পাগলী বউ
অন্তরা
সিরিয়াস মুহূর্তে হেসে দেয়ার মারাত্মক বদ অভ্যাস আছে আমার বউয়ের। আর ঠিক এ কারণেই খুব করে বকেছিলাম ওকে সেদিন।
এ জন্যই কি না জানিনা, আমার বউয়ের মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন দেখা দেয়। এই যেমন, পূর্বের ন্যায় ও আর বেশী কথা বলে না, আগের মতো হাসে না, হাসতে হাসতে কারো উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে না, অকারণে আমার বোনের শরীরে চিমটি কেটে দাগ বানিয়ে ফেলে না, আমার ছোট ভাইয়ার শরীরেও আর পানি ছুঁড়ে মারার ভুল করে না।
এরকম অনেককিছুই ও আর করে না। চশমা চোখে পড়তে বসলে এখন আর ও সেটা খুলে নিয়ে নিজের চোখে পরে দৌঁড় দেয় না।
আজকাল কোন কাজেই ওর আর ভুল হয় না। নির্ধারিত সময়ের আগে নির্ভুল এবং নিখুঁতভাবে সমস্ত কাজ শেষ করে ছোট ছোট বাচ্চাদের কুরআন পড়াতে শুরু করে।
অথচ ক’দিন আগেও ভিষণ রকম ভুল করতো ‘ও’। এইতো সেদিন ইস্ত্রি করতে গিয়ে বাজার থেকে আমার সদ্য কিনে আনা শার্ট টা পুড়িয়ে ফেলে। শুধু পুড়িয়েছে বললে ভুল হবে। শার্টের বারোটা বাজিয়ে দেয়৷ তারপর সে শার্ট গায়ে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়ায়।
রান্না করতে গিয়ে প্রতিদিন একটা না একটা অঘটন ঘটাতোই। কখনো ওড়না পোড়া কখনো বা হাত পোড়া। দুর্ঘটনার ভয়ে আমার মা তাই ওকে রান্নাঘরে দিতে চাইতো না৷ দিলেও সর্বক্ষণ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে সমস্ত কাজ দেখিয়ে দিতো।
সেবার মামার অসুস্থতার কথা শুনে আমার মা আর বোন মামাকে দেখতে চলে যায় মামাবাড়িতে।
সেদিনই প্রথম শুরু থেকে শেষ অবধি রান্নার সমস্ত কাজ ‘ও’ নিজ দায়িত্বে করেছিলো। রান্না শেষে আমাকে যখন খাবার টেবিলে ডাকে তখন ওর অবস্থা টা ছিলো দেখার মতোই। রান্নার মধ্যিখানে গ্যাস ফুরিয়ে গিয়েছিল যার দরুন লাবণ্যকে মাটির চুলোয় রান্না করতে হয়। চুলার কালিতে ওর চোখ মুখ একাকার। পুড়ে গেছে ওড়নার একাংশ। কেটে গেছে হাত৷ যদিও সেটা আমার থেকে লুকিয়ে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালায়। কিন্তু তা আমার নজর এড়ায় না।
উচ্চতায় আমার থেকে অনেক অনেক খাটো ‘ও’। গ্রামে সাধারণত ভেঁজা কাপড় মেলে দেয়ার জন্য দড়ি, তার কিংবা বাঁশ বেধে দেয়া হয় উপরে। আমাদের বাড়িতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উঠোনের মাঝ বরাবর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বেধে দেয়া হয় বৈদ্যুতিক তারের অতিরিক্ত অংশ।
‘ও’ ভিষণ খাটো তো তাই কাপড় মেলে দেয়ার সময় অসুবিধাটা ওর হতো বেশী। গোসল শেষে কাপড় নিয়ে এসে বাচ্চাদের ন্যায় খুব করে লাফাতো সেটা তারে মেলে দেয়ার জন্য। সে এক আপ্রাণ চেষ্টা। কখনো সফল হতো কখনো বা তার ধরতে গিয়ে সেটা ছিড়ে নিচে নিয়ে আসতো।
উঠোনে বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করতো রোজ নিয়ম করে। কানামাছি, কুতকুত, লুকোচুরি, রশি ঘুরানো, নুয়ে থাকা বাচ্চার উপর দিয়ে লাফিয়ে অন্য প্রান্তে গিয়ে পড়া, দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে চক্রাকারে ঘুরতে থাকা কখনো বা ঘুরতে ঘুরতে মাথা ঘুরে পরে যাওয়া। সবই হতো।
ছোট ছোট অজস্র মধুর ভুলে ভরা ছিল লাবণ্য’র কাজগুলো। কিছু ভুল অজান্তেই করতো আবার কিছু ভুল হতো স্বইচ্ছায়। বাবা মা ও তেমন কিছুই বলতো না আমার বউকে। আদর করতো ছোট বাচ্চাদের ন্যায়৷ মা তো মাঝে মাঝে পুত্রবধূকে কোলে বসে খাইয়ে দিতো। গোসল করিয়ে দিতো, চুলে তেল দিয়ে বেনি করে দিতো। এইতো! এভাবেই বেশ চলছিল আমার সুখের জীবন।
কিন্তু হঠাৎ করে লাবণ্যর আমূল পরিবর্তন আমার সমস্ত সুখকে তছনছ করে দিলো। ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। ভালো লাগতো না বর্তমানের পরিণত লাবণ্যকে। মিস করতাম আমার আগের সেই পিচ্চি পুতুলবউটি কে।
দিনকে দিন অদ্ভুত যান্ত্রিক হয়ে যায় লাবণ্য। সাংসারিক সমস্ত কাজ সেরে কেবল রাতের বেলায় লাবণ্য আমার কাছে আসতো এবং সেটা আমার শারীরিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য। আমরা কেমন যেন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ি!
লাবণ্যর হঠাৎ বদলে যাওয়া আমার মনে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ধীরে ধীরে আমি মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। কর্মস্থলে নানান ভুল হতে থাকে। সিনিয়র স্যাররা যে ভুল কখনো আমার থেকে আশা করতো না সেগুলোই হতে লাগলো। একদিন স্বয়ং প্রধান শিক্ষক আমায় নিভৃতে ডেকে নেন। জানতে চান শ্রেণীকক্ষে আমার এ উদাসীনতার কারণ।
স্কুল থেকে একমাসের ছুটি নিলাম। লাবণ্যকে নিয়ে ঘুরে আসলাম কক্সবাজার থেকে। কিন্তু নাহ! কোন উন্নতি হয়নি।
ব্যাপারটা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আতিকের সাথে শেয়ার করি।
আতিক রেগে যায়। জানান দেয়, তোর ওনার সাথে এরকম করা ঠিক হয়নি।
কিন্তু আতিক! আমি তো ওকে সেদিন রাতে স্যরি বলেছিলাম। ও তো হাসি মুখে আমার সে স্যরি একসেপ্টও করে নিয়েছিলো!
আতিক হাসে৷ বলতে শুরু করে, আরে ব্যাটা! মেয়েদের এ আরেক বৈশিষ্ট্য। ভেতরে ভেতরে ভেঙে চূড়মাড় হয়ে যাবে কিন্তু বুঝতে দেবে না কাউকে। ঠোঁটের কোণে চিরাচরিত নিয়মে হাসি টা ঝুলে থাকবে সর্বক্ষণ। সাংসারিক নানান কাজ সামলানোর পাশাপাশি এটাও যেন তার দায়িত্ব।
আতিক! জানিস, সেদিন আমি বাবার সাথে কথা বলছিলাম। বাবার জটিল একটা রোগ হয়েছে আর তারই ব্যাপারে। তারই মধ্যে কাকিমা বায়ু ছাড়ে। আমরা সেটা শুনেও না শুনার ভান করলাম। কিন্তু ও কি করলো। ফিক করে হেসে….
আমাকে থামিয়ে দেয় আতিক। এনাফ! তুই শুধু ভাবিকে এই একটা কারণেই বকা দিসনি। তুই বকার পাশাপাশি সেদিন তুলে ধরেছিস ওনার ছোট খাটো ভুলগুলো। তিরস্কার করেছিস ভিষণ। ধমক দিয়েছিস ওনার বাচ্চামীর জন্য। সংসারের উদাসীনতার জন্য। আর সে কারণেই ওনি বদলে নিয়েছেন নিজেকে। কষ্ট যে পায়নি, তা কিন্তু নয়!কষ্ট পেয়েছে কিন্তু বুঝতে দেয়নি।
সে রাতে একটু দেরী করে বাড়ি ফিরলাম৷ লাবণ্য তখন খাটে বসে পাশে রাখা মেশিনের ওপর মাথা রেখে শুয়েছিলো। তার ঠিক অপর প্রান্তেই ঢেকে রাখা ভাতের প্লেট।
ডাকতে হয়নি আমাকে আর। আমার শব্দে মাথা তুলে তাকায় সে।
সুকেসের ওপর চশমাটা খুলে রেখে লাইট টা অফ করে শুয়ে পড়ি নিচে ফ্লোরে। খাবারের কথা বলতেই জানায় দিই, ‘মাথাটা ব্যথা করছে। প্যাচাল না পেরে শুয়ে পড়ো।’ কথা বাড়ায়নি লাবণ্য আর।
মাঝরাতে নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়াই ফ্লোর থেকে। ওর অবস্থান জানতে টর্চ জ্বেলে বিছানার কাছে যাই৷ মেশিনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে আমার বউ।
লাইট টা জ্বালিয়ে ওর কাছে গেলাম। আমার বউয়ের ছোট মুখটা যেন আরো ছোট হয়ে গেছে এ কয়দিনে।
জানিনা, কেন সেদিন চোখ থেকে দু’ফোটা জল নিচে গড়িয়ে পড়েছিলো!
ধীর গলায় ডাকলাম, লাবণ্য…
এক ডাকেই মেশিন ছেড়ে ওঠে বসে লাবণ্য। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকায় আমার দিকে।
আমার চোখে জল দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। প্রশ্ন করে, আপনি কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে আপনার?
জবাব দিতে পারিনি। তার আগেই ছুটতে থাকে ব্যথার ঔষধ আনার জন্য।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসে। আমার হাতে এগিয়ে দেয় ঔষধ ভর্তি বক্স। নিচ থেকে পানির জগটা ওপরে তুলতে তুলতে জানায়, খেয়ে নিন! না হলে মাথা ব্যথা আরো বাড়বে। খেয়ে ব্যথা নাশক ঔষধটা খেয়ে নিন।
একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে পূর্বস্থানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ওর ব্যাকুলতা আমার চোখে জল এনে দেয় পুনঃবার।
এবার আমার দিকে না তাকিয়েই ওর ভালোবাসা মিশ্রিত ধমক, কি হলো? বসছেন না কেন?
পাশে গিয়ে বসলাম। স্পর্শ করলাম ওর দু’গাল। তুমি খেয়েছো?
মাথা ঝাকিয়ে না-বোধক জবাব দেয় লাবণ্য।
বিলম্ব না করে ভাত মাখিয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিলাম এক লুকমা। খাওয়া শেষে প্লেট, জগ রান্না ঘরে রেখে আসে।
ধরিয়ে দেয় হাতে ঔষধের বক্স টা। আমি জানি এবার ও পানি আনার জন্য টিউবওয়েলের দিকে ছুটে যাবে। সেটাই করছিলো।
পেছন থেকে ওর হাতটা টেনে ধরলাম।
পিছু ফিরে তাকালো ‘ও’।
নির্লিপ্ত গলায় প্রশ্ন করলাম, বাইরের ব্যথাটাই দেখলে শুধু? ভেতরে যে আমার ওলট-পালট হয়ে গেছে সবকিছু, জখম হয়েছি মারাত্মক ভাবে, সেটা দেখোনি? টের পাওনি একটুও?
হাত টা আমার থেকে ছাড়িয়ে নেয় সে। মাথা নিচু অবস্থায় এক হাত দিয়ে আরেক হাতের আঙ্গুল মুচড়াতে থাকে।
বসা থেকে ওঠে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ‘ভেঙে ফেলবে তো আঙ্গুল!’
এবার আঙ্গুল মুচড়ানো রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কেঁদে দিবে দিবে অবস্থা প্রায়।
দু’হাত দিয়ে ওর গাল স্পর্শ করলাম। ওর দৃষ্টি এখন আমার চোখের দিকে। বলতে শুরু করলাম, কেন? কেন এমন করছো? কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছো আমাকে? কেন? কেন? খুব বড় কি কোন ভুল করে ফেলেছিলাম? যে ভুলের কোন মাফ হয় না। যার শাস্তি আমাকে এইভাবে দেয়া হচ্ছে! মেরে কেন ফেলছো না আমাকে? নাকি তিলেতিলে মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছো?
এতক্ষণ ধরে জমিয়ে রাখা অশ্রুবিন্দুগুলো লাবণ্যর গাল গড়িয়ে নিচে পড়ে।
দু’হাত দিয়ে ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বুকে টেনে নিলাম।
কানে কানে বললাম, পুতুলবউ! ভালোবাসি তো….
অঝোর ধারায় লাবণ্যর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে তখনো।
সকালে ফজরের নামাজ পড়ে পুনরায় গা টা এলিয়ে দিয়েছিলাম বিছানায়। চোখ টা লেগে এসেছিলো প্রায়। তখনই বাহির থেকে অট্টহাসির আওয়াজ ভেসে আসে। ঘুমজড়ানো চোখে বাইরে যেতেই মা আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। দাদা, বাবা, ছোট ভাই, বোন, কাকা, কাকিমা সবাই হাসছে। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের ওপরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম।
‘সাজ সকালে এত হাসাহাসির কারণ কি? কি হয়ে….’ পুরো প্রশ্ন করতে পারিনি তার আগেই মায়ের জবাব, বাপরে! হাসি কি আর স্বাদে? তোর বউ আইজ্যা কি করছে হুনছোসনি?
অতি উৎসাহের সাথে প্রশ্ন করলাম, কি করলো?
হাসোজ্জল মুখে মায়ের জবাব, তোর বউ লাউ ক্ষেত থেইক্কা ৪,৫টা হুগনা মইচমইচ্যা লাউ পাতা আইন্যা কচলাইয়া গুড়া করছে। পরে একটা জর্দার ডিব্বার মাইধ্যে সব গুড়া ভইরা তোর ভাইরে দিয়া দাদার ঘরে পাডাইছে। তোর দাদা তো লাউ পাতার গুড়ারে জর্দা মনে কইরা খাইয়্যালাইছে।
মায়ের কথা শেষ হতে দেরী কিন্তু বাড়িতে হাসির রোল পড়তে দেরী হয়নি।
দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিঃশব্দে আমি আমার বউকে খুঁজতে লাগলাম।
পাশ থেকে দাদার জবাব, কারে খুঁজস? বউরে? তোর বউরে দোকানে পাডাইছি। আমারে এসব হাবিজাবি খাওয়াইছে এইডা হুনার পর থেইক্কা আমার ডাইরেক্ট লাইন। ওর স্যালাইন আনতে পাডাইছি। যা ওরে নিয়া আয় গিয়ে। আর লবনও নিয়া আসিস। লবনের কথা কইতে ভুইলা গেছিলাম।
কোনরকম হাসি আটকে দাদাকে জবাব দিলাম, আচ্ছা দাদা! জর্দাও নিয়া আসবো নে।
পেছন থেকে দাদার জবাব, হারামজাদা! তোর বউয়ের জর্দা খাইছি আমি। হেইডা অজম কইরা লই। তুই আগে স্যালাইন’ডা লইয়্যা বাড়ি আয়….
#পাগলী_বউ
লেখা- অনামিকা ইসলাম ‘অন্তরা’