#নীলাম্বুর_গহীনে
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৬
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
.
.
ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের প্রধান চেয়ারে বসে আছে আশরাফ। তাঁর পাশের চেয়ারে রুবাইয়া বসে আর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ইউশরা। রুবাইয়া আড়চোখে তাকাচ্ছে বাবা আশরাফের দিকে।
এদিকে আশরাফ চোখমুখ খিচে একবার প্লেটের দিকে তো আরেকবার ইউশরার দিকে চোখ বুলাচ্ছে। মুখে ভাত দেয়ার বদলে কেবল দু আঙুল দিয়ে নেড়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ আঙুল দুটো ভাতের আঠালো ভাবে একটি আরেকটির সাথে লেগে যাচ্ছে।
” কী রান্না করেছ এটা?না মাখতেই হাতে একেবারে চটকে গিয়েছে। মাখলে তো….”
ইউশরা অপরাধজনিত গলায় বলল,
” আসলে….. রুবাইয়ার সাথে চা খাওয়ার ফাঁকে কথা বলছিলাম তো, তাই আর কি ভাতের কথা ভুলে গিয়েছি। কিন্তু তুমি চাইলে আমি এক্ষুনি আবার ভাত রান্না করে দিতে পারি।”
ইউশরার অপরাধ বোধ ব্যবহার লক্ষ্য করে আশরাফ আর কিছু বলার সাহস পেল না। এমনি ইউশরা মন খারাপ করে আছে। তারউপর আশরাফও যদি কিছু বলে মন আরও খারাপ হয়ে যাবে। ভুল তো মানুষেরই হয়। আজ না’হয় ইউশরার’ও হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে আশরাফ বলল,
” না না, কোনো প্রয়োজন নেই। এমনি অফিসের টাইম হয়ে গিয়েছে। এখন ভাতের জন্য অপেক্ষা করলে আজ আর অফিস যাওয়া লাগবে না। তার থেকে ভালো আজ এটা দিয়েই ম্যানেজ করে নেব। ”
” কিন্তু তুমি তো নরম ভাত খেতে পারো না। আর এটা তো নরমের উপর হয়েছে। পুরো জাউ। তুমি এক লোকমাও খেতে পারবে না। ”
” বললাম তো সমস্যা নেই। তুমি ওতো ভেবো না। মাঝেমধ্যে এরকম হয়-ই। এগুলো কোনো ব্যাপার না। ”
বলেই এক লোকমা মুখে তুলল আশরাফ। সামান্য পরিমাণ না, বেশি পরিমাণেই লবণ লাগবে আজ। জাউ ভাতে তরকারি আর লবণ যতই দিবে ততই কমই পড়বে।
” লবণের বাটি টা দাও তো।”
” লবণ খাবে? তুমি তো লবণ খাও না। ”
” আরে ভাত টা নরম তো তাই টেস্ট পাচ্ছি না।”
” তরকারি নাও। ঝোল দিয়ে মাখো ভাত টা। ব্যালেন্স হয়ে যাবে। ”
” তরকারি কী এখানে কম আছে? কম দিয়েছ তুমি? আর কীভাবে নিব? প্লেটে জায়গা থাকতে হবে তো। লবণ টা দাও।”
ইউশরা দ্রুত লবণের বাটি আশরাফের সামনে ধরল। আশরাফ বেশ বড় করে চিমটি দিয়ে লবণ তুলে নিল। ভাতের সাথে মেখে মুখ দিতেই বলল,
” হ্যাঁ, এবার ঠিকাছে। ”
রুবাইয়াও আশরাফের দেখাদেখি লবণ মেখে নিল। ভাতের লোকমা মুখে তুলে বলল,
” হ্যাঁ, সত্যিই তো…. ”
আশরাফ ভ্রু কুচকে বলল,
” কী সত্যি? ”
” ঠিকাছে বললে যে ওটা। ”
” ও….. তো রুবাইয়া কী অবস্থা তোমার? অফিস থাকার সুবাদে তো তোমার সাথে তেমন কথাই হয় না। কেমন চলছে তোমার দিনকাল?”
” হ্যাঁ বাবা ভালোই। ”
” এইচএসসি পরীক্ষার ডেট কী ফিক্সড হয়েছে?শুনেছ কিছু?”
” স্যার সেদিন বলল এপ্রিল মাসের কথা। তো ফিক্সড ডেট বলেনি। ”
” ও….শুধু সপ্তাহ এদিক ওদিক হয় এই আর কি। ”
” হ্যাঁ বাবা, স্যারও এটাই বলেছেন। ”
” হুম। ইয়াসিন কি ঘুম থেকে উঠেছে? ”
” না বাবা, উঠেনি। কেন? ডেকে দেব?”
” না না, লাগবে না। ঘুমোক ছেলেটা।সারাদিন তো দৌড়দৌড়ি করে হেনস্তা হয়ে যায়। সকাল টা একটু বেশিই ঘুমোলে ওর জন্য ভালো। ”
“হুম।”
আশরাফের খাওয়া প্রায় শেষ। প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পড়তে নিলে রুবাইয়া হাসফাস করে বলল,
” বাবা!”
” হ্যাঁ মা,বলো। ”
” তুমি কিছু ভুলে যাচ্ছো।”
আশরাফ শক্ত করে চেয়ারে বসে বলল,
” ভুলে যাচ্ছি? কিন্তু কী?”
” গতকাল আমার জন্মদিন গিয়েছে। আর আজ তার পরের দিন। কিছু কি মনে পড়ছে না তোমার?”
” উম……. না তো। কিছুই মনে পড়ছে না। একটু খুলে বলো তো কিসের কথা বলছ।”
” তুমি দু মাস আগে আমাকে প্রমিজ করেছিলে জন্মদিনের পরের দিন আমাকে ল্যাপটপ কিনে দিবে। ”
” ও হো….আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ”
” তাতে কী হয়েছে? আমি তো এখন তোমাকে মনে করিয়ে দিয়েছি। আজ কিনে এনো। তাহলেই তো হলো।”
” সে তো কেনাই যায়। কিন্তু…….”
কিন্তু শব্দটা শুনে রুবাইয়া মুখটা ভার করে ফেলল। বলল,
” কিন্তু কী বাবা? ”
” কিন্তু……ল্যাপটপ যে আমি আগেই কিনে রেখেছি মা। ”
রুবাইয়া খাওয়ার প্ল্যাট থেকে একলাফ দিয়ে উঠে আশরাফের কাছে চলে এলো।
” সত্যিই বাবা! তুমি ল্যাপটপ কিনে ফেলেছ?”
” তো কিনব না? আমার একমাত্র মেয়ে কিছু চেয়েছে আর আমি দিব না, তা কী হয়? তোমার মায়ের কাছে আরও সপ্তাহ খানেক আগেই ল্যাপটপ এনে দিয়ে রেখেছি। আজ রাতে দেবার জন্যে।”
রুবাইয়া আশরাফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” লাভ ইউ বাবা। তুমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে বেস্ট বাবা। ”
আশরাফও রুবাইয়াকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে বলল,
” লাভ ইউ টু বাবা।”
বাবা মেয়ের আহ্লাদ দেখে ইউশরা কেবল মুচকি হাসল।
.
আসরের নামাজ পড়ে তজবি পড়ছিল ইউশরা। রুবাইয়া বিফ পাস্তা রান্না করে ৩ বাটিতে বেড়ে নিয়ে এলো। ইয়াসিনের সামনে বাটি, কাটা চামচ দিয়ে বলল,
” এটা তুমি ধরবে না। আমি খাইয়ে দিব কেমন।”
” না না, আমি নিজে হাতে খাবো। তোমার হাতে খাবো না। কিছুতেই খাবো না। তুমি…তুমি ধাক্কা দিয়ে দিয়ে মুখে দাও। আমার মুখ ফুলে যায়। খেতে কষ্ট হয়। আমি তোমার হাতে খাবোই না।”
” তুমি কিন্তু বেশি কথা বলো। কবে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে খাওয়াই। মিথ্যে কথা বলো কেন?”
” তুমি মিথ্যে কথা বলো। তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়েই খাওয়াও। এটাই কি আমার দোষ? ”
বলেই কাঁদতে লাগল ইয়াসিন। ইউশরা হাতের তজবি শেষ করে গায়ের থেকে ওড়না খুলে বিছানার উপর রাখল। ইয়াসিন কে কোলে বসিয়ে বলল,
” কাঁদে না বাবা। আপু তো তোমাকে ধাক্কা দিয়ে খাওয়ায় না ম। মুখে তুলে দেয়। ”
” না আপু ধাক্কা দেয়। আমার দোষ কী বলো। এটাই কী আমার দোষ? ”
কিছু না বলতে পারলেই ‘ এটাই কী আমার দোষ বলা ইয়াসিনের অভ্যাস। যা ইউশরার শুনতে খুবই ভালো লাগে।
রুবাইয়া দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
” এই…. তোকে কবে ধাক্কা মেরে মেরে খাওয়াইছি হ্যাঁ? এই বয়সে এত মিথ্যে কথা কীভাবে বলিস?”
ইউশরা বলল,
” রুবাইয়া, তোর বয়স আর ইয়াসিনের বয়স কিন্তু এক না। তুই ওর সাথে কী মুখ নাড়াচ্ছিস? ওর বয়স কত ভেবে দেখেছিস? ও কি এখনো কোনো কথা পারফেক্টলি বলতে পারে যে, তুই ওর কথা ধরছিস। ”
” পারফেক্টলি বলতে না পারলে এটা কীভাবে বলছে আমি ওকে ধাক্কা দেই? ওকে তো আজ অবধি মারলামই না, ধাক্কা তো দূরের কথা।”
” আরে বোকা মেয়ে ও কী সেই ধাক্কার কথা বলেছে? তুই যে ওকে জোর করে মুখে খাবার ঠেসে ঠেসে দিস তার কথা বলেছে। এতটুকুও বুঝিস না?”
” ও…….আর আমি ভেবেছি…. ”
” হুম, তুই তো ইয়াসিনের থেকেও ছোট তাই উল্টো টা বুজেছিস।”
ইয়াসিন কান্নার মাঝেই ফিক করে হেসে দিল। বলল,
” আপু আমার থেকে ছোট। কী মজা! কী মজা! আপু আপু,আমাকে ভাইয়া বলো। আমিও তোমাকে ধাক্কা দিয়ে খাওয়াবো। খুব মজা হবে ”
” মা!”
” কী হয়েছে? ”
” তোমার ছেলের মুখটা বন্ধ করো। আমার কিন্তু রাগ লাগছে এখন।আর পাস্তা টা যে এত কষ্ট করে রান্না করেছি খেয়ে দেখবে কী? কেমন হয়েছে….ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।”
” হ্যাঁ হ্যাঁ , খাচ্ছি। তুইও খাওয়া শুরু কর। আর ইয়াসিন তুমি একটু অপেক্ষা করো। আম্মু খেয়ে নেই, তারপর তোমাকে খাইয়ে দিব। ”
ইউশরা এক চামচ পাস্তা মুখে দিয়ে বলল,
” উম্ম……অনেক মজা হয়েছে তো। আমার থেকেও বেশি মজা হয়েছে। ”
রুবাইয়া চকচকা মুখে বলল,
” সত্যিই মা!”
” হুম সত্যি। খুব মজা হয়েছে। পুরো পাকা রাঁধুনির মত।”
” ইয়ে…..আমি পাস্তা রান্না শিখে ফেলেছি।”
এক হাত উপরে উঠিয়ে উল্লাসের সহিত বলল রুবাইয়া। এরই মাঝে ইউশরার মোবাইলে মেসেজ এলো। মেসেজ ওপেন করতেই দেখে আশরাফ দিয়েছে….
” আজ ইমার্জেন্সিতে বসের সাথে নাটোর যেতে হচ্ছে। রাতটা থাকতে হবে। আগামীকাল বিকেলেই নাটোর থেকে ব্যাক করব। তুমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে সাবধানে থেকো। আর হ্যাঁ, প্রেসারের ঔষধ টা টাইমলি খেয়ে নিও। লাভ ইউ…. ”
ইউশরা মুচকি হেসে মোবাইল রাখতেই রুবাইয়া বলল,
” কার মেসেজ? ”
” তোর বাবার। আজ আসবে না। বসের সাথে নাটোর যাচ্ছে। আগামীকাল আসবে ইনশাআল্লাহ। ”
” ও…..তাহলে আজ তুমি আমাদের সাথেই ঘুমোবে, তাই না মা? ”
” হ্যাঁ, সে তো প্রতিবারই ঘুমাই। এ আর নতুন কী? ”
” হ্যাঁ, সেই তো বললাম। ভালোই হলো, আজ তোমার সাথে ঘুমোবো। সারারাত গল্প করব। আমার সব ছটফটানি দূর হয়ে যাবে। সেই মজা হবে।”
” হ্যাঁ, তুমি তো আছো তোমার ধান্দায়। তোমার আর কিসের চিন্তা!”
ইউশরার কথা শুনে রুবাইয়া দাঁত কেলিয়ে দিল। আর অপেক্ষা করতে লাগল রাত হবার।
.
রাত ১০ টা। ইয়াসিনকে বুকে নিয়ে কিছুক্ষণ হলো শুয়েছে ইউশরা। রুবাইয়া সামনেই বসে আছে। ইয়াসিন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। রুবাইয়া লঘু গলায় বলল,
” মা, ইয়াসিন তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আর কত শুয়ে থাকবে? এবার অন্তত বেলকনিতে চলো।”
ইউশরা ইশারায় চুপ থাকতে বলল রুবাইয়াকে। ধীর গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে ইয়াসিনের বুকে বালিশ দিয়ে এগুলো বেলকনির দিকে। পেছন পেছন রুবাইয়া গিয়ে বলল,
” উফফ! ইয়াসিন যে কি-না….এতক্ষণ কাগে ঘুমোতে? ”
” তুই কিন্তু এর থেকেও বড় সেয়ানা ছিলি। ওর তো ঘুমোতে কেবল মিনিট বিশেক লাগে। আর তোর বেলা ঘন্টা পার হয়ে যেত। আমি ঘুমিয়ে যেতাম, তোর বাবা ঘুমিয়ে যেত কিন্তু তুই একশ পাওয়ারের ব্যাটারীর মত চোখ করে তাকিয়ে থাকতি। ”
” হা হা….. তাই? ”
” আজ্ঞে জি।”
” আচ্ছা এখন আজেবাজে কথা বাদ দাও। আর কাহিনী বলা শুরু করো। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। ”
” মাত্রই তো এলাম। দমটা অন্তত নিতে দেয়।”
” না না, দেরি করো না মা প্লিজ বলো।আমি আজই পুরো ঘটনা শুনব। পরের জন্য আর বাজিয়ে রাখব না।”
” কী বলছিস এগুলো? তোকে কী পুরো রাত জুড়ে কাহিনী বলব না-কি? ঘুমাতে হবে না? মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোর?”
” এমন করছ কেন মা? কত বছর ধরে এ কাহিনী শোনার জন্য অপেক্ষা করিছি।এখন যখন বলছ তাও ধীরে ধীরে। এটা কোনো কথা?”
” তাই বলে রাত জেগে?না না, আমি পারব না। রাত জেগে কাহিনী বলা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
রুবাইয়া বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে ইউশরা এভাবে রাত জেগে কাহিনী বলতে কিছুতেই রাজি হবে না। তবে রুবাইয়া এ-ও জানে, ইউশরা একবার বলা শুরু করলে প্রয়োজন ছাড়া থামবেও না। স্মৃতির পাতায় একেবারে মিশে যাবে। তাই অগত্যা কথা বাড়ানো হবে রুবাইয়ার নিতান্তই বোকামি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই রুবাইয়া বলল,
” বেশ মা, তোমার যতক্ষণ মন চাবে ততক্ষণই বলো। আমি আর তোমাকে জোর করব না। ”
ইউশরা দম নিয়ে বলল,
” যাক ভালোয় ভালোয় বুঝতে পেরেছিস। তা নাহলে আজ আমি বলতামই না।”
” হা হা…..তোমার মেয়ে না, না বুঝে উপায় আছে? ”
” হুম, তাও কথা। ”
” হুম, এবার তো শুরু করো। আর কত বসিয়ে রাখবে?”
” হুম হুম,বলছি। ”
কিছুটা সময় নিয়ে ইউশরা বলল,
____________________
” সেদিন ছিল শুক্রবার। ভার্সিটি বন্ধ। সারাদিন বাসায় বসে। ঘরের একাজ ও-কাজ করেই দিন পার করছিলাম। হঠাৎই মা ঘরে এসে বললেন,
.
.
চলবে…….