#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৩|
মাহতিমের হাতে বাঁশের লাঠি। লাঠির একভাগ হাতের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে দুলাচ্ছে লাঠিটি। তার সামনে রাস্তার মুখ বাঁধা অবস্থায় পরে আছে প্রিয়ন্তিকে শাসানো দলের সেই নেতা সদস্য। মাহতিমের রাগ একবিন্দু কমে নি। বরং চোখের সামনে দলনেতাকে এমন ব্যথাতুর স্বরে কুঁকড়ে উঠতে দেখে বুকের ভেতর অদ্ভুত শান্তি লাগছে। এমন শব্দ আরো শুনার জন্যে মাহতিম এগিয়ে এসে শক্ত করে লাঠি বসায় দলনেতা লিমনের পায়ে। লিমন পায়ে হাত রেখে মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে উঠে। মাহতিম একেধারে আরো দুবার লিমনের পায়ে আঘাত করে চেঁচায়,
‘ শালা কু”ত্তার বাচ্চা। চোখ দেবার আর জায়গা পাস নাই? তোর চোখ যদি আমি আজ না তুলেছি, তবে… ‘
পায়ের ব্যথায় মুচড়ে যাচ্ছে লিমনের দেহ। অবস্থা খারাপ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে হাতে থাকা আধ খাওয়া পেয়ারা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দ্রুত কদমে এগিয়ে আসে ওয়াহিদ। মাহতিমের রাগ তখন তুঙ্গে। ওয়াহিদ এসেই জোড় করে নাহতিমের হাত থেকে লাঠি নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মাহতিম রাগে কাঁপছে তখন! চক্ষে আগুন দিয়ে তাকায় ওয়াহিদের দিকে। ওয়াহিদ কানের দিকে ঝুঁকে এসে বলে,
‘ মামা, ওর দলের লোকেরা আসছে। সামনে তাকা। ‘
মাহতিম কথামত সামনে চেয়ে দেখল। লিমনের দলের লোকেরা গলির মুখে হন্যে হয়ে লিমনকে খুঁজে চলছে। শব্দ করে ডাকছে তার নাম ধরে। মাহতিম কিছুটা থামল। শেষবারের ন্যায় লিমনের পুরুষাঙ্গে শক্ত করে লা”থি দিয়ে ওয়াহিদকে নিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। লিমনের লোকেরা ততক্ষণে এসে পরেছে। মুখ বাঁধা অবস্থায় লিমনকে দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। তারা দ্রুত এগিয়ে এসে লিমনের মুখের বাঁধন খুলে দিল। লিমন অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে উঠল,
‘ পা-প-পানি। ‘
দলের এক সদস্য দৌঁড়ে গিয়ে পানির বোতল কিনে এনে লিমনকে ধরে পানি খাওয়াল। লিমন শান্ত হল কিছুটা। গা ব্যথায় পিষে যাচ্ছে। এত মার সে জন্মে খায়নি। নেতা হবার পর থেকে সবসময় সালাম পেয়ে এসেছে। অথচ আজ? কোথা হতে দুটো ছেলে এসে মুখ বেধে মারতে শুরু করল। যেমন তেমন মার নয়! একদম হাড্ডি মাংস এক করে ফেলার ন্যায় মার। লিমন আন্দাজ করতে পেরেছে কে এই ছেলেগুলো। রাগে তার মাথা ধপধপ করছে। মাথার বাবরি চুল টেনে ধরে উঠে বসার চেষ্টা করল সে। তার চোখ উপচে পরছে রাগের উত্তাপ! সে রাগ সহ্য করতে পারেনি। চট করে হাত উঁচু করে দলের এক ক্ষুদ্র সদস্যের গালে থাপ্পড় বসায়। ক্ষুদ্র সদস্যের নাম ওহী। সে গালে হাত রেখে অসহায় কণ্ঠে বলে,
‘ ভাই, আমারে মারলেন ক্যান? আমি কি দোষ করসি? ‘
লিমন কিছু বলল না। শুধু রাগে ফুঁসে উঠল। পাশে থেকে হিমেল বলে উঠল,
‘ ভাই মনে হয় কারোর রাগ ওর উপর ঝাড়তাছেন। ভাই একবার তার নাম বলেন। ওই ছেলের হাড্ডি থাকব, কিন্তু মাংস আস্ত রাখমু না। কুকুর বেড়াল দিয়ে খাওয়ামু ওর মাংস। নাম বলেন ভাই। ‘
লিমন কিছু বলল না। শুধু মৃদু স্বরে বললে,
‘ প্রিয়ন্তি নামের মেয়ের বাসা কোথায়? কোথায় থাকে, বাসা থেকে বের হয় কয়টায়, কোন রাস্তা দিয়ে হাঁটে! সব খবর চাই আমার। ওর নাগরগিরি ছুটাইতাসি আমি। ‘
________________________
রাত হলে প্রিয়ন্তি সদা পড়তে বসে। আজও বসেছে। পড়তে পড়তে মধ্যরাত হয়ে গেছে। রাত বাজে এখন বারোটা বিশ। বাড়ির সবাই ঘুমে। প্রিয়ন্তির রাতে ভালো পড়া হয়। সবাই যখন ঘুমে থাকে, সম্পূর্ন শহর যখন অন্ধকারে তলিয়ে যায়, প্রিয়ন্তি তখন পড়াশোনা করে। ভালো কিছু অর্জন করার অদম্য ইচ্ছে প্রিয়ন্তির। মধ্যবিত্ত বাবা মায়ের অনেক কষ্ট। এসব কষ্ট তারা মুখ ফুটে কখনো সন্তানদের বলেন না। অথচ বুকে পুষে রাখেন কি নিদারুণ যাতনা। বাড়ির বড় মেয়ে হওয়ায় প্রিয়ন্তি বুঝে সেসব। তাই তার পড়াশোনা করে বড় কিছু করার ইচ্ছে। হঠাৎ প্রিয়ন্তির মোবাইলে কল এল। প্রিয়ন্তি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মাহতিমের কল। প্রিয়ন্তি ঘড়ি দেখল। রাত বাজে বারোটা। এই বেহায়া ছেলে এখন কেন কল করেছে? প্রিয়ন্তি কল ধরল না। বরং ফোন বন্ধ করে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। দিনে শান্তি দেয় না ,আবার রাতেও তার জন্যে শান্তি পাবে না। প্রিয়ন্তি পড়ায় মন দেবে, তার আগে জানালার গ্রিলে পাথর পরার শব্দ হয়। প্রিয়ন্তি চমকে উঠে। দ্রুত গায়ে ওড়না তুলে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। মেলে রাখা পর্দা সরায়। বাসার নিচে মাহতিম দাঁড়িয়ে আছে। একহাতে ফোন,ওপর হাতে কিছু টুকরো পাথর। সে পাথর তাক করে রেখেছে প্রিয়ন্তির জানালার দিকে। যেন প্রিয়ন্তি না এলে সে পাথর আবার ছুঁড়ে ফেলার প্রস্তুতি নেবে। প্রিয়ন্তির রাগ আকাশ মাত্রা হল। প্রিয়ন্তি ফোন হাতে নিয়ে কল দিল মাহতিমকে। মাহতিম প্রিয়ন্তির কল দেখে মৃদু হেসে উপরে চেয়ে দেখে। হাত নাড়িয়ে ‘হ্যালো’ বলে নিচে থেকে। প্রিয়ন্তি যেন দেখেও দেখে না। মাহতিম কল ধরে কানে ধরে ফোন।
‘ বেহায়া ছেলে, এই মধ্যরাতে আমার বাসার নিচে কি করছ তুমি? ‘
মাহতিম মৃদু হেসে বলে,
‘ তোমাকে মনে পরছিল খুব। ঘুম আসেনি। আজকাল বড্ড যন্ত্রনা দিচ্ছ, জানো? বুকের উপর বসে থাকো সবসময়। বুক থেকে নামাতে চাইলে মাথায় চড়ে বস। একদম কথা শুনতে চাও না। এমন কেন তুমি, প্রিয়ন্তিকা?”
‘ একদম বাজে বকবে ন। জানালায় পাথর ছুঁড়ে ফেলছ কেন? সকালের থা”প্পড় কি কম হয়েছে? আরো একটা বসাতে হবে? ‘
‘ না, হয়নি। থাপ্পড় না দিলে চুমু দিলে এখন শান্তিতে ঘুমিয়ে যেতাম।’
প্রিয়ন্তি কি বলবে খুঁজে পেল না। সারাক্ষণ বেহায়ার ন্যায় কথা শুনে তার কান ভনভন করছে। সকাল, দুপুরে, মধ্যরাত সবসময় এই ছেলে আশেপাশে বসে থাকে। কবে মুক্তি মিলবে তার থেকে? জানে না প্রিয়ন্তি। প্রিয়ন্তি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। চোখ বুজে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ আর একবার জানালার দিকে পাথর ছুঁড়লে ভালো হবে না তোমার জন্যে। এক্ষুনি বাসায় যাবে তুমি। নিজে ঘুমাও আর আমাকেও ঘুমাতে দাও। ‘
মাহতিম প্রিয়ন্তির কথা শুধরে দেবার চেষ্টা করে বলল,
‘ কিন্তু তুমি তো ঘুমাচ্ছ না, পড়ছ। ‘
‘ যাই করি না কেন! তোমার এসব ভাবার দরকার নেই। তোমাকে যেতে বলেছি, যাও। ‘
প্রিয়ন্তি আর একটা কথা শোনার প্রয়োজনবোধ করল না। বরং ফোন কেটে পর্দা আবার মেলে দিল। কিছুসময় জানালার কাছে অপেক্ষা করল। মাহতিম চলে গেছে কি না দেখার জন্যে পর্দা হালকা মেলে দেখল। মাহতিম উপরের দিকে চেয়ে আছে। হঠাৎ এদিকে চেয়ে মৃদু হেসে উঠে সে। হাত নাড়িয়ে ‘বাই’ বলে চলে যাচ্ছে। দেখে ফেলেছে প্রিয়ন্তিকে সে। প্রিয়ন্তি বুকে হাত চেপে কিছুক্ষণ বড়বড় নিঃশ্বাস নিয়ে আবার পড়তে বসল। কিন্তু সে ঘুর্ণক্ষরে জানল না, ভোর সকাল তার জন্যে কি দুর্ঘটনা পরিকল্পনা করে রেখেছে। অঘটনের পাল্লা সময়ের তাকে ক্রমশ ফাঁদ পেতে রাখছে। প্রিয়ন্তির জন্যে উৎ পেতে আছে চরম খারাপ কিছু!
#চলব