#নীল_বুনোলতা ( ১০)
#লেখনীতে #রেহানা_পুতুল
খুউন!কে করেছে? ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো লতা।
জানিনাতো।
লতা ভীড় ঠেলে ঘরের সামনে গেল।
স্থির চোখে দেখল,
আলতাফ শিকদার কাত হয়ে পড়ে আছে ঘরের সামনের বারান্দায়। ছটপট করছে গলা কাটা মুরগীর মতো। পাশেই একটি ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে রইস। তার পিছনে গাছের একটা ডাল হাতে মাসুদা পড়ে আছে আহতবস্থায়।
লতা পা ঘুরিয়ে দাঁড়াল সবার দিকে দৃষ্টি তাক করে। চোয়াল শক্ত করে দরাজ কন্ঠে আদেশ দিল,
এখানে কেউ খুন হয়নি। আর হলেও আপনারা কিছু করতে পারবেন শিকদার পরিবারের বিষয়ে? দয়া করে সবাই চলে যান। এটা একান্তই আমাদের পারিবারিক ঝামেলা। কে আসতে বলেছে আপনাদের?
তখন সবাই মৃদু গুঞ্জন তুলে বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলো। লতা সপাটে লোহার গেটটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল।
গলা তুলে রইসকে জিজ্ঞেস করলো,
এরা কিভাবে ঢুকল রইস ভাই?
ভাবিসাব আমি জানিনা। আমি ওইদিকে জংলাগুলো কাইটা পরিষ্কার করতেছিলাম ছুরি দিয়ে। মাথা তুলতেই দেখলাম বোরকা পরা মহিলা একজন বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। তখন আমি তার পরিচয় জানার জন্যে আসলাম। এসেই দেখি উনি হাতের এই লাঠি দিয়া এই খবিসের উপর চড়াও হইছে। তখন সেও তারে চুলির মুঠি ধইরা বেধড়ক মারে। উনিই বেশী আঘাত খাইছে। এই অসুরের শক্তির লগে কে জিতে। কেউইনা। আমি উনারে থামাই। এবং পরিচয় জানতে চাই। তখন উনি কান্নাকাটি কইরা কইল আইজকার কাহিনী। আমিও বহুদিনের ক্ষোভ মিটাইবার একটা সুযোগ পাইলাম। তাই আমিও একটা পোচ দিই ছুরি দিয়া তার হাতের মইধ্যে। গেইট পুরাই খোলা ছিল। কেউ হয়তো পথের থেইকা দেইখা গ্যালো এই কান্ড। ব্যাস এভাবেই হুড়মুড় কইরা বাড়িতে আশেপাশের মানুষজন ঢুইকা পড়ল। সজীব ভাইকে জানাইছেন ভাবিসাব?
সজীব গাড়ি নিয়ে আসতেছে ঢাকা থেকে।
আলতাফ শিকদার কোঁকানো বিষকন্ঠে বলল,
আমার দলবল যদি একবার শুনে। তোরা কেউই জিন্দা থাকবিনা।
লতা একটা বেতের মোড়া টেনে বসল।
লুইচ্চা বুইড়া। তুই বাঁচলেইতো তোর দলবল। তোর খেলা খতম। এসে গিয়েছে বিষে ভরা নীল বুনোলতা। তার আধিপত্য কিন্তু বনের অন্য লতাগুলোর চেয়ে বেশী। জানিসতো। তার প্রভাব বনের বহুজায়গা নিয়ে। বুনোলতা গজাতে থাকে বনের বিস্তৃত অংশ নিয়ে। বুনোলতা অনেক মজবুত হয়। জেনে রাখ।
লতা মাসুদার দিকে চেয়ে কটাক্ষ করে বলল,
দেখলেনতো পরের মেয়ের জন্য গর্ত করলে নিজের মেয়েই সেই গর্তে পড়ে। এরসাথে হাত করেইতো গোপনে টাকা পয়সা খেয়ে আমাকে এই জল্লাদের হাতে তুলে দিলেন।
ওই খোদা সাক্ষী। আমি যদি এটা বুঝতাম। তাহলে রুমকিকে আমার সঙ্গে করেই বাইরে নিয়ে যেতাম। রুমকি এখানে অতিথি। সে যে তার সাথেও এমন নোংরা গর্হিত কাজ করবে। এটা আমার কল্পনাতীত ছিল। আমি অনুতপ্ত এজন্য। আমার আফসোস কভু যেন শেষ না হয়। আমি বহুদিন এই প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই রুমকির জন্য। আর আপনার ফয়সালা পরে হবে।
মাসুদা শরীরের যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল। এবং বলল মারে আমার রুমকি কেমন আছে এখন? সেরে উঠবতো?
প্রথমতো। তাই রক্তক্ষরণ হয়েছে অতিরিক্ত। আল্লাহকে ডাকুন। এই জানোয়ার আমার কলিজার বোনেরে শেষ করে দিল। আমি তাকে শেষ করে দিব। এই বলেই দাঁত কিড়মিড় করতে করতে আলতাফ শিকদারের অ’ ণ্ড কোষ বরাবর লাথি মেরে দিল লতা। ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে লাগল লতা।
ওমাগো! ও আল্লা! বাঁচাও! বলে গগন বিদারী আর্তচিৎকার দিতে দিতে আলতাফ হাত দিয়ে চেপে ধরল সেই স্থান।
পাশে দাঁড়ানো রইস যেন এবার মনে অনেক শক্তি ও সাহস পেল। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সে আলতাফের লুঙ্গি একটানে খুলে ফেলল। হাতের ধারালো ছুরিটা দিয়ে একপোচেই পু’ রু’ ষা’ ঙ্গ কেটে নিল। এক দৌড়ে বাড়ির পিছনে চলে গেল। গভীর গর্ত করে পুঁতে দিল।
ফিরে এলো ঘামাতে ঘামাতে হাঁপাতে হাঁপাতে।
রইস ভাই আমি নিজ হাতে শাস্তি দিব একে। আপনি কেন এটা করতে গেলেন? আপনি না তাদের বিস্বস্ত লোক?
ভাবিসাব ভয়ে মুখ খুলিনাই। এই খবিস আমার বউর ইজ্জত ও লুটে নিছে। একবার নয় কয়বার করেছে। সেই অপমানে শরমে আমার বউ গলায় দড়ি দিছে। আমি নিজ হাতে তার গলা কাটুম। টুকরা টুকরা করুম তারে।
হুম বুঝলাম। রইস ভাই। আপনি রান্না কতটুকু কি আছে। একটু দেখেন। উনি এসেতো খাবে।
গেইটে আওয়াজ হলে রইস গেইট খুলে তার নির্দেশ পাওয়া কাজের জন্য চলে গেল। লতার বাবা, ভাই ও তার দাদী এলো। সবাইর পাগল পাগল দশা।
লতার দাদী কাঁদতে কাঁদতে বলল,
ও লতাবু। ক্যামনে কি হইলো। রুমকির মা শুনার লগে লগেই পাগলের মতন বাড়িত থেইকা বাইর হইয়া আইল। কইলাম একলগে যাই। হুনলইনা। তাই পিছন দিয়া আমরাও আরেকটা সিএনজি নিয়া আইসা পড়লাম।
লতা তার বাবাকে ধরে কান্না শুরু করে দিল। বলল,আব্বা উনারে জিজ্ঞেস করুন আমাকে এখানে বিয়ে দিল কেন? এই বুড়ার জন্য?
লতার বাবা মাসুদার সামনে গেল। রক্তচক্ষু নিয়ে বলল, তুই কিভাবে এদের সন্ধান পেলি বল?
আল্লার কসম আমি এসবের কিছুই জানিনা। যদি জানতাম তাহলে কি আজকে রুমকিকে আসতে দিতাম এই বাড়িতে। আপনিই কন।
উনি লতারে নাকি কলেজের সামনে দেখে পছন্দ করছে। পরে আমার এক খালুরে বলল। আমি খবর নিয়ে দেখলাম ছেলে ভালো। বংশ ভালো। নামকরা বংশ। অনেক জমিজিরাত আছে এদের। তাই লতার সুখের কথা ভেবেই কথা দিছি এই ব্যাটারে। এর বাইরে এই লোকের বদ খাসলত সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। আম্মা একটু বুঝান না আপনার ছেলেরে। আহত কন্ঠে বলল মাসুদা।
লজ্জায়,অনুতাপে,দুঃখে মাসুদা ভারাক্রান্ত। মর্মাহত। ছিন্নভিন্ন।
লতার দাদী পাশ থেকে বলল,
হ বউ হাছাই কইছে। তবে আমি যদি হুনতাম শিকদার বংশের পোলা। তাইলে মানা কইরতাম। এই কুলাংগারের চরিত্র অল্পবয়স থেকেই খারাপ। আমি এই কিসসা জানি এক গোপন সূত্রেই।
লতা তার বাবাকে বলল,
আব্বা আপনারা এখানে থেকে কোন কাজ নেই। রুমকির কাছে হাসপাতালে চলে যান। আমি ঠিকানা বলে দিচ্ছি। উনি আসতেছে। তাই আমি এখন যাবনা।
লতা মাসুদাকে জিজ্ঞেস করল,
আপনি কি দুপুরে খেয়ে আসছেন।
লতার ছোট ভাই বলল,
না বুবু উনি যখন আসছে খেয়ে আসেনাই। আমরা খেয়ে আসছি।
আচ্ছা তাহলে আসেন আপনি আমার সাথে। ভাত খেয়ে নেন।
মাসুদা দেয়াল ধরে উঠার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার পড়ে গেল। পরে সবুজ ও তার বাবা মিলে মাসুদাকে ধরে দাঁড় করালো। ঘরের ভিতরে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসাল। মাসুদা বেসিন থেকে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিল। এরপর ক্ষুধা নিবারনের জন্যই সামান্য কিছু ভাত খেল।
সবুজ তাদেরকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল। বাড়িতে ফিরে এল চুমকি ও সুজানা। এভাবে কেটে গেল কয়েক ঘন্টা। চুমকি, সুজানা গোসল করে এলো। রইস সবাইকে ভাত এনে দিল। সুজানা ও লতা পাশাপাশি বসে ভাত খেয়ে নিল। চুমকিও খেয়ে নিল রান্নাঘরে বসে৷
আলতাফ শিকদার মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে আছে ঘরের সামনের খোলা বারান্দায়। তার শরির থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তগুলো জমাট বেঁধে আছে। তার উপরে মাছি মশা উড়ছে। অস্পুটভাবে গোঙাচ্ছে সে। পানি পানি করছে।
চুমকি পানি এনে দিল এবং বলল,
আইজকা বুইঝলাম তুই জ্বিন রাইতে আমার শইললে হাত দেস। তুই মরলে আমিই বেশী খুশী হমু। তখন আরামছে এই বাড়িতে থাইকতে পারুম।
হাসপাতালে রুমকির কাছে,তার বাবা,দাদী ও মাকে রেখে সবুজ চলে এলো বোনের কাছে।
আচমকা বজ্রপাতের মতো ঘটনার হায় হুতাশে বেলা বেশ গড়িয়ে গেল। রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে আজকের আকাশটা। পশ্চিমাকাশ থেকে অস্তমিত সূর্য বিদায় নিচ্ছে। সন্ধ্যা ছুইঁ ছুইঁ। সজীব চলে এলো বাড়িতে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে। আসার আগেই রুমকিকে হাসপাতালে দেখে এসেছে লতার থেকে ওয়ার্ড নং জেনে নিয়ে।
ঘরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ল আলতাফ শিকদারের নির্জীব দেহটা। অবিস্বাস্য বিষ্পোরিত চোখে চেয়ে আছে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার দিকে।
লতা গাড়ির আওয়াজ শুনেই ছুটে এলো। সজীবের পাশে এসে দাঁড়াল। এবং একনাগাড়ে সব বলে দিল।
সজীব তার দাদার দিকে পাহাড়সম ক্রোধ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
আপনি এতবড় মুখোশধারী ভন্ড লোক। আমার মাকে মেরে ফেলেছেন। কাজের লোকের বউকে..? ছিহ:
অন্য একজন নিদোর্ষ মানুষকে সারাজীবন আমার চোখের ঘৃণা আর অবঞ্জার পাত্র বানিয়ে রাখলেন?
আলতাফ বিড়বিড় করে মিনতি করছে,
আমাকে বাঁচা ভাই। যন্ত্রণায় মরে যাইতাছি। সব সম্পত্তি তোর নামে লিখে দিব। তোর বউ খুউব খারাপ। আমাকে সুস্থ করলে সব জানতে পারবি।
লতা বলল,
এই নোংরা? ধানের গোলার চাবি কই?
সজীব বলল হঠাৎ ধানের গোলার চাবি দিয়ে কি করবে?
কেন? আপনার প্রিয় দাদার বাকি কুকীর্তির অমূল্য নির্দশন দেখবেন না?
চলবে — ১০
জনরা #থ্রিলার