#পদ্ম_পাতার_জল
#পর্ব_৭
#সাহেদা_আক্তার
#গল্প_কথার_ঝুঁড়ি
হঠাৎ এত কিছুর মাঝে ইয়াশ ওর হাত ধরে একটান মারল। পদ্ম সোজা গিয়ে পড়ল ইয়াশের বুকে।
.
.
.
.
পদ্ম চোখ বড় বড় করে ইয়াশের বুকে শুয়ে আছে। ওর কানের কাছে ইয়াশের হৃদপিণ্ডটা খুব জোরে শব্দ করে সারা দেহে উষ্ণ রক্ত ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর মাঝে ইয়াশ ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে বলল, এভাবে সারাজীবন আঁকড়ে রাখব। কোথাও যেতে দেবো না। বুঝেছ? পদ্ম দাঁত কিড়মিড় করে বলল, বুঝেছি। উফ্ ফাজিলটা কি মুসিবতে ফেলল। ঘুমের মধ্যে বৌয়ের স্বপ্ন দেখছে নাকি! আমাকে বৌ ভেবে…… কি জ্বালা! এখনি এলার্ম বেজে উঠবে। তারপর যদি একবার ধরা খাই তাহলে কিমা বানিয়ে ছাড়বে। এমনিতে ঝগড়ায় আমার থেকে এক ডিগ্রি উপরে। যা হোক। এখন এই ঝামেলাটা থেকে বের হই।
পদ্ম উঠতে গেলে ইয়াশ দুই হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। পদ্ম না পারছে উঠতে, না পারছে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙ্গে দিতে। মনে মনে বলল, ব্যাটা, সত্যি সত্যি আমাকে বউ ভেবে বসল নাকি? এখনো বিয়েই করে নাই দেখে বৌয়ের স্বপ্ন দেখছে। দাঁড়া, এখান থেকে বের হই তারপর তোর বউয়ের ব্যবস্থা করব। কি করে যে বের হই!
.
.
.
.
ইরিনা, ইনু আর রিনি বারান্দা থেকে ওদের কান্ড দেখছে আর হাসছে। ইনু হাসতে হাসতে বলল, বেচারা পদ্ম আপু, ভাইয়াকে উঠাতে গিয়ে নিজেই আটকে গেছে।
ইরিনা- তা যা বলেছিস।
রিনি- আমার কিন্তু পদ্ম আপুকে অনেক ভালো লাগে। কি কিউট দেখতে।
ইরিনা- আমি যা ভাবছি তোরাও কি তা ভাবছিস?
ইরিনার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে দুজনই মাথা নাড়ালো। ইরিনা বলল, ব্যাপারটা মন্দ হয় না। কি বলিস। আগে এই ব্যাপারটা মিটুক তারপর আমি আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলব।
ওদের কথা শেষ হতেই এলার্ম বেজে উঠল। তিনজন একসাথে ইয়াশের রুমের দিকে তাকাল। ইরিনা দ্রুত বলে উঠল, প্ল্যান বি স্টার্ট।
.
.
.
.
পদ্ম কিছুতেই ইয়াশের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে পারল না। তাই ওর বুকে চুপ করে শুয়ে রইল। আগে কখনও কারো হার্টবিট শোনেনি পদ্ম। আজ প্রথম কারো বুকে মাথা রেখে হার্টবিট শুনছে। বেশ ভালো লাগছে শুনতে। তাই চোখটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ এলার্ম বাজায় ইয়াশ লাফিয়ে উঠল আর পদ্ম নিচে পড়ে গেল। পড়ার সাথে সাথে ও বিছানার নিচে গড়িয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল। ইয়াশ ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বলল, এত সকালে কে এলার্ম দিয়েছে! পদ্ম বিছানার নিচ থেকে আস্তে আস্তে বলল, নয়টা পয়ত্রিশ বাজে! আর এর কাছে এত সকাল! বলেই মুখে হাত দিয়ে দিল।
ইয়াশ- কেউ যেন ছিল। মনে হল বুকটা হঠাৎ করে হালকা হয়ে গেছে। কি জানি। ধুর, কি সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। এলার্মটা ভাঙিয়ে দিল।
বলেই ইয়াশ আবার আরাম করে তার পছন্দের তুলতুলে বালিশটায় মাথা রাখল। পদ্ম আস্তে করে মাথা বের করে দেখল ইয়াশ আবার ঘুমিয়ে গেছে। এমন সময় ওর মাথায় শয়তানি বুদ্ধি চাপল। ও আবার নয়টা সাইত্রিশে এলার্ম সেট করে লুকিয়ে গেল। একটু পরে এলার্ম বেজে উঠলে ইয়াশ আবার লাফিয়ে উঠল। এলার্মটা বন্ধ করে বলল, কি হলটা কি ঘড়িটার! মাত্র চোখটা লেগে গিয়েছিল। কাঁচা ঘুমটাই ভাঙিয়ে দিল। আজকে ঘড়িটা নিজে নিজে এলার্ম বাজছে কেন!? এমন সময় দরজায় শব্দ হল। ইরিনা বাইরে থেকে ডাকছে। ইয়াশ বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলল।
ইয়াশ- কিরে আপু, তুই এ সময়ে।
ইরিনা- এ সময়ে মানে? কটা বাজে?
ইয়াশ- নয়টা সাইত্রিশ।
ইরিনা- যাক জানিস তাহলে। এত লেট হয়ে গেল। আর তুই এখনও বিছানায়।
ইয়াশ- হঠাৎ কি হয়েছে বল তো। তুই তো জানিস আমি এত দেরিতে উঠি।
ইরিনা- কি হবে। বাড়িতে মেহমান এসেছে আর বাড়ির ছেলে এখনও পড়ে পড়ে ঘুমাবে। খারাপ দেখায় না?
কথাটা বলেই হালকা উঁকি দিল ইয়াশের রুমে। পদ্ম বিছানার নিচ থেকে আস্তে করে বের হয়ে বারান্দার দরজার দিকে এগোচ্ছে। ইয়াশ ইরিনাকে লক্ষ্য করে বলল, কি দেখছিস? বলে পেছন ফিরতে গেলে ইরিনা দ্রুত বলল, কিছু না, কিছু না। আসলে আমার ইচ্ছে করছে আজকে আমার ভাইকে আমি সাজাবো।
ইয়াশ- সাজাবি? হঠাৎ?
ইরিনা- কেন পারি না। আমার এতো হ্যান্ডসাম ভাই।
হ্যান্ডসাম শব্দটা শুনে পদ্মের হাসি পেল। ও মুখে হাত দিয়ে নিঃশব্দে হাসতে হাসতে বারান্দার দরজা বন্ধ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইয়াশ বলল, যাক এতদিন পর তোর আমাকে হ্যান্ডসাম মনে হল। প্রত্যেকবার তো বানর বলে তাড়িয়ে দিস।
পদ্ম চলে গেছে দেখে ইরিনা নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, বানরই তো। সিক্স প্যাক ওয়ালা ভোটকা বানর। বলেই ইরিনা চলে গেল। ইয়াশ অবাক হয়ে বলল, যা বাবা, কি হল! ইয়াশ দরজা বন্ধ করে ভাবতে লাগল কি হচ্ছে। প্রথমে দুবার নিজে নিজে এলার্ম বাজল আর তারপর ইরিনা প্রথমে ওর সাথে ভালো ব্যবহার করে শেষে বানর বলে চলে গেল। ভাবতে ভাবতে বারান্দার দরজার কাছে চলে এল। হঠাৎ একটা জিনিসের উপর নজর পড়ল ওর। ইয়াশ জিনিসটা হাতে নিয়ে বলল, এটা কি!………এবার বুঝেছি।
.
.
.
.
পদ্ম, ইরিনা, ইনু আর রিনি রুমে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পদ্ম হাসতে হাসতে বলল, তুমিও পারো ইরিনা আপু। সিক্স প্যাক ওয়ালা ভোটকা বানর! বলেই আবার হাসতে লাগল ওরা।
ইরিনা- যা বলিস মিশনটা ভালো হয়নি। উঠেছে ঠিক। এখন আবার না ঘুমিয়ে পড়লেই হয়।
এমন সময় দরজায় কেউ নক করল। রিনি খুলে দেখল ইয়াশ ফ্রেশ হয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। রিনি ভেতরে কিছু বলার আগেই ইয়াশ বলল, কিরে ভেতরে ঢুকতে দিবি না নাকি?
কথাটা শুনে রিনি সরে দাঁড়াল। ইয়াশ ভেতরে ঢুকে দেখল তিনজন হাসছে। ওকে দেখেই ওদের হাসি থেমে গেল। ইনু হালকা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কিছু বলবি ভাইয়া?
ইয়াশ- হ্যাঁ, আসলে খুব ক্ষিধা পেয়েছে তো। তাই ইরিনা আপুকে ডাকতে এসেছি।
ইরিনা- আমরা খেয়ে ফেলেছি। তুই গিয়ে খেয়ে নে।
ইয়াশ- আমি কি খাবার জন্য ডেকেছি নাকি!
ইরিনা- তাহলে?
ইয়াশ- আমাকে খাবার বেড়ে দিতে ডেকেছি।
ইনু- ভাইয়া, তুমি নিজে নিয়ে খেতে জানো না?
ইয়াশ ইনুর কান মলে দিয়ে বলল, না জানি না, পাকা বুড়ি।
ইনু- আ… লাগছে, ছাড়। কতবার বলেছি আমাকে পাকা বুড়ি বলবে না। আমি এখন ক্লাস সেভেনে পড়ি।
ইয়াশ- ইস্। ক্লাস সেভেনে পড়ে কত বড় হয়ে গেছে।
ইরিনা- তোরা থামবি? চল তো আমার সাথে।
ইরিনা ইয়াশকে নিয়ে নিচে চলে গেল। সাথে সাথে পদ্ম, ইনু আর রিনিও নিচে চলে এল। ইয়াশ এটাই চাইছিল। তাই মনে মনে বলল, একজনকে আনতেই পুরো বিচ্ছু বাহিনী হাজির।
ইরিনা স্যান্ডুয়িচ বানিয়ে দিয়ে বলল, এটা খেয়ে নে। আমি জুসটা করে আনি। বলে ইরিনা রান্নাঘরে চলে গেল। এদিকে ইয়াশ রিনিকে বলল, রিনি, আমার রুম থেকে ফোনটা আনো তো।
রিনি- কোথায় আছে, ভাইয়া?
ইয়াশ- কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না। খুঁজে দেখো তো।
রিনি চলে গেলে ইয়াশ ইনুকে বলল, এই তোর পড়া নেই।
ইনু- আছে, তো?
উপর থেকে রিনি বলল, ভাইয়া পাচ্ছি না।
ইয়াশ- যা তো, ইনু। একটু খুঁজে দেখতো। একটা ইম্পটেন্ট কাজ আছে।
ইনু বিরক্ত হয়ে উপরে চলে গেল। ইরিনা ইয়াশের জুসটা এনে টেবিলে রেখে বলল, আজকে লন্ড্রীতে দেয়ার জন্য কাপড়গুলো আলাদা করে রাখিস।
ইয়াশ টেবিল থেকে জুসের গ্লাসটা নিয়ে উঠতে উঠতে বলল, আচ্ছা। গিয়ে পদ্মের সামনে দাঁড়াল। পদ্ম সোফায় বসে ম্যাগাজিন দেখছিল। ইয়াশ এসে দাঁড়ালে পদ্ম ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু বলবেন?
ইয়াশ- না।
পদ্ম আবার ম্যাগাজিনের দিকে মনোযোগ দিল। মনে মনে বলল, ফাজিলটাকে কেমন কেমন যেন লাগছে। কোনো গন্ডগোল………
হঠাৎ ইয়াশের হাত থেকে ওর গায়ে অনেকটা শরবত ওর মাথায় পড়ল। পদ্ম লাফ দিয়ে উঠে সরে গেল। ইরিনা টেবিলের প্লেটগুলো গুছিয়ে রাখছিল। পদ্মকে দেখে দৌঁড়ে এসে বলল, ভাই তোকে না কতবার বলেছি হেঁটে হেঁটে খাবার খাবি না। কি করেছিস! ইস্। মেয়েটার মাথা জামা সব ভিজেয়ে দিয়েছিস।
ইয়াশ- আমি কি ইচ্ছে করে ফেলেছি নাকি?
ইরিনা- যা, রুমে গিয়ে ড্রেস চেন্জ করে নে। আমি মিনা খালাকে জায়গাটা পরিষ্কার করতে বলছি।
পদ্মর চুল বেয়ে টপটপ করে লেবুর শরবত পড়ছে। ও ওড়না দিতে সব মুছে নিল যাতে পথে না পড়ে। তারপর উপরে গেল চেন্জ করতে। একটু পরে রিনি আর ইনু এসে ইরিনাকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া কোথায়?
ইরিনা- জানি না। একটু আগেই তো উপরে গেল। রুমে হয়তো। ওর ফোন পেয়েছিস?
ইনু- না। রুমে গেলে তো দেখতাম।
রিনি উপরে তাকিয়ে দেখল ইয়াশের রুমের দরজা বন্ধ। ও বলল, আমরা দরজা খুলে এসেছিলাম না? ভাইয়ার রুমের দরজা বন্ধ করল কে?
ইনু- ভাইয়াই হবে। কোন জায়গা দিয়ে যে গেল। দেখলাম না তো।
রিনি- আমাদের সামনে দিয়েই গেছে হয়ত। আমরা খেয়াল করিনি।
ইনু- তাই বলে দুজনই খেয়াল করিনি! ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত না?
তিনজনই কপাল কুঁচকে ইয়াশের রুমের দিকে তাকাল।
.
.
.
.
ইয়াশ রিনি আর ইনু বের হওয়ার অপেক্ষায় দরজার বাইরে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল। ওরা বের হতেই ইয়াশ রুমে ঢুকে আস্তে দরজা বন্ধ করে বারান্দায় চলে গেল। লাফিয়ে ইরিনার রুমের বারান্দায় চলে এল। বারান্দার দরজা খোলাই ছিল। রুমে ঢুকে দেখল পদ্ম মাত্র শাওয়ার দিয়ে বের হয়েছে। মাথার চুলগুলো টাওয়াল পেঁচিয়ে খোঁপা করা। সামনে যে চুলগুলো আছে তার কিছু লেপ্টে আছে আর কিছু থেকে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। পদ্ম আয়নার দিকে ফিরে নিজে নিজে বকবক করছে আর জামার চেইন আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে কিন্তু আটকাতে পারছে না।
পদ্ম- ধুর। কিছুতেই আটকাতে পারছি না। আসার সময় ইরিনা আপুকে আনা উচিত ছিল। এজন্য চেইনওয়ালা কোনো জামা পরতেই ভালো লাগে না। আর ঐ ফাজিলটা কি করেছে। শরবত ফেলার আর জায়গা পায়নি।
হঠাৎ মনে হল চেইনটা আপনা আপনি আটকে গেল। পদ্ম অবাক হয়ে আয়না তাকাতেই একটা চিৎকার দিতে লাগলে ইয়াশ পেছন থেকে মুখ চেপে ধরে বলল, আজকে আমাকে জাগানোর আইডিয়াটা কার ছিল?
পদ্ম চোখ বড় বড় করে আয়নায় ইয়াশের দিকে তাকিয়ে রইল। ইয়াশ হেসে বলল, বুঝতে পারছ না? দাঁড়াও বোঝাচ্ছি। ইয়াশ জিন্সের পকেট থেকে একটা নুপুর বের করে বলল, যদিও শব্দ করে না, কিন্তু কোনো কাজের প্রমান স্বরূপ খুব ভালোই কাজ করে।
পদ্ম ভালোভাবেই বুঝতে পারল সে ধরা পড়ে গেছে। তবুও শেষ চেষ্টা করল। ইয়াশের হাত মুখ থেকে সরিয়ে বলল, আমাকে এসব বলছেন কেন? এটা দিয়ে আমি কি করব? ইয়াশ রেগে ওকে টেনে নিয়ে দেয়ালে চেপে ধরে বলল, কি করবে বুঝতে পারছ না। আমার ঘড়িতে কে এলার্ম সেট করেছে? আপু, ইনু বা রিনি, কেউই নুপুর পরে না। এই বাড়িতে নুপুর পরলে একমাত্র তুমিই পরবে। আর আমাকে কেউ জ্বালালে আমি তাকে দ্বিগুণ জ্বালাই। এটা সবাই জানে। আজ তুমিও জানলে। আজকে তুমি আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়েছো তার শাস্তি তো তোমাকে পেতে হবে, মিস গেঁয়ো।
চলবে……