নিবিদ্রিতা কাহন পর্ব -৪৩

#নিবিদ্রিতা_কাহন—-৪৩
®মেহরুমা নূর

★সকালে আদ্রিতার ঘুমন্ত মুখটার দিকে মায়ার সমুদ্র ভরা চোখে তাকিয়ে আছে নিবিড়।হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিচ্ছে আদ্রিতার কোমল তুলতলে গাল। স্নিগ্ধ ভোরের ন্যায় শুভ্রতা তার পুতুলের মাঝে পায় সে। নিবিড় হাজার জনম ধরে দেখলেও তার হৃদিপদ্মকে দেখার তৃষ্ণা মিটবেনা। এই মুখটাতেই তার সকল প্রশান্তি,সকল অভিলাষা। নিবিড়ের নয়নবিলাসের মাঝেই আদ্রিতা ধীরে ধীরে নেত্রপল্লব মেলে তাকালো। নিবিড়ের জন্য যেন আদ্রিতার এই ডাগরআঁখি মেলে তাকানোই তার সূর্যোদয়। তার সেই সূর্যোদয় হতে দেখে নিবিড়ের ঠোঁটে মুগ্ধ হাসির ঝলক ফুটল। তবে আদ্রিতার চোখের চাহুনি কেমন অপরিচিত দেখাল। মনে হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখেছে সে। নিবিড় মুচকি হেঁসে আদ্রিতার ঠোঁটে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
“গুড মর্নিং পুতুল বউ।”
বিপরীতে আদ্রিতা আচমকা দুই হাতে নিবিড়কে সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিজের উপর থেকে সরিয়ে উল্টে ফেলে দিলো। তারপর রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
“কে আপনি! সাহস কি করে হলো আমার সাথে অসভ্যতামি করার! এক্ষুণি সরে যান এখান থেকে। সোনা মা,….সোনা মা,…. দেখো আমার ঘরে এক গুন্ডা ঢুকে পড়েছে।”
নিবিড়ের যেন পুরো পৃথিবী থেমে গেল এক মুহূর্তে। প্রকৃতির সব চলন থেমে গেল। থেমে গেল হাওয়া। সাথে থামলো নিবিড়ের নিঃশ্বাসও। নিঃশ্বাস আঁটকে গেল তার। শ্বাসকষ্ট হতে শুরু হলো। মনে হচ্ছে শেষ মুহূর্ত বুঝি চলে এসেছে তার। আদ্রিতার চোখে ওই অপরিচিত চাহুনি দেখার চেয়ে মৃ,ত্যুও শ্রেয় যেন। নিঃশ্বাস নিবিড়ের দেহ ত্যাগ করতে চাচ্ছে যেন।

ঠাস করে চোখ খুলে তাকালো নিবিড়। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে হাঁপাতে লাগলো সে। পুরো শরীর ঘেমে জবজবে হয়ে গেছে। গলা শুঁকিয়ে হয়েছে মরুভূমি। খাটের পাশের কেবিনেট থেকে পানির বোতল নিয়ে গটগট করে পুরো বোতল খেয়ে ফেললো। কি ভয়াবহ স্বপ্ন ছিল এটা! এমন স্বপ্ন আসলে আজ থেকে নিবিড় আর ঘুমাবেই না। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে একটু শান্ত করলো সে। পাশে ফিরে তাকিয়ে ঘুমন্ত আদ্রিতাকে দেখে বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। মায়া ভরা করুন চোখে তাকিয়ে রইলো সে আদ্রিতার রোগাটে শুকনো মুখটার দিকে। ওদের বিয়ের দুদিন হয়ে গেছে। অথচ তার বউটা হয়তো জানেও না সে বিবাহিত হয়ে গেছে। আদ্রিতার অবস্থা আরও অবনতির দিকেই যাচ্ছে শুধু। নিবিড় এতো দৌড়াদৌড়ি করেও এখনো কিছু করতে পারছেনা। তার চোখের সামনে প্রাণচঞ্চল মেয়েটা কেমন শয্যাশায়ী হয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে। চোখের কোনে কালি পড়ে গেছে। প্রায় সময়ই বেহুঁশের মতো পড়ে থাকে। আর যখন জাগনা থাকে তখন যন্ত্রণায় ছটফট করে। অথচ নিবিড় কিছুই করতে পারছেনা। এই অপারগতায় নিবিড়ের নিজেকেই ছুরিকাঘাতে আহত করে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে মন চায়। নিবিড় বেথাতুর চোখে তাকিয়ে আদ্রিতার গালে হাত বোলালো। চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে৷ প্রিয় মানুষটাকে এমন করুন অবস্থায় দেখার চেয়ে যন্ত্রণা বুঝি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। মৃ,ত্যু যন্ত্রণার মতো যন্ত্রণা হচ্ছে নিবিড়ের। হৃদয়ে অসহনীয় র,ক্তক্ষরণ হচ্ছে। যদি কেউ বলতো নিবিড়ের জানের বদলে আদ্রিতা ঠিক হবে তাহলে হাসিখুশি নিবিড় তা করে দিতো। কি করবে নিবিড়! কীভাবে ঠিক করবে নিজের প্রানভোমরাটাকে।

নিবিড়ের চিন্তার মাঝেই আদ্রিতা ধীরে ধীরে দূর্বল চোখ দুটো মেলে তাকালো। তা দেখে দ্রুত নিজের মুখের দুঃখী ভাব সরিয়ে হাসি হাসি মুখ করে তাকালো নিবিড়। আদ্রিতা চোখ খুলে কেমন একধ্যানে তাকিয়ে রইলো। অচেতন মানুষের মতো তার চাহুনি। যেন সে এখনো বেহুঁশই আছে। আদ্রিতা কেমন বেহুঁশের মতো উপরের দিকে তাকালো। মাতালের মতো হেঁসে হাত উঠিয়ে বলল,
“ওই দেখ ওখানে ওরা এসেছে। আমাকে নিতে এসেছে।”
আদ্রিতার কথায় নিবিড়ের বুকের মাঝে তীব্র যন্ত্রণার প্রলয়ঙ্কারী লাভা সবকিছু বিধ্বংস করে দিচ্ছে। ভীতি আর আতঙ্ক গলা চিপে ধরলো যেন। নিবিড় ঢোক গিলে আদ্রিতার হাতটা ধরে নামিয়ে করুন সুরে বলল,
“ওখানে কিছু নেই। এদিকে তাকা। দেখ আমি আছি এখানে তোর কাছে। আমি থাকতে কেউ নিয়ে যেতে পারবেনা তোকে।কেউনা। তাকা আমার চোখের দিকে। ”
আদ্রিতা ফ্যালফ্যাল অবুঝ চোখে তাকিয়ে রইলো নিবিড়ের দিকে।তারপর হাত বাড়িয়ে নিবিড়ের কপাল থেকে ধীরে ধীরে সারামুখে হাত বোলাতে লাগলো। নিবিড় চোখ বুজে অনুভব করলো তা। মুখের উপর আদ্রিতার হাতটা চেপে ধরে চুমু খেল। আদ্রিতা হঠাৎ বলে উঠলো,
“আমি হারিয়ে গেলে খুঁজবেন আমাকে!”
আতঙ্কিত নজরে তাকালো নিবিড়। তারপর ঝট করে আদ্রিতাকে দুই হাতে বুকের মাঝে মিশিয়ে নিলো। সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে ধরা গলায় বলল,
“আমাকে রেখে হারানোর অনুমতি নেই তোর। হারাতে চাইলে আমার মাঝে হারাবি। আমার মাঝেই তোর সকল ঠিকানার শেষ।অন্য কোথাও না। কক্ষণো না।”

একটু পর আদ্রিতার আবারও সেই জ্বালাপোড়া শুরু হলো। আবারও ছটফট করতে লাগলো সে। নিবিড় তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আদ্রিতা নিজের শারিরীক যন্ত্রণা সইতে না পেরে নিবিড়ের হাতে কামড় দিয়ে ধরলো। এই কয়দিনে নিবিড়কে কামড়ে কামড়ে অনেক ক্ষত করে দিয়েছে। তবুও তাতে সামান্যতম খেদ নেই নিবিড়ের। সেতো শুধু আদ্রিতার কষ্টে ব্যাথিত। আদ্রিতা ছটফট করতে করতে কাতর অস্থির সুরে বলল,
“আমাকে ওই ঔষধ দিন৷ ওটা খেলে ভালো লাগে আমার। ”
আদ্রিতার এই কথা শুনে নিবিড় ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ঔষধ! কোন ঔষধ? কিসের কথা বলছিস তুই!”
“ওইযে ওই ড্রয়ারে আছে। ওটা দেন। ওটা খেলে সব যন্ত্রণা চলে যায়।”
আদ্রিতার কথা অনুযায়ী নিবিড় ড্রয়ার খুলে সেখানে সত্যিই ঔষধের পাতা পেল।কিন্তু এটাতেতো লেখা এটা আয়রন ট্যাবলেট। তাহলে এটা খেয়ে এই যন্ত্রণা থেকে কীভাবে আরাম পাবে ও! নিবিড়ের খটকা লাগলো বিষয় টা। অপরাহ্নের কথাটা মনে পড়লো ওর। নিবিড় ওষুধের পাতাটা নিয়ে আদ্রিতার সামানে বসে বলল,
“এটা কীসের ঔষধ? আর কোথাথেকে এনেছিস এটা!”
আদ্রিতা কাতরাতে কাতরাতে বলল,
“আগে দিন আমাকে। এটা খেলে আমার জ্বলন চলে যাবে।”
“না, দিবোনা। আগে বল এটা কিসের ঔষধ আর কে দিয়েছে তোকে!”
আদ্রিতা না পেরে বলল,
“এটা আমাদের কলেজে দিয়েছে। কলেজে ডাক্তারদের একটা গ্রুপ ফ্রী ক্যাম্পেইন করছিলো। সেখানকার এক মহিলা ডক্টর কলেজের মেয়েদের এই ঔষধ দিয়েছে। বলেছে এটা খেলে মেয়েদের ইন্টারনাল ইমিউনিটি অনেক ভালো হবে। তাই আমরা সবাই নিয়েছি এটা। আমার যন্ত্রণা হলে এটা খেলে আর যন্ত্রণা হয়না। এখন দিন, খাবো আমি।”
“কোন ডাক্তার দিয়েছে?”
“জানি না। মুখে মাস্ক পড়া ছিলো তাই চেহারা দেখিনি।”
নিবিড়ের ঔষধটার উপর সন্দেহ বাড়লো যেন। তবে আসলেই এটা কি তা জানতে হলে এটা ল্যাবে পরীক্ষা করাতে হবে। নিবিড় আদ্রিতাকে ঔষধ দিলোনা। অনেক কষ্টে ওকে শান্ত করে ঘুম পারিয়ে দিলো। তারপর ঔষধের পাতাটা নিয়ে অপরাহ্নের কাছে এলো সে।

অপরাহ্নকে সব খুলে বললে অপরাহ্ন ঔষধটা ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠাল। আর পরীক্ষা করে যা পাওয়া গেল তাতে ওরা দুজনই বিস্মিত হয়ে গেল। অপরাহ্ন নিবিড়কে জানাল,
“তুই ঠিকই সন্দেহ করেছিস। এটা উপর থেকে কোনো ভিটামিন দেখা গেলেও ভেতরে যেটা আছে সেটা প্রাণনাশক ড্রা,গ,স। হ্যাঁ, এটা ড্রা,গ,সের ট্যাবলেট। এবং খুবই ভয়াবহ ড্রা,গ,স। এই ড্রা,গ,সে শুধু নেশা হয়না। বরং ধীরে ধীরে শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দূর্বল করে ফেলে। সবচেয়ে বেশি মস্তিষ্কে ইফেক্ট করে।আর একারণেই অরি সব ভুলতে শুরু করেছে। যতক্ষণ এটার প্রভাব শরীরে থাকে ততক্ষণ ব্যাক্তির হুঁশ জ্ঞান থাকে না। আর যখন প্রভাব কমে যায় তখন সারা শরীরে অসম্ভব জ্বলন হয়।এটা হয় এই ড্রা,গ,সের হ্যাংওভারের কারণে। বেশিদিন এই ড্রা,গ,স শরীরে প্রবেশ করতে থাকলে মৃ,ত্যু অনিবার্য।”

অপরাহ্নের সব কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল নিবিড়। সাথে জাগলো প্রচন্ড পরিমাণ ক্রোধ। যে ওর অরির সাথে এমন জঘন্য কাজ করেছে তাকে মৃ,ত্যুর চেয়েও ভয়াবহ শাস্তি দিবে নিবিড়। নিবিড় অপরাহ্নকে বলল,
“আচ্ছা, এখনতো এটা অরিকে খেতে দিবোনা। তাহলে অরি নিশ্চয় এখন ভালো হয়ে যাবে তাইনা!”
“না নিবিড়, শুধু এটা বন্ধ করলেই অরি ভালো হবে না। এতদিন এই ড্রা,গ,স শরীরে প্রবেশ করে তার বি,ষ র,ক্তে মিশে গেছে। এই বি,ষ র,ক্ত থেকে পরিপূর্ণ ভাবে বিনাশ করতে হলে এই ড্রা,গ,স এর এন্টিডোট দিতে হবে অরিকে। নাহলে অরি সুস্থ হবে না।”
“তো দে এন্টিডোট!”
“দেখ, আমি চাইলেই এখুনি দিতে পারবোনা। এটা গবেষণা করে তৈরি করতে হবে। আর তাতে কতদিন লাগবে তা এখুনি বলা যাচ্ছে না।”
“তো কি বলতে চাচ্ছিস! ততদিন অরিকে অসুস্থ ফেলে রাখবো!”
“সেটা বলছিনা আমি৷ আমি সর্বস্ব চেষ্টা করবো যেন জলদি এন্টিডোট তৈরী হয়ে যায়। তবে অরির ইমার্জেন্সি এখনই এন্টিডোট প্রয়োজন। তাই সবচেয়ে ভালো হবে যে এই ড্রা,গ,স দিয়েছে তাকে আগে খুঁজে বের করা। আম শিওর, যার কাছে এই জিনিস আছে তার কাছে এন্টিডোটও অবশ্যই আছে। তাই ত দ্রুত সম্ভব ওই ব্যাক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে।”
নিবিড় চোয়াল শক্ত করে বলল,
“সেতো আমি এমনিতেও করবো।। আমার পুতুলকে হার্ম করার স্পর্ধাকারীকে তার ইনামতো দিতেই হবে।”

অপরাধীকে খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় লাগলোনা নিবিড়ের।আদ্রিতার কলেজে গিয়ে ক্যাম্পেইনে কোন কোন ডাক্তার এসেছিল তার খোঁজ নিলো নিবিড়। সিসিটিভি ফুটেজও চেক করলো সে। এবং সবশেষে যার নাম সামনে এলো তা দেখে বিস্মিত হয়ে গেল নিবিড়। তীব্র ক্রোধ নিয়ে রওয়ানা হলো সেই অপরাধীর ঠিকানায়। ফুল স্পিডে গাড়ী চালিয়ে পৌঁছাল একটা বাসার সামনে। চোখে মুখে ভয়ংকর ক্রোধের দাবানল নির্গত হচ্ছে যেন। তার ক্রোধের লাভায় এমুহূর্তে পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে প্রস্তুত সে। গাড়ি থামিয়ে হাত বাড়িয়ে গাড়ির ড্রয়ার খুলে তার গানটা বের বের করলো। তারপর দরজা খুলে অগ্নিমানব রুপ ধারণ করে দ্রুত পায়ে সামনের বাসায় দরজায় গিয়ে দরজা বরাবর সজোরে একটা লাথি মেরে দিলো। দুই তিনবার লাথি মারার পর দরজার সিটকানি ভেঙে দরজা খুলে গেল। দরজা খুলতেই সম্মুখে সেই কাঙ্ক্ষিত অপরাধকেই সবার প্রথম দেখতে পেল নিবিড়। দেখতে পেয়েই ক্রোধে তার মাথার রগগুলো যেন ফেটে পড়লো। ক্রোধে উন্মাদ নিবিড় তেড়ে গিয়ে সামনের ব্যাক্তির মুখের মাঝে পি,স্ত,লের নল ঢুকিয়ে দিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বলতে লাগলো,
“হাউ ডেয়ার ইউ! হাউ ব্লাডি ডেয়ার টু টাচ মাই লেডি। তোর সাহস কি করে হলো জেরিন! কি করে! এতবড় কলিজা কোথায় পেলি! একবারও ভাবলি না এই নিবিড় তোর কি অবস্থা করতে পারে তোর!”
বলতে বলতে জেরিনের মুখে পি,স্ত,লের নল ঢুকিয়ে এগুতে লাগলো নিবিড় । আর জেরিন পেছাতে লাগলো। পেছাতে পেছাতে একসময় সোফায় পড়ে গেল সে। এই অবস্থা দেখে জেরিনের মা বাবা আতঙ্কিত হয়ে মেয়েকে বাঁচাতে ছুটে এলো। নিবিড়ের উদ্দেশ্যে রাগী সুরে বলল,
“এই ছেলে কে তুমি! ছাড়ো আমার মেয়েকে! নাহলে এখুনি পুলিশ ডাকবো কিন্তু! ”
নিবিড় তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“খবরদার! আর এক পা’ও এগুলে আপনার মেয়ের খুলি উড়িয়ে দিবো আমি। আর পুলিশকে ডাকতে চান ডাকেন৷ পুলিশ এসে সবার আগে আপনার মেয়েকেই ধরবে। কারণ সি ইজ আ ব্লাডি মা,র্ডা,রার।”
জেরিনের মা বাবা ভয়ে আর এগুলোনা৷ নিবিড় আবার জেরিনের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে ক্ষিপ্র স্বরে বলল,
“বল,কেন করেছিস? কেন করেছিস আমার পুতুলের সাথে এমন? কি ক্ষতি করেছে ও তোর? বল!”
নিবিড়ের হুমকিতে জেরিনের মুখে ভয়ের বদলে হাসি দেখা গেল। জেরিন মুখ থেকে পি,স্ত,লের নলটা সরিয়ে বলল,
“আমি জানতাম তুমি আসবে আমার কাছে। আসতে হবেই তোমাকে।কি যেন বলছিলে! কেন করেছি আমি এমন! এইযে তোমার চোখের এই কষ্ট, এই ভয়,এই অস্থিরতা দেখার জন্যইতো এতকিছু করা আমার। এটা আমার মনটা ভীষণ শান্তি পাচ্ছে। পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে আমার। হ্যাঁ অনেক খুশি আজ আমি। আজ তুমিও সেই জায়গায় আছ যেখানে আমি ছিলাম আর আছি। তোমার জন্য পাগল হয়ে নিজের জান পর্যন্তও দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তবুও তোমার মন গলেনি। একবার জানতে পর্যন্ত চাওনি আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি। তোমার জন্য পাগল হয়ে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম আমি। এতটা ডিপ্রেশন যে,আমাকে হসপিটালাইজড করতে হয়েছিল। তখন আমার ভালোর কথা ভেবে মা বাবা আমাকে নিয়ে বিদেশে চলে যায়।সেখানে নিজেকে একটু সামলে পড়াশোনা করে ডক্টর হই আমি। তবে মন থেকে তোমাকে কখনো ভুলতে পারিনি। সেদিন হসপিটালে তোমাকে দেখে আমার চেপে রাখা অনুভূতি গুলো আবার জেগে উঠেছিল। কিন্তু তুমি! তুমিতো আমাকে চিনতে পর্যন্ত পারোনি। সেটাযে আমার জন্য কতটা কষ্ট আর অপমানজনক তা শুধু আমিই জানি। পূরানো ক্ষতের উপর যেন নতুন করে আঘাত লাগছিলো। তবুও বেহায়া মনে তোমার আশা তবুও ছিলো। সেদিন রেস্টুরেন্টে আমার মনের কথা বললাম। কিন্তু তুমি আবারও আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে। আমাকে বুঝিয়ে দিলে তোমার জীবনে আমার কোনো জায়গা নেই। আর তার কারণ ছিলো তোমার ওই অরি। সেদিন হসপিটালে যখন তুমি ওকে বউ সম্বোধন করেছিলে সেদিনই বুঝেছিলাম। কারণ নিবিড় শাহরিয়ার কাউকে বউ বললে নিশ্চয় সে সাধারণ কেউ হবেনা। আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমাকে প্রত্যাখ্যান করার কারণ ওই মেয়েটাই ছিলো। ওই মেয়ের মাঝেই তোমার সকল চাওয়া-পাওয়া। তাইতো তোমার মনকেই আঘাত করেছি আমি।আমার এক পেশেন্টের বডিতে এই ড্রা,গ,স পেয়েছিলাম। সেখান থেকেই এটার ব্যাপারে জানি আমি৷ আর সেটাই তোমার পুতুলকে দিয়েছি আমি। যা ধীরে ধীরে অরিকে মৃ,ত্যুর মুখক ঠেলে দিবে। হারিয়ে ফেলবে তুমি তোমার প্রিয়জনকে।তাইতো এখন আমরা দুজনই এক অবস্থানে আছি। এখন হলো হিসাব সমান সমান।”

কথাগুলো বলা শেষ করেই পাগলের মতো জোরে জোরে হাসতে লাগলো জেরিন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এখন এবনরমাল অবস্থায় আছে। নিবিড় রাগে উন্মাদ হয়ে জেরিনের কপালে গান ঠেকিয়ে বলল,
“অনেক হয়েছে তোর ফালতু নাটক। জলদি ড্রা,গ,সের এন্টিডোট দে আমাকে। নাহলে এখুনি তোর খুলি উড়িয়ে দিবো।”
জেরিন হেঁসে দিয়ে বলল,
“তোমার মনে হয় তুমি তুমি আমাকে মৃ,ত্যুর ভয় দেখাতে পারবে! আরে আমিতো কবেই মরে গেছি। যেদিন তোমার প্রত্যাখ্যান পেয়েছিলাম। এখনতো শুধু নামের বেঁচে আছি। আর তোমার হাতে মরতে পারলে এরচেয়ে ভালো আর কি হবে! তাই গুলি মারতে চাইলে মারো। তবে এন্টিডোট পাবেনা কিছুতেই। তুমিও আমার মতো হারানোর কষ্ট বয়ে বেড়াবে সারাজীবন।”

নিবিড় এই পর্যায়ে ঘাবড়ে গেল। এন্টিডোট না পেলে আদ্রিতাকে কীভাবে বাঁচাবে সে! কি করবে সে! হঠাৎ নিবিড় জেরিনের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে দুই হাত জোর করে করুন মিনতি করে বলল,
“প্লিজ জেরিন, এন্টিডোট দিয়ে দাও আমাকে। আমি পায়ে পড়ছি তোমার। এন্টিডোট দিয়ে দাও। দরকার হলে আমি সারাজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকবো। তুমি যা চাইবে তাই করবো। তবুও শুধু এন্টিডোট দিয়ে দাও প্লিজ।”
জেরিন আবারও হাসলো। তারপর বলল,
“এইযে তুমি এসব বলছোনা, এতে আমার কষ্ট আরও বাড়ছে। আর সাথে বাড়ছে রাগ। দ্য গ্রেট মিঃ নিবিড় শাহরিয়ার, যে কিনা কখনো কারোর সামনে মাথা নত করেনা।সেই তুমি আজ আমার পায়ে পড়ছ, আমার গোলাম হতে চাচ্ছ শুধুমাত্র ওই মেয়েকে বাঁচানোর জন্য। তাহলে তুমি কতটা ভালোবাসো ওই মেয়েকে তার প্রমাণ এটা। আর এটা বুঝতে পেরেই আমার কষ্ট আর রাগ দুটোই বাড়ছে। আমার কাছে আসার লোভ দেখিয়ে এখন আর লাভ নেই। আমি বুঝে গেছি তুমি আমার কেনোদিন হবেনা। আমার কাছে থাকলেও কখনো আমাকে ভালোবাসতে পারবেনা। তাই তোমাকে এখন আর আমার চাইনা। তোমারও আমার মতোই সারাজীবন ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কষ্ট নিয়ে বাঁচতে হবে। এটাই তোমার শাস্তি।”

নিবিড় এবার রাগে সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পি,স্ত,ল জেরিনের মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার চাপ দিতে নিলেই তখনই গোটা কয়েক পুলিশ হুড়মুড় করে ঢুকলো জেরিনের বাসায়৷ সাথে পিছে পিছে ঢুকলো অপরাহ্ন। নিবিড় ওকে বলেছিল সব। সে জানতো নিবিড় রাগের মাথায় উল্টো পাল্টা কিছু করতে পারে তাই আগেই পুলিশ বিয়ে চলে এসেছে। পুলিশ এসে নিবিড় সরিয়ে দিলো। অপরাহ্ন জেরিনের ব্যাপারে পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে। পুলিশ জেরিনকে ধরে নিয়ে গেল। জেরিনের মা বাবা আহাজারি করতে লাগলো। নিবিড় ধপ করে নিচে বসে পড়লো। এন্টিডোট না পেলে কীভাবে বাঁচাবে সে আদ্রিতাকে।
___

রাত তখন ১২ টা প্রায়। আদ্রিতা ঘুমিয়ে পড়েছে।তানি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আজ ড্রা,গ,স না পাওয়ায় সারাদিন মেয়েটা যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। কাঁদতে কাঁদতে মাত্রই একটু ঘুমিয়েছে।নিবিড় এখনো বাসায় ফেরেনি তাই তানি বসে আছে আদ্রিতার কাছে। নিবিড়ের জন্যেও চিন্তা হচ্ছে তানির।ছেলেটা সারাদিন বাসায় ছিলোনা। আবার এতরাত হয়ে গেল এখনো ফেরেনি। ফোনও ধরলোনা। নাজানি কোথায় ঘুরছে পাগলের মতো। অরির চিন্তায় চিন্তায় ছেলেটা আমার কেমন পাগলের মতো হয়ে গেছে। মুখের দিকে তাকানো যায়না। তানির শুধু একটাই চাওয়া, তার দুটো ছেলে মেয়েই যেন ঠিক হয়ে যায়। এসব চিন্তা ভাবনা করতে করতেই আদ্রিতার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে খাটের হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে রইল তানি। ঘুম ঘুম ভাব হয়েছে মাত্রই। তখনই হঠাৎ নিজের পায়ের কাছে কারোর অবস্থান অনুভব করলো তানি। কপাল কুঁচকে চোখ খুলে তাকালো সে। মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো নিবিড় নিচে বসে তানির পা জড়িয়ে ধরে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। ছেলেকে এভাবে দেখে চমকে গেল তানি। এগিয়ে গিয়ে নিবিড়ের মাথায় হাত রেখে হতবাক কন্ঠে সে ডাকালো,
“নিবিড়, পায়ের কাছে বসেছিস কেন? ওঠ।”

নিবিড় মাথা তুলে তাকাতেই আৎকে উঠলো তানি। ছেলের চোখে অঝোরে অশ্রু ঝরতে দেখে বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো তার। তানি বলল,
“কি হয়েছে বাবা,এমন করছিস কেন?”
নিবিড় কান্না জড়ানো গলায় বলল,
“তুমি ঠিকই বলো মা। আমার জন্যই অরির ক্ষতি হয়। আমিই ওর জীবনের কাল। তুমি বলেছিলে না, কোনোদিন আমার জন্যই অরি মরে যাবে। দেখো আজ সেটাই হয়েছে। আজ আমার জন্যই অরি মরতে বসেছে। ওই জেরিন আমার উপর বদলা নেওয়ার জন্য আমার পুতুলকে ড্রা,গ,স দিয়েছে। ওকে মারতে চেয়েছে। আমার জন্যই এসব হয়েছে। আমি না থাকলে অরি আগের মতোই হাসিখুশি থাকতো। আমি ওর জীবনের গ্রহণ হয়ে এসেছি। সব আমার জন্য হয়েছে, সব।”
নিবিড় তানির হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে পাগলের মতো করুন সুরে বলল,
“মা,তুমিতো সব জানো তাইনা! আমি যদি আবারও ওর কাছ দূরে চলে যাই তাহলে অরি ঠিক হয়ে যাবে তাইনা! তুমি শুধু প্রমিজ করো আমি চলে যাওয়ার পর ও ঠিক হয়ে যাবে তাহলে আমি আজই চলে যাবো। আর কখনো ওর সামনে আসবোনা। প্লিজ, প্রমিজ করোনা, মা।”
ছেলের এমন করুন অবস্থা দেখে তানির বুকটা ফেটে যাচ্ছে। সে মা হয়েও আজ পর্যন্ত কোনো কারণে ছেলের চোখে এক ফোটা পানিও দেখেনি। তানির ভাবনা মতে নিবিড়ের চেয়ে কঠিন মানুষ আর দুটো নেই। কঠিন থেকে কঠিন কারনেও নিবিড়কে কাঁদতে দেখেনি সে। এমনকি দেশ ছেড়ে যখন যাচ্ছিল। তখন সবাই কান্না করলো কিন্তু নিবিড়ের চোখে একটুও পানি ছিলোনা। আর আজ সেই ছেলেকে এভাবে অঝোরে কাঁদতে দেখে মায়ের মনও হু হু করে উঠলো। অরির কিছু হয়ে গেলে যে, সে মেয়ের সাথে সাথে ছেলেকেও হারাবে এতে কোনো দ্বিমত নেই। তানি দুই হাতে নিবিড়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“এসব কি করছিস! এতবড় ধামড়া ছেলে হয়ে কাঁদলে লোকে কি বলবে! তারওপর এখনতো বিবাহিত পুরুষও হয়ে গেছিস। এখন পুরুষও হয়ে গেছিস। এখন এভাবে কান্না মানায়!। আর বিয়ে করা বউকে ছেড়ে গেলে অরি তোর বাপকে পুলিশে ধরিয়ে দিবে। বাপকে বুড়াকালে জেল খাটাতে চাস! চিন্তা করিসনা, আমাদের অরি ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে ভেঙে পড়লে অরিকে কীভাবে সামলাবি! এখন কান্না বন্ধ কর। অরি দেখলে হাসবে কিন্তু। আয়, উপরে আয়। আজ আমি ঘুম পাড়িয়ে দেই তোকে।”

নিবিড় বিছানায় উঠে তানির কোলে মাথা রেখে শুলো। তানি নিবিড়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। নিবিড় তার সামনে ঘুমিয়ে থাকা আদ্রিতার একটা হাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুঁজলো। নিবিড় কিছুতেই হারাতে দিবেনা তার পুতুলকে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here