পর্ব ১০+১১
পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-১০
রোকসানা আক্তার
আমি ধীর পায়ে হেটে উনার পাশে গিয়ে দাড়াই।উনি দুপুরের রৌদ্রজ্বল পরিবেশের দিকে চোখগুলো বড় করে তাকিয়ে আছেন।শরীরের অঙ্গে অঙ্গে উনার বিষাদময় ক্রোধ বার বার ফুঁপে উঠছে।
আমি গলায় ছোট স্বর টেনে বলি,
——-স-স-স্যরি….!!
উনি আমার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে উনার ধ্যানেই মগ্ন।এক কথায় এড়িয়ে চলা যাকে বলা।তারপরও নিজেকে সামলে আবার বলে উঠি,
——আই এম সো স্যরি….
——তুমি আমায় এখনো বিশ্বাস করতে পারো নি।কাগজে-কলমে স্বামী-স্ত্রী হয়েছি ঠিকই,মনের অনুভূতিতে দুজন-দুজনকে আপন ভাবতে পারিনি।
কথাগুলো নিলয় ভাইয়া উনার পূর্বদৃষ্টি বজায় রেখেই বলেন।আমি কোনোকিছু না বুঝে উঠতে পেরে বলি,
——–আ-আ-আসলে…
এটুকু বলেই থেমে যেতে হয় উনার ইশারায়।
———আর কিছু বলা লাগবে না।দুপুর হয়ে গেছে।কিছুতো খেতে হবে তোমাকে।আচ্ছা আমি খাবার নিয়ে আসছি।।
আমি হা হয়ে জিজ্ঞাসু সূচকে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে উনি ডোর খুলে বেরিয়ে যান আর আমায় ভেতর থেকে দরজাটি অফ করতে বলেন।
আমি দরজাটা বন্ধ করে বিছানার উপর অস্থিরতা মন নিয়ে বসে পড়ি। আর নিজেই নিজের চুলগুলো ভঙ্গিমাতে টানতে থাকি।কারণ,তখন কেন যে বিয়েটা করে ফেললাম?নাহলে তো এত্ত ঝামেলা আজ পোহাতে হতো না।এতটা অনিশ্চিত জীবন নিয়ে আশায় বুক ভেসে আছি।
দরজার কড়াঘাত পড়তেই থতমত খেয়ে দরজাটা খুলে দিই।নিলয় ভাইয়া খাবার নিয়ে আমার সামনে হাজির।
——–খাবারটা খেয়ে নাও।
এ বলে প্লেটটি আমার দিকে বাড়িয়ে দেন।আমি দরজা থেকে মাথাটা বের করে উঁকি মেরে দরজার আশপাশটা দেখতে থাকি।কারণ,নিলয় ভাইয়ার পেছন পেছন আবার ওই খালমণি,মায়ের পিঁপড়ের দল তাড়া করছে কিনা তা দেখার জন্যে।আমার এমন কান্ড দেখে নিলয় ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বলেন,
——–কী ব্যাপার?শাঁকচুন্নির মতো তামাশা করছো কেন??
——-কি?আমি শাঁকচুন্নি?!!
——হু।ভাবভঙ্গি তো তা-ই বলে।
এ বলে উনি হাসিতে ফেটে পড়েন।।উনাকে হাসলে দারুণ দেখায়।উনার বেখেয়ালি হাসি ঠোঁটের কোনায় ঝিকঝিক করে।।আহা, আবারও একটা ক্রাশ খেলাম।
——ঢং!!
এ বলে উনার হাত থেকে প্লেটটি নিয়ে টি-টেবিলের উপর রাখি।উনি দরজাটা বন্ধ করে মোবাইল হাতে নিয়ে বিছানার উপর বসে পড়েন গেমস খেলার উদ্দেশ্যে।
আমি উনার কর্মকান্ডে থ মেরে থাকি।উনি তা পরখ করে মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখদুটো সরিয়ে আমার দিকে তাক করেন।
——–দাঁড়িয়ে আছো যে? খাচ্ছো না কেন??
——–আপনি খাবেন না?
——–আমার এখন খিদে নেই।
——–ওকে, আপনি না খেলে আমিও খাবো না।
——–এসব কেমন বাচ্চামো,মিথিলা?
আমি কিছু না বলে উনার প্রসঙ্গ এড়িয়ে বিছানার একপাশে অভিমান করে বসে পড়ি।উনি আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছেন।
——-তোমাকে রাগ করলে অনেক সুন্দর দেখায় মিথি…আর একটু বেশি রাগ করো, প্লিজজজ?তাতে তোমায় আরো বেশি ভাল্লাগবে।
উনাট কথায় আর রাগ আরো ফুঁসছে।কি-রে বাব্বাহ,আমায় এত্ত ইনসাল্ট করা হচ্ছে??আমি কি দেখতে আসলেই খারাপ!!আমার বসার স্থান থেকে সরু আয়নার পর্দা।আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের মুখে কিড়মিড় ভাব এনে ভালোভাবে দেখতে থাকি।।
——উফস আর এমন করো না তো!আমিতো আরো পাগল হয়ে বনবাস হবো।পরে নিলয় কে হারিয়ে ফেলতে হবে।বুঝলে??
——ছাই হারাবো।ঝোঁকের মতো সারাক্ষণ ওই বুকে ঠাই দিলে আরো কোথাও হারাতে দিব না।হু….
আমার কথায় উনার শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়।আর মুখে কানের পিছে চুলগুলো গঁজে নিচে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকি।।কিছু না ভেবেই উনি আমার কাছে এসে আমাকে উনার দু’বাহু ডোরে জড়িয়ে নেন।আর বলেন,
——এ দেহে প্রাণ থাকা অব্দি তোকো কেউ আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না মিথি।আই লাভউউ ইউ সো মাচ।।।
উনার ভরসার অনুভূতিতে আরো বেশি উনাকে আঁকড়ে ধরি।সত্যি এই মানুষটিকে কেন এত বেশি আমি ভালোবাসি তা নিজেও জানি না।আর কখনো জানার অনুভূতিও মনে আসে নি।মন শুধু জানে নিলয় নিলয় নিলয়।তা শুধু মনে বললেও ভুল হবে,তা আমার সর্বাঙ্গে।উনি বিছানার উপর আমায় আলতো শুইয়ে আমার পেটের একটা চুমুক লাগান,চুমুক লাগান আমার নাভিতে।আমার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।আমি বিছানার চাদর খামচে ধরি।উনি একে একে আমার ঠোঁটের উপর উনার ঠোঁটটা রাখেন।আর বড় লিপ কিসে ভাসিয়ে নেন আমাকে।আমি ও আর নিজেকে সামলাতে না পেরে উনাকে আরো জড়িয়ে ধরে নিজের ভালোবাসার অতলে তলিয়ে নিই।আমাদের এই মিলনে গাছে গাছে পাতা নড়ছে,পাখিরা গান গাচ্ছে,সূর্যরা তার রৌদ্রের আলোয় নিজে নিজে খেলা করছে।
সন্ধের পর আমাদের দরজায় জোরে জোরে কড়াঘাত হতে থাকে।কড়াঘাতের শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গতেই আমি আমার চোখে-মুখে কারো নিঃশ্বাসের কণা অনুভব করতে তাকিয়ে।তাকিয়ে দেখি নিলয় ভাইয়া গভীর ঘুমে গুমচ্ছেন,তাও আমার বুকের উপর মাথারেখে।।অনেকক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের মুখে লজ্জার রক্তিমা চলে আসে।টাল সামলে দরজার দিকে তাকাই।
দরজায় একের পর এক ধাক্কা,কড়াঘাত,ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে।হঠাৎ একটা শব্দের আওয়াজ শুনতেই আমার বুকটা কেঁপে উঠে।থরথর বুকে ভয়গুলো জমা হচ্ছে।নিলয় ভাইয়ার বাবা খুব কড়া গলায় নিলয় ভাইয়াকে ডাকছেন।আমি ভয় পেয়ে নিলয় ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে উনাকে ডাকতে থাকি।
——–আঙ্কেল ডাকছেন।উঠুন,উঠুন….
উনি তাচ্ছিল্য করে আমার কথা ফেলে দিয়ে আমাকে আরো দু বাহুতে জড়িয়ে নেন।আর ঘুম ঘোরে বলেন,
——-ইহু,এমন করছো কেন??শান্তিতে একটু ঘুমতেও দিবে না??
——এই সন্ধেয় কেউ ঘুমায়???
——–জানি-না তুমিইতো ঘুম পাড়িয়ে দিলে তোমার ভালোবাসার ছোঁয়ায়।
——নিলয়????!!!!!!!(নিলয় ভাইয়ার বাবা)
এবার নিলয় ভাইয়ার বাবা উনার সর্বোচ্চ দিয়ে জোরে চিৎকার করে ডেকে উঠেন। নিলয় ভাইয়ার ঘোর ঘুম কেটে যায় তরহর,উনি শোয়া থেকে বসে পড়েন আঙ্কেলের উচ্চ আওয়াজে।আঙ্কেলের আওয়াজস্ত ধ্বনি ভীষণ ক্ষোভের জানান দিচ্ছে।আমি কাঁপা কাঁপা হাতে নিলয় ভাইয়ার ডান হাতটা জোরে আঁকড়ে ধরি।উনি আমার হাতের উপর উনার হাত রেখে আশ্বাস দিচ্ছেন…
——ভয় পেও না মিথি।তোমার কিছুই হবে না।ভরসা রাখো আমার উপর।
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই।ভাইয়া বিছানা থেকে দাড়িয়ে উনার গেন্জিটা পড়ে নেন।আর আমি শাড়িটি ভালোভাবে শরীরে ঢেকে বিছানার উপর জবুথবু বসে থাকি।
ভাইয়া হেটে হেটে দরজার দিকে যতই অগ্রসর হয়,ততই আমার হৃদকম্পন উঠানামা করতে থাকে।আর পুরো শরীর ঘামতে থাকে।
ভাইয়া দরজাটা খুলতেই ঠাস ঠাস চড়ের আওয়াজ ভেসে যায় পুরো রুমে।আমি হালচোখে তাকাতেই বুকটার মধ্যে আশঙ্কার ঢেউ খেলে যায়।।
আঙ্কেল উনার গেন্জির কলার ধরে অগণিত থাপ্পড়, চড়,কিল ঘুষির বন্যা ভাসাচ্ছেন।আমি মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে পড়ি এক অজানা আতঙ্ক এবং ভয়ে।।
——–বেয়াদব,কুলাঙ্গার!!তোকে আজ মেরেই ফেলবো!!তুই তো জানিস যখন কারো উপর আমার রাগ চটে বসে আমি তাকে মেরে ফোলতেও দ্বিধাবোধ করি না।আর তুই কি না……
আবারও যএেতএে ঘুষি দিতে থাকেন নিলয় ভাইয়াকে।
নিলয় ভাইয়া কিছু বলার জন্যে হাঁক ছাড়লেও উনাকে কিছু বলার সুযোগও দিচ্ছেন না।
আমি দু’চোখ বেয়ে পানি ভাসতে থাকে।আমি মায়ের কাছে গিয়ে জোর আবদার করি,
—–মা প্লিজজ, আঙ্কেলকে বলো ভাইয়াকে ছেড়ে দিতে প্লিজজ মা!!
নিলয় ভাইয়ার মায়ের চোখেমুখে কাঁদো ভাব চলে আসে।
—–প্লিজজ আমার সোনার টুকরো কে এভাবে মেরে না, প্লিজজ???তার আগে তুমি আমায় মেরে ফেলো!!!
আমার মায়ের মুখটাও নিচু হয়ে আসে উনার এই ধরনের কর্মে।সাবিলা,সাবিলার মা ওসব দিকে খেয়াল না করে মার্বেল চোখ করে আমার দিকে কুনজর দিচ্ছেন।
——ছিঃছিঃছিঃ, দেখো মা দেখো?এই বজ্জাত মেয়েটা এর ফাঁকে ড্রেস ও চ্যান্জ করেছে।(সাবিল)
——এই বদ মেয়ে?নিলয় বাবাজির সাথে আবার উল্টাপাল্টা কিছু করিস নাইতো??(সাবিলার মা)
আমি কারো কথায় কর্ণপাত না করে চোখের অশ্রু সম্মেত নিলয় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে জোরে একটা আর্তনাদ করে উঠি।।নিলয় ভাইয়াকে প্রবল রক্তে জর্জরিত করে উনি এখন ক্লান্ত হয়ে গেছেন।আর নিলয় ভাইয়া চোখ দুটো নিবু করে হেলেদুলে ফ্লোরের উপর পড়ে যান।তা দেখে খালামণির শক লেগে যায়য়য়!!
——-তুমি একটা কাপুরুষ!!কেউ কারো আপন ছেলেকে এভাবে মারতে পারে??আমার ভাবতেও ঘৃণ্না লাগে!!
——স্টপ রুপাতা!!তুমি কোনো কথা বলবে না!কারণ,আমার বাবার রেখে যাওয়া কথা আমার এই দেহে শেষ শ্বাসটুকু থাকতেও খিলাপ করবো না।কিপ মাইন্ড ইট!!
——আর আপনি!!আপনার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি চলে যান!!আমার আর সহ্য হচ্ছে না এসব!!!কুইকলি!!…..
উনার ধমকের শরগোল পুরো বিল্ডিংটা যেন খসে পড়বে।।উনি তড়িঘড়ি স্থানটা ত্যাগ করে অন্যএে চলে যান ক্রদ্ধমনে।উনার মুখের অবয়ব এখনো মন চায় নিলয় ভাইয়াকে আরো আচ্ছামতো মারতে।
আর আমার মন বলে এভাবে না মেরে একদম কবরে পাঠিয়ে দিন আপনার ছেলেকে।তারপর নাহয় আপনার এই ক্রোধ এই অহংকার জিতে গেলো!!
খালামণি কাজের লোকদের অস্থিরতা মনে ডাকতে থাকেন নিলয় ভাইয়াকে ধরাধরি করে ওঠানোর জন্যে।আমি মায়ের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে নিলয় ভাইয়ার কাছে যাই।তড়িঘড়ি উনাকে যেই ধরতে যাবো ওমনি খালমণির কর্কশ আওয়াজ আমায় ছুঁড়ে দেন।
——–খবরদার!! তুই আমার ছেলেকে ছুঁইবি না।আজ তোর জন্যে আমার ছেলের এই দশা। দূর হ এখান থেকে অলক্ষী কোথাকার।
জানি না এই কথায় আমার আর কি বলার আছে।শুধু আছে চোখের পানি।যে কিছু বলতে পারে না,শুধু কাঁদতেই জানে।
এরফাঁকে কাজের লোকগুলো ছুটে এসে নিলয় ভাইয়াকে ধরাধরি করে ফ্লোর থেকে উঠায় এবং হাসপাতাল যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করে।।
আর আমি সং হয়ে দাড়িয়ে থাকার মাঝে মা কখন যে আমার হাতটায় হ্যাঁচকা টান মেরে বাড়ির দিকে নিয়ে আসে আমি তা নিজেই জানি না।।
পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-১১
রোকসানা আক্তার
—–মা দেখ,আমরাও তোর মনের অবস্থাটা বুঝি।তুই নিলয়কে কতটুকু ভালোবাসিস আর নিলয়ও তোকে কতটুকু ভালোবাসে।আমরা তোকে বাধা প্রদান করতাম না।যদি -না সাবিলার সাথে নিলয়ের বিয়েটা আগ থেকে ঠিক করা না থাকতো।নিলয়ের বাবার জেদের কাছে সবকিছু পরাজিত।এতটাই বলীয়ান উনি উনার ওয়াদায়।তাই আমরা এতকিছু জানা সত্ত্বেও কেন তোর ক্ষতি হতে দিব মা, বল???তোকে আমি ছোট থেকে বড় করেছি কখনোই কষ্ট কি জিনিস বুঝতে দিই নি।আর আজ তোর কষ্টটা আমার স্বইচ্ছে মেনে নিতে পারছি না রে মা।আমরা চাই না তোর জীবনটা নরকে পরিণত হোক নিলয়ের বাবার জন্যে।
মা এসব বলেন আর আমার মাথায় হাত বুলান।বাবাও মাকে সম্মতি দিয়ে চোখের পানি ফেলছেন।আমি ড্রয়িং রুমের চেয়ারের আটপৌরে পা উঁচিয়ে বসে আছি।
——–যাইহোক,মা যা হয়ে গেছে সব ভুলে যা।কারণ,যেটা আমাদের দ্বারা সম্ভব না,সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর ও ফয়দা হয়না।(বাবা)
——-আর বিধাতার লিখন যদি তুই নিলয়ের বন্ধনে থেকে থাকিস, তাহলে অবশ্যই নিলয়কে তুই পাবি নিজের করে।পৃথিবীর কোনো শক্তিই তোদের বিপক্ষে বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারবে না।(মা)
আমি সবার কথা শুনছি আর কাঠ মনে অন্যদিকে স্থির তাকিয়ে আছি।
——–মিথির মা,তুমি আর বসে না থেকে আমাকে এক গামলা পানি গরম করে দাওতো।গলাটা ভীষণ ব্যথা করছে,আজ অফিসের কাজও ভালোভাবে করতে পারিনি।কিছু ফাইল বাকি পড়ে আছে তা আজ রাতের মধ্যেই সম্পূর্ণ করতে হবে।।
——শুধুই কি গরম পানি??একেবারে আদা দিয়ে রং চা ই করে দিই?
——যদি তোমার কষ্ট না হয় তাহলে দাও।।
মা কাপড়ের আঁচল টেনে কিচেনে চলে যান।বাবা চশমা চোখে দিয়ে হাতে একটা পএিকা তুলে নেন।আর চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
——-মা তুই তোর রুমে যা।চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।আর দোয়া কর নিলয় যাতে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে পারে।
আমি বাবার সম্মতি পেয়ে নিজরুমে চলে আসি।রুমে এসে দেখি রিধি আমার রুমে টেবিলের উপরের বইগুলো উল্টেপাল্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলছে।আমার চোখগুলো অনেকটা কপালের দিকে উঠে যায় ওর এরকম কার্বার দেখে।
———কী ব্যাপার, রিধি??তুই এরকম করছিস কেন??কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজছিস??
রিধি ব্যস্ততা মনে বলে,
——-একটা চিঠি খুঁজছি আপু।
——–চিঠি?কে আবার এই আধুনিক যুগে এসে প্রাচীন প্রথা শুরু করলো??
——-আরেহ বাবা তা’নয়!তুমি আবার কি বোকার মতো কথা বলতেছো?
——-আচ্ছা তাহলে কি,বল!
——-ওদিন ক্লাসে প্রিয়া আমাকে দুষ্টমি করে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিল।জানি না চিঠিতে কি লিখা ছিল।ও আমায় বলেছিল চিঠিটা ক্লাসে না খুলতে এবং বাসায় নিয়ে এসে পড়তে।সেইভেবে,বাসায় এনে তোমার টেবিলের উপর রাখলাম,আর খেয়াল করে পড়া হয়নি।আর তুমিতো সেদিন বাসায়ও ছিলে না।এখন খুঁজতেছি চিঠিটা পাচ্ছি না।
——-ওহহ, এই ব্যাপার???
——-হু!!নিলয় ভাইয়ার জন্যে খুব মায়া লাগছে আপু….
রিধির কথাটি শুনে আমার চোখদুটো ঝাপসা হতে থাকে।টাল সামলে বললাম,
——-আচ্ছা তুই তোর রুমে যা।আপু একটু বিশ্রাম নিব।
——আচ্ছা আপু।আর টেনশন করো না প্লিজজ বোন আমার…।।
আমি রুমের বাতিটা অফ করে হাটু গেড়ে বিছানার উপর মুখ গুঁজে বসে আছি।কিছুতেই মন টাকে মানাতে পারছি না।আজ আমার সামনে এসব কি হয়ে গেলো!নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।নিলয় ভাইয়ার বাবা এতটাই হিংস্র আমার আগে জানা ছিল না।।নিলয়ের কি অবস্থা, কেমন আছে,ডাক্তার কি বলে—–উফস,স্থির থাকতে পারতেছি না।ছটফটানি মনের মাঝে বার বার এক আতঙ্ক চেয়ে যায়য়।ভবিষ্যৎ দিনগুলোর কথা ভাবলে কপালের চামড়াগুলো বুঁজে আসে।বাবাকে দিয়ে কি একবার ফোন করিয়ে দেখবো?যে নিলয়ের এখন কি অবস্থা!!বাবা কিছু বলবেন নাতো??য়ু-হু…বাবা এমনটি নয়।একবার চেষ্টা করে দেখলে তো সমস্যা নেই।দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে সোফার কাছে যাই।বাবা অফিসের কাগজ-পএ গুলোতো কি যেন লিখছেন।আমার আসার শব্দ শুনেই মাথাতুলে আমার দিকে তাকানন।
——-কিছু বলবি?মিথি??
——-ইয়ে মানে বাবা…..
বাবা আমার হাত-পায়ের দিকে ভালোভাবে পরখ করেন।কারণ,আমার হাত-পা গুলোর থরথরে কাঁপছে।বাবা জানে যখন আমি কিছু বলতে গিয়েও অসংকোচ বোধ করি,তখন আমার হাত-পায়ের কাঁপা ছুটাছুটি করে।বাবা মুঁচকি হেসে বলেন,
——-আচ্ছা,নিঃসংকোচে বল কি বলতে চাস।দ্বিধাবোধ করিস না।
আমার মুখে একটা হাসি চলে আসে।বাবা আমার প্রতিটা মুহূর্তকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝার ট্রাই করেন।আমি কখন কি চাই বাবা আমার মনের অব্যক্ত সব ভাষা বুঝে ফেলেন।শুনার পর কখনোই বিরক্তিবোধ করেন না।এজন্যই,মায়ের থেকে আমি বাবাকে বেশি ভালোবাসি।আমি জানি,বাবার এই বিয়েতে আপওি নেই তবে বাবা যে পরিস্থিতির শিকার তা আমি বাবার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি।
——–বাবা??একটু খালামণি কে কল দিতে পারবা??
——–কেন??
———নিলয় ভাইয়ার কি অবস্থা একটু জানার জন্য।আসলে এখন উনি কেমন আছেন তা তো জানি না।তাই জানতে আর-কি…..
——–আচ্ছা আচ্ছা।কোনো সমস্যা নেই।বাবা কল দিচ্ছি।ওয়েট….
এ নিয়ে বাবা টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিতেই মা কোথা থেকে এসে হরদম ফোনটা কেড়ে নেয়।
——–কে বলে তোমায় এত্ত চামচাগিরী করতে??নিজ কাজে বসছো নিজ কাজে মন দাওও।এধরনের বেখেয়ালিপনায় অফিসের স্যালারী কম পাচ্ছো।এরকম যদি করো তাহলে সংসারটা চলবে কিভাবে???হু???
মায়ের একটা বদঅভ্যেস আছে।যখন কোনো সুযোগে বাবাকে বকা শুরু করেন,তখন অপ্রাসঙ্গিক কথাগুলোও এরমাঝে টেনে আনেন।কারণ বাবাকে সরাসরি কিছু বলতে পারেন না বলে মনের জাল ফুঁসে অন্য ফন্দিতে কাজে লাগান।আর নিশ্চুপ বাবা চোখবুঁজে শুনে যান।
তারপর মা আবার বলেন,
—-নিলয়ের মায়ের সাথে আমার কিছুক্ষণ আগে কথা হয়েছে।নিলয়ের কিডনিতে এমনিতেই নাকি অনেক আগ থেকে সমস্যা।তাই আজ কিডনিতে আঘাত পাওয়ায় তা আরো প্রচন্ড মাএায় চলে যায়।এখন ডাক্তাররা বলতেছে সিঙ্গাপুর ভালো কোনো ডাক্তারকে গিয়ে দেখাতে,নাহলে এটি দিনকে দিন মারাত্মক আকার ধারণ করবে।।ওরা আগামী ২/৩ দিনের মধ্যেই সিঙ্গাপুর ব্যাক করছে।
একথা শুনার পর আমার বুকটা খা খা করে উঠে।মা এসব যে বলছে আদৌ কি সত্য?নাকি কোনো মাকড়সার জাল!
এরই মধ্যে বাবা বলে উঠেন,
———ওর বাবারতো বিজনেস ডিলে সিঙ্গাপুর নিয়মিত যাতায়াত।শুনলাম,কোম্পানি থেকে নাকি সিঙ্গাপুর একটা কোয়ার্টার পেয়েছে??
———হু।তাই ফ্যামিলিও ভিসাও আছে ওদের সিঙ্গাপুরের।
——–হুম।এসব বড়লোকদের কার্বার।যাইহোক,দোয়া করি,নিলয় বাবা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক।
এ বলে বাবা আবার নিজ কাজে মন দেন।মা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
——-রিধি কে ডেকে নিয়ে আস।আমি ড্রাইনিং এ খাবার নিয়ে আসতেছি।
আমি অপলক মায়ের কথা শুনি।তবে, মনটা এখন অন্যদিকে।কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আমার রুমে চলে আসি।বেলকনির কাছে গিয়ে নিঃশব্দে ঘোর ঘোর অন্ধকারের শহরটা দেখতে থাকি।এখন মনে হাজারো প্রশ্নের সমীকরণ ভিড়তেছে।কিছু প্রশ্ন এরকম—-
আচ্ছা??নিলয় ভাইয়ার যে কিডনির প্রবলেম কখনই তো উনি আমায় বলেননি।তাছাড়া ফ্যামিলির কারো থেকেই তো শুনি নি যা আজ প্রথম শুনলাম।তবে সবাই কি ড্রামা সাজাচ্ছে নাকি?যাতে একবাহানায় কোথাও চলে গিয়ে নিজেদের মুক্ত করতে পারে আমার থেকে??তাছাড়া,নিলয় ভা-ভা-ইয়া….
——নাহ,নাহ এমনটি কখনোই হবে না।আমি জানি,আমার নিলয় এরকম না।আমার নিলয়ের আমি নিঃশ্বাস।প্লিজজ নিলয়?আমি আর সইতে পারছি না।খুব খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।আমি শুধু আল্লাহর কাছে এটুকুই চাই যে আল্লাহ আপনাকে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনুক।।তওবা,তওবা….আমি কি ভেবে ফেললাম।আমি আমার নিলয়কে অবিশ্বাস করলাম!!?
——-আপু???
রিধি কাঁধে হাত রেখে ডাকতেই আমি চমকে উঠি।চোখের পানিটুকু মুছে বলি,
——-কী রিধি?বল???
——-মা বললো খেতে যেতে।
——-আচ্ছা রিধি আমায় একটা হ্যাল্প করতে পারবি??
রিধি আমার কৌতূহল অনুভূতি দেখে বলে,
—-কি হ্যাল্প?বলো?
—–খালামণির কাছে কল দিতে পারবি একটু??
—–খালামণির কাছে কল দিব মানে???উনাকে এখন আমি বাঘের মতো ভয় পাই।
——আরেহ বোকা!ভয় পাওয়ার কি আছে??উনার সাথে তো তোর সম্পর্ক খারাপ হয়নি যে উনি তোকে কিছু বলবেন!তুই জাস্ট বলবি “খালামনি নিলয় ভাইয়ার এখন কি অবস্থা??মায়ের কাছে শুনলাম যে ভাইয়াকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাবেন ভাইয়াকে ডাক্তার দেখাতে??”
জাস্ট এনাফ।দ্যান দেখতি উনি কি বলে।।
——-আপু তুমি পাগল??তুমি জানো এখন যদি আমি কল দিতে যাই তাহলে উনি ভাববেন সবটা তুমি করতেছ আমাকে দিয়ে…
——-আরেহ বোকা জানবে না।তুই তো আর আমার ফোন দিয়ে কথা বলবি না,বাবার ফেন দিয়ে কথা বলবি।
——-উফস আপু!!নিলয় ভাইয়ার ফোন অফ নাকি অন??
——-বন্ধ বাতাচ্ছে রে….প্লিজজ রিজেক্ট করিস না আপুর রিকুয়েষ্ট? একটু তো আপুর জন্য কর??
——-কিন্তু আপু—আমার আনইজি লাগতেছে।
——-কোনো আনইজি ফিল হবে না।যা শেখার আমি শিখিয়ে দিব।অন্তত প্লিজজ বোন আমার….বুকে একটু হাতটা রেখে দেখ বুকটা কেমন আশঙ্কায় লাফাচ্ছে…..
রিধিকে এসব বলি আর জোড় হাতে রিকুয়েষ্ট করতে থাকি।রিধি খানিকক্ষণ ভেবে বলে,
——-আচ্ছা দাও তাহলে।
——-বাবার কাছ থেকে নিয়ে আস গেমস খেলার বাহানা দিয়ে।
——আচ্ছা ওয়েট করো।আমি আসতেছি।
রিধি সড়াৎ সড়াৎ বাবার কাছে চলে যায়।তার ক্ষাণিক পরে ফোনটা লাফাতে লাফাতে নিয়ে আসে।
——-এই নাও।নাম্বার বের করে দাও।
তারপর আমি নাম্বার টা টুকে স্ক্রিনে টাচ করি।কলটা ঢুকতে থাকে গোত গোত করে।
দু’তিনবার বাজার পর ওপাশ থেকে রিসিভ হয়।
——-হ্যালো??আসসালামু-আলাইকুম,খালমণি??
ওপাশ থেকে শব্দের আওয়াজ শুনে রিধি চোখগুলোকে ঘুরোতে থাকে।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় কলটি রিসিভ করলো!!
——-আ-আ-আপু?খালামণি তো কলটি রিসিভ করেনি।কোনো পুরুষ মানুষ বোধ হয়।
——আচ্ছা লাউড দে।
রিধি লাউড টা দিয়ে দেয়।ওপাশ থেকে বার বার ভেসে আসে–
——-হ্যালো,রিধি??তুমি ভাইয়ার কথা বুঝতে পারছো না?আমি তোমার নিলয় ভাইয়া।।
আমি প্রিয় কন্ঠস্বরটি শুনার সাথে সাথে রিধির থেকে ফোনটা নিয়ে যাই।অস্থির মনে বলি,
——হ্যালো??নিলয় ভাইয়া??
——মিথি??
নিলয় ভাইয়ার কন্ঠস্বরে কান্নাস্বর চলে আসে।তার হুট করে কলরা ধপাস ধপাস কেটে যায়।বোধহয় কেউ ভাইয়ার থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়েছে।দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদতে কাঁদতে থাকি।বিধাতা আমাকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছে।আর কত সহ্য করবো??ধৈর্যের বাঁধ যে ভেঙ্গে যাচ্ছে।
চলবে….