পৌষের কোন এক বিকেলে পর্ব -১২+১৩ ও শেষ

#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ১২
অপরাজিতা অপু

সবার সামনে দিয়ে এভাবে শাড়ি পরে বেরোতে ভীষণ অসস্তি হচ্ছিলো আমার। সেটা যে রুপম কে বোঝাতেই পারছি না। আর বোঝাবো বা কি করে তার সাথে তো কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি না। ওই তখন টেবিলে বসে যা কথা হয়েছে সেটাই। তারপর সে বাবার সাথে আবারো গল্প জুড়িয়ে দিয়েছে। বেশ অসস্তির মাঝে শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছি আমি। ভাবী এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। আমি তার চোখের দিকে তাকাতেই বলল
” তোমার দেখি সেন্সর খুব একটা কাজ করে না।”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ভাবী হাত থেকে শাড়িটা একদম ছিনিয়ে নিয়ে বলল
” এটা পরে বাইরে যেতে চাচ্ছো? বিয়ের পর প্রথম ঘুরতে যাচ্ছো। এমন একটা ফ্যাকাশে রঙের শাড়ি পরবে?”

আমি মুখটা অন্ধকার করে বললাম
” শাড়ি পরবো কিনা সেটাই ভাবছিলাম আর রং নিয়ে তো এখনো ভাবিনি।”

ভাবী নিজের কপালে হাত রাখলো। কিছুক্ষণ ভেবে বলল
” এতো কনফিউশন নিয়ে সংসার কিভাবে করবে বলো তো? তোমাকে দেখে আমারই টেনশন হচ্ছে।”

আমি উত্তর দিলাম না। ভাবী আলমারি খুলে বেশ সময় নিয়ে একটা শাড়ি বের করে বলল
” এটা পরো। দেরি করবে না।”

আমি হাতে নিয়ে বসে পড়লাম বিছানায়। ভাবী বেরিয়ে গেলো। আমিও নিজের মত রেডি হয়ে দরজায় দাড়ালাম। আমার ঘরের দরজার ঠিক সামনা সামনি বসে আছে রুপম। বাবার সাথে গল্পে মত্ব। আমি অনেক্ষণ ধরেই সেখানে দাড়িয়ে আছি। রুপম বেখেয়ালি ভাবে এক পলক তাকাল আমার দিকে। তারপর খুব সহজ ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে নিলো। আমি একটু বিরক্ত হলাম। নিজেই আবদার করেছিলো শাড়ীতে দেখতে চায় আর এখন তাকানোর ফুরসৎ পাচ্ছেন না জনাব। অভিমানে ভারী হয়ে উঠলো বুক। আমি সেখান থেকে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পর ভাবী এসে বলল
” বাইরে চলো।”

অভিমানী আমি মান ধরে রেখেই বললাম
” ওনাদের গল্প শেষ হয়েছে?”

” হয়েছে।”

আমি কথা বাড়ালাম না। বাইরে গেলাম। রুপম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেতেই মাকে বলল
” আমরা আসছি মা।”

রুপম এর মুখে মা ডাক শুনে আমার মায়ের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো মা। রুপম সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমাকে বলল
” চলো।”

আমি মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলাম তার সাথে। পাশাপাশি হাঁটছি দুজন রাস্তার ধারে ঘেঁষে। কেউ কোন কথা বলছি না। আমি নাহয় অভিমান করেছি। কিন্তু এই লোকটার কি হয়েছে। কেনো কথা বলছে না আমার সাথে। আমি মনে মনে ভীষণ রাগ করলাম। নিজে থেকে কথা বলবো না একদম। যার কাছে আমার রাগ অভিমান এসবের কোন মূল্য নেই তার সাথে কথা বলার প্রশ্নই উঠে না। রুপম হাত উচিয়ে একটা রিক্সা থামালো। তারপর রিক্সায় উঠে বসলো। আমি দাড়িয়ে রুপমের দিকে তাকিয়ে আছি। একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে রিক্সায় বসলাম। ঠিক প্রথম দিনের মতই এক পাশ ঘেঁষে বসলাম। রিক্সা চলতে শুরু করেছে। বেশ অনেক্ষণ হল কেউ কোন কথা বলছি না। এবার আমার অসস্তি হচ্ছে। আমি আর চুপ করে থাকতে পারছি না। কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম
” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

রুপম আমার দিকে তাকালো না। কিছুটা হেয়ালি করে বলল
” কেনো? না জানলে কি যাওয়া যাবে না?”

আমি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালাম। রুপম সামনের দিকে তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করলো। তার মাঝে কোন অভিব্যক্তির পরিবর্তন ঘটলো না। আমি তার আচরণে ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছি। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম
” জানলেও কি কোন সমস্যা আছে?”

রুপম বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল
” জানতেই হবে কেনো? আমি সাথে আছি সেটাই কি যথেষ্ট নয়? নাকি মনের সন্দেহ আছে যে কিডন্যাপ করে কোথাও নিয়ে যাবো।”

রুপম এর কথা শুনে আমার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। আমিও খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম
” হতেও তো পারে। কিভাবে বিশ্বাস করি। আজকাল কার মানুষকে একদম বিশ্বাস নেই। আর কদিনই বা হয়েছে আপনার সাথে ঘুরতে যাওয়া।”

আমার কথাটা যে রুপমের ইগো তে লেগেছে সেটা তার চাহুনি দেখেই বুঝেছি। আর মনে মনে খুব খুশি হয়েছি। এতক্ষণ যা ভাব নিচ্ছিলো এখন একটু হলেও জব্দ হয়েছে। রুপম হুট করেই আমার দিকে ঝুঁকে গেলো। তার উষ্ণ নিশ্বাস আমি আমার মুখের উপরে অনুভব করছি। এভাবে হুট করেই এতো কাছে আসার ব্যাপারটা আমার কাছে অসস্তিকর হয়ে উঠলো। আমি একটু পেছনে হেলতেই সে এক হাতে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে বলল
” পড়ে যাবে। শেষে কিনা ঘুরতে যাওয়া বাদ দিয়ে হাসপাতালে হানিমুন করতে হবে।”

আমি স্থির হয়ে গেলাম। অস্থির নিশ্বাস ফেলে ভেংগে ভেংগে বললাম
” হানিমুন মানে?”

রুপম ঠোঁটের কোন প্রশস্ত করে বলল
” স্বামী স্ত্রী বিয়ের পরে হানিমুন করতে যায় এটা জানো না? ঠিক আছে আমি বুঝিয়ে দেবো। ইন ডিটেইল।”

রুপম ঠোঁট টিপে হেসে আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসল। আমিও সোজা হয়ে বসলাম কিন্তু দম এখনো বসছে না। আমার সামান্য খোঁচা মারা কথার বিনিময়ে এমন একটা কান্ড ঘটালো সেটা বুঝতে বাকি রইলো না আমার। আমি অবচেতন মনে আবারো জিজ্ঞেস করলাম
” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

রুপম হেসে ফেলে বলল
” বললাম তো হানিমুনে।”

হঠাৎ ই আমার মনে ভয় গ্রাস করল। কিসের ভয় বুঝতে পারলাম না। তবে আমি এখনই কেঁদে ফেলার জোগাড়। কাদো কাদো কণ্ঠে বললাম
” প্লিজ! সত্যি কথা বলেন না।”

রুপম এবার হেসে উঠলো অদ্ভুতভাবে। আমি তাকালাম। আমাকে এভাবে ভয় পেতে দেখে সে বেশ মজা পাচ্ছে। হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকালো। বেশ আদুরে কণ্ঠে বললো
” ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। অধিকার থাকলেও সেটা জোর করে আদায়ে আমি বিশ্বাসী নই।”

বলেই আমার হাতে হাত রাখলো। আমি রুপমের স্পর্শে মৃদু কেপে উঠলাম। সে বুঝল কিনা জানি না। তবে আলতো করে ধরে থাকা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল
” এই হাতটা যতক্ষণ তোমার এই হাত ধরে রাখবে ততক্ষণ কোন ভয় নেই আজরা। তুমি আমার কাছে আমার থেকেও দামী। আমার জীবনের সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। তবে আমি না থাকলে সে অন্য কথা।”

রুপম এর শেষের বাক্যটা আমার বুকের ভেতরে আঘাত করলো। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পিটপিট করে পানি আটকাবার চেষ্টা করে বললাম
” আপনি কেনো থাকবেন না?”

রুপম মৃদু হেসে বলল
“মানুষ কি সারাজীবন থাকে? কে জানে এই আছি হয়তো এই থাকবো না।”

আমি প্রায় কেদেই ফেললাম। রুপম এর ফোন বাজলো। আমি কোন রকমে চোখের পানি আটকিয়ে রাখলাম। ওপাশ থেকে কি বলল শুনতে পেলাম না। কিন্তু এপাশে রুপমের অস্থিরতা বেড়ে গেলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল
” ফাইল টা তো আমি বাসায় রেখেছি। কাল অফিস থেকে আসার সময় সাথে এনেছিলাম। রাতে চেক করবো বলে।”

থেমে গেলো রুপম। ওদিকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল
” কিন্তু আমি তো আজ ছুটিতে।”

খানিকবাদেই হতাশ সুরে বলল
” আচ্ছা ঠিক আছে। দেখছি।”

ফোনটা কেটে হাতের মুঠোয় ধরে কি একটা ভাবলো। আমি তার ভাবনা দেখে বললাম
” কোন সমস্যা হয়েছে?”

রুপম সামনে তাকিয়েই বলল
” আমাকে একটু অফিসে যেতে হবে। তুমি আমার সাথে বাসায় যাবে আজরা? তোমাকে বাসায় রেখে আমি শুধু অফিসে যাবো আর আসবো। বেশি দেরি করবো না।”

আমি মাথা নাড়লাম। রুপম রিক্সা ঘুরিয়ে ওর বাসার দিকে নিয়ে যেতে বলল। বাসার সামনে এসে রিক্সা থেকে নেমে ভেতরে নিয়ে গেলো আমায়। আমি বেশ ইতস্তত বোধ করছি। রুপম আমার অবস্থা বুঝে বলল
” তোমাকে দেখলে সবাই অনেক খুশি হবে। আগে ভেতরে চলো তারপর বুঝতে পারবে।”

আমি মনে সাহস নিয়ে ভেতরে গেলাম। রুপম এর কথা সত্যি। আমাকে দেখে তার পরিবারের লোকজন বেশ খুশি হলো। আমাকে তো ওর মা পাশে বসিয়ে গল্প জুড়ে দিলো। রুপম এক পর্যায়ে বলল একটা ফাইল দিতে অফিসে যেতে হবে। দিয়েই চলে আসবে। রুপম বিদায় নিয়ে চলে গেলো। রুপম এর মা তো আমাকে দেখে রান্না করতে শুরু করে দিলেন। রাতে না খেয়ে নাকি যেতে দেবে না। নিরুপায় আমি কোন কথা বলার সুযোগ পেলাম না। সময় পেরিয়ে গেলো। দুপুরে আমরা সবাই খেতে বসবো। কিন্তু রুপম এখনো আসেনি। শাশুড়ি মা আমাকে বললেন রুপম কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে। আমি ফোন দিলাম কিন্তু বন্ধ পেলাম। ভাবলাম হয়তো কাজে ব্যস্ত তাই ফোন বন্ধ করে রেখেছে। শাশুড়ি মাকে বললে তিনি কিছুটা ভাবুক হয়ে বললেন
” রুপম তো কখনো ফোন বন্ধ রাখে না। মিটিং এ গেলেও সাইলেন্ট করে রাখে। আমার অভিজ্ঞতা নেই বিধায় তেমন কিছুই বললাম না। শাশুড়ি মা কিন্তু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তার চিন্তা দেখে আমার মনে হলো অযথাই তিনি এমন করছেন। আমি তবুও কিছু বললাম না। রুপম এর বোন টিভি অন করলো। আমাকেও টিভি দেখতে ডাকলো কিন্তু আমি শাশুড়ি মায়ের সাথে গল্প করে সময় কাটাতে চাইলাম। এক সময় আমাদের গল্পের মাঝেই রুপমের বন চিৎকার করে উঠে বলল
” মা এদিকে আসো। দেখো কি হয়েছে?”

আমরা দুজনই সেখানে গেলাম। সে টিভির দিকে ইশারা করে দেখতে বলল। আমরা সেদিকে তাকালাম। তাকাতেই আতকে উঠলাম। টিভির স্ক্রীনে বড়ো করে ব্রেকিং নিউজ চলছে।

” এল সি কোম্পানিতে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৭ টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে।”

একজন সাংবাদিক লাইভ রিপোর্ট করছেন।
“৪ তলা এই অফিসে কয়েক হাজার কর্মী কাজ করতেন। তাদের মধ্যে প্রায় সবাই বের হয়ে এসেছেন। তবে তিনতলায় কয়েকজন কর্মী বের হতে পারেন নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চেষ্টা করেও তাদের কে বের করতে সক্ষম হন নি। ধারণা করা হয় তারা সবাই মৃ ত।”

শাশুড়ি মা সোফায় বসে পড়লেন। তার দৃষ্টি টিভির স্ক্রীনে স্থির। মেয়েকে বললেন
” রুপম এর কলিগ সায়েমকে ফোন কর। রুপম এর খবর নে। অফিসে আগুন লেগেছে। ছেলেটা আমার কেমন আছে।”

বলতে বলতেই তিনি কেঁদে ফেললেন। আমার বুকের ভেতরটা কেপে উঠলো। রুপম এর বোন তার কলিগ কে ফোন দিলো। তার কথা শুধু শুনতে পেলাম। সেটা শুনেই আন্দাজ করলাম রুপম ভেতরে আটকা পড়ে আছে। কি অবস্থায় আছে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আমার পুরো দুনিয়া ঘুরে গেলো। শাশুড়ি মা এক চিৎকার দিলেন। আমার মাথা ঘুরে গেলো। আমি সোফায় বসে পড়লাম। একটা কথা শুধু মাথায় ঘুরছে।

“মানুষ কি সারাজীবন থাকে? কে জানে এই আছি হয়তো এই থাকবো না।”

চলবে

( আজকের পর্বটা রিচেক করার ইচ্ছা নেই। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
শেষ পর্ব
অপরাজিতা অপু

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে কেটে গেলো শত শত মুহূর্ত। হাসি কান্না দিয়ে জড়ানো সেসব মুহূর্ত জীবনের একেকটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে স্মৃতির পাতায় গাঁথা থাকবে। কেটে গেলো একটা বছর। এক পৌষ পেরিয়ে আরেক পৌষ এলো জীবনে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা শহরে শিরশিরে হাওয়া বইছে। জনজীবন শীতের প্রকোপে অস্থির হয়ে উঠেছে। কেউই জরুরি কাজ ছাড়া তেমন বাইরে বেরোচ্ছে না। ছাদের উপরে দমকা হাওয়ায় কাপড় গুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমি সোয়েটারের উপরে চাদর জড়িয়ে ছাদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই ধোয়ার মতো কুয়াশা ভেসে এসে আমাকে ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। ঠান্ডার দাপট থেকে বাঁচতে চাদরের কিছু অংশ দিয়ে নাক ঢেকে ফেললাম। হুহু করে বাতাসটা শরীর কেপে তুলছে। কাপতে কাপতে কাপড় গুলো তুলে নিয়ে দ্রুত নিচে এলাম। তবুও শরীরের কপুনি গেলো না। আমাকে কাপতে দেখে ভাবী বলল
” আহা রে! এখনই কাপড় আনতে হবে? পরে আনা যেত না? কি অবস্থা হয়েছে।”

বলেই হাত থেকে কাপড় গুলো নিয়ে সোফায় ফিকে দিয়ে আমাকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলো। কম্বল দিয়ে আমাকে মুড়ে দিয়ে বলল
” ঠাণ্ডা লাগানো যাবে না তোমার।”

আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমাকে রেখে রান্না ঘরে গেলো। কিছু সময় পরে এক কাপ লাল চা বানিয়ে নিয়ে এলো। আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
” এটা খেয়ে নাও।”

আমিও ভদ্র মেয়ের মতো কোন কথা না বলে চায়ে চুমুক দিলাম। লেবুর গন্ধ টা নাকে লাগতেই মন টা পরিবর্তন হয়ে গেলো। এই লেবু চায়ের সাথে জড়িয়ে আছে আমার অনেক স্মৃতি। আমি ভাবুক হয়ে বললাম
” অনেকদিন পর এমন লেবু চা খেলাম।”

ভাবী আমার পায়ের কাছে বসে ফেসবুক চালাচ্ছিল। আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকালো। আমি তার দিকে তাকাতেই মুচকি হেসে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। ফোন চালাতে চালাতে বলল
” তুমি তো লেবু চা পছন্দ করো না। আমার বিয়ের পর থেকে কখনো খেতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে ইদানিং খেয়াল করছি শীত পড়লেই লেবু চায়ের প্রতি কেমন দুর্বলতা বেড়ে যায়।”

কথাটা শেষ করেই আবার ঠোঁট টিপে হাসলো। আমি বেশ বুঝতে পারলাম আমাকে খোটা দিয়ে কথা টা বলল। আমিও গায়ে মাখিয়ে নিয়ে বললাম
” শীতের দিনে লেবু চা অনেক উপকার। আমি মাঝে মাঝেই খাই। শুধু আমি কেনো এটা সবারই খাওয়া উচিত।”

ভাবী আবারো ঠোঁট টিপে হেসে বলল
” বুঝেছি।”

আমার বেশ রাগ হলো। ইদানিং সামান্য কারণেই মেজাজ হারিয়ে ফেলি। অভিমানটাও কেমন যেনো বেশি হয়ে গেছে। নিজেকে এলোমেলো লাগে। ভাইয়ার গলার আওয়াজ পেলাম। ভাবীকে ডাকছে। ভাবীও দ্রুত চলে গেলো। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম। তারপর গ্যালারী তে ঢুকলাম। একের পর এক ছবি স্লাইড করছি। হঠাৎ করেই একটা বিশেষ মানুষের ছবি সামনে এলো। হাস্যজ্বল চেহারা দেখে আমার বুকের ভেতরটা কেমন শীতল হয়ে উঠলো। আচমকাই চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগলো। আমি ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এক সময় কান্নার বেগ বাড়তেই আমি ফোনটা ছুড়ে ফেলে মারলাম। তবুও কান্না থামলো না। বাইরে মায়ের গলার আওয়াজ পেলাম। চোখটা মুছে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছি। মা ঘরে ঢুকেই আমাকে বলল
” তোর শাশুড়ি ফোন করেছিলো। তারা দুপুরে আসছে তোকে দেখতে।”

আমি কথার জবাব দিলাম না। উল্টা চোখ বন্ধ করে বললাম
” আসুক। আমার শরীর ভালো লাগছে না। আমি এখন ঘুমাবো। দরজা বন্ধ করে দিয়ে যাও।”

মা কি বুঝে আর দেরি করলো না। দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে গেলো। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে রুপমের নাম্বারটাতে কল দিতে গিয়েও দিলাম না। এক পাহাড় সমান অভিমান জমে আছে এই বুকে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে আমার। শাশুড়ি এসে কি লাভ যার খোঁজ নেয়া দরকার সে তো খোঁজ নেয়না। আর বাকি সবাই খোঁজ নেয়ার দরকার নেই। আমি অভিমানে টইটুম্বুর হয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। অনবরত গড়িয়ে পড়ছে। আজ আমার কান্না থামানোর কোন ইচ্ছা নেই। প্রায় দুইদিন হয়ে গেলো রুপমের কোন খবর নেই। এতো কি কাজে ব্যস্ত যে আমাকে একটা ফোন করার সুযোগ পায়না। আমার জানা মতে এই দুইদিন তার ছুটি ছিলো। তবুও সে আমাকে ফোন দেয়নি। এর কারণ কি হতে পারে? মাথায় নানা রকম চিন্তা ঘুরঘুর করছে। পাশের বাড়ির আনটি এসেছিলো গতকাল। গল্পের এক পর্যায়ে খুব দুঃখ করে বলল তার মেয়ের জামাই নাকি এমনই অফিস থেকে ট্রেইনিং এ ৩ মাসের জন্য গিয়েছিলো। এক সময় ধীরে ধীরে মেয়ের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। জামাইয়ের হাবভাব ভালো বুঝতে না পেরে তারা খোঁজ নেয় গোপনে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে জামাইয়ের নাকি আরো একটা বউ আছে। অফিসের ট্যুরের কথা বলে সেখানে যায়। আমার মাথাটা ঘুরে উঠলো। কি থেকে কি ভাবছি আমি। মন বলছে রুপম এমন কাজ করতেই পারে না। আবার মস্তিষ্ক বলছে মানুষ পরিবর্তন হতে সময় লাগে না। আমার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। উপায় না দেখে রুপমের নাম্বারে ফোন করলাম। কিন্তু রিং হয়ে কেটে গেলো। ফোনটা তুললো না। আমি আবারো কাদতে শুরু করলাম। রুপম আমার সাথে এমন কেনো করছে। বিছানা ছেড়ে জানালার ধারে দাড়ালাম। বাইরে কুয়াশা ভেদ করে রোদের প্রখরতা বাড়ছে ধীরে। আমি সেদিকে তাকিয়ে ভাবছি। এই একটা বছরে এই মানুষটা আমার জীবনের সবথেকে কাছের একজন হয়ে উঠেছে। এক বছর আগেও যে মানুষটাকে জীবনসঙ্গী বানাতে আমার ছিলো একরাশ সংশয়। সেই মানুষটাই আজ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এই ব্যাপারটা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেনি আমার। যেদিন রুপমের অফিসে আগুন লেগেছিল সেদিনই আমি অনুভব করেছিলাম যে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এই মানুষটার প্রতি আমার দুর্বলতা আছে। বিয়ের কালেমা পড়ে যখন স্বামী হিসেবে স্বীকার করেছিলাম তাকে তখনই তার প্রতি এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হয়েছিল আমার। তবে সেটা উপলব্ধি করতে কিছুটা সময় লেগেছে। সেদিন টিভি তে নিউজ দেখে যখন জানতে পারলাম রুপম অফিসের ভেতরে আর তার কোন খবর পাওয়া যায়নি তখন আমার ভেতরটা কেপে উঠেছিল। দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল আমার। এক মুহূর্তেই যেনো রুপম কে হারিয়ে ফেলার অনুভূতি হলো ভেতরে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। তারপর কতক্ষণ অমন অবস্থায় ছিলাম সেটা জানিনা। তবে যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন চোখের সামনে রুপম কে দেখতে পেয়ে যেনো নিজের নিশ্বাস অনুভব করতে পেরেছিলাম। নিজেকে জীবন্ত অনুভব করেছিলাম। বুকের ভেতরের হৃদপিন্ডটা তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল। রুপম আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলেছিল
” এখন কেমন আছো আজরা?”

আমি তখন নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সবার সামনেই রুপম কে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম। চিৎকার করে উঠে বলেছিলাম
” তুমি আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না। কোনদিন যাবে না।”

রুপম সেদিন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল
” ঠিক আছে যাবো না। এখন শান্ত হও। আমি এসেছি তো।”

আমি হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লাম। কিন্তু সে তার কথা রাখেনি। আমাকে রেখে চলে গেছে অফিসের কাজে। তার নাকি ২ মাসের ট্রেইনিং আছে। একবার ভাবলো না আমার মন খারাপ হতে পারে। আমি ভীষণ অভিমানে জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নিতেই পেটে এক মিষ্টি ব্যাথা অনুভব করলাম। শরীরে নতুন এক অস্তিত্বের অনুভূতি। মায়ের এই একাকিত্ব সময়ে সে যেনো নড়েচড়ে জানান দিচ্ছে আমি একা নই। আমার শরীরের ভেতরে বড়ো হচ্ছে আমাদের অংশ। হ্যা রুপম আর আমার অংশ। দরজায় টোকা পড়তেই আমি চকিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালাম। ভাবী এসে ঘরে ঢুকে বলল
” তোমার শাশুড়ি আর ননদ এসেছে। বাইরে আসো।”

আমি কোন কথা না বলে বাইরে চলে গেলাম। আমার শাশুড়ি মা আমাকে কাছে বসিয়ে বললেন
” তোমার শরীর কেমন মা?”

আমি নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললাম
” আলহামদুলিল্লাহ! ভালো আছি মা। আপনি কেমন আছেন?”

” ভালো আছি। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করছো তো?”

আমি মাথা নাড়লাম। দুপুরে আমরা সবাই একসাথে খেলাম। মা আর আমার শাশুড়ি মা দুজন এক ঘরে বসে গল্প করছে। আর আমি ভাবী আর আমার ননদ তিনজনে আমার ঘরে বসে গল্প করছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। দরজায় কলিং বেল বাজলো। ভাবী আমাদের বসিয়ে রেখে দরজা খুলতে গেলো। একটু পর দৌড়ে এসে বলল
” রুপম এসেছে। বাইরে আসো।”

আমি অবাক হলাম। হৃদপিণ্ডের ধুকধুকানি আওয়াজটা বেড়ে গেলো। রুপম এসেছে অথচ আমাকে কিছুই জানালো না। মানুষটার সারপ্রাইজ দেয়ার সভাবটা গেলো না। কিন্তু আমি খুশি হলেও সেটা কেনো প্রকাশ করবো। সে তো আমার খবর নেয়নি। তাই নিজের অভিমানটা ধরে রাখলাম। আমার ননদও বাইরে চলে গেলো। আমি গেলাম না। কম্বল জড়িয়ে ভালোভাবে শুয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর রুপম এলো। আমি নিজেকে শক্ত রাখলাম। দেখেও না দেখার ভান করে থাকলাম। রুপম আমার পায়ের কাছে বসলো। আমি তবুও নড়লাম না। সে এক পর্যায়ে আমার শরীর থেকে কম্বল টা সরিয়ে দিলো। আমি বিরক্ত হলাম। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে আমার পেটে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করে হাত রেখে বলল
” কেমন আছো? মিস করেছো বাবাকে? বাবাও তোমাকে অনেক মিস করেছে। বাবা অনেক সরি। আর কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবে না। প্রমিস।”

আমি হাতটা সরিয়ে দিলাম। রুপম রাগ দেখিয়ে বলল
” বিরক্ত করছো কেনো? আমি তো তোমাকে বিরক্ত করছি না।”

আমি রেগে গিয়ে বললাম
” তো কাকে বিরক্ত করছো? আমার পেটেই তো হাত দিয়েছো।”

” সে তোমার ব্যাড লাক যে আমার সন্তান তোমার পেটে। নাহলে তোমাকে ছোঁয়ার প্রয়োজন ছিলো না।”

আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছি। আমার সমস্ত মন খারাপ একসাথে হানা দিলো। চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তেই রুপম মুচকি হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল
” একদম কাদবে না। চুপ করো। কাদছো কেনো? আমি তো দুষ্টুমি করলাম। তুমি কি কিছুই বোঝনা আজরা?”

আমার অভিযোগের পাহাড় ভেংগে গেলো। আমি ঝেড়ে ফেলে বললাম
” ফোন করো নি কেনো আমাকে? আমি ফোন দিয়েছিলাম তাও ধরনি। কেনো? আমার টেনশন হয়না?”

রুপম আমার কপালে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করে বলল
” সরি! একটা জরুরী মিটিংয়ে ছিলাম। তাই সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম। মিটিং শেষ করেই তোমার কাছে চলে এসেছি। এই যে দেখো। আর কোথাও যাবো না। একদম প্রমিস্।”

আমি কেঁদে ফেললাম। রুপম তার বুকে আমাকে আগলে নিলো। কি অদ্ভুত অনুভূতি। এমনই এক পৌষের বিকেলে এই মানুষটা আমার জীবনে এসেছিলো। আজও সেই পৌষ মাস। আর আমার ভেতরে নতুন এক অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। পৌষের কোন এক বিকেলেই আমার জীবন পরিবর্তন হয়ে গেলো।

সমাপ্ত

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here