পার্সেল পর্ব শেষ

পার্সেল ৪র্থ(অন্তিম) পর্ব
Misk Al Maruf
.
আসল সময়ে তিনি সিসিটিভির ফুটেজটি নিয়ে আসতেই আমি অবাক হবার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলাম। একি এটাতো আমার প্রথম স্ত্রীর অনুরূপ সেই মেয়েটি যাকে আমি সেদিন রাস্তায় এক যুবকের সাথে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম।
নজরুল ভাই আমাকে ধাক্কা দিতেই আমি বাস্তবে ফিরে তাঁকে সবকিছু খুলে বললাম। তাঁর মতো একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তিও আমার কথায় বেশ হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি তৎক্ষনাৎ আমাকে বলে উঠলেন,
-কিন্তু আপনার স্ত্রীকেতো আপনি নিজ হাতে কবর দিয়েছিলেন আর তাছাড়া আপনার ভাষ্যমতে তাঁর কোনো জমজ বোনও ছিলোনা তবে এই মেয়েটি আপনার স্ত্রীর অনুরূপ কীভাবে হলো? আর যদি আপনার স্ত্রীর সাথে তাঁর কোনো যোগসূত্র নাও থাকে তবে সে আপনার সম্পর্কে এবং আপনার স্ত্রীর সম্পর্কে এতো কিছু জানলোই বা কীভাবে?
নজরুল ভাইয়ের একনাগাড়ে এতোগুলো প্রশ্ন শুনে আমি গাধার ন্যায় তাঁর দিকে শুধু তাকিয়েই রইলাম কিন্তু আমার শ্রবনাঙ্গ থেকে কোনো শব্দ বের হলোনা। মূলত তিনি যেই প্রশ্নগুলো আমাকে করলেন সেগুলোর উত্তরইতো আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি।
অজস্র কৌতুহলকে কোনোমতে মাটি চাপা দিয়ে নজরুল ভাই বেশ খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন,
-যাক আমরা রহস্যের কাছাকাছি চলে এসেছি বাকিটা কালকেই জানা যাবে।
এই বলেই তিনি কুরিয়ার অফিসের দায়িত্বে থাকা প্রধান লোকটিকে সবকিছু খুলে বললেন। তিনিও এসব ঘটনা শুনে বেশ অবাক হলেন বটে পরক্ষণেই বললেন,
-ভাই, আপনাদের যেকোনো সাহায্য লাগলে আমি করতে রাজি আছি। আসলে এই রহস্যের শেষটা আমারও জানার তুমুল আগ্রহ মনে উঁকি দিচ্ছে।
নজরুল ভাই লোকটির থেকে এমন আশ্বাস শুনে বেশ খুশি হয়ে বললেন,
-অনেক ধন্যবাদ ভাই। তবে আপনাকে আমাদের একটুখানি সাহায্য করতে হবে। আমি জানি মেয়েটি যেহেতু গত তিনদিন টানা আপনাদের এখানে পার্সেল দিতে এসেছে তাই কালকেও আসবে। আপনাদের কাজ হলো শুধু সে যেইসময়টিতে এখানে আসবে তখন আমাদের ফোন করে জানাবেন এবং তাঁকে বিভিন্ন কথার মারপ্যাঁচে এখানে দাঁড় করিয়ে রাখবেন।
-জ্বী ভাই অবশ্যই।
কুরিয়ার অফিস থেকে আমরা দুজন বেরিয়ে পুনরায় যাত্রাবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। পথিমধ্যে নজরুল ভাই আমাকে বললেন,
-কালকে দুজনেরই অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে এবং সকাল সকালই সদরঘাঁট চলে আসতে হবে। কারণ বেশি দেরী করলে মেয়েটিকে আমরা ধরতে পারবোনা বুঝছেন? তবে আমার একটা জিনিস ভালোভাবেই মাথায় খেলছে আর সেটা হলো উনি আপনার স্ত্রীরই হয়তো জমজ বোন হবে। কারণ এতোটা হুবুহু চেহারা অন্য কারো হওয়াটা অসম্ভব।
-কিন্তু আমার শ্বশুর শাশুরী কিংবা আমার স্ত্রীতো কখনোই তাঁর বোনের ব্যপারে আমাকে কিছু জানায়নি।
-হয়তো এর পিছনেও কোনো কারণ লুকিয়ে আছে। যাই হোক কালকেই বোঝা যাবে আসল কাহিনী কী?
.
বহুত উত্তেজনা নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। ভুলবসত আজকের পার্সেলটি সেই কুরিয়ার অফিসেই রেখে এসেছি তবে আমার মনে হয়না গতকালকের পর এই পার্সেল আর কোনো কাজে আসবে। এসব ভাবনার মাঝে হঠাৎই মিমি আমাকে ডাক দিলো। ওর ডাকে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরেই জিজ্ঞেস করলাম,
-কী হয়েছে?
-না মানে খাবার খেতে আসো।
ওর পিছুপিছু আমি খাবার টেবিলে উপস্থিত হতেই দেখি আমার শ্বশুর আর শ্যালক মিহাদ আমার আসার অপেক্ষায় এতক্ষণ বসে ছিলো। মিমি এক এক করে সকলের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে একপর্যায়ে মিমি আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললো,
-শোনো! বাবার টাকাটা কী ব্যাংক থেকে এনেছো?
মিমির কথায় আমি কিছুটা অঙ্গভঙ্গি করে বললাম,
-উফফ একদমই মনে ছিলোনা। আসলে আজকে অফিসে কাজের এতোটাই চাপ ছিলো যে আসার সময় ব্যাংকে যাওয়ার কথা মনেই ছিলোনা। কাল সত্যি সত্যি এনে দিবো।
মিমি আমার কথায় নিশ্চুপ হয়ে গেলেও শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম তিনি বেশ ক্ষুব্ধ। আমি মনে মনে কিছুটা হাসি দিয়ে বললাম,
-শালায় টাকা নিবে ধার আবার রাগও করে।
খাবার খাওয়া শেষ করে বেডরুমে আসতেই মিমিও আমার পিছুপিছু ছুটে আসলো।
-আচ্ছা কালকেই একটু টাকাটা দেওয়ার চেষ্টা করো। আসলে তরমুজের বীজ ফেলানোর সিজন চলে যাচ্ছে তাই বেশি দেরী করলে বাবা সময়মতো সবকিছু করতে পারবেনা।
-আচ্ছা কালকে অবশ্যই দিবো।
মিমিকে ব্যর্থ সান্ত্বনা দিয়ে আমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। আগামীকাল কী হবে সেটা ভাবতে ভাবতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।
সকাল সকাল উঠে নজরুল ভাইকে কল দিতেই তিনি বললেন,
-আপনি রেডি হয়ে বের হন আমি একটু পরই বের হচ্ছি।
ইতঃমধ্যে আমরা দুজনই অফিসে ফোন দিয়ে ছুটি নিয়েছি। যদিও সরকারী চাকুরীতে ছুটি নেওয়াটা অনেক কঠিন ব্যপার তবে নজরুল ভাইয়ের মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তি থাকতে ছুটি নিতে বেশি বেগ পেতে হলোনা।
অতঃপর দুজন যাত্রাবাড়ী থেকে মিনিবাসে করে সদরঘাঁটে উপস্থিত হলাম। কুরিয়ার অফিসের বেশ কিছুটা দূরেই একটি হোটেলে বসে আমরা একের পর এক চায়ের অর্ডার দিয়েই যাচ্ছি কিন্তু সেই লোকের কল তখনো আসছিলো না। যদিও নজরুল ভাই বিশ মিনিট পরপরই লোকটিকে ফোন দিয়ে জানার চেষ্টা করছেন যে মেয়েটি এসেছে কীনা কিন্তু বরাবরই তাঁর নাবোধক শব্দ শুনে বেশ হতাশ হচ্ছিলাম। তবুও উত্তেজনার রেশ যেন একটুও কাঁটছিলোনা।
ঠিক বারোটা পনেরো মিনিটে লোকটির কল আসতেই আমি অতি উত্তেজনায় নজরুল ভাইকে বলে উঠলাম,
-ভাই, লাউডস্পিকার দেন।
তিনি আমার কথামতো কলটি রিসিভ করে লাউডস্পিকার দিতেই ওপাশ থেকে অনেকটা ফিসফিসিয়ে লোকটি বলে উঠলো,
-ভাই, মেয়েটি এসেছে! একটু তাড়াতাড়ি আসেন।
-আচ্ছা ভাই এখনি আসছি আপনি একটু তাঁকে দাঁড় করিয়ে রাখেন কোনোভাবে।
-হুম ভাই চেষ্টা করছি।
ফোনটি কেঁটে দিয়েই তিনি চেয়ার থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি কোনোমতে পকেট থেকে একশ টাকার একটি নোট হোটেল ওয়ালাকে ধরিয়ে দিয়ে নজরুল ভাইয়ের পিছু পিছু ছুটে চললাম। এরমধ্যে হোটেল ওয়ালা ডাক দিয়ে বললো,
-ভাই চল্লিশ টাকা পাইবেনতো।
দূর থেকে আমি জোরে জোরে বললাম,
-ঐটা আপনার বখশিশ।
এদিকে কুরিয়ার অফিসের যতই কাছে যাচ্ছি ততই আমার বুকের ধুকধুকানি বর্গহারে বেড়েই চলছে। আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে এতোটা উত্তেজনার কারণে আমি কুরিয়ার অফিসে যাওয়ার আগেই হার্ট এ্যাটাক করবো। অজস্র কৌতুহল নিয়ে কুরিয়ার অফিসে প্রবেশ করতেই একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেখানের দায়িত্বে থাকা ছেলেগুলোর সাথে কথা বলতে দেখলাম। মেয়েটি উলটো দিকে ঘুরে থাকার কারণে তখনো পর্যন্ত আমি তাঁর চেহারা দেখতে পারছিলাম না। আমার আগেই নজরুল ভাই মেয়েটির কাছে গিয়ে বলে উঠলো,
-আপু কেমন আছেন?
আকস্মিক একজন অচেনা লোকের থেকে এমন প্রশ্ন শুনে স্বভাবতই মেয়েটি সন্দেহভরা চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কে আপনি? চিনতে পারলাম নাতো।
নজরুল ভাই আমার দিকে আঙ্গুলটা তাক করে বললেন,
-আমাকে না চিনলেও ওনাকে বোধহয় খুব ভালো করেই চিনেন।
যখন মেয়েটি আমার দিকে তাকালো তখন সহসাই তাঁর হাত থেকে নতুন পার্সেলখানা মাটিতে পরে গেলো। তাঁর পুরো মুখোমন্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভা ছড়িয়ে পরলো এবং তাঁর হাত দুটোও অজানা এক ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দিলো। সে হয়তো কখনোই ভাবেনি যে আমি তাঁর সামনে হঠাৎ করেই এভাবে উপস্থিত হবো।
.
আমি, নজরুল ভাই আর আমার স্ত্রীর রূপ ধারণকারী সেই মেয়েটি বসে আছি রেষ্টুরেন্টের একটি কেবিনে। মেয়েটির মুখোমন্ডলের দিকে তাকিয়ে আমি আঁচ করতে পারছিলাম যে সে হয়তো খুব ভয় পাচ্ছে। তবে আমি কেন জানি ওর চেহারায় নিশির মতোই একটি ছোঁয়া পেলাম। হঠাৎই নজরুল ভাই বলে উঠলেন,
-এবার আমাদের সবকিছু খুলে বলেন। কেন আপনি ওনাকে এরকম উদ্ভট পার্সেল পাঠাচ্ছিলেন আর ওনার প্রাক্তন স্ত্রীর সাথেই বা আপনার কীসের সম্পর্ক?
মেয়েটি কিছুটা কাচুমাচু করেই বললো,
-আসলে নিশি আর আমি জমজ বোন ছিলাম। তবে আমাদের জন্মের পূর্বেই আমার বাবা মারা যায় আর তখন আমার মা বেশ অসহায় হয়ে পরে। আমাদের দুবোনের জন্মের পর মা একসাথে দুজনকে লালন পালন করতে পারবেনা দেখে নিশিকে এক বড়লোক ঘরের নিঃসন্তান দম্পতির নিকট দত্তক দিয়ে দেয়।
নজরুল ভাই কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে হঠাৎই মেয়েটিকে বলে উঠলেন,
-সবই বুঝলাম কিন্তু একটি দিক থেকে আমি দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে পারছিনা। আপনি যদি ওনার প্রথম স্ত্রীর বোনই হয়ে থাকেন তাহলে আপনি এতো কিছু জানেন কীভাবে? আর ওনার স্ত্রী যে আত্মহত্যা করেছে নাকি তাকে খুন করা হয়েছে সেটাতো উনি স্বামী হিসেবেই কনফিউশনে আছেন।
-আসলে নিশির আর আমার মাঝে পারিবারিক দূরত্ব থাকলেও ওর সাথে সবসময়েই আমার সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো তাই ও সবকিছুই আমাকে শেয়ার করতো।
-না না যতই শেয়ার করুক তবুও এতোটা গভীর বিষয়গুলোতো আপনার কোনোভাবেই জানার কথা নয়। আর ওনার স্ত্রীর মৃত্যুর একমাস পর যেহেতু ডিভোর্স পেপার এসেছিলো ওনার স্ত্রীরই সাইন করা তাহলে রহস্যের মোড়টাতো অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে আপু।
নজরুল ভাইয়ের কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলেও কিছুই বুঝতে পারলাম না। অপরদিকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম তাঁর মুখমন্ডলে পুনরায় ঘামের আস্তরণ জেগে উঠেছে। ঠিক তখনি নজরুল ভাই ভ্রু কুঁচকে এবং মুখে কিছুটা রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললেন,
-আসলে সত্যিটা কী জানেন? ওনার স্ত্রী আর কেউ নয় বরং আপনিই ছিলেন এবং যে খুন হয়েছে সে ছিলো আপনারই বোন। হয়তো সেদিন আপনারা নিজেদেরকে কোনো কারণবসত এক্সচেইন্জ করেছিলেন কিন্তু একমাস পরে দেওয়া ডিভোর্স পেপারই সব রহস্যের তীরকে ভেঙ্গে দিয়েছে।
নজরুল ভাইয়ের কথায় আমার হৃৎপিন্ডে ধুক করে একটি শব্দ হলো, এটা কী বলছেন তিনি? তৎক্ষনাৎ আমি মেয়েটির দিকে তাকাতেই সেও কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আর পরক্ষণেই সে নিজের মুখখানি আঁচলে লুকিয়ে নিজের আবেগের ধারা ছেড়ে দিয়ে কান্না করে দিলো। তাঁর মানে ওই আমার নিশি ছিলো? আমি তখন খুব কষ্টে নিজের চোখের অশ্রুবাধ কিছুক্ষণের জন্য আটকে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
-এমনটা কেন করেছিলে নিশি? আমি কী তোমাকে ভালোবাসতাম না?
নিশি তখনো কান্না করেই চলেছিলো হয়তো ও নিজেও ভাবেনি দীর্ঘ একবছর পর আমার সামনে ও এইভাবে উপস্থিত হবে। বেশকিছুক্ষণ কেঁটে যাবার অন্তর নিশি হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে উঠলো,
-আমি এসব কিছুই নিজের ইচ্ছাতে করিনি আর আমি জানতামও না সেদিন নিজের একটুখানি সখের কারণে আমার বোনকে হারাতে হবে।
কিছুটা থেমে নিশি আবার বললো,
-তোমার মনে আছে তুমি যেদিন অফিসের কাজে খুলনা গিয়েছিলে তাঁর আগের দিন আমি বাবার বাড়িতে গিয়েছিলাম? সেদিন আমি বাড়িতে গিয়ে আমার বোন সুমির সাথে যোগাযোগ করি। একপর্যায়ে আমার নিজের মাকে দেখার জন্য মনের মধ্যে প্রবল ইচ্ছা জাগে। তাই অনেকটা বুদ্ধি করেই সুমিকে রাজি করিয়ে কিছুদিনের জন্য ওকে আমাদের বাড়িতে রেখে আমি আমার মায়ের কাছে থাকার জন্য যাই। সুমিকে আমি সবকিছু শেয়ার করার কারণে ও খুব ভালো করেই জানতো যে আমার পরিবারের সাথে কীরকম আচরণ করতে হবে তাই ওর ব্যবহারে ও ধরা খায়নি। কিন্তু সেদিন বিকালেই তুমি জানাও যে কিছুদিনের জন্য খুলনা যাবে তাই আমার মা সুমিকে আমাকে ভেবে জোরপূর্বক তোমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। আমি তখন এতোটা দ্রুত ওর সাথে নিজেকে বদলি করারও সময় পাইনি তাই ওকে ফোনে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে তোমার কাছে পাঠাই। আমার বোন তোমার সাথে কীভাবে সবকিছু ম্যানেজ করেছিলো তা জানতাম না তবে তোমার নিকট পাঠানোর পর প্রতিমুহূর্তেই আমি ভয়ে ছিলাম যে ও আবার ধরা পরে যায় কীনা? কিন্তু ও তোমার থেকে বেঁচে গেলেও নিজের জীবনটা আর বাঁচাতে পারলোনা।
এই বলেই নিশি হু হু করে কেঁদে দিলো। ওর কথাগুলো শুনে আমিও নিজের অশ্রুবাধ আর আটকাতে পারলাম না। এভাবেই আমরা দুজন কিছুক্ষণ কষ্ট লোপন করার পর নজরুল ভাই পাশ থেকে কিছুটা নরম সুরে বলে উঠলেন,
-আসলে আমার মনেও এই ঘটনাটা বেশ নাড়া দিয়েছে, মনে হচ্ছে রূপকথার কোনো গল্পকেও এই ঘটনাটি হার মানাবে। তা যাই হোক তবে এটা নিশ্চিত যে সুমি আত্মহত্যা করেনি। কিন্তু তাকে খুনটা করলো কে?
প্রতিউত্তরে নিশি বললো,
-দাড়োয়ান কোনোদিনই সুমিকে খুন করার সাহস রাখেনা যদিও সে আগে আমার দিকে প্রায়শই কুদৃষ্টিতে তাকাতো। তবে একজনকে আমার সন্দেহ হয়।
আমি অনেকটা উৎফুল্ল নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কাকে?
-তোমার খালুকে অর্থাৎ তোমার বর্তমান স্ত্রীর বাবাকে! কারণ তিনি যখন প্রায়শই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন তখন আমাকে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখাতেন যেন আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাই। কারণ তাঁর মেয়ের স্থানে যেহেতু আমি বসেছিলাম তাই এটা তাঁর কোনোভাবেই সহ্য হতোনা।
নিশির কথায় আমার মনে মুহূর্তেই এক হিংস্রতা আর ক্রোধে ছেঁয়ে গেলো। তাঁর মানে এই কু*র বা*র ডাকাতি অভ্যাসের রেশ এখনো কমেনি? আমি তখনি রাগের মাথায় চেয়ার থেকে উঠতে গেলেই নজরুল ভাই আমার হাত ধরে পুনরায় জোরপূর্বক বসিয়ে দিলেন।
-ভাই! রাগের মাথায় এখন কিছু করতে গেলে আমও যাবে ছালাও যাবে। আমাদের দরকার শুধু প্রমাণ আর ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধিমত্তার সহিত কাজ করা।
তাঁর কথায় আমি কিছুটা শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-প্রমাণ পাবো কোথায়?
-জেলের ভিতর! মানে ঐ যে দাড়োয়ানকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছিলো সে সেদিনকার ঘটনা একটু হলেও জানে। এখন আমাদের কাজ তাঁর সাথে জেলে দেখা করতে যাওয়া।
নজরুল ভাইয়ের কথায় আমি বলে উঠলাম,
-সে তো কেরাণীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে আছে।
-যাক আপনি যেহেতু জানেন তবুও তাঁর পরিবারের সাথে আলাপ করে যেতে হবে। কারণ তাঁর কয়েদী নাম্বার কত তা আমাদের জানা নেই।
.
অতঃপর অনেক চড়াই উতড়াই পেরিয়ে আমরা কেরাণীগঞ্জে সেই দাড়োয়ানের সাথে কথা বলতে গেলাম। এদিকে আমার স্ত্রী মিমি বারবার ফোন দিয়েই যাচ্ছে। কলটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
-টাকাটা কী ব্যাংক থেকে উঠিয়েছো? না মানে তোমারতো আবার মনে থাকে না তাই মনে করিয়ে দিলাম আরকি।
আমার মনে প্রচুর ক্ষোভ থাকলেও সেটা মনের মধ্যে চেপে রেখে শান্ত গলায় বললাম,
-হ্যাঁ টাকা নিয়েই আসছি।
আমার কথায় মিমি বেশ খুশি হয়ে বললো,
-আচ্ছা সাবধানে এসো।
কলটি কেঁটে দিয়েই মনে মনে বলছি,
-টাকা নিয়ে আসতেছি না কী নিয়ে আসতেছি সেটাতো কয়েক মুহূর্ত পরই টের পাবে।
.
দাড়োয়ান আমাকে দেখেই জেলের বাহিরে থাকা লোহার শিকের ওপাশ থেকেই দৌড়ে এসে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বললো,
-ভাই, বিশ্বাস করেন আমি জীবনেও নিশি ভাবির সাথে খারাপ কিছু করিনাই এমনকি তাঁরে মারিও নাই। আমারে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাইয়া আমার বউ বাচ্চারে এতিম বানানো হইছে।
দাড়োয়ানের এহেন আর্তনাদ দেখে আমার মন কিছুটা নরম হলেও পরক্ষণেই কঠিন স্বরে তাঁকে বললাম,
-তুই না মারলে কে মারছে নিশিকে?
-ভাই আমি সত্যি বলতেছি জানিনা। আল্লাহর কছম।
ওর কথা শুনে নজরুল ভাই বলে উঠলো,
-আচ্ছা তুমি একটা জিনিস মনে করোতো! মারুফ ভাই যেদিন অফিসের কাজে খুলনা গিয়েছিলো তার পরে কী কেউ এসেছিলো ওনার খোঁজে?
দাড়োয়ান বেশ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো,
-হ হ ভাই। একজন আইছিলো।
আমি কৌতুহলী দৃষ্টিতে বললাম,
-কে কে এসেছিলো?
-একজন আধাবুড়া কইরা লোক! তিনি আগেও আপনার বাসায় আইছিলো। মনে হয় আপনার চাচা নাকি খালু জানি লাগে!
নজরুল ভাই অনেকটা লাফিয়ে উঠে বললেন,
-ইয়েস! দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেছে। আচ্ছা তুমি চিন্তা করোনা, তুমি যদি সত্যিই নির্দোষ হয়ে থাকো তবে অবশ্যই দুই একদিনের মধ্যে তুমি জেল থেকে বের হয়ে যাবে।
নজরুল ভাইয়ের কথা শুনে দাড়োয়ানের খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে উঠলো।
.
আমি তখন অলরেডী বুঝে গিয়েছি নিশির খুনি আর কেউ নয় বরং আমার বর্তমান শ্বশুর সম্পর্কে থাকা খালু। ইতঃমধ্যে আমি, নজরুল ভাই আর নিশি থানা পুলিশ নিয়ে আমাদের বাসার সামনে উপস্থিত হয়েছি। রাত এখন সাড়ে বারোটা..
আমার এতো দেরী হওয়াতে মিমি যদিও অনেকবার কল দিয়েছিলো তবে আমি সেটা রিসিভ করিনি। কারণ আমি বজ্রপাতের ন্যায় ওর সামনে উপস্থিত হতে চাই। পুলিশ ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলে নজরুল ভাই তাঁদেরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-দাঁড়ান প্রমাণটা আরেকটু দৃঢ় করে নেই। মারুফ ভাই আপনার শ্বশুরের নাম্বারটা দেনতো।
তাঁর কথামতো আমি মিমির বাবার নাম্বারটি তাকে দিতেই তিনি ডায়াললিষ্টে উঠিয়ে কল দিলেন। কিছুক্ষণ রিং বাজার অন্তর কলটি রিসিভ করতেই নজরুল ভাই লাউডস্পিকার করে দিলেন। ওপাশ থেকে আমার শ্বশুর বলে উঠলেন,
-হ্যালো কে বলছেন?
-আপনার জম বলছি। আপনার কী মনে আছে? গত একবছর আগে একটি মেয়েকে মেরে এক নির্দোষ দাড়োয়ানকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র আপনার মেয়েকে মারুফ নামের ছেলেটির সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য?
আমার শ্বশুর কিছুটা হকচকিয়ে বলে উঠলো,
-কে আপনি? আর কীসব আবোলতাবোল বকছেন এই রাতে?
-আবোলতাবোল নয়। আপনি যে মেয়েটিকে মেরেছেন তাঁর সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। এমনকি আপনি পুলিশকে টাকা খাইয়ে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট উলটে দিয়েছেন সেটার প্রমাণও আছে আমার কাছে।
এবার আমার শ্বশুর বেশ ভয় পেয়ে বললো,
-ভাই কে আপনি বলেনতো?
-আমি কে সেটা না জানলেও হবে। তবে এসব যদি আমাকে প্রকাশ করতে না করেন তবে আমি করবোনা। কিন্তু একঘন্টার মধ্যে যদি আমার মেসেজ করা ঠিকানায় চলে না আসেন তাহলে বুঝতেই পারছেন কী হবে?
-ভাই ভাই…
শ্বশুর কিছু বলার আগেই এপাশ থেকে নজরুল ভাই কলটি কেঁটে দিলেন। অতঃপর মেসেজে কী যেন একটি লিখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললেন,
-ভাই কাজ হয়ে গেছে। আমরা বরং এখানেই অপেক্ষা করি।
তাঁর কথামতো আমরা গেটের সামনে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতেই সিড়ি থেকে কারো হুড়মুড়িয়ে নামার আওয়াজ শুনতে পেলাম। গেটের সামনে আমাদেরকে পুলিশের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শ্বশুর মশাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। তবে সবচেয়ে অবাক হলেন নিশিকে দেখে। কারণ তাঁর ধারণা নিশিকে তো তিনি সেই কবেই মেরে ফেলেছেন তাহলে এখানে সে আসলো কীভাবে?
পুলিশের দায়িত্বে থাকা দুজন তাকে জাপটে ধরতেই সে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো,
-ভাই আমাকে ধরছেন কেন? আমি কী করেছি?
নজরুল ভাই তাঁর কাছে গিয়ে বললেন,
-আহা বুইড়াটা কী করছে তাও জানেনা। ঐ দেখ তুই যারে মারছিলি তাঁরে কবর থেকে উঠাইয়া আনছি। সেই আমাদের বলে দিছে তাকে কেমনে মারছিলি। শালায় তাড়াহুড়া করতে যাইয়া শার্টটাও উল্টা পরছে দেখছেন নি?
ডাকাতের ছোঁয়া থাকা আমার এই নিকৃষ্ট শ্বশুরের কথা আস্তে আস্তে আমার বাড়িতে সহ সব জায়গাতে ছড়িয়ে পরলো। মিমি তাঁর বাবার এরকম নিকৃষ্ট কাজের দরুন সে অতিকষ্টে বারবারই মূর্ছা যাচ্ছে। আমার মা যেখানে আমার সাথে মিমিকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপরে লেগেছিলেন আজ তিনিই তাঁর বোনকে আর মিমিকে দেখামাত্রই থুথু ছুড়ে মারলেন।
.
নিশির সাথে বসে আছি পার্কের একটি বেঞ্চে। কারো মুখ দিয়েই কোনো বাক্য পরিস্ফুটিত হচ্ছে না। নীরবতা ভেঙ্গে আমি নিশিকে বলে উঠলাম,
-তুমিতো সেদিন বেঁচে গিয়েছিলে তাহলে সেদিন কেন তুমি আমার কাছে চলে আসোনি?
-আমি এখনও জানিনা সেদিন কেনো আমি আসিনি তবে আমার মনে অনেক ভয় কাজ করেছিলো। তাছাড়া আমার আপন মা তখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলো আর তিনি যদি শুনতেন যে উনি যেই মেয়েকে এতো বড় করেছেন সেই মেয়েটিই খুন হয়েছে তখন তিনিও আর বেঁচে থাকতেন না। আর তোমার খালু যেহেতু নিজের মেয়েকে তোমার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্যই এতোকিছু করেছেন তাই আমিও আর তাঁর পথের বাধা হতে চাইনি। তবুও আমার মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিলো তাই আমি চেয়েছিলাম আড়ালে থেকে তোমার মাধ্যমে তাকে শাস্তি পাইয়ে দেওয়া যায় কীনা?
-আচ্ছা তাহলে কী আমরা আগের মতো আবার জীবনটা শুরু করতে পারিনা?
-না, কারণ তোমার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেক আগেই।
-কিন্তু ওটাতে তো আমি সাইন করিনি।
-সাইন না করলেও তিনমাস পর এমনিতেই হয়ে যায়। আর তোমার স্ত্রীরতো এখানে কোনো দোষ নেই সে তো এসবের কিছুই জানতো না।
পরমুহূর্তেই নিশি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
-তাছাড়া আমি নতুন একজনকে নিয়ে সুখে আছি। তুমিও সুখে থাকো তোমার স্ত্রীকে নিয়ে এই প্রত্যাশাই রইলো। আজ আসি।
এই বলেই নিশি পার্কের ছোট ছোট ঘাসের উপর দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো। আমি খুব ভালো করেই জানি নিশি কাঁদছে কারণ এই ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে কেউই নিজের মনে গেঁথে থাকা কষ্টকে প্রশমিত করতে পারেনা।
নিশিকে বিদায় দিয়ে বাড়িতে আসতেই দেখতে পাই মিমি আর মিহাদ দুজনেই আমার শাশুরীসহ লাগেজ গুছিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু বাসায় উপস্থিত থাকা কেউই তাঁদেরকে বাধা দিচ্ছে না বরং সবার মনেই তাঁদের প্রতি এক প্রকট ঘৃণার জন্ম নিয়েছে। আমাকে দেখেই মিমি মাথা নিচু করে অপর দুজনকে নিয়ে ঘর থেকে আস্তে করে বেরিয়ে গেলো।
ওরা বের হতেই নজরুল ভাই আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে বললেন,
-ধুর মিয়া, আপনি কী বোকা নাকি? বউ একটা হারাইছেন এখন এইটাও হারাইবেন নাকি? এখানেতো ওনাদের কোনো দোষ নাই।
তাঁর কথামতো আমি হঠাৎই ঘর থেকে বের হওয়ার মুহূর্তেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
-কই যান?
-ভাই বিয়ে অলরেডী দুইটা করে ফেলছি তাই আবার কোনো বিয়ে করতে চাইনা। তাই বউকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি।
আমার কথা শুনে নজরুল ভাই কিছুটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললেন,
-আপনার জন্য যে এতো গোয়েন্দাগিরি করলাম তাঁর বখশিশটা দিবেন কবে?
-বউকে আগে নিয়ে আসি তারপর আপনার যা যা লাগে সব দিবো।
এই বলেই আমি ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেলাম। কারণ যত যাই হোক মিমির মতো কেয়ারনেস ওয়ালা আর ভীতুমার্কা বউ আমি কোনোদিনই পাবোনা। তাকে যেভাবেই হোক আমার চাই। আপনারা সবাই ঘর থেকে নেমে তাকে বাধা দিন সে যেন চলে যেতে না পারে। দেখতে হবে না ভাবীটা কার?
.
(সমাপ্ত)
.
{ভুলত্রুটি মার্জনীয়}
[সকলের গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here