্ছে, আর পিঠা পুলি দাদাবাবুর সাথে করে কিছু পাঠিয়ে দিবে।
সুহানা বিস্মিত স্বরে বললো,
—— চলে যাচ্ছে মানে? ওর তো আরো দশ দিনের মতো থাকার কথা ছিল। এখনই চলে যাবে কেন?
তুলি বিরক্ত হলো। মনে মনে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—— স্বামীর তো খোঁজ খবর নেয় না কোনো, বিয়ের দিন যাত্রা পালা দেখাইলো, এখন আবার দরদ দেখাইয়া জিজ্ঞেস করা হইতেছে কেন চলে যায়!
মুখে যদিও কিছু বললো না। তুলির ছোট মিনমিন করা চোখের চাহনি দেখে সুহানা একটু অপ্রতিভ হলো। মেয়েটা কিছু বললো না কেন? সুহানা আবার জিজ্ঞেস করলো,
—— এই মেয়ে মুখে কি কুলুপ এঁটেছো? আর এমন বিচ্ছুর মতো তাকিয়ে আছো কেন?
—— এমনি চলে যাবে দাদাবাবু, সে বলছে সে নাকি কারো যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।
—— এই মেয়ে…
—— আমি বলি নি, দাদাবাবু নিজেই বলছে। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করেন গিয়ে।
সুহানা বাড়ির ভিতর চলে আসলো। রনিতের সাথে শেষ কথা হয়েছিল বিয়ের দিন রাতে, এরপর আর কোনো কথাই হয় নি। এতে অবশ্য তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু এখন সাংঘাতিক রাগ হচ্ছে। কেন রাগ হচ্ছে সে জানে না, না তার কষ্ট হচ্ছে না রনিতের চলে যাওয়ার সংবাদ শুনে।
রনিতের ঘরে সুব্রত বসে ছিল। সুহানা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই সুব্রতের উদ্দেশ্যে বললো,
—— তুমি একটু বাহিরে যাবে? আমার ওর সাথে কিছু কথা ছিল।
সুব্রত ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ানোর আগ মুহূর্তেই রনিত বললো,
—— কোথাও যাওয়ার দরকার নেই , এখানে বসে থাক ভাই। আমরা কথা বলছিলাম।
সুহানা ক্ষেপে গিয়ে বলে,
—— রনিত আমি বলছি তো কথা আছে।
—— আমার তোমার সাথে কোনো কথা নেই। এট লিস্ট এমন কোনো কথা তো নেই ই যা শুনতে হলে প্রাইভেসি দরকার।
সুহানা খানিক চেঁচিয়েই বললো,
—— বিয়ে যখন করেছো প্রাইভেসিও দরকার আছে। সুব্রত তুমি নির্লজ্জের মতোন বসে আছো কেন?
—— সুব্রত নির্লজ্জ না, তুমি নির্লজ্জ। এখানে কি করতে এসেছো?
—— রনিত দেখো আমি বলছি কিছু কথা আছে আমার।
—— এখানেই বলো, এখন।
—— সুব্রতের সামনে বলবো না৷
—— আমার কোনো প্রবলেম নেই সুব্রত এইখানে থাকলে৷
—— আমার সাথে রোমান্স করার হলেও কি সুব্রতকে সামনে নিয়ে দেখাবে? অসহ্য!
রনিত হো হো করে হেসে উঠলো। মুখে হাসি বজায় রেখেই বললো,
—— তোমার সাথে রোমান্স কে করবে? আমি তোমার কাছে আসবো কিনা তারই খোঁজ নেই, আর তুমি পড়ে আছো কারো সামনে করবো না আড়ালে?
—— স্বামীর মতো থাকবে না, স্ত্রীর মতো রাখবে না তাহলে স্ত্রী হিসেবে রেখেই কেন দেশ ছেড়ে পালাচ্ছো? ডিভোর্স কই আমার?
—— সময় মতো ডিভোর্স ঠিকই পেয়ে যাবে। ডোন্ট ওয়ারি। এমন বিষাক্ত কীটের সাথে সারাজীবন কাটানোর ইচ্ছা এমনিতেও আমার নেই।
সুব্রত উঠে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। সুহানা সেদিকে নজর না দিয়ে রনিতের সামনে গিয়ে ওর কর্লর টেনে ধরলো,
—— তোমার কি মনে হয় আমি মরে যাচ্ছি তোমার সাথে থাকার জন্য? তোমার সংসার করার জন্য? তোমার সাথে বিছানায় শোয়ার জন্য?
—— দেখো সুহানা, এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে আছে। এর মধ্যে এমন লম্ফঝম্প আমার সামনে করবে না। মাথা বেশি গরম করলে তোমায় মারতে আমার হাতে বাধবে না।
—— রনিত, আমায় আগে ডিভোর্স দিবে এরপর যেখানে যাওয়ার যাবে।
—— আজব! ডিভোর্স তো মুখের কলা তাই না? ওকে ফাইন! তোমার বাবার না এতো পাওয়ার, তোমার বাবাকে বলো দেখি! দুই মিনিটে ডিভোর্স প্রসেস টা সম্পূর্ণ করে দিতে৷
সুহানা রনিতের শার্টের কলার ছেড়ে দিল। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
—— ডিভোর্স হবে এটা তো জানতেই। কি দরকার ছিল তোমার রেজিষ্ট্রেশন করার?
—— আমার ইচ্ছা।
—— রনিত, আই ওয়ান্ট ডিভোর্স।
রনিত রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ডিবোর্স সে অবশ্যই দেবে, তাই বলে যখন তখন তো আর সেটা সম্ভব না! সময় লাগে এসবে।
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ৪৬
৭৮.
রনিত সেদিন দেশ ছাড়লো সন্ধ্যার ফ্লাইটে। আবার কিছুদিন পরেই আসবে যখন ডিবোর্স নেওয়া সম্ভব হবে।
দুই তিনদিন ভালোই কেটেছিল সব। সুহানা কারো সাথেই ঝামেলাতে যায় নি। সুহানা সুব্রতদের বাড়িতেই থেকেছে। যেহেতু ঝামেলা করলে সে একা সবার সাথে পেরে উঠবে না তাই সে শান্ত হয়েই থেকেছিল।
তার ছুটির আরো কিছুদিন বাকি ছিল। বাবার বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছা একদমই ছিল না হরেক রকম প্রশ্নের জন্য। বিয়ের পর একবার বাড়ি গিয়েছিল। মায়ের কথা শুনে সেখানে মন টিকে নি। তাই আবার শ্বশুর বাড়ি চলে এসে।
এরপরেও মা যে ক’বার ফোন করেছে তাকে বিভিন্ন ভাবে কথা শুনিয়েছে৷ তাই সে ইচ্ছে করেই বাবার বাড়ি যায় নি।
সুব্রতদের বাড়িতে থাকতেও তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। সবার তীর্যক দৃষ্টি তার বিরক্ত লাগতো। তাই ছুটির যে সময়টা বাকি সে সময়টা সে ঘুরে ফিরে কাটাবে বলে ঠিক করলো। এটাই হয়তো তার কাল ছিল।
ঢাকা সিলেট হাইওয়ে দিয়ে লং ড্রাইভের প্লান বানালো। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিকেলের দিকে বেরুলো গাড়ি নিয়ে, একা। কাউকেই কিছু জানায় নি। যে পরিবারের মানুষকে তার বিরক্ত লাগে তাদের আবার এতো জানানোর কি আছে!
মাঝেমধ্যে নিজের সঙ্গে নিজের একটা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা উচিৎ । সুহানা এসেছে সিলেট হাইওয়েতে। ঢাকা শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা জায়গায় থামলো । জায়গাটা বেশ নির্জন। তবে এর সৌন্দর্য নজরকাড়া। সুহানা আগে কখনো এখানে আসে নি। নাম জানা নেই তার৷ সৌন্দর্য নজর কেড়েছে বলেই এখানে থামলো ।
দু ধার দিয়ে সারি সারি ঝাউ গাছ লাগানো হয়েছে। একটা মাঝারি সাইজের ব্রীজ আছে। ব্রীজ থেকে নেমে হাতের বা দিকে পাঁচ মিনিটের পথ তারপর সুন্দর একটা লেক।
গাড়ি নিয়ে সোজা লেকের পাড়েই চলে আসলো ও৷ গাড়ি থেকে নেমে লেকের একাংশ ঘুরে ঘুরে দেখলো, বটতলায় সিমেন্টের বেঞ্চে বসে চুপচাপ বসে রইলো কতক্ষণ! খারাপ লাগছে না একা এসে। মানুষ যে বলে ডিপ্রেশনে থাকলে জনাকীর্ণ স্থানে যাওয়া উচিৎ, সুহানা তো বলে মন ভালো থাকলেও যাওয়া উচিৎ ।
নিস্তব্ধতায় নিভৃতে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করায় অন্যরকম একটা সুখ আছে। আত্নগ্লানিও হচ্ছে এখন। রনিত চলে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে শুধু শুধুই সুব্রত আর তার ঝামেলায় বেচারাকে কষ্ট দেওয়া হয়ে গেছে৷ সেখানে রনিত শুধু তার গায়ে এক ডিবোর্সীর তকমা লাগিয়েই থেমে যাবে৷
৭৯.
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে , সুহানা তখনো লেলের ধারেই বসে ছিল। ভালো লাগছে না আর তার। মনের মধ্যে কিছু একটা খচ খচ করছে। সুব্রতদের বাড়িতে ছিল সুযোগ বুঝে তপসীর একটা ক্ষতি করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এখন ইচ্ছে হচ্ছে না। আজ বাসায় গিয়ে হোটেলে উঠবে কোনো একটা। কাল সকালেই চলে যাবে ক্যান্টনমেন্টে।
এখন ভর সন্ধ্যেবেলা। ঝিঁঝি পোকার ডাক বাড়ছে। উহ্ নিস্তব্ধ প্রকৃতি হঠাৎ সরব হয়ে গিয়েছে। ভালো লাগছে না আর। এখনই বাড়ি ফিরবে না। শহরতলির অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াবে গাড়ি নিয়ে।
বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালো সুহানা। ফোনের ফ্ল্যাশটা জ্বালিয়ে ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো।
হঠাৎ মেঘের গুড়গুড় আওয়াজ শোনা গেল। অদ্ভুত এত সুন্দর রৌদ্রজ্বল দিন ছিলো আজ, এক নিমিষেই মেঘে ঢেকে গেল!
ভীষণ বিরক্তবোধ করলো সুহানা। মোবাইলের রিংটোন বাজছে। তপসীর নাম ভেসে উঠেছে। বিরক্তি আরো বেড়ে গেলো। এই মেয়েটা কেন ফোন করেছে!
সুহানা ফোন পিক করবে না করবে না ভেবেও রিসিভ করলো। তপসী ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—— দি, আপনি কোথায়?
—— আমি কোথায় তা দিয়ে তুমি কি করবে শুনি? আমার উপর খবরদারি করবে না।
ফোনের ওপাশে তপসী হয়তো ভারী নিঃশ্বাস ফেললো। এরপর তপসী বললো,
—— দি, খবরদারি করছি না। অনেকক্ষণ হলো আপনাকে বাড়িতে দেখি না, কেউ জানেও না কোথায় আপনি তাই জিজ্ঞেস করেছি।
—— যেখানেই থাকি না কেন, তোমায় কৈফিয়ত আমি দিবো না৷
—— আচ্ছা সর্যি আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য৷ যেখানেই থাকুন যলদি বাসায় চলে আসবেন। বেশি রাত করে বাড়ি ফেরা বাবার পছন্দ না৷
সুহানা হাসিতে ফেটে পড়লো। বললো,
—— তোমাদের ভালো লাগা মন্দ লাগা দেখছে কে? আমার ব্যাপারটা দেখেছিলে তোমরা?
—— আপনার ব্যাপারটা আমরা দেখেছি বলেই এখনো আমি এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারছেন নয়তো আপনার কর্মের ফল তো জঘন্য থেকে জঘন্যতম হওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, সময় মতো চলে আসবেন।
ইতমধ্যে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। সুহানা কান থেকে ফোন নামিয়ে লাইন কেটে দিলো। তার কি সত্যিই শাস্তি হওয়া দরকার ছিল নাকি? তার দেওয়া কষ্ট কি লোকে দেখেছে বলে তার শাস্তি পাওনা আর সুব্রতের তার মনে তৈরি করা ক্ষতের বিপক্ষে কোনো শাস্তি পাওনা হয় না? কারন মানুষের চোখে সে ক্ষত টা পড়ছে না তাই? সুহানা আর ভাবলো না। ফিরে যাওয়া যাক। আবার তাকে হোটেলেও যেতে হবে।
যেহেতু রাস্তা ফাঁকা, হাই স্পিডে ড্রাইভ করছে সুহানা। বৃষ্টির পানি পড়ে বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে গাড়ির কাঁচ। একটা অদ্ভুত শীতল হাওয়াও বয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিতে। নিমেষে ভালো লাগাটা হাওয়া করে দিয়ে বিরক্তি জায়গা করে নিয়েছে ওর মনের ভেতর। কোথাও যাবে না আর সোজা বাসায়।
একটা গান ছাড়া যেতে পারে কি? যদি মাইন্ড ডাইভার্ট হয়! এত মেজাজ খারাপ হয়েছে যে ড্রাইভও করতে ইচ্ছে করছে না। লুকিং গ্লাসে সুহানা তাকিয়ে দেখলো একবার। তার কপালের সিঁদুর স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে। রায়া জোর করে লাগিয়ে দিয়েছে। যতসব আদিখ্যেতা।
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সিঁথিতে ঘষলো। কপাল সারাটাই লাল বর্ণ ধারন করলো এতে। হাতের শাখার আওয়াজে আরো বেশি বিরক্ত লাগলো। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে গাড়ির সামনের আংশে হাত ঝাড়া মারলো। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে, তবুও রাগ কমছে না।
হাইওয়ে দিয়ে চলছে ওর গাড়ি। আশেপাশে কোনো গাড়িঘোড়া নেই। সামনে একটা তিন মাথার মোড়। একবার ভাবলো স্পিড কমাবে কি? অপজিট সাইড থেকে যদি কোনো গাড়ি আসে! কি ভেবে এই চিন্তা বাদ দিলো।
এক হাত স্টিয়ারিংয়ের ওপর রেখে সামান্য ঝুকলো গান ছাড়ার জন্য। হঠাৎ মনে হলো খুব কাছে থেকে মালবাহী ট্রাকগুলোর গমগম আওয়াজ শুনছে। চকিতে মাথা তুলে তাকালো সুহানা। তীব্র হলুদ লাইট গাড়ির স্যাতস্যাতে কাঁচ ভেদ করে ওর চোখে এসে লাগলো। নিজের জায়গায় জমে গেল সুহানা।
স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অন্যদিকে নেবে তা যেন মাথাতেই এলো না। অতঃপর থ্যাচ করে একটা শব্দ হলো। ছিঁটকে পড়ে গেলো ওর গাড়িটা। রাস্তার মধ্যেই কয়েকটা ডিগবাজি খেলো। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে আসেপাশে চোখ বুলালো। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ট্রাকটাও চলে গেছে বহুদূর।মৃত্যুর স্বাদটা কি তাহলে আজই পেতে হবে তার!
৮০.
রাত তখন এগারোটা। তপসীরা হাসপাতালে এসেছে। সুব্রতকে দেখতে পেয়ে সুহানার বাবা তেড়ে আসলো তাকে মারার জন্য। সুব্রত থামালো তাকে।
সুব্রত দাতে দাত চেয়ে বললো,
—— আপনার মেয়ের এক্সিডেন্টের দায় অবশ্যই আমাদের না। বেশি তেড়িবেড়ি করবেন না।
সুহানার বাবা ফ্লোরে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মেয়েটা তাদের জীবন। সুহানার মা অনেক আগেই জ্ঞান হারিয়েছে। এই হাসপাতালেরই আরেক কেবিনে তাকে রাখা হয়েছে।
তপসী ক্রন্দনরত সুহানার বাবার সামনে গিয়ে বসলো। জিজ্ঞেস করলো,
—— আঙ্কেল কোথায় এক্সিডেন্ট হয়েছে? কারা নিয়ে এসেছে দি কে?
—— সিলেট হাইওয়েতে। এক ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, তারাই ফাঁকা রাস্তায় ওর গাড়ি বিচূর্ণ দেখে ওকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে এসেছে। আমার মেয়েটা এখন ওদের কারণেই জীবিত আছে। কিন্তু এতোক্ষণ বেঁচে থাকবে তা কে জানে!
—— আঙ্কেল শান্ত হন, দি সুস্থ হয়ে যাবে।
—— তুমি একদম আমায় স্বান্তনা দিতে আসবে না। তোমাদের জন্যই আমার মেয়ের এই অবস্থা। তোমাদের অশান্তিতেই এমন হয়েছে। নয়তো আমার মেয়ে ওমন অচেনা জায়গায় কেন যাবে বল?
তপসী এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলো। অশ্রু আগে থেকেই তার চোখে বহমান ছিল। চোখের সামনে ঘোরাফেরা করা মেয়ের এমন দুর্ঘটনার কথা শুনলে যে কারো মাথা আউলে যাবে।
সুব্রত তপসীকে টেনে তুললো। বেঞ্জে বসিয়ে দিয়ে বললো,
—— তপসী একদম এর দায় আমাদের নয়, তুমি চিন্তা করো না।
—— দায় নিয়ে চিন্তা হচ্ছে না সুব্রত৷ দি বাঁচবে তো?
—— বেঁচে যাবে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করো শুধু।এর বেশি কিছুই করার নেই আমাদের।
চলবে…..
চলবে….
(ছোট হওয়ার জন্য দু:খিত)
চলবে……