নেশাক্ত তোর শহর পর্ব শেষ

#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৫ (অন্তিম)

বেডের দুপাশে শুয়ে আছে দুজন। মাঝখানে পাহাড় সমান কোল বালিশ রাখা। একপাশ থেকে ওপাশ দেখা যাচ্ছে না এমন। পাশ থেকে আয়াতের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ গুনতে পারছে তৃষ্ণা। আয়াত তার সাথে সামান্য দুই একটা কথা ছাড়া কথাই বলে না। যেন মেপে মেপে কথার বলে। একটা বর্ণও না বের হয়। ঠোঁট কামড়ে বালিশ চেপে মন খারাপ করে শুয়ে আছে তৃষ্ণা।

হঠাৎ আয়াতকে দেখার তীব্র হাহাকার বিরাজ করলো মনে। মাঝখানে রাখা বালিশটা টেনে নিচে ফেলে দিল। আলতো ঝুঁকে আয়াতের উপরে উঠে পড়লো। দুহাতে ভর করে বেডের উপর নিজের ভারসাম্য বজায় রাখলো। আয়াত মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে কপাল কুঁচকে ফেলছে আর নাক টানছে। যেগুলো মনের ভেতরে অস্তিরতা তৈরি করছে তৃষ্ণার। হঠাৎ ই চুলের গোছা ছড়িয়ে পড়লো আয়াতের মুখ জুড়ে। আয়াত যেন চরম বিরক্ত হলো। আয়াতের রেসপন্স করার আগেই হাত উঠিয়ে চুলগুলো ছুঁয়ে দিল তৃষ্ণা। শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে আয়াতের শরীর স্পর্শ করলো তৃষ্ণা। আচম্বিতে এমন ঘটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেই হালকা মৃদু চিৎকার করলো আয়াত। চোখ খুলে তৃষ্ণার করুন মুখটা তার নজরে এলো। চোখ জোড়া তার মাঝের মাঝে স্তব্ধ হয়ে আছে।

তৃষ্ণা আয়াতের দিকে তাকিয়ে সরে আসতে নিলেই সোজা নিয়ে পড়ে গেল। কোমড়ে হাত রেখে স্লাইড করছে। উঠে বসলো আয়াত। বেডের কিনারায় হেলান দিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণা আয়াতের কান্ডে চরম অবাক। আগের আয়াত হলে দৌড়ে তৃষ্ণার কাছে গিয়ে তাকে জরিয়ে ধরে বলতো, “তৃষ্ণা কি হয়েছে। ব্যাথা লেগেছে? কোথায় লেগেছে? বল আমাকে।” আর আজ কেবলার মতো তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণার কিছু হলে যেন তার কিছু যায় আসেনা। আখিতে পূর্ণ হয়ে আসছে।

ধীরে ধীরে নিচে থেকে উঠে বসলো সে! নির্বিকার ভাবে আয়াতের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ছিটকিনি খুলে পা ফেলতেই পেছনে থেকে টেনে ধরলো আয়াত। নিজের দিকে ফিরিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল.

— “কি হয়েছে তৃষ্ণা? এতোরাতে কোথায় যাচ্ছ তুমি? আমি তো তোমার উপর কোনো প্রকার জোর করি না। তোমাকে নিজের মতো স্বাধীনতা দিয়েছি, তাহলে এইসবের মানে কি” ?

চোখের বাঁধ ভেঙে গেল তৃষ্ণার। ফোপাতে ফোপাতে বলল..

— “কেন? কেন জোর করেন না? কেন দিয়েছেন আমাকে স্বাধীনতা? একবারও আমি আপনার কাছে স্বাধীনতা চেয়েছি? কেন আপনি বুঝতে পারেন না; আমি আপনার যত্নগুরো ছাড়া ক্রমাগত দিশেহারা হয়ে পড়েছি। প্রথম প্রথম আপনার কেয়ারিং গুলোতে চরম বিরক্ত হতাম। পরে-তো বড্ড মিস করতাম। হুট করে না জানিয়ে আমাকে ছেড়ে বহু দূরে চলে গেলেন। এমন একটা মুহূর্ত নেই, যেখানে আপনি ছিলেন না। রাতে আপনার শার্ট গায়ে না ঝরালে আমার ঘুম হতো না। আর আজ আপনি আমার পাশে থেকেই হালকা জরিয়ে নিচ্ছেন না। সেদিনের একটা চড়ের জন্য এতোটা স্বার্থপর হতে কিভাবে পারলেন।
থাকবো না আপনার সাথে”।।।

অন্ধকারের মাঝে তৃষ্ণার মুখটা পরিষ্কার দেখা না গেলেও তার কান্না মিশ্রিত কন্ঠ বুকের ভেতরের শ্বাস আটকে দিচ্ছে আয়াতের। তার সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা থাকলেও তৃষ্ণা কান্না সহ্য করতে পারে না।

দুহাত বাহুতে রেখে বুকে টেনে নিল তৃষ্ণাকে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে গেছে তৃষ্ণার। তৃষ্ণার সাথে তাল মিলিয়ে আয়াতের শরীরটা মৃদু মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে। চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আশ্বাসের কন্ঠে বলল..

— “ডোন্ট ক্রাই পিয়াসু পাখি। আমি তো আমার পিয়াসু পাখির জন্য দূরে দূরে ছিলাম। ততোটাইও দূরে নয়। তুমি হাত বাড়ালেই আমাকে ছুঁতে পারতে। তৃষ্ণার্থ আয়াত কখনো আলাদা হতেই পারে না”।

কথাটা বলে বুকের গুটিয়ে থাকা তৃষ্ণার মুখটা তুললো। তৃষ্ণা আয়াতের দিকে তাকালো না। পূর্বের ন্যায় বুকে মুখ লুকিয়ে নিল। লজ্জার্থ মুখে বলল.

— “প্লীজ আয়াত। আমাকে আপনার থেকে সরাবেন না”।

সরালো না আয়াত। হাতের বাঁধন দৃঢ় করে তৃষ্ণার বেষ্টিত করে নিল নিজের সাথে। মৃদু হেসে বলল.

— “জানো তৃষ্ণা; আমি সবসময় তোমার উপর বিশ্বাস রেখেছি। আমি জানতাম; আমার পিয়াসু ঠিক আমার আছে ফিরে আসবে। তোমার মায়াবী মুখটা দেখে কতো রাত জেগে কাটিয়ে দিয়েছি তুমি জানো না। প্রথম যখন জানতে পেরেছিলাম, তোমার জীবনে আমি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ ছিলো। প্রচুর ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছি, না-চাওয়ার সত্ত্বেও তোমাকে পেয়েছি। এতেই খুশি ছিলাম। আমি আজ বড্ড বেশী খুশী তৃষ্ণা”।

আয়াত কে ছাড়িয়ে দূরত্ব বজায় রেখে সরে এলো তৃষ্ণা। কাচুমাচু হয়ে ধীরে ধীরে বেলকেনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। সময় অবিলম্ব না করে আয়াতও তৃষ্ণার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। রেলিং এর দুপাশে হাত রেখে, হাতের মাঝে বন্দী করে নিল তৃষ্ণাকে।

আয়াতের নিঃশ্বাস চুলের বাজে আঁচড়ে পড়তেই ফিরে তাকালো তৃষ্ণা। আয়াতের চিবুকের সাথে হালকা ধাক্কা লেগে সামনে এগিয়ে গেল। ভেংচি কেটে নুইয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আয়াত ধরে নিল। গ্ৰীলহীন বেলকেনিতে চেপে ধরে শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালো সে। মুখ ঘুরিয়ে টানা টানা গলায় বলল..

— “স-সরুন। বর্তমানে ভাইরাস আরো বেড়ে গেছে। তিন ফিট ডিসটেন্স মেইনটেইন করে দাঁড়ান”।

দাঁত কেলিয়ে স্বল্প ঝুঁকে তৃষ্ণাকে কোলে তুলে নিলো। বাঁকা হেসে বললো..

— “কোভিট-এর থেকেও বড় ভাইরাস হচ্ছো তুমি; আর তোমার ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরে আর কোনো ভাইরাস আমাকে আক্রান্ত করতে পারবে না”।














— “আদু দেখ তোর জন্য আমি ললিপপ এনেছি? এগুলো সব তোর”।(ব্যাগ থেকে ললিপপ বের করে রিদ্রু)

— “আদু শুধু আমাল টোকায় ননিপপ খাবে। তোল তা তুই খাঁ।
তিহান ললিপপ গুলো নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল দূরে। সাথে রেগে গেল রিদ্রু। চুলগুলো টেনে মাটিতে ফেলে দিয়ে আদুরে কোলে তুলে নিলো। তিহানও কম যায় না। রিদ্রুর থেকে আদুকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। একজন হাত ধরে টানছে তো আরেকজন পা ধরে টানছে। দুজনের টানাটানি মাঝখানে কেঁদে উঠলো আদু। সাথে সাথে ছেড়ে দিল দুজনে। পড়ে যেতে নিলেই ধরে নিল তিশা। ঠাস করে রিদ্রুর গালে চড় মেরে জোরে জোরে ডেকে উঠল সে”।

— “ঐ রিজভীর বাচ্চা; তোর ছেলেকে এখান থেকে নিয়ে যা। না-হলে ছেলের দোষে তুই আস্ত থাকবি না”।

তিশার চিৎকার শুনে একপ্রকার দৌড়ে ছুটে এলো সবাই। সামনে রিদ্রু আর তিহানকে দেখে বুঝতে বাকি রইল না, এখানে কি হয়েছিল।

তিহানের বয়স সবে সাড়ে তিন বছর। তাহসান আর শান্তির ছেলে। তিশা আর রিজভীর ছেলের বয়স পাঁচ বছর। আর তৃষ্ণা আয়াতের একটা ছোট মেয়ে আছে। তার নাম আরিয়া। আরোহী পছন্দ করে নাম রেখেছে। বয়স সাত মাস পেরিয়েছে। সবাই ভালোবেসে আদু বলে ডাকে
দুই ভাইয়ের জ্বালায় শান্তি নেই। দুজনেই আরিয়াকে বিয়ে করবে। প্রায় সময়ই তাহসানের বাড়িতে থাকে। না-হলে আয়াতের বাড়িতে গিয়ে হট্টগোল শুরু করে দেয়। আজ পুরো পরিবার একসাথে রিজভীদের বাড়িতে এসেছে। আজ পঞ্চমতম জন্মদিন রিদ্রুর।

তৃষ্ণা এগিয়ে গিয়ে তিশার কোল থেকে আদুকে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। আদু এখনো ভয়ে কেঁদে চলেছে। তৃষ্ণার কান মুচড়ে তিশা বলল.

— “ইচ্ছে করছে তোকে আচ্ছামত পিটাই। বাচ্চাগুলোকে আদরে আদরে বাঁদর তৈরি করেছিস। একটু বকলে কি হয়? যদি নিচে পড়ে যেত”।

রিদ্রু তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে গিয়ে কপালের মাঝবরাবর শব্দ করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। ওমনি কান্না বন্ধ করে রিদ্রুর দিকে তাকিয়ে রইল আদু।
এবার রিদ্রুর খুশি দেখে কে?? মুরগীর মতো লাফাচ্ছে আর বলছে..

— “দেখ দেখ! আমি চুমু দিলাম আর কান্না থামিয়ে দিল। পারলে তুই একটা চুমু দে তো দেখি থামে কি-না”।

সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে তিহান। রিদ্রু তৃষ্ণার সামনে দাঁড়িয়ে বলল..

— “আন্টিমনি! আন্টিমনি। আজ তো আমার জন্মদিন। তুমি জন্মদিনের গিফট হিসেবে বাবুকে আমায় দিয়ে দাও। প্লীসসহহ..

— “একদম ভাদে কতা বনবি না। তোর জল্মদিন তো মাতা কিনে নিয়েতিস। দুদিন পল আমালও জন্মদিন আতবে। তখন?
তুপিমনি তুমি আলো একটা বাবু কিনে আনবে। বনো না তুফিমনি”।

দুজনের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে‌ তৃষ্ণার। তৃষ্ণার পরিস্থিতি দেখে সবাইকে বের করে দিল তিশা। ততক্ষণে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেছে আদু।

তৃষ্ণা আদুকে দোলনায় শুইয়ে দিল। কপালে চুমু এঁকে বেরিয়ে যেতে নিলে হাত ধরে আটকে দিল আয়াত। বুকে হাত গুজে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়াল। ভ্রু কুঁচকে তাকালো তৃষ্ণা। ভেংচি কেটে বলল..

— “পথ আটকে দাঁড়ালেন কেন আপনি? কি চাই”?

সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো আয়াত.
— পিয়াসুকে!

— “ডং করছেন আমার সাথে? আমিই তো পিয়াসু”!

পেছনে থেকে তৃষ্ণাকে জড়িয়ে নিয়ে বলল.

— “আমার জানামতে তুমি তৃষ্ণা। আমার চাই পিয়াসুকে। পিয়াসু অর্থ তৃষ্ণা। অর্থাৎ তৃষ্ণা মেটাতে তৃষ্ণাকে চাই।”

গভীরভাবে তৃষ্ণার কাঁধে মুখ গুঁজতেই ভ্যা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো আদু। খিলখিল করে হেসে উঠলো তৃষ্ণা। চুলগুলো ঝাড়া দিয়ে ভাব নিয়ে বলল.

— “যেমন বাপ তার তেমন বেটি”!

গালে হাত দিয়ে করুন চোখে মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে আয়াত। যখনই রোমান্স করতে যায়, তখনই বারোটা না বাজানোর পর্যন্ত শান্তি পায় না আদু।।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here