#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৮
— “ঐ গন্ডরের বাচ্চা গন্ডার বললাম তো সরি। এবারও রাগ করে থাকবেন। আপনি জানেন, আমি একটবার হ্যালো বললে, সব ছেলেটা পাগল হয়ে যায়। দেখবেন”?
আয়াত তৃষ্ণার কথা এক কানে দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিল। গা ছাড়ানো ভাব নিয়ে বাদামের লালচে খোসা গুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল। সামান্য খোঁসা তৃষ্ণার মুখে পড়তেই চোখ বন্ধ করে নিল। চোখ খুলে আয়াতের দিকে তাকাতেই মেজাজ বিগড়ে গেল তার।
— “আপনার আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না”!
আর কিছু বলার আগেই আয়াত তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলল..
— “প্রথমত গন্ডারের বাচ্চা অলওয়েজ গন্ডারই হয়, সিংহ নয়। আর দ্বিতীয়ত আমি সবসময় তোমার সাথে ছিলাম না। তাই তুমি হ্যালো বললে ছেলেরা পাগল হয়ে পাগলা গারদে যায় নাকি অন্য কোথায়, সেটা আমি কিভাবে জানবো।
তোমার ভয়েজ এতোটাই খারাপ যে, ছেলেদের হ্যালো বললেই পাগল হয়ে যায়। তুমি আবার তা গর্ব করে বলছ? হাউ ফানি”।
গভীরভাবে কিছুক্ষণ ভাবলো তৃষ্ণা। কথার মাঝে ফাঁক রাখলে যা হয় আরকি।” ওয়েট” বলে উঠে গেল তৃষ্ণা। আয়াতের সামনে ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে পড়লো। বাদাম খেতে খেতে আড়চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল এক্সজেকলি কি করছে তৃষ্ণা।
মাথার ঘোমটা ফেলে পায়ের উপরে পা তুলে ভাব নিয়ে বসলো তৃষ্ণা। চোখের দৃষ্টি মোহনীয় করে সামান্য দূরত্বের ছেলেটার দিকে তাকালো। ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা চুলগুলো ছেড়ে দিল। চুলে কিছুক্ষন হাত বুলিয়ে ছেলেটাকে চোখ টিপ মারলো। দুগালে হাত রেখে ইশারায় কথা বলছে।
তৃষ্ণার কান্ড দেখে পরপর ঢেকুর তুললো আয়াত। কিছুতেই কমছে না, যতোই তৃষ্ণার দিকে তাকাচ্ছে ততোই ঢেকুর বেড়েই চলেছে। বেঞ্চিতে রাখা পানির বোতলের ছিপি খুলে দুই ঢোক খেয়ে সামনে তাকালো।
তৃষ্ণা ঠোঁট কামড়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে, দেখে মাথা গরম হয়ে গেল আয়াতের। বোতলটা দূরে ছুঁয়ে ফেলে এগিয়ে গেল তৃষ্ণার দিকে। শরীর থেকে ওরনাটা টান দিয়ে নিজের গলায় পেঁচিয়ে নিল।
থেমে গেল তৃষ্ণা। ওরনাটা ধরার আগেই আয়াতের হাতে চলে গেল। দুহাতে শরীর ঢেকে মাথা নিচু করে নিল। আয়াতের চোখের তাকানোর মতো সাহস খুঁজে পাচ্ছেনা। আয়াত পকেট থেকে ফোন বের করে বলল..
— “ওরনাটার সাথে তোমার নোংরা বিহেব যাচ্ছে না। তাই খুলে নিলাম। এবার যেটা করছিলে সেটা কান্টিনিউড করো। আমি ভিডিও করছি”।
তৃষ্ণাকে শান্ত দেখে আবার বলল..
— “বুঝতে পারছি, আমার সামনে সমস্যা হচ্ছে। ঠিক আছে তারচেয়ে বরং আমি চলে যাই আর তুমি কান্টিনিউড করো”।
শিস বাজাতে বাজাতে আয়াত চলে গেল। আয়াতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিল তৃষ্ণা।পার্কের সবাই বাজে দৃষ্টিতে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। বড্ড অভিমান জন্মালো তার উপর। কিভাবে পারল এমন পরিস্থিতিতে ফেলে চলে যেতে।
মিনিট দুয়েক পর কেউ একজন ওরনা পেঁচিয়ে দিলো তৃষ্ণা শরীরে। দুহাতে ওরনার ফাঁক দিয়ে কোমড় জড়িয়ে গলায় গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। চমকে উঠলো তৃষ্ণা। সে ভালো করেই জানে আয়াত এসেছে। আয়াতের অস্তিত্ব উপলব্ধি করে তাকে চিনতে হয়না। উষ্ণ স্পর্শগুলো জানান দেয় আয়াতের উপস্থিতি।
.
— “কি হলো, বাড়িতে যাবে না না-কি এভাবেই থাকবে”।(নিজের দিকে ফিরিয়ে আয়াত)
— “আসলে হাতি পড়ে গিয়েছিল তাই কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে। হাঁটতে পারবে না। কোলে নিতে হবে”।
বলেই হাতজোড় বাড়িয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো তৃষ্ণা। আয়াতও হেসে তৃষ্ণাকে কোলে তুলে নিলো। এগিয়ে গেল নিজের গন্তব্যে দিকে।
__________________________
হাসি আনন্দের মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। ধীরে ধীরে তৃষ্ণার মনে অজান্তেই আয়াত জায়গা করে নিয়েছে। প্রায়ই আগের সেই কেয়ারিং আয়াতকে মিস করে তৃষ্ণা। কারণ আয়াত আর আগে মতো নেই। তৃষ্ণার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। সে চায়না তার কেয়ারিং এ তৃষ্ণা অস্বস্তিতে পড়ুক। প্রথমে তৃষ্ণার অতীত সম্পর্কে কিছু না জানলেও পরবর্তী তার মায়ের কাছ থেকে সবটা জেনেছে। তাই তৃষ্ণাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সময় দিয়েছে।
বেশ কিছুদিন ধরে কাজের চাপে নিজের যত্ন নিতে পারে না। ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে অফিসে যাচ্ছে আর মাঝরাত করে বাড়ি ফিরছে। ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় গাড়িতে অবস্থান করা সময় টুকু আর রাতে ঘুমন্ত তৃষ্ণার মুখটা মন ভরে দেখে আয়াত।
রাতের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে আবার মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রাত নয়টার কাটা অতিক্রম করার আগেই জনশূন্য হয়ে পড়েছে শহর। রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচলও অনেকটা কমে গেছে।
বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছে আয়াত। ব্যাগটা সোফায় রেখে সুট খুলে রাখল। বাড়িটা অন্ধকার হয়ে আছে। বৃষ্টির দিনে ঘুম ভালো হয় বিদায় সন্ধ্যা রাতে সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ভেজা শরীর নিয়ে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালে পেছন থেকে ঢেকে উঠল মনিকা..
— “আয়াত খাবারটা নিয়ে যা। নিচে আর আসতে হবেনা। দুজনে একসাথে খেয়ে নিস”।
পেছনে ঘুরে খাবার হাতে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো আয়াত..
— “মা! তৃষ্ণা খায়নি”।
— “জানি না মেয়েটার কি হয়েছে। সকালে সামান্য খেয়ে ভার্সিটিতে গেছে। দুপুরে আর খায়নি”।
বাক্য উচ্চারণ না করে খাবার নিয়ে উপরে চলে এলো আয়াত। অন্ধকারে গ্ৰাস করে আছে আয়াতের রুমটা। জানালা দরজা খোলা বিধায় বৃষ্টির পানিতে রুমের অনেকটা অংশ ভিজে আছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলকানিতে সবকিছু দিনের মতো আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। আবার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। যেই ঝলকানিতে তৃষ্ণার ঘুমন্ত মুখটা আয়াত দেখতে পারছে। যেই মুখের দিকে তাকিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে দ্বিতীয় বার ভাববে না আয়াত।
খাবারটা টেবিলের উপর রেখে দরজা জানালা বন্ধ করে দিল। ভেজা জামা কাপড়সহ ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। যাওয়ার আগে শান্তভাবে বলে গেল..
— “তৃষ্ণা খাবারটা খেয়ে আবার ঘুমাও। নাহলে অসুস্থ হয়ে যাবে”।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে খাবারের দিকে একবার তাকিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকালো। আগের ভঙ্গিতেই তৃষ্ণা শুয়ে আছে। আলো জ্বালাতেই গোপনীয় প্রয়োজনীয় জিনিস নজরে এলো আয়াতের। মেয়েটার এমন বিহেবের কারণ বুঝতে ব্যর্থ হলো না সে।
এগিয়ে গিয়ে তৃষ্ণার পায়ের কাছে বসে পড়লো। বাঙ্কেটের ভেতর থেকে পা বের করে কোলের উপর রাখলো। ধীরে ধীরে টিপে দিতে লাগল।
অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে ফিরে তাকালো তৃষ্ণা। মাথার ঘোমটা টেনে করতলের উপর ভর করে ধীরে ধীরে উঠে বসলো তৃষ্ণা। সময় নষ্ট না করে তৃষ্ণার পেছনে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। অতঃপর খাবার মেখে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিলো।
খেতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু আয়াতের হাতে খাওয়ার সুযোগটা ছাড়তে চাইছে না। বড় করে হা করলো। আয়াত খাবার মুখে পুড়ে দিয়ে বলল..
— “তৃষ্ণা আমি হয়তো জানি না এইসব দিনগুলো কেমন হয়। কিন্তু এইটুকু তো জানি, এই সময়ে স্বাভাবিক দিনের তুলনায় খাবারগুলো স্বাস্থ্যকর হতে হবে। পাশাপাশি নিজের যত্ন নিতে হবে। কিন্তু তুমি দিন দিন কেমন আলসে হয়ে যাচ্ছ”।
তৃষ্ণা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আয়াতের কোলে উঠে বসলো। শক্ত করে আয়াতের গলা বেষ্টিত করে কাঁধে মাথা রাখলো। মৃদু শব্দে বলল..
— “আমি আলসে হয়ে গেছি তাতে কি? আমার আয়াত তো আছে, আমার জন্য! সে নাহয় তার পিয়াসু পাখির যত্ন নেবে”।
প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল আয়াতের মুখে। প্রথমবার আয়াতকে নিজের বলে দাবি করছে তৃষ্ণা। নিজেকে আয়াতের পিয়াসু পাখি বলে সম্বোধন করছে।
বাম হাত থেকে খাবারের প্লেট নামিয়ে তৃষ্ণার গালে হাত রাখলো। কিছু একটা ভেবে কপালের এপিঠ ওপিঠ ছুঁয়ে দিল। না জ্বর আসে নি।
.
ল্যাপটপের মৃদু আলোয় আয়াতের ক্লান্তিময় মুখটা স্পষ্ট দেখতে পারছে তৃষ্ণা। কতো গুলো এই মুখটার বদলে ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে থেকেছে তার হিসেব নেই। কিছুক্ষণের দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মুখ খুললো তৃষ্ণা।
— “শুনছেন”?
ভ্রু কুঁচকে তাকালো আয়াত। পূর্ণরায় ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বলল –“হয়”
— “বলছিলাম, আপনাকে আজ বড্ড ক্লান্ত লাগছে। প্রতিদিনই তো রাত জেগে কাজ করেন আজ ঘুমিয়ে পড়ুন”।
আয়াত কিছুক্ষণ ভেবে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল..
— “ঠিক আছে ঘুমিয়ে পড়বো। আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে”।
#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৯
— “ঠিক আছে ঘুমিয়ে পড়বো। আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে। আসলে এতো দিনে কাজের চাপে মাথাটা পুরো ধরে আছে। যদি অফিসের কাজ করতাম তাহলে চা খেলেই কমে যেত”।
আয়াতের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করলো না তৃষ্ণা। কোল থেকে ল্যাপটপ টা সেন্টার টেবিলের উপর রাখল। গুছিয়ে রাখা বালিশটা নিজের কোলের উপর রাখলো। আয়াতের মাথাটা টেনে নিজের কোলের উপর রাখা বালিশটার উপর রাখল। চুলের ভাঁজের হাত রেখে সুন্দর ভাবে চুলগুলো টেনে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
তৃষ্ণার হাত ছাড়িয়ে উঠে বসলো আয়াত। কোলের উপর থেকে বালিশটা সরিয়ে পূর্ণরায় তৃষ্ণার কোলে মাথা রাখল। তৃষ্ণার হাতজোড়া নিজের চুলের ভাঁজে রেখে চোখ জোড়া গ্ৰথন করে বলল..
— “তোমার শরীরে উষ্ণভাব টা বালিশের কারণে পুরোপুরি আমার কাছে আসছে না। তাই আসার ব্যবস্থ করলাম”।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করলো দুজনের মাঝে। নিরবতা কাটিয়ে আয়াত মুখ খুললো..
— “তৃষ্ণা তোমার কি তোমাদের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। বিয়ের পর তোএকবারও যাও নি”।
— “আগে ইচ্ছে করত না বাট এখন করে। পুরোনো সেই দিন গুলোকে বড্ড মিস করি”।
— “তাহলে চলো কালকে যাই। আমারও বন্ধ আছে। তাছাড়া তুমি যদি চাও তাহলে বেশ কিছুদিন থাকতেও পারো”।
“আর আপনি” বিরবির করে উচ্চারণ করলো তৃষ্ণা। ভ্রু কুঁচকে বলল..
— “তুমি তো জানো, কাজের চাপে বাবা দেশে ফিরতে পারছে না। আমাদের বিয়েতেও আসতে পারেনি। তাই আমি ভেবেছি, কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে গিয়ে থাকবো, বাবাকে হেল্প করবো। তুমি চাইলে পুরোটা সময় সেখানে থাকতে পারো”।
চুপ হয়ে গেল তৃষ্ণা। অজানা মন খারাপ এসে তৃষ্ণার মনে ভর করলো। বুকের মাঝে আয়াতের শূন্যতা অনুভব করলো সে।
_____________________
বেশ কিছুক্ষণ আগে তাহসানের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে আয়াত তৃষ্ণা। আসার সময় পুরো বাজার তুলে এনেছে। তৃষ্ণার বারণ আয়াত শুনেনি। তার একটাই কথা,” প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি,, ফাঁকা হাতে কিছুতেই যেতে পারবো না। প্রয়োজনে পুরাতন হলে কিছুই নেবো না”। তাই কিছু বলার অবকাশ পাইনি তৃষ্ণা।
সেখানে এসে চমকে গেছে দুজনে। আগে থেকেই সেখানে রিজভী আর তিশা উপস্থিত ছিল। তবুও স্বাভাবিক বিহেব করেছে। তার ভাবনার আয়াতকে ঘিরে অন্যকোনো পুরুষের অস্তিত্ব সেখানে নেই।
সোফায় বসে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তৃষ্ণা। সাথে পেটে ক্ষুধার জ্বালা যোগ হয়েছে। ভাবীর কড়া নির্দেশ ছেলেরা না আসা পর্যন্ত খাওয়া যাবে না।
তাহসান, আয়াত, রিজভী জুম্মার নামাজ আদায় করতে মসজিদে গেছে।
দুহাতে পেট চেপে রান্না ঘরের ভেতরে চলে গেল তৃষ্ণা। শান্তা শাওয়ার নিতে গেছে। নিঃশব্দে বাটির ঢাকনা সরিয়ে লোভাতুর দৃষ্টিতে ইলিশ মাছের ঝোলের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রতিটি পিচের ভেতরে ডিমের ভর্তি। ঝোল ছাড়িয়ে ডিম ভর্তি ইলিশ মাছের থেকে ডিমটুকু বের করে মুখে পুড়ে নিল। অতি দ্রুত চিবিয়ে এক ঢোক পানি খেয়ে শান্তির শ্বাস ছাড়লো। এবার যদি তার ভাবী জানতে চাই কে মাছ খেয়েছে। তাহলে সোজা উত্তর দেবে। “ঐ বাড়ির ছুঁছুম বিড়াল খেয়েছে।
এইসব ভেবে নিজেই শব্দ করে হেঁসে উঠলো।
— “তুমি এখানে কি করছ”?
ভরকে গেল তৃষ্ণা। প্রতিবারের মতো আজও ফেঁসে গেল সে। শব্দহীন হাতে ঢাকনাটা বাটির উপর রেখে পেছনে ফিরে মেকি হাসি দিল।
এগিয়ে এলো আয়াত। পেছন থেকে তৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরে গম্ভীর কন্ঠে বলল..
— “তুমি চুরি করছ তৃষ্ণা। তোমার থেকে এটা আমি এক্সপেক্ট করি নি”।
নিজের ভেতরের সাহস সঞ্চয় করে থেমে থেমে উত্তর দিল..
— “আমি যে চুরি করেছি তার কি প্রমান আছে হ্যা? আজকাল লোকেরা সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করে না”।
তৃষ্ণাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল..
— “আই সি। সাক্ষী হচ্ছি আমি নিজে আর প্রমান হচ্ছে তোমার মুখের কোণে লেগে থাকা ডিমের গুঁড়ো”।
ঠোঁট উল্টে আয়াতের দিকে তাকিয়ে মুখ মুছতে নিলে, হাত ধরে থামিয়ে দিল আয়াত। উপায় না পেয়ে করুন সুরে বলল..
— “প্লীজ মুছতে দিন, সবাই দেখলে কি ভাববে। প্রয়োজনে আমি আপনাকেও ঘুষ দেবো”।
— “কি ঘুষ”।
অপেক্ষা করলো না তৃষ্ণা। অন্য একটা মাছের ডিম বের করে আয়াতের দিকে এগিয়ে দিলো। আকস্মিক ঘটা তৃষ্ণার এমন ঘুষের জন্য আয়াত প্রস্তুত ছিলো না। তাতে তৃষ্ণার কিছু যায় আসেনা। একহাতে আয়াতের গাল চেপে পুরো ডিম মুখে পুড়ে দিয়ে হাত ধুয়ে নিল।
.
সবাই তৃপ্তি করে খেতে বসেছে। তৃষ্ণা আর শান্তা সবাইকে পরিবেশন করে দিচ্ছে। শান্তার জোরাজুরিতে তৃষ্ণাও খেতে বসেছে। তাহসান বোনের প্লেটে খাবার সাজিয়ে ইলিশ মাছ দিতে গেলেই চোখ ছানাবড়া। একটা ইলিশ মাছেরও ডিম নেই। তৃষ্ণা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ইনোসেন্স ফেস করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল..
— “ভাইয়া বিয়ের পর প্রথমবার এলাম। আর তুমি কিপ্টামো করে ডিম ছাড়া ইলিশ মাছ এনেছ? আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি চাও নি আমি এই বাড়িতে আসি। যাও আমি আর আসবো না। এবার খুশি তো”।
তৃষ্ণার উদ্ভর কথাবার্তা শুনে আয়াতের চোখ কপালে। একটু আগে রান্না ঘরে বসে সব ডিম সাভার করে দিয়ে এখন ইনোসেন্স ভাব নিচ্ছে।
তাহসান ক্ষুব্ধ চোখে শান্তার দিকে তাকালো। আজ তৃষ্ণারা আসবে বলে, বাজার থেকে বড় বড় ডিম ওয়ালা মাছগুলো কিনে এনেছে।
— “ডিমগুলো কোথায় শান্তা”।
নরম কন্ঠে ভয় পেয়ে গেল শান্তা। সে তো ডিমগুলো সরায় নি তাহলে গেল কোথায়। শান্তা মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আয়াত বলল..
— “আসলে কি হয়েছে ভাইয়া। আপনাদের পাশের বাড়ির ছুঁছুম বিড়াল টা মাছগুলো বেছে বেছে ডিমগুলো খেয়ে গেছে। আমি কতো করে বললাম, ডিমগুলো রেখে মাছগুলো খাঁ। ডিম আমার বউয়ের খুব পছন্দ কিন্তু শুনলোই না।
বলল, শাড়ি পড়া না থাকলে সবগুলোই খেতাম”।
সরাসরি তৃষ্ণাকে না বোঝালেও ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে সেই তৃষ্ণাকেই মিন করছে আয়াত। তাহসান আয়াতের কথার মানে বুঝতে না পেরে বলল..
— “বিড়াল আবার শাড়িও পড়ে”?
— “এটা যেই সেই শাড়ি না। একদম কালো শাড়ি”।
কালো শাড়ি শুনতেই সবাই আড়চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকালো। সামান্য সময় তৃষ্ণার কান্ড দেখে শব্দ করে হেঁসে উঠল সবাই। তৃষ্ণা আয়াতের দিকে তাকিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। নাক টানতে টানতে বলল..
— “এরজন্যই আমি আপনাকে ঘুষ খাইয়ে ছিলাম হ্যা। আপনি সবার সামনে আমাকে এভাবে! ভ্যাঁ ভ্যাঁ”।
তৃষ্ণা হাত নাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে হুট করে গরম তরকারির বাটিতে ধাক্কা লাগল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আয়াতের পাঞ্জাবির উপরে পড়ল। আকস্মিক ঘটা দূর্ঘটনায় জন্য সবাই হতবাক হয়ে গেল। চর্বিযুক্ত গরম তরকারি আয়াতের শার্টের সাথে আঠার মত লেগে আছে। আয়াত দ্রুত পাজ্ঞাবি শরীর থেকে খানিকটা দ্রুতে নিয়ে বুকে ফুঁ দিতে লাগলো।
তৃষ্ণা খাওয়া ছেড়ে আয়াতের দিকে এগিয়ে গেল। আয়াতের পাজ্ঞাবীতে হাত দিতেই “আহহ” করে চিৎকার করে উঠলো তৃষ্ণা। তৃষ্ণার চিৎকার শুনে আয়াত পাজ্ঞাবী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তৃষ্ণার হাতের দিকে দিল। তৃষ্ণা হাতে ফুঁ দিচ্ছে। একহাতে নিজের পাজ্ঞাবী অন্যহাতে তৃষ্ণা হাত ধরে বেসিনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। ট্যাপ ছেড়ে ধীরে ধীরে তৃষ্ণার হাত পরিস্কার করে নিল।
— “ভাবী একটু মলমটা রুমে দিয়ে যাবেন”।
বলে অপেক্ষা না করে তৃষ্ণার হাত ধরে উপরে চলে গেল। রুমে এসে এক টানে শরীর থেকে পাজ্ঞাবী খুলে ফেলল। চিবুকে প্রচুর পরিমাণে জ্বলছে তবুও কোনো আক্ষেপ নেই তার। তৃষ্ণার কষ্টের কাছে তার কোনো ব্যথা কিছুই নয়।
তৃষ্ণার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি ঝড়ছে। আয়াত তৃষ্ণার পাশে বসে করুন সুরে বলল..
— “খুব জ্বলছে। একটু দেখে শুনে কাজ করতে পারো না। হাত পুড়ে গেলে কি হতো।
একটু অপেক্ষা করো, ভাবী এক্ষুনি মেডিসিন নিয়ে আসবে”।
আয়াতের গলা জড়িয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলো তৃষ্ণা। অপরাধী কন্ঠে বলল..
— “আ’ম সরি। আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। কিভাবে পড়ে গেল বুঝতে পারিনি। সামান্য হাতে লেগেই আমার এতো জ্বলছে। আর আপনার তো।
আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না”। (আয়াতের চিবুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে)
এক দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ির অর্ধ আঁচল ভিজিয়ে ফিরে এলো আয়াতের কাছে। অতি সাবধানে সময় নিয়ে আয়াতের চিবুকে লাল হয়ে যাওয়া অংশে ভিজিয়ে নিচ্ছে।
(চলবে)
(চলবে)