প্রিয়ন্তিকা পর্ব -০৮

#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব- |৮|

প্রিয়ন্তি নিজের কথামত একবারও মাহতিমের দিকে তাকায় নি। উল্টো মাহতিম একটা দুটো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছে। প্রথমবার প্রিয়ন্তি উত্তর বলে দেয়নি। কিন্তু পরেরবার মাহতিম প্রিয়ন্তির বাম হাতের কব্জি চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,

‘ উত্তর বলে না দিলে এক্ষুনি চুমু খেয়ে বসব, প্রিয়ন্তিকা। স্যার, বিয়ে, বৈধতা সব ভেসে যাক। ‘

অশ্লীল সব কথা শুনে প্রিয়ন্তির মাথা ঝিম ধরে গেল। মাহতিমের কন্ঠে স্পষ্টতা। যেন প্রিয়ন্তি তার কথা না শুনলে এক্ষুনি চুমু খেয়ে বসবে। প্রিয়ন্তি গলা কেশে উঠে হাতের কব্জি ছাড়িয়ে চট করে খাতা তুলে দেখিয়ে দিল উত্তর। মাহতিম মৃদু হেসে উত্তর টুকে নিল। প্রিয়ন্তি হাফ ছাড়ল।

সকল পরীক্ষার ইতি টেনেছে আজ। হল থেকে বেরিয়ে প্রিয়ন্তি নিপা এবং দৃষ্টির সঙ্গে ক্যান্টিনে এসে বসেছে। মাহতিম ব্যাগ কাধে তুলে বেরিয়েছে সবে। ভীষন গরমে মাথা পুড়ে যাচ্ছে। গা ঘামে ভেসে যাচ্ছে। মাহতিম ব্যাগ থেকে ক্যাপ বের করে মাথায় লাগাল। চোখে রোদচশমা পরে ওয়াহিদের উদ্দেশ্যে বলল,

‘ প্রিয়ন্তিকাকে দেখেছিস? আমি আসার আগেই বেরিয়ে গেল। ‘

ওয়াহিদ ঠাণ্ডা কোকাকোলার ক্যান খুলে তাতে চুমুক বসিয়ে বলল,

‘ ক্যান্টিনে বোধহয়। ‘

মাহতিম ওয়াহিদের কাধে হাত রেখে তার উপর ঝুলে পরল। ওয়াহিদ মাহতিমের ওজন সহ্য করতে না পেরে নিচে ঝুঁকে গেল। বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,

‘ সর শালা। মেয়েদের মত গায়ে পরে যাচ্ছিস কেন? ‘

মাহতিম হেসে উঠল। ঝরঝরে হাস। যেন হাসিতে মুক্ত ঝরে। ওয়াহিদের বিরক্ত ভঙ্গিতে কুচকে রাখা ভ্রু ক্রমশ তীরের ন্যায় বাঁকিয়ে গেল। মাহতিমের হাসি চমৎকার! যেকোনো মেয়ে তার হাসিতে চট করে ঘায়েল হয়ে যাবে। কলেজে পড়ার সময় অনেক মেয়েই মাহতিমকে প্রপোজ করেছে। ওয়াহিদ যাকে পছন্দ করত, সে মেয়ে অব্দি মাহতিমের উপর পাগল ছিল। ওয়াহিদকে এই নিয়ে মাহতিম খেপিয়েছে অনেক। ওয়াহিদ হেসে উড়িয়ে দিয়েছে সব। মাহতিম সুন্দর ছেলে। গায়ে গতরে ছিপছিপে গড়ন নয়। মোটাসোটা, বলিষ্ট গড়নের ছেলেই আজকালের মেয়েদের পছন্দ। এত চমৎকার এক ছেলেকে প্রিয়ন্তি পছন্দ করে না। বিষয়টি ভীষন হতাশাজনক। বিষয়টি উল্টো হলেও পারত। হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল ওয়াহিদ। মাহতিম বলল,

‘ ক্যান্টিনে যাবি? ‘

ওয়াহিদ ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ খাবার জন্যে ত যাবি না। যাবি ওই মেয়ের জন্যে। ‘
‘ ঠিক ধরেছিস। এখন চল। ‘

মাহতিম ওয়াহিদকে আর নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ দিল না। টেনে নিয়ে যেতে লাগল ক্যান্টিনের দিকে।

প্রিয়ন্তি সবে চায়ের কাপে চুমুক বসিয়েছে। মাহতিম যেমন কফি পাগল, প্রিয়ন্তি তেমন চা পাগল। চা ছাড়া প্রিয়ন্তির চলেই না। দিন শুরু হয় চা খেয়ে, শেষও হয় চায়ে। প্রিয়ন্তি চা খেতে খেতে কথা বলছে সামনের দিন নিয়ে। পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেজাল্ট চলে আসবে এক মাসের মধ্যে। চাকরির পড়া শুরু করে দিতে হবে এই সময়ের মধ্যে। কি পড়বে,কোন বই ভালো হবে সেসব নিয়েই আলোচনা চলছে তাদের মধ্যে। কিন্তু নিপা বড্ড চুপচাপ হয়ে আছে। বেশ কিছুদিন যাবৎ প্রিয়ন্তি লক্ষ্য করেছে, নিপা আগের ন্যায় হাসছে না। কথা বলছে না। সারাক্ষন কিসব চিন্তা করে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কারন কি জানে না প্রিয়ন্তি। প্রিয়ন্তি নিপার হাত ধরে। নিপা চমকে উঠে। প্রিয়ন্তি বলে,

‘ নিপা, তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তায় আছিস? ‘

নিপা উত্তর দেবে তার আগে হঠাৎ প্রিয়ন্তির পাশে চেয়ার টেনে বসে পরে মাহতিম। ওয়াহিদ বসে নিপার পাশে। ওয়াহিদ বসার সঙ্গেসঙ্গে নিপা সরে যায় চেয়ার নিয়ে। ওয়াহিদ ভ্রু কুচকে চায় নিপার দিকে। নিপা অপ্রস্তুত হাতে কানের পেছনে চুল গুঁজে।

মাহতিম একপল টেবিলে পরে থাকা খাবারসমূহের দিকে চায়। প্রিয়ন্তি ভ্রু কুচকে বেশ বিরক্তি নিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। প্রিয়ন্তি জিজ্ঞেস করে,

‘ এখানে কি চাই তোমার? দেখছ না মেয়েরা মেয়েরা বসে ছিলাম। মেয়েদের মাঝখানে কেন এলে? ‘

মাহতিম প্রিয়ন্তির চায়ের কাপ নিজের দিকে টেনে নেয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

‘ তোমার চোখ দেখতে ভীষন ইচ্ছে হচ্ছিল। তুমি কি জানো প্রিয়ন্তিকা? তোমার ঐ দু চোখ কতটা ভয়ঙ্কর? ওই চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। খুন হয়ে যায় আমার মন। এই যে এখন আবার চেয়ে আছো। চোখ ফেরাও দ্রুত, ফেরাও বলছি। ইশ! ‘

মাহতিম বুকের বা পাশে হাত চেপে চোখ বুজে প্রিয়ন্তির কাধের দিকে ঝুঁকে এল। তাৎক্ষণিক প্রিয়ন্তি সরে গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে পরল। ব্যাগ কাধে তুলে নিপার দিকে চেয়ে বলল,

‘ নিপা, উঠ। ‘

নিপা কি শুনতে পেল? বোধহয় না। নিপা আড়চোখে ওয়াহিদের দিকে চেয়ে সঙ্গেসঙ্গে চোখ ফেরাল। ওয়াহিদ ঠোঁট টেনে হেসে চেয়ে আছে নিপার দিকে। নিপা দ্রুত নিঃশ্বাস ছাড়ছে। যেন অনুভূতির সাগরে পিষে যাচ্ছে। প্রিয়ন্তি সবই দেখল। প্রিয়ন্তি নিজের মধ্যে উকি দেওয়া ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে চাইল না। হাত উঁচু করে নিপার চোখের সামনে তুড়ি বাজাল। নিপা চমকে উঠল। চমকে তাকাল প্রিয়ন্তির দিকে। প্রিয়ন্তি বলল,

‘ বাসায় যেতে হলে উঠ। ‘

প্রিয়ন্তির কথা শুনে নিপা উঠে গেল। মাহতিম প্রিয়ন্তির এটো হয়ে যাওয়া চায়ে চুমুক বসাতে বসাতে আয়েশ করে বসল চেয়ারে। নিপার দিকে চেয়ে চোখ টিপে বলল,

‘ তা নিপা, বন্ধু আমার কেমন লেগেছে? ‘

নিপা হকচকিয়ে গেল। আড়চোখে প্রিয়ন্তির দিকে চেয়ে চোখ সরাল। মাহতিম এখনো হেসে যাচ্ছে। প্রিয়ন্তি ভ্রূ কুচকে দুজনকে দেখল। অতঃপর নিপার হাতের কব্জি চেপে ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। নিপা অসহায় চোখে একবার ওয়াহিদকে দেখল। তারপরই তাল মেলাল প্রিয়ন্তির পায়ের সঙ্গে।
_________________________________
মোটরসাইকেলে করে লিমনের আস্তানার দিকে যাচ্ছিল মাহতিম এবং ওয়াহিদ। মাহতিম কথা বলছে,

‘ শালারে আজ ছাড়ব না আমি। দেখিস! ওর হাড্ডি ভেঙে হাতে নিব। লাঠি এনেছিস তো, ওয়াহিদ? ‘

ওয়াহিদ অন্যমনস্ক হয়ে হ্যাঁ-হু বলল। মাহতিম কিছুক্ষণ থেমে তারপর হঠাত করেই বলল,

‘ নিপার কথা ভাবছিস? ‘

ওয়াহিদ চমকে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে মাথা নেড়ে বলল,

‘ আরে ধুর। ওর ব্যাপার না। ‘

মাহতিম লুকিং গ্লাসের আয়নায় ওয়াহিদের দিকে চেয়ে ভ্রু বাঁকাল,

‘ সত্যি…’

ওয়াহিদ দম ছাড়ল। অতঃপর হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ হ্যাঁ, ও’ই। ‘

‘ নিপাকে দেখে মনে হল, ও নিজেও তোকে ভালোবাসে। মামলা তো সেট সব। তাহলে? কি চিন্তা করিস? ‘

‘ মামলা সেট না রে দোস্ত। নিপা আমাকে ভালোবাসে আমি জানি সেটা। কিন্তু ওর বাবা মা আমাকে মানবে না। চাকরি বাকরি নেই। সবে ভার্সিটি শেষ করলাম। মাস্টার্স করব, তারপর চাকরি পাওয়া তো সোনার হরিণ। ওর বাবা মা ওকে তার আগেই বিয়ে দিয়ে দেবে। এতসব চিন্তা করে ও এগুতে চাইছে না। ‘

‘ হুঁ! বুঝতে পারলাম। তুই এক কাজ করতে পার…. ‘

কথাটা আর শেষ করা হল না মাহতিমের। তার আগেই এক ট্রাক ভুল লেনে এসে টক্কর দিল মাহতিমের মোটরসাইকেলকে। মাহতিম এবং ওয়াহিদ ছিটকে পরল রাস্তায়। মাহতিমের মাথা লাগল এক শক্ত বড়সড় পাথরের সঙ্গে। মাহতিম মাথায় হাত রেখে সশব্দে আর্তনাদ করে উঠল। ওয়াহিদ পায়ে আঘাত পেয়েছে। ওয়াহিদ চোখে অন্ধকার দেখছে। চোখ বুজে ফেলার আগে শুনতে পেল মানুষের আহাজারি, শোরগোল। তার খানিক পর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। আর শুনতে পেল না কিছুই। নিরবে চোখ বুজে এল। চোখ থেকে চট করে এক ফোঁটা জল গড়াল। এ অশ্রু কান্নার নাকি ব্যর্থতার জানা হল না ওয়াহিদের।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here