প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব -২১+২২+২৩

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২১তম_পর্ব

মাহির কথাটা শেষ না হতেই দিগন্তের আগমণ ঘটলো। ছুটে এসে বলল,
“কুইজ ক্যান্সেল, অনল স্যারের শরীর খারাপ”

কথাটা কর্ণপাত হতেই থমকে গেলো ধারা। শরীর খারাপ, কিন্তু কেনো! আজ সকাল অবধি তো দিব্যি সে ফিটবাবুটি সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো, তাহলে এই সামান্য সময়ে কি এমন হলো! অনলের অসুস্থতা শুনতেই ধারার ভেতরের সকল রাগ, ক্রোধ, অভিমান বিগলিত হতে লাগলো। বরং উদ্বিগ্নতা তৈরি হলো অনলের জন্য। এক অসামান্য হাহাকার তৈরি হলো অন্তস্থলে। চিনচিনে তীক্ষ্ণ ব্যাথা ছেয়ে গেলো হৃদয়ে। অস্থিরতা মস্তিষ্ককে গ্রাস করলো। অস্থির কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে তার?”
“সেভাবে তো জানি না, তবে যা জানি তা হলো তাকে ধরে টরে মেডিক্যালে নিয়ে গেছে। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছেন হয়তো সিড়ি থেকে”

দিগন্ত নির্লিপ্ত স্বরে কথাটা বলেই চেয়ার টেনে বসলো। কিন্তু শেষ কথাটায় বুক কাঁপলো ধারার। কেমন আছে সে! মাহি ধারার দিকে তাকালো। তাকে রক্তশূন্য লাগছে। মেয়েটি হয়তো ভেতরে ভেতরে বেশ চিন্তিত। কিন্তু দিগন্তের সামনে তা প্রকাশ করতে পারছে না। প্রকাশ করাটা বুদ্ধিমানেরও হবে না। তাই ফন্দি আঁটলো মাহি। ধারাকে বললো,
“যেহেতু কুইজ হচ্ছে না, চল ধারা অনল ভাই কে দেখে আসি”
“কেনো কেনো? তোদের যেতে হবে কেনো? সামান্য মাথা ঘুরে পড়েছে। এতে এতো আদিক্ষেতা কেনো?”

সাথে সাথেই দিগন্ত বাঁধ সাধলো। মাহিও কম নয়, উলটো চোখ গরম করে বললো,
“কেনো রে! মানবিকতা থাকতে নেই নাকি! স্যার আমাদের সে। হুট করে মাথা ঘুরে সিড়ি থেকে পড়ে গেছেন, ব্যাপারটা ভয়ংকর। কেমন আছেন জানবো না? আর ভুলে যাস না সে ধারার আপন জন, চল তো ধারা। এই পা’গ’লে’র কথা শুনে লাভ নেই”
“হ্যা, হ্যা। আমি পা’গ’ল, আর তুই কি! চু’ন্নী মাহি। আমি বুঝি না তাই না? তোর মতলব তো অন্যখানে, আর ধারাকে বানাচ্ছিস ঢাল”
“খুব বুঝছো তুমি! এবার অফ যেয়ে আমাদের ধন্য করো”
“তুই অফ যা”

এক কথায় দু কথায় ঝগড়া লাগলো মাহি এবং দিগন্তের। এই দুজনের জন্য এটা নতুন কিছু না। সর্বদা এদের মাঝে কিছু একটা নিয়ে ঝামেলা চলবেই। দিগন্ত উত্তর বললে, মাহি দক্ষিণ বলবে। মাহি কোনো কথা বললেই সেখানে ভেটো দিবে দিগন্ত। আর দিগন্তের কথা একেবারেই সহ্য হবে না মাহির। তখনই লাগে তৃতীয় বি’শ্ব’যু’দ্ধ। আর সেই যু’দ্ধে আ’হ’ত হয় ধারা, নীরব এবং অভীক। আজও তাই হচ্ছে। ধারার মেজাজ বিগড়ে গেলো। একেই অনল ভাই এর চিন্তায় বুক কাঁপছে, ভেতরটা অস্থিরতায় অশান্ত হয়ে আছে। এর মাঝে এই দুটো মানব মানবী নিজের তর্কযুদ্ধ করছে। একটা সময় তীব্র স্বরে বলে উঠলো,
“থাম না তোরা, একটা মানুষ অসুস্থ আর এদিকে তোরা ঝগড়া করছিস! এমন কেনো রে তোরা?”
“আমাকে বকছিস কেনো! এই মা’থা’মো’টা দিগন্ত ই তো আমার সাথে তর্ক জুড়লো, তুই বরং উঠ। আমরা অনল ভাইকে দেখে আসি”

ধারা মাথা নাড়লো। তার পক্ষে বসে থাকাটা অসহনীয় লাগছে। সে দেরি করলো না, বই খাতা বন্ধ করে মাহির সাথে বেড়িয়ে গেলো। দিগন্তের কাছে ব্যাপারটা বড্ড অটপটে লাগলো। যে তীক্ষ্ম দৃষ্টির তাকিয়ে রইলো ধারা এবং মাহির যাবার পানে। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“যত দোষ নন্দঘোষ”

ভার্সিটির মেডিক্যাল সেন্টারটি পশ্চিম দিকে বড় মসজিদের পাশে। লাইব্রেরি থেকে যেতে পনেরো মিনিট লাগে। সেই দূরত্বটি ধারা এবং মাহি দশ মিনিটে পার করলো। মাহির মনে হলো ধারার পায়ে যেনো কেউ রোলারস্কেটের চাকা লাগিয়েছে। সে হাটছে না ছুটছে। তার সাথে তাল মিলাতে যেয়ে হাঁফসে উঠলো মাহি। মেডিক্যাল সেন্টারে যেয়ে সামনের ডেস্কে বসা মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করতেই সে রুম দেখিয়ে দিলো। রুমের সামনে যেতেই প্লাবণের দেখা পেলো ধারা। প্লাবণের দেখা পেতেই হন্তদন্ত হয়ে বললো,
“অনলভাই কেমন আছে?”

প্লাবণ মৃদু হাসলো। তারপর মজার ছলে বললো,
“বরের প্রতি কি টান! তা এতই যখন টান ওড়নায় বেঁধে রাখো না কেনো?”
“মজা বাদ দাও প্লাবণ ভাই। ভালো লাগছে না। সে কেমন আছে তাই বলে উদ্ধার করো তো!”
“ভেতরে যেয়েই দেখো না, আর শোন মান অভিমানটা মিটিয়ে নিও”

প্লাবণের শেষ উক্তির উত্তর দিলো না ধারা। হনহন করে ছুটলো ভেতরে। এদিকে মাহি বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকলো। পাহারা দেবারো একটা ব্যাপার থাকে। হুট করে কেউ চলে এলে ধারাকে সংকেত দিতে হবে তো! প্লাবণ হেসে শুধালো,
“তুমি যাবে না?”
“স্বামী স্ত্রীর মাঝে আমার কি কাজ? বরং বান্ধবীর প্রেমে যাতে বাধা না পরে সেই ব্যাবস্থা করি”
“সহমত প্রকাশ করলাম। আমারো সেই একই কাজ”

বলেই প্লাবণ হেসে দিলো। মাহির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেলো অনলকে শুভ্র, ছোট বিছানায় আধশোয়া অবস্থায়। বালিশটায় হেলান দিয়ে বা হাতখানা চোখের উপর দিয়ে শুয়ে রয়েছে সে। তার বা পায়ের গোড়ালির দিয়ে সফেদ ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে। ধারা ধীর পায়ে এগিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়ালো। ধীর স্বরে বললো,
“কিভাবে হলো?”

ধারার চিকন কন্ঠ কর্ণপাত হতেই হাত সরিয়ে চোখ মেলে তাকালো অনল। নড়ে চড়ে উঠলো সে। কিভাবে হলো সে নিজেও জানে না। বাড়ি থেকে রওনা দেবার মাঝপথেই অঝোর বর্ষণের প্রকোপে পড়তে হলো তাকে। ছাতাও ছিলো না সাথে, বাইকের উন্মুক্ত থাকায় আপাদমস্তক কাকভেজা হলো সে। বৃষ্টির ধারা বাড়ার সাথেই সাথেই মাথায় এলো ধারারাণীকে বাসায় ফেলেই চলে এসেছে। আর তাদের গলির চিরন্তন নিয়ম, একটু বৃষ্টি হলেই আশেপাশের সকল রিক্সা যেনো গায়েব হয়ে যায়। অবশ্য হবে না কেনো একটু বৃষ্টিতেই তো তাদের রোড পানিতে টুইটুম্বর হয়ে উঠে। তাই এই অঝর ধারায় ধারারানীর জন্য রিক্সা খুঁজতে ব্যাকুল হয়ে উঠলো অনল। এদিকে নিজে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। বহু খোঁজার পর এক যুবকের রিক্সা পেলো সে। তাকে একশত টাকার নোট ধরিয়ে বললো,
“রহমত পাড়া চেনো? বা দিয়ে ঢুকে ডানে!”
“জ্বী চিনি”
“ওখানে ঢুকে একদম শেষে কালো কেঁচি গেটে দেখবে একটি মেয়ে দাঁড়ানো। ও যেখানে যাবে নিয়ে যেও”
“ভাড়া নিমু?”
“হ্যা, নিবে। কিন্তু আমি ঠিক করে দিয়েছি সেটা প্রকাশ করবে না। আর এই টাকাটা রেখে দাও”

যুবকের চোখ চকচক করে উঠলো। এই অক্লান্ত বৃষ্টিতে ফ্রি কাস্টোমারের সাথে একশত টাকা পেলে যে কারোর ই মন ভাল হয়ে যায়। যুবক উৎফুল্ল মনে অনলের বলা জায়গায় গেলো। অনল ও পিছু পিছু বাইক চালিয়ে গেলো। কিন্তু সামনে এলো না। লুকিয়ে থাকলো দু বাড়ি পেছনে। সে যা আন্দাজ করেছিলো তাই হয়েছে, ধারা মুখ লম্বা করে দাঁড়িয়ে আছে। রিক্সাটি তাকে যাবার কথা বলতেই সে উঠে পড়লো৷ রিক্সাটি যাওয়া অবধি অপেক্ষা করলো সে। যতই মান অভিমান চলুক নিজের বউকে তো বৃষ্টিতে ভিজতে দেওয়া যায় না। রিক্সা যাবার পর অনল ও রওনা দিলো ভার্সিটির দিকে। ভার্সিটিতে যখন পৌছালো তখন তার অবস্থা সুনামির সময় নদী পথে আটকে পড়া মাঝির ন্যায়। ভাগ্যিস নিজ রুমে এক্সট্রা এক জোড়া শার্ট, প্যান্ট ছিলো। তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় বদলে নিলেও ঠান্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচলো না। দুটো ক্লাস করার পর ই প্রবল মাথা ব্যাথা, সারা গায়ে অসহনীয় উত্তাপ। কড়া লাল চা পানির মতো পাঁচ ছ বার খেয়েও যেনো রেহাই হলো না। সিড়ি দিয়ে যখন নামছিলো তখন মনে হলো দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে। শরীরের উত্তাপ যেনো দুটো চোখে এসে জমেছে। চোখ জোড়া যেনো হয়ে উঠেছে জ্বলন্ত কয়লা। রক্তিম চোখজোড়া ডান হাত দিয়ে ঘষলো অনল। কিন্তু লাভ হলো না। মাথাটা ভার হয়ে এসেছে। ফলে সিড়ি থেকে নামতে গিয়ে একটা সিড়ি অজান্তেই বাদ পড়ে গেলো। টাল সামলাতে না পাড়ায় অনল যেয়ে পড়লো একেবারে তিনসিড়ি পর। ওখানে উপস্থিত ছাত্ররা তাকে টেনে টুললো। উঠতেই টের পেলো পা টা মচকেছে। কোনো মতে ধরে তাকে মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে আসা হলো। উপস্থিত ডাক্তার কপালে হাত দিতেই বললেন,
“আপনার তো জ্বর, গা পুড়ে যাচ্ছে! ঔষধ খান নি?”
“জ্বরটা হুট করে হলো মনে হচ্ছে, টের পাই নি”
“বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন?”
“অসময়ের বৃষ্টি, ভিজতে না চাইলেও ভেজা হয়”
“বুঝেছি, ঔষধ দিচ্ছি। আর পা টা ভোগাবে দু একদিন। ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি, সিরিয়াস না তেমন”

অনল শুধু মাথাই দোলালো। অনলের সিড়ি থেকে পড়ে যাবার কথা কানে আসতেই প্লাবন ছুটে এলো। বন্ধুকে এই প্রথম এতোটা অসাবধান এবং দায়িত্বহীন দেখলো প্লাবণ। এদিকে অনলের এই পড়ে যাওয়ার কাহিনী আগুনের মতো ছড়িয়ে গেলো। কৃতিত্বটি দিগন্তকে দেওয়াই যায়। কারণ সেই সময় সে উপস্থিত ছিলো ঘটনাস্থলে। তবে অনলকে সাহায্য করার থেকে তথ্যটা ছড়ানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। যাকে অপছন্দের সারিতে রাখা হয় তাকে সাহায্য করার নীতি দিগন্ত রাখে না। অবশ্য তাতে লাভ একটা হলো, ধারা শোনামাত্র ছুটে এলো।

অনল এখনো নিশ্চুপ। ধারা এখনো অপেক্ষা করছে উত্তরের। কিন্তু উত্তরটি পাওয়া হলো না। অনল অন্য দিকে তাকিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছে। ধারা মুখ গোল করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর এগিয়ে এসে অনলের পাশে বসলো। ডানহাতটা আলতোভাবে তার কপালে রাখলো। তাপমাত্রা মাপলে পারদের থার্মোমিটারে ১০২ তো হবেই।এবার কোমল কন্ঠে বললো,
“তুমি জানো তোমার ঠান্ডার ধাঁচ আছে তাহলে কেনো বৃষ্টিতে ভিজলে?”
“শখে কি কেউ ভিজে?”

অবশেষে মুখ খুললো অনল। ধারা আর কিছু বললো না। কারণ কিছু বললেও সোজা উত্তর মিলবে না। হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিস্প্রভ কন্ঠে বললো,
“তুমি অসুস্থ হলে আমার উদ্বিগ্নতা বাড়ে। তাই দয়া করে অসুস্থ হয়ো না। যখন কানে এলো তুমি পড়ে গেছো, মাথায় অনেক অনর্থক চিন্তা এসেছিলো। এখন হয়তো এটা তোমার কাছে আবেগের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। তবে আমি জানি আমার ভেতরে কি চলছিলো!”

অনল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ধারার দিকে। ধারার ব্যাথিত চোখজোড়া তাকেও ব্যাথা দিচ্ছে যেনো। কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো! বুকের ভেতর জমা কথাগুলো দলা পেঁচিয়ে অন্তস্থলেই রয়ে গেলো________

******

প্লাবণের সহায়তায় অনলকে নিয়ে বাসায় ফিরলো ধারা। অনলের বাইকটি বাড়ি অবধি পৌছে দিলো অফিসের পিয়ন পিয়াস। বাড়িতে আসতেই দেখলো সদর দরজায় কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে জমজ বি’চ্ছু। অনল অবাক কন্ঠে শুধালো,
“এবার তোরা কি করেছিস?”

অনলের প্রশ্নে এশা হতাশ কন্ঠে বললো,
“আমরা সত্যি নিরপরাধ, অস্ট্রেলিয়ান চেরাগআলী আমাদের বিনা অপরাধে ফাঁসিয়েছে। আর আমাদের নির্দয় মা, আমাদের শাস্তি দিচ্ছে।

অনলের বুঝতে বাকি রইলো না তার প্রখ্যাত বোনেরা কিছু একটা কান্ড তো করেছে। নয়তো ছোট চাচীর শাস্তি দেবার কথা নয়। আসলে তখনের গোবরকান্ড ফাঁস হয়েছে। রোগাপটকা লোকটা ছিলো এশা আশার তৃতীয় শিক্ষক, যিনি তাদের সুনাম পুরো মহল্লায় ছড়িয়েছে। তাই তার উপর শোধ তুলতেই সেই কাজ করেছিলো তারা। কিন্তু দীপ্তের কারণে ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেছে। লোকটি চেঁচামেচি করায় বাসায় মানুষ ও জড়ো হয়। ফলে সবাই জেনে যায় মুল ঘটনা। সেকারণেই রুবি দুটোকে সদর দরজায় কান ধরে দাঁড় করে রেখেছে। অনল বা ধারা পাত্তা দিলো না এশা আশার উপর। এদিকে অনলের পায়ের ব্যান্ডেজ দেখেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন সুভাসিনী বেগম। হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হলো তারা। মনে হলো কোনো ইন্টারোগেশন রুমে বসে আছে। সুভাসিনী বেগম বুলেটের মতো প্রশ্ন করছে, “কিভাবে হলো?” “কেনো হলো?” “জ্বর বাঁধালো কেনো?” “যখন শরীর খারাপ ছিলো বাড়ি ফিরে এলো না কেনো?”। অনল ধারা যেনো হাফসিয়ে উঠলো। শেষমেশ না পেড়ে অনল
বলেই উঠলো,
“মা, এবার থামো। ভুল হয়ে গেছে পা মচকালাম, এবার ক্ষান্ত হও। আর এই বাঁ’দ’র দুটোকে ভেতরে ঢোকাও। লাগছে কেমন? যেনো চিড়িয়াখানা থেকে উঠে আসা হ’নু’মা’ন”

অবশেষে ক্ষান্ত হলেন সুভাসিনী বেগম এবং অনলের জন্য এশা আশাও ঘরে প্রবেশ করতে পারলো। ধারা কোনোমতে অনলকে নিজ রুমে নিয়ে গেলো। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করলো, দীপ্ত নামক আগুন্তককে দেখা যাচ্ছে না। তবে ব্যাপারটা তাকে আনন্দ ই দিলো। যাক ব্যাটা হয়তো ভেগেছে। কিন্তু ধারা তো জানে না, সে গোবরকান্ডে এতোটাই ভয় পেয়েছে যে ঘর থেকেই বের হচ্ছে না। বলা তো যায় না, আবার কোন পরিস্থিতিতে তাকে ফাঁসিয়ে দেয় তারা।

*****

নিগুঢ় রাত, নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে ঘরটিতে। শুধু পুরোনো ফ্যানের ক্যাচর ক্যাচর শব্দ কানে আসছে। বাহিরে প্রবল আষাঢ়িয়া বর্ষণ। ঝমঝম বৃষ্টির মধুর শব্দ ক্ষীন ঢুকছে ঘরটিতে। কিন্তু ফ্যানের শব্দে তা হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কাঠের জানালার ফাঁক দিয়ে দিয়ে পানির ছিটে আসছে। জানালাটা ঠিক করবে করবে করেও করা হচ্ছে না। এদিকে কাঁথা গলা অবধি টেনে ঘুমিয়ে আছে ধারা। বৃষ্টির কারণে অসহনীয় গরমটা আর লাগছে না। হঠাৎ চাপা আর্তনাদ ভেসে আসলো কানে। পাতলা ঘুমটা নিমিষেই চুরমার হয়ে গেলো। উঠে বসলো সে। হাতের কাছের ল্যাম্পটি জ্বালালো। পাশে তাকাতেই দেখলো কাঁপছে অনল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধারার ডান হাত চলে গেলো তার কপালে। উত্তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে যেনো। খাবার আগেও জ্বরটা ছিলো বললেই চলে। ঔষধ ও দিয়েছিলো সে অনলকে। তবুও আবারো কেনো জ্বর এলো বুঝলো না। উঠে গিয়ে ঔষদের বাক্সটা হাতে নিলো সে। পারদের থার্মোমিটার দিয়ে মাপলো জ্বরটা। পারদের মাত্রা ১০৪ ছুই ছুই। অনলকে মৃদু স্বরে ডাকলো, কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না। জ্বরের কারণে প্রবল ঘোরে যেনো ডুবে আসে সে। ধারা দেয়ালের ঝুলন্ত ঘড়ির দিকে তাকালো। তিনটে ছুই ছুই। এই সময় বাড়ির প্রতিটি প্রানী গভীর ঘুমে। সুতরাং কাউকে ডেকে লাভ নেই। যা করার নিজেকেই করতে হবে। কোনো মতে অনলকে ডাকলো সে। অস্পষ্ট স্বরে অনল বললো,
“হু”

ধারা গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। কোনো মতে পাহাড় সম মানুষটাকে তুললো সে। পেছনে বালিশ ঠেকিয়ে বসালো। দুটো প্যারাসিটামল খাওয়ালো কোনো মতে। ঘোরের মাঝে অনল তা খেলো ও। তারপর আবার তাকে সটান শোয়ালো। অনলকে উঠাতে আর শোয়াতে যেনো হাঁপিয়ে উঠলো ধারা। মানুষটির এতো ভার কল্পনাও করে নি। মুখ গোল করে নিঃশ্বাস ছাঁড়লো সে। তারপর কাঁথাটা টেনে দিলো অনলের গলা অবধি। ফ্যান বন্ধ করে দিলো, যেনো ঠান্ডা না লাগে। ঠান্ডা পানির একটা মগ ওয়াশরুম থেকে আনলো। তারপর ছোটবেলার জ্বর কমানোর টেকনিক খাটালো, তা হল জলপট্টি। এভাবেই কাটলো রাত। ভোরের আলো পূর্ব আকাশে ফুটতেই দুনিয়ার ঘুম চেপে বসলো ধারার চোখে। অনলের জ্বর এখন নেই বললেই চলে। মানুষটি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তাই ধারাও ক্লান্ত চোখজোড়া বুজে নিলো। অনলের রুক্ষ্ম, শক্ত হাতটা নিজের নরম হাতের মাঝে রেখেই ঘুমিয়ে গেলো সে_____

ব্যস্ত শহর, নরম সূর্যোলোক কাঠের জানালা ভেদ করে প্রবেশ করছে ঘরে। সারারাত বৃষ্টি হওয়ায় তার তাপ নেই এর কাছাকাছি। শীতল সমীরে উড়ছে জানালার গোলাপি পর্দাটি। কুসুম প্রভা চোখে লাগাতেই ঘুম ভাঙ্গলো অনলের। মাথায় এখনো প্রবল যন্ত্রনা। জ্বর নেই, তবে মনে হচ্ছে সারা শরীরে হাতি দাঁপিয়ে গেছে। অসহনীয় ব্যাথা। উঠে বসতেই বা হাতে প্রবল ভার অনুভূত হলো। পাশ ফিরতেই দেখলো কিশোরী বউ টি তার হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে নিবিড় ঘুমে মগ্ন। পাশের টেবিলের ঔষধের এলোমেলো বাক্স, অবহেলায় পড়ে থাকা মগ এবং অর্ধশুকনো রুমালটি দেখেই আন্দাজ করতে পারলো, কেনো তার এখন জ্বর নেই। ব্যাপারখানা ভাবতেই অজান্তেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। মনের আকাশে এক নবরঙধনুর আবির্ভাব হলো। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো প্রসন্ন, স্নিগ্ধ হাসি। অপলক নজরে দেখলো নিজের কিশোরী বউকে। তার কপালে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলোকে সরিয়ে দিলো সে। কপালে উষ্ম ঠোঁটের আলতো পরশ বুলিয়ে নরম স্বরে বললো,
“আবারো ম’র’লাম আমি, আবারো হারলাম। তবে এই মৃ’ত্যুতে যে জন্মের শান্তি, এই হারে যে প্রবল প্রশান্তি। ভালোবাসি বউ, প্রচন্ড ভালোবাসি”..………….
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২২তম_পর্ব

কপালে উষ্ম ঠোঁটের আলতো পরশ বুলিয়ে নরম স্বরে বললো,
“আবারো ম’র’লাম আমি, আবারো হারলাম। তবে এই মৃ’ত্যুতে যে জন্মের শান্তি, এই হারে যে প্রবল প্রশান্তি। ভালোবাসি বউ, প্রচন্ড ভালোবাসি”

অনলের স্বগোতক্তি শেষ হবার সাথে সাথেই চোখ মেলে তাকালো ধারা। যেনো সে এতোটা সময় চোখ বুজে অপেক্ষা করছিলো কখন অনল তার হৃদয়ের অন্তস্থলে জমে থাকা কথাগুলো নিজ মুখে বলবে। ধারা সটান হয়ে উঠে বসলো। ধারার উঠে বসা দেখে ঈষৎ বিস্মিত হলো অনল। সে ভেবেছিলো ধারা গভীর ঘুমে। ধারা কিছুসময় গোল গোল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর ডানহাতটা অনলের কপালে ঠেকালো। ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
“যাক জ্বর নেমে গেছে, উফ রাতে যে কি একটা ভয় পেয়েছিলাম! হুট করে জ্বরটা বাড়লো কেনো বুঝলাম না!”

অনল একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে ধারার মুখশ্রীর দিকে। চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে নেমে গেছে ঘাড় বেয়ে। চোখগুলো এখন ঘুমের মাদকতা থেকে বের হয় নি। মুখখানা ঈষৎ ফোলা। গোলাপ ফুলের মতো স্নিগ্ধ ঠোঁটজোড়া দেখে কিছু নিষিদ্ধ ইচ্ছে উঁকি দিলো হৃদয়ের ভেতরে। কিন্তু পর মূহুর্তেই তা দমিয়ে নিলো। ঠোঁটে টেনে নিলো স্নিগ্ধ হাসি। তারপর মুখখানা একটু এগিয়ে নিয়ে নরম গলায় বললো,
“জ্বর না আসলে বউ এর এতো যত্ন পেতাম কি করে?”

অনলের কথাটা কর্ণপাত হতেই ঘুমগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো যেনো ধারার। অনলের “বউ” ডাকে যেনো এক অসামান্য সম্মোহনী শক্তি আছে। যা পাগলের মতো টানে ধারাকে। সে কিছুসময় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। অনল এখনো হাসছে, দূর্বোধ্য সেই হাসি এবং একই সময় মারাত্মক বুকে লাগা হাসি। মারাত্মক সুন্দর, মাদকাসক্ত। পুরুষের হাসি সাধারণত সুন্দর হয় না। তবে অনলের হাসিটি বরাবর ই ধারাকে মুগ্ধ করে। হয়তো সে সর্বদা হাসে না তাই। কিন্তু পরমূহুর্তেই গতদিনের বাক বিতন্ডার কথাটা মনে পড়তেই মনের ভেতর একটা তিতকুটে অনুভূতির সৃষ্টি হলো। মুখ ফিরিয়ে নিলো ধারা। ঠোঁট ভিজিয়ে অভিমানী স্বরে বললো,
“কেনো? এগুলো তো কিশোরীর আবেগমাত্র!”
“ভুল হয়ে গেছে! ক্ষমা করে দে। এই দেখ কান ধরছি”

বলেই হাতদুটো কানের কাছে নিয়ে গেলো অনল। ধারা সাথে সাথে হাতদুটো নামিয়ে নিলো। গম্ভীর স্বরে বললো,
“আমি কি কান ধরতে বলেছি? কান ধরিয়ে বিশ্বজয় করার ইচ্ছে নেই”
“তাহলে মহারানীর রাগ ভাঙ্গাই কি করে?”

কথাটা বলেই ধারার কোমড় আকড়ে ধরলো অনল। অনলের নিবিড় স্পর্শে কেঁপে উঠলো ধারা। মেরুদন্ড বেয়ে উষ্ণ রক্তের ধারা বয়ে গেলো। অনলের উষ্ণ স্পর্শে হৃদয়ের তপ্ত জমিনে যেনো এক পশলা শীতল বর্ষন হলো। হিম হয়ে গেলো তার হাত পা। আরোও বিস্ময় জমলো যখন কানে মুখ ঠেকিয়ে অনল মাদকাসক্ত কন্ঠে বললো,
“বউ এর মান ভাঙ্গাতে হলে কি করতে হবে এই অ’ধ’ম’কে?”

ধারা অনুভব করলো তার গাল উষ্ণ হয়ে উঠলো। কথাগুলো দলা পাকালো। তবুও একরাশ সাহস নিয়ে বললো,
“যা ঘুমন্ত অবস্থায় বলেছো, তাই সজ্ঞানে শুনতে চাই”

অনল বুঝলো তার কিশোরী বউ তার স্বগোতক্তি শুনেছে। সুতরাং লুকোচুরি শেষ। অবশ্য আর লুকোচুরি করেও লাভ নেই। কারণ অনলের ভেতরটাও হাহাকার করছে। ধারাকে একান্ত করে পাবার ইচ্ছে তাকে বেসামাল করে তুলছে। সে মাথা ঠেকালো ধারার কাঁধে। কন্ঠ নরম করে বললো,
“একটা গল্প শুনবি?”
“সুন্দর গল্প হতে হবে, কিন্তু!”
“আমার প্রথম প্রণয়ের গল্প, শুনবি?”

ধারার বুকে মোচড় পড়লো। বাহিরে তখন আবারো বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাঠের জানালা ভেদ করে পানি ছিটকে পড়ছে শীতল ঘরটিতে। অনল তখন তার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বসে রয়েছে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে তার দেহে। ধারা মাথা উপর নিচ দোলালো। মানে সে শুনবে। অনলের হাসি বিস্তারিত হলো। তারপর সে মৃদু কন্ঠে বলা শুরু করলো,
“আমি তখন স্কুলে। এই বাড়িতে আমার একার রাজত্ব। আমার চেয়ে ছোট কেউ নেই। সবার আদরের মনি আমি। তখন জন্ম হয় একটা ছোট্ট শিশুর। ছোট একটি মানুষ, গোল মুখ, ছোট ছোট নরম হাত পা তার। অথচ এই মানুষটি আমার নয়বছরের রাজত্ব গুড়িয়ে দেয়। আমার আধিপত্যে নিঃশব্দে ভাগ বসায় সে। জানিস কে সে? তুই! বিনা কিছু করেই ছোট হবার দরুন সকলের আদরের মনি হয়ে উঠিস তুই। যে ফুপি আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না সেই ফুপির সারাদিন কাটতো তোর যত্নে। নয়বছরের বালকের পক্ষে নিজের সিংহাসন ছেড়ে দেওয়া মোটেই সহজ হলো না। আজব এক হিংসে জন্মালো। তাই তোকে ভালোবাসতে ভালো লাগলো না। ফুপি যখন ই তোকে নিয়ে এ বাড়ি আসতো আমার বিরক্ত লাগলো। চাচু যে কিনা প্রতি বিকালে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হতো সেই চাচু তোকে কোলে নিয়ে ঘুরতে লাগলো। আমার বাবা আমার আগে তোকে চকলেট দিতো। খুব রাগ হতো জানিস। তারপর একদিন ফুপা অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলো। তুই ফুপির সাথে এলি এ বাড়িতে। আমার হিংসে দ্বিগুন হলো। তোর মনে আছে কি না জানি না, একবার আমি তোকে সিড়ি থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। বা পায়ে খুব ব্যাথা পাস তুই। মা খুব রেগে গিয়েছিলো আমার উপর। কিন্তু সকলকে অবাক করে তুই বলেছিলি তুই নাকি নিজ থেকেই পড়ে গিয়েছিলি। এতে আমার দোষ নেই। সেইদিন প্রথম আমার তোকে ভালো লেগেছিলো। একটা পাঁচ বছরের মেয়ে এতো চমৎকার করে হাসতে পারে সেদিন প্রথম দেখেছিলাম। চৌদ্দ বছরের ছেলেটির বুকে যেয়ে লাগলো সেই মারাত্মক মোহনীয় হাসিটি। যাই হোক, ইতিমধ্যে আমার রাজত্বে ভাগ বসাতে আরোও মানুষ চলে এলো, আফিয়া, এশা, আশা, আফসার, আলিজা। আমার অভিমান চুরমার হলো। তাই অন্য একটা ফন্দি আটলাম, রাজত্বটা তোদের উপর খাটাবো। বড় হবার দরুন তোরা সবাই আমাকে হুজুর হুজুর করতে লাগলি! আমার দাপট ও চললো! তারপর ফুপির অসুখ ধরা পড়লো। মাত্র মাস দুয়েক মাঝেই সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। তখন তুই ছয় বছর। মৃতরা যে ফিরে না ব্যাপারটা তখন ও বুঝতে পারছিলি না। বারবার বলছিলি “মা ঘুমিয়ে আছে, ডেকো না। মা অসুস্থ”। সেদিন তোর প্রতি এক অসামান্য মায়া কাজ করলো জানিস, মনে হলো এই মেয়েটাকে আগলে রাখাই যেনো আমার কাজ। পনেরো বছরের ছেলের পক্ষে প্রণয় কি বোঝাটা অসম্ভব, শুধু এটুকু বুঝছিলাম তুই প্রচুর জরুরি আমার জন্য। আমার মনে খোড়াক, তোকে না জ্বালালে তো আমার ভাত ই হজম হয় না। এর পর ফুপা ফিরলেন তোকে নিয়ে যাবার জোর করতে লাগলেন। তার সাথে একজন নারীও এলো। যাকে দেখে তুই জেদ ধরলি তুই যাবি না। লুকিয়ে বসে রইলি ছাঁদের চিলেকোঠায়। সেদিন আমি প্রথম ভয় পেয়েছিলাম। ভয় পেয়েছিলাম তোকে হারাবার। তুই চলে গেলে আমি কার চুল টানতাম? তার চুলে চুইংগাম লাগাতাম? কার উপর হুকুম ঝারতাম? কার জন্য পাড়ায় ঝগড়া করতাম? কাকে পাহারা দিতাম যেতো কোনো ছেলে তার আশেপাশে না ঘুরে! যাক গে, দাদাজানের সামনে ফুপার জোর খাটলো না। আমার জীবন আবার আগের মতো হয়ে উঠলো। তুই থেকে গেলি, আমার চিরজীবনের খেলার সাথী। এর মাঝে স্কুল থেকে আসার সময় আমি ছেলেধরার কবলে পড়ি। দিনটা আমার জীবনের সবথেকে কালো দিনের একটা। ওরা আমাকে একটা অন্ধকার ঘরে আটকে রাখে। তিন দিন আমি ওই ঘরেই থাকি, বিনা খাবার, বিনা পানি তে। তিনদিন পর আমাকে উদ্ধার করা হয়। আমার তখন নিজের ছায়াকেও ভয় করতে শুরু হয়। নিজেকে ঘরে আটকে রাখতাম। একদিন দেখলাম আমার ঘরের দরজার নিচে একটা চকলেট আর একটা এবড়োখেবড়ো হাতের লেখার চিরকুট। যাতে লেখা ছিলো “অনল ভাই, আমি তোমাকে পাহারা দিচ্ছি”। ভাবা যায় একটা সাত বছরের একটা মেয়ে কিনা ষোল বছরের ছেলেকে পাহারা দিবে। সেদিন প্রথমবারের মতো ম’রে’ছি’লা’ম। বুঝলাম আমি হেরে গেছি তোর চঞ্চলতার কাছে। তোর প্রতিটা কাজে মুগ্ধ হতাম। তুই বড় হতে থাকলি, আমার সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকলো তোর। একই বাড়িতে থাকা স্বত্তেও আমাদের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। আমার প্রতি তোর বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখে নিজেকে আরোও বেশি গুটিয়ে গেলাম আমি। তোর প্রতি আসক্তিটা লুকিয়ে রাখলাম এক অজানা প্রকোষ্ঠে। যেদিন আমাদের বাড়ি প্রথম প্লাবণ এলো সেদিন আমি তোর মাঝে এক অকল্পনীয় পরিবর্তন দেখলাম। একটা মেয়েলীভাব এলো তোর মাঝে, সাজগোজ করা, সুন্দর লাগা ব্যাপারগুলো যেনো তোকে বড্ড ভাবাতে লাগলো। প্রথমে খেয়াল না করলেও যত দিন গেলো বুঝলাম তোর প্লাবণের প্রতি একটা আবেগ জমেছে। তোর প্লাবণের প্রতি আবেগ আমার ভেতরের ঈর্ষার দাবানল তৈরি করলো। আমি এজন্য ওকে বারণ করতাম আসতে। তোর আসে পাশে না ঘেষতে। কিন্তু ছেলেটা শুনতো না, তোর আবেগে হাওয়া দিতো আর সেটা আরো বেগে জ্বলতো। না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলাম ওকে, কেনো এগুলো করে। ছেলেটা উত্তরে বললো, তোকে দেখলে তার নিজের আপন বোনের মতো মনে হয়। আমি আর বাধা দিতে পারলাম না। আর তোকে যে বোঝাবো সে জোর রইলো না, কারণ আমার প্রতি তোর আচারণ ছিলো বড্ড বিচিত্র। তোর মনে আছে যেদিন তোর এস.এস.সি এর রেজাল্ট দিলো, মার কড়া লাল শাড়িটা জোর করে পড়লি?”
“আর তুমি ইচ্ছে মতো আমাকে বকে ছিলে”
“কারণ তোকে সেদিন বউ বউ লাগছিলো। সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো ম’রে’ছি’লা’ম। তোর কাজলকালো চোখে নিজেকে আবারো হারিয়েছিলাম। কেনো তোকে এতোটা মায়াবিনী হতে হবে! পাড়ার সব কটা ছেলের চোখ শুধু তোকে গিলছিলো। সহ্য হলো না। তোর সাথে খারাপ ব্যাবহার করলাম। সেদিনের পর থেকে আমার সাথে সোজা মুখে কথা বলাই ছেড়ে দিলি তুই। আমিও আমার প্রণয়কে আরো একবার গুটিয়ে নিলাম। এর পর দাদাজানের অসুস্থতা, আমাদের বিয়ে সব কিছু যেনো এলোমেলো করে দিলো। প্রথমে না করলেও শেষমেশ মনের হারতেই হলো। রাজি হলাম বিয়েতে। কিন্তুআমি বুঝছিলাম না ঠিক কি করা উচিত। তোকে নিজের করে পাবার আনন্দটা যেমন হচ্ছিলো, তোকে হারানোর ভয়টা আরোও মাত্রা ছাড়াচ্ছিলো। আমি বড্ড ভয় পাই, ভয় পাই আঘাতের। ভয় পাই নিজেকে হারিয়ে নিঃস্ব হবার। ভয় পাই শূন্যতার। এতো ভয়ের মাঝেও অবুঝ হৃদয়টা তোর প্রতি আকৃষ্ট হয় বারেবারে। বারবার তোর প্রতি বেসামাল প্রণয় আমাকে কাবু করে। তাই তো মৃ’ত মানুষটি আমার ম’রে, পরাজিত হৃদয় আবার হারে। হ্যা, ভালোবাসি তোকে। প্রচন্ড ভালোবাসি। আবার ভালোবাসাকে কখনো পায়ে ঠেলে দিস না। সইতে পারবো না”

ধারা অনুভব করলো তার কাধে উষ্ণ তরল গড়াচ্ছে। সেই তরলে ভিজে যাচ্ছে তার কাঁধ। অজান্তেই তার চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়লো নোনাজলের রেখা। একমূহুর্ত দেরী না করেই জড়িয়ে ধরলো সে অনলকে। বলিষ্ঠ শক্ত বুকে লেপ্টে রইলো সে। ধরা গলায় বললো,
“শেষ নিঃশ্বাস অবধি এই প্রণয় কে আগলে রাখবো। কথা দিলাম।”
“ভালোবাসিস?”
“কারণ অকারণে ভালোবাসি, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি”

অনলের বেষ্টনী আরোও নিবিড় হলো। কিশোরী বউ কে আগলে ধরলো তার শক্ত বাহুবেষ্টনীতে গভীরভাবে। বাহিরে ঝুম আষাঢ়িয়া বৃষ্টি। ব্যাস্ত শহর ভিজে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রুমেও তখন চলছে প্রণয়ের বর্ষণ, কি মধুর সেই বর্ষণ_________

****

ব্যস্ত শহরে নামলো সন্ধ্যা। ঘুটঘুটে আলো সন্ধ্যা। সেই সাথে চলছে আষাঢ় মাসের চিরন্তর নৃত্য। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি আর মেঘের গর্জন। অবশ্য সকালের কড়া, তেজী উত্তাপের জ্বালানো শহরটি ঠান্ডা করার প্রয়োজন ছিলো। বাংলাদেশে না আসলে হয়তো এই অলীক মায়াটার সাক্ষী হতে পারতো না দীপ্ত৷ সে এখনো ধারাদের বাড়িতেই ঘাপটি মেরে আছে। জামাল সাহেবের সাথে বনাবনি হয় নি মোটেই। কিন্তু রাজ্জাক সাহেবের দয়ার পাত্র সে হয়ে গিয়েছে। হাতে টাকা নেই, লাগেজ নেই। অনলের কাপড় পড়ে দিব্যি দিন কাটছে তার। এদিকে অনলের পা ঠিক হয়ে গিয়েছে। লোকটি বেশ ত্যাদর, দীপ্তকে মোটেই ধারার ধার ঘেষতে দিচ্ছে না। অবশ্য দীপ্ত ধৈর্য্যশীল ছেলে। পাঁচদিন চুপচাপ ই রয়েছে। সে অবশ্য জমজদের খুব ভয় পায়। ভুলে ও ও পথ মা’রা’য় না।

দীপ্ত কাঠের জানালাটা খুলে দিলো। সাথে সাথেই পানির ছিটে মুখে পড়তে লাগলো। তবুও মোহনীয় দৃষ্টিতে বাহিরে তালিয়ে রইলো সে। সোডিয়ামের রোড লাইট গুলো একের পর এক জ্বলে উঠছে রাস্তার ধারে। বৃষ্টির শব্দ যেনো কোনো সুখময় গান। এই গানে বাধা দিলো কাঠের দরজার ঠক ঠক আওয়াজ। ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে খুলতে অবাক হলো সে। জমজেরা বাটি হাতে বিনীত হাসি একে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাবড়ানো কন্ঠে শুধালো দীপ্ত,
“কি চাই?”
“ক্ষমা”

একসাথে বলে উঠলো এশা আশা। খানিকটা বিস্মিত হলো দীপ্ত। মুখে সন্দেহের ছাপ। সন্দীহান কন্ঠে বললো,
“কিসের ক্ষমা?”
“বাহ রে! আমাদের জন্য আপনাকে কি অপমানটাই না হতে হলো। সেটার ক্ষমা চাইতে এসেছি। আর দেখুন আপনার জন্য এই বৃষ্টিতে ভিজে রহমাত পাড়া বিখ্যাত চটপটি নিয়ে এসেছি। আমাদের এবার ক্ষমা করে দিন দীপ্ত ভাই”

এশা এতোটা নরম এবং বিনয়ী স্বরে বললো যে দীপ্ত মানা করতে পারলো না। আর কেনো জানে জমজগুলোকে তার ভীষণ ভালো লাগে। ইচ্ছে করে গাল টিপে দিতে। তাই হাসি মুখে চটপটির বাটিটা নিলো। তারপর বললো,
“থ্যাংক ইউ। আমরা তাহলে বন্ধু?”
“একদম, আপনি তাহলে আমাদের ক্ষমা করেছেন তো?”
“তা আর বলতে, এটা কি স্পাইসি?”
“হালকা, তবে বেশ মজা। আপনি খান আমরা তাহলে আসি”
“তোমরা খাবে না?”

সাথে সাথেই আশা বলে উঠলো,
“আমাদের খাওয়া যাবে না”
“হ্যা?”
“না আসলে আমরা খেয়েছি, ওয়েদার খারাপ তো। তাই বেশি খাওয়া যাবে না। আশা পা’গ’লী বোঝাতে পারে নি”

আশাকে কনুইয়ের গুতো দিয়ে এশা কথাটা বললো। তারপর তারা “আসি” বলেই বিদায় নিলো। দীপ্ত তৃপ্তি নিয়ে চটপটিটা খেলো। একটু ঝাল বটে, কিন্তু ভীষণ মজা। কিন্তু ঝামেলাটা হলো এক ঘন্টা পর, যখন তার পেট মুড়িয়ে উঠলো। শুধু রুম টু বাথরুম আর বাথরুম টু রুম। এক মিনিট যে বসবে তার উপায় নেই……….
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৩তম_পর্ব

দীপ্ত তৃপ্তি নিয়ে চটপটিটা খেলো। একটু ঝাল বটে, কিন্তু ভীষণ মজা। কিন্তু ঝামেলাটা হলো এক ঘন্টা পর, যখন তার পেট মুড়িয়ে উঠলো। শুধু রুম টু বাথরুম আর বাথরুম টু রুম। এক মিনিট যে বসবে তার উপায় নেই। যখন ই বাথরুম সেড়ে একটু জিড়িয়ে নিতে চায়, অবুঝ, অবাধ্য পেটটা পুনরায় মোচড় দেয়। বুঝে উঠতে পারছে না, এতো বিশ্রী ডিসেন্ট্রি হলো কেনো! একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লো দীপ্ত। ক্লান্ত, রুগ্ন, শক্তিহীন শরীরটি বসে পড়লো বাথরুমের মেঝেতে।

এদিকে দীপ্ত এর ঘরের বাহিরে ঘাপটি মেরে অবস্থান করছিলো জমজেরা। কান পেতে শুনছিলো দীপ্তের প্রতিটি গতিবিধি, যেনো কোনো নামকরা গোয়েন্দা টিমের সদস্য। যখনই দীপ্তের ঘরের বাথরুমের পুরোনো জং ধরা দরজার শব্দ পাচ্ছিলো তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো। একে অপরের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিচ্ছিলো। আসলে দীপ্তের এই পেট মোচড়ের কৃতিত্ব সম্পূর্ণ জমজের। সেদিনের গোবড়কান্ডের পর রুবি তাদের সদর দরজার বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা। সেই সময়ে ঘরে যারাই প্রবেশ করছিলো এই দুজনের অবস্থা দেখে না চাইতেও মুখ টিপে হাসছিলো৷ ব্যাপারটা অপমানজনক। দীপ্ত যদি সেই সময় ওদের পাশে না দাঁড়াতো ওদের গোবড়কান্ড ফাঁস হতো না, কেউ জানতো না, শাস্তি ও পেতে হতো না। ফলে দীপ্তের প্রতি অসামান্য ক্ষোভ জন্মেছে তাদের। এমনিতেও দীপ্ত দিনকে দিন চক্ষুশূল হয়ে উঠছে তাদের৷ ভীষন সন্দেহ হয়। মতিগতি কিছু সুবিধের নয়। ফলে সেদিনের শোধ তুলতেই এই চটপটি বুদ্ধি বের করলো এশা। রহমত পাড়ার বিখ্যাত চটপটিতে মিশিয়ে দিলো নিজের তৈরি ফর্মূলা নম্বরা ২০৩। যদিও আশা বেশি পরিমাণ মিশাতে চেয়েছিলো, তখন এশা বাধা দিয়ে বললো,
“বেশি না, কম মিশা। যেনো অন্তত ১০-১২ বার হয়”
“এতো কম কেন? চেরাগআলীর জন্য সাড়ে চার ঘন্টা ভুতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওকেও সাড়ে চারঘন্টা বাথরুমে কাটাতে দে”
“একেবারে না, পাখিকে খেলিয়ে খেলিয়ে মা’র’বো। ওই ব্যাটা ঘুঘু দেখেছে ফাঁ’দ দেখে নি। আমরা ওকে ফাঁদে ফেলে বোঝাবো কত ধানে কত চাল! আর একেবারে এতো দিলে সন্দেহের মুখোমুখি হবো। বার কয়েক হলে এটা স্বাভাবিক মনে হবে। এমনেও ব্যাটা বিদেশী মাল, দেশী খাবার পেটে সয় না। দেখিস নি, মিনারেল পানি বাদে খেতে পারে না। তুই যদি বেশি দিস আমাদের জ’ল্লা’দ মা বুঝে যাবে। আর ওই চেরাগআলী ও আমাদের উপর ভরসা করবে না। এটা হতে দেওয়া যাবে না। ধীরে ধীরে ওকে বোঝাতে হবে। আর ফর্মূলা ২০৩ ই তো সব নয়। ওর উপর ফর্মূলা ৩০৩, ৪২০ ও এপ্লাই করবো। শুধু সময় আসতে দে”

এশার কথা শুনে পৈশাচিক হাসি হাসে আশা। হিং’স্র প্রাণী যখন বহু খোঁজের পর তার শিকারকে খুঁজে পায় তখন যেমন তাদের চোখ চকচক করে, জমজদের চোখ ও চকচক করছে। তারা দুজন মিলে “হু হাহা” করে পৈশাচিক হাসি দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু হলো না, স্বরে টান লাগায় উভয় ই কেশে উঠলো। তবে তাদের মনে প্রফুল্লতা কমলো না। দীপ্তকে না’কে দ’ড়ি দিয়ে ঘুরাবার আনন্দ যেনো অমূল্য________

ডাইনিং টেবিলে সকলে একত্রিত হলো। আজ একটি বিশেষ দিন। আজ জীবনে প্রথমবারের মতো ধারা রান্না করেছে। মামা বাড়িতে সর্বদা আদর এবং স্নেহে মানুষ হবার দরুন রান্নাঘরে কারণ ব্যাতীত যাওয়া পড়ে নি তার। ধারার মনে আছে, সে যখন ক্লাস টেনে পড়তো অতি উৎসাহী হয়ে নানাভাই কে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবার জিদ ধরে। বড়মার হাজারো মানার পর ও সে রান্না করে। রান্না যেমন ই হোক না কেনো, গোল বাধে যখন ডিম ফু’টে তেল ছি’টে পড়ে ধারার হাতে। বেশ ক জায়গায় গরম তেল পড়ায় পু’ড়ে যায়। ফলে সুভাসিনী বেগম এবং জামাল সাহেব কড়া নিয়ম জারি করে, ধারার প্রয়োজন ব্যতীত রান্না করার প্রয়োজন নেই। তার পর থেকে চা বানানো ব্যতীত কোনো রান্না ধারা করে নি। তবে আজ করছে। করছে কেবল অনলের জন্য। সুভাসিনী বেগম গাইগুই করেছেন বহুবার। কিন্তু ধারা শুনে নি। অনলের পছন্দের খাবার রান্না করবে সে। অনলের বরাবরই খিঁচুড়ি, ডিমভুনা এবং বেগুনের আঁচার বড্ড পছন্দ। উপরন্তু আজ বর্ষার দিন। বৃষ্টির ভেজা রাতে খিঁচুড়ি না হলে যেনো বাঙ্গালীর মন ভরে না। তাই ধারাও নিজের প্রণয়নের জন্য রান্না করলো এই তিনপদ। জামাল সাহেব অতি উৎসাহী, যদি ও হার্টের ব্যামোর জন্য ডিমের কুসুম অংশ, ঘি খাওয়ায় তার বাধ্যবাধকতা আছে। তবুও ধারারানীর হাতের রান্না সে খাবেই। ধারা সকলকে বেড়ে দিলো খাবার। অনলের দিকে তাকিয়ে আছে সে অধীর আগ্রহে। টেবিলে নিজের কিশোরী বউ এর সন্ধ্যা থেকে করা কষ্টের অমূল্য ফল দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো অনলের। একমুগ্ধতা নিয়ে তাকালো সে ধারার দিকে। অনলের হাসি লেপ্টানো মুখখানা দেখে সকল কষ্ট পরিশ্রম যেনো সার্থক মনে হলো ধারার। অনল সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে নিজের পাশের চেয়ার খানা একটু সরিয়ে দিলো। বোঝালো, “এখানে এসে বস”। ধারাও সেই ইঙ্গিত অনুসরণ তার পাশে গিয়ে বসলো। ধারা বসতেই অনলের রুক্ষ্ণ হাতটা তার কোমল হাতটি আয়ত্ত করে নিলো। এতোসময় পানির কাজ করায় হাতটি ঠান্ডা হয়ে আছে। ফলে অনলের হাতের উষ্ণতা নিমিষেই ছড়িয়ে পড়লো ধারার হাতে। ধারা মাথা নামিয়ে নিলো। ভীষণ লজ্জা তাকে ভর করেছে। এরমাঝেও যেনো একরাশ ভালোলাগা মিশে আছে।

জামাল সাহেব খাবার মুখে তুললেন। খাবার খেয়েই তার চোখ টলমল করে উঠলো। ভেতরটা আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলো অজান্তেই। প্রয়াত মেয়ের কথা মনে পড়ছে। প্রতিটি বাবার কাছে তার মেয়ের রান্না মায়ের রান্নার সমতূল্য। সুরাইয়ার রান্নাও জামাল সাহেবের অতিপ্রিয় ছিলো। অতি সচেতন মানুষটিও তখন অসচেতন হয়ে যেতো, গোগ্রাসে গিলতেন মেয়ের রান্না। আজ এতোটা বছর পর তার মনে হলো তিনি সুরাইয়ার হাতের রান্না খাচ্ছেন। ফলে অজান্তেই পেটের সাথে মনটিও তৃপ্ত হয়ে উঠলো।

এর মাঝেই ডাইনিং এ উপস্থিত হলো দীপ্ত। তার শুভ্র চেহারাটি মূর্ছা গেছে, কোকড়ানো বাদামী চুল ঘামে অবিন্যস্ত হয়ে আছে। চোখগুলো নিস্প্রভ, ঠোঁটজোড়া শুকনো। দেখে মনে হচ্ছে যেনো ঝড় চলে গেছে তার উপর। তাকে দেখেই সুভাসিনী বেগম শুধালেন,
“দীপ্ত খাবে না?”
“না আন্টি, আই এম নট ফিলিং ওয়েল। পেটটা ভালো নেই”
“এ বাবা ডাইরিয়া হলো নাকি?”
“মে বি?”
“তুমি কি কিছু উলটা পালটা খেয়েছিলে?”

দীপ্ত এবার জমজদের দিকে করুন দৃষ্টিতে চাইলো। কিন্তু তারা নির্বিকার। বরং উলটো অতি আগ্রহী চাহনীতে দীপ্তের দিকে চেয়ে রয়েছে। দীপ্ত একটু রয়ে সয়ে বলল,
“টুইন্স গেভ মি এ বাউল অফ চটপটি। সেটা এই পাড়ায় ফেমাস নাকি! ওটাই খেয়েছিলাম। তারপর থেকে এই অবস্থা?”
“তুমি চটপটি খেতে গেলে কেনো? তোমার বিদেশি পেটে কি অগুলো সইবে?”

দীপ্তের কথা শেষ না হলেই ফট করে কথাটা বলে উঠলো ইলিয়াস। ইলিয়াসের কথা শুনে মুখশ্রীতে বিজ্ঞ ভাব টেনে এশা বললো,
“ও, দাদাজান এই ঘটনাকেই কি বলে “কু’ত্তার পেটে ঘি সয় না”?

এশার কথা কর্ণপাত হতেই হো হো করে হেসে উঠলেন জামাল সাহেব। উপস্থিত সকলেও হাসি কোনোমতে আটকালো। দীপ্ত খেয়াল করলো ধারা দু হাত দিয়ে মুখ চেপে বসে রয়েছে। সে কোনো মতেই নিজ হাসি আটকাতে পারছে না। প্রবাদটির অর্থ না জানলেও দীপ্ত ঠিক বুঝলো এটার অর্থ বেশ সুবিধার নয়। নিজের করুন অবস্থাতে বেশ লজ্জিত হলো সে। শুভ্র মুখশ্রীটা লজ্জা এবং অপমানে কালচে বর্ণ ধারণ করলো। এশা তখন বিনয়ী স্বরে বললো,
“দীপ্ত ভাই, আমি কিন্তু আপনাকে কু’ত্তা বলি নি। আসলে প্রবাদ তো, বই তে পড়েছি। সেটাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করলাম মাত্র। আপনি কিন্তু রাগ করবেন না। আসলে বুঝিতে পারি নি আপনার পেট খারাপ হবে। জানলে কখনোই চটপটি দিতাম না। ভাবলাম বৃষ্টির দিন সবাই যেহেতু খাচ্ছে আপনিও উপভোগ করুন। কিন্তু এতে যে আপনার এই হাল হবে কে জানতো! সরি”

দীপ্ত নিস্প্রভ, মলিন হাসি হাসলো। নিজের অবস্থার জন্য তো বাচ্চা মেয়ে দুটোকে দায়ী করা যায় না, যেখানে তারা তো বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে এসেছিলো। ধারা নিজের হাসি আটকাতে পারছে না, সে তো জানে তার মামাতো বোনেদের প্রখ্যাত স্বভাব। দীপ্তকে দেখে প্লাবণের কথাটা স্মরণ হলো। না চাইতেও শব্দ করে হেসে উঠলো সে। তাকে থামাতে অনল তার হাটু চেপে ধরলো। ইশারা করে বোঝালো, “হাসি বন্ধ”। কিন্তু ধারা তো ধারা, মুখ চেপে হাসতে লাগলো অনবরত। এর মাঝে জামাল সাহেব বাজখাঁই কন্ঠে বলে উঠলেন,
” সুভাসিনী”
“জ্বী, আব্বা?”
“এই বিদেশী ফকিরটারে একটু চিড়া আর দই মাখায় দাও। আমি চাই না, কেউ বলুক জামালের বাড়িতে মানুষ না খাইয়া ঘুমায়। আর ওরে কও স্যালাইন খাইতে, সামান্য চটপটি যে খাইতে পারে সে আইছে আমগোর দেশে। হাহ, যতসব”

সুভাসিনী তাই করলো, একটা বাটিতে চিড়া আর দই মেখে দিলো। দীপ্ত কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। এতোসময় বাথরুম টু ঘর আর ঘর টু বাথরুম করে সত্যি ক্ষুদা লেগেছিলো, কিন্তু খিঁচুড়ী দেখে ভয়ে খেতে চাচ্ছিলো না। বলা তো যায় না, রাতটা না বাথরুমেই কাটে_____

খাবার শেষে জমজেরা নিজের ঘরে যেতে ধরলে ধারা তাদের খপ করে ধরলো। চোখ ছোট ছোট করে সন্দীহান কন্ঠে বললো,
“সত্যি করে বল তো, চটপটিতে কি মিশিয়েছিস? ফর্মূলা ২০৩?
“ধারাপু এটা ঠিক নয়, তুমি বরাবর আমাদের সন্দেহ করো। আমরা কি কাউকে বিনা কিছু মিশিয়ে দিয়ে পারি না? আমরা সত্যি অনুতপ্ত!”

ভীষণ করুন গলায় বললো আশা। এশা ও চোখগুলো আহত বিড়ালের মতো করে রাখলো। তাদের করুন মুখশ্রীতেও ধারার মন গললো না। ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
“মার কাছে মাসির গল্প দিও না। সত্যি করে বল! আমি কিন্তু ছোট মামীকে বলে দিবো। এবার কান ধরিয়ে পাঁড়ার ল্যাম্পপোস্টে দাঁড় করাবে”
“থাক আশা, এই নির্দয় মহিলা আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। ছেড়ে দে”

হতাশ দুঃখভরাক্রান্ত কন্ঠে কথাটা বললো এশা। আশাও তাল মিলালো,
“এটাই যা’লি’ম সমাজ, সত্যের দাম নেই। আমাদের মতো অসহায়রা কোথায় যাবে”

ধারার না চাইতেও হাসি পেলো, কিন্তু নিপুন ভাবে তা গোপন করে গেলো। নিজের বোনদের এই নাটক তার জানা। এই দুটোর হাড় নয়, অস্থিমজ্জাও তার পরিচিত। এর মধ্যেই পুরুষালী গম্ভীর কন্ঠ কানে আসে,
“কি রে! গান্ধীর তিন বা’দ’র এখানে জট পাকিয়েছিস কেনো?”

অনল তখন দীপ্তকে ঔষধের বাক্স দিয়ে এসেছে। অনলের কথা শুনে তিনজন সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ধারা গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“জিজ্ঞাসাবাদ চলে, এই দুটোর চটপটি কারসাজির জিজ্ঞাসাবাদ”

এশা আশা শুকনো ঢোক গিলে। অনলের সামনে তাদের সব অভিনয়গুলো যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ভেবেছিলো অনল ভাইও হয়তো জিজ্ঞাসাবাদ করবে। কিন্তু তাদের অবাক করে অনল বলে,
“যা করছিস কর, ধরা পড়িস না। আর একটা কথা, চোখ কান খোলা রাখবি। ওই দীপ্ত যেনো আমার বউ এর ত্রিসীমানায় না থাকে। মনে থাকবে?”
“আই আই ক্যাপ্টেন”

বলেই দুটো একসাথে অনলকে স্যালুট দেয়। অনল ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। তারপর ধারার হাতটা নিজের হাতের ফাঁকে নেয় এবং পা বাড়ায় নিজ ঘরের দিকে। অনল চলে গেলে আশা এশাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“বুঝলি কিছু?”
“হুম, বুঝছি”
“কি?”
“অনল ভাই এর মাথা গেছে”

*******

নিজ রুমে আসতেই ধারা অনলের টিশার্টের কোনা টেনে ধরে। ধারার এমন আচারণে খানিকটা প্রফুল্ল হলেও তা প্রকাশ করে না অনল। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“কি চাই?”
“রান্না কেমন ছিলো?”

ধারা লাজুক স্বরে কথাটা বলে। যেনো কোনো নববধু তার স্বামীর মুখে নিজের প্রশংসা শুনবার জন্য অধীর হয়ে আছে। ওড়নাটা নিজ হাতের ফাঁকে নিজে দলা পাকাতে পাকাতে বললো,
“আমি তোমার জন্য রান্না করেছি। বললে না তো রান্নাটা কেমন হয়েছে?”

অনল সময় নিলো। কিছুসময় অপলক নজরে তাকিয়ে রইলো সামনে দাঁড়ানো কিশোরী মেয়েটির পানে। সে প্রতীক্ষিত। প্রতীক্ষা ভালোবাসার মানুষটির মুখে নিজের প্রশংসা শোনার। যদিও খিঁচুড়িটি হালকা লবণ ছিলো, ডিমভোনায় হালকা ঝাল বেশি হয়েছিলো আর বেগুনের আঁচার ঈষৎ পুড়ে গিয়েছিলো; কিন্তু খাবারগুলো ধারার ভালোবাসায় ছিলো পরিপূর্ণ। মেয়েটি সন্ধ্যা থেকে ধৈর্য্য ধরে রান্নাটা করেছে। অনল স্মিত হাসলো। অনলের বলতে ইচ্ছে হলো,
“খাবার এতো সুস্বাদু হয়েছে যে আমার ইচ্ছে করছিলো রাধুনীর হাতে একটা শীতল চুমু একে দেই”

কিন্তু সেটা সে বললো না। উলটো একটা দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো মাথায়। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“মন্দ হয় নি, খাওয়া যাচ্ছিলো বটে। তবে এতোটা কষ্ট করে রাধলি একটা পুরস্কার তো পাওনা তোর”
“কি পুরষ্কার? কি দিবে আমায়?”

উৎসাহী কন্ঠে বললো ধারা। অনল একটু থেমে বললো,
“চোখ বন্ধ কর, সারপ্রাইজ বলে কথা”

ধারা সাথে সাথে চোখ বুজলো। মস্তিষ্কে হাজারো কল্পনা জাগলো। কি হতে পারে সারপ্রাইজ? কি দিবে অনল ভাই? বেলীর মালা! নাকি একজোড়া নুপুর! নাকি ধারার অতি পছন্দের এক পাতা কাগজের টিপ! নাকি গোছা কয়েক রেশমি চুড়ি! ধারা বই তে পড়েছিলো, নায়কেরা নায়িকাদের চমকে দিতে নানারকম উপহার দেয়। নায়িকার মুখে হাসি ফোটার জন্য কেউ কেউ তো অঝর বর্ষায় ভিজে নিয়ে আসে বছরের প্রথম ফোটা সিন্ধুপুষ্প। অনল ও কি তেমন হবে! আসলে আত্মদাম্ভিক, কঠিন, জেদী মানুষটি অকপটে প্রেম নিবেদন করলেও প্রণয়ের প্রকাশটি করবার ধরণ তার বড্ড বিচিত্র। তার ভালোবাসার ধরণ বড্ড বিচিত্র। কাছে আসার আগ্রহটি যেনো ধারার ই বেশি। অনল বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত। ধারা উন্মুখ হয়ে আছে তার সারপ্রাইজের জন্য। মিনিট পাঁচেক বাদে অনল বললো,
“হাত এগিয়ে দে”

ধারা মন প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। হাতখানা নির্দ্বিধায় এগিয়ে দিলো। অনল তার হাতে কিছু রাখলো। যার ভারে হাত ভেঙ্গে আসার জোগায়। ধারা সাথেই চোখ খুললো। চোখ খুলতেই তার মুখ বিস্ম্যে হা হয়ে গেলো। অবাক কন্ঠে বললো,
“এগুলো কি?”
“ইংলিশে বলে নোট আর খাস বাংলায় বলে চোঁ’থা”

ধারায় মাথায় যেনো আগুন জ্বললো। এই মানুষটা এমন কেনো! তার জন্য গরমে ঘেমে নেয়ে এতো সময় রান্না করেছে আর সে কি না এই বস্তা ভর্তি গণিতে ভরা কাগজ ধরিয়ে বলে এটা সারপ্রাইজ। ক্ষিপ্ত কন্ঠ বললো,
“তুমি এমন আনরোমান্টিক কেনো বলতো? একদম খা’চ্চ’র, বেরসিক, চরম আমরোমান্টিক একটা বর। কার বর তার বউ কে উপহার স্বরুপ এই নোটপত্র দেয়, শুনি?

কাগজের স্তুপ সজোরে টেবিলে রাখলো সে। ধারা রীতিমতো রাগে ফুসছে। তার চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। অনল মুগ্ধ নজরে তার বউ কে দেখলো কিছুসময়। তারপর এগিয়ে এসে তার চোখে চোখ রেখে নরম স্বরে বললো,
“তা আমার বউ এর ঠিক কেমন রোমান্টিক স্বামী চাই?”………

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here