(শেষ পর্ব পর্যন্ত এড করে দেওয়া হয়েছে এতে শেষ পর্যন্তই আছে এর কোন সিজন ২ হবে না যাস্ট এখানে এড করে দেওয়া হয়েছে)
উপন্যাস_প্রপর্ণ(৩৯-সমাপ্ত)
#কুরআতুল_আয়েন
স্নিগ্ধা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লিটনের নিথর দেহটির সামনে।সারা শরীর রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে।বুকের ভিতরে কয়েকটা রড ঢুকে রয়েছে।লিটনের নিথর দেহটা দেখেই স্নিগ্ধা চোখ দুটি বন্ধ করে নিলো।তবে,চোখ পড়লো পাশের লাশটির দিকে।লাশটি একটি মেয়ের।মেয়েটির হাতটা লিটনের হাতের ভাঁজে আঁটকে আছে।স্নিগ্ধা যা বুঝার বুঝে গিয়েছে।ঘৃণায় চোখ ফিরিয়ে নিলো লিটনের প্রাণহীন দেহটার থেকে।সকালের দিকেই স্নিগ্ধার ফোনে ফোন আসে!ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে একটা অটো খুব মারাত্মক ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে।সেখানে দু’জন ব্যক্তি ছিলেন।তারা দু’জনেই সেখানে মারা গিয়েছেন।এমনকি এই ফোনটিও সেই ব্যক্তিটির ফোন।কথাটা শোনার সাথে সাথেই স্নিগ্ধার হাত থেকে ফোনটা ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে যায়।ইফাতকে পাশের বাসায় রেখে স্নিগ্ধা সেই জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।কিন্তু,লিটনের পাশে অন্যমেয়েকে হাত ধরা অবস্থায় দেখবে এইটা কখনোই ভাবতে পারে নি স্নিগ্ধা।প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন তার মনে হচ্ছে মরে গিয়েছে বেশ ভালো হয়েছে।কিন্তু,মনকে বোঝ দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে স্নিগ্ধার।যতোই হোক লিটনকে তো সে একটা সময় খুব ভালোবাসতো।এমনকি ইফাত তাদেরই সন্তান।ইফাতের কথা মনে পড়তেই স্নিগ্ধা ডুকরে কেঁদে উঠলো।এই ছোট একটা ছেলেকে নিয়ে স্নিগ্ধা এই অচেনা শহরে কীভাবে থাকবে।এতোদিন তো লিটন ছিলো।সম্পর্ক ভালো না থাকলেও ভরসা তো পেতো।এইসব ভাবছে আর ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।আকাশের অবস্থা ভালো না।বৃষ্টি হতে পারে।
————-
নিজেকে এখন রুম বন্দী করে রাখে রায়ান।বাহিরের পরিবেশের উপর তার বিরক্তি ধরে গিয়েছে।রায়ান বারান্দার রেলিঙ ধরে দূরের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছে।সেখানে গাড়িঘোড়ার অনেক জ্যাম জমেছে।যা ছুটতে গেলে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।রায়ানের মনে হচ্ছে তারও মনে কষ্টের জ্যাম লেগে আছে।কিন্তু,রাস্তার জ্যাম ছুটলেও তার মনের জ্যাম কিছুতেই ছুটবে না।ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রায়ান।খুশিকে ভুলতে গিয়েও ভুলতে পারছে না।বরং,ভুলতে গেলেই খুশি তার মনে আরো জেঁকে বসে।কিন্তু,রায়ান তার মা ইমা খানমের উপর যথেষ্ট ক্ষিপ্ত।তার এক কথা সে কখনোই বিয়ে করবে না তার উপর অনামিকাকে তো মোটেও না।কিন্তু,ইমা খানম শুনতে নারাজ।উনার একটাই ইচ্ছা অনামিকাকে রায়ানের পুত্রবধূ করে আনা।
ইমা খানম দরজা টা হালকা খোলে রায়ানের রুমে গিয়ে ঢুকে পড়লেন।কাটকাট গলায় বললেন,
–“তোমার সমস্যা টা কোথায় রায়ান অনামিকাকে বিয়ে করতে?”
রায়ান এবার অনেকটা রেগে যায়।সকাল সকাল তার কাছে এইসব একদম অসহ্য লাগছে।এমনকি অনামিকার নামটা শুনলেই তার শরীর বিষের প্রকোপে জ্বলে উঠে।মাঝেমধ্যে নিজেই নিজেকে ধমকে উঠে,কেনো আনামিকাকে সাহায্য করেছিলো!যার প্রতিদান আজকে এইভাবে দিচ্ছে।কিন্তু এবার রায়ানের আর সহ্য হলো না।ইমা খানমের কথার পিঠে কিছুটা জোর গলায় বললো,
–“তোমার সমস্যা কোথায় মা!আমাকে একটু বলবে?কেনো বারবার আমাকে জোর করছো।আমি অনাকে বিয়ে করতে রাজি নই।অনা শুধু আমার বন্ধু।এর বেশি কিছু না।”
–“এটাই তো আমি চাই রায়ান।একজন বন্ধুই পারে অন্য এক বন্ধুকে আগলে রাখতে।ঠিক তেমনি অনামিকাও পারবে তোমাকে আগলে রাখতে।”
–“আমি নিজেই নিজেকে আগলে রাখতে পারবো মা।তার জন্য কাউকে প্রয়োজন হবে না।আমি একাই যথেষ্ট।”
–“রায়ান অনামিকা তোমাকে ভালোবাসে।খুব ভালোবাসে।তোমার জন্য অনামিকাই ব্যাটার।শুধু তাই নয় তোমার সাথে অনামিকাকে খুব মানাবে।”
রায়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে।সেই সাথে হাত দুটোও মুঠোয় করে নিয়েছে।নিজের রাগ সংবরণের জন্য কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে বললো,
–“অনা ভালোবাসলেও আমি ওকে বিন্দুমাত্রও ভালোবাসি না।আমি ওকে শুধু বন্ধু ভাবি।”
ইমা খানম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই অনামিকা রায়ানের রুমে ঢুকে বললো,
–“তাহলে তুমি কি ওই খুশিকে ভালোবাসো রায়ান?তুমি কি পাগল রায়ান।এতো ছোট একটা মেয়ে তোমার সাথে যায় নাকি?”
রায়ানের মাথা রাগে আগুনের মতো দপদপ করছে।চোখ গরম করে তাকালো অনামিকার দিকে।ইচ্ছে করছে অনামিকার গালে দুটো চড় বসিয়ে দিতে।কিন্তু,অনেক কষ্টে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখেছে।
ইমা খানম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন অনামিকার দিকে।অনামিকার মুখের কথায় উনি কিছু বোধগম্য করতে পারছেন না।তাই অবাক হয়ে বললেন,
–“এইসব তুমি কি বলছো অনামিকা!খুশির মতো ছোট একটা মেয়েকে রায়ান মোটেও পছন্দ করতে পারে না।তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।
–“আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না আন্টি।তুমি রায়ানকে নিজেই জিজ্ঞেস করে নাও।”
রায়ান রুমকাঁপিয়ে চিল্লিয়ে উঠলো।রায়ানের চিল্লানোতে ইমা খানম আর অনামিকা দু’জননেই ভয় পেয়ে যায়।ভায়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রায়ানের দিকে।রায়ান তেড়ে গেলো অনামিকার দিকে।আঙুল তুলে শাসিয়ে বললো,
–“তুমি একটা কালসাপ অনা।তোমাকে আমি বন্ধু ভেবে খুব ভুল করেছি।আজকে তোমার জন্য আমার এই অবস্থা।নিজের ভালোবাসা হাতে পেয়েও পাচ্ছি না।বুঝতে পারছো কতটুকু যন্ত্রণা আমি সহ্য করছি।তুমি ঠিকই বলেছো অনা!আমি খুশিকে ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।কিন্তু,আমি তার কাছে আর কখনোই যেতে পারবো না।সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র তোমার জন্য।এবার প্লিজ আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাও।তোমাকে দেখতে আমার ভালো লাগছে না।মনে হচ্ছে,এখনেই তোমাকে মেরে শেষ করে দেই।”
ইমা খানম চমকে তাকালেন রায়ানের দিকে।ছেলের মনে যে এতোটা পাথর জমে আছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পান নি তিনি।অনামিকা যা বলেছে তাই বিশ্বাস করে গিয়েছে।অনামিকা যখন কেঁদেকেটে বলতো সে রায়ানকে ছাড়া একদন্ডও থাকতে পারবে না তখনই ইমা খানমের মনে অনামিকার জন্য আলাদা একটা মায়া তৈরি হয়ে যায়।কিন্তু,একটিবারও তিনি ছেলের কাছ থেকে জানার প্রয়োজন মনে করেন নি ছেলের মন কি চায়!
রায়ানের কথা শুনে অনামিকা কেমন একটা পাগলের মতো আচরণ শুরু করে দেয়।দৌড়ে গিয়ে রায়ানের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বললো,
–“রায়ান প্লিজ তুমি এমন করো না।আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সেই শুরু থেকে।খুশি তো একটা বাচ্চা মেয়ে।ও তোমাকে কীভাবে সুখী করবে বলো।না শারীরিকভাবে আর না মানসিকভাবে।আমাকে দেখো আমি সব পারবো তোমার জন্য।তোমাকে শারীরিক সুখও দিতে পারবো।”
রায়ান আর না পেরে অনামিকার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।ঘৃণা আর রাগে তার শরীর কাঁপছে।দাঁতে দাঁত পিষে অনামিকাকে বললো,
–“ভালোবাসা শারীরিক সম্পর্ক দিয়ে হয় না।মন আর অনুভূতি দিয়ে হয়।আমার মন আর অনুভূতি জুড়ে শুধু খুশিই বিরাজ করছে।সেখানে তোমার কোনোকিছুতেই কাজ হবে না।আর,এতো নিচু মনের কেউ আমার বন্ধু হতে পারে না।বেরিয়ে যাও এখান থেকে।অত্যন্ত আমাকে একটু শান্তি দাও তুমি।”
অনামিকা ক্রন্দনরত অবস্থায় ইমা খানমের দিকে এগিয়ে যেতেই উনিও মাঝরাস্তায় আটকিয়ে বললেন,
–“আমার সামনে আসবে না তুমি।প্রতিনিয়ত তুমি আমাকে ভুলভাল বলেছো।তোমার জন্য আমার ছেলের আজকে এই অবস্থা।তুমি চলে যাও অনামিকা।আর কোনোদিনও এই বাসায় আসবে না তুমি।”
অনামিকা আর কিছু বলার সাহস পায় নি।রায়ানের দিকে একবার তাকিয়ে দৌড়ে চলে যায়।সে ভেবেছিলো কি আর হয়েছে কি!তার সব প্ল্যান একদম ফুটুসফাটুস হয়ে গিয়েছে।
————-
খুশি মনমরা হয়ে বিছানার মাঝখানে বসে আছে।দু’দিন পর থেকে তার এসএসসি পরীক্ষা শুরু।কিন্তু,তার কিছুতেই পড়ায় মন বসছে না।মন রায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।খুশি আচমকাই ডুকরে কেঁদে উঠলো।নিজেই নিজেকে ক্রন্দনরত গলায় বলছে,
–“কেনো বলতে গেলি ওইসব কথা।এখন তো নিজেই কষ্ট পাচ্ছিস।ওইভাবে না বলে শান্তশিষ্ট হয়ে বলতি।কিন্তু,এখন কি করবি খুশি তুই।তুই তো রায়ানকে ভালোবেসে ফেলেছিস।থাকতে পারবি তুই উনাকে ছাড়া!!”
সেসময় বেলী খুশির রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো।খুশির সব গুলো কথা বেলীর কানে এসে ঠেকেছে।খুশির কথা শুনে বেলী চমকে উঠে।এইটা সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।দৌড়ে খুশির রুমে ঢুকে দরজা টা আঁটকে দিলো।খুশির দিকে এগিয়ে গেলো নিঃশব্দে।
খুশি সামনে বেলীকে দেখে কিছুটা চমকে উঠে।তাড়াতাড়ি চোখ দুটো মুছে হাসির চেষ্টা করে কিন্তু পারে না সেই কান্নাই চলে আসে।বেলী খুশির সামনে হাঁটুগেঁড়ে বসে খুশির হাত দুটো আঁকড়ে ধরলো।কোমল কন্ঠে বললো,
–“বাহির থেকে যতটুকু শুনেছি ততটুকুতেই বুঝতে পেরেছি তুই রায়ান ভাইয়াকে ভালোবাসিস।কিন্তু,খুশি তুই রায়ান ভাইয়াকে ভালোবাসলি কীভাবে।”
খুশি জাপটে ধরে বেলী।এবার শব্দ করেই কেঁদে দেয়।কাঁদতে কাঁদতে বেলীকে সব বলে।বেলী খুশির মুখে সব শুনে একদম হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছে।কিন্তু,তার ভয় হচ্ছে বুরাগ এসব শুনলে কি করবে।মেনে নিবে কি!রায়ান আর খুশির সম্পর্ক।তাদের বয়সের পার্থক্য যে অনেক!!
————-
দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা দিন কেটে যায়।হাসি,খুশির পরীক্ষাও শেষ হয়ে গিয়েছে।দিনদিন খুশি যেনো মনমরা হয়ে যাচ্ছে।আগে রায়ানের দেখা পেলেও এখন আর রায়ানের ছাঁয়া টুকুও পায় না।খুশি উপলব্ধি করতে পারছে সে ভালো নেই।রায়ানকে ছাড়া সে একটুও ভালো নেই!
—-
আজাদ রহমান এখন আর অফিসে যান না।সবকিছু বুরাগের হাতে তুলে দিয়েছেন।এখন উনি বাসায় বসে সময় কাটায়।লিভিং রুমে গিয়ে দেখে শিউলি সোফায় বসে টিভি দেখছে।ঘাড় অবধি চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে।একটু পর পর চুলকাচ্ছে আর কপাল থেকে সরানোর চেষ্টা করছে।আজাদ রহমান শিউলির এমন কর্মকাণ্ড দেখে হেসে ফেললেন।আস্তে আস্তে শিউলির প্রতি উনি দূর্বল হয়ে যাচ্ছেন।ছোটবেলায় তেমন একটা নাও দেখতে পারলে এখন ঠিকই শিউলির জন্য মন কেঁদে উঠে।এইতো সেদিন!শিউলি বাগানে খেলতে গিয়ে ইটের সাথে লেগে পড়ে গিয়েছিলো,হাতের দিকে একটু ব্যথা পেয়েছিলো কিন্তু,আজাদ রহমানের কাছে সেই একটুখানি ব্যথা টা অনেকটা মনে হয়েছে।আবার,শিউলি যখন দাদা বলে ডাকে তখন আজাদ রহমানের যেনো মন জুড়িয়ে যায়।উনি ধীর গতিতে শিউলির দিকে এগিয়ে গেলেন।শিউলির পাশে বসে শিউলির চুল গুলো গুছিয়ে দিতে লাগলেন।রান্নাঘর থেকে আফিয়া আর বেলী উঁকি মেরে দেখছে।আফিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।আফিয়া বুঝতে পারছেন আজাদ রহমান বেলী আর বেলীর সন্তানকে মেনে নিতে শুরু করে দিয়েছেন।
—
বুরাগ খুব দ্রুত গতিতে ড্রাইভ করছে।দশটার মধ্যে তাকে একটা মিটিং এ জয়েন করতে হবে।না হলে,অনেক টাকার ডিলটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।যা বুরাগ কিছুতেই চায় না।আচমকাই গাড়ির সামনে একটা মেয়ে আসায় বুরাগ তাড়াতাড়ি ব্রেক চেপে ধরলো।কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না।মেয়েটা বুরাগের গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে কপালে অনেকটা আঘাত পেয়েছে।সেখানেই সেন্স লেস হয়ে পড়ে যায়।বুরাগ তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়।মেয়েটিকে দেখেই বুরাগের পায়ের তোলা থেকে যেনো মাটি সরে যাচ্ছে।শুধু তাই নয় বুকে একটা চিনচিনে ব্যথাও অনুভব করছে।তাড়াতাড়ি করে মেয়েটিকে কোলে তোলে নিলো।গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
—-
রাতে মনমরা হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে বুরাগ।সবকিছুই বিষাদ লাগছে তার কাছে।ঠিকঠাক ভাবে অফিস টাও করতে পারে নি।তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছে বাসায়।
বেলী ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো।শিউলিকে ঘুম পাড়িয়ে এখন শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।মাথার বিনুনি টা করে বুরাগের দিকে এগিয়ে গেলো।বুরাগের কাঁধে হাত রাখতেই বুরাগ চমকে বেলীর দিকে।বেলীর মুখ টা দেখে বুরাগ স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিলো।বেলীকে নিজের কাছে নিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।মিনমিনে গলায় বললো,
–“বেলী আজকে তোমাকে আমি কিছু কথা বলতে চাই।”
বেলী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।কয়েকবার চোখ পিটপিট করে বললো,
–“কি কথা!”
–“বলছি শোনো!আমি তখন সবেমাত্র ভার্সিটির প্রথম বর্ষে পড়ি।মা’র সাথে নানু বাড়িতে গিয়ে দেখা হলো ছোট খালামনিদের সাথে।খালামনির পাশে বসে থাকা জিন্স,টপস পড়া অতি মর্ডান মেয়েটিকে দেখে আমি চমকে উঠি।এক দেখাতেই আমার খুব ভালো লেগে যায় মেয়েটিকে।পরে জানতে পারলাম মেয়েটি আমার ছোটখালামনির মেয়ে স্নিগ্ধা।সেই ছোটবেলায় দেখা হয়েছিলো আমাদের।আর,তেমন একটা দেখা হয় নি।কিন্তু,আমার মনে যে স্নিগ্ধা তখনেই জায়গা করে নিয়েছিলো।এমনকি আমাদের কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছিলো।এইভাবে একসপ্তাহর মতো আমরা নানুবাড়িতে থাকি।আসার আগের দিন ভেবে নিয়েছিলাম স্নিগ্ধাকে আমার মনে কথা জানাবো।প্ল্যানও করে ফেলেছিলাম।প্ল্যান মাফিক সব কিছু হলেও আমি আমার মনের কথা বলার আগেই স্নিগ্ধাই আমাকে আমার প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলেছিলো।সেইদিন মনে হয় আমি ছিলাম পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ।প্রতিদিন রাত জেগে আমরা ভালোবাসার কথা বলে কাটাতাম।কথা বলতে বলতে কখন যে সকাল হয়ে যেতো তা একটুও বুঝতে পারতাম না।এইভাবে প্রায় দুই বছরের মতো কেটে যায়।তারপরও সবকিছু ভালোই চলছিলো।কিন্তু,ওইদিন রাতে স্নিগ্ধার আসল চেহারা আমার সামনে চলে আসলো।অভিমান হলো স্নিগ্ধার প্রতি।কিন্তু,ভালোবাসার উপলব্ধি থেকে তাকে সরাতে পারি নি।”
বেলী নিঃশব্দে কাঁদছে।বুরাগের মুখে তার আর তার প্রাক্তন প্রেমিকার কথা শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে।কোনো মেয়েই চাইবে না নিজের স্বামীর মুখে অন্য মেয়ের কথা শুনতে।তবুও বেলী আজকে শুনবে।এই কথাটা শোনার অপেক্ষায় সে অনেকদিন থেকেই ছিলো।কোনোমতে কান্নাটাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–“কি হয়েছিলো সেই রাতে!”
বুরাগ বেলীর মুখপানে তাকালো না।এমতাবস্থায় বললো,
–“একটা সময় স্নিগ্ধার আমাদের বাসায় খুব আনাগোনা ছিলো।আমি ভাবতাম হয়তো আমার জন্য আসে।কিন্তু না স্নিগ্ধা আসতো আমার ফুফা লিটনের জন্য।লিটনের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।ওইদিন রাতে আমি স্নিগ্ধা আর আমার ফুফাকে ফিজিক্যালি দেখেছি।বাসায় কেউ ছিলো না বিধায় তারা একে অপরের সাথে সেসবে মেতে ছিলো।যখন আমি সেসবের উত্তর জানতে চেয়েছিলাম স্নিগ্ধার কাছে তখনই স্নিগ্ধা আমাকে বলেছিলো সে আমাকে কোনোদিন ভালোইবাসে নি।লিটন তাকে যা দিতে পারে আমি তাকে তা দিতে পারবো না।ওইদিনের পর থেকে স্নিগ্ধাকে আমি ভুলে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি।কিন্তু,কিছুই হতো না!না পারতাম ভুলতে আর না পারতাম ভালোবাসতে।তবুও আমার মনে শুধু স্নিগ্ধাই ছিলো।এমনকি তারপরেও আমার সামনেই তারা দুজন আরো ইন্টিমেট হয়েছে।আমি পারতাম না সেসব সহ্য করতে।একটা সময় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম।মা স্নিগ্ধার ব্যাপারে জানলেও কেনো স্নিগ্ধার সাথে আমার সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে তা জানতো না।তার কিছুদিন পরেই বুনির বিয়েতে যাওয়া।সেখানে ভাগ্যক্রমে তোমার সাথে বিয়ে হয়ে যায়।বিশ্বাস করো বেলী!আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই নি।মা’র অনুরোধে বিয়ে করেছিলাম।তখনও আমার মনে স্নিগ্ধাই ছিলো।কিন্তু,তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসার পর আমি পড়ি বিশাল বড় বিপাকে।লিটন তোমার দিকে চোখ দিয়েছিলো।আমি বেশ বুঝতে পেরেছি লিটনের তোমাকেও চায়।এমনকি সে আমাকে নিজের মুখেও বলেছিলো ওর তোমাকে একদিনের জন্য হলেও চায়।সেদিন কেনো জানি আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।তার উপর ওই রাতে তুমি আমাকে আর স্নিগ্ধাকে খুব ক্লোজ অবস্থায় দেখে নিয়েছিলে।বিশ্বাস করো!সেদিন স্নিগ্ধাই নিজে থেকে আমার নিকটে এসেছিলো।কিন্তু,তোমার পাগলামি গুলোতে আমি বুঝে গিয়েছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো।আমিও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমাকে মেনে নিবো।তোমার উপর আমার একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো।তবে,সেদিন রাতে তুমি যে বলেছিলে তুমি যদি পতিতালয়েও যাও তাহলে আমার কিছুই যায় আসবে না ওই কথাটায় আমি আরো ভয় পেয়ে যাই।ভয়ের কারণ,ছিলো একমাত্র লিটন।মনে হতো ও যদি তোমাকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়।তাই বাধ্য হয়ে সেদিন আমি তোমার খুব নিকটে যাই।তোমাকে আমার স্ত্রীর অধিকার দেই।কিন্তু,তাও কোনোকিছু শান্ত হয় নি।একটা সময় ফুপিও সবকিছু জেনে যায়।আর দেখো!ফুপিও এতো কষ্ট সহ্য করতে পারে নি।চলে গিয়েছে আমাদের সবাইকে ছেড়ে।তবে,বিশ্বাস করো বেলী!আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব।তুমি যেদিন রাগ করে চলে গিয়েছিলে সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার অনুভূতি।তাই তো সেদিন রাতে ছুটে গিয়েছিলাম তোমার কাছে।”
সবকথা শুনে বেলী কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।লিটন যে এইরকম একটা খারাপ পুরুষ তা বেলী ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি।আর স্নিগ্ধার কথা তো বাদেই দিলো।কিন্তু,ফুফির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে বেলীর।বেলী দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে বুরাগের বুকে মাথা ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরলো।বুরাগও বেলীকে পরমযত্নে নিজের সাথে আলিঙ্গন করে নিলো।
————-
সব কিছু ঠিক থাকলেও এই কয়েকদিন ধরে বেলীর কাছে বুরাগের আচরণ খুব অন্যরকম লাগছে।ঠিকমতো বাসায় ফেরে না।ফিরলেও অনেকটা রাত হয়ে যায়।আবার মাঝরাতে ফোন নিয়ে অনেকটা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।বেলী কিছু বলতে গেলেই এড়িয়ে যায়।কয়েকদিন ধরেই বেলীর শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না।বমি আর মাথা ঘুরানোর লক্ষ্মণ দেখে বেলী প্রেগ্ন্যাসির কীট এনে টেস্ট করিয়েছিলো।পজিটিভ আসায় বেলী নিশ্চিত হয় সে আবার মা হতে চলেছে।বেলী খুব খুশি হয়।বুরাগ তো তার কাছে আরেকটি সন্তানের আবদার করেছিলো।এই খবরটা শুনে বুরাগ নিশ্চয় অনেক খুশি হবে।কথাটা ভেবেই বেলীর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো।
পরেরদিন সকালে!বুরাগ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়ায় বেলী আর খবরটা দিতে পারে নি।তাই ভেবে নিয়েছে!ডাক্তারের কাছ থেকে আজকে চেকাপ করিয়ে নিয়ে আসবে।তারপর রিপোর্ট টা বুরাগের হাতের সামনে তোলে দিবে।তাই,বেলী একটু পরেই বেরিয়ে পড়লো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
চেকাপ করিয়ে রিপোর্ট আনতে আনতে অনেকটা বিকেল হয়ে পড়ে।তার উপর গাড়ির জ্যামে আটকে আছে।হঠাৎ চোখ যায় বেলীর একটা হোটেলের সামনে।বুরাগকে সেখানে ঢুকতে দেখে বেলীর কিছুটা খটকা লাগে।যারফলে,বেলী গাড়ি থেকে নেমে যায়।বুরাগের পিছু নেওয়ার জন্য কিছুটা দ্রুত গতিতে পা চালায়।
হোটেলের ভিতরে ঢুকে বেলী যে এমন একটা দৃশ্য দেখবে তা কিছুতেই বুঝতে পারে নি।তার চোখের সামনে বুরাগ স্নিগ্ধাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।শুধু তাই নয় একটা বাচ্চা ছেলেকেও নিজের সাথে চেপে ধরে রেখেছে।দেখে মনে হবে একটা পরিবার।বেলী আর সেখানে দাঁড়াতে পারলো না।দৌড়ে বেরিয়ে আসলো।তার সব কিছু পাগল পাগল লাগছে।এইবার বুঝতে পেরেছে এই কয়েকদিনে বুরাগ কেনো তার সাথে ভালো করে কথা বলে নি।তাকে কেনো এড়িয়ে গিয়েছে!তার আসল কারণ হলো স্নিগ্ধা!!
—-
ক্লান্ত হয়ে রুমে ঢুকে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো বুরাগ।সাইড বক্স টার উপর থেকে পানিটা খেয়ে নিলো।বিছানার পাশে চোখ বুলিয়ে শিউলিকে খুঁজতে লাগলো।কিন্তু শিউলির দেখা পায় নি।এমনকি রুমে বেলীর অস্বস্তিও নেই।বুরাগ রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো সারা বাসা খুঁজে বেলীর কোনো খোঁজও পেলো না।দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা হলো আফিয়ার সাথে।আফিয়াকে বুরাগ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফিয়া বুরাগের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।বুরাগ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আফিয়ার দিকে।আফিয়া চোখের পানিটুকু মুছে নিয়ে বললেন,
–“স্নিগ্ধার সাথে কেমন সময় কাটলো তোর!নিশ্চয় অনেক ভালো।স্নিগ্ধাকে পেয়ে তো বেলীকে এই কয়েকদিন পাত্তাই দিলি না।”
–“মা!তুমি জানলে কি করে স্নিগ্ধার কথা।আর বেলীই বা কোথায়।শিউলিকেও তো দেখছি না।”
–“তুই ওদের কাউকেই পাবি না।ওরা দু’জনেই চলে গিয়েছে।তুই বেলীকে এইভাবে কষ্ট নাও দিতে পারতিস বুরাগ।স্নিগ্ধাকে তুই এখনো ভালোবাসিস সেটা তুই বেলীকে বলেই দিতি।কেনো ওকে অবহেলা করেছিলিস।”
বুরাগ মাথাটা চেপে ধরলো।এমতাবস্থায় বললো,
–“মা!তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।আমার সবটা কথা আগে তুমি শুনে নাও।”
–“তোর কোনো কথাই আমি শুনতে চাই না বুরাগ।চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে।”
আফিয়া চলে যেতেই বুরাগ এলোমেলো পা’য়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।টেবিলের পাশে চোখ পড়তেই বুরাগ আঁতকে উঠলো।সাদা কাগজে ভাঁজ করে রাখা চিঠিটা খোলে পড়তে শুরু করলো,
প্রিয় বুরাগ!
চিঠিতেই আমি আপনাকে নাম ধরে সম্বোধন করলাম।কি লিখবো কিছুই বুঝতে পারছি না।তবে,আসল কথা কি জানেন আমি আপনার জীবন থেকে চলে যাচ্ছি।আপনি আর স্নিগ্ধা খুব সুখী থাকবেন।স্নিগ্ধা ফিরে এসেছে বলেই আপনি আমার সাথে এই কয়েকদিনে ভালো করে কথাও বলেন নি।এমনকি ফিরেও তাকান নি।মাঝরাতে তাহলে,স্নিগ্ধার সাথেই চ্যাটে ব্যস্ত থাকতেন।আমাকে কেনো এতো ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছিলেন আপনি!তবে যাই হোক!আজকে আমি নিজেই আপনার থেকে সরে আসলাম।আর না পাবেন আমার দেখা।আরো একটা কথা!আপনি আবার বাবা হতে যাচ্ছেন।চিন্তা নেই আমি নিজেই ওদের দু’জনকে মানুষ করে নিতে পারবো।টেবিলের উপরেই রিপোর্ট টা রাখা আছে।
চিঠিটা বুরাগের হাত থেকে পড়ে যায়।নিঃস্তব্ধ এই পরিবেশ টায় বুরাগ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।তার একটা ভুলের জন্য আজকে সে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে।তার মনে পড়ে,এই কয়েকদিনে আসলেই সে বেলীকে অনেকটা অবহেলা করেছে।কথায় কথায় রাগও দেখিয়েছে।আজকে,তার আনন্দ হওয়ার কথা দ্বিতীয় বারের মতো বাবা হতে যাচ্ছে।কিন্তু,আনন্দের বদলে সে এখন কষ্ট পাচ্ছে।তার এখন একটাই চাওয়া।যেকোনো মূল্যে সে বেলী আর শিউলিকে চায়।বেলী যে তার ভালোবাসা!তাদের দু’জনকে ছাড়া তার একমুহূর্তও চলবে না।বেলীকে যে তার অনেক কথা বলার আছে।এই কথা গুলো না বললে বেলী তাকে সারাজীবন ভুলেই বুঝে যাবে।সে সবকিছু এইভাবে ঝরাপাতার মতো ঝরে পড়ে যেতে দিবে না।কিন্তু,এতো রাতে সে খুঁজবে কোথায় বেলীকে।আদোও কি বেলীর দেখা পাবে বুরাগ!!
#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৪০-পরিশিষ্ট অংশ)
#কুরআতুল_আয়েন
“তোমার মাঝে নামবো আমি
তোমার ভেতর ডুব
তোমার মাঝে কাটবো সাঁতার
ভাসবো আমিই খুব
তোমার মাঝেই জীবন-যাপন
‘স্বপ্ন দেখা’ ‘স্বপ্ন ভাঙা’
………..
সুইমিংপুলের শীতল পানিতে পা দুটো ডুবিয়ে রেখেছে রায়ান।হাতে গিটার নিয়ে কয়েক লাইনের এই গানটি গেয়ে তার বুকের ভিতর যেনো আরো হাসফাস করা শুরু করে দিয়েছে।অন্যদিনের তুলনায় আজকে বেশি অস্থিরতা লাগছে।এতোগুলো মাস কেটে গেলো তাও খুশিকে ভুলতে পারে নি।খুশিকে ভুলার জন্য কি না করেছে সে!!এমনকি ঢাকা শহর থেকে সিলেটে এসে বসবাস শুরু করেছে।তাও,হাজার চেষ্টা করেও খুশি নামক পোঁকা টাকে কিছুতেই দূরে সরাতে পারছে না।বরং,দিনের পর দিন মাসের পর মাস,খুশি নামক পোঁকা টা তার মনের ঘরে বাসা বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে।রায়ান একধ্যানে তাকিয়ে রইলো সুইমিংপুলের নীলচে রঙের পানিটার দিকে।নীলচে রঙের পানিটায় রায়ান যেনো স্পষ্ট খুশির চেহারা দেখতে পাচ্ছে।আচমকাই বুকটা ধক করে উঠলো তার।বুকে হাত দিয়ে চটজলদি করে পিছনে তাকালো।উঁহুহু!খুশির কোনো অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছে না।তার মানে মনের ভুল ছিলো।রায়ান গিটার টাকে সাইডে রেখে হাত দিয়ে মাথা টা চেপে ধরলো।বিরবির করে বলতে লাগলো,
–” নিষ্ঠুর তুমি খুশি!খুব নিষ্ঠুর।চলে তো এসেছি তোমাকে ছাড়া তাও কেনো আমাকে শান্তি দিচ্ছো না।আমাকে কি তুমি তিলেতিলে মারতে চাও খুশি!দোষ কি ছিলো আমার।কেনো এতো কষ্ট দিলে আমায়!কেনো এতো অবিশ্বাস করলে আমায়!!”
এরিমাঝেই একটা ছেলে হাতে ফোন নিয়ে দৌড়ে এলো।গা’য়ে তার চেকের লুঙ্গি আর রঙিন শার্ট জড়ানো।রায়ানের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বললো,
–“ভাই!আম্মাজান আপনারে মোবাইল করছে।”
রায়ান মাথা তোলে তাকালো সামনে দাঁড়ানো হাকিমুল্লার দিকে।গায়ের সাথে শার্ট টা খুব আঁটসাঁট হয়ে আছে।শার্টের সবগুলো বোতাম লাগানো।হাকিমুল্লার রঙিন শার্ট পছন্দ বলে কালকেই এই শার্ট টা সহ আরো তিনটা শার্ট কিনে দিয়েছে রায়ান।সাথে প্যান্টও কিনেছিলো কিন্তু,হাকিমুল্লা প্যান্ট বাদ দিয়ে লুঙ্গি পড়তে বেশি পছন্দ করে।রায়ানের সিলেটের একমাত্র সঙ্গী বলতে গেলে হাকিমুল্লা।রাস্তায় একদিন দেখা হয়েছিলো তাদের দু’জনের।হাকিমুল্লা তখন চা’য়ের দোকানে কাজ করতো।একটা সময় হাকিমুল্লার সাথে কথা বলতে বলতে রায়ানের খুব মনে ধরে যায়।তারপর থেকেই রায়ান হাকিমুল্লাকে চা’য়ের দোকানে কাজ ছেড়ে দিয়ে তার সাথে থাকতে বলে।হাকিমুল্লা প্রথমে নাকোচ করলেও রায়ানের জোরাজোরিতে ঠিকই রাজি হয়ে যায়।তারপর থেকেই রায়ানের সাথে হাকিমুল্লার বসবাস শুরু।
রায়ান দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
–“ফোনটা কেটে দে হাকিমুল্লা।আমি এখন কথা বলবো না।”
হাকিমুল্লা ধপাস করে বসে পড়লো রায়ানের পাশে।লুঙ্গিটা কিছুটা উপরে তোলে নিজেও শীতল পানিটায় পা ডুবিয়ে দিলো।ঠান্ডা অনুভব করতেই হাকিমুল্লা কিছুটা চেঁচিয়ে বললো,
–“উফফ!কি ঠান্ডা ভাই।এই ঠান্ডায় কেমনে পা ডুবাইয়া বইয়া আছেন।আমার শরীলটা তো মনে হয় পাথরের মতো জইম্মা গেলো গা।”
রায়ান হেসে ফেললো।এমতাবস্থায় বললো,
–“তোকে কতোবার বলবো আমি হাকিমুল্লা!পড়াশোনা টা শিখ।কি ভুলভাল বাক্য বলিস তুই।শরীর হবে শরীল না।আর,পাথরের মতো না ওইটা হবে বরফের মতো।”
–“যাই কন ভাই!পড়ালেহা আমার দ্বারা অসম্ভব।যেমনে আছি ওমনেই ভালা।”
–“উফফ!হাকিমুল্লা!ওইটা পড়াশোনা হবে পড়ালেহা না।”
হাকিমুল্লা এবার নিভিয়ে যায়।আর কিছু বলার সাহস পায় না।না জানি!আবার কখন ভুলভাল বলে ফেলে আর রায়ান তাকে পড়াশোনার তাগিদ দেয়।
ফোনটা পুনরায় ভেজে উঠতেই হাকিমুল্লা চমকে উঠলো।বুকে একদফা থু থু দিয়ে বললো,
–“ভাই!আম্মাজান তো আবার মোবাইল করছে।কি করমু এহন!কাইট্টা দিমু নি!”
রায়ান ফোনটার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“না!ফোন টা আমার কাছে দিয়ে তুই বাসার ভিতরে যা!”
হাকিমুল্লা বাধ্য ছেলের মতো ফোন টা রায়ানের হাতে দিয়ে জায়গা প্রস্থান করলো।রায়ান ফোন টা হাতে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো।ফোন টা ধরবে কি ধরবে না।মা’র কথা যে ইদানীং রায়ানেরও খুব মনে পড়ে।ইচ্ছে করে!মা’র কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে।কিন্তু,ঢাকা শহরে পা রাখলেই রায়ানের যে দমবন্ধ হয়ে আসবে।বারবার মনে হবে এই শহরেই তো আছে খুশি।তাই,রায়ান ফোনটা আর ধরলো না।কারণ,এখন ধরলেই ইমা খানম কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যাবেন।যা রায়ান মোটেও চায় না।
————————–
পাঁচমাসের উঁচু পেট টা নিয়ে বেলী রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সবজি কুটছে।নিচে বসতে অসুবিধা হয় বলে চপিং বোর্ডেই কেটে নিচ্ছে।শিউলি কেঁদেকেটে একটু আগে ঘুমিয়েছে।এই কয়েকটা মাস শিউলিকে সামলাতে বেলীর অনেকটা হিমশিম খেতে হয়েছে।প্রতিনিয়ত শিউলি বুরাগের কাছে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যেতো!যার জন্য শিউলিকে সামলাতে গিয়ে বেলীর এক্সট্রা একটু কষ্ট করতে হয়েছে।হাফ রুমের এই বাসাটা বেলী এই মাসেই ভাড়া নিয়েছে।এতোদিন তার ভার্সিটির বান্ধবী মিমের বাসায় ছিলো।মিম নানাভাবে বেলীকে সাহায্য করে গিয়েছে।এমনকি,মিমের মাও বেলী আর শিউলিকে আপন মনে করে কাছে টেনে নিয়েছে।দু’মাসের মতো হলো বেলী একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে জয়েন করেছে।বেতন পেয়েই এই বাসাটায় উঠেছে।
বেলীর সেইদিনের ঘটনা টা এখনো মনে পড়ে।স্নিগ্ধা আর বুরাগকে একসাথে পুনরায় দেখবে তা কখনেই ভাবে নি।সে তো বুরাগকে একান্ত ভাবে চায়।বুরাগকে অন্যকারোর সাথে ভাগ করে নিতে পারবে না।কিন্তু,ওইদিনের দৃশ্যটা দেখে বেলী অনেক কষ্ট পেয়েছিলো।সেই সাথে অভিমানও যুক্ত হয়েছিলো বুরাগের প্রতি।তাই তো!বুরাগের থেকে দূরে সরে এসেছে।ছোটবেলা থেকেই বেলীর অভিমান টা একটু বেশিই।তাই তো আম্মা তাকে একটু বেশিই আদর করতো।বাহিরের যানবাহনের শব্দে বেলী ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে।মনে মনে ভেবে নিয়েছে আর ভাববে না বুরাগের কথা।যতোই কষ্ট হোক না কেনো তাকে শক্ত থাকতে হবে।
কলিং বেলের আওয়াজে বেলী রান্নাঘর থেকে গুটিগুটি পা’য়ে বেরিয়ে আসলো।মুখে হাসি ফুটিয়ে দরজার সামনে এগিয়ে গেলো।দরজা খোলে বেলী সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে চমকে উঠলো।সে তো ভেবেছিলো মিম এসেছে।কিন্তু না তার সামনে মিম না বুরাগ দাঁড়িয়ে আছে।বেলী চটজলদি করে দরজাটা লাগিয়ে দিতেই বুরাগ হাত দিয়ে আঁটকে ফেললো।পকেটে হাত গুঁজে রুমে ঢুকে নিজেই দরজা টা বন্ধ করে দিলো।বেলীর দিকে কতক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইলো।চোখ পড়লো বেলীর পেটের উপর।বুরাগ ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে মনে মনে আওড়িয়ে বলতে লাগলো,
–“বাহ!দ্বিতীয় জন আসার সময়ও হয়ে যাচ্ছে।অথচ,আমি বাবা হয়ে তার থেকে দূরে আছি।শিউলির সময়ও দূরে ছিলাম আর দ্বিতীয় টার সময়ও।পাঁচ পাঁচটা মাস বেলী কেড়ে নিয়েছে।শুধু উল্টা পাল্টা রাগ করে।”
বেলীর ঘাম ছুটে যাচ্ছে কপাল বেয়ে।এই ঠান্ডাতেও কীভাবে ঘামছে সে।বুরাগকে এইখানে একদমই আশা করে নি।সে তো ভেবেছিলো বুরাগ জানবেই না বেলী কোথায় আছে।আর,এখন বুরাগ তার বাসায় এসেই হাজির।বেলী জায়গা প্রস্থান করতে নিলেই বুরাগ বেলীর হাত ধরে টেনে নিজের সাথে চেপে ধরলো।এমন হওয়ায় বেলী পেটে একটু আঘাত পায়।যার ফলে,ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে আছে।বুরাগ ব্যপার টা বুঝতে পেরে হাতের বাঁধন একটু আলগা করে দেয়।বেলীর দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থুঁতনীটা উঁচু করে তোলে বললো,
–“নিজেকে খুব চালাক মনে করো তুমি তাই না মিসেস বুরাগ!কি ভেবেছিলে আমি কিছুই জানবো না।”
বেলী রাগান্বিত হয়ে তাকালো বুরাগের দিকে।বুরাগের চোখে ক্রোধ আর অভিমান দেখতে পাচ্ছে।সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বললো,
–“ছাড়ুন আমাকে!একদম আমাকে ধরার সাহস জোগাবেন না।হাত কেটে একদম রেখে দিবো।”
বুরাগ মুচকি হাসলো শুধু।বেলীর নাকের ডগায় চুমু খেয়ে বললো,
–“সামান্য ধরাতেই এতো তেজ।তাহলে!চুমুতে কি হবে।আমাকে কেটে কি কুচিকুচি করে ফেলবে মিসেস বুরাগ।”
–“দেখুন!ভালোই ভালোই ছেড়ে দিন আমাকে।আমার আপনাকে এক মুহুর্তের জন্যও সহ্য হচ্ছে না।”
–“ছাড়বো না আমি।কি করবে তুমি!”
বেলী কথার উত্তর না দিয়ে হাত মোচড়ামুচড়ি করছে।বুরাগ কতক্ষণ বেলীর দিকে তাকিয়ে রইলো।বেলী যখন হাত মোচড়ামুচড়ি করেও ছাড়াতে পারলো না তখন ছোট বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো।বুরাগ সাথে সাথেই বেলীকে নিজের বুকে চেপে ধরলো।এতে যেনো বেলীর কান্নার বেগ আরো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।বুরাগের বুকে একদফা কেঁদে ভাসিয়ে গাল ফুলিয়ে বললো,
–“ছাড়ুন আমাকে।আর চলে যান এইখান থেকে।”
–“উঁহুহু!তোমাকে আর শিউলিকে ছাড়া আমি কোথাও যাবো না।অনেক ভুল করেছো তুমি।”
বেলী তেজে উঠলো।খড়খড় গলায় বললো,
–“ভুল আমি না আপনি করেছেন।আর একটা কথা আমি আপনার সাথে কখনোই যাবো না।সতিনের ঘর আমি কিছুতেই করতে চাই না।আপনি থাকুন ওই স্নিগ্ধার সাথে।”
–“বেলী স্নিগ্ধা আর বেঁচে নেই।গত শুক্রবারেই সে পরকালে পাড়ি জমিয়েছে।”
বেলী অবাক হয়ে তাকালো বুরাগের দিকে।এইরকম একটা কথা শুনবে সে কল্পনাও করে নি।স্নিগ্ধার উপর এতক্ষণ রাগ হলেও এখন তার কেমন যেনো অনুভব হচ্ছে।ক্লান্ত গলায় বললো,
–“মানে!”
বুরাগ বেলীকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বেলীর সামনে বসে পড়লো।বেলীর হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বললো,
–“এটাই সত্যি বেলী।স্নিগ্ধা আর বেঁচে নেই।ক্যান্সারের সাথে স্নিগ্ধা আর যুদ্ধ করে বাঁচতে পারে নি।ব্যর্থ হয়ে তাকে চলে যেতে হয়েছে।”
বেলী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।বেলীর এরূপ চাহনি দেখে বুরাগ আবারও বলতে লাগলো,
–“আমি জানি বেলী তোমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে।আর,ওইদিন আমাকে আর স্নিগ্ধাকে একসাথে দেখে যে তুমি সহ্য করতে পারো নি তাও জানি।বিশ্বাস করো বেলী!তোমার সাথে আমি সব শেয়ার করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সময় করেও যেনো বলতে পারি নি।বারবার একটা বাঁধা চলে আসতো।জানো বেলী!এইসব ঘটনা ঘটার কয়েকদিন আগেই স্নিগ্ধা আমার গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে এক্সিডেন্ট করে।মাথায় কিছুটা আঘাত পেয়েছিলো।প্রথমে স্নিগ্ধাকে দেখে আমি চমকে উঠি।চেহারার ভাবেই বলে দিচ্ছিলো স্নিগ্ধা ভালো নেই।খুব খারাপ লাগলো তখন।দৌড়ে কোলে করে আমার গাড়িতে তোললাম।হসপিটালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত স্নিগ্ধা অচেতন অবস্থায় ছিলো।যখন স্নিগ্ধা চোখ খোলে আমাকে দেখে তখনই আমার হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।তার সাথে হওয়া এক একটা ঘটনা আমাকে খুলে বললো।লিটনের মৃত্যু সংবাদও আমাকে বললো।এমনকি!লিটন আর তার সন্তান ইফাতের কথাও বললো।ইফাত হওয়ার পর লিটনের পরিবর্তন আর পরকীয়া কাজ গুলোতে স্নিগ্ধা নাকি আরো ভেঙে গিয়েছিলো।স্নিগ্ধার মুখে সেসব কথা শুনে আমার শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিলো পাপের করা শাস্তি আজ স্নিগ্ধা পাচ্ছে।আমার ফুফির সুখ কেড়ে নেওয়ার শাস্তি স্নিগ্ধা পাচ্ছে।মনের দিক দিয়ে একটু শান্তি পেলেও খারাপও লাগছিলো বটে।সেদিন স্নিগ্ধা আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো।শুধু তাই নয় তোমাকে দেখতেও চেয়েছিলো।আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে বলেছিলাম অন্য একদিন।ওইদিন স্নিগ্ধাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ইফাতকে দেখে এসেছিলাম।ইফাত একদম লিটনের ডুপ্লিকেট।প্রথম প্রথম ইফাতকে দেখে রাগ হলেও পরে ছোট বাচ্চা ভেবে কাছে টেনে নিয়েছিলাম।ভেবেছিলান এখানে সব থেমে যাবে।উঁহুহু!থামলো না।ইফাত আমার জন্য পাগল হয়ে গেলো।আচমকাই একদিন আমাকে ফোন দিয়ে বাবা ডাকতে শুরু করে দিলো।ইফাতের বাবা ডাকটা আমার কানে আসতেই আমি চোখ,মুখ রাগে কুঁচকে ফেলি।তখন,তুমি শিউলিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলে।শিউলির মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে একটাই ভাবনা এসেছিলো!আমি শুধু শিউলির বাবা।আর কারোর না।আমার অংশ শিউলি।ইফাতকে শক্ত গলায় যখন বলেছিলাম আমি তোমার বাবা নই,আমাকে একদম বাবা বলে ডাকবে না।তখন ইফাত কান্নাজুড়ে দেয়।ক্রন্দনরত গলায় আলতো বুলি ফুটিয়ে বলেছিলো,তুমি আমাল বাবা।তখন আমি আরো রেগে যাই।হঠাৎ মনের ভিতর এক ভাবনা আসলো এইসব স্নিগ্ধা শিখিয়ে দিচ্ছে না তো।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম স্নিগ্ধাকে সামনাসামনি শাসিয়ে আসবো ইফাত যেনো নেক্সট বার থেকে আমাকে বাবা না বলে।পরের দিন স্নিগ্ধার বাসায় গিয়ে তাকে শাসিয়েও ছিলাম!কারণ,আমার ভাবনা ঠিকই ছিলো স্নিগ্ধাই ইফাতকে শিখিয়ে দিয়েছিলো আমাকে বাবা ডাকতে।আমি যখন এর উত্তর জানতে চাইলাম!তখন স্নিগ্ধা এর উত্তরে বলেছিলো!ইফাত নাকি ছোটবেলা থেকেই লিটনকে যখন দেখত তখনি লিটনের দিকে হাত বাড়িয়ে রাখতো, কিন্তু,লিটন!ইফাতের জন্মের পর একবারও তাকে কোলে পর্যন্ত নেয় নি।ওইদিন আমি তাকে কোলে নিয়েছিলাম বলে সেই রাত থেকে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিয়েছিলো।তাই,স্নিগ্ধা ইফাতকে বলেছিলো আমাকে বাবা বলে ডাকতে।কথাটা শোনার পর আমার খুব খারাপ লেগেছিলো।সেদিনও আমি আসার আগে ইফাতকে আদর করে এসেছিলাম।ছোট বাচ্চা ওর তো কোনো দোষ নেই।কিন্তু,এইভাবে যে তোমাকে আর শিউলিকে একটু একটু করে দূরে ঠেলে দিচ্ছিলাম তা আমার ভাবনাতেই আসে নি।তারপর একদিন সকালে স্নিগ্ধার ফোন পেয়ে আমি কিছুটা চমকে উঠি।একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে ফোনটা কানে চেপে ধরতেই একজন ভদ্র মহিলার কন্ঠ শুনতে পাই।সেই সাথে ইফাতের কান্নার আওয়াজ।আমি একটু ভয় পেয়ে যাই।ভদ্র মহিলার কোনো কথা না শুনেই আমি দৌড় লাগাই স্নিগ্ধার বাসার দিকে।গিয়ে দেখি স্নিগ্ধা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে আর তার পাশেই ইফাত কান্না করছে।ইফাতের চোখ গুলো দেখে আমার সেদিন ভীষণ কষ্ট লেগেছিলো।আমি হাত বাড়িয়ে দিতেই ইফাত আমাকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো।আমি বাহিরের কিছু মহিলার সাহায্যে স্নিগ্ধাকে ধরে আমার গাড়িতে বসিয়ে দেই।হসপিটালে যাওয়ার পর জানতে পারি স্নিগ্ধার ব্লাড ক্যন্সার।তাও,আবার লাস্ট স্টেজ।কথাটা শুনে স্নিগ্ধার জন্য আহামরি কষ্ট না হলেও ইফাতের জন্য কষ্ট হয়েছিলো।এইভাবেই সবকিছুই চলছিলো।তোমাকে বলতে গিয়েও আর বলা হয়ে উঠে নি।যখন আরো কয়েকটা দিন পার হয়ে যায় তখন স্নিগ্ধার অবস্থা খুব বেগতিক হয়ে গিয়েছিলো।সেই সাথে তোমার থেকেও অনেকটা দূরে সরে আসলাম।এমনকি!তোমার সাথে অনেকটা খারাপ ব্যবহারও করেছি।একদিন অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম।দুপুরের দিকে স্নিগ্ধার ফোন পেয়ে আমি পুনরায় তার বাসার দিকে দৌড় লাগালাম।স্নিগ্ধার বাসায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই স্নিগ্ধা আমাকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো।স্নিগ্ধার চোখের পানিতে আমার বুকের জায়গার শার্ট টা ভিজে গিয়েছিলো।ওইদিন স্নিগ্ধাকে দেখে আমার খুব মায়া হয়েছিলো।এতোদিন ইফাতকে দেখে হয়েছিলো আর ওইদিন স্নিগ্ধা ইফাত দু’জনকে দেখেই।কিন্তু,ওইদিনই যে তুমি আমাকে আর স্নিগ্ধাকে এইভাবে দেখে ফেলবে তা আমার ধারণার বাহিরে ছিলো।সারাটা বিকেল ওদের দু’জনের সাথে কাটিয়ে আবার অফিসে গিয়ে কাজে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম।হঠাৎ তোমার কথা খুব মনে পড়ছিলো।এতোকিছুর মাঝে তোমার থেকে যে দূরে সরে এসেছি তা ওইদিনই টের পেয়েছিলাম।সেই সাথে অনুভব করেছিলাম বুকে অসহনীয় তীব্র ব্যথা।কাজ না শেষ করেই বাসায় ফিরে এসেছিলাম।ক্লান্ত শরীর টা নিয়ে বিছানায় বসেই দেখতে পেয়েছিলাম বিছানা সম্পূর্ণ খালি।সারা বাসা খোঁজ করেও তোমার দেখা পায় নি বেলী।তারপর মা’র মুখ থেকে যখন শুনি তুমি চলে গিয়েছিলো তখন আমার সবকিছু অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো।মনে হয়েছিলো আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি।তার উপর তোমার সেই চিঠি আর আমার সন্তান আসার খবর।ওইদিন আমি খুশি হবো নাকি কষ্ট পাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।তবে,এইটা বুঝতে পেরেছিলাম আমি ভালো নেই!তোমাকে ছাড়া আমি একদন্ডও ভালো নেই।এই কয়েকটা মাস আমি তোমাকে পাগলের মতো খুঁজেছি।প্রতিটা রাত আমি ছটফট করেছি তোমার আর শিউলির জন্য।অবশেষে!একদিন তোমাকে রাস্তায় দেখি!সেইদিন তোমাকে ফলো করে তোমার আসল ঠিকানা জেনে নেই।”
বেলী মুখে হাত গুঁজে কান্না করছে।বুরাগের প্রতিটা কথাই সে শুনেছে।স্নিগ্ধার জন্য তার খুব কষ্ট হচ্ছে।সেই সাথে ইফাতকেও দেখতে ইচ্ছা করছে।বেলীর সেদিনের কথা মনে পড়ে যায় যেদিন বুরাগ আর স্নিগ্ধাকে একসাথে দেখে অভিমান করে চলে এসেছিলো।আফিয়া জিজ্ঞেস করলেও বেলী কিছু বলতে চায় নি।কিন্তু,আফিয়ার জোরাজোরিতে বেলী বলতে বাধ্য হয়েছিলো।তার পরেই বেলী শিউলিকে নিয়ে বেরিয়ে আসে।আশ্রয় নেয় মিমের কাছে।বেলী সেদিনের কথাটা ভেবেই ডুকরে কেঁদে উঠলো।অভিমানের জোঁকে সে বুরাগকে ভুল বুঝেছে,অবিশ্বাস করেছে।বুরাগের দোষ থাকলেও এখন মনে হচ্ছে তার দোষেই বেশি।সেই দৃশ্যটা দেখে যদি সাথে সাথেই বুরাগকে বলে দিতো তাহলে আজকে এই কয়েকটা মাস বুরাগের থেকে দূরে থাকতে হতো না।শিউলির প্রতিটি রাত বুরাগের জন্য কাঁদতে হতো না।সেও তো কম কষ্ট পায় নি বুরাগের জন্য।কিন্তু,সব তো নিজের দোষেই।এখন!কীভাবে যাবে বুরাগের সামনে তা ভেবেই বেলীর কান্নার গতি আগের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।
বেলীর কান্নার গতি বাড়তেই বুরাগ বেলীকে জড়িয়ে ধরলো।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেলীকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।কিন্তু বেলী থামছেই না।শেষে বুরাগ একটা কাজ করেই বসলো!বেলীর মুখ তোলে নিজের ঠোঁট দুটো বেলীর গোলাপি ঠোঁটের ভাঁজে ঢুকিয়ে দিলো।বেলী প্রথমে হতবিহ্বল হয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই বুরাগকে জাপটে ধরলো।
____________
মান অভিমানের পাল্লা শেষ হয়েছে বেলী আর বুরাগের।বেলী আবার বুরাগের হাত ধরে রহমান ভিলাতে এসেছে।বেলী আসতেই সবকিছু আগের মতো হয়ে গিয়েছে।সবাই স্বাভাবিক থাকলেও খুশি স্বাভাবিক নেই।আগের থেকে শুকিয়ে যেনো কাঠ হয়ে গিয়েছে।চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে।ফর্সা তেলতেলে ত্বক টা কেমন মলিন হয়ে গিয়েছে।খুশিকে পরোক্ষ করে বেলী সিদ্ধান্ত নিলো এবার সাহস করে বুরাগকে বলেই ফেলবে।আর দেরি করা চলবে না।না হলে,হিতে বিপরীত হয়ে যাবে!
————-
বেলী বুরাগের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।বুরাগের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।বুরাগ বেলীর মুখের মতিগতি দেখে বললো,
–“আমার না খুব রাগ হচ্ছে রায়ানের উপর।একবারও বললো না আমাকে ও যে খুশিকে ভালোবাসে।আর,খুশিও রায়ানের মতো এক বুইড়াকে ভালোবাসলো।”
বেলীর মুখ অটোমেটিকলি হা হয়ে গিয়েছে।মুখ ভেঙচি মেরে বললো,
–“ভালোবাসা বয়স দেখে হয় না মশাই।মন লাগে মন।খুশি আর রায়ান ভাইয়ার মন একসাথে বাঁধা পড়েছে বলেই তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতে পেরেছে।”
–“তা বুঝলাম!এখন কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।ও যে,প্রেমের বিরোহে দেবদাস হয়ে সিলেটে পাড়ি জমিয়েছে তা তো আগে জানতাম না।জানলে ঠিকই রশি দিয়ে বেঁধে রেখে দিতাম।”
–“দেখলেন!রায়ান ভাইয়া কতোটা ভালোবাসে আমাদের খুশিকে।”
বুরাগ সরুচোখে তাকালো বেলীর দিকে।এমতাবস্থায় বললো,
–“আচ্ছা!তুমি কোনোভাবে আমাকে খোঁটা দিচ্ছো না তো।যে আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসি না।”
বেলী নাক ফুলিয়ে বললো,
–“ভালো না বাসলে কি আর এই অল্প বয়সে দুই দুইটা বাচ্চার মা হতাম।না জানি পরে!আরো কয়টা নিতে হয়।আপনার ভালোবাসার বিশ্বাস নেই বুঝলেন।আপনার থেকে দূরে থাকতে গিয়েও পারি না।কেমন যেনো চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে।”
বেলীর কথার ধরন দেখে বুরাগ শব্দ করে হেসে দিলো।বেলীকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।দিনগুলো বেশ ভালো যাচ্ছে তার।এমন সুখী হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
————-
রায়ান তড়িঘড়ি করে ইমা খানমের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।ইমা খানমের অসুস্থতার কথা শুনে রায়ান তখনই সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।সাথে হাকিমুল্লাকেও নিয়ে এসেছে।
রায়ান ইমা খানমের রুমে ঢুকে গিয়ে থমকে গেলো।পা দুটো সেখানেই আঁটকে আছে।অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো লাল বেনারসি পরিহিতা মেয়েটির দিকে।উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে বিধায় মুখ দেখতে পারছে না।রায়ানের মাথায় কিছুই আসছে না তার মা’র রুমে বেনারসি পড়া এই মেয়ে কোথা থেকে আসলো।রায়ান আলতো কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“কে তুমি!”
সামনের থেকে কোনো উত্তর আসলো না।রায়ান পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
–“কে তুমি!এইখানে কি করছো!”
এবারও কোনো উত্তর আসে নি।রায়ান রাগে সামনে এগিয়ে গেলো।মেয়েটিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে যেনো আরেকদফা চমকে উঠলো।সেই সাথে অনেকটা বিস্ময়ও হয়েছে।খুশিকে এইরূপে তার সামনে দেখবে তা তার ভাবনার বাহিরেই ছিলো।কিন্তু,খুশি কেনো এই সাজে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তা রায়ান কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
খুশি ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকালো রায়ানের দিকে।রায়ানের চোখ,মুখ দেখে কিছুই ঠাহর করতে পারছে না।তবে,এতোদিন বাদে রায়ানকে নিজের সামনে দেখে খুশি আচমকাই রায়ানকে জাপটে ধরলো।রায়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলো।
রায়ান যা বুঝার বুঝে গিয়েছে।তার মা যে তাকে মিথ্যা কথা বলে এইখানে নিয়ে এসেছে তা এখন তার কাছে সম্পূর্ণ পরিষ্কার।মুহুর্তেই তার মাথায় রাগ চেপে যায় সেই সাথে মনেও পড়ে যায় খুশির সেইদিনকার কথা গুলো।খুশিকে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।আর,এক মুহূর্তও এইখানে থাকবে না।ধপাধপ্ পা’য়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু,বেশিদূর আগাতে পারে নি।তার আগেই বেলী এসে হাজির হয়েছে।বেলীকে দেখে রায়ানের অগ্যাতা থামতে হলো।
বেলীর শরীরটা আগের থেকে অনেকটা ভারী হয়ে গিয়েছে।শিউলি পেটে থাকতে সে এতোটাও মোটা ছিলো না আর এখন সাত মাসের মাথায় মোটা হয়ে একদম যা তা অবস্থা।তার উপর আজকে জেদ করে একটা কালো বেনারসি শাড়িও পড়েছে।এইসব কিছু বুরাগ আর সে মিলে করেছে।দু’পরিবারের সম্মতিতে রায়ান আর খুশির বিয়ে ঠিক হয়েছে।তাই তো মিথ্যা বলে রায়ানকে আজকে ঢাকায় আনা হয়েছে।না হলে কি আর রায়ানের দেখা পেতো!!
বেলী খোঁপার গাঁজরা টা ঠিক করতে করতে বললো,
–“আজকে পালাতে দিচ্ছি না রায়ান ভাইয়া।আপনার জন্য আমার বোনটার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছেন।কীভাবে পারলেন আমার এতোটুকু বোনটাকে কষ্ট দিতে।”
–“ভাবী!এই সবকিছু বুরাগের ফন্দি তাই না।ইশশ!আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।কেনো বোকার মতো চলে এসেছি।”
–“মা’র অসুখের কথা শুনলে কি আর মাথা ঠিক থাকে রায়ান ভাইয়া।আমি বুঝেছি আপনার ব্যাপার টা।কিন্তু,কি করবো বলুন!ওই মিথ্যা কথাটা না বললে আপনাকে যে আর আনা যেতো না।আমার বোনটা যে কষ্ট পেতো।শুধু তাই নয় আপনিও তো কষ্ট পেতেন।”
–“ভাবী!আপনারা যা ভাবছেন তা কিন্তু আর সম্ভব না।আমি এইসব বিয়েসাদী করতে পারবো না।আমি একাই বিন্দাস আছি।”
–“না ভাইয়া!আমরা আর মানছি না।অনেক কষ্ট পেয়েছেন আপনারা।এখন আমরা যা বলবো তাই হবে।”
বেলী রায়ানের হাতটা ধরে টেনে নিচে নামতে লাগলো।রায়ান বেলীর সাথে জোর করছে না।যদি কোথাও লেগে যায় তাই।নিচে নেমে দু’পরিবারের সবাইকে দেখে হঠাৎ করেই রায়ানের খুব লজ্জা লাগতে শুরু করে দিলো।কেনো করছে তা রায়ানের অজানা।
—-
সেদিন রাতেই পরিবারের সম্মতিতেই রায়ান আর খুশির বিয়ে হয়ে যায়।খুশি এখন নিঃশব্দে রায়ানের রুমে বসে আছে।তার খুব ভয় হচ্ছে।পাগলামি করে রায়ানকে তো বিয়ে টা করেই নিলো না জানি এখন তার উপর কি তান্ডব শুরু করে।রায়ান ফ্রেশ হয়ে এসে সোজা বারান্দায় চলে গেলো।খুশির দিকে একদন্ডও তাকায় নি।খুশি আহাম্মকের মতো কিচ্ছুক্ষণ বসে থেকে শুয়ে পড়লো।তার খুব ঘুম পাচ্ছে।এতো রাত পর্যন্ত সে কখনেই সজাগ ছিলো না।খুশিকে শুতে দেখেই রায়ান বারান্দার থাইগ্লাস টা বন্ধ করে দিয়ে খুশির দিকে রাগে তেড়ে আসলো।খুশির ডান হাত টা ধরে টেনে তুললো।আচমকাই এমন হওয়ায় খুশি ভয় পেয়ে যায়।পিটপিট করে রায়ানের দিকে তাকাতেই রায়ান খুশির গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো।একটার পর একটা চুমু দিয়েই যাচ্ছে।সেই সাথে কামড়ও।রায়ানের এইরূপ আচরণে খুশি প্রথমে ভয়ে জমে গেলেও পরক্ষণে নিজেও রায়ানের তালে তাল মিলাতে লাগলো।তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।রায়ানের চুল গুলো আঁকড়ে ধরে নিজেকে রায়ানের সাথে মিশে রয়েছে।দু’জনের ভালোবাসার মান অভিমানের পাল্লা আজকে শেষ হতে চলেছে!!
_______________
চোখের পলকেই সময় যে কীভাবে চলে যায় তা ভাবাই মুশকিল।রায়ান আর খুশির বিয়ের আজকে তিনমাস চলছে।এই তিনমাসে রায়ান খুশির বিবাহিত জীবন বেশ চলছে।তাদের মধ্যে ভালোবাসার কোনো কমতি নেই।
খুশি সকালের নাস্তা রেডি করছে।ইমা খানম সোফায় বসে ইসলামিক কয়েকটা বই পড়ছেন।রায়ান ফর্মাল ড্রেসে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে।সাথে হাকিমুল্লাও আছে।হাকিমুল্লা কে রায়ান যেতে দেয় নি।পার্মানেন্ট নিজের সাথে থাকতে বলেছে।
রায়ান চেয়ার টেনে বসে পড়লো।খুশির দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে ব্রেডে কামড় বসালো।খুশি লজ্জায় রায়ানের দিকে তাকাতেও পর্যন্ত পারছে না।মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসছে।
হাকিমুল্লাও রায়ানের পাশে বসে মুচকি মুচকি হেসে বললো,
–“ভাই!আমি না একটা মাইয়া দেখছি আমার লাইজ্ঞা।পাশের বাসায় থাহে।যদি একটু বিয়ার প্রস্তাব ডা লইয়া যাইতেন।তাইলে!খুব উপকার হইতো।”
রায়ান খাওয়ার মাঝেই খুকখুক করে কেশে উঠলো।খুশি দৌড়ে পানির গ্লাস টা এগিয়ে গেলো।রায়ান সবটা পানি সাবাড় করে হাকিমুল্লার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তোর বিয়ের বয়স হয় নি হাকিমুল্লা।বিয়ের বয়স হলে আমি নিজেই তোর জন্য বউ খুঁজে নিয়ে আসবো।”
–“যাই কন ভাই আমি এহনেই বিয়া করতে চাই।আপনার মতো চুল পাইক্কা গেলে বিয়া করবার চাই না।বউ আমারে বুড়া ডাকবো।”
রায়ান গোলগাল চোখে তাকালো হাকিমুল্লার দিকে।খুশি এবার হেসে ফেললো।শুরু থেকেই হাকিমুল্লার কথাগুলো শুনতে তার ভালো লাগে।এমনকি ইমা খানমও হেসে দিলেন।হাকিমুল্লা এবার বেক্কল হয়ে গিয়েছে।তার মাথায় ধরেছে সে আসলে কি বলে ফেলেছে।এদিক ওদিক না তাকিয়ে দৌড়ে চলে গেলো।রায়ান এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।ইমা খানমের দিকে তাকিয়ে একবার পরোক্ষ করে নিলো।ইমা খানমকে পড়তে ব্যস্ত দেখায় ধীর গতিতে খুশির দিকে এগিয়ে গেলো।খুশির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
–“খুব হাসি পাচ্ছে তাই না খুশি তোমার।রাত টা আসুক তারপর তোমাকে বুঝাবো।এখন বেঁচে গেলেও রাতে কিন্তু বাঁচতে পারবে না।”
খুশি শুকনো একটা ঢোক গিলে রায়ানের দিকে তাকালো।রায়ান মুচকি হেসে খুশির গালে চট করে একটা চুমু খেয়ে নিলো।
–“লাভ ইউ খুশি।আসছি!”
কথাটা বলেই বেরিয়ে পড়লো।খুশি লজ্জায় আর রায়ানের দিকে তাকায় নি।রান্নাঘরে চলে গেলো!অনেক কাজ পরে আছে।
—————–
বেলী গোসল করে গামছা দিয়ে মাথাটা পেঁচিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো।কাল সারারাত বুরাগ একটুও ঘুমোতে দেয় নি।কাল রাতের কথা মনে পড়তেই বেলী লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেললো।গলায় এখনো জ্বলজ্বল করছে বুরাগের কামড়ের দাগটা।
বুরাগ ঘুমের মাঝে আন্দাজ করতে পারছে তার পেটের কাছে টি-শার্ট ভিজে একদম জুবুথুবু হয়ে গিয়েছে।পিটপিট করে চোখ মেলে দেখলো তার ছোট মেয়ে শৈলী প্রসাব করে একদম তার টি-শার্ট টা ভিজিয়ে দিয়েছে।শুধু তাই নয় তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।বুরাগ চিল্লিয়ে বেলীকে ডেকে বললো,
–“বেলী তুমি শৈলীকে ডায়াপার পড়াও নি কেনো।ওর কি ডায়াপারের অভাব ছিলো?আবার কি সুন্দর হাসছে আমাকে দেখে।
বেলী বারান্দা থেকে রুমে ঢুকে বুরাগকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“ইচ্ছা করে পড়ায় নি।আর মুতু করেছে বেশ করেছে।ওকে একটু পরিষ্কার করে দিন তো।আমার অনেক কাজ আছে।”
–“মানে!”
–“মানে!বলেছি!আপনার ছোট মেয়েকে একটু পরিষ্কার করে দিন।না হলে,একটু পরেই গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠবে।তার জন্য শিউলিরও ঘুম ভেঙে যাবে।দেখছেন তো!একজনের জন্য আরেকজনের ঘুম ভেঙে যাবে।তাই বলছি!তাড়াতাড়ি করুন।”
বুরাগ অসহায় চোখে তাকালো বেলীর দিকে।বেলী সেদিকে পাত্তাই দিলো না।বুরাগ,শৈলীকে পরিষ্কার করে দিয়ে শুয়ে পড়লো।দশ মিনিটও যেতে পারে নি শৈলী আবার কাঁথা নষ্ট করে দিয়েছে।শেষমেষ!মজার ঘুম থেকে উঠে বুরাগকে কাবার্ড থেকে ডায়াপার আনতে হয়েছে।ডায়াপার পড়িয়ে দিয়ে পড়েছে আরেক বিপদে।শৈলী ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।বুরাগ হাত বুলিয়ে দিলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।কিন্তু,হাত সরিয়ে আনতেই মুখ কেঁদে দেবার ভাব।এমন দু’একবার হওয়ায় বুরাগ না শুয়ে শৈলীকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো।আর,বেলী তা দেখে তৃপ্তির হাসি হাসলো।
—————————————
ভালোবাসার দিন গুলো খুব সুন্দর ভাবেই কেটে যাচ্ছে বুরাগ বেলীর।দুই সন্তান নিয়ে তারা বেশ সুখেই আছে।কয়েকদিন আগেই বেলী বুরাগ শিউলি আর শৈলীকে নিয়ে আশাকুঞ্জ নিবাস থেকে ঘুরে এসেছে।অলি সাহেবের মৃত্যুর পর আশাকুঞ্জ নিবাসটা অন্যরকম শান্ত হয়ে গিয়েছে।অলি সাহেবের মৃত্যুর কথা শোনার পর পরেই জাবেদা অসুস্থ হয়ে পড়েন।যার ফলে,জাবেদাকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।জাবেদা এখন বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে আছেন।
বেলীর খুব আফসোস হয় শিউলির জন্য।আজকে শিউলি যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তার আব্বা আম্মা কে এতো সহজে হারাতে হতো না।বেলীর আজকে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে।হুট করেই শিউলির সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো মনে পড়ে গিয়েছে।বেলী আর আটকাতে না পেরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।শিউলি বিছানায় বসে শৈলীকে নিয়ে খেলছিলো।মা’র কান্না দেখে শিউলি পিটপিট করে তাকালো বেলীর দিকে।শৈলী তো অলরেডি ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিয়েছে।এবার শিউলিও বাদ গেলো না।সেও কেঁদে দিয়েছে।কান্নার আওয়াজ পেয়ে বুরাগ দৌড়ে রুমে আসলো।বেলী আর দু’মেয়েকে কাঁদতে দেখে বুরাগ কিছুই বুঝতে পারছে না।বুরাগ নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো বেলীর দিকে।বেলীর মাথায় হাত রেখে বললো,
–“বেলী কি হয়েছে কাঁদছো কেনো!দেখো তোমাকে দেখে ওরাও কাঁদছে।”
বেলী বুরাগকে জাপটে ধরে বললো,
–“শিউলি কেনো এইভাবে চলে গেলো।ও এইভাবে চলে না গেলে আজকে আব্বা আম্মার কিছুই হতো না।আমি সবাইকে কাছে পেতাম।”
বুরাগ কি বলবে তা ভেবে পাচ্ছে না।মনে মনে ভেবে নিয়েছে বেলীকে আজকে একটু কান্না করতে দিবে।যার ফলে,মনে জমা হয়ে থাকা কষ্ট গুলো ঝড়া পাতার মতো ঝড়ে যাবে।বুরাগ তিনজনকেই নিজের দু’হাতে আগলে ধরে রেখেছে।এই তিন জন কে একসাথে নিজের বুকে ঠায় দিয়ে বুরাগের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো।মনের গহীনে শান্তির অনুভূতি খুঁজে পাচ্ছে।
সমাপ্ত
(বাপরে বাপ!অবশেষে লিখে শেষ করলাম।যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার ধৈর্য আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আর উপন্যাস লিখতে চাই না।কই শেষ করবো তা বুঝতে পারছিলাম না।😑😑
লাস্ট দুই পার্টে আমি অনেক হিমশিম খেয়েছি লিখতে গিয়ে।এইটাকে পরিশিষ্ট অংশ বলা চলে না একটা পর্বই বলা চলে।আমি নিজেও বুঝি নি লাস্টে এসে আমার এমন হয়ে যাবে।তাও!সবকিছু ক্লিয়ার করে লিখার অনেক চেষ্টা করেছি।)
সমাপ্ত
(