প্রিয় তুই পর্ব -০২

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০২

-”বায় চান্স, আম্মুর কিছু হলে আমিও তোমাকে ছেড়ে কথা বলব না, ভোর চৌধুরী। ”

উপরোক্ত কথাটা বলে তিতাস প্রস্থান করল। জবাবে কিছু বলার সুযোগটুকুও দিলো না। ভোরও আর না বসে বেরিয়ে পড়ল। তার কিছু ব্যক্তিগত কাজ সারতে হবে। রোগীর চাপ কম তাই আজ সারায় উত্তম। আর এই পাগলের কথায় সে পূর্বেও কান দেয় নি, এখনো দিবে না। ছোট মানুষ বুঝে কম বকে বেশি। তাছাড়া পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে বিয়ের জন্য লাফাচ্ছে সে। অথচ এ তিতাসই একদিন আফসোসে ডুবতে বসবে না, এর নিশ্চয়তাও অনিশ্চত। জীবন ছেলেখেলা নয়। কতই না চড়াই-উতরাই আছে এই জীবন নামক সংগ্রামের।
সব কাটিয়ে উঠতে পারলেই মানব জীবন স্বার্থক। তিতাসের জীবনযাত্রা কেবল শুরু। তার রংহীন জীবনে জড়িয়ে তাকে হতাশাগ্রস্ত করার মানেই হয় না। মূখ্য কথা সে করুণার পাত্রী হতে চায় না। এভাবেই ওর রংহীন পানসে জীবনখানা দিব্যি পেরিয়ে যাবে। তাছাড়া সবাইকেই সংসার ধর্ম পালন করতে হবে এর কোনো মানে নেই। প্রচ্ছন্নতার ভীড়ে একরাশ রঙিন স্বপ্ন স্বযত্নে সেও সাজিয়েছিল, বাস্তববায়ন হলো কই! বরং স্বপ্ন মেলা ধরার আগেই সব ভেঙ্গে চুরে চুর্ণ-বিচূর্ণ রুপ ধারণ করল। মলিন করে দিলো তার সুখপূর্ন জীবনচরিতা।যেখানে
এখন একরাশ বিষণ্নতার বসবাস। এরচেয়ে তিতাসের সঙ্গে ওর আগের সম্পর্কই বহাল থাকুক। যেন দিনশেষে হাসিপূর্ণ মুখে বলতে পারে, সে কাউকে ঠকায় নি। কারো দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয় নি।

তিতাস বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। খুব ক্লান্ত সে। ক্লান্তিতে চোখের পাতাজোড়াও অমনমনে বন্ধ হয়ে আসছে। প্রচন্ড ক্ষুধার্তও বটে। তবে উঠে বসে খাওয়ার মতো শক্তি তার শরীর অবশিষ্ট নেই। পরিশ্রান্ত দেহখানা যে বিশ্রাম চাচ্ছে। এত ধকল শরীর আর কুলাচ্ছে না। তিতাস কিছুক্ষণ সেভাবেই শুয়ে রইল। তারপর হঠাৎ’ই বন্ধ চোখজোড়া খুলে উঠে বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে পিয়াস আর তার ছবি দেখে মলিন হাসল। ওর প্রাণপ্রিয় ভাইয়া মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এখন শত চায়লেও প্রাণ ভরে ডাকতে পারবে না ‘ভাইয়া’ ডাকটা।
বিপদে আপদে ভাইয়ের থেকে বুদ্ধি নেওয়া হবে না।পছন্দের পারফিউমটা চুরি করে ব্যবহার করা হবে না। “এই টি-শার্টে তোমায় ভালো লাগছে না ভাইয়া”বলে নিজেরও দখল করা
হবে না। ভাইয়ার ফোনের চ্যাট লিস্টসহ বেনামি প্রেমপত্রের ছবি তুলে রাখা হবে না। যাতে পরে সেগুলো দেখিয়ে মোটা টাকা হাতাতে পারে। নাস্তার টেবিলে হুটোপুটি করে ভাইয়ার প্লেটের মাংস অথবা ডিম নিয়ে দৌড় দেওয়া যাবে না। এক সঙ্গে বাইক নিয়ে বের হলে সুন্দরী মেয়ে দেখলে চেঁচিয়ে বলা হবে না, ”শুনুন সুন্দরী ললনা, আমার ভাই আপনাকে পছন্দ করেছে। এজন্য ‘আই লাভ ইউ।’
এসব বলে কতশত মেয়ের মুখে গালি শুনেছে ইয়াত্তাও নেই।
এই অপরাধে বাসার বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়েও থেকেছে। আর কান ধরা অবস্থাতেই পথচারী মেয়েদের প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে, ফোন নাম্বার চেয়েছে। তখন ওরা আবার বাসাতে গিয়ে ওর নামে বিচার দিয়ে এসেছে। ফলস্বরুপ ওর আম্মু কেঁদে কেটে কথা বলা বন্ধ করে দিতেন, রান্নাঘরের দরজায়
তালা ঝুলিয়ে রাখতেন। যাতে এসব আর না করে। কিন্তু না,
এতেও সে শুধরাবার ছেলে নয়। বরং ফুড পান্ডা থেকে তার পছন্দের খাবার এনে পায়ের উপর পা তুলে খাবার খেতো, আর খেলা টিভিতে দেখত। কেউ বিরক্ত হয়ে তাকালে তাকে হাসি মুখে খাবার অফার করত। ওর এহেন চঞ্চলতা, অস্থির ভাব, দেখে পাড়াতো এক দাদী বলেছিলেন,’ ওর পশ্চাদ্‌দেশ নিশ্চয়ই বানরের হাঁড় আছে। নয়তো এমনই বা করে কেন?’
একথা শুনে সে সত্যি সত্যি বানরের হাঁড় আছে নাকি দেখতে
এক্স- রে করতেও চেয়েছিল। ঠিক এমন চঞ্চল, দুরন্তপনা, প্রকৃতিক ছেলে ছিল সে। অথচ এই ছয়মাস যাবৎ সে ধীর, স্থির। যেন এটা অন্য এক তিতাস।

তিতাস উঠে ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে কিছু কথা সাজিয়ে নিলো। তবে মুখে উচ্চারণ করার সাহস পেলো না। পিয়াস মারা যাওয়ার পরেও ভোরকে সে ভাবির নজরেই দেখত, সন্মান করত। কিন্তু ভোরের ইদ্দত পালনের সময়সূচী
পার করে, ওর আম্মুর প্রস্তাব পাঠানোর পরে মন ঘুরিয়েছে। যদিও যুক্তিযুক্ত আরো কিছু কারণ রয়েছে। যা অপ্রকাশিত।
মূলত সেই অপ্রকাশিত রেখেছে। অর্থাৎ মূল কাহিনি দাঁড়ায়,
পিয়াসের মৃত্যুর ছয় মাস হলেও ভোরকে ভাবি মেনেছে মাত্র চারমাস দশ দিন। যা বিধবা বিয়ের উপযুক্ত সময়। এছাড়াও ওর মায়ের অসুস্থতা এবং ভোরের আত্মহত্যার ঘটনাতে মন স্থির করে ফেলেছিল, ভোরকে বিয়ের করার।এছাড়া কোনো পথ খোলা ছিল না। তিতাসের এসব ভাবনার ছেদ ঘটল দরজায় নক পড়ার শব্দে। সে দরজা খুলে দেখে রেশমি চাচী দাঁড়িয়ে আছেন। ওর চাচা মারা গেছে আট বছর হলো। সেই থেকেই চাচী উনার একমাত্র মেয়ে রোজাকে নিয়ে এখানেই থাকেন। রোজার বর্তমান বয়স এগারো বছর বয়স। তবে সে হাঁটতে পারে না। সর্বদা হুইলচেয়ার ব্যবহার করে। জন্ম গত ভাবে ওর পা বাঁকা। আর ওদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা ছিল মোট সাতজন। বাবা-মা, বড় বোন সারা (ডিভোর্সি), চাচী, রোজ, পিয়াস আর সে। ভোরেরও যুক্ত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হলো না। ভাগ্য তাকে চরম ধোকা দিয়েছে। তখন চাচী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
-” বিকাল চারটা বাজে কখন খাবি তুই?”
-”যাও আসছি।”
-“আমিও হসপিটালে যাব। আমাকে ফেলে যাস না যেন। তুই খেয়ে নে, আমি রেডি হচ্ছি।”
-” বাবা কোথায়, খেয়েছে?”
-”হুম, খেয়ে কেবল রুমে গেলেন।”

তিতাস আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে রেডি হয়ে চাচীকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা দিলো। সেখানে পৌঁছে চাচীকে ওর আম্মুর কেবিনে রেখে নিজের কাজে চলে গেল। আজ এই বেলাতে অনেক রোগী ভর্তি হয়েছে। কারো এক্সিডেন্ট, কেউ বা হাত পুড়িয়েছে, অথবা কেউ পেটের অসনীয় ব্যথায় জর্জরিত। তিতাস ওর ডাক্তারী সাদা এপ্রোন গায়ে জড়িয়ে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে রোগী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
এভাবে রোগী দেখতে দেখতে ঘন্টা খানিক সময় কেটে গেল
তার। তারপর বরাদ্দকৃত রুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে বসতেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। সে বিরক্ত চেপে কথা বলতে বলতে ওর আম্মুর কেবিনের দিকে পা বাড়াল। অপর ব্যক্তিকে কথা দীর্ঘ করার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত কল কাটল।
তারপর কেবিনের দরজায় পা রাখতে অবাকও হলো। কারণ ভোর স্ব-শরীরে এখানে উপস্থিত। তিতাস ঘড়িতে সময় দেখে ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলল। রাত নয়’টা বাজে। এখানে ভোরের আসার কারণ বোঝার চেষ্টা না করে সে সরাসরি ওর আম্মুর পাশে বসল। নার্সকে ডেকে ঠিকঠাক ওষুধ খায়য়েছেন কি না খোঁজ নিলো। নিজে ওর আম্মুর শরীরের হালচাল জিজ্ঞাসা করল। চাচী সন্ধ্যার আজানের পরপর চলে গেছে। ড্রাইভার
কাকা এসে নিয়ে গেছেন। সব ঠিকঠাক দেখে তিতাস এবার ভোরকে বলল,
-”এখানে কি? ”
ভোর তখনো ফোন স্কল করতে ব্যস্ত। তখন তিতাসের আম্মু রুগ্ন কন্ঠে বললেন,
-” আমিই ডেকেছিলাম।”

তিতাস কেন জানি নিজের রাগটা সংবরণ করতে পারল না। সে হাতের স্টেথোস্কোপ ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে বলল,

-”কেন আম্মু, কেন? তুমি কেন বারবার অপমান হতে যাও? কিসের অভাব তোমার, বলবে আমায়? এই মেয়েটা সুযোগ বুঝে নাচাচ্ছে তোমাকে, বুঝছ না তুমি? কেন ডেকেছ তুমি ওকে? এক্ষুণি তাকে যেতে বলো, এক্ষুণি! যার অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না, রূপের গড়িমা শেষ হয় না, তাকে আর কখনো ভুলেও এখানে আসতে বলবে না!”

এবার ভোর নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে তিতাসের মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর স্বজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে অতি শান্ত কন্ঠে বলল,

-”ছোট ছোটোর মতোই থাকবি। ফারদার বাড়তি কথা বললে থাপ্পড়ে মাড়ির দাঁত ফেলে দিবো, বেয়াদব কোথাকার।”

তিতাস জবাব না দিয়ে ভোরের দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রাগে ওর শরীর কাঁপছে। একটা অসুস্থ মানুষ এতবার বলার পরেও তার কথা রাখছে না। এখন আসছে বাহারি ঢং দেখাতে, আদিখ্যেতা। তিতাসের আম্মু শুয়ে নিশ্চুপ হয়ে শুধু দেখছেন। বললেও এরা শুনবে না। দু’জনে ঘাড়ত্যাড়া জাত।
এই ছয়মাসে এমন কাহিনি বেশ কয়েকবার ঘটিয়েছে তারা।
তখনো তিতাস রাগান্বিত দৃষ্টিতে সেভাবেই তাকিয়ে রয়েছে। যেন ভোরকে আস্ত গিলে খাবে। নতুবা চোখ দিয়ে ভস্ম করে
দিবে। তখন ভোর ওর দৃষ্টি দেখে তিতাসকে পুনরায় থাপ্পড় মেরে বলল,

-”তাকা, সুন্দর করে তাকা বলছি। আরেকটা দিবো কিন্তু, কি কথা কানে যাচ্ছে না? ”

তিতাস মার খেয়ে আর দাঁড়াল না। গমগম শব্দ তুলে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তখন অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি কুটিল হেসে মনে মনে বলল,

-‘ তোমাদের দু’জনকে আমি এক হতে দিবো না তিতাস। কখনো না, কোনোদিনও না।”

To be continue…….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here