পবিত্র_সম্পর্ক পর্ব ৪ + শেষ

#পবিত্র_সম্পর্ক
#পর্ব_৪(শেষ)
#Nishat_Tasnim_Nishi

.

সময়গুলো স্রোতের গতিতে চলছে,পলক ফেলার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।রোহান আর রুহির সম্পর্ক ও একদম স্রোতের বেগে চলে যাচ্ছে।ওদের বিয়ের আজ পনেরো দিন চলছে,রুহি দিনদিন শুকিয়ে কেমন পাংশুটে হয়ে যাচ্ছে। একদম ভেঙ্গে পড়েছে,দিন দিন ওর শরীরের অবনতি হচ্ছে।সেদিনের পর থেকেই রুহি এমন চুপচাপ হয়ে গেছে। রুহির পরিবারের সবাই সেদিন এসেছিলো,রুহি স্বাভাবিকভাবেই উনাদের সাথে কথা বলেছিলো, রুহির ব্যবহার দেখে ওর পরিবার একদম চমকে গিয়েছিলো। উনারা এতটাও আশা করে নি,উনাদের ধারনা ছিলো রুহি হয়তো উনাদের সাথে রাগারাগি-চিল্লাচিল্লি করবে। কিন্তুু রুহি তার কিছুই করে নি, শুধু যাওয়ার সময় রেহানা বেগম অর্থাৎ রুহির মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিলো। রেহানা বেগম এত গভীর ভাবলেন না,উনার ধারনা শশুড়বাড়ী চলে এসেছে তাই হয়তো কাঁদছে,
মেয়ের কান্না দেখে নিজেও কেঁদে দিয়েছিলেন,যতই হোক আদরের মেয়ে বলে কথা। এরপর উনি মেয়েকে কিছুক্ষণ শান্তনা দিয়ে চলে গিয়েছেন। রুহি একদম দুষ্টমি কমিয়ে দিয়েছিলো,রাতে ঘুমানোর সময় নিজে চুপচাপ নিচে বিছানা করে শুয়ে পড়েছিলো। রোহান তো একদম অবাক হয়ে গিয়েছিলো,ও বিষয়টা এত গায়ে মাখে নি।ভাবলো ওকে ওর মতো থাকতে দেই। কালকেই হয়তো আবার বিছানায় এসে হামলা দিবে,কিন্তুু রোহানকে অবাক করে দিয়ে রুহি প্রতিদিন নিচেই বিছানা করে শুয়েছে। রুহি এখনো ঘোরের মধ্যে আছে,রিসাদ যে ওর সাথে এমন করবে ও তো ভাবতেই পারে নি।কি করে নি ও রিসাদের জন্য? রোহানও রুহির তেমন খবর নেই নি ও নিজের অফিসের কাজে প্রচুর বিজি, প্রজেক্ট টা শেষ করে দু সপ্তাহের মধ্যেই ওটা নিয়ে প্যারিসে যেতে হবে।
রোহান বিছানায় বসে ফোন চাপছে,তখন শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করলো রুহি।ও এসেই বালিশ নিয়ে নিচে রাখতেই রোহান গম্ভীর কন্ঠে বললো,,”বালিশ নিয়ে উপরে আসো।” রুহি রোহানের কথা কানে না তুলে নিচে বিছানা করতে লাগলো।রোহান আরো কয়েকবার উপরে আসার কথা বললো,,রুহি কোনো কথা না বলে চুপচাপ কাঁথা টেনে শুয়ে পড়লো। এটা দেখে রোহানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো,ও এসে দুই বাহু ধরে রুহিকে টেনে বসিয়ে জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে বললো,,”এতক্ষণ কী বলছি,কানে যাচ্ছে না?” রুহি রোহানের দিকে চোখ তুলে তাকালো, রোহান রুহির চোখে হাজারো অসহায়ত্বের চাপ দেখতে পেলো।এরপর ও নরম হয়ে বললো,,”আমি কী বলছি শুনতেছো না?” রুহি কাটকাট গলায় বললো,,”তো কী করবো?” রোহান জানে যে এই মেয়ে একদম ঘাড় ত্যাড়া, যা বলে তা করেই ছাড়ে। ও কিছু না বলে রুহিকে টেনে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো।রুহি উঠার জন্য জেদ করতেই রোহান রুহিকে পেঁচিয়ে শুয়ে পড়লো।রুহি বারবার চুটাচুটির চেষ্টা করতেই রোহান ওকে আরো জোরে চেপে ধরে। শেষপর্যন্ত রুহি ছুটতে না পেরে কেঁদে দেয়। রোহান ওর কান্নাকে পাত্তা না দিয়ে ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। রুহি সারাটা রাত রোহানকে জড়িয়ে ধরে ওর বুক কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিলো। রোহান শুধু একটা কথাই বলেছিলো,”যে তোমাকে কোনোদিন তোমায় ভালোইবাসে নি তার জন্য কাঁদা টা একদম ই উচিত নয়। যা হয় ভালোর জন্যই হয়,আরো পরে বিষয়টা জানলে আফসোস ও করতে পারতে না। তাছাড়া তুমি এখন বিবাহিত আমি চাই না তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভেবে কষ্ট পাও। তুমি যদি আমার সাথে সংসার করতে চাও আমি কথা দিচ্ছি অন্য কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকাবো না, শুধু তোমাকেই ভালোবাসবো আর তোমার সাথেই সংসার করবো।ভেবে চিন্তে সকালে আমাকে জবাব টা জানিও আর হ্যা এখন থেকে টোজ রাতে আমার সাথে এভাবেই ঘুমাবে।” বলেই রোহান ঘুমিয়ে পড়েছিলো আর রুহি পুরো রাত রোহানের বুক কেঁদে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিলো। ভোরের আলো চোখে পড়তেই রোহানের ঘুমটা ভেঙ্গে যায়,ও চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে রুহি একদম ওর বুকের সাথে বাচ্চার মতো গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে।ও সেটা দেখে মুচকি হাসলো,সাবধানে রুহিকে শুইয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো।এ কয়েকটা দিনে মেয়েটার প্রতি বেশ মায়া জন্মেছে রোহানের।কারনে-অকারনে ওকে জ্বালাতে রোহানের খুব ভালো লাগে।রুহিকে বিরক্ত হতে দেখলে কেনো যেনো রোহানের খুব ভালো লাগে। রুহি অনেকভেবে রোহানকে বলেছিলো ও কিছুটা সময় চায়। রোহান বলেছে যতটা সময় চাও নিয়ে নাও, তবে দিনশেষে আমি জবাব হ্যা শুনতে চাই। এভাবেই কেটে গেলো আরো এক সপ্তাহ, এরমধ্যে রুহি ওর মামাকে ফোন করে সব বলে ম্যানেজ করে নিয়েছে,রুহির মামা তো জেদ চেপে সেদিনই আসতে চেয়েছিলো কিন্তু রুহির কারনে আর আসা হয়ে উঠে নি। এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর আরো দুদিন কেটে যাওয়ার পর তিনদিনের দিন রোহান রুহিকে নিয়ে বারান্দায় আসলো। রোহানন রুহিকে এক পেপার কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললো,,”কাল আমি প্যারিস যাচ্ছি,আমার পুরো পরিবারও যাচ্ছে।নিশ্চই বিষয়টা তুমি জানো। উনারা তোমাকেও নিয়ে যেতে চাইছেন,আমি তো জানি তুমি যেতে চাইছো না। আমি চাইও না কোনো দায়বদ্ধতা নিয়ে তুমি আমার সাথে সংসার করো। দিনশেষে ততোমার জবাব হ্যা হোক সেদিন আমি কথাটা তোমাকে শক্ত হওয়ার জন্য বলেছিলাম। তুমি কিছুটা শক্তও হয়েছো,তুমি যথেষ্ট এডাল্ট তাই তোমার ভালো-মন্দ বুঝার বয়স হয়েছে। তাই ভেবে চিন্তে ডিসিশন নিও,ভালো থেকো!আজকেই হয়তো শেষ দেখা।রাতে তোমাকে বাড়ী পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থ করে দিবো।”
রোহানের কথা শেষ হতেই রুহি বললো,,”কাগজ টা তে কী?” রোহান গড়গড় করে বললো,,”ডিবোর্স পেপার। ” রুহি পেপারটাকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে বললো,,”আমি কী বলেছি যে আমি থাকতে চাই না বা যেতে চাই না। আমি দায়বদ্ধতা নিয়ে সংসার করছি সেটা আপনাকে কে বললো?সবকিছুতে এত বেশি বুঝেন কেনো?” রোহান হাসে,হেসে হেসেই বললো,,”দরকার নেই,সমাজের কথা আর পরিবারের কথা ভেবে দায়িত্বের সংসার করার।আমি রিসাদের সাথে কথা বলেছি,ও নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত এবং কথা দিয়েছে এরপর আর কোনো দিন কারো সাথে কথা বলবে না। শুধু আপনি ওর সাথে থাকলেই হবে,সবাই লাইফে ভুল করে, রিসাদও করেছে এবং তার ক্ষমাও তো চেয়েছে,ওকে ক্ষমা করে দেও।আমি জানি তুমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবে না,তুমিও তো ওকে চাও।” হঠাৎ রুহি রোহানকে জড়িয়ে ধরে বললো,,”আমি আপনার সাথে থাকতে চাই।আমি অন্য কারো সাথে থাকবো না।” রোহান কিছুটা অবাক হয়,গম্ভীর কন্ঠে বললো,,”কিন্তু যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই সেটা কীভাবে টিকবে?আমি তো তোমাকে ভালোইবাসি না।”

—“তাই?”

–“হুম”

–“আপনার ফোনের পাসওয়ার্ড কী?” রুহির প্রশ্নে রেহান কিছুটা ইতস্তবোধ করে,ও বারবার প্রশ্ন টা এড়িয়ে যেতে লাগলো। রোহান বলছে না দেখে রুহি গিয়ে রোহানের ফোন নিয়ে এসে ওর সামনে নিজের নাম দিতেই খুলে যায়। রুহি ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো কী? রোহান এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললো,,”তোমার নাম দিয়েছি যাতে মনে থাকে।আসলে তুমি এমন একটা মানুষ যাকে ভুলার মতো নয় তাই দিয়েছি।” রুহি এরপর গিয়ে সুকেচের ড্রয়ার খুলে একটা আর্ট খাতা বের করে এনে রুহির ইস্কেচ রোহানের সামনে দেখিয়ে বলে “তাহলে এটা কী?” এ চিত্র টা রোহান এঁকেছিলো যখন রুহি ঘুমিয়ে ছিলো, ছবির পাশে ছোট্ট করে লিখা আমার বউ। রোহান এটা দেখে একদম হকচকিয়ে যায়,আমতা আমতা করে কিছু বলার আগে রুহি রোহানকে থামিয়ে দিয়ে বলে ইশির কাছে যা বলেছিলেন সেটাও শুনেছি। এবার রোহান একদম চুপ করে চোরের মতো তাকালো। কারন ইশির কাছে রোহান বলেছে যে ও রুহির প্রেমে পড়েছে। রোহান মুখটা মলিন করে বলে,,”কিন্তুু তুমি তো ভালোবাসো না।” রুহি কিছুক্ষন চুপ করে রইলো,গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোহানকে বললো,,” আমি না হয় সংসার করবো ‘পবিত্র সম্পর্কের’ টানে।আমরা কোনো জিএফ-বিএফ নই যে যখন ইচ্ছা রিলেশন করবো যখন ইচ্ছা ব্রেকআপ করবো।আপনাকে ভালোবাসি কি না জানি না।তবে আপনার প্রতি আলাদা অনুভূতি অনুভব করি,আপনার প্রতি আমার মনের কোনে মায়া জন্মেছে,কিছুদিন পর হয়তো ভালোবাসাও জন্মাবে।আমি আপনাকে চাই,আপনার সাথে থাকতে চাই,সংসার করতে চাই ফিরিয়ে দিয়েন না আমাকে।” সেদিন রোহান আর কোনো কথা বলে নি, গভীরভাবে রুহিকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে নিয়েছিলো। পরের দিনের ফ্লাইটেই ওরা সবাই প্যারিসে চলে যায়, যাওয়ার সময় রুহি অনেক কেঁদেছিলো।রিসাদ অনেকবার ক্ষমা চেয়েছিলো কিন্তু রুহি আর ওর দিকে তাকায় নি চলে যায় রোহানের হাত ধরে অজানা-অচিনা দেশে।

প্যারিস যাওয়ার পর মাসের পর মাস কেটে গিয়েছে।রুহি আর রোহান দুজনেই একই অফিসে চাকরী করে,চাকরিতেও রোহানের জেদের কাছে হার মেনে রুহি জয়েন করেছিলো।না হলে ওর তো একদম ইচ্ছাই ছিলো না চাকরি-বাকরি করার। রোহান তো রুহিকে প্যারিসের সব বিখ্যাতজজায়গাগুলো ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে।প্রতিদিন দুজনে একসাথেই অফিসে যায় আর একসাথেই অফিস থেকে ফিরে আসে।
বাসায় এসে শাশুড়ির সাথে কিছুক্ষন আড্ডা দেয়,মাঝে মাঝে বাড়ীতে ফোন দিয়ে খোজ খবর ও নেয়। দুজনের বিয়ের ছয় মাস হতে চললো কাল,আর এজন্য দুজনেই মনে মনে আলাদা আলাদ সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করলো। বাড়ী থেকে দু কিলোমিটার দূর একটা পার্ক রয়েছে,সেটাই ভাড়া করেছে রোহান। পুরো পার্ক একদম সাজিয়ে রুহিকে নিয়ে এসেছে। রুহি তো এত আয়োজন দেখে অবাক,রোহানের সাথে পুরো রাত সেখানেই কাটিয়েছে আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে। মধ্য রাতেই হুট করে রুহি বললো,,”আমি বেবী চাই।” রোহান কাটকাট গলায় বললো,,”সময় হলে এমনিতেই বেবী নিবো।” এরপর আর রুহি কোনো কথা বলে নি চুপচাপ রোহানের বুকে মাথা গুজে শুয়ে রইলো।

চারবছর পর দেশের মাটিতে পা রাখলো রোহান,রুহি আর সাথে তাদের ছয়মাসের সন্তান ‘আফরাহিম ফায়াত’। বাচ্চাটা দেখতে একদম রোহানের মতো। রাতে যখন রুহি আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল চিরুনি দিয়ে আছড়াচ্ছিলে তখন রোহান ঢং করে বললো,,”দিনদিন দেখি তোমার রুপ বেড়ে যাচ্ছে। বয়স হলে মেয়েদের রুপ কমে,বয়স্কের ছাপ পড়ে অথচ তোমার বেলা দেখি উল্টো। দিনদিন আরো নায়িকার মতো হয়ে যাচ্ছো।”
রুহি হাসলো সাথে সাথে ওর গালে টোল পড়লো আর রোহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।রুহি চিরুনি দিয়ে রোহানের গায়ে আলতো স্পর্শ করে বললো,,”কী এভাবে কু নজর দিচ্ছেন কেনে আমাকে?” রোহান হেসে দেয়। রুহিকে পিছন থেকে কোলে নিয়ে নিলো।রুহি ব্যস্ত হয়ে বললো,”আরে কী করছেন, পড়ে যাবো তো।”
“পড়বে না”বলে রোহান রুহিকে নিয়ে বারান্দায় বসলো। ব্যালকনির পর্দা টা সরিয়ে রুহিকে বললো,,”দেখো পূর্নিমা রাতের চাঁদের থেকেও তোমাকে সুন্দর লাগছে। তুমি আকাশের ওই চাঁদ দেখো আর আমি জমিনের এই চাঁদ দেখবো।” রুহি ঘাড় ঘুরিয়ে রোহানের দিকে তাকায়। ভাবছে রোহান কী পাগল হয়ে গিয়েছে?কী বলছে এসব আবোল-তাবোল। রুহি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রোহান ওকে ধরে বসিয়ে দিয়ে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। রুহিকে জড়িয়ে ধরে বললো,,”নড়ো না, আমি ঘুমাবো। কালকে সারাদিন আর আসতে পারবো না, প্রজেক্টের কাজে ওখানেই থাকতে হবে,আমি একটু শান্তিতে ঘুমাতে চায়।” রুহিও আর উঠলো না, দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে রোহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।রুহি মাঝে মাঝে ভারী অবাক হয় এটা ভেবে যে এত দিন হওয়ার পরেও লোকটা কেনো রুহিকে বলতে বলে না ভালোবাসার কথা। রুহি রোহানের কপালে আলতো চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,,”ভালোবাসি।”

সমাপ্ত!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here