প্রণয় আসক্তি পর্ব ২৪+অন্তিম

#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ২৪

ছোট্ট ছোট্ট আলোকিত প্রদীপ ও রঙবেরঙের বেলুন দিয়ে কক্ষ টা সুন্দর করে সাজানো।কক্ষের বিছানার উপর বিভিন্ন রঙের চিরকুট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আছে গোলাপ,কাঠগোলাপ ও শিউলি ফুলও।পুরো কক্ষ জুড়ে একটি মিষ্টি ঘ্রাণ নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।এ এক অদ্ভুত নেশা ধরানো পরিবেশ, রোমান্টিকতায় ভরপুর!
খাবার ও সেই সাথে কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে রিসোর্টের কক্ষে ফিরে নিজের কাছে থাকা চাবি দ্বারা দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করতেই চমকে যায় আর্শ।পুরো কক্ষে চোখ বুলোতেই মুগ্ধতায় ভরে ওঠে তার হৃদয়।তবুও এতোসব সৌন্দর্য উপেক্ষা করে তার আঁখিযুগল নিজের হৃদহরণি কন্যার সন্ধানে ব্যস্ত।
নিজ স্ত্রীর দেখা পাবার মনোবাসনা নিয়ে এক কদম আগাতেই বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই চিরকুটগুলোর দিকে আবারও নজর যায় আর্শের।প্রতিটি চিরকুটে মিয়ামির ব্যক্ত করা অনুভূতি গুলো পড়বার লোভ সামলাতে না পেরে বিছানার দিকে অগ্রসর হয় আর্শ।বিছানার এক কোণে বসে হলুদ রঙের একটি চিরকুট নিজের হাতে তুলে নেয় সে।অতঃপর তার ভাঁজ খুলে তাতে লেখা অক্ষরগুলোয় চোখ বুলিয়ে নেয়।

“অপ্রিয় ভাইটু,
আজ আমার ক্লাস সেভেনের ক্লাস পার্টি ছিলো।তাই অনেক কান্নাকাটি করে আম্মুকে রাজি করিয়ে তার নীল রঙের একটা শাড়ি পড়ে কলেজে গিয়েছিলাম।গিয়ে দেখি তুমি আর্শিকে স্কুল অব্দি দিতে এসেছো কিছুটা হলদে রঙের পাঞ্জাবি পরে।আচ্ছা,এভাবে নীল-হলুদ রঙ মিলে যাওয়াটা কি উপরওয়ালার কোনো ইশারা?এমন নয়তো যে,তুমি আমার হিমু আর আমি তোমার রুপা?”

চিরকুটটি পড়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আর্শের।এ চিরকুটটি সে আরো ২ বার পরে আবারও ভাঁজ করে বিছানার উপর রেখে লাল রঙের একটি চিরকুট হাতে তুলে নেয়।

“অপ্রিয় ভাইটু,
অপ্রিয় হলেও তুমি না আমার খুব প্রিয়! জানি না আজকাল তোমায় দেখলে কেমন যেনো লজ্জা লজ্জা লাগে।লুকিয়ে লুকিয়ে তোমায় দেখতে ভালো লাগে,তোমায় নিয়ে রাত-দিন ভাবতে ভালো লাগে, তোমার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে, তোমার কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে ভালো লাগে আরো অনেক ভালোলাগা মিশে আছে তোমাতে।আগেও তোমায় ভালোই লাগতো।তবে এখনের অনুভূতিগুলো কেমন যেনো ভিন্ন।”

ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে আর্শের।প্রেমের শুরুর দিকে এইযে অনুভূতিগুলোর কোনো নাম দিতে চেয়েও না পারা,কেমন এক বিভ্রান্তির সম্মুখীন হওয়া এই সময়টা উপভোগ করার মতো।প্রেমে এই সময় টাই বেশি সুন্দর।মিয়ামির চিরকুটটি পড়ে আর্শেরও ঐ সময়টার কথা মনে পরে যাচ্ছে।সেই সুন্দর অনুভূতিরা আরো একবার তার হৃদয় ছুঁয়ে দিচ্ছে।

মিয়ামির এ চিরকুটটি পরে আর্শ বুঝতে পারছে যে,এ চিরকুটটি লেখার সময় থেকেই মিয়ামি ধীরে ধীরে আর্শের প্রতি তৈরি হওয়া তার অনুভূতিগুলোকে বুঝতে আরম্ভ করেছিলো।
লাল চিরকুটটি রেখে এবার একটি কালো চিরকুট হাতে নিলো আর্শ।এতে কিছুটা রুপালি রঙের কালি দিয়ে লেখা আছে,

“অপ্রিয় অপ্রিয় অপ্রিয়,
জানতে চাও কেনো এতো অপ্রিয় তুমি আমার?
সবসময় গম্ভীর মুখ রাখো,কথা তো মুখ দিয়ে বাইর হয় না আর হইলেও শুধু বকা।এতো বকো কেন হ্যা?করল্লা কোথাকার!”

এবার একটু বেশিই হেসে ওঠে আর্শ।এমনিও সে একটু কম কথা বলে,যা তার স্বভাব।ছোটবেলা দিয়েই চাপা স্বভাবের সে।আর অন্য সবার সাথে মোটামুটি ভালোভাবে কথা বললেও মিয়ামির সাথে কমই বলতো,মেয়েটি সামান্য ভুল করলেও বকতে ছাড়তো না আর্শ।ঐ যে কথায় আছে না,চোরের মন পুলিশ পুলিশ! ভালোবাসাটাকে লুকোতেই তার এই একটু রুক্ষ ব্যবহারটা।
এভাবেই আরো অনেক চিরকুটের মাঝে লাভ আকৃতির হরেক রঙের একটি চিরকুট রাখা আছে।আর্শ আর সময় অপচয় না করে সেই চিরকুটটি নিজের তুলে নেয়।ভাঁজ খুলে তাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে।

“প্রিয় অর্ধাঙ্গ,
জানো,আজ একটি বিশেষ দিন!আজ থেকে ঠিক ৩১ দিন আগে দুটা অর্ধেক হৃদয় এক হয়ে পূর্ণতা লাভ করেছিলো।এ প্রাপ্তি টা ছিলো অনেক বড়!ঠিক তেমনই আজও একটি প্রাপ্তির দিন।আজ পুরো ৩০ দিন তুমি নেশার জগৎ থেকে দূরে ছিলে।ড্রাগস ভুলে তুমি মিয়ামিতে আসক্ত ছিলে।আর বেশি দিন নয়, আর্শ।২-৩ মাসে তুমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।আমি জিতে গিয়েছি আর্শ।আমার আর্শ আসক্তি জিতে গিয়েছে।”

চিরকুটটি পড়তেই চোখমুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করছে আর্শের।ঠোঁটে এক বৃহৎ হাসি তার।তার বিন্দু পরিমাণ খেয়াল ছিলো না যে আজ এক মাস যাবত সে ড্রাগস সেবন করেনি।যে ছেলে দুটো দিন ড্রাগস না নিলে তৃতীয় দিন পাগলের মতো আচরণ করতো সে আজ এক মাস ড্রাগস নেয়নি! সত্যিই এ বিজয়টি আর্শের একার নয় বরং মিয়ামিরও।মেয়েটি সকাল ৯-১০ টার আগে কোনোক্রমেই ঘুম থেকে উঠতে চাইতো না।সেই মেয়ে এই একমাস ভোর ৫ টায় উঠেছে।আর্শ না উঠতে চাইলেও তাকে জোর করে উঠিয়ে আগে নামাজ তারপর মেডিটেশন করিয়েছে।কত রাত আর্শ ঘুমোতে পারেনি,ছটফট করেছে আর মিয়ামি রাত জেগে আর্শকে সামলানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গিয়েছে।আসলে মানসিকভাবে একটা মানুষকে সহযোগিতা প্রদান করলে একটি মানুষ নিজের মনোবল দিয়েই অনেক অসাধ্যকে সাধন করে নিতে পারে।কিন্তু এই মানসিক সহায়তা প্রদান করাটাই যথেষ্ট কষ্টসাধ্য কাজের মাঝে একটি।আর এ কাজটিই মিয়ামি নিজের জায়গা থেকে বিনা কোনো ত্রুটিতে করতে সক্ষম হয়েছে।সত্যিই তার আর্শ আসক্তি জয়ী।

!!
সখ করেই আজ রাঁধতে ইচ্ছে করছে আর্শির।তাই আর সময় ব্যয় না করে ফ্রিজ থেকে গরুর মাংসের একটি প্যাকেট বের করে তা পানিতে ভিজিয়ে রেখে আবারও নিজের কক্ষে ফিরে আসে সে।বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ভাবছে,মাংস টা কিভাবে রান্না করবে?আগে একবার রেঁধেছিলো সে তাও ইউটিউব দেখে।কিন্তু এখন তো রান্না টা মনে নেই।
ভাবনার মাঝেই ফোনে ম্যাসেজ আসার শব্দ কানে আসে আর্শির।ফোনটি হাতে নিতেই দেখতে পায় বিহান ম্যাসেজ দিয়েছে।
“কি করো?”
উত্তরে আর্শি লিখে পাঠায়,
-শুয়ে শুয়ে ভাবছি,গরুর মাংস কিভাবে রাঁধবো!
-ওহ আচ্ছা।
বিহানের ম্যাসেজের উত্তরে আর্শি কিছু বলার জন্যে টাইপিং শুরু করেও থেমে যায়।হঠাৎ তার মনে পরে বিহান নিজের রান্না নিজে করে তাও ছাত্র জীবন থেকেই।ছেলেটির হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগ তো আর্শির হয়নি তবে ছেলেটির রেসিপি নিয়ে নিজে তো রেঁধে খেতেই পারে।যেই ভাবা সেই কাজ!আর্শি দ্রুত লিখে ফেলে,
-এই,আমাকে গরুর মাংস রাঁধা শিখাবেন?
-গরুর মাংস তো অনেকভাবে রান্না করা যায়।কোন ভাবে শিখবা?
-সব থেকে সহজ যেটা।
-উম,সবই তো সহজ।আসলে,মাংস রান্না করা অনেক সহজ।
-হ,নিজে পারেন তো তাই সহজ লাগে সব।আমার দিক থেকে ভেবে বলেন কোন পদ্ধতি সহজ।
-সব মশল্লা একবারে দিয়ে তার সাথে সামান্য পানি যোগ করে একটু সময় নিয়ে মশল্লা কষাবা।মশল্লা যত সময় নিয়ে জ্বাল করবা তরকারির টেস্ট তত ভালো হবে।মশল্লা প্রায় ৫ মিনিট কষানোর পর মাংস দিয়ে ভালো করে নেড়েচেড়ে মাংস দিয়ে যে পানি বের হবে তা শুকিয়ে ফেলে বারতি ১-২ বার পানি দিবা যাতে মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ হয়ে যায়।আর অবশ্যই সিদ্ধর জন্যে যে পানি দিবা তা আগে আলাদাভাবে গরম করে নিবা।
-আচ্ছা।কিন্তু মশল্লা কি কি দিবো?
-পিয়াজ কাটা ও দিবা আর কিছু পরিমাণ বাটা টাও,আদা ও রসুন বাটা,জিরা আস্তো কিছুটা দিবা আর বাটাও দিবা,জায়ফল আর জয়ত্রী একটু ভেজে তারপর বেটে নিবা,গরম মশল্লাগুলো আর ভাজা লাগবে না তা এমনিই বেটে নিয়ে তরকারিতে দিবা।আর হলুদ,মরিচের গুঁড়া,লবন,তেল এগুলো তো দিবাই।
-ব্যাস আর কিছু লাগবে না?
-এই পদ্ধতি টা হচ্ছে একদম সহজ। তাছাড়া তুমি টক দই,টমেটো,সস আরো অনেক উপাদান আছে যা তরকারিতে দিয়ে তরকারির স্বাদ আরো মজা বানাতে পারো।
-কোনো দরকার নেই।আমি সহজ টাই রাঁধবো এতো মজা হওয়া লাগবে না।
-হু।
-আচ্ছা রাঁধতে যাই।
-যাও।
বিহানের রিপ্লাই পেয়ে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হয় আর্শি।মাংসের মশল্লা গুলো আগে প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে এক একটি মশল্লা বের করে করে হাতের কাছেই রাখছে সে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো,সে তো জায়ফল আর জয়ত্রীই চিনছে না।মশল্লা সব খুলে খুলে দেখার সময় ছোট ছোট কয়েকটি গোল আকৃতির কালচে কোনো ফলের মতো দেখতে মশল্লাটিই হয়তো জায়ফল তা আন্দাজ করে সেটির ছবি তুলে নেয় আর্শি।ছবিটি বিহানকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে নেয় এটিই জায়ফল কিনা।ছেলেটি সম্মতি দেয়।এই জায়ফলের ঝামেলাটা মিটলেও আরেটি ঝামেলা রয়ে গিয়েছে তা হলো গরম মশল্লায় কি কি মশল্লা থাকে!এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আর্শি আবারও ম্যাসেজ দেয় বিহানকে। ছেলেটিও সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয় তাকে।

আর্শির অনেক আগের থেকেই ইচ্ছে ছিলো,সে নিজের বরের কাছ থেকে রান্না শিখবে।তাই তো কখনো রান্না শিখা নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না।তার একটাই কথা ছিলো,”আমার জামাই অনেক ভালো কুক হবে আর আমি তার কাছ থেকে রান্না শিখবো।”
বলতে গেলে আর্শির সেই ইচ্ছে টা আজ পূরণ হয়েছে।বিহান হয়তো তার প্রেমিক বা বর কোনোটিই নয় তবে তার হৃদয়ে বসবাস রত একমাত্র পুরুষ তো বিহানই।ভালোবাসা এমন একটা অনুভূতি যে অনুভূতিতে একটা অপরিচিত মানুষ এমন একজনে পরিণত হয় যে মানুষ টাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নেওয়া টাও যেন বিষাক্ত লাগে।ঠিক তেমনই ভালোবাসলে আমরা ভুলেই যাই মানুষ টা আমাদের বিয়ে করা বর বা বউ নয়।আমরা ঐ মানুষটাকেই নিজেদের অর্ধাঙ্গ বা পরিপূরক ভাবা শুরু করে দেই।ঠিক এমনই আর্শির বেলায়ও।তার কাছে,বিহানই তার পরিপূরক।
আজ ছেলেটির কাছ থেকে গরুর মাংস রান্না শিখে তার একটা ইচ্ছে পূর্ণ হলো।আর্শি তো আজ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে যে,সে বিহানের কাছ থেকে আরো অনেক রান্না শিখে নিবে।
#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ২৫(অন্তীম পর্ব)

রিসোর্টের কক্ষের সাথে বেশ বড় বারান্দা আছে।এর সুবিধা হচ্ছে পর্যটক যারা রিসোর্টে আসেন তারা এ বারান্দাতে দাঁড়িয়ে এক নির্দিষ্ট সময়ে খুব কাছ থেকে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে মেঘ বিলাস করতে পারেন।

রিসোর্টের কক্ষের সাথে থাকা বারান্দার ঠিক এক কিনারায় কাঠের তৈরি রেলিং ধরে বেশ অনেকক্ষণ সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে মিয়ামি।অপেক্ষা আর্শের আগমনের।ছেলেটি রিসোর্ট হতে বেরিয়েছে তার অনেকটা সময় পাড় হয়ে গিয়েছে।এখনো কেনো এলো না!দুশ্চিন্তায় ব্রু দ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ পরেছে মিয়ামির।
তার এ দুশ্চিন্তার মাঝেই হটাৎ সে নিজের কোমরে দু’টি ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে মৃদু কেঁপে ওঠে।চমকে নিজের পেছনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে দেখার উদ্দেশ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে দৃষ্টিপাত করতেই নিজের অর্ধাঙ্গের দেখা পেলো মিয়ামি।বিস্মিত কন্ঠে আর্শকে উদ্দেশ্য করে সে বলে ওঠে,
-কখন এলে?আর কিভাবে এলে?দরজা তো আমি লক করে রেখেছিলাম।
মিয়ামির ঘাড়ে মুখ গুঁজে নিম্ন স্বরে আর্শ বলে ওঠে,
-চাবি ছিলো আমার কাছে।
আর্শের উত্তর শুনে ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে মিয়ামি বলে ওঠে,
-আমার সব সারপ্রাইজ ভেস্তে গেলো!!
মিয়ামির কথায় মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আর্শের ঠোঁটে।এ কথাটি দ্বারা তার কাছে স্পষ্ট যে,মেয়েটি আরো কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিলো যা সে বাস্তব রূপ দিতে অসফল হয়েছে।
আর্শ পেছন থেকেই মিয়ামিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার গালে,গলায়,ঘাড়ে আলতো করে বেশ কয়েকবার ঠোঁট ছুঁইয়ে নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,
-এতো নিখুঁত করে কিভাবে ভালোবাসতে জানো, মিয়ু?আমি কি আদৌও তোমার যোগ্য?
আর্শের কথার উত্তরে কিছু না বলে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় মিয়ামি।দু’হাতে আর্শের গলা জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,
-উম,যোগ্য কিন্তু একটু কম কম!
মিয়ামির উত্তরে ব্রু দ্বয়ের মাঝে ভাজ ফেলে আর্শ মিয়ামির কোমর আঁকড়ে ধরে এক টানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-তাহলে কি করলে পুরোপুরি যোগ্য হওয়া যাবে?
আর্শের প্রশ্ন কানে আসতেই ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটে ওঠে মিয়ামির।সে দুষ্টু হাসি নিয়েই দু’হাত প্রসারিত করে বলে ওঠে,
-অনেকককগুলাআআ আদর দিতে হবে।
মিয়ামির কথায় চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকায় আর্শ।জিজ্ঞাসু স্বরে বলে ওঠে,
-কেন?আদর করি না?
-করো তো!কিন্তু ছোট্ট ছোট্ট।এবার,বড়ওওও আদর চাই।
কথাটি বলে ঠোঁটের দুষ্টু হাসিটি আরেকটু প্রসারিত করে মিয়ামি।
মিয়ামির উত্তরে আর্শ ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে মেয়েটির কোমরে রাখা হাতদুটির মাঝে একটি উঠিয়ে আলতো করে মিয়ামির নাক চেপে ধরে বলে ওঠে,
-আগে নিজে বড় হয়ে নেও,মিসেস!
আর্শের কথায় সাথে সাথে ব্রু কুঁচকে ফেলে মিয়ামি।রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,
-আগের কালে আমার বয়সেই মেয়েরা ২-৩ টা বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে যেতো।
-হতো হয়তো কিন্তু আমার এখনো বাবা হওয়ার বয়স হয়নি।
এমন ডাহামিথ্যে কথা বলে ঠোঁটে একটু চোরা হাসি নিয়ে মিয়ামিকে নিজের বাহুডোরে বন্ধী করে নেয় আর্শ।সময় ব্যয় না করেই মেয়েটির কপালে চুমু বসিয়ে দেয় সে।
এদিকে মিয়ামি তো আজ এমন ছোট আদরে সন্তুষ্ট হবে না বলে মনঃস্থির করেই রেখেছে।যতোই হোক, নিজের কলিজার বান্ধবীকে কথা দিয়ে এসেছে সে যে আর্শিকে ফুপু বানানোর দায়িত্ব তার।এখন এ কথা তো তার রাখতেই হবে।যেভাবেই হোক আজ সে বড় আদর নিবেই নিবে।তাই, আর্শের বাহুডোর হতে মক্ত হবার জন্যে জোরাজোরি করছে সে ও কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বায়না করে চলছে,”বড় আদর চাইইই”!
মিয়ামির এমন বাচ্চামো আবদারে ঠোঁটে হাসি ফুটে আছে আর্শের।সেই সাথে মুগ্ধতা!মিয়ামির এমন বাচ্চামিগুলো খুব করে উপভোগ করে সে।এইতো আর মাত্র ৩-৪ বছরেই মেয়েটি বড় হয়ে যাবে।ধীরে ধীরে তার মাঝে পরিপক্বতা আসবে আর বিলীন হয়ে যাবে এই বাচ্চামি টা।তখন আর মেয়েটি আদর আবদার করবে না।কারণ তখন সংসারের ভার টা যে তাকেই বহন করতে হবে।দায়িত্ব,পড়াশোনা সব কিছুর চাপে এই আবেগি ভালোবাসাটা কোথায় যেন হারিয়ে যাবে! সত্যিই বাস্তবতার কাছে আবেগের পরাজয় নিশ্চিত,যুগ যুগ ধরে এমনটিই তো হয়ে আসছে।
এসব ভাবতেই হৃদয়ে এক অদ্ভুত কষ্ট অনুভব করে আর্শ।নিজের অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার ভেরত থেকে।তার মন বলে ওঠে,এই সময়টাকে বিশেষ থেকে আরো বিশেষ বানিয়ে স্মৃতির পাতায় যত্নে সংরক্ষণ করে রাখতে।কারণ সময়,মানুষ,অনুভূতিরা নিজেদের রূপ বদলালেও স্মৃতিরা চিরকাল একই রূপে,একই মুগ্ধতায় থেকে যায়।খারাপ সময়েও এরাই এক চিলতে ঠোঁটের হাসি!
মনের কথায় সায় দিয়ে আর্শ আর দেরি না করে মিয়ামির অশান্ত ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে। নিজের হৃদয়ে জমানো সকল ভালোবাসা,আদর, সোহাগ সব টাই মিয়ামিতে উজাড় করে দিতে আরম্ভ করে সে।
হটাৎ নিজের ঠোঁটে আর্শের স্পর্শ পেয়ে চমকে গেলেও আনন্দে নেচে উঠে মিয়ামির মন।এতোক্ষণ বায়না করার পর অবশেষে সে সফল হয়েছে আদর কুড়াতে।চোখজোড়া বুজে নিয়ে দু’হাতে আর্শের চুল খামচে ধরে মিয়ামি।মিয়ামির সাড়া পেয়ে আর্শ যেনো আরো উন্মাদ!সে দু’হাতে মিয়ামির কামিজ একটুখানি উপরে তুলে সেথা হতে হাত ঢুকিয়ে মিয়ামির উন্মুক্ত কোমরে নিজের হাতের স্পর্শ আঁকতে আরম্ভ করে দেয়।অনেকটা সময় মিয়ামির ঠোঁটে স্পর্শ এঁকে এবার ঠোঁটের আশেপাশে, গালে, চোখে, কপালে, গলা-ঘাড়ে সব জায়গা জুড়ে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পরে আর্শ।আজ আর আঁটকাবে না সে নিজেকে।নিজের মাঝে জমে থাকা সবটা ভালোবাসা নিজের স্ত্রী,নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে উজাড় করে দিবে সে আজ।উহু,আজ আর কোনো ভালোবাসা নিজের হৃদয়ে জমানো রাখবে না সে।

!!
এখন প্রায় মাঝ রাত!
এমনি তো বিহান ১ টার মধ্যেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় তবে মাঝে মাঝে সে ঘুমাতে একটু দেরি করে।আজও জেগে আছে বিহান।সেই সাথে মন টাও ভালো তার।স্বাভাবিক সময়ে সে কম কথা বললেও মাঝে মাঝে যখন মন ভালো থাকে তখন অনেক কথা বলে সে।আজও বলতে গেলে অনেক কথা বলছে সে।অন্য কারো সাথে নয় বরং আর্শির সাথেই।প্রেম করলে নাকি প্রেমিক-প্রেমিকারা সারারাত জেগে কথা বলে! এর কোনো অভিজ্ঞতা আর্শি বা বিহানের নেই।কারণ তারা উভয়ই জন্মগত সিঙ্গেল।
এখন প্রেমিক-প্রেমিকারা রাত জেগে কি কথা বলে তা না জানা থাকলেও আর্শি ও বিহান মাঝে মাঝে অনেক রাত অব্দি একে-অপরের সাথে চ্যাটিং এ ব্যস্ত থাকে।তাদের কথা হয় ভবিষ্যতের কিছু পরিকল্পনা বা স্বপ্ন নিয়ে নতুবা অতীতের কিছু সুন্দর স্মৃতি ইত্যাদি নিয়ে।আর্শির কাছে এসব কিছু খুবই বিশেষ।সে যে মানুষটাকে ভালোবাসে সেই মানুষটা তার বেস্ট ফ্রেন্ড।অর্থাৎ এই মানুষটাকে ও নিজের মনের সব কথা নিরদ্বিধায় বলতে পারে।নিজে যেমন ঠিক সেভাবেই এই মানুষটার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে।এই মানুষটা ওকে অন্য সবার থেকে বেশি ভালো করে বোঝে।এই মানুষটা মন খারাপের সন্ধ্যাতেও চাঁদের আলোর ন্যায় প্রশান্তির হাসি ফুটাতে জানে।এই মানুষটা আর্শির যত্ন নিতে জানে,শাসন করতে জানে,অধিকার ফলাতেও জানে।আর সব থেকে বড় কথা,আর্শি জানে যে বিহানের জীবনে সে ছাড়া অন্য কোনো নারীর অস্তিত্ব নেই।এমনটা নয় যে,বিহানের অন্য মেয়ে বান্ধবী নেই।বন্ধুূদের মাঝে মেয়ে বান্ধবীও আছে কয়েকজন তবে তাদের মাঝে কেউই বিহানের কাছে আর্শির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।বিহান যেমন আর্শির সাথে নিজের সমস্ত কিছু শেয়ার করে তেমনটা অন্য কারো সাথে করে না।এটিই আর্শির প্রশান্তি!

এই মাঝ রাতে দু’জনের মাঝে চলা বিভিন্ন কথোপকথনের মাঝে আর্শি হুট করেই বিহানকে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আচ্ছা,আপনি আপনার জীবনের ২৮ টা বছর পাড় করে দিলেন এমন প্রেমহীন?প্রেম কেন করেন নাই?
-কি দরকার প্রেমের?
-প্রেম মানুষ কোন দরকারে করে?
-কোনো দরকারেই না।
-ভালোবাসে তাই করে।
-ভালোবাসলে প্রেম কেন করতে হবে?
-প্রেমের সম্পর্কে দুইটা মানুষ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে যে তারা একে-অপরকেই বিয়ে করবে।আর ভালোবাসলে মানুষ একে-অপরকে হারাতে ভয় পায় তাই এই প্রেমের সম্পর্ক হলে ভয়টা কমে তাদের।
-প্রেমে বিচ্ছেদ হয় না?শোনো যারা প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না হলেও নিজেকে নিজের ভালোবাসার মানুষের করেই রাখে এবং ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার জন্য অপেক্ষাও করে।আর সব থেকে বড় কথা,ভাগ্যে থাকলে তারা একে-অপরের হবেই এর জন্য প্রেমে জড়ানোর দরকার নেই।
বিহানের চিন্তাভাবনায় নতুন করে আরেকবার প্রেমে পরে যায় আর্শি।ছেলেটির কথাগুলো তো অযৌক্তিক নয়।এই ছেলেটাকে সে শুধু শুধুই তো আর অনন্য বলে না।বিহানের মতো করে আর কয়জন এভাবে ভাবে!
নিজের মুগ্ধতাকে নিজের হৃদয়ে যত্নে রেখে দিয়ে আর্শি আবারো প্রশ্ন করে ওঠে,
-আপনি প্রেমের এতো বিরুদ্ধে কেন?
-এই প্রেম জিনিসটা একটা সুন্দর সম্পর্ককে নষ্ট করে দেয়।দুইটা মানুষের একসাথে থাকার জন্য তাদের মাঝে সুন্দর একটা বন্ধুত্ব থাকা টাই সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।প্রেমের প্রয়োজন নেই।ধরো,এখন যদি আমাদের মাঝে প্রেম হয় তাহলে আমাদের বন্ধুত্বটাই ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে।কিভাবে তাও বলি!এখন তুমি যদি আমার গার্লফ্রেন্ড হইতা তাহলে আমি তোমার কাছে টেকেন বা গ্রান্টেড হয়ে যেতাম ঠিক তেমনই তুমিও আমার কাছে টেকেন বা গ্রান্টেড হয়ে যেতা।আমরা একে-অপরের উপর অধিকার ফলাতে যেয়ে একে-অপরের স্বাধীনতাটাই নষ্ট করতে আরম্ভ করতাম,নিজের অজান্তেই।এতে আমাদের মাঝে ঝামেলা হতো,ঝগড়া হতো।আবার,প্রেমের সম্পর্কে গেলে আমরা একজন আরেকজনের উপর অনেক কিছু আশা করতাম।কোনোভাবে যদি এই এক্সপেক্টেশন ব্রেক হতো তাহলে চাপা অভিমান জমতো।জানো,চাপা অভিমান একটা সম্পর্কের জন্য কতোটা ভয়ংকর?এমন হাজারো কারণ আছে যে জন্য প্রেম আমার পছন্দ না।নিজ চোখে এই প্রেমের জন্য অনেক সুন্দর বন্ধুত্ব নষ্ট হতে দেখছি!
-সবার ক্ষেত্রে তো বিষয় টা এক না।অনেকেই ৫-১০ বছর প্রেম করে বিয়ে করছে।কই, তাদের তো বিচ্ছেদ হয়নি।
-কারণ তারা অনেক সমঝোতা ও ত্যাগ স্বীকার করেও সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখে।এটাও গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।কিন্তু আমার কাছে প্রেম একটা লুকায়িত অনুভূতি হিসেবেই ভালোলাগে।যেখানে কেউ কারো কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নয়,একে অপরকে পাওয়া,না পাওয়ার ভয় কাজ করবে তাদের মাঝে তবুও মন থেকে তারা একে-অপরের হয়ে রবে।আসলে,অপ্রকাশিত ভালোবাসার গভীরত্ব টা অনেক,এ অনুভূতির তীব্রতাও অনেক।আমার মনে হয়,অনুভূতি প্রকাশ করলে অনুভূতির বিশেষত্ব টা হারিয়ে যায়।
বিহানের উত্তরে আবারও মুগ্ধ হয় আর্শি।ছেলেটির কোনো কথাই অযৌক্তিক নয় তেমনই এই মানুষটার চিন্তাধারায় বারংবার শতসহস্রবার মুগ্ধ হয়ে আসছে আর্শি।এতোদিন আর্শি খুব করে চাইতো,বিহান যদি তাকে ভালোবাসে তবে যেনো তা দ্রুতই প্রকাশ করে দেয়।কিন্তু এই প্রথম আর্শির মনে হচ্ছে,কি দরকার প্রকাশের।ভালো যদি বাসেও তাহলে থাক না অপ্রকাশিতই।আর যদি ভালো নাও বাসে তবুও ক্ষতি কি? ভাগ্যে থাকলে ভালোবাসুক আর না বাসুক মানুষটা তো তার হবেই। বিহান আর তার সম্পর্কটা এখন যেমন আছে এটাই সুন্দর,খুব সুন্দর।হয়তো অধিকার ফলাতে যেয়েও মাঝে মাঝে তা হয়ে উঠে না, হয়তো প্রকাশ্যে তাকে ‘নিজের’ বলে সম্বোধন করা যায় না, হয়তো ভালোবাসিময় কথোপকথন হয় না তবুও বন্ধুত্বের এই সম্পর্কে সুখ তো কম নেই।
এসব কিছু ভাবতেই আর্শির ঠোঁটে এক চিলতে হাসি এসে জায়গা করে নেয়।সে মনে মনেই বলে ওঠে,
“অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি আপনাকে, বিহান।সারাটা জীবন ভালোবেসে যেতে চাই।”

সমাপ্ত ❤️

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here