নিবেদিতা ৩

0
284

নিবেদিতা

বাহির দরজার পর্দাটা মেলতেই চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে শশীভূষণ।

সেই মলিন শাড়ি জড়ানো অবয়ব, ঘোমটার ভেতর থেকে চেয়ে থাকা পদ্মপাপড়ির চোখ..

এই তো সে!

মেয়েটি একবার কেবল মুখ তুলে তাকাল। তারপর দৃষ্টি নামিয়ে শশব্যস্ত হয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল দু’পা।

-‘হ্যাঁ রে নিবি, মা তুই অন্তত আমায় বল দিখিনি হয়েছেটা কী?’- কাননবালা মেয়েটির অবনত চিবুক আলতো করে তুলে ধরলেন।

-‘মাসিমা! প্রীতিটাকে তো জানোই কেমন ছন্নমতি! ওর ঐ খেলার পুতুলটা, নিজের মেয়ে বলে যেটিকে উমা বলে ডাকত, পিসিমনি ওটিকে লুকিয়ে রেখে ওকে জবরদস্তি এনে বসিয়ে রেখেছিলেন!’- থেমে থেমে, স্পষ্ট স্বরে কথাগুলি বলল মেয়েটি। কোনো অভিযোগ কিংবা শ্লেষের সুর নেই, যেন কেবল সত্যটুকু জানাতে হয় বলে জানানো।

-‘তবে যে শুনলুম পিতি আজকাল বেশ গিন্নিবান্নি হয়ে উঠেচে?’, কাননবালার কণ্ঠে স্পষ্ট দ্বিধা।

জবাবে মেয়েটি কেবল নিরুত্তর মুখটি তোলে। দীঘল আঁখিপল্লবে ঘেরা বেদনাভরা সুগভীর চোখখানা মেলে তাকায়। বোকা শশীভূষণও সে চোখ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার পড়তে পারে। সেখানে স্পষ্ট লিখা, “নাতনিটিকে সুপাত্রের গলায় গছাবেন বলে পিসিমনি এতকাল মিছেকথা বলে এসেছেন- এ কথা আমি কেমন করে মুখে ফুটে বলি?”

শশীর কাছে বড় ছোট হয়ে আছেন কাননবালা। টেনেটুনে ছেলেটাকে মেয়ে দেখাতে নিয়ে গিয়ে শেষে কিনা এই কাণ্ড! যা হলো, এবারে যদি সত্যি সত্যিই গয়া-কাশী কোথাও উড়াল দিতে চায় এ ছেলে- কে আটকাবে? চিন্তায় চিন্তায় কাজকর্ম এগোয় না, পদে পদে কেবল ভুল হয়।

ভয় আর সংকোচ- দুজনার যুদ্ধে ভয় জিতে যায়। পাছে ছেলেকে আবার হারাতে হয় এই ভয়ে শশীর দু’হাত ধরে অশ্রুসজল চোখে কাননবালা বারংবার অনুরোধ করেন, সে যেন আজকের ঘটনাটা ভুলে যায়। সবকিছু না জেনেশুনে আর বিয়ে-থা’র কথা তুলবেন না কোনো দিন৷ তবু শশী তার বুক জুড়ে থাকুক।

শশী অল্প হাসে। তারপর মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘কনে আমার পছন্দ হয়েছে মা!’

জগতের সবচেয়ে বিচিত্র বস্তুটি বোধকরি মানবের মন। নইলে গতকাল অব্দি যে মনখানা সমস্তকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে কাশীবাসী হবে বলে পণ করে বসে ছিল, আজ কেন সে রায়বাড়ির ঐ জংলা মাঠের ওপর খুঁটি পেতে বসে পড়তে চাইছে?

হায় শশী! আরজন্মে তুই বোধহয় খুঁটিবাঁধা, গৃহপালিত, ল্যাজদোলানো গো-শাবকই ছিলি!

পরদিন সকালে কাননবালা যখন নিজে যেচে বাড়িতে এসে সহাস্যে সইয়ের হাত দুটো ধরে আমুদে গলায় বললেন- ‘তোর ভাইঝিটিকে আমায় দিবি রেণু?’, রেণুমালার মুখে তখন কথা সরেনি আর। স্তম্ভিত রেণুমালা কেবল ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালেন।

তারপর কাননবালা বিদায় হতেই ব্যাঘ্রমূর্তি ধারণপূর্বক ঝাঁপিয়ে পরলেন সেই অসহায়া মেয়েটির ওপর, আদর করে বাপে যার নাম রেখেছিল- নিবেদিতা।

রেণুমালা ধরেই নিয়েছিলেন সইয়ের সাথে এবারে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। কাননের সামনে আর মুখ দেখাবার জো নেই বলে গতকালের পর ও-বাড়ির পথটি আর ভুলেও মাড়াননি। কিন্তু আজ যখন কানন যেচে পড়ে নিবেদিতাকে চাইতে এল, সহসাই দোষ চাপানোর জন্যে আস্ত একটি ঘাড় পাওয়া গেল! যেচে দুর্ঘটনা ঘটাবার পর তার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর স্বভাব বাঙালির মজ্জাগত, দোষ স্বীকার করে নেয়াটাকে এ জাতি বড় নিকৃষ্ট কাজ বলে গণ্য করে কিনা! রাধিকা আর রেণুমালা মিলে যে মিথ্যে নাটকের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন, নিবেদিতা সরল সত্য উন্মোচন করে তার যবনিকাপাত করতে চেয়েছিল। সেটিই তার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়াল।

সদ্য অনাথা এই মেয়েটি পিসিমার আশ্রয়ে যথাযথ আদর-যত্ন না পেলেও, দিব্যি মানিয়ে নিয়েছিল। নিবেদিতার মা গত হয়েছিলেন তার জন্মের সময়েই। নৃপতিবাবু তাঁর এই মেয়েটিকে সম্বল করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিলেন। তাঁর বড় শখ ছিল মেয়েকে লেখাপড়া শেখাবেন, কলকাতায় বড় কলেজে ভর্তি করবেন। মাতৃহীনা মেয়েটি জ্ঞান হবার পর থেকেই বড় শান্ত, সুশীলা। নৃপতিবাবু প্রায়শই ঠাট্টাচ্ছলে বলতেন- ‘গতজন্মে নিবু আমার মা ছিলো, এবারে মেয়ে হয়ে জন্মেছে!’

বাস্তবিকই এই দুটি প্রাণীর ছোট্ট সংসারটার সমস্ত দায়িত্ব নিবেদিতা সেই বাল্যকালেই স্বেচ্ছায় এবং সানন্দে ঘাড়ে তুলে নিয়েছিল। মাস ছয়েক আগে নৃপতিবাবুর আকস্মিক প্রস্থানের মধ্যে দিয়ে সে হাসি-আনন্দ পরিপূর্ণ সংসারখানা বিসর্জন গেল। এদিকে নিবেদিতার লেখাপড়ার স্বপ্নটা অকালে গেল ভেঙে। ওদিকে পড়া-পড়া করে মেয়েকে আইবুড়ো করে রেখছিলেন বাপ- এমন ধেড়ে মেয়ের জন্য কে-ই বা পাত্র খুঁজে বেড়াবে? শেষমেশ এ কূল, ও কূল- দুই কূল হারানো অভাগিনীর ঠাঁই হলো পিসিমার আশ্রয়ে। বিনে পয়সায় একরকম কাজের লোক পেয়ে রেণুমালাও ভেতরে ভেতরে বেশ আনন্দিত ছিলেন, যদিও মুখে সেটা প্রকাশ করেননি। সে যা হোক, দুর্ভাগ্যকে বরণ করে নিয়ে নিজেকে একরকমের মানিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছিল নিবেদিতা। কিন্তু শেষমেশ তাই বা আর পারল কই? শশীভূষণ নামক হতভাগা হবু ডাক্তারটির অকালবুদ্ধিতে সমস্তটাই যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল!

অন্নবস্ত্রের খোঁটা শুনিয়েও যখন নিবেদিতার মুখ থেকে টুঁ শব্দটি বের করা গেল না, রেণুমালা তখন তার মৃত দাদা-বৌদিকে নানাবিধ কুরুচিপুর্ণ সম্বোধন এবং বিস্তর অভিশাপ প্রদানপূর্বক দাবি করে বসলেন যে- এমন কুলাংগার, দুশ্চরিত্রা মেয়েকে জন্ম দেবার দুঃখেই তাঁর ভ্রাতৃবধূ সেদিন পরপারে গমন করেছিলেন। সবশেষে, এত বয়স অবধি মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে নৃপতিবাবু যে মস্ত ভুল করেছেন বারবার অঙ্গুলিনির্দেশপূর্বক তা দেখিয়ে দিয়ে এবং তজ্জন্যে স্বর্গীয় ভাইটির উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকখানা কটুবাক্য নিঃসরণ করে তবে থামলেন।

এতকিছুর পরেও নিবেদিতা কথাটি কইল না। তার ডাগর ডাগর চোখ দুটি বেয়ে কেবল অশ্রুধারা উপচে পড়ল, বাঁধভাঙা নদীর মতন। রেণু কিংবা রাধিকা সজ্ঞানে থাকলে ঐ বাঙময় চোখের আয়নায় নিজেদের কুৎসিত কদর্য রূপ দেখে লজ্জায় সিঁটিয়ে যেতেন। কিন্তু গতকাল থেকে নিজেদের ওপর চেপে বসা অপরাধবোধের বোঝাটুকু এই অবলা মেয়েটির ওপরে চাপানোর বীভৎস নেশায় উন্মত্ত এই দুই নারী যাবতীয় বিবেচনা জ্ঞান হারালেন।

মরা বাপ-মায়ের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত এইসব বিবেচনাহীন গালাগালের তীরগুলি নিবেদিতার অন্তরের কতখানি ছিদ্র করেছে তা টের পাওয়া গেল পরদিন, সারা বাড়ি খুঁজেও মেয়েটিকে না পেয়ে এক টুকরো চিরকুটের সন্ধান পেলেন যখন রেণুমালা। সাদা কাগজের ওপরে গোটা গোটা হাতে লেখা-
‘পিসিমনি, শুনেছি অনাথের শেষ আশ্রয় নাকি কাশী। সেখানেও যদি স্থান না জোটে তো আশীর্বাদ করো, যেন বাপের কাছে যাবার মতো মনের জোর পাই।’

রেণুমালা তার পলায়নপর ভাইঝির উদ্দেশ্যে আশীর্বাদ কি অভিশাপ বর্ষণ করেছিলেন সে আমাদের জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, নিবেদিতার এরূপ আকস্মিক পলায়নে সবচেয়ে ব্যথিত হয়েছিলেন যে মানুষটি তিনি কাননবালা। ঐ মেয়েটির প্রস্থানের সাথে সাথে শেষ আশার প্রদীপখানাও তো নিভে গেল! এবার শশীকে সংসারে আটকানো যে শিবেরও অসাধ্য!

ওদিকে শশীভুষণের মনে এই ঘটনাটা একটা দগদগে ক্ষত হয়ে আজীবনের জন্যে দাগ কেটে গেল। আমাদের এই আধেক-ডাক্তার আধেক-সন্ন্যাসী আর আগাগোড়া প্রেমিক শশীবাবুটি দিব্যি বুঝে গেল— জগতের সমস্তটা পায়ে ঠেলে দিয়ে হিমালয়ের চূড়োয় ধ্যান করতে বসলেও, সেই শরৎ বিকেলের সোনাঝুরি রোদে যে নিটোল সারল্যভরা মুখখানি তার মানসহৃদয়ে আঁকা হয়ে গেছে- তাকে মোছা যাবে না। অতএব, সন্ন্যাসব্রত উচ্ছন্নে গেল। মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে শশী বলল- ‘তোমার ঠাকুর চান তো তোমার ছেলের বিয়ে হবে মা! এবারে আশীর্বাদ দাও, পরেরবার যেন ডাক্তার হয়ে তবে গ্রামে ফিরতে পারি।’

অর্থাৎ, পুনরায় সিদ্ধান্ত বদল!

এ কেমন নড়বড়ে ছেলে রে বাবা! এ কথা নিশ্চিত করে বলে দেয়া যায়, দু’দিন বাদে আবার কোনো অনুপমা, নিরূপমার জালে আটকে এ ছেলে আরেক অঘটন ঘটাবে। এমন জলবৎ তরলং হৃদয়খানা নিবেদিতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়ে ধৈর্য ধরে বসে থাকবে বুঝি?


পরের পর্ব আগামীকাল।
এই গল্প অনলাইন থেকে ডিলিট করব না। ধীরে সুস্থে পড়তে পারেন, সমস্যা নাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here