#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
রাফিদ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ইনশিতার দিকে। ইনশিতা হাতে পানির বোতল নিয়ে মাথা নিচু করে কাঁদছে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ইনশিতা। শীত বেশি না পড়লেও আবহাওয়াটা খুবই ঠান্ডা। রাফিদের ইচ্ছে করছে সিনেমার নায়কদের মতো জ্যাকেট খুলে ইনশিতাকে পরিয়ে দিতে। কিন্তু আফসোস, সে এটা কখনোই পারবে না।
ইনশিতা নিজেকে ধাতস্থ করে ঠিকভাবে উঠে বসে। পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে নেয়। পানি খেতে গিয়ে গলার দিকটাও ভিজে যায়। বোতল হাতেই আবারও ডুকরে কেঁদে উঠে। রাফিদ নিজেকে এতক্ষণ শান্ত রেখেছিল ইনশিতাকে সামলে ওঠার জন্য। ইনশিতার কান্নায় নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেনি। একটু এগিয়ে ইনশিতার মাথায় হাত বুলাতে গিয়েও থেমে যায়। হাত নামিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“ইতু, তাকাও আমার দিকে।”
ইনশিতা তাকাল না। মাথা নিচু করে কাঁদতেই থাকল। রাফিদ আবার বলল,
-“ইতু, তুমি যদি না বলো তাহলে কী করে বুঝবো কী হয়েছে? অনেক্ষণ আগে থেকেই লক্ষ্য করছি তুমি কোনো কারণে প্রচন্ড ভয় পেয়ে আছ। তাই তোমাকে সময় দিয়েছি নিজেকে সামলে উঠতে। এখন ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যাস্ট রিল্যাক্স।”
ইনশিতা মাথাটা একটু উঁচু করে তাকাল রাফিদের দিকে। রাফিদ তাকিয়ে থাকতে পারল না। সে চোখ বন্ধ করে নিলো। ইনশিতার দুচোখ লাল হয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে আছে, কপালেও আঘাতের চিহ্ন। জামাটারও কিছু কিছু অংশে ছেঁড়া যেটা ইনশিতা ওড়না দিয়ে আপাতত আড়াল করে রেখেছে। কাঁদতে কাঁদতে মুখের অবস্থা বেহাল। এমন অবস্থা দেখে রাফিদের ইচ্ছে করছে ইনশিতাকে বুকে জড়িয়ে নিতে। নিজের ইচ্ছাকে দমন করতেই চোখ বন্ধ করে ফেলল রাফিদ। এই অবস্থার জন্য যদি জেহের দায়ী হয়ে থাকে তবে রাফিদ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে ইনশিতাকে নিয়ে সোজা চলে যাবে নিজের বাড়ি। জেহের নিতে চাইলে সে নিজেও একটা রক্তারক্তি কান্ড ঘটাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।
ট্যাক্সির বাতি বন্ধ করে দিতে বলল ড্রাইভারকে। বাতি বন্ধ করার একমাত্র কারণ ইনশিতার যাতে অস্বস্তি না লাগে। ইনশিতা কিছুক্ষণ বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলার জন্য তৈরি হয়। পানির বোতলটা হাতে শক্ত করে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ আগের মুহুর্তটা চোখের সামনে ভাসলেই তার রাগে, লজ্জায়, ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করে।
তখন ইনশিতাকে তিনজনই জোরাজুরি করে সাত তলায় একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। রুমে এনে জিহাদ ইনশিতাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। যার ফলে কপালে খানিকটা আঘাত পায় ইনশিতা। কয়েকটা ব্যাগ ইনশিতার মুখের ছুঁড়ে মেরে নয়নিকা আর জেবাকে আদেশ দেয় রেডি করিয়ে দিতে। জিহাদ বেরিয়ে গেলে নয়নিকা আর জেবা তৈরি করাতে লাগে ইনশিতাকে। ইনশিতা কিছুই বুঝতে পারছিল না। কান্নার দমকে তার গলা দিয়েও কোনো কথা বের হতে চাইছিল না। যখন দেখল ব্যাগ থেকে বিয়ের বেনারসী আর গয়নাগাটি বের করছে তখনই তার মনে অজানা আতংক হানা দিতে লাগল বারংবার। আর একটু দূরেই দেখল তিনটা বড় বড় ব্যাগে গোলাপ ফুল। ইনশিতা ভয় পেয়ে জেবা আর নয়নিকার দিকে তাকাল। তারা তখন শাড়ী আর গয়না ঠিক করতে ব্যস্ত।
ইনশিতা ভয়ে দরজার কাছে দৌড়ে যেতে নিলে জেবা আর নয়নিকা জোর করে ধরে রাখে। ইনশিতার ইচ্ছে করছিল গলায় ঝুলানো ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন দেয়। কিন্তু সেই সুযোগও আর পেল না। ইনশিতার ওড়না আর জামা খুলে শাড়ী পরানোর চেষ্টা করতে থাকে তারা। ইনশিতা সাপের মতো মোচড়ামোচড়ি করার কারণে কেউই ঠিকভাবে কিছুই করতে পারল না। এভাবেই প্রায় পনের মিনিট কাটল তবে ইনশিতাকে ধরে রাখা ছাড়া কেউই কিছু করতে পারল না। ইনশিতা হাতের কাছে একটা গ্লাস পেয়ে নয়নিকার কপালে বারি মারে। নয়নিকা এক মুহুর্তের জন্য ইনশিতাকে ছেড়ে নিজের কপাল চেপে ধরলে ইনশিতা জেবার থেকে ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়ের থেকে ছাড়া পাওয়াটা বেশি কষ্টের নয়। ইনশিতা জেবার চুলের গোছায় টান মারলে জেবা ককিয়ে উঠে ইনশিতাকে ছেড়ে দেয়। ইনশিতা জেবাকে নয়নিকার উপর সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
রুম থেকে বের হয়েই আরেক যমের মুখোমুখি পড়ে। জিহাদ দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে, পাহারা দিচ্ছে দরজার কাছে। ইনশিতাকে শাড়ি পরা ছাড়া বের হতে দেখে রেগে যায় সে। ইনশিতা দৌড়ে পালাতে নিলে জিহাদ ইনশিতাকে নিজের কাঁধে তুলে নেয়। ইনশিতা চড় থাপ্পড় ঘুষি দিয়েও ছাড়াতে পারে না নিজেকে। মেয়েদের সাথে শক্তি দিয়ে পারলেও জিহাদের সাথে কখনোই পেরে উঠবে না সে।
বলা বাহুল্য, জেহের আর জিহাদের শক্তি খুবই কাছাকাছি। তবে জেহের আরেকটু বলশালী। ইনশিতাকে কাঁধে তুলে লিফটের দিকে এগিয়ে যায় জিহাদ। পেছন থেকে নয়নিকা আর জেবা দৌড়ে আসে। নয়নিকার কপাল বেয়ে তখন রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। তার দৃষ্টি এমন যেন সে এক্ষুনি ইনশিতাকে একা পেলে চিবিয়ে খেত। জেবা মাথায় হাত চেপে ধরে বলে,
-“ও’কে তো এখনো রেডিই করাতে পারলাম না। কীভাবে এখন…”
জেবার কথা শেষ হওয়া পূর্বেই জিহাদ থামিয়ে দিয়ে বলে,
-“বিয়ে করার জন্য বর আর কনে থাকলেই যথেষ্ট। বাড়তি কোনো সাজের প্রয়োজন নেই। আর আমার জানের যখন কোনো সাজ ছাড়া বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে তখন তাই হবে।”
ইনশিতা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। বিল্ডিংটাতেও বোধহয় বেশি মানুষ নেই। এই মুহুর্তে সে প্রার্থনা করছে জেহের যাতে ছুটে এসে তাকে বাঁচিয়ে নিক। সকলকে মেরে তক্তা করে দিক। তবে ইনশিতা যে নিজেই সেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে জেহেরকে বেঁধে। আর এমন ভাবে বেঁধেছে যে কারো সাহায্য ছাড়া সেই বাঁধন খুলবে না। কী আশ্চর্য! যাকে বেঁধে রেখে সে পালিয়ে এসেছে এখন তাকেই বাঁচাতে আসার জন্য প্রার্থনা করছে!
জিহাদ লিফটে উঠে নয়তলার একটা রুমে ঢুকে যায়। রুমে ঢুকেই ইনশিতাকে একটা চেয়ারে জোর করে বসিয়ে নিজে আরেকটা চেয়ারে বসে পড়ে। ইনশিতার দুহাত নিজের একহাতে নিয়ে হাঁটু দিয়ে ইনশিতার পা চেপে ধরে আছে যাতে উঠতে না পারে। তাদের সামনেই চশমা চোখে কাজী বসে আছে। জেবা আর নয়নিকা তাদের পেছনে এসে দাঁড়ায়।
জিহাদ ইনশিতাকে চাপ দিতে থাকে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার জন্য। ইনশিতা কাঁদতে কাঁদতে বলছে সে কিছুতেই সাইন করবে না। তা দেখে কাজী বলে,
-“আমার মনে হয় কনের বিয়েতে মত নেই। এভাবে জোর করে তো…”
জিহাদ ধমকে বলল,
-“সেটা আপনার জানার দরকার নেই। কাজী আছেন, কাজীর মতো থাকবেন। বেশি বুঝতে গেলে আপনাকে জেলের ভাত খাওয়াতেও সময় লাগবে না আমার।”
কাজী সাহেব চুপসে গেলেন। ইনশিতা জিহাদের সাথে ধস্তাধস্তি করে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। ইনশিতা নয়নিকার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-“নয়ন রে, তুই প্লিজ এসব থামা। আমাকে জেহেরের কাছে যেতে দে নয়ন। প্লিজ নয়ন।”
নয়নিকা কটমট করে বলে,
-“তোর নাটক শেষ হলে সাইনটা করে দে। বিয়ে বসতে চলেছিস, কোনো ফাঁসিতে ঝুলছিস না কোনো।”
-“আমার জেহেরের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সব নিয়ম মেনেই বিয়ে হয়েছে। আরেকটা বিয়ে করা যাবে না কোনোমতেই। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি জিহাদকে বিয়ে করতে পারবো না। ওনার মতো নোংরা মন মানসিকতার লোক কখনো কারো স্বামী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।”
এটা শুনে জিহাদ ইনশিতার বাহু চেপে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
-“সেই নোংরা মন মানসিকতার লোকটাই আজ তোমার স্বামী হবে। আর জেহেরের সাথে বিয়ে কেউ মানেই না। সো নিজেকে জেহেরের স্ত্রীর পরিচয় দেওয়া বন্ধ করো। জেহেরকে শুধুমাত্র ভয় পেয়ে বিয়ে করেছো তুমি। ওটা কোনো বিয়েই ছিল না।”
তারপর ইনশিতার হাতে কলম ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-“সাইনটা করো আগে।”
জেবাও বলল,
-“ভালোয় ভালোয় সাইনটা করে নাও ইনশিতা।”
ইনশিতা কলম ছুঁড়ে মারল। জিহাদকে ধাক্কা মেরে চলে যেতে নিলে নয়নিকা চেপে ধরে। ইনশিতা মিনতি করে বলে,
-“তুই কেন এমন করছিস নয়ন? তুই তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার বোনের মতো। তাহলে কেন তুই আমাকে এই বিয়ের জন্য জোর করছিস? আমি জেহেরের সাথে ভালো থাকবো। তুই কি চাস না আমি ভালো থাকি? এই নয়ন, প্লিজ আমাকে রেহাই দে। আ-আমাকে যেতে সাহায্য কর রে নয়ন।”
বলতে বলতে ইনশিতা নয়নিকার পা ধরে ফেলল। পা ধরে বারবার মিনতি করতে লাগল এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার। নয়নিকা বিরক্তি নিয়ে ইনশিতাকে টেনে উঠাল। শক্ত গলায় বলল,
-“সাইনটা কর, তারপর নিয়ে যাব।”
ইনশিতা দুহাত জোড় করে রেখেছে। চোখের অশ্রু বাঁধ ভেঙে কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। কোনরকমে কষ্টে বলল,
-“আম-আমি স-সাইন করবো না। আমি জেহেরের কাছে যাবো। তুই শত্রুর মতো আচরণ করছিস কেন নয়ন? তুই তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”
নয়নিকা তাচ্ছিল্য কন্ঠে বলে,
-“আমার বালের বেস্ট ফ্রেন্ড।”
নয়নিকার এমন আচরণ ইনশিতার বোধগম্য হচ্ছে না। সে নয়নিকার গাল ধরে বলে,
-“এই নয়ন। তুই পাল্টে কেন গেলি নয়ন? এদের হাত থেকে আমাকে বাঁচা না রে নয়ন। আমি তোর কী ক্ষতি করেছি?”
নয়নিকা রাগ সামলাতে না পেরে সপাটে একটা চড় মেরে দিলো ইনশিতার গালে। নয়নিকার হাতে থাকা কলমের জন্য ইনশিতার ঠোঁট কেটে যায়। চড়টা এতটাই জোরে ছিল যে ইনশিতা পিছিয়ে গিয়ে পড়ল জিহাদের বুকে। ইনশিতা গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ বনে চেয়ে রইল নয়নিকার দিকে। এ কোন নয়ন? এটা কী সেই নয়ন যে ইনশিতার কষ্টে নিজে কষ্টিত হতো? নিশ্চয় না। এই নয়ন আর আগের নয়নের মধ্যে বিস্তর ফারাক।
ইনশিতাকে মারতে দেখে জিহাদ নয়নিকাকে শাসালো,
-“লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছ না কি? ইনশিতাকে চড় মারার সাহস কোথায় পেলে হু? নিজের লিমিটের মধ্যে থাকো। নইলে ভালো হবে না তোমার জন্য।”
নয়নিকা ঘৃণার দৃষ্টিতে চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইনশিতার দিকে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্যতম বস্তুটি এখন তার সামনে। জিহাদ ইনশিতার বাহু ধরে নিয়ে আবার চেয়ারে বসাতে চাইল। ইনশিতা এখনো নিস্তব্ধ। আচমকা সে জিহাদের হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে এক দলা থুথু ছুঁড়ে মারল নয়নিকার মুখে। রাগে ইনশিতার হাত পা কাঁপছে। চিল্লিয়ে বলল,
-“তোর মতো বেস্ট ফ্রেন্ড যেন আমার শত্রুরও না হয় এই দোয়া করি। মরিস না কেন রে তুই? তোর মতো বন্ধু তো কোবরার থেকেও বিষাক্ত। থুউউ…”
আরেক দলা থুথু ছুঁড়ল নয়নিকাকে। ইনশিতার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে রাগে। নয়নিকা রেগেমেগে ইনশিতার দিকে তেড়ে গেলে জিহাদ এসে আটকায় নয়নিকাকে। আঙ্গুল তুলে নয়নিকাকে হুমকি ধামকি দিলেও নয়নিকা ইনশিতার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসে। জেবা এসে নয়নিকাকে নিয়ে রুমের বাহিরে চলে গেল। জিহাদ এগিয়ে আসে ইনশিতার দিকে। ইনশিতা তখনও ভাবছে তার বোনের মতো ফ্রেন্ডের আচরণের কারণ। জিহাদ ইনশিতাকে নিয়ে আবারও চেয়ারে বসালে ইনশিতা উঠে পড়ে। জিহাদের রাগটাও ধীরে ধীরে লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। খুব কষ্টে সামলাচ্ছে নিজের রাগ। শান্ত কন্ঠে বলে,
-“সাইনটা করে দাও জান। প্রমিস, জেহেরের থেকেও বেশি সুখে রাখবো আমি।”
ইনশিতা রাগে দিশেহারা হয়ে গেল। জিহাদকে আচমকা থাপ্পড় মেরে বলে,
-“তোর মতো কু***বা*র সাথে সুখে থাকতে চাই না আমি।”
এমন আরও কয়েকটা কথা বলছিল সে। জিহাদ স্তম্ভিত হয়ে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকল ইনশিতার দিকে। পরমুহুর্তে রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। পা দিয়ে চেয়ার উল্টে ফেলে ইনশিতাকে আগের ন্যায় কোলে তুলে নেয়। যেতে যেতে বলে,
-“এই কু***বা*র হিংস্রতাও আজ তোকে দেখাব। চল তুই।”
ইনশিতাকে নিয়ে সেই সাত তলার রুমে নিয়ে আসে। খাটের মাঝে চেপে ধরে ফুলের ব্যাগ থেকে ফুল ছড়াতে লাগে খাটে। জেবা আর নয়নিকা পেছন পেছন আসে। জেবা বলে,
-“বিয়েটা হয়েছে?”
জিহাদ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
-“হয়নি, তবে এখন আমি যা করব তাতে বিয়ে না করে আর উপায় নেই।”
সকলেই বুঝে গেছে ইনশিতার সাথে এখন কী ঘটবে। জেবা খানিকটা চিন্তিত মুখে বলে,
-“বাট ভাই, বিয়ে না করে এখন এসব করার কী দরকার। বিয়েটা করে নে আগে। তারপর না হয়…”
জিহাদ বিরক্তি নিয়ে বলে,
-“একই তো। বিয়ের পর যা করব, তা বিয়ের আগেই করে ফেলি। বিয়েটা তো হচ্ছেই আমাদের।”
-“কিন্তু…”
-“তুই প্লিজ, এখন রুম থেকে বের হ। যা।”
নয়নিকা জেবাকে টেনে বেরিয়ে নিয়ে আসে। বেরিয়ে আসার সময়ও ইনশিতা ব্যাকুল দৃষ্টিতে ওদের থেকে সাহায্য চাইছিল। কিন্তু কেউই ফিরে তাকায়নি। নয়নিকা তো চায় ইনশিতাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিক জিহাদ।
নয়নিকা আর জেবা বেরিয়ে আসলে জিহাদ রুমের দরজা আটকে দেয়। জিহাদ ইনশিতাকে এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে ইনশিতা ব্যথা পেয়ে পেট হাত দিয়ে আছে। সাহায্যের জন্য একমাত্র আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। জিহাদ ইনশিতাকে খাট থেকে উঠিয়ে নিজের একহাতে পেঁচিয়ে ধরে আরেকহাতে ফুলের পাপড়ি ছড়ায় শুভ্র বিছানায়। মুখে তার বিদঘুটে হাসি। ইনশিতা কাঁদতে কাঁদতে জিহাদের হাত জড়িয়ে বসে পড়ল।
-“আ-আমাকে প্লিজ ছেড়ে দিন জিহাদ। আমার এ-এত বড় সর্বনাশ করবেন না প্লিজ।”
জিহাদের হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে পা জড়িয়ে ধরে। ইনশিতার চুলের মুঠি ধরে উঠে দাঁড় করিয়ে দেয় জিহাদ।
-“তখন বলেছিলাম সাইন করে দিতি, দেসনি। আর এখন যা করব তাতে নেচে নেচে তুই সাইন করবি। আমাকে কু**বা* বলা তাই না? দেখ আজ এই কু**বা* তোর কী অবস্থা করে।”
ইনশিতাকে ধাক্কা মেরে খাটে ছুঁড়ে দেয় জিহাদ। নিজের শার্ট খুলে মেঝেতে ফেলে ইনশিতার পা ধরে নিজের কাছে টেনে আনে। ওড়না খোলার চেষ্টা করে জিহাদ। ইনশিতা বাকশূন্য হয়ে গিয়েছিল সেই মুহুর্তে। এমন পরিস্থিতিতে ঠিক কী করতে হয় এই মুহুর্তে তার মাথায় আসছে না। এদিকে ইনশিতার উপর প্রায় ঝাঁপিয়েই পড়ল জিহাদ। জামার কিছু অংশও ছিঁড়ে ফেলল সে। ইনশিতা বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে আগে নিজের মাথা ঠান্ডা করে নেয়। এই মুহুর্তে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে। ইনশিতা ধস্তাধস্তি না করে শান্ত হয়ে যায়। ইনশিতাকে শান্ত হতে দেখে জিহাদ নিজেও খানিকটা আলগা করে ধরে রাখে ইনশিতাকে। ওড়না ছুঁড়ে যেই জামায় হাত দিবে অমনি মেইন পয়েন্টে লাথি মেরে দেয় ইনশিতা। খুব জোরে না লাগলেও ততটাও আস্তে লাগেনি। ব্যথা পেয়ে ছেড়ে দেওয়ার মতোই লেগেছে। জিহাদ ইনশিতাকে ছেড়ে ব্যথা পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে সরে যায়। তখনই ইনশিতা উঠে সর্বশক্তি দিয়ে খাট থেকে ফেলে দেয়। দৌড়ে দরজার কাছে আসতে গিয়ে কিছু একটার সাথে লেগে আর পা কেটে যায়।
তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে লিফটের দিকে দৌড় মারে ইনশিতা। ঘটনাটা এত দ্রুতই ঘটেছিল যে নয়নিকা আর জেবা ইনশিতাকে ধরার সময়ও পায়নি। সিঁড়ি দিয়ে নামলে দেরি হবে তাই ইনশিতা লিফটাই বেছে নিলো। লিফটটা বন্ধ হতেও যেন দেরি লাগছে। বিপদের সময় সবকিছুতেই কেন যে দেরি হয়? উফ! ততক্ষণে জিহাদ নিজেও রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। তিনজনেই দৌড়ে লিফটের দিকে আসছে ইনশিতাকে ধরার জন্য। ইনশিতা ভাবছে কোনোরকমে যদি কেউ তাকে আজ ধরে নেয় তাহলে তার আর নিস্তার নেই। জিহাদ প্রায় লিফটের কাছাকাছি এসে গেছে। ইনশিতা তখন দোয়া করছে লিফটা বন্ধ হওয়ার। জিহাদ যেই লিফটে ঢুকতে নিবে সেই মুহুর্তেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইনশিতা লিফট ঘেঁষে বসে পড়ে। যেন সে এই মুহুর্তে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে।
নিচে নেমে কোনদিক যাবে ভেবে পায় না সে। এই রাস্তাটা সম্পূর্ণ অচেনা। তার উপর সন্ধ্যা নেমে গেছে। নিয়নের আলোতে ইনশিতা খানিকটা এগিয়ে এলে নয়নিকা জেবা আর জিহাদের আওয়াজ শুনতে পায়। তার মানে তারা চলে এসেছে। এইখানে গাছগাছালিও নেই যে লুকাবে। রাস্তায় দৌড়ালেও জিহাদ ধরে ফেলবে। গাড়ি থামানোর চেষ্টা করলো সে। তবে একটাও থামল না। তার গলা আর কোমর মিলে ঝুলছে ছোট্ট ব্যাগটা। এইমুহুর্তে যে কাউকে ফোন করলেও পাবে না সেটা সে বুঝতে পারছে। অদূরে কিছু গাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে পা ছুটালো সেদিকটায়।
ইনশিতা গিয়ে একটা গাড়ির পেছনে লুকালো। ইতিমধ্যে জিহাদ জেবা আর নয়নিকা রাস্তায় এসে পড়েছে। জিহাদ খালি গায়েই দৌড়ে এসেছে। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ইনশিতাকে খুঁজতে লাগে। এখন যদি ইনশিতাকে পেয়ে যায় সে তাহলে পৃথিবী উল্টে গেলেও কোনোভাবেই ছাড়বে না। এমন অবস্থা করবে যে মানুষকে নিজের চেহারাও দেখাতে লজ্জা পাবে ইনশিতা। চারিদিক তাকিয়ে খুঁজছে তারা ইনশিতাকে। ইনশিতার লুকানো গাড়ির কাছেই জিহাদ দাঁড়ানো। একটু পেছন ফিরলেই ইনশিতাকে দেখতে পাবে সে। ইনশিতা দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল যাতে কান্নার আওয়াজ জিহাদ না পায়। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জিহাদ তখন হুমকি দিচ্ছিল ইনশিতাকে। কারণ সে জানে ইনশিতা আশেপাশেই লুকিয়ে আছে।
তখনই একটা ট্যাক্সি ঐ রাস্তা দিয়ে যায়। জিহাদ তখন আশেপাশে খুঁজতে ব্যস্ত। আর নয়নিকা আর জেবা বিল্ডিংয়ের আশেপাশে খুঁজতে লাগে। ট্যাক্সির মধ্যে বসা রাফিদ দেখতে পেল নয়নিকাকে। সে তার বাবার সাথে একটু আগে হসপিটাল থেকে চেকাপ করে ফিরল। বাবা একটা কাজে গিয়ে তাকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিলেন। নয়নিকাকে এই ভরসন্ধ্যায় হঠাৎ দেখে রাফিদ গাড়ি থামাতে বলে। তার পা এখনো ঠিক হয়নি। তবুও একটু একটু হাঁটতে পারে।
নয়নিকাকে যেই ডাক দিবে তখন তার চোখ পড়ে একটা কালো গাড়ির পেছনে হলুদ জামা পরিহিত চেনা কাউকে। যে কিনা মুখ চেপে বসে আছে। ড্রাইভারকে সেই কালো গাড়ির কাছে এগিয়ে যেতে বলে। সেখানে গিয়ে থামলে রাফিদ দরজা খুলে দেয়। ইনশিতার চোখ পড়ে তখন রাফিদের উপর। প্রাণ ফিরে পায় যেন সে। হুড়মুড় করে ট্যাক্সির মধ্যে ঢুকে পড়ে। ইনশিতার বিধ্বস্ত অবস্থা দেগে রাফিদ কিছু বলতে যাবে ইনশিতা ইশারায় চুপ করতে বলে আর ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে।
আশেপাশে এমন অনেক গাড়িই যাতায়াত করছে তাই তাদের তিজনের কেউই বিশেষ খেয়াল করেনি ট্যাক্সিটাকে। গাড়ি চলতে শুরু করলে রাফিদ লাইট অন করতে বলে। বিস্মিত চোখে বলে,
-“তোমার এই অবস্থা কেন ইতু? আর নয়নিকাকে দেখলাম। ও’কে নিয়ে আসলে না কেন? কী হয়েছে?”
ইনশিতা তখন থেকেই কাঁদতে লাগে। রাফিদ পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে নিজেকে সামলানোর সময় দেয় ইনশিতাকে।
.
.
সব শুনে রাফিদের ইচ্ছে করছে নয়নিকাকে টুকরো করে রাস্তার কুকুরকে খাওয়াতে। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। ছিঃ! ইনশিতা নয়নিকাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করত। আর সেই নয়নিকাই যে ইনশিতার পিঠে ছুরি মারবে সেটা কে জানতো? রাফিদের হাত পা আজ ঠিক থাকলে সে নিশ্চিত নয়নিকাকে তার অবস্থান বুঝিয়ে দিত।
ইনশিতা তখনও সেই মুহুর্তের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। তার হাত পা মৃগী রোগীর মতো কাঁপছে ভয়ে। গলা ব্যথা হয়ে গেছে তার। রাফিদ ইনশিতাকে আর এই পরিস্থিতি নিয়ে একটাও প্রশ্ন করল না। কথা ঘুরানোর জন্য বলে,
-“তুমি কী সত্যিই জেহেরকে ভালোবাসো?”
শত কষ্টের মধ্যেও ইনশিতার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। যা দেখে উত্তর পেয়ে যায় রাফিদ। তার কষ্ট হতে লাগে, কিন্তু সেটা অপ্রকাশিতই রাখে। ইনশিতা আপনমনে বলে,
-“কখন কীভাবে জেহেরকে যে ভালোবেসে ফেললাম নিজেই জানি না। ভালোবাসা কখনোই বলেকয়ে হয় না। হুট করে হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রেও বোধহয় তাই হয়েছে।”
রাফিদ ঢোক গিলে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজের কষ্ট দমন করে। নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখে তার ভালোবাসার মানুষটির কথা শোনা বোধহয় সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয়। রাফিদ আড়চোখে তাকাল ইনশিতার দিকে। সে পারলে জেহেরের নামে সেদিন কেসটা করতে পারত। তবে জেহের তাকে হুমকি দিয়েছিল তার পরিবারের ক্ষতি করার। তাই রাফিদ সেদিন পুলিশকে মিথ্যে বলেছিল যে ঝামেলায় জড়িয়ে তার এই অবস্থা হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাফিদ। তবে তার এটা ভেবেই বেশি রাগ লাগছে জিহাদ কীভাবে এমন একটা নোংরা কাজ করতে পারল? নিজের বোন আর ইনশিতার ফ্রেন্ডের সাহায্যে এত বড় একটা অন্যায় করতে একবারও বিবেকে বাঁধলো না! জেবার সম্পর্কে এবার ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই জন্মালো না রাফিদের মনে। মনুষ্যত্বহীন মানুষ সবগুলো। রাফিদ সুযোগ পেলেও এখন আর এমনটা করবে না। সে চায় ইনশিতা খুশি থাকুক। ভালোবাসার মানুষটি ভালো থাকলে সেও ভালো থাকবে। সবসময় যে কাছে থেকেও ভালোবাসা যায় কে বলল? দূর থেকেই ভালোবেসে যাবে নিজের ভালোবাসাকে।
জঙ্গলের রাস্তায় পৌঁছাতেই ইনশিতা ট্যাক্সিটা এখানে থামাতে বলল। এখান থেকে হেঁটে গেলে দশমিনিটে পৌঁছে যাবে সে। কিন্তু রাফিদ তাকে একা ছাড়তে নারাজ। পথিমধ্যে আবার কোনো বিপদ হোক সেটা সে চায় না। ইনশিতা রাফিদকে বোঝাতে চাইল, জেহের যদি কোনোভাবে জানে যে রাফিদ তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে তাহলে রাফিদকে আর ছাড়বে না। রাফিদ চাইল সে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে তারপরই আসবে। রাফিদের হাত পায়ের অবস্থা ভেবে ইনশিতা বাঁধা দিতে চাইল। তবে রাফিদ শুনল না কোনো কথা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ইনশিতাকে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। পুরো বাড়িটায় এখন অন্ধকার ঘিরে রয়েছে। সামনে যে একটা ঘর আছে সেটাও বোঝবার উপায় নেই। রাফিদকে অসংখ্য ধন্যবাদ দেয় ইনশিতা। বিদায় দিয়ে ইনশিতা ফ্ল্যাশ অন করে গেইট বন্ধ করে ধীর পায়ে এগোলো ঘরের দিকে। খুশি আর ভয়ের সংমিশ্রণে হাবুডুবু খাচ্ছে ইনশিতা। জেহেরকে আজ তার ভালোবাসার কথা বলবে সেই খুশি। আর আজকে জেহের ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেই ভয়। জেহের নিশ্চয় ছেড়ে দেবে না আজ! এটা সত্যি যে ইনশিতার মনে খুশির থেকে ভয়টাই বেশি ঝেঁকে ধরেছে। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে দরজা খুললো সে।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে মনে হচ্ছে এটা ভুতের বাড়ি। এই এতটা ক্ষণ জেহের কীভাবে যে ছিল ভাবতেই ইনশিতার শরীরে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যায়। দরজা আটকে রুমের দিকটায় পা বাড়ালে সে শুনতে পায় ভয়ঙ্কর সেই হাড় হিম করা সুর। যেটা একবার নয়নিকাদের পুরোনো বাড়িতে জেহের বাজিয়েছিল। যেই ভয়ানক সুরে ইনশিতা প্যানিক হয়ে গিয়েছিল। হারমোনিকার অদ্ভুত ভয়ানক সুর। ইনশিতা কান চেপে ধরল। সে এমনিতেই এমন সুর শুনতে পারে না। তার উপর মোবাইলটা পড়ে বন্ধ হয়ে ফ্ল্যাশ অফ হয়ে গিয়েছে। অন্ধকার ছাড়া চোখে আর কিছুই দেখছে না সে। ভয়ে ইনশিতার শ্বাস উঠে গেল যেন। হরর মুভিগুলার হাড় হিম করা সুরের থেকেও বোধহয় জেহেরের এই সুরটা অত্যাধিক ভয়ানক।
আন্দাজ করে হাতড়ে হাতড়ে ইনশিতা রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। সুরটা আরো গাঢ় হয়ে এলো ততক্ষণে। ইনশিতা বলতে চাইল জেহেরকে এই আওয়াজ বন্ধ করতে। কিন্তু বলতে পারল না। ইনশিতা দরজা ধরে বসে পড়ল। ভেতর বাহির কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে সে সিওর সে জেহেরের রুমের সামনেই। কান চেপে চিৎকার করতে চাইল ইনশিতা। সুরটা যেন কানের পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্ক ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। ইনশিতার চাপা কন্ঠ শোনা গেল শুধু।
-“জেহের, বন্ধ করুন। আমি আর নিতে পারছি না এই সুর।”
তবে সেই ক্ষীণ কন্ঠ হারমোনিকার আওয়াজে চাপা পড়ে গেল। প্রায় মিনিট খানিকক্ষণ পরে সুরটা আচানক থেমে গেল। থামতেই ইনশিতার কান্না শোনা গেল। নিস্তব্ধ পরিবেশের মাঝে ইনশিতার ক্ষীণ কন্ঠের কান্নাকেও বিশাল আওয়াজ মনে হয় যেন। ইনশিতা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। এখন শুধু সাপের মতো ফোঁস ফোঁস আওয়াজ আসছে।
ইনশিতা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ভেতরে। হাত দিয়ে ধরে ধরে সুইচ খুঁজতে থাকে। কোথায় সুইচ সে নিজেও এখন ঠাওর করতে পারছে না। আচমকা তার হাত টেনে ধরে নিজের বুকের উপর ফেলে জেহের। ইনশিতা ভয় পেয়ে জেহেরকে জড়িয়ে ধরে। জেহেরের বড় বড় নিঃশ্বাসের উষ্ণ বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে ইনশিতার সারা মুখে। ইনশিতা জেহেরকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তখন সেই সুর আবারও ভেসে আসে। একদম কানের কাছে এবার। দু’হাত দিয়ে কান চেপেও যেন আওয়াজ থামাতে পারছে না ইনশিতা। এদিকে উঠেও দাঁড়াতে পারছে না কারণ জেহের নিজের দু’পা দিয়ে শক্ত করে ইনশিতার পা চেপে আছে। ইনশিতার মাথা ধরে যাচ্ছে সেই সুরে। জেহেরের বুকে শক্ত করে মুখ গুঁজে কাঁদছে সে। আজ সারাদিন তার উপর এত ধকল গিয়েছে যে শরীরের সমস্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। সেই ভয়ানক সুর আর কানে বাজলো না তার। জেহের হারমোনিকাটা ছিটকে ফেলে ইনশিতার চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো। অস্ফুটে কিছু বলল সে। তবে ইনশিতা বুঝতে পারল না।
টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলো জেহের। ইনশিতা দেখল শান্ত অথচ লাল চোখ নিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জেহের তার দিকে। জেহেরের বাহু ধরে উঠে হাতের বাঁধন খুলে দিতে লাগল ইনশিতা। দেখল জেহেরের হাতের কব্জি পর্যন্ত রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে আছে। নিজেকে নিজে ধিক্কার জানালো ইনশিতা।
জেহের এখনো একই দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ইনশিতা তোয়াক্কা করলো না। তার মনে হলো সে এক্ষুনি হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তাই দ্রুত উঠে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। আপাতত একটা লম্বা শাওয়ার নিলে নিজেকে বড্ড ফ্রেশ লাগবে। তারপর জেহেরের হিংস্রতামি সহ্য করা যাবে।
.#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৮
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
টুপটুপ করে রক্ত ঝরছে ফ্লোরে। হাতের কাছে কোনো অয়েন্টমেন্টও নেই। ইনশিতা উঠে দাঁড়িয়ে ব্যালকনির দরজায় দাঁড়াল। সে নিজেও বুঝতে পারছে না এই মুহুর্তে ঠিক কী হচ্ছে। তবুও অজস্র ভয় আর সীমাহীন চিন্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যালকনিতে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে কয়েক পলক চেয়ে নির্বিকার দৃষ্টিতে হাতের দিকে একবার তাকাল। খুব সাবধানে পা ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে হাতের রক্ত ধুয়ে বের হলো। ব্যথায় হাতের শিরা উপশিরা চিলিক দিয়ে উঠছে তবুও টু শব্দটি না করার আপ্রাণ চেষ্টায় আছে সে।
ড্রয়ারে এইড বক্স খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। তাই কাপড়ের ছোট টুকরা ক্ষত স্থানে ভালোভাবে বেঁধে নিলো। লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। আসলে ইনশিতা নিজেকে বাহিরে থেকে যতটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে ততটা নয়। তার মনে পৃথিবী তোলপাড় করে দেওয়া অশান্ত ঝড় বইছে। কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে না। এই বাড়িতে আর কেউই নেই। সে আর জেহের। জেহেরের এমন অবস্থায় সে নিজেও যদি অশান্ত হয়ে পড়ে তাহলে জেহেরকে সামলাবে কে? তাই নিজকে শান্ত রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে।
রুমের ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোগুলো নিঃশব্দে পরিষ্কার করতে লাগল ইনশিতা। মনে মনে ডিসিশন নিয়ে নিয়েছে যে, জেহের যেই রুমে থাকবে সেই রুমে কাঁচের জিনিস একদমই রাখবে না। কাঁচের জিনিস পরিষ্কার করতে কষ্ট ভীষণ। বিনে ফেলতে গিয়েই হুংকারে কেঁপে উঠে ইনশিতা। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। মৃদু আওয়াজে জেহেরকে ডেকে ওঠে। তবে জেহের সাড়া দেয় না। সে মাথা চেপে ধরে বারবার এপাশ ওপাশ হাঁটছে আর কিছুক্ষণ পর পর হুংকার ছাড়ছে। ইনশিতা কাছে এলেই সে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় কিংবা গলা চেপে ধরে। তাই ইনশিতা কাছে যাওয়ার সাহস পায় না।
ইনশিতা যখন জেহেরের অবাধ্য হয় তখন জেহের রুমের অবস্থা বেহাল করলেও তাকে তেমন কিছু করে না। অথচ আজ জেহেরের আচরণ দেখে ইনশিতা নিজেই হতবাক। জেহেরকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তার মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। রক্তলাল চোখ ঝিমিয়ে পড়ছে। বড় বড় শ্বাস ফেলে গর্জে উঠছে।
.
ইনশিতা তখন গোসল করে বের হলে দেখে জেহের খাটের সাথে হেলান দিয়ে নিচে বসা। পুরো ফ্লোরময় কাঁচে ছড়াছড়ি। একদৃষ্টিতে জেহের তাকিয়ে ছিল ইনশিতার দিকে। যেন সে এই লাল চোখ দ্বারাই গিলে খাবে ইনশিতাকে। ইনশিতা জানে না তার কপালে কী আছে। তবুও ভাবল আজকে যেভাবে হোক জেহেরকে সামলে নিবে। তাই জেহেরের কাছে এগিয়ে এলো। তার চলার সাথেও জেহেরের নজর তার দিকেই নিবদ্ধ ছিল। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। সাদা শার্টের উপরের সব বোতাম খোলা, তার মধ্য থেকে লোমহীন ফর্সা বুক উঁকি দিচ্ছে। ইনশিতা জেহেরের হাত থেকে কাঁচের ভাঙা গ্লাসটা সরিয়ে নিতে চাইলে আচমকা ইনশিতার হাত টেনে নিয়ে বড় একটা পোঁচ মেরে দেয়। ইনশিতা চিৎকার দিয়ে উঠলে জেহের পৈশাচিক আনন্দ পায়। যেন এই কাজটি সবচেয়ে মজার কাজের একটা। ইনশিতা উঠতে নিলে হাত চেপে নিজের কোলে বসিয়ে দেয়। ইনশিতা তখন চোখের জল ফেলতে ব্যস্ত। জেহের নিজের তর্জনী দিয়ে ইনশিতার গাল আলতো স্পর্শ করতে থাকে। হুট করে গাল চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
-“আমার কথার নড়চড় যে করে তাকে আমি দুনিয়াতে শান্তিতে থাকতে দেই না। আর সেখানে তুমি আমার স্ত্রী হয়ে আমাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে যাও! গুড!”
বলে ক্লান্ত চোখে বাঁকা ঠোঁটে হাসল জেহের। এরপর গম্ভীর স্বরে বলল,
-“কারো বুকের পাটা নেই যে এই জেহেরকে বেঁধে তাকে ফাঁকি দিবে। আর এই যে, এই বুকে প্রচুর সাহস।”
জেহের ইনশিতার গলার নিচে নজর দিলো। ইনশিতা দ্রুত ওড়না নিচে টেনে নামাল। জেহের ইনশিতার গাল ছেড়ে দুই বাহু আলতো চেপে ধরল।
-“জেহেরের ওয়াইফ হিসেবে ইউ আর দ্যা পারফেক্ট লেডি। আমাকে বশ করার, আমাকে বেঁধে রাখার, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার সব গুণ আছে তোমার মধ্যে। তাও আমি তোমাকে কিছু করতে পারি না। কেন জানো? কজ আই লাভ ইউ। আমার ভালোবাসাকে কষ্ট দিলে তো আমি নিজেই কষ্ট পাবো। কিন্তু তুমি যখন আমাকে কষ্ট দাও তুমি কি নিজে তখন কষ্ট পাও রোজ? পাও না। এই যে আমাকে সারাটাদিন বেঁধে রেখে নিজে ঠিকই বেরিয়ে এসেছো। ফুর্তি করে এসেছো।”
কথাটা বলেই হঠাৎ চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার। চোখমুখ শক্ত করে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইনশিতাকে জোরে চেপে ধরে বলল,
-“ওয়েট এ মিনিট! ফুর্তি করে এসেছো? কার সাথে? সেই বাস্টার্ড কে?”
এক মিনিট চুপ থেকে কড়া স্বরে বলল,
-“রাফিদ তাই না? তোমার প্রাক্তন আশিক রাফিদ হু? ওকে দুনিয়া থেকে সরাবার ব্যবস্থা করছি ওয়েট।”
বলে ইনশিতাকে সরিয়ে নিজে উঠে দাঁড়াল। টলমল করছে তার পা। যেন এক্ষুনি পরে যাবে। ইনশিতা নিজের ব্যাথা ভুলে দ্রুত জেহেরকে ধরল। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
-“আমি কারো সাথে ফুর্তি করে আসিনি জেহের। আ-আমি শুধু বাড়িতেই গিয়েছি। বি-বিশ্বাস করুন। আমাকে ক্ষমা করুন জেহের। আমি আপনাকে আর কোনোদিন ফাঁকি দিবো না, আপনার সব কথা শুনব। এখন আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন জেহের।”
জেহের কঠিন দৃষ্টিপাত করল ইনশিতার দিকে। ইনশিতা কিছুটা নিভল। হাত ছেড়ে দিলো জেহেরের। জেহের গর্জে উঠে বলল,
-“সবসময়ই তো এই একই কথা বলো। ‘আপনার সব কথা শুনবো জেহের’ অথচ কোনদিন শুনেছ আমার কথা? নিজ ইচ্ছা মতোই তো ঘুরে বেড়াও। আজ আবার নিজের হাজব্যান্ডকে বেঁধে আশিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছ। আর যাতে সেই আশিকের কাছে যেতে না পারো সেই ব্যবস্থা করব। তোমাকে কিছু করব না। বাট তোমার আশিককে কী করি জানি না। ছাড়ব না আমি।”
টলতে টলতে জেহের রুমের বাইরে বের হলো। ইনশিতা শব্দ করে খাটে বসে পড়ল। মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। সে তো সবসময়ই জেহেরের কথা মানে। আজ মাত্র অবাধ্য হয়েছে। আজকের সেই নোংরা ঘটনাটা সে ইচ্ছে করেই চেপে গেছে জেহেরের কাছে। জেহের জানলে নিজের আপন ভাই বোনকে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবে না। আর যেখানে রাফিদের কারণে সে বেঁচে গেছে সেখানে রাফিদকেই জেহের মারতে যাচ্ছে! ইনশিতা দ্রুত উঠে দাঁড়াল। নাহ, সে কখনোই এমনটা হতে দিবে না। জেহেরকে থামাতে হবে। দৌড়ে রুমের বাহিরে আসতেই দেখল জেহের রান্নাঘর থেকে ছুরি হাতে দরজার দিকে যাচ্ছে।
জেহেরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে থামায় ইনশিতা। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে,
-“আপনি রাফিদকে কিচ্ছু করবেন না জেহের। আপনি যদি এমন কিছু করে থাকেন তা-তাহলে আমি আপনার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেব।”
জেহের কানে নিলো না সেই কথা। দরজা খুলে হাঁটতে লাগল গেটের দিকে। ইনশিতা চিৎকার করে জেহেরকে থামতে বলল কিন্তু থামার নাম নেই জেহেরের। আচমকা জেহের ছুরি ফেলে মাথা চেপে ধরল। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে। ইনশিতা জেহেরের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলতে লাগল,
-“জেহের, প্লিজ ঘরে চলুন। জে…”
জেহের ইনশিতার হাত জড়িয়ে ধরে নিজের মাথায় রাখল হঠাৎ। আর্তনাদের মতো করে বলল,
-“আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা করছে রোজ। খুব ব্যাথা করছে। একটু ম্যাসাজ করে দাও তো। মাথাটা-মাথাটা মনে হচ্ছে কেটে ফেলে দেই একদম। অসহ্য!”
ইনশিতা কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে রইল। হঠাৎ কী হলো জেহেরের? এমন করছে কেন?
-“কী হয়েছে আপনার?”
জেহের করুণ চোখে তাকাল। ইনশিতার বুকটা ধ্বক করে উঠল।
-“সহ্য করতে পারছি না রোজ। মাথায়…উফ!”
জেহের মাথা শক্ত করে চেপে ধরল। ইনশিতা তাড়াতাড়ি জেহেরকে উঠিয়ে ঘরে নিয়ে আসতে লাগল। ইনশিতা ভাবল জেহের আজ সারাদিনে কিছু খায়নি, আর জেহের না খেয়ে থাকতে পারে না। তাই হয়ত যন্ত্রণা করছে। সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
-“আপনি বসুন। আমি এক্ষুণি আপনার জন্য কিছু বানিয়ে আনছি।”
ইনশিতা চলে যেতে নিলে জেহের হাত ধরে আটকায়। ক্ষীণ কন্ঠে বলে,
-“কোথাও যেও না। আমার কাছে বসে একটু ম্যাসাজ করে দাও রোজ। প্লিজ।”
ইনশিতার কষ্ট হতে লাগল। আজ তার জন্যই সবটা হয়েছে। জেহেরের সামনে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“একটু অপেক্ষা করুন। আমি আপনার জন্য এক্ষুনি খাবার আনছি।”
হাত ছাড়িয়ে ইনশিতা রান্নাঘরে চলে গেল। চিন্তায় পড়ে গেল কী বানাবে সে? জেহের লাঞ্চ কিংবা ডিনারে অর্ডারকৃত খাবার খায়। অফিসে গেলে সেখানে লাঞ্চ করে সেখান থেকেই নিজের ডিনার নিয়ে এনে ফ্রিজে রাখে। কেমন সেদ্ধ, আধসেদ্ধ খাবার সেসব। ইনশিতা সেসব বানাতে পারে না। এখন কী করবে? ভাবতে ভাবতে এক গ্লাস গরম দুধ বানিয়ে আনল।
জেহেরের সামনে গ্লাস এগিয়ে দিতে জেহের হুট করে গ্লাসটা ছুঁড়ে মারল। ফর্সা হওয়ায় পুরো মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আর চোখ দুটোও অসম্ভব লাল। জেহেরের হঠাৎ এমন আচরণের কারণ খুঁজে পেল না সে। একটু আগেই না অন্যরকম ছিল, তাহলে এখন? জেহেরের মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগে,
-“কী হয়েছে জেহের? দুধটা ফেলে দিলেন কেন?”
জেহের গরগর শব্দ করছে। ভয়ানক লাগছে ইনশিতার কাছে। জেহের ইনশিতাকে ধাক্কা দিয়ে হঠাৎ ফেলে দিলো। ব্যাথা না পেলেও অবাক হলো ইনশিতা। জেহের মাথা চেপে ধরে আর্তনাদ করতে লাগল। ইনশিতার কাছে জেহেরের আজকের আচরণটা খুবই অস্বাভাবিক ঠেকল। জেহের কখনো তার উপর রেগে গেলে অন্তত এমনটা করে না। তাহলে আজকেই হঠাৎ এত অস্বাভাবিক লাগছে কেন জেহেরকে? জেহের তখন একবার রুমে, ব্যালকনিতে মাথা চেপে গর্জন করতে শুরু করল। চোখমুখ দেখে বুঝতে পারছে ইনশিতা যে জেহেরের খুব কষ্ট হচ্ছে।
ইনশিতা নিজেকে শান্ত রাখলো। আজকে তার উপর যেই ধকল গেছে তাতে তার সারাদিন বিশ্রাম নেওয়ার কথা। অথচ হচ্ছে তার ঠিক উল্টো।
.
.
হঠাৎ ডোরবেলের আওয়াজে ইনশিতা ব্যালকনি থেকে চোখ ফেরাল। সে কী ভুল শুনছে? না, ঐ তো আবার ডোরবেল বাজছে। জেহেরের সেই ধ্যান নেই। সে তখন বিড়বিড় করে মাথা চেপে আছে। যেন মনে হচ্ছে সে যদি পারত তাহলে সিওর মাথা কেটে ফেলত। ইনশিতা মেইন দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। এই বাড়িতে সে আর জেহের ছাড়া আর কেউই কখনো আসে না। আর এত রাতেই বা কে ডোরবেল বাজাবে? এই বাড়ির ঠিকানা কার জানা আছে?
ইতস্তত করতে করতে সে দরজা খুলেই ফেলল। দেখল জেহেরের একজন গার্ড একটা প্যাকেট হাত দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে গার্ড মাথা নিচু করে মিনমিন স্বরে বলে,
-“স্যারের জন্যে খাবার এনেছি ম্যাডাম। আসলে ম্যাডাম, আমাদের স্যার সবসময় যেই খাবার খায় সেটা শহরেই পাওয়া যায় আর স্যার দুপুরে না খেয়ে থাকতে পারে না। আজকে স্যার অফিসে আসেনি তাই স্যারের খাবার নিয়ে এসেছি। স্যার তো এই খাবার ছাড়া অন্য কিছু খেতে পারে না।”
ইনশিতা মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলো গার্ডকে। এই মুহুর্তে যেন এটারই প্রয়োজন ছিল। ইনশিতা ধন্যবাদ জানিয়ে খাবার নিলো। গার্ড চলে যেতে নিলে সে আবার জিজ্ঞেস করে,
-“আপনি এ বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলেন? যতদুর জানি এই বাড়ির খবর কেউই জানে না।”
গার্ড আগের ন্যায়ই মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
-“স্যারের এ বাড়ির খবর ওনাদের ঘরের কেউ জানে না কিন্তু আমরা স্যারের গার্ডরা জানি। কারণ অনেক সময় স্যার এই বাড়িতে আসলে আমাদের আগে থেকেই সব গুছিয়ে রাখতে হয়।”
গার্ড চলে গেলে ইনশিতা দরজা আটকে খাবার রেডি করে নেয়। ভয়ে ভয়ে জেহেরের কাছে এগিয়ে হাতটা ধরে। জেহের ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকালে ইনশিতা একবার বুকে থুথু দিয়ে নেয়। নরম কন্ঠে বলে,
-“এক্ষুনি আপনার মাথা ব্যাথা ঠিক হয়ে যাবে। চলুন আমার সাথে।”
জেহের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে আগের চেয়েও ভয়ানক ক্লান্ত লাগছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার। ইনশিতা হাত ধরে আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে টেবিলে বসায় জেহেরকে। আর জেহেরও যেন রোবটের মতো ইনশিতার পিছু পিছু আসে। তার চেহারা অনুভূতিশূন্য। ইনশিতা জেহেরকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। জেহের নিজেও কোনো কথা না বলে খেয়ে নেয়। অথচ চোখের দৃষ্টি পুরো ইনশিতার দিকে আবদ্ধ। যেন কত জনম দেখে না তার রোজকে।
জেহেরকে খাইয়ে দিয়ে ইনশিতা শুইয়ে দেয়। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে জেহেরের মাথা ব্যাথাও যেন চলে গেছে। চুপচাপ শুইয়ে দিলে জেহের নিজের দু’হাত ইনশিতার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ইনশিতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলতো হেসে জেহেরের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। যত কিছুই হোক, জেহের ইনশিতাকে বুকে না নিয়ে ঘুমোতেই পারে না। জেহের খুব দ্রুত ঘুমালেও ইনশিতার চোখে ঘুম নেই। একটু মাথা তুলে জেহেরের মুখপানে তাকায় সে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে এই একদিনেই। মুখটাও কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। আজকের জেহেরের এই অদ্ভুত আচরণের কথা ইনশিতাকে ভাবাতে থাকে।
.
.
সকালে আজ কেউই জগিংয়ে যায়নি। জেহের একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছে। তবে ঘুম থেকে ওঠার পর ইনশিতার সাথে একটা কথাও না বলে বেরিয়ে গেল অফিসের জন্য। আজকের ব্যবহারে ইনশিতা দ্বিতীয় দফা অবাক হলো। খাওয়ার সময়ও জেহের চুপচাপ নিজে খেয়ে ইনশিতাকে খাইয়ে দিয়ে চলে গেছে। ভাবটা এমন যেন গতকালের কথা কিছুই মনে নেই জেহেরের।
তবে ইনশিতা বেশিক্ষণ জেহেরের কথা ভাবতে পারল না। গতকাল সন্ধ্যের ঘটনাটা মাথাচাড়া উঠেছে তার। একা বাড়িতে যেন ভয়টা আরও বেশি করে ঝেঁকে ধরেছে। জিহাদের নোংরা কাজটির কথা ভাবলেই আতঙ্কে পুরো শরীরে কাঁটা দেয়। নিজেকে ঐ সময় ঠিক কতটা অসহায় লেগেছে সেটা একমাত্র যে ঐ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে সে-ই বলতে পারবে। নয়নিকার কথাটা ভাবলেই ইনশিতার চোখে অশ্রু এসে ভীড় করে। এমন ব্যবহার নয়নিকার থেকে সে কখনোই আশা করেনি। যার সাথে নিজেকে বেশি সেইফ ভাবে সে-ই গতকাল খুব খারাপ কাজে তাকে ঠেলে দিয়েছে। জিহাদ যখন ইনশিতাকে নিয়ে রুমে এসেছিল তখন নয়নিকার মুখে সে বিভৎস হাসি দেখতে পায়, যা তীরের মতো বুকে বিঁধে ইনশিতার। ইনশিতার ইচ্ছে করছে জেহেরকে কালকের ঘটনা সব বলে দিতে। তবুও কেন জানি বলতে পারছে না।
গতকালের ঘটনাটা ভেবে ভেবে ইনশিতা ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছে মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে। মা যদি মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতো তাহলে সে গতকালের ঘটনা নিমিষে ভুলে যেত। ইনশিতার ভাবনার মাঝে ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। ইনশিতা চকিতে খাট থেকে নেমে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। ফোনটা সাইলেন্ট করতে ভুলে গিয়েছিল সে। ভাগ্যিস জেহের নেই। নাহলে ফোনটা দেখলেই তুলকালাম কান্ড ঘটাতো আবার।
ফোন নিয়ে দেখল রাফিদ ফোন করেছে। বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল ইনশিতা। ফোন রিসিভ করে নেয় সে।
-“কেমন আছো ভাইয়া?”
ঐ পাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসে না। কিছু মুহুর্ত নিরবে কেটে গেলেই রাফিদের কন্ঠ ভেসে আসে,
-“হু! ভালো আছি। তুমি?”
ইনশিতা একটু হেসে বলে,
-“আমিও।”
-“মিথ্যে বলছো কেন ইতু? গতকালের ঘটনার পর তুমি কতটা ভালো আছো সেটা কী এখন মিথ্যে বলে বোঝাতে হবে আমায়?”
ইনশিতা চুপ থাকে। রাফিদই একমাত্র তার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। ইনশিতা কখন ভালো থাকে আর কখন মন খারাপ থাকে সব রাফিদ বুঝে যায়। কীভাবে যে বুঝে যায়? তার মতো কেন নয় জেহের? কেন সে ইনশিতার মনের অবস্থা বুঝতে পারে না। দুপাশের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে যায় ইনশিতার কন্ঠে,
-“আমি জানি না রাফিদ ভাইয়া। কেন আমার সাথেই এমন হয় সবসময়! আমি তো কারো কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে? তাহলে কেন কালকে এমন বাজে ঘটনা ঘটল আমার সাথে?”
ইনশিতা আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল। রাফিদ বুঝতে পারল এখন এই টপিকে যাওয়াটা ঠিক হবে না। টপিক পাল্টায় রাফিদ। বিভিন্ন কথার মাঝে ইনশিতাকে হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করল সে। যাতে কোনোভাবেই গতকালের কথা ইনশিতার মনে না পড়ে। এখন যদি ইনশিতা কাছে থাকত, তাহলে সে জড়িয়ে ধরে ইনশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে সব কষ্ট ভুলিয়ে দিত। দীর্ঘশ্বাস চেপে ইনশিতাকে খুশি রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাফিদ। ইনশিতার খুশি মানেই তার কাছে সব।
আজ পুরোটা দিন কাটল রাফিদের কথা বলে। সকাল থেকে বিকেল অবধি একটু পর পর কথা ফোন করেছে রাফিদ। হাসি ঠাট্টায় কাটলো পুরোটা দিন। এক মুহুর্তের জন্য সে ভুলে গেল গতকালের ভয়াবহ ঘটনা।
-“গান শুনবে ইতু?”
-“শোনা যায়।”
-“কী গান।”
-“তোমার যেটা ইচ্ছা।”
-“আচ্ছা, ওয়েট।”
রাফিদ গিটার নিয়ে ফোনটা কাছে রেখেই গাইতে শুরু করে। রাফিদের কন্ঠে গান শুনতে এত ভালো লাগে যে ইনশিতার মনে হয় রাফিদকে সামনে বসিয়ে সবসময় খালি গানই শুনতে। রাফিদ ইনশিতাকে উদ্দেশ্যে করেই গান গায়। সে তো সব গানই ইনশিতাকে উদ্দেশ্য করে গায়। ইনশিতা কী বুঝে তা?
Juda hum ho gaye mana
Magar yein jaan lo janaa(2)
Kabhi mein, yaad aaun to
Chale aana, chale aana
Tumhe mein vul jaunga
Yein baate dil mein na lana
Kabhi mein, yaad aaun to
Chale aana, chale aana…
Tha kon mera ek tu hi tha
Sason se jeyada zo jaruri thaa
Tere liye main kuch nehi lekinn
Mere liye tu mera sab kuch thaa…
Nehi jaana vula karke
Yein batein tum he kehte the
Nehi khushiyan nehi meri
Ki tum bhi waqt jaise the
Tumhara tha rahega abhi
Kare kya dil hain dewanaa
Kabhi main yaad aaun to
Chale aana, chale aana…
.#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৮ [এক্সট্রা]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
জেহের আসলো সন্ধ্যায়। তবে ঘরে না। বাগানের সামনের ছোট মাঠের বেতের সোফায় গিয়ে সোজা বসে পড়ল। ফর্মাল ড্রেসেই। বাগানে আওয়াজ পেয়ে ইনশিতা ড্রয়িংরুমের বারান্দায় গেল দেখার জন্য। দেখল জেহের চিন্তিত চেহারায় বাগানের সোফায় বসে আছে। হাঁটুর উপর ল্যাপটপ। ইনশিতা অবাক হলো জেহেরকে এভাবে দেখে। ঘরে না এসে হঠাৎ বাগানেই বা কেন গেল?
জেহের ইনশিতাকে লক্ষ্য করলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইনশিতাকে পর্যবেক্ষণ করে এক আঙ্গুল উঁচিয়ে ইশারা করলো ভেতরে যাওয়ার। ভ্রু কুঁচকালো ইনশিতা। তখন দেখল দু’জন গার্ড এগিয়ে যাচ্ছে জেহেরের দিকে। গার্ডদের আসতে দেখে জেহের চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ইনশিতা হনহন করে রুমে চলে গেল।
মনটা তার অভিমানে ভারী হয়ে গেল। আজ সকাল থেকে জেহের একটাও কথা বলেনি তার সাথে। এখন এসেছে তাও ধমকে ভেতরে যেতে বলছে! কোথায় একটু এসে আদর করে কথা বলবে তা না। হঠাৎ তার মাথায় আসলো, আজকে সে জেহেরের কনসার্ন পাওয়ার জন্য এত উদগ্রীব হচ্ছে কেন? আগে তো জেহের আসলে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করত। আর এখন তার মনটা চাইছে ছুটে গিয়ে জেহেরের বুকে পড়তে। অভিমানী হয়ে বলতে,‘আজ আপনি একবারও কেন কথা বলেননি জেহের? আপনার রোজ বুঝি কষ্ট পায় না?’এতদিন যার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছে আজ তার কাছে যাওয়ার জন্যই উৎসুক হয়ে আছে তার বেহায়া মন। যাকে অগোচরে পাগল বলত আজ তারই প্রেমে সে পাগল হয়েছে। ভালোবেসে ফেলেছে সে। ভাবতেই ইনশিতা দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ঝলমল করে উঠল। এত লজ্জা লাগছে কেন তার!
উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আয়নাতে নিজেকে দেখতেই পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা যেন তাকে ঘিরে ধরল। গালটা লালচে আভায় ছেয়ে গেছে। অন্যরকম এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য এসে ভর করেছে তার চেহারায়। ইনশিতা আলতো হেসে নিজের মাথায় চাপড় মারলো।
ক্যাবিনেট খুলে জেহেরের কালো শার্ট একটা নিলো। জেহেরের অর্ধেক শার্টই সাদা কালো। কারণ জেহেরের পছন্দের রঙ সাদা কালো। তাইতো রুমের বেশিরভাগ আসবাবপত্র সাদা কালো। শার্টটাকে গায়ে জড়িয়ে ধরে মনে হলো যেন জেহেরকেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সে। কলারে ঘ্রাণ নিলো। জেহেরের শরীরে আলাদা একরকমের গন্ধ আছে। যেটা সে সবসময় ঘুমাতে গেলে জেহেরের শরীর থেকে পায়। সেই একই ঘ্রাণ এখন শার্টে মেখে আছে। প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিলো ইনশিতা। যেন এই ঘ্রাণ নিয়েই সে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগে নিজেকে। কালো স্কার্টের উপর কালো শার্ট। উহুম, খারাপ লাগছে না তো। জেহেরের ব্ল্যাক রোজের মতোই লাগছে এখন। ভাবতেই একা একাই হাসতে লাগল সে। হাসতে হাসতেই হঠাৎ পেছনে ফিরে থমকে গেল।
পেছন ফিরতেই দেখে জেহের দরজায় ঠেস দিয়ে পকেটে হাত রেখে মিটমিট করে হাসছে। জেহেরকে এই মুহুর্তে আশা করেনি সে। সে তো মাত্রই না উঠোনে ছিলো। এখন হঠাৎ এখানে! জেহেরের হাসি দেখে ইনশিতা চাইছে এক্ষুনি মাটি ফাঁক হয়ে যাক, আর সে মুখ লুকোয় সেখানে। লজ্জায় কান দিয়ে গরম ধোঁয়া উঠতে লাগল। মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে রইল। এতটা লজ্জা আগে সে কখনোই পায়নি।
জেহের মাত্রই এসেছিল ড্রেস চেঞ্জ করতে। রুমে ঢুকতেই দেখল তার রোজ তারই শার্ট পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। গাল দুটো রক্তিম হয়ে আছে। এই প্রথম রোজকে এতটা লজ্জা পেতে দেখল সে। তার কাছে দৃশ্যটা বড্ড মিষ্টি লাগলো। তাই সেখানেই দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল তার মিষ্টি রোজকে।
জেহের পকেটে হাত রেখেই ধীর পায়ে কাছে আসলো ইনশিতার। লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না ইনশিতা। জেহের নিজেই দুই আঙুল দিয়ে চিবুক উঁচু করল ইনশিতার। চোখ বন্ধ করে আছে ইনশিতা। জেহের মৃদু হাসলো। ইনশিতা চোখ বন্ধ রেখেই তড়িঘড়ি করে শার্ট খুলতে শুরু করল। বাঁধ সাধলো জেহের। কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“ভালোই তো লাগছে আমার বউটাকে। লাল লাল গাল, উমম, স্ট্রবেরি। ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলি একদম। অনুমতি আছে কি?”
ইনশিতা লজ্জায় কী করবে বুঝতে পারছে না। বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। জেহেরকে সরিয়ে চলে যেতে নিলে জেহের হাত ধরে টেনে কোমড় জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পলকবিহীন তাকিয়ে থাকে রোজের লালিমাপূর্ণ চেহারায়। রোজের গালে নিজের উষ্ণ স্পর্শ ছড়িয়ে দিতে থাকে জেহের। আচমকাই রোজের কম্পিত কোমল ওষ্ঠাধর নিজের অধরের ভাঁজে নিয়ে নেয়। অদ্ভুত অনুভূতিতে কেঁপে ওঠে ইনশিতা। ছাড়ানোর প্রয়াস চালায় না আর।
জেহের ইনশিতার হাত ধরতেই ব্যথায় ককিয়ে উঠে ইনশিতা। উষ্ণ স্পর্শ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে হাত চেপে ধরে। কপালের মধভাগ কুঞ্চিত হয় জেহেরের। রোজের হাতের দিকে খেয়াল করতেই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। হাতের ক্ষতটা এখনো তাজা। জেহেরের এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। সে কীভাবে কষ্ট দিতে পারল রোজকে? কালকে মাথাটাই পুরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। যার ফল ভোগ করতে হলো রোজকে।
ইনশিতাকে খাটে বসিয়ে জেহের দ্রুত এইড বক্স নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছে। ইনশিতা অবাক নয়নে দেখছে জেহেরকে। ক্ষত স্থানে মলম ছোঁয়ানোর সময় জেহের চোখ মুখ কুঁচকে রাখে, যেন ব্যাথাটা ইনশিতা না, জেহের পেয়েছে। আগোচরে হাসলো ইনশিতা। জেহের বারবার নিজে নিজে বিড়বিড় করছে যা কিছুটা হলেও ইনশিতা শুনতে পেয়েছে,
-“স্যরি, স্যরি, স্যরি। আ’ম রিয়েলি ভেরী স্যরি। স্যরি রোজ, ক্ষমা করো আমাকে, স্যরি…”
ব্যান্ডেজ করার পর জেহের এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল হাতের দিকে। হাত দুটো নিজের কাছে নিয়ে অধরের স্পর্শ দিতে থাকে দুহাতে। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় ইনশিতার হাত। ইনশিতার ভালো লাগলেও পরক্ষণে সে বিরক্ত হয়ে যায়। কেননা হাত সহ ব্যান্ডেজটাও ভিজে যাচ্ছে। হাত সরিয়ে নিতে চাইলে জেহের জোর করে ধরে রাখে। ইনশিতা বিরক্তি নিয়ে বলে,
-“ছাড়ুন না। জেহের!”
জেহের নিজের কাজেই ব্যস্ত। এভাবে প্রায় অনেক সময় কেটে গেলেও জেহেরের থামার লক্ষণ নেই। ইনশিতা এক প্রকার জোর করেই হাত ছাড়িয়ে নেয়। জেহের অসহায় চাহনিতে তাকায় ইনশিতার দিকে। ইনশিতা কন্ঠে রাগ ঝরিয়ে বলে,
-“কী হলো ব্যান্ডেজ লাগিয়ে? সেই তো ভিজেই গেল। এরচেয়ে ভালো ছিল খালি হাতেই থাকা।”
জেহেরের কানে ইনশিতার কথা ঢুকল না। তার চোখে অন্যরকম দৃষ্টি খেলা করছে। আবারও ইনশিতার হাত ধরতে নিলে ইনশিতা দাঁড়িয়ে পড়ে। জেহেরের সামনে এই মুহুর্তে থাকা মানেই বিপদ। একবার ঘোর লেগে গেলে সেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসা দুঃসাধ্য তার জন্য। ইনশিতা নিজেই আরেক হাতের সাহায্যে ব্যান্ডেজ খুলে পরিষ্কার করে নিলো। পুরো হাত ভিজে গেছে। ছিঃ! ইনশিতা জেহেরের হাত ধরে নিয়ে বাথরুমে জোর করে ঢুকিয়ে দিলো। একটা শার্ট আর ট্রাউজার হাতে ধরিয়ে বলল,
-“যেই কাজের জন্য এসেছেন সেটা করুন।”
বলে নিজেই বাথরুমের দরজা আটকে দিলো। জেহের চেঞ্জ করে বেরিয়ে ইনশিতার দিকে বারবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। ইনশিতা খেয়াল করেও কিছু বলল না। খাবার সাজাতে লাগল। খাবার খেতে এসেও জেহের আড়চোখে ইনশিতাকে দেখছে। ইনশিতা এবার ভাব নিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে বলল,
-“আই নো হাউ বিউটিফুল আই অ্যাম। সব ছেলেই আমার জন্য পাগল। তবে আমি পাগল শুধু আপনার জন্য। এভাবে লুকিয়ে না দেখে সরাসরি দেখলেই পারেন। আমি তো সবটাই আপনার। জেহেরের রোজ।”
বিস্ময়ে জেহেরের মুখ থেকে খাবার পড়তে গিয়েও পড়ল না। সে তো এমনটাই হেলিকপ্টারে বলেছিল। তারই কথা তাকেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে! রাগে ফুঁসে উঠল জেহের। তবে রাগটাকে চেপে মিষ্টি হেসে বলল,
-“একটা কথা ভুল বললে মাই লাভ। ইউ আর নট অনলি বিউটিফুল বাট অলসো ব্লাডিফুল।”
ইনশিতা মুহুর্তেই চুপসে গেল। অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে গেল তার। সে যতবারই জেহেরকে কথার জালে হেনস্থা করতে চায় ততবারই সে নিজে হেনস্থা হয়ে ফিরে। সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে থমথমে মুখে চুপচাপ খেয়ে নেয়।
ইনশিতা যখন বেডশিট ঝাড়ছিল তখন জেহের এসে হুট করে কোলে তুলে ব্যালকনির চেয়ারে নিয়ে বসায়। ইনশিতা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল শুধু। জেহেরের থেকে মুখ ফিরিয়ে বাহিরে তাকাল। তার শীত করছে রীতিমত। শীতটা বেশ ভালোই জেঁকে ধরেছে আজকাল। জেহের নিজের সাথে ইনশিতাকে মিশিয়ে নিয়ে ইনশিতার মাথা নিজের বুকে ঠেকায়। ইনশিতার রাগ এখনো পড়েনি। সে জোর করে মাথা তুলে নেয়। জেহের কিছু বলে না, শুধু নিবিড়ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। ইনশিতা একবার তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাল জেহেরের দিকে। দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছে। প্রায় বেশ সময় বাদে জেহের নিরবতার জাল কেটে বলে,
-“রোজ, তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার।”
ইনশিতা কিছু বলল না। তার মনে হচ্ছে জেহের তার সাথে কথা জমানোর জন্য এমনটা করছে। তাই সে মুখ ফিরিয়ে নিলো, জেহেরের সাথে কথা বলবেই না আজ সে, এত বড় অপমান করল কীভাবে তখন!
-“আশা করি তুমি সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিবে। কিছু লুকোবে না আমার কাছে।”
ইনশিতা এবার ফিরে তাকাল জেহেরের দিকে। তার মুখটা দেখে মনে হচ্ছে সে খুবই সিরিয়াস। ইনশিতা নড়েচড়ে বসল। আপাতত জেহেরের কথা না শুনে তাকে রাগাতে চায় না সে। তাই ক্ষীণ কন্ঠে একটি শব্দে জবাব দিলো।
-“হুম।”
জেহের ভণিতা ছাড়াই সরাসরি কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ইনশিতার দিকে,
-“কাল কী হয়েছিল তোমার সাথে? এখান থেকে যাওয়া অবধি আসা পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব বলো আমাকে।”
ইনশিতা চমকে তাকাল জেহেরের দিকে। হঠাৎ এমন কিছু বলবে সেটা ভাবতে পারেনি সে। গতকালকের কথা মনে করতেই শিউরে উঠল সে। শরীরে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গিয়ে কেঁপে উঠল। জেহের স্পষ্ট টের পেল ইনশিতার কাঁপুনি। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রোজকে। তার মন বলছে রোজের সাথে গতকাল খুব খারাপ কিছু হয়েছে। এমনটা না যে সে জানতে পারবে না, সে জেনেছে কিছুটা, তবে পুরোটা আগে রোজের মুখ থেকে জানা দরকার। ইনশিতা জোর করে হাসার চেষ্টা করল। কিছু বলতে নিবে তার আগেই জেহের থামিয়ে দিয়ে বলল,
-“আমি কোনো মিথ্যে শুনতে চাই না রোজ। যা বলার সত্যিই বলবে, আলাদা কোনো এক্সপ্লেনেশনের দরকার নেই।”
জেহেরের চেহারাটা যথেষ্ট গম্ভীর এবং সিরিয়াস দেখে ইনশিতা কোনো মিথ্যা বলতে পারল না। কিন্তু সে সত্যিটাও বলতে পারবে না। সে জানে সত্যিটা জানার পর জেহের ওদের মেরে ফেলতেও কুণ্ঠিত হবে না। আর সে জেহেরকে কখনোই খুনি হিসেবে চায় না। জেহের খুনি হলে তাকে মেনে নিতে পারবে না সে। চোখের দৃষ্টি নামিয়ে মিথ্যে বলার চেষ্টা করল,
-“ক-কী হবে আর? বাড়িতেই গ-গিয়েছিলাম খালি, আর কিছুই না, এ-এটাই।”
ইনশিতার কথা আটকে আসতে লাগলো। জেহেরের এমন চেহারার দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলতে পারছিল না সে। জেহের চুপ থেকে খুবই শীতল কন্ঠে বলল,
-“বারণ করেছিলাম মিথ্যে বলতে।”
ইনশিতা ভয়ে ভয়ে তাকাল জেহেরের দিকে। জেহেরের এই শীতল কন্ঠ যেন ঝড়ের পূর্বের আভাস। ঢোক গিললো ইনশিতা। জেহের নিজেই বলল,
-“গতকাল যদি তুমি শুধুই বাড়ি গিয়ে থাকো তাহলে তোমার জামা ছেঁড়া ছিল কেন? তোমার ঠোঁটও কাটা ছিলো। এই যে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তোমার অবস্থার কথা আর নাই বা বলি। এবারও কী তুমি বলবে শুধুমাত্র বাড়ি গিয়েই ফিরে এসেছিলে?”
ইনশিতা কিছু বললো না। কালকের ঘটনাটা আবার শরীরে কাঁটা দিয়ে দিচ্ছে। বড় বড় শ্বাস ফেলছে সে। জেহের দেখলো ইনশিতার শরীর ধীরে ধীরে কাঁপছে। প্যানিক হয়ে যাচ্ছে সে। জেহের ইনশিতার গালটাকে নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে নরম কন্ঠে বলল,
-“হেই গার্ল, ডোন্ট বি প্যানিক। লুক অ্যাট মি রোজ।”
ইনশিতা তাকাতে পারল না। ঘটনাটা তার কাছে স্বাভাবিক লাগেনি। জিহাদ যখন তার কাছে আসতে চেয়েছিল তখন সে কী পরিমাণ ভয়টা পেয়েছিল সেটা কাউকে বোঝানো সম্ভব না। নয়নিকার হঠাৎ পরিবর্তন আর জিহাদের এমন নোংরা আচরণ ইনশিতার মাথায় সেট হয়ে আছে। সে কিছুক্ষণের জন্য ভুলতে পারলেও এখন আর ভুলতে পারছে না। জেহেরকে দেখলেই জিহাদের কথা মনে পড়ছে তার। এমন মনে হচ্ছে যেন সে এখন জিহাদের কোলেই বসে আছে। তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে পড়লো ইনশিতা। তার কপাল বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চোখে মুখে অজস্র ভয়, যেন কালকের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
জেহের উঠে দাঁড়িয়ে ইনশিতার কাছে এগোলো ধীরে ধীরে। রোজ প্রচুর ভয় পেয়েছে। শান্তনা সুরে বলল,
-“লুক রোজ, ভয় পাবে না। তোমাকে কিছু বলতে হবে না। অ্যান্ড আই প্রমিস তোমার থেকে জোর করে কিছু জানতেও চাইব না। তুমি কাছে এসো। বললাম তো কিছু হবে না, দূরে যাচ্ছ কেন? কাম হেয়ার।”
ইনশিতা পেছাচ্ছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। জেহের এগিয়ে ইনশিতার বাহু ধরল আলতো করে। নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিতে চাইলে ইনশিতা ছাড়াতে চায়। জেহের আজ আর ধমক দেয় না। শুধু নরম কন্ঠে শান্ত করার চেষ্টা করছে সে।
সে গতকালকের ঘটনার কিছুটা জানতে পেরেছে রাফিদের কাছ থেকে। আজ অফিস গেলে শুনে রাফিদ এসেছে তার সাথে দেখা করার জন্য। জেহের পাত্তা না দিয়েই নিজের কাজে মন দেয়। রাফিদ তার দুচোখের বিষ। তবুও এখন আর তার সাথে কোনো ঝামেলা করতে চায় না। রিসেপশনিস্ট কল করলে সে বলে দেয় রাফিদকে যাতে ধাক্কা মেরে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়। তার কিছুক্ষণ বাদে আননোন নাম্বার থেকে কল আসলে রিসিভ করে দেখে রাফিদ। সে কেটে দিতে নিলে রাফিদ খালি বলে,
-‘কেটে যখন দিবেন তার আগে একটা কথা শুনে রাখুন মিঃ জেহের। নিজের ঘরেই কিন্তু আপনি দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষছেন। সময় গড়ানোর আগেই তাড়িয়ে দিন তাদের। নাহলে গতকাল যেভাবে আপনার স্ত্রীকে সেই কালসাপ গুলো ছোবল মারতে যাচ্ছিল সেভাবে যে পরবর্তীতে মারবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আর আমিও সবসময় থাকবো না আপনার স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য। খেয়াল রাখবেন।’
এইটুকুই বলে রাফিদ কল কেটে দিয়েছিল। রাফিদের ইঙ্গিত জেহের বুঝতে পারলেও কালসাপদের চিনতে পারেনি সে। রাফিদের সাথে দেখা করতে গিয়েও যায়নি। কারণ সে চাইছিল রোজের মুখ থেকেই সবটা শুনবে। এখন রোজের থেকেও কিচ্ছু জানতে পারেনি। তবে খুব খারাপ কিছু যে ঘটেছিল তা আন্দাজ করতে পারছে সে। আর সেই কালসাপদের চিনে তাদের তিলে তিলে মারবে বলে প্রতিজ্ঞা নেয়।
ইনশিতাকে কোলে করে জেহের বিছানায় শুইয়ে দেয়। ইনশিতা জেহেরের বুকে মাথা দিয়ে কাঁদছে। জেহের এক হাতে আলতো জড়িয়ে ইনশিতার চুলে পরম আদরে বিলি কেটে দেয়। একসময় ইনশিতা ঘুমিয়ে পড়লে জেহের ঠিকমতো শুইয়ে দিয়ে উঠে পড়ে। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। যারা তার রোজকে কাঁদিয়েছে তাদের অবস্থা এমন করবে যে সারাজীবন আক্ষেপ করতে করতেই একসময় মরেই যাবে। জ্যাকেট জড়িয়ে মোবাইল আর ল্যাপটপ নিয়ে বাগানের মাঠে চলে যায়। রাত বাড়লেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার।
.
.
খট করে কিছু শব্দের আওয়াজে ইনশিতা জেগে যায়। শোয়া থেকে উঠে বসে। তবে ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। ঘুমু ঘুমু চোখ নিয়েই উঠে পড়ে। আওয়াজকে অনুসরণ করে দেখে বাগানে জেহের আর তিন চারজন গার্ড কথা বলছে। জেহেরকে দেখে মনে হচ্ছে সে প্রচন্ড রেগে আছে। ফর্সা মুখমন্ডল রক্তিম হয়ে আছে। চোখ দিয়ে অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে যেন। কপালের আর ঘাড়ের রগ দপদপ করে জ্বলছে। ইনশিতা বারান্দায় গেল না, জেহের দেখলে রেগে যাবে আবার। তাই সোফায় বসেই কাঁচের মধ্য দিয়েই জেহেরকে দেখতে লাগে। বাহিরে কুয়াশায় ঘেরা সব। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সাড়ে তিনটা।
এইমাত্ররই সবটা জানতে পেরেছে জেহের। গার্ডদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে, আর রাফিদের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনে রাগে তার ইচ্ছে করছে পুরো দুনিয়াটা শেষ করে দেয়। সিসি ক্যামেরায় রোজকে জিহাদ যেভাবে টাচ করে টানা হেঁচড়া করেছিল সেটা দেখে জেহেরের মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। কতটা অসহায় ছিল তখন তার রোজ! সারা শরীর কাঁপছে রাগে। এমন একটা কাজ যে তার ভাই আর বোন মিলে করবে সেটা তার কল্পনার বাইরে ছিল। এখন তার সবচেয়ে বেশি রাগ উঠছে রোজের উপর। রোজকে সে বারবার সাবধান করেছিল ঐ বিশ্বাসঘাতক মেয়েটার থেকে দূরে থাকার। এই মেয়েকে তার এমনিতেই বিরক্ত লাগে। আর রোজকে সে দেখতেই পারতো না এই মেয়েটার সাথে। রোজ যদি কালকে তাকে বেঁধে না রাখতো তাহলে এমন ঘটনা সে চাইলেই আটকাতে পারতো।
রাফিদকে এখন তার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে। যতই হোক, তার ভালোবাসাকে সে ঐ নরকীটদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। এখন জেবা জিহাদ আর নয়নিকাকে সে কখনোই ছাড়বে না। তার রোজের ভয়ের আর কান্নার কারণকে সে দুনিয়া থেকেই নিঃশেষ করে দেবে। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে জেহের। তখনই তার চোখ যায় ব্যালকনির কাঁচ ভেদ করে সোফায় শুয়ে থাকা রোজের দিকে। গার্ডদের বিদায় দিয়ে বড় বড় পা ফেলে ড্রয়িংরুমে যায় সে। গিয়ে দেখে সোফার এক কোণে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে রোজ। হাটু গেড়ে তার মাথার কাছে বসে জেহের। ঘুমন্ত চেহারার রোজকে দেখে রোজের উপর থাকা সব রাগ নিমিষেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কপালের চুল গুলো সরিয়ে গভীর মনোযোগের সহিত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রোজকে পর্যবেক্ষণ করে সে। ঘন পাপড়িযুক্ত চোখের নিচে চিকন নাক। কিশলয়তুল্য পাতলা আবরণবিশিষ্ট ঠোঁট। গোলগাল চেহারার আদুরে মুখটা জেহেরের ভেতরটায় তোলপাড় সৃষ্টি করে।
ইনশিতার মনে হচ্ছে সে হাওয়ায় ভাসছে। পিটপিট করে চোখ মেলে জেহেরকে দেখতে পায়। এক হাত বহু কষ্টে উঠিয়ে জেহেরের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলায়। জেহের তাকিয়ে মিষ্টি হাসে। ইনশিতার হাত ঢলে পড়ে আবারও সে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমায়।
.
সকালে জেহেরকে পাশে দেখতে পায় না সে। শুধু টেবিলে একটা ছোট্ট চিরকুট দেখতে পায়। যেখানে লেখা আছে, ‘গুড মর্নিং লাভ। আজ তাড়া থাকায় তোমাকে না বলেই যেতে হচ্ছে। স্যরি ইনফিনিট। তোমার ব্রেকফাস্ট রেডি করে রেখেছি। খেয়ে নিও।’ লেখার শেষে লাভ আর স্মাইলিং ইমোজি।
চিরকুটটা পড়ে ইনশিতার মন মুহুর্তেই ফুরফুরে হয়ে গেল। আরো কয়েকবার পড়ে নিলো। সতেজ মনে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখলো টেবিলের উপর সব সাজানো। ব্রেডে সস দিয়ে লাভ আঁকা। আর টেবিলের উপর বড় একটা কালো গোলাপের বুকে। ইনশিতার মাথায় তখন একটা আইডিয়া আসলো। আজকে জেহেরকে সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়?
.
.