#প্রহেলিকা
#পর্ব_০৩
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————–
ভোর হতে এখনো বেশ খানিকটা দেরি। নিঝুম রাতে দূর থেকে কোনো এক নাম না জানা পাখির ডাক থেকে থেকে কানে ভেসে আসছে। সকলে ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু ঘুমে নেই জিহাদ আর শিফা। ডিভানে বসে আছে জিহাদ। দুই হাত জোড় করে থুতনির নিচে রেখে বাহিরে তাকিয়ে আছে জিহাদ। শান্ত চোখের মণির দৃষ্টি আটকে আছে বারান্দায় রাখা গোলাপ ফুলের গাছটিতে। লাল গোলাপটিতে শিশির জমতে শুরু করেছে। আর শিফা আইস ব্যাগ মাথার পিছন চেপে ধরে আছে।
শিফা জিহাদের ফুফাতো বোন। কিছুদিন হলো এখানে এসে রয়েছে। এখানে আসার সবচেয়ে বড় কারণ হলো জেহের। জেহের অস্বাভাবিক সেটা জেনেও জেহেরের পিছন পড়ে আছে। আর সেটা একটাই কারণ – টাকা। জেহের আর জিহাদ জমজ ভাই। কয়েক মিনিটের বড় ছোট শুধু। জেহের বড় আর জিহাদ ছোট। তবুও জেহেরকে জিহাদ ভাই বলেই ডাকে। তাদের দেখে সকলেই তালগোল মিলিয়ে ফেলবে কে জেহের আর কে জিহাদ। তবে পরবর্তীতে জিহাদ আর জেহরকে পার্থক্য করতে সহজ হয়ে যায়। কারণ জিহাদ চোখে চশমা পড়ে, আর তার চোখের মণি কালো। অপরদিকে জেহের চশমা ব্যবহার করে না, আর তার চোখের মণিও কালচে নীল।
জিহাদের চোখ এমনকি চেহারাও সবসময় শান্ত, হাস্যোজ্জ্বল থাকে যার বিপরীতে জেহের গম্ভীর। আর জেহেরের শান্ত চোখ দুটো দেখলে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। তার চোখগুলোই এমন ভয় পাওয়ার মতো। জেহের কারো সাথে মিশে না, কথা একদমই বলে না, এমনকি হু হা করেও না। যেই কথাটা ভাল্লাগবে বা প্রয়োজনীয় মনে করে সেটারই উত্তর দিবে। এছাড়া অস্বাভাবিক আচরণ তো আছেই। যদিও এই তার অস্বাভাবিকতার পিছনে অনেক বড় একটা কারণ আছে। এর জন্য তাকে বিশেষ মেডিসিন দেওয়া হয়, তাও জেহেরের অজান্তে। অথচ দিনদিন তার অস্বাভাবিক আচরণ বাড়তেই থাকে। কথায় কথায় হুটহাট রেগে যায়, ভাঙচুর করে।
জেহেরের এই অস্বাভাবিকতার কারণে আফজাল এবং জেসমিন ডক্টর দেখাতে চাইলে জেহের রেগে গিয়ে বাঁধা দেয়। সে কোনো ডক্টর দেখাতে চায় না। বাহিরের কেউ তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করুক, মেডিসিন দিক এগুলো একদম অপছন্দ করে সে। শত চেষ্টার পরেও ডক্টরের কাছে নিতে পারেনি তাকে। একবার শুধু ডক্টরের কাছে নিতে পেরেছিল তাও অচেতন অবস্থায়। তখনই ডক্টর কিছু মেডিসিন দিয়েছিল। তারপর থেকে মেডিসিনগুলো জেহেরের অজান্তে তাকে খাওয়ানো হয়। আর সেই দায়িত্ব নিয়েছে জিহাদ। একমাত্র জিহাদের উপরই রাগ কম দেখায় জেহের।
দু’ভাই মিলে নিজেদের বিজনেস পরিচালনা করে। জেহের কাজের বেলায় একদম পারফেক্টলি সব কাজ করে। বিজনেসের সকল কাজ, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সকলের থেকে এগিয়ে আছে সে। এ কারণেই তাদের বিজনেস সবসময় টপে থাকে। কাজের বেলায় হেয়ালী, বাড়তি কথা একদমই পছন্দ না তার। অফিসে গিয়ে সবসময় কাজে ধ্যান দিয়ে থাকে, কাজে যদি কোনো রকমের ব্যাঘাত ঘটে তাহলেই অস্বাভাবিক আচরণ শুরু হয়ে যায় তার। সেখানেই রাগারাগি করে সকল রাগ স্টাফদের উপর ঝাড়ে। যার কারনে কাজের ব্যাঘাত ঘটে তাকে তো সে ছাড়েই না। এ কারণেই অফিসের সকলে ভয় পায় তাকে। এমনকি মিটিংয়ে গিয়ে কারো সাথে কুশল বিনিময় না করেই কাজের কথা শুরু করে দেয়। মিটিংয়ে উপস্থিত সকলেই সেই সময়ে ভয়ে কাঁপাকাঁপি শুরু করে দেয়। কারণ একটু ঊনিশ বিশ হলেই সে আর দুনিয়াতে টিকবে কিনা সেটার নিশ্চয়তা নেই। ঘরের সকলেই তাকে ভয় পায়; এমনকি তার বাবা আফজাল চৌধুরীও।
আর জিহাদ সকলের সাথেই হাসিখুশি থাকে। জিহাদের থেকে জেহেরের ব্যাংক একাউন্টে ব্যালেন্স বেশি। আর এইজন্যই শিফা জেহেরের পিছন পড়ে আছে। জিহাদকেও সে নিজের করতো কিন্তু জিহাদের একাউন্টে টাকা জেহেরের চেয়ে কম হওয়ায় সে জিহাদের পেছন লাগেনি। কিন্তু জেহেরের কাছে যেতে ভয় পায় সে। একবার তো জেহেরের হাত একটু টাচ করায় তাকে গলা চেপে ধরেছিলো। ভাগ্যিস সেদিন সকলে কাছেই ছিলো বলে বেঁচে গিয়েছিলো। এরপর থেকে সে আর জেহেরের ধারে কাছে যায়নি। অশ্লীল জামাকাপড় পরেই দূর থেকে জেহেরকে আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু জেহের তাকে দেখলেই কিছুনা কিছু ছুঁড়ে মারেই। তাকে চোখের সামনে সহ্য করতে পারে না জেহের।
আজ যখন ইনশিতাকে আটকে রেখে জেহের খাবার বানাতে গিয়েছিলো তখন জিহাদ গিয়ে ইনশিতাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করে। কারণ সে জানে তার ভাইয়ের সাথে কেউ কখনোই ভালো থাকতে পারবে না। তার ভাইয়ের যেটা একবার পছন্দ হয় সেটা নিজের করে রাখে, কাউকেই দিতে চায় না। একদম বন্দী করে রাখে জিনিসটা। আর এটা তো একটা মানুষ। একটা মানুষ কখনোই কারো বন্দিনী হয়ে থাকতে চাইবেনা নিশ্চয়ই!
ইনশিতাকে ছাড়ানোর সময় শিফাও সেখানে উপস্থিত হয়ে যায়। ইনশিতাকে অন্য ড্রেসে বের করে নিজেই ইনশিতার শাড়িটা পরে জেহেরকে ইমপ্রেস করার কথা ভাবে শিফা।
ইনশিতা বেরিয়ে যাওয়ার পর কোনোরকমে ইনশিতার শাড়িটা পরে অপেক্ষা করতে থাকে জেহেরের। আর জিহাদকে বলে বাহির থেকে দরজা আটকিয়ে যেতে। জিহাদ একবার না করলেও পরে কি ভেবে সে দরজা আটকে চলে যায়। শিফার ধারণা ইনশিতার মতো সাজলে তাকে গ্রহণ করবে জেহের। জেহের খাবার নিয়ে রুমে গিয়ে দেখে রোজ উল্টোদিকে ফিরে আছে। তবে তার খটকা লাগলো যে রোজের চুল কোমর পর্যন্ত আর এখন পিঠের অর্ধেক মাত্র! ভ্রু কুঁচকে সামনে এগিয়ে গিয়ে রোজের কাঁধে হাত রাখতে গিয়ে সরিয়ে নিলো। রাগান্বিত দৃষ্টিতে ছদ্মবেশী রোজের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে একটা শোপিস দুর থেকে ছুঁড়ে মারলো একদম মেয়েটির মাথা বরাবর।
হঠাৎ মাথায় আঘাত লাগায় শিফা চিৎকার দিয়ে পিছনে ফিরলে জেহের দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“তোমার সাহস কি করে হয় আমার রুমে ঢোকার। আর তুমি আমার রোজের শাড়ি কেন পরেছ? আর..আর আমার রোজ কোথায়? র..রোজ! কোথায় তুমি? রোজ!”
চিৎকার করে রোজকে ডাকতে লাগলো আর পুরো রুমের প্রতিটা কোণা খুঁজতে লাগলো। তারপর হুট করে শিফার দিকে ফিরলো সে। শিফা তখনও মাথায় হাত দিয়েছিলো। চোখে আগুন ঝরিয়ে জেহের বলল,
-“তুই..তুই আমার রোজকে পালাতে সাহায্য করেছিস তাই না? আমার থেকে দুরে সরিয়েছিস তুই? ইউ বাস্টার্ড।”
বলেই হাতের কাছের ছোট ফুলদানীটা ছুঁড়লো। আর একটুর জন্য সেটা চোখে লাগেনি। কারণ জিহাদ এসে টান মেরে শিফাকে সরিয়ে দিয়েছিলো। অবস্থা বেগতিক দেখে শিফা তৎক্ষণাৎ রুম ছেড়ে পালালো। আর তখনই জেহেরের ভাঙচুর শুরু হয়ে যায়। তার রোজ তার থেকে পালিয়েছে! সেই রাগ গিয়ে পড়ে রুমের প্রতিটা জিনিসের উপর।
.
.
জেহেরকে ইনজেকশন দেওয়ায় সে গভীর ঘুমে মগ্ন। জেবা সেই বিকেলের ঘটনার পর থেকে ভয়ে নিজের রুম থেকেও বের হয়নি।
নিস্তব্ধতার চাদর ছিঁড়ে জিহাদের কন্ঠস্বর ঝংকারের মতো আওয়াজ তুললো।
-“এইখানে বসে কি করছো শিফা? গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
-“ভাবছি।”
খানিকটা ভ্রু কুঁচকে এলো জিহাদের। থুতনি থেকে হাত না সরিয়েই বললো,
-“কি?”
-“যেই জিহাদ আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না, তার ভাইয়ের কাছেও ঘেঁষতে দেয় না, দেখলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে, সেই জিহাদ আজ আমাকে তার ভাইয়ের রুমে থাকতে কোনো বারণ করছেনা? আবার আমাকে দেখেও কোনো বাড়তি কথা বলছে না? ইজন্ট ইট সো স্ট্রেইঞ্জ?”
উত্তর না দিয়ে থুতনি থেকে হাত সরিয়ে কিছুটা গা এলানোর মতো করে বসলো জিহাদ। শান্ত দৃষ্টিতে একবার শিফার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো। অন্ধকারকে দুরে ঠেলে ভোরের সূর্য স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে উদিত হয়েছে। নীল আকাশ লালচে আভায় ছেয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরই জেহেরের জ্ঞান ফিরবে। তখন কি হবে? ঐ মেয়েটার জীবন নরকে পরিনত হতে আর বেশি দেরি নেই। তার কপালে কি আছে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউই জানেনা। হিংস্র জানোয়ারের গুহাতেই হয়ত তার ঠাই হবে শেষ পর্যন্ত।
.
.
সকালের মিষ্টি রোদ ইনশিতার মুখে পড়তেই আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলো সে। পাশে ঘুমিয়ে আছে নয়নিকা, কেমন গুটিগুটি মেরে ঘুমাচ্ছে! মুচকি হেসে চাদর টেনে নয়নিকার গায়ে দিলো। নিজ গায়ের চাদর সরিয়ে দিয়ে বেশ বড়সড় একটা হাই তুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো ইনশিতা। তারপর লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলো। আজ তার কাছে বেশ ফুরফুরে লাগছে। মনে হচ্ছে হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। মনটাও কেমন ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে। কতদিন পর এত ভালো লাগছে জানা নেই তার। কালকের ঘটনাটাও হঠাৎ করেই মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের সাহায্যে রুটি, ভাজি তৈরি করে নিলো। বাবা আর নয়নিকাকে ডেকে নাস্তা করাতে বসে গেল। নয়নিকা খেতে না চাইলে জোর করে বসিয়ে দিলো ইনশিতা। ইনশিতার বাবা মিজান হোসেন বলল,
-“ইতু মা। তুই কি আজ ভার্সিটিতে যাবি?”
-“হ্যাঁ বাবা, যাবো তো। কেন বলো তো?”
-“তোর চাচিমা আজকে আসবেন বলেছিলেন। তিনি তোকে নিয়ে কয়েকদিন তার কাছে রাখতে চান।”
-“কিন্তু বাবা, আমি ওখানে গিয়ে থাকলে আমার ক্লাস মিস হয়ে যাবে। আর তোমাদেরকে দেখে রাখবে কে? মায়ের বাতের ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে, আর তোমারও তো ডায়বেটিস বেড়ে গেছে তাইনা? এখন আমি তোমাদের এই অবস্থায় রেখে কি করে থাকবো বলো?”
তার মাঝেই নয়নিকা রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল,
-“আহ ইতু! আমি আছি না? আমাকে কি আঙ্কেল আন্টি নিজের মেয়ের মতো দেখে না? তুই যতদিন না আসছিস ততদিন আমি আঙ্কেল আন্টির খেয়াল রাখবো। তুই চিন্তা করিস না। নিজেকে একটু সময় দে। ভার্সিটির পর টিউশন, ঘরের কাজ, তোর বাবার দোকানের হিসেব এগুলো নিয়েই তো থাকিস। খাটুনি তো আর কম করিসনি! এবার একটু ঘুরে বেড়িয়ে আয়।”
নয়নিকার কথায় মাইশা বেগমও সম্মতি দিলেন।
-“হ্যাঁ রে মা, একটু ঘুরে বেড়িয়ে আয়। তোর চাচির কাছে থাকলে তোর কোনো কিছুরই অভাব হবে না। তিনি তো তোকে অনেক ভালোবাসেন। আর আমাদের কথা চিন্তা করিস না। নয়ন মা আছে, ও-ই সামলে নেবে।”
-“মা!”
-“যা মা, আর না করিস না।”
শত অনুরোধের পরই রাজি হলো ইনশিতা। ভার্সিটির কয়েকটা ক্লাস করে এসে চাচি আসলে তার সাথে চলে যাবে।
-“বাবা, একটা কথা বলার ছিলো।”
-“বল।”
-“আমি কয়েকটা জায়গায় চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করবো ভাবছি।”
মিজান অবাক হয়ে বলেন,
-“সে কি রে! তাহলে তোর পড়াশোনার কি হবে?”
-“পড়াশোনা পড়াশোনার জায়গাতেই থাকবে। পার্টটাইম জব করবো আরকি। অনার্সটা ভালোভাবে শেষ হলেই অন্য কোনো ভালো একটা চাকরি খুঁজবো ভাবছি।”
-“এভাবে পড়াশোনা, জব, টিউশনি একসাথে চালালে তো তুই আরো বেশি হিমশিম খাবি। না না, চাকরির কোনো দরকার নেই এখন। পড়াশোনাটা শেষ হোক তারপর।”
-“কিচ্ছু হবে না বাবা, আমি ম্যানেজ করে নিবো। আর এখন টাকাটাও অনেক দরকার। চারদিকে এত ধারদেনা এসব শোধ করতে হবে তো! তোমার দোকান আর টিউশনিতে কতই বা টাকা আসে বলো তো? এখন চাকরি করাটাই শ্রেয়।”
মিজান হোসেন নিশ্চুপ থেকেই সম্মতি দিলেন। আসলেই তো এখন টাকার অনেক দরকার। এই ছোট মেয়েটার কাঁধে কত দায়িত্বের বোঝা! নিজের কষ্ট চেপে কি সুন্দর হাসিমুখে সয়ে যাচ্ছে সব। তিনি নিজেও তো একটু শান্তনা দিতে পারছেন না মেয়েকে। মেয়ের মুখ দেখলেই তার বুকটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। তার মেয়ের জীবনে কি একটু সুখ আসবে না? কবে সে একটু চিন্তাবিহীন জীবন কাটাবে। ছোট্ট একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন মিজান।
.
ক্লাস শেষ করে বাড়ির পথে রওয়ানা দেবে ইনশিতা আর নয়নিকা। বাবা একটু আগে ফোন করে বলেছে তার চাচিমা এসে গেছে। ভার্সিটির রাস্তার মোড়ে আসতেই থমকে গেল ইনশিতা। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে। কালকের ঘটনাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তার।
.
.
চলবে…