#নিয়তি
#নুসাইফা_আশরাফী_আনিফা
#শেষ পর্ব
ওর ন্যাকামো দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল মেহের। সালমা বেগম মুচকি হেসে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মেহেরের দিকে। আর মনে মনে ভাবেন এভাবেই সারাজীবন আমি তোদের হাসিমাখা মুখখানা দেখে যেতে চাই!
.
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল সাতটি মাস। আজ মেহরাব বেশ ক্লান্ত। স্কুলের পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে শেয়ারে নতুন একটা বিজনেস শুরু করেছে সে। অল্প সময়ে বেশ সাফল্য পেতে শুরু করেছে ব্যাবসাটা। তাই একটু বেশিই খাটতে হচ্ছে তাদের। বিজনেসটা অনলাইনে হওয়ায় মাঝে মাঝে শখের বসে মেহেরও ওকে হেল্প করে। মেহেরের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখে মেহেরাবও আর মানা করে না। কিন্তু কয়েকদিন থেকে মেহেরের শরীরটাও যেন ভালো নেই। প্রায়ই ওকে ঘুমহীন কাটাতে হয় প্রতি প্রহর। মেহরাব সেটা লক্ষ্য করে কিন্তু কিছু বলে না। আজ সে নামাজ পড়ে এসেই রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। মেহের মায়ের কাছে বসে গল্প করছিল।
রাত প্রায় বারোটা। ওয়াশরুম থেকে ভেসে আসা পানির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে মেহরাবের। হ্যাঁ যা ভেবেছিল তাই, সেখান থেকে বেরিয়ে আসে মেহের। ড্রিম লাইটের ঝাপসা আলোয় সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে।ওর মায়াবী মুখের আড়ালে কতটা ব্যাথা যে সে অনায়াসে লুকিয়ে রেখেছে তা হয়তো কেউ বুঝতে পারবে না। এমনকি মেহরাবও না। হঠাৎ মেহেরের চিৎকারে ধ্যান ভাঙ্গে তার।
-ওহ মা… আল্লাহ.. বলেই মেহের মুখ চেপে কোনমতে সোফায় বসে ছটফট করতে থাকে।
একটু পর উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়ে।
মেহরাব তাড়াতাড়ি উঠে মেহেরের কাছে যায়,
-মেহের কি হয়েছে তোমার, কষ্ট হচ্ছে খুব না, বলেই মেহেরের মুখটা নিজের বুকের সাথে আগলে ধরে মেহরাব। ভয় পেয়ো না একটু সহ্য করো দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ…বলতে বলতে নিজের অজান্তেই চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার।
মেহরাবের এমন পাগলামিতে মেহের বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।
-কই কষ্ট হচ্ছে না-তো…বলে মেহের নিজের পেটে হাত রেখে বলে ‘আমাদের বাবুটা ব্যাথা পেয়েছে, এটাই আমায় জানিয়েছে, তাই ওর কষ্টে আমারও কষ্ট হচ্ছে। বলে মেহের মুচকি হাসে।
-আমায় ধাক দিয়ে জাগিয়ে তুললেই-তো পারতে। তোমার কষ্টে বুঝি আমার কষ্ট হয় না… তুমি এখানে ব্যাথায় ছটফট করবে আর আমি ঐখানে পড়ে পড়ে ঘুমাব এটা ভাবো কি করে!
এরপর অনেকক্ষন চুপ থেকে বলে সত্যিই মায়েরা সব ব্যাথা হাসিমুখে মেনে নিতে পারেন। তাইতো মহান আল্লাহ মায়ের পায়ের নিচে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ জান্নাত রেখে দিয়েছেন। আর আমাদের দিয়েছেন কেবল সান্তনা পুরুষ্কার। সত্যিই… যদি তোমরা এই ত্যাগ শিকার না করতে তবে হয়তো আমরা কোনদিনই বাবা হওয়ার আনন্দটা পেতাম না…..বলতে বলতে মেহরাব সামনে এগিয়ে যায়, এরপর ফিরে এসে বলে,
-নাও…
মেহের অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,
-আপনি কি করে জানলেন?
-জানি তো, আরও অনেক কিছু জানি, নাও…
মেহের কোরআন শরীফটা হাতে নিয়ে বুকের সাথে আগলে রাখে অনেক্ষণ, এরপর কোরআন শরীফ খুলে পড়তে শুরু করে। মেহেরাব মুগ্ধ হয়ে শুনে তার তিলাওয়াত।
পড়া শেষে মেহের কোরআন শরীফটা জায়গামতো রেখে আসার জন্য উঠতে গেলে মেহরাব ওকে থামিয়ে বলে, তুমি বসো দাও আমি রেখে আসি!
………. …….. ………
-হুম এবার বলো, ব্যাথা কিছুটা কমছে?
-হুম.. আলহামদুলিল্লাহ..
-তবে চলো…
-কোথায়..?
-ঘুমাবে না!
-হুম,, তার আগে বলুন আপনি আর কি কি জানেন?
-নামায পড়বে..
-হুম..
-তবে চলো আগে নামাজ আদায় করে নেই,পরে তুমার প্রশ্নের উত্তর দেই।
নামাজ শেষে মেহের বলে ,
-এবার বলেন আপনি আর কি কি জানেন?
-ওম….. হ্যাঁ…তোমার নতুন রুটিন মানে, আজ কয়েকদিন থেকে দেখছি তুমি প্রতি রাতে না ঘুমিয়ে কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করো, এরপর আমার বুকে মানে এখানে মাথা রেখে শুয়ে থাকো, আর আমি তাহাজ্জুদের নামায আদায় করার জন্য উঠতে গেলে আমার সাথে তুমিও উঠে পড়ো, মোট কথা তুমি রাতে ঘুমাও না, মানে ঘুমাতে পারো না আমাদের দুষ্টু বাবুটার জন্য … মেহের ওর কথা কেটে নিয়ে বলে,
-ওমা এটা তো আমি আপনায় বলিনি। আপনি কি করে জানলেন..?
-হুম আর এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা, কেনো তুমি আমায় সেটা বলোনি? নিজে একা একা কষ্ট করছ?
-এটা কোন কষ্ট হলো আপনাকে প্রতিদিন কতো কষ্ট করতে হয়। আর রাতের এই সামান্য সময় যদি আমার জন্য আপনি ভালোভাবে ঘুমাতে না পরেন তবে জান্নাতে আপনার জন্য নির্ধারিত ঐ স্ত্রী(হূর)আমায় অভিশাপ দেবে যে..। যেটা আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারব না.. গাল ফুলিয়ে বলে মেহের।
মেহরাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখছে সেটা লক্ষ্য করে রসিকতা করে মেহের আবার বলে,
-তাছাড়া আমি জানি আমি না বললেও আমার হাত ঠিকই আমার চোখের জল মুছে দেবে।
-বাহ এতো কনফিডেন্স..মাথা চুলকে বলে মেহরাব
-কেনো সন্দেহ আছে?
মেহরাব মুচকি হেসে মেহের কে বুকে জড়িয়ে বলে
-নাহ.. তবে এটা কেমন কথা, জান্নাতের ঐ স্ত্রী (হুর) মানে টা কি?
মেহের বলে,
– কোনো স্ত্রী যখন তার স্বামীকে কষ্ট দেয়, তখন ঐ পুরুষের জন্য জান্নাতে নির্ধারিত স্ত্রী (হূর) বলতে থাকে, হে অভাগিনী আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুক, তোমার স্বামী কে কষ্ট দিও না, সে তো তোমার কাছে কিছু দিনের জন্য মেহমান মাত্র, অচীরেই সে জান্নাতে আমার কাছে চলে আসবে।
(তিরমিজিঃ১১৭৪)
মেহের কেঁদে কেঁদে বলে,আমি জান্নাতেও আপনাকে চাই, এর জন্যে পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট আমি মাথা পেতে নেব, তবুও আপনাকে আমি হারাতে পারব না।
-ধুর পাগলি, আমিও কি জান্নাতে তুমি ছাড়া সুখে থাকতে পারব বলো! আল্লাহ যদি তাঁর এই অধম বান্দাকে জান্নাতে দেন, তবে সেই জান্নাতে মহান প্রভুর কাছে আমার প্রথম চাওয়টাই হবে তুমি। মেহের উল্লাসিত কন্ঠে বলে,
-সত্যি..
মেহরাব ওর নাক টেনে বলে,
-একদম সত্যি..
…….
-মেহের..
-হুম..
-মা হতে অনেক কষ্ট অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়,আমি জানি অনেক কষ্ট আছে যা মাকেই করতে হয়, আমি চাইলেও সেই কষ্টের ভাগ নিতে পারব না, কিন্তু সেই কষ্টের সময় আমি তোমার পাশে তো থাকতে পারি, এই সুযোগটা অন্তত আমায় দিও..
-কে বলল আপনি আমার পাশে নেই, আপনি পাশে আছেন বলেই তো আমি সঠিক পথের নিশানাটা পেয়েছি। আপনি পাশে থাকার কারণেই আমি সেই জাহেলিয়াতি চিন্তাচেতনা থেকে উঠে আসতে পেরেছি।আপনিইতো আমার বেঁচে থাকার শক্তি। এই যে আমি ঘুমাতে পারিনা দেখে আপনিও ঘুমান না,অথচ আমায় বুঝতে দেননি কখনো, আমার কষ্টে আপনার চোখে পানি আসে, আমার সকল চাওয়া পাওয়া আমি চাওয়ার আগেই আপনি পূরণ করতে চেষ্টা করেন… এগুলো কি পাশে থাকা নয়!
-নাহ নয় আমি তোমার সমস্ত সুখে দুঃখে ছায়া হয়ে পাশে থাকতে চাই..জানো আজ স্কুল থেকে পাক্কা পাঁচ মাসের ছুটি নিলাম।
-ওমা…. পাঁচ মাস.. বলেন কি! কি করবেন এতো ছুটি দিয়ে?
-আপাদত তোময় দেখে রাখব,এরপর বাবু আসবে,ওদের প্রতিদিন গোসল করাব, খাইয়ে দে… ওহ থুক্কু এটা তুমি করবে, ঘুম পাড়িয়ে দেব, প্রস্রাব করলে ডায়পার চেঞ্জ করে দে..
-স্টপ স্টপ..সবই যদি আপনি করেন তবে আমি করব টা কি হ্যাঁ?
মেহরাব মুচকি হেসে বলে,
-তুমি শুধু বসে বসে খাবে..আরে না না খাইয়ে তো আমি দেব তুমি শুধু কষ্ট করে একটু চিবিয়ে গিলে ফেলবে ব্যাস..আর বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করবে।
মেহের বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওর দিকে! এই পাগল মানুষটাকে কি বলবে ভেবে পায় না।
জীবনে সুখ আর দুঃখ একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জীবনে যেমন হাসি আনন্দের জোয়ার আছে তেমনি ওপিঠে লুকিয়ে আছে বেদনার অশ্রু। এটাই যে নিয়তি।
কেননা এভাবেই জীবনচক্র সাজানো হয়েছে ।আল্লাহ বলেন ” আমি তো মানুষ সৃষ্টি করেছি কষ্ট -ক্লেশের মধ্যে। ( সূরা বালাদ:আয়াত : ৪ )
মেহরাব যোহরের নামাজ থেকে ফেরার পথে মায়ের ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে রিসিভ করে,
-আসসালামু আলাইকুম মা..
-ওয়ালাইকুমুস সালাম, বাপ জলদি একখান গাড়ি লইয়া আয়, আমার মাইয়াটা কেমনে যেন করতাছে হসপিটালে লইয়া যাওন লাগব।
মেহের কে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো মেহরাব আর সালমা বেগম। ফোন করে মেহেরের বাবাকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। উনিও আসছেন।
মেহের সেই কখন থেকে আবোল তাবোল বকেই যাচ্ছে। মেহরাব আর সালমা বেগম ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন আর একে অন্যের থেকে নিজের চোখের পানি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছেন। মেহের যে সালমা বেগমের কলিজার টুকরা, বুকের ধন।ওর কষ্টে যেন ওনার ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছেন অবিরাম। মেহরাবের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। হঠাৎ মেহরাব হাত দিয়ে আগলে ধরার চেষ্টা করে মেহের আর মাকে।
অমনি সামনে থেকে একটা মালবাহী ট্রাকের ধাক্কায় চারপাশ থমথমে হয়ে যায়, চারিদিকে নিরব-নিস্তব্ধতা। অন্ধকারে ছেয়ে যায় চারপাশ।
প্রায় দুই দিন পর জ্ঞান ফিরল মেহেজাবিনের।
চোখ তুলে তাকাতেই দেখে ডাক্তার তিশা দাঁড়িয়ে আছে।এই তিশা মেহরাবের দুঃসম্পর্কের এক কাজিন।প্রথম থেকেই মেহেরের সমস্ত ট্রিটমেন্ট তিশাই করেছে। মেহের তিশার হাত ধরে বলে,
-আপু.. উনি কোথায়, মা কোথায় আমার কি হয়েছে ,আমার মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?
মেহেরের কথার আওয়াজে মেহেরের বাবা বাইরে থেকে ছুটে এলেন, এগিয়ে এলেন মেহেরের বড় বোন মেহেরুন্নেসাও!
তিশা আস্তে করে ওর পাশে বসে ওর মাথায় হাত রেখে বলল,
-শান্ত হও বোন, দেখো আল্লাহ তোমায় কি সুন্দর দুটো ফুটফুটে বাচ্চা দান করেছেন..
মেহেরুন্নেসা এগিয়ে এসে একটি বাচ্চাকে ওর কোলে তুলে দিয়ে বলে,
-জাবিন দেখ বোন কি কিউট দুইটা বেবি..
মেহের তাকিয়ে দেখে ওর বাবার চোখে পানি টলমল করছে, মেহের ডাকে,
-বাবা….
উনি কোলের বাচ্চাকে বাড়িয়ে ধরে বলেন,
-দেখ মা, আমার নাতনি আমার লগে কি করে খেলতাছে দেখ…
মেহেরের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে,কান্না করতে করতে মেহের বলে,
-বাবা ..আপু…তিশা’পু, তোমরা কেউ বলছ না কেনো উনি কোথায় আমার মা কই…..
বলতে বলতে জ্ঞান হারায় মেহের।
মেহের আজও বেঁচে আছে মেহরাবের শেষ স্মৃতিটুকু নিয়ে। বেঁচে আছেন সালমা বেগমও। তবে এক্সিডেন্টে হারিয়েছেন দুটি পা। মেহরাব একদিন বলেছিল, ‘মেহের তুমি দেখে নিও আমাদের টুইন বেবী হবে! মেহের সেদিন অবাক হয়ে বলেছিল,
-মানে..?
মানে আমার খুব ইচ্ছে আমাদের টুইন বেবী হবে আর ওদের একজন হবে ছেলে আর অন্যজন মেয়ে। আমার বিশ্বাস আল্লাহ আমার এই চাওয়াটা পূর্ণ করবেন। মহান প্রভু সেদিনের তার ওই চাওয়াটা পূর্ণ করেছেন, কিন্তু সেই মানুষটি তা দেখে যেতে পারল না। এটাই বোধহয় নিয়তি! মেহরাবের পছন্দেই ছেলেমেয়েদের নাম রেখেছে মেহের।ছেলের নাম তালহা আর মেয়ের নাম সুমাইয়া। ওদের নিয়েই হয়তো কেটে যাবে মেহেরের বাকী জীবন।
প্রতি নামাজের শেষ মুনাজাতে মহান প্রভুর কাছে মেহের একটি দোয়া’ই করে।
আর সেটা হলো,ওপারে যেন মহান প্রভু তাদের আবার এক করে দেন, অনন্তকালের সেই শেষ ঠিকানায় যেন তারা আবার একসাথে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে।
★★★★★★★★★সমাপ্ত★★★★★★★★★