#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৩৬)
#কুরআতুল_আয়েন
মনের কোণে অনুভূতিরা জাগতে বেশি সময় লাগে না।ঠিক একইভাবে,খুশির মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে।তবে,সেসব অনুভূতি ঘিরে শুধু রায়ানেই আছে।খুশি নিজেও নিজের মনের মতিগতি বুঝতে পারছে না।সে তো এই মানুষটাকে বিন্দুমাত্রও সহ্য করতে পারতো না।কিন্তু,আজ এই মানুষটার সংস্পর্শ তার বেশ ভালো লাগছে।খুশি এখনো রায়ানের বুকে মাথা ঠেস দিয়ে রেখেছে।তবে,খুশির খুব ইচ্ছা করছে রায়ানকে একটিবার ভালো করে দেখতে।সে তো লজ্জায় রায়ানের দিকে ভালো করে তাকাতেও পারে নি।ভিডিও কলে আবছা আবছা দেখলেও সামনাসামনি তো সেই কবে দেখেছিলো।খুশি ধীর গতিতে চোখ উঁচু করে রায়ানের দিকে তাকালো।উঁহুহু!মানুষটা আগের মতোই আছে।বরং,বিদেশের আবহাওয়ায় যেনো আরো সুন্দর হয়ে গিয়েছে।কে বলবে!মানুষটার বয়স ত্রিশ প্লাস।খুশির শব্দহীন ভাবে হেসে উঠলো।তার মনের এইসব কথা গুলো ভেবে নিজেই নিজের মনে হেসে উঠলো।
রায়ান চোখ খুলে তাকালো খুশির দিকে।খুশিকে তার দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বললো,
–“কি হয়েছে?এইরকম ক্যাবলার মতো হাসছো কেনো।পাগল টাগল হয়েছো নাকি।”
খুশি সাথে সাথেই মাথা নিচু করে নিলো।ইশশ!কি লজ্জাটাই না পেলো সে।সে তো আর জানতো না রায়ান চোখ মেলে তাকে এইরকম একটা প্রশ্ন করবে।অবশ্য,রায়ানের এইরকম প্রশ্ন করা যুক্তিযুক্ত।কারণ,সেই তো রায়ানের দিকে তাকিয়ে হাসছিলো।
রায়ান বার কয়েক চোখের পলক ফেলে তাকালো খুশির দিকে।খুশিকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে কিছুটা জোর গলায় বললো,
–“বললে না তো হাসছিলে কেনো।তাও আবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।আচ্ছা!আমার মুখের প্যার্টান কি রম্বসের মতো হয়ে গিয়েছে নাকি ট্রাপিজিয়াম।এই দুটো সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে তো।”
খুশির মুডের বারোটা থেকে চৌদ্দটায় গিয়ে পৌঁছছে।হা করে তাকিয়ে আছে রায়ানের দিকে।রায়ান খুশির হাবভাব দেখে চোখ মুখ উল্টিয়ে বললো,
–“আবারও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছো।উমম!!এই খুশি প্রেমে পড়লে নাকি আমার।”
খুশি রায়ানের কথা শুনে থতমত খেয়ে গিয়েছে।এই কথার উত্তর তার কাছে জানা নেই।সে শুধু এটাই জানে,রায়ানের প্রতি সে অন্যরকম একটা অনুভূতি অনুভব করতে পারছে।তাই,মিনমিনে গলায় বললো,
–“ছাড়ুন আমাকে।আমি বাহিরে যাবো।”
–“হুশ!একদন্ডও ছাড়বো না তোমাকে।পাঁচ বছর দূরে থাকার কষ্ট বুঝো তুমি?তুমি বুঝবে কি করে!তখন তো তুমি ছোট ছিলে।আর,এখন একদম আস্ত একটা মহিলা হয়ে গেলে।”
–“কি!আমি মহিলা??সবেমাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিবো।তার আগেই আমাকে মহিলা উপাধি দিয়ে দিলেন।”
–“আমার কি দোষ বলো!তোমার শরীরের কিছু অঙ্গ প্রতঙ্গের দিকে তাকালেই বুঝা যায় তুমি মহিলা নাকি যুবতী।”
রায়ানের কথাটায় খুশির শরীর জ্বলে যাওয়ার উপক্রম।দাঁতে দাঁত পিষে চেয়ে রইলো রায়ানের দিকে।রায়ানের সেদিকে কোনো ভাবান্তর নেই।তার ভাব এমন,সে কাউকেই কিছু বলে নি।খুশি রায়ানকে দূরে ঠেলে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।দৌড়ে বেলীর রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো।শরীর টাকে এপাশ ওপাশ করে হেলিয়ে দুলিয়ে নিজেকে অনেকক্ষণ ধরে দেখে নিয়ে বিরবির করে বলতে লাগলো,
–“কই!আমি তো ঠিকই আছে।আমাকে তো মহিলা লাগে না।আচ্ছা!লোকটার কি মাথায় সমস্যা আছে?হয়তোবা আছে!বিদেশির ধূলোময়লায় মস্ত বড় মাথাটাই মনে হয় ধূলোময়লায় ভরে গিয়েছে।না হলে!কি আমাকে মহিলা বলতো।”
খুশি চলে যেতেই রায়ান হাসতে হাসতে শেষ।যাক,খুশিকে বোকা বানিয়ে তার এখন বেশ ভালো লাগছে।পরমুহূর্তেই চোখ,মুখ কঠিন করে নিজেই নিজের মাথায় চাপড় মেরে বললো,
–“উঁহুহু!রায়ান একদমই হাসা যাবে না।নিজেকে শক্ত করে রাখবি খুশির সামনে।না হলে,কীভাবে বুঝাবি তোর কষ্টের কিছু অংশ।”
রায়ানি মুখে ডেভিল একটা হাসি টেনে বললো,
–“আমি তো আগেই বলেছি এবার তোমার টার্ন খুশি।এতে কেনো ছাড় নেই।”
—-
বেলী রান্নাঘরে এসেছে রাতের খাবার তৈরি করার জন্য।রায়ান আর অনামিকাকে রাতে না খাইয়ে যেতে দিবে না।শিউলি কান্না করছিলো বলে আফিয়া আর কোহিনূর মিলে সামনের পার্কে নিয়ে গিয়েছেন।বেলী না করলেও আফিয়া আর কোহিনূর কিছুতেই শুনেন নি।তাই,অগ্যাতা,বেলী চুপ মেরে যায়।বেলী ভেবে পায় না শিউলির হাবভাব!রাগ করলে রাগ চড়ে উঠে সপ্তম আকাশে আর অভিমান করলে অভিমানও চড়ে উঠে সপ্তম আকাশে।রাগ,অভিমানের দিক দিয়ে শিউলি একদম বুরাগের মতো।বাপ বেটি দুইজনেই এই দিক দিয়ে একশো তে একশো।
বুরাগ সুযোগ বুঝে রান্নাঘরে এসে নিঃশব্দ হীন ভাবে দাঁড়ালো।বেলী যে তার উপর খুব রেগে আছে সে ঠিকই বুঝতে পারছে।বুরাগ আশপাশ তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বেলীকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
বেলী বুরাগের উপস্থিতি টের পেয়েও কিছু বললো না।ইচ্ছে করে বুরাগের দিকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো।বেলীর বিরক্তির চাহনি দেখে বুরাগ বেলীকে ছেড়ে দিয়ে সুড়সুড় করে রান্নাঘর থেকে চলে গেলো।সে বেলীর এরূপ চাহনি বিয়ের পর থেকে একবারও দেখে নি।বুরাগের নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।এক মেয়েও তার কাছে ঘেঁষছে না আর বউও তাকে তার কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না।
—-
হাসির অনেক জোরাজুরিতে খুশি ছাঁদে সবার সাথে গিয়ে যোগ দিলো।খুশির বেশ লজ্জা লাগছে।সে তো কিছুতেই আসতে রাজি ছিলো না।রায়ানের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তার নেই।আচমকাই যেনো নিজের মধ্যে লজ্জার গোডাউন এসে ভিড় করে বসলো।রায়ানও বুঝতে পারছে খুশির মনের অবস্থা।তবে,তার বেশ লাগছে খুশিকে এইভাবে দেখতে।
অনামিকা অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছে রায়ানকে।রায়ানের চোখ অনুসরণ করে খুশির দিকে তাকালো।কেনো জানি তার মোটেও ভালো লাগছে না খুশিকে।এমনকি রায়ানের তাকানোর হাবভাবও না।পরমুহূর্তেই নিজের মনকে নিজেই বুঝ দেয়,আরে ও তো একটা ছোট বাচ্চা ওকে রায়ান কোনোমতেই পছন্দ করতে পারবে না।তাছাড়াও আমার পাশে এই মেয়ে কিছুই না।
নিজের মনকে বুঝ দিয়েও অনামিকা কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না।মন শুধু বারংবার উশখুশ করে উঠছে।রায়ানের দিকে পরোক্ষ করে দেখলো রায়ান এখনো তাকিয়ে আছে তার দিকে।তবে কি রায়ানের মনে খুশিকে নিয়ে কিছু আছে ভাবতেই অনামিকা ক্ষিপ্ত চোখে তাকালো খুশির দিকে।খুশির থেকে চোখ ফিরিয়ে অনামিকা রায়ানের মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
–“কোথাও এতো হারিয়ে গেছো তুমি রায়ান।আগে তো কখনো তোমাকে এইরকম দেখি নি।”
রায়ান কিছুটা চমকে উঠলো।গলা কেশে খুশির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
–“হারিয়ে যাওয়ার মতোন জিনিস বা বস্তু যদি সামনে থাকে তাহলে তুমি কি করবে অনা?”
–“অবশ্যই হারিয়ে যাবো তার মাঝে।কিন্তু,তুমি কার মাঝে হারিয়ে গিয়েছো রায়ান?”
রায়ান মুচকি হেসে বললো,
–“বাকিটা তোমার জানতে হবে না অনা।আমি আমার উত্তর জেনে গিয়েছি।তুমিও হারিয়ে যাবে তার মাঝে।সেইম আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম তার মাঝে।”
অনামিকা রায়ানের এমন খাপছাড়া উত্তরে একদম সন্তুষ্টি হয় নি।সে যা বুঝার বুঝে গিয়েছে।খুশির দিকে রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে অনামিকা রায়ানের হাত চেপে ধরলো।রায়ানের শরীর ঘেঁষে বসে পড়লো।খুশিকে দেখিয়ে হেসে হেসে কথা বলছে রায়ানের সাথে।
আর,রায়ানের খুব অস্বস্তি হচ্ছে।অনামিকার এইরকম শরীর ঘেঁষে বসায় তার খুব রাগ হচ্ছে।কিন্তু,কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না।রায়ান খুশির দিকে তাকিয়ে দেখলো খুশি তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।সুন্দর মুখশ্রীতে অন্যরকম একটা ছাপ পড়ে আছে।রায়ান খুশির মুখের দিকে তাকিয়েই অনামিকাকে উদ্দেশ্য করে কিছুটা জোড়ালো গলায় বললো,
–“অনা প্লিজ ছাড়ো।এইটা বিদেশ নয় অনা।এইটা বিডি।বিডিতে এইসব চলে না।আর,আমার ভাবতে অবাক লাগে তুমি এই বিডির মেয়ে তাহলে তুমি কীভাবে এইরকম একটা কাজ করো।”
পাশ থেকে হাসি কিছুটা আমোদিত গলায় বললো,
–“তার মানে কি রায়ান ভাইয়া!আপনি আর অনামিকা আপু বিদেশে ওইভাবে চলাফেরা করতেন।সব বুঝি আমরা।ওহহো!অনামিকা আপুর গাল দুটো একদম লাল হয়ে গিয়েছে।প্রমাণ পেয়ে গেছি আমরা।আর,কিছু বলা লাগবে না।আর,রায়ান ভাইয়া সমস্যা নেই!আমাদের সামনে আপনারা দু’জন ফ্রি থাকতে পারেন।যা মন চায় তাই করতে পারেন।আমরাও দেখেও না দেখার ভান করে থাকবো।”
খুশির মনটা নিমিষেই অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে।ভিতরে অসহনীয় এক ব্যথা অনুভব করছে।সেই সাথে একরাশ অস্থিরতা।তাহলে,কি উনাদের মধ্যে অন্যরকম সম্পর্ক আছে।না হলে,উনি কেনোই বা বললো এইটা বিডি।এইখানে এইসব কোনো কিছু না করতে।এই কথা দ্বারা সম্পূর্ণ বুঝা যায় বিদেশে তারা দু’জন একসাথেই ছিলো।ছি ছি!উনি এতোটা খারাপ।আর,আজকে বড়মাও তো বলেছিলো উনাকে এই আপুকে যেনো বিয়ে করে নেয়।আচ্ছা!উনাদের মধ্যে সেইরকম কিছু না থাকলে বড়মা কেনো বলবে এইসব কথা!!
কথাগুলো ভেবেই খুশির দলা পাঁকিয়ে কান্না আসতে লাগলো।সটান করে উঠে দাঁড়ালো।এইখানে আর একদন্ডও থাকতে পারবে না সে।খুশি উঠতেই রায়ান চমকে উঠলো।রায়ান যেটার ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হয়েছে।এতো মানুষের মাঝে সে কিছুতেই খুশির কাছে যেতেও পারছে না।খুশির দিকে তাকিয়েই রায়ানের বুকটা আঁতকে উঠলো।মেয়েটার মুখ,চোখ একদম লাল হয়ে গিয়েছে।
খুশি সামনের দিকে পা বাড়াতেই হাসি চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
–“এই খুশি!তোর কি হয়েছে বল তো।তুই তো এইরকম মনমরা থাকিস না।আজকে তোকে খুব অন্যরকম লাগছে।কি হয়েছে রে তোর।”
খুশি এক কদম এগিয়ে গিয়ে থেমে বললো,
–“আমার কিছু হয় নি হাসি।আমি ঠিক আছি।শুধু একটু মাথা ব্যথা হচ্ছে।বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবো।”
—-
রাতে খাবার টেবিলে বসে রায়ান একদন্ডও খাবার মুখে দিতে পারে নি।সবাই থাকলেও খুশি নেই।খুশিকে এইখানে খুব আশা করেছিলো রায়ান।কিন্তু,তার আশা একদম নিরাশা হিয়ে গিয়েছে।কোনোমতে খেয়ে রায়ান সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলো।যাওয়ার আগে আরো একবার তাকিয়ে ছিলো খুশির রুমের দিকে।কিন্তু,লাভের লাভ কিছুই হয় নি।আগের মতো নিরাশা হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।অনামিকা আগেই গাড়িতে গিয়ে বসে আছে।এই বাসা থেকে যতো আগে বের হতে পারে ততই ভালো তার জন্য।
খুশি জানালার পর্দার আড়াল থেকে রায়ানকে দেখছে।অবাধ্য মন শুধু রায়ানকে দেখার অস্থিরতায় হয়ে উঠছিলো।সেই কখন থেকে এইখানে দাঁড়িয়ে আছে রায়ানকে দেখবে বলে।অপেক্ষা করতে করতে মশার কামড়ও খেয়েছে।তাও রায়ানকে সে একপলক দেখতে চায়।
রায়ান গাড়িতে উঠার আগে চট করে খুশির রুমের জানালার দিকে তাকালো।পর্দার আড়াল থেকে খুশিকে সে দেখতে পেরেছে।মুহুর্তেই চোখ,মুখে উল্লাস ভরে উঠলো।গাড়ির দরজা খুলে হাসতে হাসতেই স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখলো।
আর,খুশি ছিটকে দূরে সরে গিয়েছে জানালার পাশ থেকে।সে তো ভাবতেই পারে নি রায়ান তার রুমের দিকে চোখ নিক্ষেপ করবে।হাত,পা কেমন তার থরথর করে কাঁপছে।
|
বেলী নাইটি টা পড়ে করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো।আজকে তার উপর অনেকটা দখল গিয়েছে।আরো একটু হিমশিম খেয়েছে শিউলিকে খাওয়াতে গিয়ে।লাস্টে রাগ করে আলতো করে একটা চড়ও বসিয়ে দিয়েছে শিউলির গালে।চড় বসিয়েও শান্তি হয় নি কোথা থেকে বুরাগ এসে বেলীকে কড়া গলায় বলতে লাগলো,
–“ওকে মারার সাহস করবে না বেলী।তাহলে,কিন্তু তোমার এই বাসায় থাকা চলবে না।ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিবো।সাহস কতো বড়ো,আমার মেয়ের গা’য়ে হাত তুলে।দিনদিন আমি তোমার সাহস দেখে চরম পর্যায়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি।”
তারপরও সব কিছু থেমে যায় নি।শিউলি গাল ফুলিয়ে ধপাধপ্ পা’য়ে বুরাগের কোলে গিয়ে বসলো।ঠোঁট ফুলিয়ে গলা ফাটিয়ে কান্না করে দিলো যার ফলে,বাসার সবাই জড়ো হয়ে গিয়েছে।এমনকি,আজাদ রহমানও চলে এসেছিলেন।উনি,শিউলিকে পছন্দ না করিলেও অপছন্দ করেন না।তবে,শিউলির আজকের কান্নাটায় উনি অনেকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।তাই,রুমে বসে আর থাকতে পারেন নি।আফিয়া স্বামী আজাদ রহমানকে আসতে দেখে অনেকটাই খুশি হয়েছিলেন।বাহিরে প্রকাশ না করলেও ভিতরে ঠিক খুশি লেগে ছিলো।
দাদি,দাদা,ফুপি সবাইকে দেখে শিউলি যেনো আরো জোরে কাঁদতে লাগলো।বুরাগ এবার শিউলির সামলাতেও পারছে না।কোলে নিলেও কোলে উঠছে না।দৌড়ে গিয়ে আফিয়ার কোলে উঠে পড়লেন।আফিয়া চোখ দুটো মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
–“কি হয়েছে আমার দিদি ভাইয়ের!কান্না করছে কেনো।”
শিউলি কান্না করেই যাচ্ছে।কিছুই বলছে না।আফিয়া বেলীর হাতে খাবারের প্লেট দেখে বুঝে গিয়েছেন আসল কাহিনি।তিনিও বেলীকে বকা দিয়ে বেলীর হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে গেলেন সেই সাথে শিউলিকেও।শিউলিও আজ দাদির সাথে চলে গিয়েছে।আজকে,সে দাদির সাথে থাকবে।বাবা,মা’য়ের কাছে তো একদন্ডও না।
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা টা নিয়ে বেলী বেশ ক্ষেপেই আছে।এতো গুলো বকা খেলো সে।কিই বা ভুল টা করেছিলো সে।মা হয়ে মেয়েকে একটা চড়েই তো দিয়েছিলো।না খেয়ে খেয়ে যখন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে তখন তো তারেই কথা শুনতে হবে।আর,এখন আরো রেগে আছে বুরাগের উপর।বুরাগ যে তাকে ইচ্ছে করে কথা শুনিয়েছে তা তার অজানা নয়।ফোঁসফোঁস করে শুধু বুরাগের আসার অপেক্ষা করছে।বুরাগ,ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেলো।শরীর টাকে একটু টানা দিয়ে ধীর গতিতে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো।বিছানা শুতে নিলেই বেলী কোমরে হাত রেখে বুরাগের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বললো,
–“একটু আগে কি যেনো বলছিলেন!আমাকে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাপের পাঠিয়ে দিবেন।তাই তো।”
বুরাগ লম্বা একটা হাই তোলে বললো,
–“বেলী অনেক ঘুম পাচ্ছে।কাল সকালে কথা হবে গুড নাইট।”
–“ঘুমালে কিন্তু আপনার খবর আছে।আমি কিন্তু খারাপ কিছু করে ফেলবো।”
হুট করেই বুরাগ বেলীকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।বেলীকে জড়িয়ে ধরে বেলীর গলায় মুখ গুজে দিয়ে বললো,
–“তারপর।”
বেলী বুরাগের থেকে দূরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।না পেরে বললো,
–“ছাড়ুন আমাকে।হুট করেই ঝাঁপিয়ে পড়েন আপনি আমার উপর।বদলোক একটা!”
–“ঠিকাছে নেক্সট টাইম থেকে জানিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বো।এখন,চুপ থেকে আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও।ভিষণ যন্ত্রণা করছে।”
বেলী আর কিছু বললো না।মুচকি হেসে নিজেকে বুরাগের আরেকটু কাছে নিয়ে গেলো।আলতো হাতে বুরাগের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।হয়তো বেশি ক্লান্ত থাকায়।বুরাগ ঘুম ঘুম চোখে বেলীকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে নিজেও মুচকি হেসে চোখ দুটো পুনরায় বন্ধ করে নিলো।
______
স্নিগ্ধা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।চোখে,মুখে তার রাগ ফুটে উঠেছে।একটা চার বছরের বাচ্চা যে এতো দুষ্টু হতে পারে সে কোনোমতেই ভাবতে পারে নি।ঘর এইদিকে গুছিয়ে গেলে অন্যদিকে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয় তার চার বছরের ছেলে ইফাত।কিছুক্ষণ আগেই,তার এতো সাধের মোবাইল টা ভেঙে গুড়িগুড়ি করে দিয়েছে।স্নিগ্ধার এখনো মনে পড়ে এই সন্তানকে নিয়ে তার লিটনের সাথে কি ঝগড়াটাই না করতে হয়েছিলো।
সেদিন যখন জানতে পারে!আসলেই তার মাঝে ছোট্ট একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে তখন সে নিজের মনে অন্যরকম একটা অনুভূতি খুঁজে পায়।হয়তো সেইটা মাতৃত্বের স্বাদ ছিলো।তাই,সে সিদ্ধান্ত নিলো এই বাচ্চাকে সে পৃথিবীর আলো দেখাবে।খবর টা লিটনকে জানাতেই লিটন একবাক্যে না করে উঠে।তার এক কথা সে কোনোমতেই এইসব ঝামেলা নিজের ঘাড়ে নিতে পারবে না।এই নিয়ে দু’জনের মধে অনেক বিবাদ সৃষ্টি হয়।স্নিগ্ধা তাও তার কথায় অটল ছিলো।যার জন্য,লিটন তার পেটে একদিন খুব বাজে ভাবেই আঘাত করে বসে।তবে,আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হয় নি।স্নিগ্ধা প্রেগন্যান্ট থাকাকালীন লিটন স্নিগ্ধার সাথে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করতো।স্নিগ্ধা তখন বাঁধা দিতে আসলেও লিটন শুনতো না।তবে,স্নিগ্ধার শরীর যখন ভারী হতে শুরু করলো তখন লিটনের মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখতে পেয়েছিলো স্নিগ্ধা।রাতে,বাসায় ফিরতো না।এমনকি,দু’এক রাতও পার হয়ে যেতো।তবে,এইসবে স্নিগ্ধার কোনো মাথা নেই।সে তখন খুব করে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করতে পারছিলো।
স্নিগ্ধা আগের কথা গুলো ভেবেই দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো,নিজের ফোনটার দিকে।
—-
রাস্তা দিয়ে আনমনে হেঁটে যাচ্ছে খুশি।দুপুর হওয়ায় রাস্তাঘাট বলতে গেলে ফাঁকা।কোচিং এ আজকেও যায় নি সে।তার একটুও ভালো লাগছে।তাই,হাসিকে রেখেই সে কোচিং থেকে বের হয়ে চলে আসলো।দুপুরের এই কড়া রোদে হাঁটতে গিয়ে তার খুব কষ্ট হচ্ছে তাও সে গুটিগুটি পা’য়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।
আচমকাই সামনে গাড়ি দেখে খুশি থেমে যায়।এইটা যে রায়ানের গাড়ি তা চিনতে তার অসুবিধা হয় নি।ভ্রুকুটি কুঁচকে গাড়ির দিকে তাকালো।হ্যাঁ ঠিকই ধরেছে সে!রায়ান ড্রাইভিং সিটে বসে আছে।খুশি রায়ানকে দেখেও না দেখার ভান করে সামনে হাঁটা ধরলো।তবে,বেশি দূর যাওয়ার আগেই রায়ান খপ করে খুশির হাত ধরে বললো।গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে পানির বোতল টা এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“আমার উপর অভিমান করেছো বেশ ভালো কথা।তার রাগ আমার উপর দেখাবে!আমার উপর না দেখিয়ে নিজেকে এইভাবে কষ্ট দিচ্ছো কেনো।রোদে এইভাবে হাঁটার দরকার টা কি খুব প্রয়োজন ছিলো তোমার।চেহারার কি করেছো তুমি।”
খুশি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
–“আপনার তা নিয়ে একটুও ভাবতে হবে না।আমার লাইফ আমার ডিসিশন।”
–“বাপরে!কি তেজ।তবে একটু ভুল বললে!তোমার লাইফ পর্যন্ত ঠিক ছিলো পরের কথাটা ভুল ছিলো।শুনে রাখো!তোমার লাইফ রায়ানের ডিসিশন।বুঝলে মিসেস রায়ান!”
খুশি ছলছল তাকালো রায়ানের দিকে।খুশি ভেবে পাচ্ছে না রায়ানের কথার আগামাথা।মিসেস রায়ান কথাটা শুনেই খুশি চোখ দুটো ভরে উঠতে শুরু করে দিয়েছে।ঠোঁট কামড়ে কান্না দমিয়ে রেখে মনে মনে আওড়াতে লাগলো,
–“লোকটা কি আমাকে মেরেই ফেলবে।মিসেস রায়ান বলার মানে কি।তার মানে!কি লোকটা আমাকে ভালোবাসেন।উঁহুহু!তা মোটেও সম্ভব না।উনি তো অনামিকা কে ভালোবাসেন।”
খুশির ভাবনার মাঝেই রায়ান আলতো কন্ঠে বলে উঠলো,
–“কি হলো মিসেস রায়ান।কি এতো ভাবছেন!বলেছিলাম না এই বুকে শুধু আপনার এই বিচরণ থাকবে,সেখানে আর কারোর এন্ট্রি হবে না।আর,এন্ট্রি নিতে গেলেও পারবে না কারণ,কাঁটাতার দিয়ে বেড়া দিয়ে রেখেছি।আসতে গেলেই রক্তাক্ত হয়ে যাবে।”
খুশি চোখ দুটো সরু করে তাকালো।এইরকম সময়ে লোকটা কীভাবে মজা করতে পারে তাই ভেবে পাচ্ছে না খুশি।ইশশ!এখন তার খুব আফসোস লাগছে কেনোই বা কোচিং না করে বেরিয়ে এসেছিলো।তাহলে,আর এখন লোকটার সাথে কিছুতেই দেখা হতো না।অত্যন্ত এইরকম নেশাযুক্ত চাহনি থেকে সে মুক্তি পেতো।ভেবেই খুশি উল্টো ঘুরে বসে পড়লো।
চলবে..