#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
বিকেল পাঁচটা। ম্রিয়মান সূর্যের আলো। ধূসর আকাশ ধীরে ধীরে লুপ্ত হচ্ছে নীলাভ কালচে মেঘে। গুরুগম্ভীর মুখ করে বসে আছে আয়েন্দ্রি। চিন্তিত মুখশ্রীতেও চকচকে চোখ। প্রাবিশের ক্ষীণ গলার প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গে আয়েন্দ্রির। হড়বড়িয়ে তাকাতেই ফিচেল হাসে প্রাবিশ।
“কী ভাবছিস?”
“কিছু না।”
আয়েন্দ্রি ভার্সিটির গেইটের দিকে চোখ স্থির রেখে মোলায়েম গলায় বলল—
“প্রাণ আজ আসেনি কেন?
প্রাবিশ সহজ গলায় বলল—
“ও গ্রামে গিয়েছে।”
আয়েন্দ্রি ভ্রু উঁচু করে তাকাল। চোখের কোণে ভাঁজ ফুটিয়ে বলল–
“কেন?”
“তা তো জানি না। সকালে ম্যাসেজ করেছিল। তারপর মোবাইল সুইচ অফ।”
আয়েন্দ্রি শঙ্কিত হলো। তাকে কিছু না জানিয়েই চলে গেল!
আয়েন্দ্রির চোখে, মুখের বিরসভাব বুঝতে পারে প্রাবিশ। আশ্বাসিত গলায় বলল—
“চিন্তা করিস না। চলে আসবে। হয়তো জরুরি কাজ ছিল। তাই হুট করে চলে গিয়েছে।”
আয়েন্দ্রির চিন্তা কমলো না। খুটখুট করছে নিষ্প্রাণের চিন্তা তার মস্তিষ্কে। কন্ঠে গভীরতা টেনে প্রশ্ন করল—
“তুই কখনো প্রাণের বাসায় গিয়েছিস?”
প্রাবিশ মাথা ঝাঁকালো। আয়েন্দ্রি তটস্থ গলায় ফের প্রশ্ন করে—
“ওর ঘরে গিয়েছিস? ওকে আমার আজব লাগে!”
চট করে হেসে ফেলে প্রাবিশ। তার চোখে চাটুকারিতা। ফিচেল গলায় বলল—
” দরিয়ার জল বলে, মৎস কইরো না ফরফরানি! আছি আমি,তোমারই সঙ্গে নিরবধি। এখন এইসব চিন্তা কেন তোর? আজাইরা!”
আয়েন্দ্রি বিষিয়ে উঠা কন্ঠে বলল—
“আরে এই! আমি তোকে ফাজলামি করার মতো কী বললাম?”
“ভালোবাসিস নিষ্প্রাণকে?
আয়েন্দ্রির কন্ঠে মৌনতা নেমে আসে। ঠোঁটের কোণের অনাবিল হাসিটা বন্ধ হয়ে যায়। নিষ্প্রভ চোখে নামে জলপুকুরের অথৈ জল। আয়েন্দ্রি পাশ ফিরে নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত হয়। প্রাবিশ ঠান্ডা গলায় বলল—
“ছেলেটা খারাপ না। একটু অন্যরকম। কিন্তু তুখোড় মেধাবী! নিজেকে গুটিয়ে রাখে ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজনে মেলেও ধরে। ও আসলেই একটু অদ্ভুত ! যতবারই ওর বাসায় গিয়েছি কখনো ঘরে প্রবেশ করার অধিকার পাইনি। নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। ও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এমনকি মেসের অন্যদের সাথেও তেমন সখ্যতা নেই নিষ্প্রাণের! কাউকে ওর ঘরে কখনো যেতে দেয় না।”
একাগ্রচিত্তে তা শ্রবণ করছে আয়েন্দ্রি। প্রাবিশ থামতেই হুট করে বলল—
“ওর বুয়া?”
“বুয়া পাশের ঘরে রান্না করে। খেতে ইচ্ছে হলে সেখান থেকেই খেয়ে আসে।”
আয়েন্দ্রির দৃষ্টি ক্রমশ প্রশস্ত হচ্ছে। টনটন করছে মস্তিষ্ক। কোনো মানুষ এত ইন্ট্রোভার্ট কী করে হয়!
প্রাবিশ নিজ থেকেই বলল—
“এইসব আমাকে সীমান্ত বলেছে। প্রথমে আমিও অবাক হয়েছে। পরে মনে হয়েছে স্বাভাবিক।”
“কেন?
প্রাবিশ দুর্বোধ্য হাসল। বিগলিত গলায় বলল—
“নিষ্প্রাণ ছোটোবেলা থেকেই একা বড়ো হয়েছে। মানুষের সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠতে একটু সময় লাগবেই। হয়তো ওর হেসিটেশন!
এই তোর কথাই ভাব না! কত দ্রুত ও তোকে ভালোবেসে ফেলেছে! কিন্তু চিন্তা কর্, গত ষোলো মাসেও ও তোকে খেয়াল করেনি। আর যখন করল..হায়!”
প্রাবিশের অধরে খেলে গেল দুষ্ট হাসি। আয়েন্দ্রি বরফের মতো জমে আছে। তরলে পরিণত হতে বেশ সময় লাগবে। তৎক্ষণাৎ দৌঁড়ে আসে তৃণা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আয়েন্দ্রির হাত ধরে তাকে টেনে তোলে। হকচকিয়ে ওঠে আয়েন্দ্রি। অধৈর্য গলায় বলল—
“কী হয়েছে তোর? পাগল হয়েছিস?”
তৃণা গালভর্তি উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল—
“সারক স্যার তোকে ডাকছে। জলদি চল্।”
আয়েন্দ্রি প্রতিক্রিয়া করার সময় পেল না। তাকে জোর করেই টেনে নিয়ে গেল তৃণা।
টুং করে প্রাবিশের ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। তা দেখে অধরে ঝুলে মিষ্টি হাসি।
,
,
,
প্রফেসর যামিনী তার ডিপার্টমেন্টের একটা প্রোগ্রাম করবেন। তাতে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার জন্য তিনি একজন মেয়ে খুঁজছেন। প্রফেসর সারক তাকে আয়েন্দ্রির নাম রিকোমেন্ড করে। রবীন্দ্র সংগীত শুনেই মাথায় হাত আয়েন্দ্রির! সে কোনোভাবেই রাজি নয়। যামিনী তাকে রিকোয়েস্ট করে। অনুষ্ঠান হতে আরো একমাস। ততদিনে নিয়মিত চর্চা করলে ভালো কিছু হবে বলে তিনি আশা রাখেন। মনে সাহস সঞ্চয় হচ্ছে না আয়েন্দ্রির। সে নারাজ। আয়েন্দ্রিকে কমন রুমের একপাশে নিয়ে যায় সারক। বিনীত গলায় বলল—
“দেখো, তোমাকে কিন্তু রাজি হতেই হবে। আমি ম্যামকে কথা দিয়েছি।”
আয়েন্দ্রি অপ্রস্তুত গলায় বলল—
“স্যার রবীন্দ্র সংগীত! আমার পক্ষে অনেক টাফ একটা ব্যাপার!”
“আমরা তো আছি। আর অনেক সময়ও আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তুমি পারবে।”
“কিন্তু স্যার….।”
আয়েন্দ্রির কথার মাঝেই তার মোবাইলের বিরক্তিকর রিংটোন বেজে ওঠে। নিষ্প্রাণের নম্বরটা দেখে অপুপল ব্যয় না করেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে রিসিভ করে। আশাভরা গলায় বলল—
“হ্যালো! হ্যালো! প্রাণ?
ওপাশ থেকে কোনো শব্দ হলো না। আয়েন্দ্রি নিরাশ হলো। ক্ষণপল পূর্বেই সোনালী রোদ্দুরে ঝকমকিয়ে ওঠা মুখটায় নিষ্প্রভতা ছেয়ে যায়। ক্ষুণ্ণ হয় তার মন। চোখে নামে কাতরতা !
টলটলে চোখ দুটো প্রশস্ত করতেই টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। বিভ্রান্তিকর এই পরিস্থিতি এড়াতে অন্যদিকে ফিরে চোখের পানি মুছে ফেলে আয়েন্দ্রি। সারক ভ্রু বাঁকায়। কুঁচকানো চোখে চেয়ে জিজ্ঞাসু গলায় বলল—
“তুমি ঠিক আছো তো?”
আয়েন্দ্রি জমাট গলায় বলল—
“হুম।”
আচমকা আবার মোবাইল বেজে ওঠে। ব্যগ্র হয়ে তা রিসিভ করে কমন রুম থেকে বেরিয়ে আসে আয়েন্দ্রি। একনাগাড়ে বলতে থাকে—
“হ্যালো! হ্যালো! প্রাণ? কথা বলছিস না কেন তুই? হ্যালো!
কোনো উত্তর এলো না। আয়েন্দ্রি মোবাইল কান থেকে নামিয় বিষণ্ণ চোখ দুটো দিয়ে তাকাতেই দেখে কল কেটে গেছে। দৈবক্রমে নিজের কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে সপ্রতিভ হয় আয়েন্দ্রি। পেছনে ফিরতেই চমকিত হয় সে।
“প্রাণ!”
নিষ্প্রাণ বজ্রদৃঢ় হাতে চেপে ধরে আয়েন্দ্রির হাত। তার রঞ্জিত চোখের দিকে তাকিয়ে আত্মা শুকিয়ে আসে আয়েন্দ্রির। ছটপটে পা দুটো লম্বা লম্বা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে নিষ্প্রাণ। ভয়ে কম্পিত হচ্ছে আয়েন্দ্রির দেহ। নিষ্প্রাণের পায়ের সাথে পা মেলাতে পারছে না সে। তবুও চলছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে বাম দিকে কাউন্টার। সেখানের দেয়ালের সাথেই চেপে ধরে আয়েন্দ্রিকে নিষ্প্রাণ। ভয়ে নেত্রযুগল মুদিত করে আয়েন্দ্রি। শ্বাসরুদ্ধ করে নিষ্প্রাণের পরবর্তি কাজের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আয়েন্দ্রিকে অবাক করে নিষ্প্রাণ!
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পিটপিট করে চোখের পল্লব মেলে ধরে আয়েন্দ্রি। সিঁড়ির শেষ প্রান্তটুকুতে তিন পাশেই ঘেরাও। একপাশে সিঁড়ি, অনপাশে কাউন্টার আর আরেকপাশে হাফ দেয়াল। সেই হাফ দেয়ালের পাশেই কাউন্টারের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ। বুকে হাত ভাঁজ করে এক হাঁটু ভেঙে দেয়ালে সেটে রেখেছে। আয়েন্দ্রির পাশ দিয়ে নেমে গিয়েছে কয়েকজন প্রফেসর। ভার্সিটি বন্ধের সময় হয়ে এসেছে। আয়েন্দ্রি বিতৃষ্ণা গলায় চিৎকার করে উঠে—
“পাগল হয়েছিস তুই? এমন করলি কেন?
মিষ্টি করে হাসল নিষ্প্রাণ। সরস গলায় বলল—
“আমি তো পাগলই।”
এই ছোট্ট বাক্যেই আয়েন্দ্রির গর্জে ওঠা রাগ স্থিমিত হলো। সকাতরে চেয়ে বলল—
“কখন এসেছিস তুই?”
নিষ্প্রাণ হালকা করে মাথাটা ঘোরাল। নমনীয় গলায় বলল—
“একটু আগেই।”
আয়েন্দ্রি অতলস্পর্শী চাহনিতে অবলোকন করে নিষ্প্রাণকে। এলোথেলো চুল, শুষ্ক ওষ্ঠাধর, ম্লাণ চোখ। ব্যথিত হয় আয়েন্দ্রি। ভেজা গলায় বলল—
“এখনো কিছু খাসনি?”
“বাসায় যাইনি তো! তোকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর যাব।”
আয়েন্দ্রি আকুঞ্চনিত চোখে চেয়ে বলল—
“তাই বলে না খেয়ে থাকবি?”
চোখে হাসে নিষ্প্রাণ। নির্মল গলায় বলল—
“তোর বাসায় খাব। চল্।”
আয়েন্দ্রি চঞ্চল হেসে নিষ্প্রাণের মাথাভর্তি চুলে হাত গলিয়ে দেয়। ফিচেল গলায় বলল—
“চুল কাটিস না কেন তুই? কাকের বাসা!”
অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল নিষ্প্রাণ–
“কাটব।”
আয়েন্দ্রি মেকি রাগ দেখিয়ে বলল—
“আমি যেন এই কাকের বাসা আর না দেখি।”
“আচ্ছা। চল্ এখন। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আমার।”
ঝরা হাসে আয়েন্দ্রি।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
গম্ভীর চোখে চেয়ে আছেন আলফাজ সাহেব। তার চাহনিতে নিষ্প্রাণের হাবভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে নির্দ্বিধায় খেয়ে যাচ্ছে। টেবিলের একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন ঝুমা। তার পাশ ঘেঁষেই আয়েন্দ্রি। আলফাজ সাহেব বেজায় বিরক্ত হলেন নিষ্প্রাণের এহেন আচরণে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন—
“কী করা হয়?”
মুখে দেওয়া খাবারের লোকমা গেলতে পারল না নিষ্প্রাণ। চোখ তুলে তাকিয়ে আনম্র গলায় বলল—
“খেয়ে নেই স্যার? তারপর কথা বলি।”
চোখের কোণ বাঁকিয়ে আয়েন্দ্রির দিকে তাকাল নিষ্প্রাণ। চতুর চাহনি। আলফাজ সাহেব চড়া হলেন। অসহ্যকর চাহনিতে মেয়েকে দেখলেন। আয়েন্দ্রির কাতর চোখে শান্ত হলেন তিনি। খাবার টেবিলে আর কোনো কথা হলো না।
খাওয়া শেষে নিজের ঘরে গেলেন আলফাজ সাহেব। বসার ঘরে বসে আছে নিষ্প্রাণ। অনুদ্বেগ, নিরুত্তেজ, স্থির। চট করে তার পাশে বসে আরিশা। একগাল হেসে বলল—
“থ্যাংক ইউ! জানো? অলিক স্যারকে কোচিং থেকে বের করে দিয়েছে! আই এম সো হ্যাপি।”
নিষ্প্রাণ চোখে হেসে স্নিগ্ধ স্বরে বলল—
“অলওয়েজ বি হ্যাপি!”
আরিশা ফিক করে হেসে ফেলে। চটপটে গলায় বলল—
“এই তুমি বিয়ে করছো কবে? আমি আপুকে বলেছি। আমাকে বিয়েতে একটা লাল শাড়ি কিনে দিতে। লাল টুকটুক সাজবো আমি। ইশ! কবে হবে তোমার আর আপুর বিয়ে?”
নিষ্প্রাণ মিষ্টি করে হেসে ঝরা গলায় বলল—
“যখন তোমার আপু কবুল বলবে!”
আরিশা উচ্ছ্বাসিত গলায় বলে উঠে—
“আরে, আরে জলদি, জলদি করো। ইশ! আমি কিন্তু খুব সাজবো!”
“ওকে কিউটি।”
তীক্ষ্ম স্বর ভেসে আসে আয়েন্দ্রির। রঞ্জিত চোখে কাটকাট গলায় বলল—
“এক চড় মেরে দাঁত ফেলে দেবো। যা এখান থেকে।”
আরিশা মুখভর্তি হাসি নিয়ে ফিচেল গলায় বলল—
“এমন করছো কেন? তোমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে যাচ্ছি না- কি?”
আয়েন্দ্রি রাগ দেখিয়ে বলল—
“বেয়াদব মেয়ে কোথাকার! যা এখান থেকে।”
দুই বোনের কথায় মুচকি হাসে নিষ্প্রাণ। তার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় কাতর হয় আয়েন্দ্রি।
কিছু সময় পর আলফাজ সাহেব আসেন। নিষ্প্রাণ তাকে দেখেই বিগলিত হাসে। সম্মানপূর্বক ওঠে দাঁড়ায়।
নিষ্প্রাণকে বসতে বলেন আলফাজ সাহেব।
ঘড়ির কাটা টিকটিক করে চলছে। সন্ধ্যারাত ক্রমশ নিশুতি রাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আলফাজ সাহেব ভারী গলায় প্রশ্ন করলেন—
” ফ্যামিলিতে কে কে আছে?”
নিষ্প্রাণ আলতো চোখে তাকায় আয়েন্দ্রির দিকে। তার এ চাহনির মানে, “আয়েন্দ্রি কী বলেনি তার সম্পর্কে?। নিষ্প্রাণ মোলায়েম গলায় প্রত্যুত্তর করে।
“সবাই আছে।”
আয়েন্দ্রি ভড়কে যায়! দমবন্ধ করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আলফাজ সাহেবের কঠোর দৃষ্টিতে থমকে যায়। নিষ্প্রাণের দেওয়া উত্তরে ক্ষুব্ধ হলেন আলফাজ সাহেব। ক্ষুণ্ণ গলায় বললেন—
“মানে কী?
নিষ্প্রাণ শীতল চোখে চেয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল—
“যার কেউ নেই পুরো দুনিয়াটাই তার। সেক্ষেত্রে সবার পরিচয় দেওয়া কী আদৌ সম্ভব?”
আলফাজ সাহেব মুখ বিকৃতি করলেন। মনে মনে রাগ চড়ে গেল তার। তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন—
“আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও। আর সেই মেয়ের বাড়িতে এসেই খাওয়া দাওয়া!
বিয়ের পর আমার মেয়ের ভরণপোষণ করতে পারবে তুমি?
নিষ্প্রাণ তার মায়ময় চোখের নিগূঢ় চাহনি আবদ্ধ করল আয়েন্দ্রির তরল মুখে। তারপর ঠোঁটে। এই ঠোঁটের জন্যই এতকিছু। ওই ঠোঁটের মালিকানাসত্ত্ব তাকে পেতেই হবে। তার ধ্রুবতারাকে তার চাই। তার অমারজনীর একমাত্র তারা করে চাই।
নিষ্প্রাণ নজর ঘোরায়। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নিরুদ্বেগ গলায় বলল—
“আমি তো এখানে আপনার জামাই হয়ে আসিনি! ধ্রুবতারার বন্ধু হয়ে এসেছি। মায়ের ছেলে হয়ে এসেছি। আরিশার ভাই হয়ে এসেছি। একবেলা খাওয়ার জন্য কাউকে খোঁটা দেওয়া কোনো ভদ্রলোকের কাজ বলে আমি মনে করি না। ”
তেঁতে উঠলেন আলফাজ সাহেব। ক্ষোভিত গলায় বললেন—
“কী বলতে চাও তুমি? কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেবো?”
“ভালোবাসার যোগ্যতায়।”
তীব্র রাগের পরিস্ফুটন ঘটালেন আলফাজ সাহেব। রিনরিনে গলায় বললেন—
“তুমি আমার মেয়েকে ভালোবাসো। শুধু এই একটা কারণে আমি আমার মেয়েকে তুলে দেবো! ভাবলে কী করে তুমি?”
আলফাজ সাহেবের বিস্ফোরিত রাগে ধুকপুক করে ওঠে আয়েন্দ্রির অন্ত:রিন্দ্রিয়। ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে বলল—
“বাবা, তুমি একটু ওর কথাটা শোনো।”
আলফাজ সাহেব কর্কশ স্বরের বর্ষণ ঘটালেন। নিষ্প্রাণ সমাহিত। তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আয়েন্দ্রির চোখ ভিজে উঠে। তার দিকে একবার পলক ফেলে তাকায় নিষ্প্রাণ। চোখের কোণ সংকুচিত করে তীক্ষ্ম চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। আলফাজ সাহেব উগ্রমূর্তি ধারণ করলেন। বললেন—
“কারো দায়িত্ব নিতে হলে নিজেকে আগে তার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। ধরণীর মাটিতে দাঁড়িয়ে চাঁদকে সবাই দেখে। কিন্তু তাকে পাওয়া আশা করতে নেই।”
নিষ্প্রাণ মনোষ্কোনে হাসে। যোগ্যতা! তার যোগ্যতাকে টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা হচ্ছে! কিন্তু ওই মানুষটা জানে না, যে অর্থের বড়াই সে করছে নিষ্প্রাণের কাছে তার মূল্য জিরো! তিনজন আলফাজ সাহেবকে কেনার ক্ষমতা রাখে নিষ্প্রাণ। কিন্তু আপাতত সে তার পরিচয় সকলের অগোচরে রাখবে। রাজন শিকদার নিষ্প্রাণকে শর্ত দিয়েছে, একজন সাধারণ মানুষের মতোই তাকে তার জীবন অতিবাহিত করতে হবে। অনার্স কমপ্লিট হওয়ার আগ পর্যন্ত সে কাউকে তার পরিচয় দিতে পারবে না। নিষ্প্রাণ এইটাকে তার করা অন্যায়ের মাসুল মনে করে। কিন্তু রাজন শিকদার ভেবে রেখেছেন অন্যকিছু।
তিনি নিষ্প্রাণের সুস্থ মস্তিষ্কের প্রমাণ চান। এক প্রাণহীন পুরুষের মাঝে প্রাণের সঞ্জারণ চান। যে মানুষ নিজের হাতে তার জন্মদাতা পিতাকে খুন করেছে!
চিকিৎসার জন্য নিষ্প্রাণকে পাঠানো হয় ইংল্যান্ড। বারো বছর সেখানেই কাটায় নিষ্প্রাণ। তাকে স্বাভাবিক জীবন কাটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে আসতে হয় নিজের দেশে।
নিষ্প্রাণ বেশ কিছু সময় নীরব থাকল। নীরবতা কাটিয়ে সহজ গলায় বলল—
“আমি আপনার কাছে সময় চাইছি। মাত্র দুটো বছর দেবেন আপনি আমাকে। আমি কথা দিচ্ছি। আপনার মেয়েকে আমি রাণি বানিয়ে রাখব। যদি সে যোগ্যতা আমি অর্জন করতে না পারি, তাহলে আমার আকাশের ধ্রুবতারাকে আমি আপনারে হাতে সৌপর্দ করে যাব।”
বিতৃষ্ণ চোখে তাকালেন আলফাজ সাহেব। তার ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো। নিষ্প্রাণের আস্ফালন দেখে তিনি রীতিমতো বিস্মিত হলেন! নিষ্প্রাণ আনম্র গলায় বলল—
“সব বাবা, মা- ই তার সন্তানের ভালো চায়। মেয়েদের বাবা, মা আরো একধাপ এগিয়ে। তাদের অনেক কিছু ভাবতে হয়। দুই বছর অনেকটা সময়। ভাবুন, দেখুন, সঠিক সিদ্ধান্ত নিন। চাঁদ সবাই চায়। তাকে পাওয়া সম্ভব নয় তা জেনেও তাকে পেতে চায়। এসব মানুষের স্পর্ধা নয়, তাদের অনুরক্তি, প্রেম! চাঁদকে পাওয়া জরুরি নয়। চাঁদের অনুরূপ যে কেউ তার জ্যোৎস্নায় আকাঙ্ক্ষীত মানুষটির অমানিশিকে আলোকিত করতে পারে। ”
আলফাজ সাহেব কথা বাড়ালেন না। দ্বিরূক্তি করলেন না কোনো। কিন্তু নিষ্প্রাণ বিচলিত নয়। তার ধ্রুবতারাকে তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। তার ছায়াও নয়।
আঁধার কালো নভোলোকে রুপার থালার মতো চাঁদ। ঝকমকে তারা। কৃষ্ণকায় নভোলোক ভেদ করে স্মমহিমায় উঁকি দিচ্ছে। খিলখিল করে যেন হাসছে! তার নিচে দাঁড়িয়ে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির কঠোর দৃষ্টি হৃদপিন্ড ফুঁড়ে দিচ্ছে তার। জ্বলন্ত গলায় বলল—
“সমস্যা কী তোর? ভালোভাবে কথা বলতে পারিস না? এইসব কী বলছিলি বাবাকে?”
নিষ্প্রাণ একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নেয়। অধর ছড়িয়ে তা নিঃসৃত করে। মিহি গলায় বলল—
“যা সত্যি তাই বলেছি। এর চেয়ে ভালো জবাব আমার কাছে ছিল না।”
“তাই বলে তুই…।”
আয়েন্দ্রির কথার মাঝপথেই তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিষ্প্রাণ। অপাংক্তেয় কাজ করে বসে। আয়েন্দ্রির হাতে শক্ত করে অধর চেপে ধরে। হতভম্ব হয়ে যায় আয়েন্দ্রি। তরলে ভরে ওঠে আঁখিদ্বয়। চন্দ্রিকার ক্ষীণ আলোতে তা চিকচিক করে ধরা দিচ্ছে নিষ্প্রাণের চোখে। অপ্রমেয় মায়ায় নিজের হাত ছোঁয়ায় আয়েন্দ্রির গালে। ঝনঝনিয়ে ওঠে আয়েন্দ্রির নিদ্রিত নারীমন। ভারী শ্বাস ফেলে আচ্ছন্ন চাহনিতে তাকাতেই সরব গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে নিষ্প্রাণ—
“ভালোবাসিস আমাকে?”
ডুকরে উঠে আয়েন্দ্রি। ভারী বর্ষণ ঝরিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল—
“হুম।”
নিষ্প্রাণ চোখে হাসে। আয়েন্দ্রির ‘হুম’ শব্দেই নিষ্প্রাণের পুরুষমনে কাতরতা দেখা দেয়। দাম্ভিকতার সাথে বলল—
“ভরসা রাখ আমার উপর।”
আয়েন্দ্রি তার চোখের ধারা দমন করে। ঝাপসা চোখ দুটো মুছে নিয়ে নিরেট গলায় বলল—
“বাসায় যা। অনেক রাত হয়েছে।”
“যাচ্ছি।”
“সাবধানে যাবি।”
“ওকে মাই লাভ। বাই। সি ইউ সুন।”
আয়েন্দ্রিকে বিদায় জানিয়ে চলতে শুরু করে নিষ্প্রাণ। ছোট ছোট পা ফেলে অদম্য চলা। আয়েন্দ্রি অনিমেষ চেয়ে থাকে আবছায়াতে। একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে নিষ্প্রাণ তমসাচ্ছন্ন, নীরব পরিবেশে।
,
,
,
সেই গলিতে ঢুকে চঞ্চল মনে হাঁটতে থাকে নিষ্প্রাণ। তড়াক করে মস্তিষ্ক ঝেঁকে ওঠে সেই কুকুরের কথা। নিষ্প্রাণ তার শুষ্ক অধরের বলয় করে সিটি বাজাতে থাকে। কিন্তু কুকুরটিকে কোথাও দেখল না সে। থমকে যায় নিষ্প্রাণ। সোডিয়াম বাতির আলোতে এধার ওধারে তাকিয়েও কোনো কিছু তার দৃষ্টিগোচর হলো না। পাশ দিয়ে একটা লোক যাচ্ছিল। নিষ্প্রাণ আনম্র গলায় তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে কুকুরটির কথা। লোকটি জানায় আজ সকালেই একটা গাড়ির নিচে চাপা পড়ে কুকুরটি। সারাদিন রাস্তায় পড়েছিল কুকুরটির প্রাণহীন দেহটি। সন্ধ্যার দিকে সিটি কর্পোরেশনের লোক এসে দেহটিকে নিয়ে যায়।
বিষণ্ণ শ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ। লোকটি চলে যায় তার গন্তব্যে। নিষ্প্রাণের মনে হলো, সেই কালো কুকুরটি লেজ নাড়াতে নাড়াতে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিষ্প্রাণ বিনা দ্বিধায় বসল। কুকুরটির মাথায় হাত বোলাল। নরম গলায় বলল—
“তোর সাথে শেষবারের মতো দেখা হলো নারে! ক্ষমা করিস আমায়।”
কুকুরটি সশব্দে ডেকে ওঠে। নিষ্প্রাণ অদ্ভুতভাবে ঘাড় নাড়িয়ে সিটি বাজাতে থাকে।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
বিভাবসুর তপ্ত কিরণে আধঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ আর আয়েন্দ্রি। উষ্ণতায় অতিষ্ঠ জনমানবপূর্ন জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে তারা।
বিশ দিন হসপিটালে শুয়ে-বসে কাটিয়ে একটা তিক্ত অনুভূতির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছিলো সীমান্ত। তাই আর দেরি না করে সীমান্তের বড় ভাই তাকে বাসায় নিয়ে যায়। সীমান্তকে দেখতেই তাদের এলাকায় আসে আয়েন্দ্রি আর নিষ্প্রাণ। কিশোরী বিকেলে ভীড়ভাট্টা প্রচুর। গন্তব্যে ফেরা মানুষগুলো তখন তটস্থ, উদ্বিগ্ন, বিচলিত। সময়কে ডিঙিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ফিরতে হবে।
প্রায় আধাঘণ্টা দাঁড়িয়েও কোনো বাস পেল না নিষ্প্রাণ যাতে তারা নির্বিঘ্নে চড়তে পারে। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে ওঠা মানুষগুলোর অবস্থা দেখেই গা গুলিয়ে উঠছে আয়েন্দ্রির। তবুও থেমে থাকার নয়। বাধ্য হয়ে অনেকটা মনের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা বাসে ওঠে দুজনে। সিট খালি নেই। পেছন দিকে গুটিকতক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আয়েন্দ্রি অস্বস্তিকর চোখে তাকায়। আয়েন্দ্রির উচাটন বুঝতে পেরে নিষ্প্রাণ বদ্ধ শ্বাস ফেলে। বাসের মাঝামাঝি গিয়ে বাম দিকের সিটের সাথে ঘেঁষে দাড়ায় সে। আয়েন্দ্রিকে দাঁড় করায় নিজের সামনে। বাস চলতে শুরু করে। লোকাল বাস হওয়ায় একটু পরে আরো কিছু মানুষ বাসের ভেতরে ওঠে। ফুঁসতে থাকে নিষ্প্রাণ! আয়েন্দ্রির সামনেই কৃশাঙ্গ দেহের একটা ছেলে এসে দাঁড়ায়। নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—
“ঘুরে দাঁড়া ধ্রুবতারা।”
আয়েন্দ্রি দ্বিরূক্তি করল না। আজকাল মেয়েরা নিজের সেফটির জন্য সামনে ব্যাগ নিয়ে চলতেও দ্বিধা করে না! নিষ্প্রাণের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি। আয়েন্দ্রির পেছন দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির চোখ বলে দিচ্ছে নেশায় পেয়েছে তাকে। চলন্ত বাসের সাথে তাল মিলিয়ে ছেলেটি একটু একটু করে আয়েন্দ্রির দিকে চেপে আসে। নিষ্প্রাণের কুপিত দৃষ্টি। কিন্তু তা দৃষ্টিগোচর হলো না আয়েন্দ্রির।
মহান আল্লাহ্ পাকের এক অদ্ভুত সৃষ্টি নারী। তাকে না-কি বুঝা যায় না!
সত্যিই কী তাই? হ্যাঁ, তাই। নিজের শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিত একগোছা তুলোর স্পর্শও নারীর রাতের ঘুম কেড়ে নিতে যথেষ্ট! সেখানে কাঙ্ক্ষিত যন্ত্রণাময় ছোঁয়াতেও নারী মন পুলকিত হয়!
আয়েন্দ্রিও আজ তাই হচ্ছে। নিষ্প্রাণের এতটা কাছে সে এর আগে কখনো আসেনি। তার নিমগ্ন দেহে আছড়ে পড়ছে নিষ্প্রাণের শ্বাস। ঝলসে দিচ্ছে তার দেহপিঞ্জর। ড্রাইভার গাড়ির ব্রেক কষতেই নিষ্প্রাণের বুকের উপর আছড়ে পড়ে আয়েন্দ্রি। লজ্জায়, সংকোচে শিউরে ওঠে সে। তার নারী সত্ত্বায় নিষ্প্রাণের দৃঢ় বুকের পাটাতনের স্পর্শে বিগলিত হতে থাকে। নাজুক চোখে নিষ্প্রাণের মুখের দিকে তাকায়। নিষ্প্রাণ দৃঢ়, কঠোর, প্রকুপিত। কিন্তু তার ধারণা করতে পারল না আয়েন্দ্রি। সে প্রফুল্লচিত্তে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণের দিকে। কৃশাঙ্গ ছেলেটির ধাক্কাতেই আয়েন্দ্রি হেলে পড়ে নিষ্প্রাণের বুকে। তাতে খানিকটা প্রসন্ন হয় আয়েন্দ্রি, কিন্তু রোষানলে জ্বলে ওঠে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির বাম দিকের সিটেই এক দম্পতি বসে আছে। পুরুষটির বুকের সাথে জড়িয়ে আছে ছয়- সাত বছরের একটি মেয়ে। ঘুম জড়ানো আঁখি দুটো খুব কষ্টে মেলে রাখতে চায় বাচ্চাটি। নিমিঝিমি চোখে আয়েন্দ্রিকে দেখে। আয়েন্দ্রি দুই হাতে নিষ্প্রাণের শার্ট খামচে ধরে আছে। মিটিমিটি হেসে বাচ্চাটির সাথে চোখের ইশারায় ভাবের আদান-প্রদান করছে। খোলা জানালা দিয়ে হুরহুরে উষ্ণ বায়ু ঢুকছে। গাড়ি স্লো হতেই নিষ্প্রাণ তার কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে আয়েন্দ্রির পিঠের উপর রাখে যাতে করে আর কারো স্পর্শ না লাগে তার ধ্রুবতারা শরীরে। চোখাচোখির এক পর্যায়ে বাচ্চাটি ফিক করে হেসে ফেলে। তার বাবা মুগ্ধ গলায় বলল—
“কী হয়েছে আমার রিনী মামুনির?
রিনী হৃদয় গলা হাসে। আয়েন্দ্রির দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে দন্তপাটি বের করে। মায়া লাগে আয়েন্দ্রির! বাচ্চা বাচ্চা চোখ দুটো তাকে টানছে! নিষ্প্রাণের দিকে তাকাতেই ক্ষুণ্ণ হয়ে সে। এই ছেলেটা এমন কেন!
কেমন অদ্ভুত !
আচমকা নিজের কোমরে কারো ছোঁয়া অনুভব করে আয়েন্দ্রি। তার সপ্রতিভ মন নিষ্প্রাণের দিকে চেয়ে আছে। ধীরে ধীরে সেই স্পর্শ গভীর হয়। আয়েন্দ্রি মৃদু গলায় বলল—
“প্রাণ!”
মুহূর্তেই নিষ্প্রাণের উগ্র চেহারা দেখে আত্মারাপ কেঁপে ওঠে আয়েন্দ্রির। সেই স্পর্শ নিষ্প্রাণেরই ছিল। পেছনের ছেলেটি নিজের হাত বাড়াচ্ছিলো দেখে নিষ্প্রাণ নিজেই আয়েন্দ্রির কোমরে হাত রাখে। এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতে আয়েন্দ্রির কোমর। নিজেকে পুরোদস্তুর ঠেসে রেখেছে সিটের বাড়ন্ত জায়গাটার সাথে। কষে এক লাথি বসায় ছেলেটির উরুতে। অকস্মাৎ সংঘটিত ঘটনায় ছেলেটা ধড়াস করে পড়ে যায়। বাসভর্তি মানুষ হকচকিয়ে ওঠে। হেল্পার চেঁচামেচি শুরু করতেই ড্রাইভার বাস থামায়। নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির কাছ থেকে সরে এসে ছেলেটার গেঞ্জির কলার ধরে মুখে টপাটপ কয়েকটা ঘুষি মেরে বসে। আয়েন্দ্রির থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে। ছোট্ট মেয়েটির বাবা উঠে এসে বলল—
“আপনি আমার সিটে বসুন। বি রিল্যাক্স।”
আয়েন্দ্রি ভয়াতুর চোখে নিষ্প্রাণের হিংস্রতা দেখছে! ছেলেটিকে ইচ্ছে মতো ঘুষি মারছে, সাথে লাথি। বাসের অনেকেই থামাতে গিয়েও ব্যর্থ। একটু সুযোগ পেতেই ছেলেটি বাস থেকে নেমে পড়ে। দ্রুতপায়ে নামে নিষ্প্রাণ। ছেলেটির পিঠে এক লাথি বসাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আয়েন্দ্রি বাস থেকে নেমে আসে। নিষ্প্রাণের হাত চেপে ধরে ভীত গলায় বলল—
“প্রাণ থাম। প্লিজ থাম।”
ছেলেটির মুখ দিয়ে লহুর ধারা বইছে। শীর্ণ শরীরে এরচেয়ে বেশি আঘাত সয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। ছোট্ট বাচ্চাটি বাবার কোল থেকে ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে আছে। পুরুষটি বলল—
“সমস্যা কী আপনার? এদেরকে এভাবেই শায়েস্তা করা উচিত। এদের মতো কিছু পিশাচের দলের জন্য মেয়ে মানুষ ঠিক মতো রাস্তায় চলাফেরা করতে পারে না।”
বাচ্চাটির মা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে—
“রিনীর আব্বু!
চুপ করুন। দেখছেন না মেয়েটা ভয় পেয়ে আছে।”
আয়েন্দ্রির চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সেদিকে এক পলক তাকিয়েই আহত ছেলেটির পুরুষাঙ্গ বরাবর সজোরে এক লাথি বসায় নিষ্প্রাণ। দমবন্ধ হয়ে আসে আয়েন্দ্রির। আজরাহান বাঁকা হাসে। তার হাত চেপে ধরে প্রহর। প্রহরিনী বাবার বুকে সমাহিত। উৎসুক জনতার কলকাকলি। আজরাহান গাঢ় গলায় বলল—
“এদের মতো মানুষদের উপযুক্ত শাস্তি। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাশরী।”
প্রহর হজম করে নিল সেই বাক্য। সে অভ্যস্ত এতে। আয়েন্দ্রি কেঁপে যাচ্ছে। নিষ্প্রাণ হট করেই বাসের ভেতরে ঢোকে। তার ব্যাগটা নিয়েই বেরিয়ে আসে। শক্ত হাতে আয়েন্দ্রির হাত চেপে ধরে বলল—
“চল্।”
আজরাহান মুগ্ধ হাসে। প্রহরকে খোঁচা মেরে বলল—
“প্রেমিক পুরুষ দেখেছিস! দেখে নে।”
একটা রিকশায় চড়ে বসে দুজন। আয়েন্দ্রি নৈঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে।নিষ্প্রাণের হাতটা বুকের সাথে চেপে ধরে আর্দ্র গলায় বলল—
“এত রাগ কেন তোর? নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারিস না? যদি বাবা জানতে পারে এসব…।”
আয়েন্দ্রির হাত সরায় নিষ্প্রাণ। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করছে। এলোথেলো চুলে ঢেকে আছে কপাল। কর্কশ স্বরে বলে উঠে নিষ্প্রাণ—
“রিকশা থামান মামা। থামান।”
নিষ্প্রাণের ভারী কন্ঠে রিকশাওয়ালা ধম মেরে যায়। নিষ্প্রাণ নেমে পড়ে। ভাড়া মিটিয়ে কিছুদূর চলে যায়। আয়েন্দ্রিও নেমে যায় রিকশা থেকে। নিষ্প্রাণের হাত ধরে কাতর গলায় বলল —
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
নিষ্প্রাণ খরখরে গলায় বলল—
“তোকে আমায় নিয়ে ভাবতে হবে না। আর তোর বাবাকে বলবি বেশি বাড়াবাড়ি না করতে। সেইটা কারো জন্যই ভালো হবে না।”
নিষ্প্রাণ চলতে শুরু করে। নিরন্তর চলা। খুটখুট শব্দে কাঁদছে আয়েন্দ্রি। ঘোলা চোখে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণের যাওয়ার পানে।
চলবে,,,
চলবে,,,
চলবে,,,