নিবিদ্রিতা কাহন পর্ব -৩৫

#নিবিদ্রিতা_কাহন—–৩৫
®মেহরুমা নূর

★তুলি বেগমের অসুস্থতা হঠাৎই একটু বেড়ে গেছে। আবিরের বাবা তাকে ক্লিনিকে নিয়ে এসেছে। সাথে তানহাও এসেছে। আসলে তুলি বেগমের সাথে একজন মেয়ে মানুষ আসার দরকার ছিলো। তানি একটু তার বাবার বাসায় গেছে। তাই তানহাকেই আসতে হয়েছে । কিন্তু এখানে এসে অনেকটা বিপাকে পড়ে গেছে সে। কারণ তাকে অপরাহ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সামনেই দাদুনকে চেক-আপ করছেন উনি। যাকে সে গত কয়েকদিন যাবৎ খুব বাজে ভাবে এরিয়ে যাচ্ছে। তার কাছ থেকে একপ্রকার নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। কিন্তু আজ তার সামনে এসে চোখ মেলানো ভার হয়ে যাচ্ছে যেন। তানহা একবার চোরা চোখে তাকিয়ে দেখলো অপরাহ্ন কেমন গম্ভীর মুখ করে আছে। যেন ভীষণ পরিমাণ রাগ পুষে আছে সে। তুলি বেগমের চেকাপ করতে করতে অপরাহ্ন জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে দাদুন! এমন ইয়াং এন্ড বিউটিফুল রমনী আবার অসুস্থ কীভাবে হয়! সত্যি করে বলোতো কি হয়েছে? দাদা কি বেশি জ্বালায় নাকি তোমাকে!”
তুলি বেগম হাসিমুখে বলল,
“নারে অপু। আসলে টুডে মর্নিং মর্নিং আই মাথা ইস ভেরি রাউন্ড এন্ড রাউন্ড। তারপর আবার বমিটিংও হোয়িং। আইতো ভেরি অসুস্থায়িং। কি জানি হোয়াট হাঁপানি(হ্যাপেন্ড) টি মি।”
তুলি বেগমের বিশ্ববিখ্যাত ইংলিশ শুনে স্মিথ হাসলো অপরাহ্ন। মজার সুরে বলল,
“বলো কি দাদুন। তাহলেতো মনে হচ্ছে গুড নিউজ দিবে তুমি। বাহ! দাদার স্টামিনার দাগ দিতে হবে। এই বয়সেও জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।”
তুলি বেগম হেঁসে বলল,
“চুপ নটি বয়, হোয়াট বলিস এসব!”
অপরাহ্নের কথায় তানহাও ঠোঁট টিপে হাসলো।চেক-আপ শেষে অপরাহ্ন আবিরের বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
“দাদুনের বিপি অনেক বেশি। আর ডায়বেটিস টাও বেড়ে গেছে। একারণেই অসুস্থতা বেড়ে গেছে। ঔষধের সাথে সাথে দাদুনের খাবার দাবারের ব্যাপারেও নিয়ম মেনে করতে হবে।কিছু টেস্ট লিখি দিচ্ছি। আমাদের ক্লিনিক থেকে করিয়ে নিন। যদিও তেমন বড় কোন সমস্যা নেই। তবুও মাথা ব্যাথার জন্য একটা নিউরোলজিস্ট দেখিয়ে নিলে ভালো হবে। আমার পরিচিত এক বন্ধু নিউরোলজিস্ট। ওর কার্ড দিচ্ছি। হেল্থ এন্ড কেয়ার হসপিটালে বসে ও। দাদুনকে একবার দেখিয়ে আসুন৷”
“ঠিক আছে অপু। নিয়ে যাবো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। প্যাথলজিতে দাদুনের স্যাম্পল দিয়ে যান।”
“আচ্ছা।”

এর মাঝে একবারও অপরাহ্ন তানহার দিকে তাকালও না। কেবিন থেকে বের হয়ে তানহা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। লোকটার সামনে বসে থাকা অনেক কষ্টকর হয়ে উঠেছিল তানহার জন্য। হঠাৎ মনটা ভীষণ হয়ে উঠছে কেমন যেন। না চাইতও মন টেনে চলেছে ওই ডাক্তারের কাছে।তবে নিজেকে শক্ত করে নিলো তানহা। আবিরের বাবা তুলি বেগমকে নিয়ে প্যাথলজিতে গেল। তানহা বাইরের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো তাদের। হঠাৎ কোথাথেকে আচমকা অপরাহ্ন এসে তানহার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে দাঁড় করাল। তানহা চমকে গেল ভীষণ। কিছু বলার আগেই অপরাহ্ন শক্ত কন্ঠে বলল,
“সবার সামনে সিনক্রিয়েট করতে না চাইলে চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো আমার সাথে চলো।”
বলেই তানহার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো সে। তানহাও অপরাহ্নের হুমকির সামনে ভয়ে আর কিছু বলতে পারলোনা।লোকজনের সামনে কোন সিনক্রিয়েট করতে সেও চায়না। তাই অগত্যা অপরাহ্নের সাথে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলো।

অপরাহ্ন তানহাকে সোজা ওর কেবিনে নিয়ে এলো। ভেতরে এসে ঠাস করে বিকট শব্দে কেবিনের দরজা বন্ধ করে দিলো। এতো জোরে বন্ধ করলো যে তানহার অন্তর কেঁপে উঠল। তারপর তানহাকে কেবিনে রাখা সোফায় ঠাস করে বসিয়ে দিলো। আর নিজে তানহার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। তানহার ভেতর ভয় বাড়তে লাগলো। অপরাহ্নের চোখ মুখ এখন ভীষণ পরিমাণ লাল হয়ে আছে। তার রাগ দেখেই ভয় লাগছে ওর। অপরাহ্ন তানহার দুই পাশ দিয়ে সোফায় দুই হাত রেখে তানহার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“এখন বলো,সমস্যা কি তোমার!”
তানহা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
“কি….কি সমস্যা! সমস্যা আবার কিসের! অসুস্থ দাদুন। আমি না।”
অপরাহ্ন চোয়াল শক্ত করে বলল,
“তানহা ডোন্ট ট্রাই মাই পেশেন্ট। এমনিতেই প্রচন্ড গরম হয়ে আছে মাথা। তাই হেয়ালি না করে সোজাসুজি বলো সমস্যা কি তোমার। তুমি ভালো করেই জানো আমি কোন সমস্যার কথা বলছি।”
“না আমি জানি না। আমি বুঝতে পারছি না আপনি কিসের কথা বলছেন।”
অপরাহ্ন এবার একটু ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
“ও আচ্ছা, তুমি জানোনা তাইনা! গত কয়েকদিন যাবৎ কি করছ তুমি! আমার ম্যাসেজ সিন করোনা। ফোন দিলে ধরোনা৷ কলেজে দেখা করতে গেলেও তোমাকে পাওয়া যায় না। সমস্যা কি তোমার! কেন করছ আমার সাথে এমন!”
তানহা এবার একটু দৃঢ়তার সহিত বলল,
“আপনি কি বলতে চাইছেন আমি সত্যিই বুঝতে পারছিনা। আপনি আমার ভাইয়ের বন্ধু। আমাদের পরিচিত জনের একজন। এছাড়া আমাদের মধ্যে এমন কোন সম্পর্ক নেই যার কারণে আপনার সাথে রোজ দেখা বা যোগাযোগ রাখাটা জরুরী বা বাধ্যতামূলক। তাহলে আপনি কেন আমার কাছ থেকে এমন কিছু এক্সপেক্ট করছেন!”
তানহার কথায় অপরাহ্নের রাগ যেন বাড়লো বৈ কমলো না।সে সোফায় সশব্দে একটা চাপড় মেরে বলে উঠলো,
“রিয়েলী! তুমি কিচ্ছু বোঝনা! এতটাও নিশ্চয় কচি খুকি না তুমি! একটা ছেলে একটা মেয়ের পিছে ঘুরলে তার মনোভাব কি সেটা বোঝার জন্য নিশ্চয় রকেট সাইন্সের প্রয়োজন হয় না। আমি কেন তোমার পিছে পিছে আসি,কেন তোমার সাথে একটুখানি কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি, কেন তোমাকে একনজর দেখার জন্য টিনেজারদের মতো নানান অজুহাতে কলেজের সামনে চলে যায়,কেন তোমার ভালো-মন্দ আমাকে বিচলিত করে এসব কিছু কি তুমি বোঝনা! নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছ, বলো!
অপরাহ্ন হঠাৎ দুই হাতে তানহার মাথা ধরে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে অধীর কন্ঠে বলল,
” ভালোবাসি,ড্যাম ইট৷ এটা কি বুঝিস না তুই!”

স্থির হয়ে গেল তানহা। ধমকে গেল তার হৃৎস্পন্দন। অপরাহ্নের এইমাত্র বলা শব্দটা কেবিনের চার দেয়ালে ঝংকারিত হয়ে বাজতে লাগলো। নিজেকে হঠাৎই শক্তিহীন মনে হতে লাগলো।হাত পা অবশের মতো কাঁপতে লাগলো। অপরাহ্ন কন্ঠে এবার আবেগ মাখিয়ে আবারও বলল,
“ভালোবাসি তানহা। খুব ভালোবাসি আমার শ্যামকন্যাকে।”
তানহা আর যেন নিতে পারলোনা। গলার মাঝে দলা পাকানো কান্নাগুলো ঢোক গিলে নিয়ে নিজেকে শক্ত করে অপরাহ্নের কাছ ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“প্লিজ, আমার সাথে এমন করবেন না। আমি জানি আপনি কি করতে চাইছেন। আপনি আমার সাথেও এক্সপেরিমেন্ট করতে চাচ্ছেন।জীবনে অনেক মেয়ের সাথেই হয়তো সম্পর্ক করেছেন। তাই এখন আমার সাথেও এক্সপেরিমেন্ট করতে চাচ্ছেন। ভাবছেন এই বোকাসোকা, এভারেজ লুকিং মেয়েটার সাথেও একটু এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা যাক তাইনা! নাহলে আপনার মতো লোক আমার মতো মেয়েকে কেন ভালোবাসতে যাবে! না দৈহিক সৌন্দর্য, না দক্ষতা কোনটাইতো আপনার সাথে যায়না। আপনার জন্যতো কত ভালো ভালো সুন্দরী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার মেয়েরা লাইন লাগিয়ে আছে। তা ছেড়ে আমার মাঝে কি দেখে ভালোবাসবেন! এটা শুধুই ইয়ার্কি ছাড়া আর কিছুই না। তাই প্লিজ আমার সাথে এমন বেহুদা মজা করবেন না প্লিজ। আমি অনেক দূর্বল মনের। এসব সহ্য করতে পারি না।”

তানহার অভিব্যক্তি শুনে অপরাহ্ন আহত চোখে তাকালো তানহার দিকে। এতদিনে মেয়েটা তাকে এই ভাবলো! নিজের উপরই যেন হাসি পেল তার। অপরাহ্ন তাচ্ছিল্যকর একটা হাসি দিয়ে বলল,
“ওয়াও তানহা! গ্রেট! আমার ব্যাপারে তোমার মনোভাব শুনে আমি বাকরুদ্ধ। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি আমি। আমার ব্যাপারে যদি সত্যিই তুমি এই ধারণাই করে থাকো তাহলে আর কিছু বলারই থাকে না। আম সরি তানহা তোমাকে এভাবে আনার জন্য। তুমি এখন যেতে পারো। আজকের পর আর আমার পক্ষ থেকে কোন ডিস্টার্বেন্স আসবেনা।”
তানহার শরীর হঠাৎ কেমন যেন অসার হয়ে এলো। বুকের মাঝে যন্ত্রণা হচ্ছে অসহনীয়। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেই অপরাহ্ন পেছন থেকে বলে উঠলো,
“তবে একটা কথা শুনে যাও তানহা। আমার ভালোবাসা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে একদিন অবশ্যই তোমারও সেই ভালোবাসার উপর বিশ্বাস আসবে৷ সেদিন তুমি নিজেই আসবে। আমি অপেক্ষায় থাকবো সেদিনের। অপেক্ষায় থাকবো তোমার ফিরে আসার।”
তানহা আর থাকতে পারলোনা। নিজের কান্না আঁটকে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল সে।
___

তুলি বেগমের স্বাস্থ্যের খুব একটা উন্নতি হলোনা। বরং উল্টো আরও অবনতি ঘটছে। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে একেবারে। বাড়ির সবাই চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লো। অপরাহ্নের কথামতো তুলি বেগমকে নিউরোলজিস্টকে দেখানো হয়েছে। তিনি তুলি বেগমকে নিয়মিত কিছু ট্রিটমেন্টের জন্য হসপিটালে এডমিট করতে বলেছেন। ডক্টরের কথামতো তুলি বেগমকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। তার পাশে পরিবারের সদস্যরা কেউ না কেউ সর্বক্ষণ থাকে। নাহলে তুলি বেগম বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি শুরু করে দেন৷ সকাল থেকে আহনাফ সাহেব, আবির,তানি ওরা ছিলো। দুপুরের পর আবার সানা, তাসির ওরা আসে। আর বিকালের দিকে সব পোলাপান গুলো এসে হাজির হয়। মুহুর্তে ওরা হসপিটালকে পিকনিক স্পট বানিয়ে দেয়। তাসান বাংলা সিনেমার নায়কের মতো স্লো মোশনে দৌড়ে এসে তুলি বেগমের উদ্দেশ্যে ড্রামাটিক ভঙ্গিতে বলল,
“প্রেতাত্মা, থুক্কু প্রিয়তমা,দেখ তোমার আশিক,তোমার জানে জিগার,সাইকেলের গিয়ার এসে গেছে। আমি থাকতে কিছু হবে না তোমার। আমি এখুনি গান গাইবো আর তুমি একদম ঠিক যাবে দেখবে।”
সানভি মাঝখান থেকে বলে উঠলো,
“কেন, তোর গানে কি প্যারাসিটামল আছে নাকি যে নানুমনি ঠিক হয়ে যাবে!”
“আরে এটা বাংলা সিনেমা থেরাপি বুঝলি!যেটা বড় বড় সাইনটিস্টরা করতে পারে না সেটা এই থেরাপি করতে পারে বুঝলি! বাংলা সিনেমায় গান গাইয়ে মরা মানুষ জীবিত করে ফেলে। তাহলে এটা এমন কি জিনিস! ”
বলেই তাসান গলা ছেড়ে গান ধরলো,
♬ তুলি লো তোর পাকা মাথার কেশ
♬ ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে পাগল করলি দেশ

তাসানের গানে হাসির ফোয়ারা ছুটলো সবার মাঝে। ওদের মাঝে একটু পর নিবিড়ও অফিস থেকে সরাসরি হসপিটালে এলো। সেও তুলি বেগমের সাথে মজা করে বলল,
“জলদি ঠিক হয়ে যাও দাদুন। নাহলে তোমার জামাই হাত ছাড়া হয়ে যাবে কিন্তু। এখুনি দেখলাম বাইরে সিনিয়র ফিমেল ডাক্তারের সাথে প্রেমলিলা করে বেড়াচ্ছে।”
নিবিড়ের কথায় তুলি বেগম তেতে উঠে বলল,
“কিহ! এত বিগ ডেয়ার ওর! এখুনি ফান শো করছি ওকে।”
ওদের কথার মাঝেই নার্স এসে বলল,
“আপনারা সবাই বাইরে যান।এখন ডক্টর আসবে রুগী দেখতে। ”

সবাই বাইরে এসে দাঁড়াল। সানভি হঠাৎ আদ্রিতা আর তানহার উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে বলল,
“দেখ দেখ ওই ডক্টরটা হ্যান্ডসাম না! আমি এসেই ওই ডক্টরের উপর ক্রাশ খেয়েছি। তোদের কেমন লাগলো!”
ডক্টরের কথা বলতেই তানহার অবচেতন মনের দেয়ালে হঠাৎই অপরাহ্নের চিত্র প্রতীয়মান হলো। তার সাথেই বিষন্নতা ভর করলো তার সর্বস্ব জুড়ে। তাই সে আর সানভির কথার কোন জবাব দিলোনা। চুপ করে ওয়েটিং এরিয়ার চেয়ারে বসে রইল। আদ্রিতা সানভির কথার পরিপেক্ষিতে ওই ডক্টরকে দেখলো একটু।তারের বলল,
“হ্যাঁ ঠিকঠাকই আছে। দেখে মানুষ মানুষই মনে হচ্ছে। গাধা,ঘোড়া মনে হচ্ছে না।”
সানভি বলল,
“অরিরে,আমার একটু হেল্প করনা! ওই ডক্টরকে গিয়ে বলবি আমার বোন অসুস্থ একটু দেখুন। তখন সে এসে আমাকে দেখবে। এই উছিলাই পটিয়েও ফেলা যাবে।”
“কেন! এতে আমার কি লাভ! মাগনা মাগনী আজকাল কিছুই পাওয়া যায় না বস।”
“তোকে আমার নতুন কেনা হেডফোন টা দিয়ে দিবো। তাহলে করবিতো প্লিজ! ”
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। এত করে বলছিস তাই যাচ্ছি।”
“আচ্ছা আমি ওই কেবিনটাতে গিয়ে বসছি। তুই ডক্টরকে নিয়ে আসিস কেমন!”
“ঠিক আছে।”

আদ্রিতা এগিয়ে গেল ওই ডক্টরের কাছে। সানভির শিখিয়ে দেওয়া কথা অনুযায়ী তার সাথে কথা বলতে লাগলো। তারপর তাকে নিয়ে সানভির বলা কেবিনে নিয়ে গেল। ডক্টরকে কেবিনে দিয়েই আদ্রিতা চলে এলো। বাইরে আসতেই আচমকা নিবিড় আদ্রিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশের একটা ফাঁকা কেবিনে নিয়ে এলো। কেবিনে ঢুকেই একহাতে আদ্রিতার থুতনি শক্ত করে চেপে ধরে অগ্নিলাল চোখে তাকিয়ে বলল,
“সাহস অনেক বেশি বেড়ে গেছে তোর তাইনা! কি করছিলি ওই ডক্টরের সাথে একা একা তুই! কি করলে আমার সব নিয়ন্ত্রণ ভেঙেচূড়ে যাবে,আমার মাথা ফেটে যাবে তা খুঁজে খুঁজে বের করাই তোর একমাত্র কাজ তাইনা!”
আদ্রিতার মনে হচ্ছে তার চোয়াল বুঝি ব্যাথায় অবশ হয়ে খসে পড়বে এবার।ব্যাথায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো তার। তা দেখে বোধহয় উন্মাদ নিবিড়ের হুঁশ এলো। ছেড়ে দিলো সে আদ্রিতার চোয়াল। চোয়াল আলগা হতেই হালকা ফুঁপিয়ে উঠলো আদ্রিতা। নিবিড় উল্টো দিকে ঘুরে নিজের চোখ বন্ধ করে নিজেকে হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলো। আদ্রিতা নাক টেনে ফোপাঁতে ফোপাঁতে সানভির ব্যাপার টা ক্লিয়ার করে দিলো। নিবিড় আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে চোয়াল চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“সানভি বললেই তোকে তাই করতে হবে! তোর কি নিজস্ব কোন জ্ঞান নেই ইডিয়ট! কাল যদি বলে বুড়িগঙ্গায় ঝাপ দে, তাই দিবি তুই! ”
আদ্রিতা বোকার মতো বলে উঠলো,
“ঝাপ দিবো কীভাবে! আমি কি সাঁতার জানি নাকি! আগে সাঁতার না শিখতে হবে! ”
এই পর্যায়ে নিবিড়ের রাগ যেন আর থাকলোনা। মাথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে হালকা হাসলো সে তার বোকা পুতুলের কথায়। এগিয়ে এলো আদ্রিতার কাছাকাছি। আদ্রিতা একটু ভয় পেল। ভাবলো নিবিড় বোধহয় আবার রাগ দেখাবে। কিন্তু তা হলোনা। নিবিড় আদ্রিতার গালে আলতো করে হাত রাখলো। তখন ওভাবে চেপে ধরায় আদ্রিতার চোয়ালের কাছে লাল হয়ে গেছে। নিবিড় সেখানে বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে দিতেই ব্যাথা পেয়ে হালকা ককিয়ে উঠলো আদ্রিতা। নিবিড় আদ্রিতার গালের লাল হওয়া স্থানে চুমু খেয়ে অসহায় সুরে বলে উঠলো,
“তুই এতো ননির পুতুল কেনরে! সামান্য ছোঁয়াতেই তোর এই অবস্থা। যখন গভীর ছোঁয়া পাবি তখনতো তোকে আইসিউতে ভর্তি করতে হবে। আমার ভবিষ্যৎ গভীর অন্ধকারে ডুবতে দেখতে পাচ্ছি আমি। ”
নিবিড়ের বলা কথাটার সারমর্ম বুঝতে অনেকটা সময়ই ব্যায় করতো হলো আদ্রিতাকে। আর যখন বুঝতে পারলো তখন লজ্জারা চারিদিক থেকে দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়লো আদ্রিতার উপর। নিজেকে কোন সিন্দুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার লোকটা দিনদিন যেন অসভ্য হয়ে উঠছে। আদ্রিতাকে শুধু লজ্জা দেয়।

ওদের কথার মাঝেই হঠাৎ কেবিনের দরজায় নক পড়লো। আদ্রিতা একটু হকচকিয়ে উঠলো। নিবিড় আদ্রিতার হাত ধরে চোখের ইশারায় আস্বস্ত করলো। আদ্রিতার হাত ধরেই এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে দেখলো একজন ফিমেল ডক্টর দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো এটা তারই কেবিন হবে বুঝতে পেরে নিবিড় বলে উঠলো,
“সরি ডক্টর, আসলে আমার ওয়াইফ একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলতো তাই এখানে একটু রেস্ট করাতে নিয়ে এসেছিলাম। কিছু মনে করবেন না।”
আদ্রিতার মুখ আপনাআপনি ফুটবল আকার হয়ে গেল। কীভাবে এত সুন্দর করে মিথ্যে কথাটা বলে দিলেন উনি। যেন খুবই স্বাভাবিক কথা এটা। কথা বলেই নিবিড় আদ্রিতার হাত ধরেই ওখান থেকে চলে যেতে নিলো। দুই কদম এগুতেই পেছন থেকে মেয়েলী কন্ঠে শোনা গেল,
“মিঃ নিবিড় শাহরিয়ার! ”
ডক্টরের মুখে নিবিড়ের নাম শুনে নিবিড়, আদ্রিতা দুজনই পেছনে ফিরে তাকালো। ফিমেল ডক্টরের চোখে মুখে অদ্ভুত বিস্ময় ছড়িয়ে আছে। ডক্টর ওদের কাছে এগিয়ে এসে রহস্যময় হাসি টেনে বলল,
“ফাইনালি।দ্য গ্রেট নিবিড় শাহরিয়ারের দর্শন পেলাম৷ আমিতো ভেবেছিলাম এজনমে হয়তো আর দেখাই হবে না।”
ডক্টরের কথা বলার ধরণ দেখে ভ্রু কুঁচকে আসলো আদ্রিতার। কে এই মেয়ে! আর নিবিড় ভাইয়াকে চেনে কীভাবে! আদ্রিতার মতো নিবিড়ও ভ্রু কুঁচকে বলল,
“জি বুঝলাম না। আপনি কি আমাকে চেনেন!”
ডক্টর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“বাহ! তাহলে এখন চিনতেও পারছনা! কলেজে যে মেয়েটা তোমার জন্য নিজের জান দিতে চলেছিল, আজ তাকে তুমি চিনতেও পারছনা! জেরিন নামের সেই মেয়েটাকে বেমালুম ভুলে গেলে! অন্তত মনে রাখার মতোও প্রয়োজন মনে করলে না!”

ডক্টরের কথায় নিবিড়ের চোখে মুখেও এবার কিছু মনে পড়ার আভাস পাওয়া গেল। সে বিস্মিত সুরে বলল,
“জেরিন!!
এবার আদ্রিতার মনটা হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠলো। মেয়েটার কথাবার্তা যেদিকে ইঙ্গিত করছে তা ভাবতেও আদ্রিতার বাজে রকম অনুভূতি হচ্ছে। যে অনুভূতি আদ্রিতার অসহনীয় পীড়া দিচ্ছে।

চলবে……
(আজকে এপর্যন্তই। বাকি পর্ব কাল দিবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here