প্রাণস্পন্দন পর্ব ৫২+৫৩

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

একজন সুস্থ মানুষ তার আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনায় রিয়েক্ট করবে এটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু যখন একটি শিশু তার শৈশবে ঘটা কোনো ঘটনায় কোনো ধরনের রিয়েক্ট করতে পারে না তখন তার মধ্যে সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীকালে রাগের জন্ম দেয়। এই রাগ একসময় তার আওতার বাইরে চলে যায়। তখন সে রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে বিভিন্ন অযাচিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। তার সামনে করা কোনো অপরাধের জন্য অপরাধিকে ক্ষমা করতে নারাজ সে। একে আনফরগিভনেস হুপ বলে। এর ফলে উক্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে তার সামনের মানুষটিকে ক্ষমা করার মহৎ গুণ হারিয়ে ফেলে।

হাঁটু ভাঁজ করে হাতের বাঁধনে জড়িয়ে ধরে বসে আছে নিষ্প্রাণ। তার শিড়দাঁড়া ঠেসে আছে রাজন শিকদারের হুইল চেয়ারের সাথে। নিষ্প্রাণের নিমগ্ন দৃষ্টিত মেঝেতে। ক্লান্তিহীন গলায় বলল—

“আপনাকে বাঁচিয়ে রাখা আমার ভুল হয়েছে। আপনার কারণে আজ আমাকে ধ্রুবতারার গায়ে হাত তুলতে হলো। আপনি ইচ্ছে করলেই সব থামাতে পারতেন। কিন্তু করেননি। আপনার কারণে তারাকে হারিয়েছি আমি। আমার মাকে হারিয়েছি আমি। আজ আপনার কারনেই আমি আমার ধ্রুবতারার প্রাণটাও কেড়ে নিতে চেয়েছি।”

সক্রোধে উন্মাদ নিষ্প্রাণ ওঠে দাঁড়ায়। এক লাথি বসায় হুইল চেয়ারে। তা গিয়ে ঠেকে দেয়ালে। রাজন শিকদার হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মেঝেতে। তার চোয়াল আঘাতপ্রাপ্ত হলো। চকিতে দাঁতের সাথে গালের নরম জায়গা লেখে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। কপালের একপাশ মেঝের শক্ত পাটাতনে লেগে ফেটে যায়। গলগলিয়ে শোণিতে মাখামাখি হলো সফেদ মেঝে। রাজন শিকদার কাতরাতে থাকল। তাকে বিছানায় শোয়াল নিষ্প্রাণ। নিভুনিভু, ফ্যাকাশে দৃষ্টি। নিষ্প্রাণ নির্বিকার গলায় বলল—

“যদি ধ্রুবতারার কিছু হয় তাহলে আপনাদের কাউকে আমি ছাড়ব না। মনে রাখবেন। হাসমুল! হাসমুল!”

রাজন শিকদারের ভয়ে থমকে যাওয়া দুই চোখ দিয়ে জলস্রোত বইছে। কপাল কেটে ঝরছে রক্তস্রোত। নিষ্প্রাণের চিৎকারে ছুটে এলো হাসমুল। তাকে দেখেই কঠোর গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“ইঞ্জেকশনটা দিয়ে দাও। তার আগে ডাক্তার ডেকে ড্রেসিং করিয়ে নিয়ো। ”

“জে ছোডো সাহেব।”

রাজন শিকদার অসাঢ় হয়ে পড়ে রইলেন। নিষ্প্রাণ বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। করিডোর দিয়ে নরম পায়ে হেঁটে এসে নিজের কক্ষে প্রবিষ্ট হয় সে। আয়েন্দ্রি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ডাক্তার তাকে অল্প মাত্রার ঘুমের ঔষধ দিয়েছে। আপাতত মাথার যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য তার ঘুম প্রয়োজন। নিষ্প্রাণ ধীর পায়ে এসে বিছানার সাথে লেগে মেঝেতে বসে। তার প্রগাঢ় দৃষ্টি আয়েন্দ্রির ঘুমন্ত মুখে। কপালে দুটো সেলাই লেগেছে। ঠোঁটের কোণে লাগিয়েছে মলম। নীল হয়ে গেছে জায়গাটা। লাল তিল ঢেকে গেছে কালচেভাবে। তবুও তা উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিচ্ছে নিষ্প্রাণের চোখে। নিষ্প্রাণের এক দুর্দমনীয়, কৌতূহলী, তূরন্ত টান আয়েন্দ্রির কোমল ওষ্ঠাধরে। যারা মোহ সে কাটাতে পারে না। বিছানার কার্ণিশে দুই হাতের ভরে উঁচু হয় নিষ্প্রাণ। ঝুঁকে পড়ে গভীর আশ্লেষে আয়েন্দ্রির অধরসুধায় নিজের অশান্ত, অতৃপ্ত সত্ত্বার মৃত্যু ঘটায় সে। আয়েন্দ্রির ঘুমন্তভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। ফিচেল হাসে নিষ্প্রাণ। এই ঠোঁটের মায়া সে এই জন্মে কাটাতে পারবে না। পকেট ভর্তি বেলীফুলের পাঁপড়ি। তা নিয়ে ছড়াতে থাকে আয়েন্দ্রির সারা অঙ্গে। মুচকি হাসি নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির কাঁধের কাছে আঁচলের সম্মুখভাগ নিয়ে নিজের মুখের সামনে ধরে।

এত ভালোবাসা গো জান রাখিও আঁচলে…..

“ধ্রুবতারা! ব্যাথা পেয়েছিস তুই? কী করব বল। তুই কেন আমার কথা শুনিস না? কতবার না করলাম ওই বাড়িতে যাস না। কিন্তু তুই…।”

বুকপাঁজরে জমে থাকা চাপা শ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ। কাতর গলায় বলল—

“আরেকটু হলেই তো সব শেষ হয়ে যেতো। এই হাতে আমি আমার অস্তিত্বকে শেষ করে দিতাম। কেন বলিসনি তুই আমাকে, তুই মা হতে চলেছিস?”

নিষ্প্রাণ বিছানার কার্ণিশের উঁচু বর্ডারে চিবুক রাখে। তার মুখটা একদম আয়েন্দ্রির বুকের কাছে। যেন হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে নিষ্প্রাণ।
বাচ্চাদের মতো অস্পষ্ট গলায় বলল—

“আমার সন্তানকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলি তুই? এতটা পাষাণ কী করে হলি?”

আয়েন্দ্রির চুলে হাত গলায় নিষ্প্রাণ। মেয়েটার এই শান্ত রূপ বুকে ব্যাথা বাড়ায় নিষ্প্রাণের। কপালের সেলাইয়ে সযত্নে অধর ছোঁয়াল, চোখের পাতায় ছুঁয়ে দিলো নিরভিমান মায়া। নিষ্প্রাণ ওঠে দাঁড়াল। দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে জ্বালিয়ে দিলো সবুজাভ ক্ষীণ আলোক বাতি। জানালা পর্দা উড়িয়ে সুধানিধির জগৎ মোহনীয় জ্যোৎস্না হুরহুর করে ঢুকে পড়ছে। নিষ্প্রাণ পর্দা টেনে নেয়। নিঃশব্দে এসে তার ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় আয়েন্দ্রির পাশে। দেহের উচাটন কমাতে মাথাটা রাখে আয়েন্দ্রির বুকের উপর। আলতো হাত রাখে আয়েন্দ্রির নরম উদরে। নিষ্প্রাণ শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তার চোখের সামনে হাজারো প্রতিচ্ছবির সমাবেশ ঘটেছে। আয়েন্দ্রির বক্ষস্থল ভিজতে লাগল নিষ্প্রাণের নিমেষহীন চাহনির ক্লান্ত, নিরবধি,নোনতা স্বচ্ছ জলের নহরে।
,
,
,
দুই দিনে অনেকটা সুস্থ হয়েছে আয়েন্দ্রি। কিন্তু মৌনতা যেন এখন তার নিত্যসঙ্গি। ঘরের মধ্যে বিড়াল ছানার মতো গুঁজে থাকে। নীরবতায় এক প্রশান্তি খুঁজে নিয়েছে সে।

আয়েন্দ্রির মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে নিষ্প্রাণ। চকিতে নজরুল ডেকে ওঠে।

“ছোডো সাহেব, নিচে ক্যাডায় আইছে আফনের লগে দেহা করতে।”

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য শেষ করে নজরুল। নিষ্প্রাণ প্রশস্ত গলায় বলল—

“তুমি যাও, আমি আসছি।”

আয়েন্দ্রি ভীত, নরম দৃষ্টিতে তাকাল। গহন হাসল নিষ্প্রাণ। চোখের ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত করে বলল—

“তুই থাক, আমি আসছি।”

আয়েন্দ্রি কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। অচঞ্চল সে।
,
,
,
“কেমন আছেন মি. মিশকাত?”

মিশকাত নড়েচড়ে বসল। তার কৌতূহলী দুই চোখ আয়েন্দ্রিকে খুঁজে চলছে। গত দুই দিনে আয়েন্দ্রির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ সে। তাই বাড়িতে আসতে হলো তাকে। কণ্ঠে ঠাঁট রেখে প্রত্যুক্তি করে মিশকাত—

“জি ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

“ভালো। তা কী মনে করে এসেছেন?”

মিশকাত চোখ বুলালো সিঁড়ির দিকে। তার চোখের দর্পণে ধরা দিলো না আয়েন্দ্রি। সরল গলায় বলল—

“আয়েন্দ্রি কোথায়? অনেকদিন ওর সাথে দেখা হয় না। তাই ভাবলাব দেখা করে যাই।”

নিষ্প্রাণ চমৎকার হাসল। তার হাসিতে মিশকাতের কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো। কিন্তু মিশকাত তা প্রকাশ করল না। তার অধরে দীপ্ত হাসির মাতম খেলিয়ে বলল—

“ওর সাথে দেখা করা যাবে?”

নিষ্প্রাণ আগ্রহের সাথে বলল—

“শিওর। হোয়াই নট? আসুন আমার সাথে। দাদুর সাথেও দেখা করে নেবেন। অবশ্য আমার জানা মতে দাদু ঘুমোচ্ছে এখন। তবুও দেখা করে যান। কখন কী হয়ে যায় আবার!”

মিশকাত মৃদু চমকাল। নিষ্প্রাণের ব্যক্ত কথার অর্থোদ্বারের প্রয়াসে সে তাকাল নিষ্প্রাণের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই উঠছে নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণের বিষয়ে এত কিছু শোনার পর তার আচরণে অবাক না হয়ে পারে না মিশকাত। এত কিছু করেও এত স্বাভাবিক থাকে কী করে মানুষ?

রাজন শিকদারের কক্ষে প্রবেশ করেই গা ছমছম করে ওঠে মিশকাতের। তিনি ঘুমোচ্ছেন। পাশেই বসে আছে হাসমুল। নিজের গরজেই নিষ্প্রাণ বলল—

“হাসমুল সবসময় দাদুর আশেপাশেই থাকে। তার সার্বক্ষণিকের সঙ্গি। আসুন।”

মিশকাত পুরো ঘরে চোখ বুলায়। সবকিছু কেমন শান্ত, সমাহিত। গা শিউরে ওঠে তার।

আয়েন্দ্রি সেভাবে বসে রয়েছে। মিশকাতকে দেখে কোনো ভাবাবেশ হলো না তার। কপালের উপরে চুল থাকায় সেলাইয়ের দাগ অস্পষ্ট। আয়েন্দ্রির থেকে বেশ দূরত্বে বসে মিশকাত। নিষ্প্রাণের চোখ এড়িয়ে কোনো কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। নিষ্প্রাণ সচল চোখে চেয়ে আছে। আয়েন্দ্রি মৌনতার সাগরে ডুবন্ত। তার ফ্যাকাশে আনন, ক্লান্ত চোখ আর চকিতে সেলাইয়ের দাগ চোখে পড়তেই অধৈর্য হয়ে ওঠে মিশকাত। ভীতসন্ত্রস্ত চোখে চেয়ে রয় সে। নিষ্প্রাণের মোবাইল বেজে উঠতেই সে বাইরে চলে আসে। আয়েন্দ্রি হুটোপুটি করে ওঠে দাঁড়ায়। বালিশের তলা থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে তা ব্যস্ত হাতে মিশকাতের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল—

“প্লিজ আপনি চলে যান, চলে যান এখান থেকে। ”

“আয়েন্দ্রি তোমার এই অবস্থা হলো কী করে? এসবের মানে কী?”

“প্লিজ আপনি চলে যান। আমি যা বলার এখানে লিখে দিয়েছি। আপনি এখন চলে যান।”

গলা কাঁপছে মিশকাতের সাথে থরথরিয়ে ওঠল শরীর।

“ওকে, ওকে। যাচ্ছি আমি। নিজের খেয়াল রেখো।”

বাইরে বেরিয়ে আসে মিশকাত। দেখল, করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণ অবাক গলায় বলল—

“আরে চলে যাচ্ছেন যে?”

মিশকাত রয়ে সয়ে বলল—

“একটা জরুরি কল এসেছে তাই। আসি আবার দেখা হবে।”

“ওকে।”

দ্রুত পা চালায় মিশকাত। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে বাইকে বসে। ভাইব্রেট করে ওঠে তার মুঠোফোন। রিসিভ করতেই ওপাশের ব্যক্তির তটস্থ গলার প্রশ্ন—

“আয়েন্দ্রি কেমন আছে?”

মিশকাত মর্মভেদী গলায় বলল—

“ভালো নেই। নিষ্প্রাণ নির্ঘাত আয়েন্দ্রির গায়ে হাত তুলেছে।”

“তুমি ওকে এরেস্ট করছ না কেন?”

মিশকাত হেয়ালি গলায় বলল—

“বললেই এরেস্ট করা যায় না কি? প্রুভ পাবো কোথায়? ওয়েট, আয়েন্দ্রি কিছু একটা দিয়েছে আমায়।”

মিশকাত কল হোল্ডে রেখে আয়েন্দ্রির দেওয়া কাগজটা খুলে দেখে। গোটা গোটা অক্ষরে সেখানে লেখা, ” আমার মোবাইল নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাদের কিছু করতে হবে না। আমি ঠিক আছি। যতক্ষণ না আমি কিছু বলছি আপনারা প্লিজ নিষ্প্রাণ থেকে দূরে থাকুন।”

“শুধু এতটুকুই?”

মিশকাত ঘটনার সত্যতার স্বীকারোক্তিতে বলল—

“হ্যাঁ। এতটুকুই।”

সারক হতাশ গলায় বলল—

“আমার সত্যিই এখন আয়েন্দ্রির জন্য ভয় হচ্ছে।”

করিডোর থেকে বাইকে বসা মিশকাতকে দেখছে নিষ্প্রাণ। তার সব কথা শুনতেও পারছে। বক্র হাসি তার অধরে। নজরুল বাধ্য ভৃত্যের মতো বলল—

“আফনে যেভাবে কইছেন তেমনেই লাগাইয়া দিছি তার সিডের লগে।”

“গুড। ড্রাইভিং কত দূর তোমার?”

“জে ভালো।”

“মনোযোগ দিয়ে শেখো। লাইসেন্সের ব্যবস্থা আমি করে দেবো। এখন যাও। মায়ের খেয়াল রেখো।”

“জে ছোডো সাহেব।”

কক্ষে আসে নিষ্প্রাণ। বিছানায় বসে সে। আয়েন্দ্রি এখনো মোমের মূর্তির মতো বসে আছে। আয়েন্দ্রির কাছে এগিয়ে গেল নিষ্প্রাণ। মখমলে গলায় বলল—

“তুই আর ঝামেলা করিস না ধ্রুবতারা। ওদের আমি ক্ষমা করে দিলাম। ”

আয়েন্দ্রির বুকের কাছে মাথা রাখে নিষ্প্রাণ। আদুরে গলায় বলল—

“তোর হৃদস্পন্দন শুনতে পাই আমি। তুই কেন আমার প্রাণস্পন্দন শুনতে পাস না?”
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ড্রেসিং টেবিলের পাশে একটা ছোট্ট ড্রয়ার। যার তিনটা তাক। তার ভেতরেই কিছু একটা খুঁজছে নিষ্প্রাণ। অলস ভঙ্গিতে বিছানায় বসে আছে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ পরম যত্নে তার চুলে পনিটেল করে দিয়েছে। আয়েন্দ্রির কপালের সেলাইয়ের দাগ জ্বলজ্বল করে ধরা দিচ্ছে চোখে। গোল গোল চোখে চেয়ে প্রশ্ন করে আয়েন্দ্রি—

“আমরা ঢাকা কবে যাব?”

সুক্ষ্ম চোখে তাকায় নিষ্প্রাণ। একটা ছোট্ট হাসি উপহার দিয়ে বলল—

“তুই একটু সুস্থ হলেই।”

গাঢ় শ্বাস ফেলে আয়েন্দ্রি। কৌতূহলী গলায় ফের প্রশ্ন করে—

“কী খুঁজছিস?”

“একটা জিনিস। তোকে দেখাব। এখানে কোথাও ছিল। তুই দাঁড়া আমি খুঁজে দেখছি।”

আয়েন্দ্রি নীরব হয়। তার হাত চলে যায় উদরে। এখানেও একটা ছোট্ট প্রাণ আছে। ওই প্রাণহীন মানুষটার অংশ সে। একজন নারীর পূর্ণতা আসে তার সন্তান যখন তাকে মা বলে ডাকে। একটা ছোট্ট প্রাণ যখন কোনো নারী নিজ গর্ভে ধারণ করে তখন সে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। যে দশমাস লড়াই করে নিজের সন্তানকে বসুমতির আলো দেখায়। মা হওয়ার খুশি এক সুপ্ত অনুভূতি। তা বলে বলে বোঝানো যায় না, যায় না কাউকে দেখানো। শুধু হৃদয়ের অন্তস্তলে খুব গোপনে তাকে লালন করা যায়, ভালোবাসা যায়, প্রেমে পড়া যায়। আয়েন্দ্রির আজ সেই অনুভূতি হওয়ার কথা। কিন্তু তার কোনো অনুভূতিই নেই। যেন সমস্ত অবারিত, অনাবৃত প্রেমাচ্ছন্ন অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।

নিষ্প্রাণ খুটখুট করে খুঁজে চলছে কিছু একটা। আয়েন্দ্রির মনে আচমকা এক অদ্ভুত প্রশ্ন জাগ্রত হলো। তার ইচ্ছে হলো সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে। নিষ্প্রাণ তাকে মারবে না। আর ছাড়বেও না। এইটা আয়েন্দ্রি উপলব্ধি করে ফেলেছে। তাই ভনিতা না করেই নিজের মনের অদ্ভুত প্রশ্নটা সে করেই ফেলল।

“প্রাণ!”

নিষ্প্রাণ অস্পষ্ট জবাব দেয়।

“হুম।”

“তুই এই পর্যন্ত কতজনকে মেরেছিস?”

নিষ্প্রাণের হাত লাগে যা এতক্ষণ ধরে সে খুঁজে যাচ্ছিল। স্বমহিমায় উঠে দাঁড়িয়ে আয়েন্দ্রির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। হাতের ছবিটার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল—

“ওয়ান নাইন। মানে নাইনটিন।”

আয়েন্দ্রির মনে হলো কেউ তার কলিজার উপর শত টনের পাথর চেপে দিয়েছে এবং তা ততক্ষণ পর্যন্ত সরবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার মৃত্যু না ঘটে।
নিষ্প্রাণ বিড়ালপায়ে আয়েন্দ্রির সামনে এসে বসে। ঠোঁটভর্তি হেসে বলল—

“ভয় পেয়েছিস? এখন আর কাউকে মারব না। চিন্তা করিস না।”

নিষ্প্রাণের সাবলীল কথায় আয়েন্দ্রির গলায় যেন ভারী কিছু আটকে গেল। সে শ্বাস নিতে পারছে না। নিষ্প্রাণ সহাস্য অধরে বলল—

“এর মধ্যে দুজন আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম তখন। তুই ই বল, রেগিং করতে হলে কাউকে মলেস্ট কেন করতে হবে?
মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। নিজের হাতে মারিনি। একদিন ল্যাবে কাজ করছিলাম তখন কেমিকেলের ব্লাস্ট করিয়েছি। ব্যস! আর কি! আমার তেমন কিছু হয়নি। শুধু এই গলার কাছে একটা গরম কি এসে যেন গেঁথে গিয়েছিল। দেখ, এখনো দাগ আছে।”

আয়েন্দ্রি তার কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নিষ্প্রাণ এমনভাবে তার ক্রিমিনাল কনসপেরিসি ডিসক্রাইভ করছে যেন দুধ দিয়ে ভাত খাচ্ছে সে। যার অতিরিক্ত মিষ্টি তার বিরক্ত লাগছে। আয়েন্দ্রি তবুও শান্ত রইল। তার কাছে এসব পরিচিত মনে হচ্ছে। নিষ্প্রাণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার মধ্যে কোনো অনুশোচনাই নেই। এ কেমন মানুষ! অনুভূতিশূন্য মানুষ কী আসলেই মানুষ

আয়েন্দ্রির ভাবনার ব্যাঘাত ঘটায় নিষ্প্রাণ। তার নরম অধরে গাঢ় ঘষা দেয় সে। আয়েন্দ্রি প্রতিক্রিয়াহীন। নিষ্প্রাণের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ আয়েন্দ্রির ওষ্ঠাধরে। তার সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গের মধ্যে এই ঠোঁটের উপরই কড়া শাষণ চালায় নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণ আলতো করে ছোট্ট কামড় বসায় আয়েন্দ্রির নিচের ঠোঁটে। রক্ত লেগে যায় নিষ্প্রাণের স্বঅধরে। আয়েন্দ্রির অধরের রঞ্জিত মুছে নেয় নিষ্প্রাণ। ঘোরের চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ছবিটা ফট করে আয়েন্দ্রির সামনে ধরে। আয়েন্দ্রি নরম হাতে ছবিটা নেয়। রঙিন ছবিটাতে একটা মেয়ে। মেয়েটাকে পরী বললে ভুল হবে না। মেয়ে মানুষ এত সুন্দর কী করে হয়! আয়েন্দ্রি চিনতে পারল না তাকে।

“কে ও?”

আয়েন্দ্রির করা শীতল গলার প্রশ্নে নিগূঢ় হাসে নিষ্প্রাণ। প্রফুল্ল গলায় বলল—

“ভালো করে দেখে বলতো চিনিস কি না?”

আয়েন্দ্রি ছবিটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। হঠাৎ তার নজরে পড়ে মেয়েটির ঠোঁট। শুধু মুখের ছবি হওয়াতে নয়নতারা ঠোঁটের তিল ধরা দিল আয়েন্দ্রির চোখে। অবিশ্বাস্য গলায় বলে উঠে সে—

“তারা!”

“আমার তারা। নয়নতারা।”

ভরাট চাহনিতে নিষ্প্রাণকে দেখে আয়েন্দ্রি। আমার তারা বলতেই নিষ্প্রাণের স্বাভাবিক আননে এক চমৎকার দীপ্ততা খেলে গেল। যেন হীরক খন্ড পেয়েছে সে। ছবিটার দিকে তাকাতেই চোখ ভর্তি জল নেমে আসে আয়েন্দ্রির। সে তারার মতো সুন্দর নয়, বরঞ্চ তারার সাথে তাকে দাঁড় করানোর কোনো যুক্তিকতাও নেই। দুধসাদা গায়ের রঙ, পদ্মলোচন আঁখি। চোখের তারায় যেন আবেগের ঢল! পল্লবে পল্লবে ঢেউ খেলানো তীর। ঠোঁটে নেমেছে বসন্ত! হাজারো প্রজাপ্রতি উড়ছে তার মধু আহরণে। নিষ্প্রাণ সহজ, সাবলীল গলায় ভালোবাসার চাঁদোয়া ভিজিয়ে রেখে বলল—

“আমার তারা আমার জীবনের দেখা সবচেয়ে সুন্দর নারী। আমার মাও এত সুন্দর ছিল না। ছিল কারো কালো থাবার ভোগ। কিন্তু তারা! ও সদ্য ফোঁটা এক লাল পদ্ম। অগাধ জলরাশিতে যার বিচরণ। স্রোতে স্রোতো যার মহিমা। পরতে পরতে যার অভিরাম। জগৎ মোহনীয় রূপের রাণি। ”

নয়নতারার কথা বলতে বলতে এক অন্য জগতে হারিয়ে গেল নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির মনে হলো নিষ্প্রাণ যেন তার সামনে থাকা কোনো নৈসর্গিক প্রতিমার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিচ্ছে। আয়েন্দ্রি নিজেও যেন সেই প্রতিমাকে দেখতে পাচ্ছে। সব জীবন্ত মনে হচ্ছে তার।

নিষ্প্রাণ আচমকা নিভে গেল। দমে গেল তার কণ্ঠস্বর। প্রশ্বস্ত হলো চোখের আয়তন। ক্ষিপ্ত হলো চাহনি। শক্ত হলো চোয়াল। ফুঁসে উঠে বলল—

“কিন্তু সব শেষ করে দিলো। সব।”

আয়েন্দ্রি বদ্ধশ্বাস ফেলল। এক অতলস্পর্শী সাগরে ডুবন্ত কেউ যখন পানির উপরে মাথা তুলে শ্বাস নেয়, আয়েন্দ্রির অবস্থা ঠিক তেমন হলো। সে মুক্ত শ্বাস নিয়ে বলল—

“শুধু এই কারণে তুই আমাকে বিয়ে করেছিস?”

নিষ্প্রাণের মসৃণ কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। নাকের ডগায় বিতৃষ্ণা ঝুলিয়ে বলল—

“কী বলছিস তুই?”

আয়েন্দ্রি রোদনে আচ্ছন্ন হয়ে বলল—

“তুই আমাকে ভালোবাসিস না। শুধু নয়নতারার এই চিহ্নকে আগলে রাখতে আমাকে নিয়ে তোর এত পাগলামি? এই জন্যই এত আকর্ষণ আমার ঠোঁটে?”

“কী পাগলের মতো কথা বলছিস তুই?”

“ঠিকই বলছি আমি। তুই তাহলে আমাকে ভালোবাসিসনি। আমার মাঝে তারাকে খুঁজেছিস। কেন করলি এমন? কেন?”

নিষ্প্রাণ দুই হাত আয়েন্দ্রির মাথার দুই পাশে শক্ত করে ধরে তার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে জমাট গলায় বলল—

“আমি তোকে ভালোবাসি ধ্রুবতারা। হাজারো মেয়ের মধ্যে আমার তারা তোকে আমার জন্য সিলেক্ট করেছে। কারণ, তুই স্পেশাল তাই।”

আয়েন্দ্রি হাত সরিয়ে ফেলে। ধরা গলায় কান্না গিলে নিয়ে রাগের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে বলল—

“না। মিথ্যে বলছিস। আমাকে তুই কখনো ভালোই বাসিসনি। আমার এই একটা অঙ্গই ছিল তোর এডিকশন, তোর অবশেশন। কারণ তুই তারাকে চেয়েছিস। আমাকে নয়।”

নিষ্প্রাণ অসহিষ্ণু গলায় চড়াও হয়ে বলল—

” আবোলতাবোল কথা বলবি না। তারা শুধুই তারা। আর তুই আমার সব। আমার ধ্রুবতারা। আমার সত্য। আমার স্থায়িত্ব।”

উঠে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ। মাথাভর্তি সুপ্ত রাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে। হাতের ছবিটা ছুড়ে ফেলে আয়েন্দ্রি। আর সম্ভব নয় তার পক্ষে। আর ভালোবাসতে পারবে না এই মানুষটাকে সে। যে তাকে অন্য কেউ কল্পনা করে আজ পর্যন্ত ঠকিয়ে এসেছে। একজন মৃত মানুষকে খুঁজে চলছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির দেয়ালে মাথা ঠুঁকতে ইচ্ছে করছে। নিষ্প্রাণ এত পাগলামি করেছে, এতবার কনফেস করেছে, এত কমপ্লিমেন্ট করেছে তার ঠোঁটের, সে ভাবতে পারেনি এসবই তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো কাল হয়ে দাঁড়াবে।
,
,
,
কাউচে শান্ত হয়ে বসে আছে নিষ্প্রাণ। নিষ্পেষিত হচ্ছে তার মস্তিষ্কের নিউরণ। কনকন করছে চোখের কোণ। মুদিত চোখেও সেই যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে তার। অতর্কিতে একটা উষ্ণ হাওয়া দুলে গেল নিষ্প্রাণের গাত্রবরণে। শুনতে পেল মিষ্টি, মিহি কণ্ঠ—

“প্রাণ!”

অমিলীত চোখে তাকায় নিষ্প্রাণ। কাউচ থেকে সোজা হয়ে বলল—

“তারা! তুমি এসেছ?”

নয়নতারা প্রফুল্ল হাসল। বলল—

“আমার গলুমুলু প্রাণ বাবা হবে আর আমি আসব না! তা কী হয়?”

নিষ্প্রাণ কণ্ঠে অসহায়তা নিয়ে বলল—

“ধ্রুবতারা আমাকে ভালোবাসতে চায় না কেন বলোতো? ও কেন বিশ্বাস করে না আমি ওকে ভালোবাসি?

নয়নতারা চমৎকার হাসল। রহস্য করে বলল—

“তোর ছেলে কেমন আছে?”

নিষ্প্রাণ অবাক চোখে চেয়ে রইল।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here