পরিত্রাণ পর্ব ১

#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১

ইউসুফ চৌধুরীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিধ্বস্ত, ভগ্ন দশা চেহারায়! বাম হাতের কড়ে আঙ্গুল দিয়ে কপালের ডানদিকের শিরা চেপে ধরে ঘাড় নিচু করে বসে আছেন তিনি। আজকে তাঁর একমাত্র ছেলে অনিক চৌধুরীর বিয়ে। এই বিয়ে উপলক্ষে কম করে হলেও এককোটি টাকা খরচ করেছেন তিনি। মেয়েকে গয়না দিয়েছেন পঞ্চাশ ভরি। শহরের সবচেয়ে নামীদামী হোটেল বুক করেছেন। কিন্তু মিনিট দশেক আগে খবর পেয়েছেন বিয়ের আসর থেকে বর মানে তাঁর অনিক উধাও। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর আগেও দুবার এমন হয়েছে। তবে এবারের পাত্রীটি মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরি। ইউসুফ চৌধুরীর র ধারণা ছিলো এবার অন্তত ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে। কিন্তু নাহ! অনিক আবারো তাঁকে ভুল প্রমাণ করে দিলো। বিগত দুইবারের মত এবারেও বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে সে। বিয়ে বাড়িতে ইতোমধ্যে দুপক্ষের মাঝে ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে। আগের দুবার তিনি টাকা পয়সা খরচ করে ঝামেলা মিটিয়ে ছিলেন। কিন্তু এবারের সম্বন্ধটা আলাদা। পাত্রী তার ছোটবেলার বন্ধু জনাব আসিফ ইকবাল এর মেয়ে। আসিফ ইকবাল এতকাল যাবত সপরিবারে আমেরিকাতে ছিলেন। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যেই দেশে ফিরেছেন। মেয়েটিকে ইউসুফ চৌধুরীর খুবই পছন্দ হয়েছিলো তাই স্থান, কাল, পাত্র সব ভুলে গিয়ে তাঁকে নিজের বাউণ্ডুলে, ছন্নছাড়া, মদ্যপ ছেলের বউ করার জন্য মরিয়া হয়ে গেছিলেন তিনি।

আব্দুর রহিম হাঁপাতে হাঁপাতে ইউসুফ চৌধুরীর নিকটে এসে দাঁড়ালো। মনিবের মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে সহানুভূতিশীল কন্ঠে বলল,”অনিক বাবাজির খোঁজ পেয়েছি হুজুর। আমি আর রাজু যাচ্ছি তাকে নিয়ে আসার জন্য!”

আব্দুর রহিম ইউসুফ চৌধুরীর বিশ্বস্ত কর্মচারী। রাজু তার ছেলে। রাজুর দুবছর বয়স থেকে আব্দুর রহিম সস্ত্রীক এই বাড়িতে বসবাস করছে। সেই থেকে পারিবারিক, ব্যবসায়িক সকল সমস্যার সমাধানের জন্য ইউসুফ সাহেবের এই কর্মচারীটি এক পায়ে খাড়া! ইউসুফ সাহেব চোখ বন্ধ করে আব্দুর রহিমের ওপর বিশ্বাস করতে পারেন। অনিক-কে ছোটবেলা থেকে রহিম এবং তাঁর স্ত্রীই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন।
যাওয়ার সময় আব্দুর রহিম সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে একবার মনিবের দিকে চাইলো। ইউসুফ সাহেবের মুখটা দুবছর বয়সী ছোট্ট শিশুদের মত দেখাচ্ছে। ইতর ছেলের জন্য মানুষটাকে বারবার বিনাদোষে অপদস্থ হতে হয়। তার নিজের ছেলে হলে সে গলায় পাড়া দিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতো। এমন নালায়েক ছেলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।

অনিকের অবস্থা ঢুলুঢুলু। মদ খেয়ে টাল হয়ে গেছে। ঘড়িতে এখন বাজে রাত বারোটা। ধানমন্ডির একটা ক্লাবে মদ খেয়ে বন্ধুদের সাথে হল্লাবাজি করছিলো। সেখান থেকে আব্দুর রহিম আর রাজু মিলে টেনে গাড়িতে তুলে। সেখানেও বিচ্ছিরি কান্ড! গালাগাল দিয়ে একঅবস্থা করেছে অনিক। শেষমেশ তার গলায় হাত ঢুকিয়ে জোরপূর্বক বমি করানো হলো। তারপর প্রায় টেনে হিঁচড়ে বিয়ের আসরে নিয়ে আসা হলো।

ইউসুফ চৌধুরী মনে মনে প্রার্থনা করছিলেন অন্তত কবুল বলা পর্যন্ত অনিক যেন শান্ত থাকে। এখন যদি যদি কোনকারনে অনিক চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয় তাহলে আরেক কেলেঙ্কারি ঘটবে। মেয়েপক্ষকে জানানো হয়েছে ছেলের বন্ধু অ্যাক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি, বন্ধুর অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে তার সাথে দেখা করতে গেছিলো অনিক।

অবশেষে রাত ১:২৫ মিনিটে অনিকের সাথে পারিবারিক ভাবে রুমুর বিয়েটা হয়ে গেলো। গোলমাল দেখে মেহমানরা সবাই অনেক আগেই চলে গেছে। বিয়ের আসরে একেবারে শান্ত ছেলের মত চুপচাপ বসে ছিলো অনিক। কোন রকম গন্ডোগল করে নি। তবে বউ নিয়ে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত থাকতে পারলেন না ইউসুফ সাহেব। অনিকের বিশ্বাস নেই। যে কোন মুহূর্তে বেঁকে বসতে পারে। তাই বিয়ে থেকে শুরু করে বাসায় ফিরে বউকে বরণ করা পর্যন্ত সব তিনি নিজে দাঁড়িয়ে সমাধা করলেন। আর বর মহাশয় বউকে গেটে রেখেই গটগট করে ভেতরে ঢুকে গেলো।


অনিকের ফুপাতো বোন সাথী রুমুকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলো। ডুপ্লেক্স বাড়িটার সবগুলো কামরাই আলিশান। তবে বহির্মুখী শোভা বেশ দৃষ্টিনন্দন! সামনে বিশাল লনে টেনিস কোর্ট। সুইমিং পুল। একপাশে অতি যত্নে গড়ে তোলা বাহারি ফুলের বাগান। রুমু নিজের ঘরের চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে দেখলো। চোখ ধাঁধানো দামী আসবাবপত্র! খাটের পেছনে পুরো দেওয়াল জুড়ে অনিকের একটা ছবি টাঙ্গানো। হাসিতে ঝলমল করছে সারা মুখ। অনিক নিঃসন্দেহে সুদর্শন। রুমু কিছুক্ষন একদৃষ্টে ছবিটার দিকে চেয়ে রইলো। তারপর লাগেজ থেকে জামা বের করে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকলো।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক চোখ বোলালো সে। অনিক এখনো আসে নি। এত দেরী করছে কেন সে? হাতের টাওয়েলটা বারান্দায় ঝোলানোর জন্য বারান্দার দরজা খুলতেই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো রুমুর! অনিক হাত পা ছড়িয়ে বারান্দায় বসে মদ খাচ্ছে। চোখজোড়া ভয়ানক লাল! মাতালের দৃষ্টি। ঘৃনায় সারা শরীর রিরি করে উঠলো রুমুর। স্বপ্নের পৃথিবীটা একমুহূর্তেই তছনছ হয়ে গেলো। বাবা তার সাথে এ কি করলেন? সারাজীবন বিদেশে রেখে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে শেষে কি না একটা মাতালের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিলেন? যার কিনা বিয়ের দিনটাতে পর্যন্ত মদ গিলতে হয়!

-‘কি চাই?’

শক্ত পুরুষালী ধাঁচের কন্ঠস্বর। রুমুকে উদ্দেশ্য করে কথাটা জিজ্ঞেস করলো অনিক। জবাব দিলো না রুমু। ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। বারান্দার দরজা আবার আগের মত টেনে দিয়ে খাটে গিয়ে বসলো। নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো সে

ছেলেবেলা থেকেই রুমু প্রচন্ড সুন্দরী। বুঝজ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে এসেছে ছেলেরা তার পেছনে মৌমাছির মত ঘুরঘুর করে এসেছে। চাইলে একটা কেন হাজারটা প্রেম করতে পারতো। কিন্তু বিদেশে বড় হলেও বাবা মায়ের কাছ থেকে সুশিক্ষাই পেয়েছে সে। তাই আমেরিকাতে বড় হলেও তাদের ওয়েস্টার্ন কালচারে নিজেকে জড়াতে পারে নি। নিজের দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি বাধা হয়ে দাড়িয়েছিলো। আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মতন বাবার মায়ের ওপর ভরসা করেছিলো। কিন্তু একি হলো তার সাথে? ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সে। বারান্দার দরজা ঠেলে অনিক ভেতরে ঢুকলো। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এদিক ওদিক টলছে। হোঁচট খেয়ে রুমুর পায়ের কাছে এসে পড়লো। রুমু রাগে ধরলো না। তাঁর ডিসিশন নেওয়া হয়ে গেছে অনিকের সাথে সে সংসার করবে না। সকাল হলেই বাড়ি ফিরে যাবে। বাবাকে জিজ্ঞেস করবে কেন তিনি তার সাথে এমন করলেন।

পাঁচসাত মিনিট বাদে চমকে উঠলো রুমু। অনিক হাত পা ছড়িয়ে মেঝেতেই পড়ে আছে! খাট থেকে নেমে এলো রুমু। হাত দিয়ে হালকা ঝাঁকি দিলো অনিককে। কোন নড়চড় নেই। মরে টরে গেছে নাকি?

-‘এই যে?…এই?’

-‘হুঁ?’

রাগে দাঁত খিঁচে ফেললো রুমু। অনিকের মুখ থেকে অ্যালকোহলের বিশ্রী গন্ধ আসছে। ঘৃণায় সরে গেলো সে। আধশোয়া হয়ে খাটে বসে রইলো।

সূর্যের আলো ফুটতেই রুমুর ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ খুলে ফ্যালফ্যাল করে আশেপাশে চারদিক তাকিয়ে দেখলো। কালরাতের কথা মনে পড়তেই রাগে সমস্ত শরীর জ্বালাপোড়া দিয়ে উঠলো। বিছানা ছেড়ে নামতে গিয়ে নরম কিছুর ওপর পা পড়লো। অনিকের হাতের তালু মাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। অনিক মেঝেতে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। গায়ে বিয়ের শেরওয়ানী। এমন কদর্য অবস্থাতেও খুব সুন্দর লাগছে নিকৃষ্টটাকে। না চাইতেও মুগ্ধ হলো রুমু। সাবধানে পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুম ঢুকে গেলো। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। বাসাভর্তি মেহমান। ড্রয়িংরুমে তার শ্বশুর মহাশয় সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন। রাগে, ক্ষোভে মুখ ফিরিয়ে নিলো রুমু। ইনি নিশ্চই তার ছেলের কুকর্মের কথা আগে থেকেই জানতেন? ইচ্ছে করেই বাবাকে কিছু জানায় নি? বাবা জানলে কখনোই এমন কুলাঙ্গার ছেলের সাথে রুমুর বিয়ে দিতো না।

সাথী এসে রুমুর হাত ধরে টেনে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে গেলো। ভেতরে রুমুর ফুপু শ্বাশুড়ি তহুরা বানু রান্না করছেন। রুমুকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,’ উঠে গেছো বউমা? অনিক উঠে নি?’

-‘না।’

দায়সারা ভাবে জবাব দিলো রুমু। তহুরা বানু রুমুর মনের অবস্থা খানিকটা আন্দাজ করতে পেরে কথা বাড়ালেন না। সাথীকে ইশারা করলেন রুমুকে নাশতার টেবিলে নিয়ে যেতে। মায়ের নির্দেশমত সাথী ওকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে দিয়ে গেলো। আফসোসের নিশ্বাস ফেললেন তহুরা বানু। অনিককে তার চেনা আছে। হাড়বজ্জাত এই ছেলে! রুমুর অবস্থা ভেবে দুঃখবোধ করলেন তিনি। এমন সুন্দর একটা মেয়ের কপালে এমন ইতর জুটবে কে জানতো?


সকালের নাশতা সেরে ইউসুফ সাহেব অফিসের জন্য বেরোচ্ছিলেন। রুমু দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করলো,” বাবা আসবো?”

-‘এসো মা।’

পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো রুমু। ইউসুফ সাহেব টাইয়ের নট বাঁধছেন। রুমু চারদিকে চোখ বোলালো। এই ঘরটি বাড়ির অন্যান্য ঘরের তুলনায় খুবই ছিমছাম। পুরো কামরায় একখানা খাট, একটা ছোট আলমারি, একটা ড্রেসিংটেবিল আর একটা পড়ার টেবিল। এই ছাড়া বিদেশী কোন শো-পিস, জঁমকালো পর্দা, টিভি, সোফাসেট কিছুই নেই।ইউসুফ সাহেব হাসিমুখে বললেন,

-‘দাঁড়িয়ে আসছো কেন বউমা? বসো।’

বসার মত কিছু খুঁজে পেলো না রুমু। খাটে বসতে অস্বস্তি হচ্ছে। অগত্যা দাঁড়িয়ে রইলো।

-‘আমি বসবো না। আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে বাবা।’

আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো ইউসুফ সাহেবের মুখ। পলকহীনভাবে রুমুর সুন্দর মুখখানার দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। রুমুর অস্বস্তি হচ্ছে। মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে মেঝে খুঁটছে শুরু করলো। ইউসুফ সাহেব ম্লান হেসে বললেন,’ঠিক আছে মা। আমি রাতে ফিরে তোমার সাথে কথা বলবো, কেমন?’

আরো একটা দিন এইবাড়িতে থাকার কোন ইচ্ছে রুমুর নেই। মরিয়ে হয়ে বললো,’আমি বাসায় যেতে চাই বাবা।”

ইউসুফ সাহেব মনে মনে এই আশংকাই করছিলেন। তাই কৌশলে রাতের কথা বলে এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু রুমুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি যেতে পারলে বাঁচে। ইউসুফ সাহেব দুঃখ পেলেন। রুমুর প্রতি কোনরূপ রাগ কিংবা ক্ষোভ হলো না। বরঞ্চ তার নিজের অপরাধ বোধ হলো। ঝোঁকের বশে মেয়েটার এতবড় সর্বনাশ করা তার উচিৎ হয় নি। নিজের স্বার্থের জন্য একটা ফুলের মত মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যা হয়ে গেছে তাকে তো আর বদলানো যাবে না। মিষ্টি হেসে বললেন,’যাবে মা, নিশ্চই যাবে। আমি নিয়ে যাবো তোমাকে। কিন্তু তার আগে আমার যে তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে। আমাকে একটা দিন সময় দিতে পারবে না, মা?’

বাধ্য হয়ে রুমু হ্যাঁ বললো যদিও ইউসুফ সাহেবের কথা শোনার কোন ইচ্ছে তাঁর ছিলো না। এই লোক তাঁদের সাথে প্রতারণা করেছেন। এনাকে সে কোনভাবেই মাফ করবে না। ইউসুফ সাহেব বিষণ্ণ মুখে নাশতা না করেই বেরিয়ে গেলেন। রুমু সারাদিন ড্রয়িংরুমে তারফেরার প্রহর গুনলো।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here