প্রিয়কাহন পর্ব -১৪+১৫

#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |১৪|

সন্ধ্যার সময় শান্তনুকে ভয়াবহ চড় মারলো অভী। অঙ্কে ডাবল জিরো পেলে কেউ যে কাউকে এত ভয়াবহ ধরনের থাপ্পড় দিতে পারে এটা শান্তনু তার ভাইকে না দেখলে বুঝতে পারতো না। বোধ হওয়া মাত্রই শুরু করলো গলা ফাটিয়ে কান্না। আকাশ-পাতাল কাপিয়ে গলা ছেড়েছে সে। বিরক্ত হলো সেলিনা। বিরক্ত হয়ে বললো,

‘ ছেলেটাকে এভাবে না মারলে কি হতো না? মানছি অঙ্কে ডাবল জিরো পেয়েছে তাই বলে এই হাল করবি?’

‘ তোমার ধারনা আছে কি করেছে? এতদিন রাত জেগে পড়ানোর মানে টা কি ছিলো তাইলে? ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাবা স্থানীয় কলেজের শিক্ষক- আর সে বাড়ির ছোট ছেলে কি-না গণিতে ডাবল জিরো পেয়ে বেড়ায়।’

শান্তনু আরও আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে কাদলো। ফুপাতে ফুপাতে বললো,

‘ তুমি আমার বাবা যে এভাবে মারবা? বাবাও আমারে মারে না আর তুমি আমার কি করলা? বন্ধুরা সবাই কালকে হাসাহাসি করবে আমার গালে তোমার পাস্টস্ট্যাম্প দেখে!’

‘ আবার একটা কথা বলি বাম গালে সপাটে চড় লাগাবো।’

ক্ষান্ত হলো না শান্তনু। বললো,

‘ বউমনির কাছে বিচার দিবো আমি দেখো। সে যখন আমার সামনে কান টেনে ধরবে তখন আমিও দেখবো মজা!’

বলেই সে ভৌ দৌঁড়৷ অভী হতবিহ্বল হয়ে রইলো। সেলিনা কিছু না বলে চলে গেলো নামাজ পড়তে। এই বাড়ি অদ্ভুত না, মহা অদ্ভুত। কেউ যদি কাউকে খুনও করে ফেলে তবুও মুখ ফুটে টু শব্দ করবে না। অভী বসার ঘরের কোণে বসে আছে। বড় থাই গ্লাসটি খোলা থাকায় হুড়মুড় করে ঢুকছে লেনের দাপুটে হাওয়া। সেই হাওয়ার আদলে চুলগুলো একটু নড়বড়ে হয়ে গেলো। রিক্সার টুংটাং আওয়াজ আসছে। অভীর হঠাৎ মনে পড়লো সেদিন সন্ধ্যার বৃষ্টিময় মুহূর্তের কথা। শান্তনুর ‘বউমনি’ কথাটি কানে বেজে চলছে সমানতালে।

প্রিয়তার প্রতি প্রেমানুভূতি এতদিন না হলেও মনে দুর্বলতা হানা দিচ্ছে। চোখের সামনে ভাসছে রিক্সায় নিজের কাছাকাছি থাকা প্রিয়তার লালচে মুখটা। প্রিয়তা ভীতু ধরনের মেয়ে, তবে রাগলে রূপকন্যা লাগে। গা ছমছমে অনুভূতি হয় তখন। আর এই অনুভূতি করুন হয় তখন যখন মেয়েটা অভিমানে মুখ কালো করে রাখে। আজ দেখেছিলো সে প্রিয়তার বিষন্ন মুখটি। ক্লাসে আড়চোখে তাকিয়েছিলো বেশ কয়েকবার। তবে প্রিয়তা তা দেখেনি। দেখাতেও চায়নি অভী। প্রিয়তার তাকে সূক্ষ্মভাবে এড়ানো দেখে অভী হৃদয় ভেতর থেকে ফেটে যাচ্ছিলো। তবে নিজেকে সামলালো সে। ধাতস্থ করলো তাকে পারতে হবে। পারতে হবে অভিমানিনী প্রিয়তার বিষন্ন মনটা ভেঙ্গে তাকে কাছে টানতে। চোখে ঘুম নেমে এলো অভীর। আজ দ্রুত ঘুমাবে সে। নাহলে বেপোরোয়া মনে প্রিয়তা রোগ বাসা বাঁধলে নির্ঘুমে রাত কাটাতে হবে।

____________________

কড়া ঝাঁঝালো রোদ পড়ছে প্রিয়তার মুখের ওপর। অদ্রি হারামীটা আজও পর্দা না লাগিয়ে ঘুম থেকে উঠে চলে গিয়েছে। বিশ্রি রোদটার বিকট প্রভাবে প্রিয়তা ঘুম থেকে উঠলো তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে। আজ অফ ডে। ভার্সিটিতে ক্লাস নেই। এটা এক সুবাদে ভালোই অভীর মুখোমুখি আর হতে হবে না। নিচতলায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ঘ্যাড় ঘ্যাড় কন্ঠে কথা চলছে তাদের ছুটা কাজের বুয়া মানিকের মা। ঝগড়াটা অদ্রির সাথে লেগেছে এটা নিশ্চিত। একটু পরই ঝনঝন শব্দ হলো আবার। নিশ্চিত অদ্রি একটা কাচের গ্লাস ভেঙেছে।

প্রিয়তা এবার উঠে বসলো। সকালে এসব ব্যাপার নতুন না। মানিকের মার যেই গলা মহল্লাসুদ্ধু জানবে ঘরের অবস্থা। উঠে বাথরুমে গেলো সে। মুখ ধুয়ে ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয়ে নিচে গেলো। এখন শান্ত দেখাচ্ছে সব। ঝড় থেমে গেলে যেমন হয় ওরকমই। প্রিয়তার বড় আব্বু আর বাবা সবেমাত্র অশান্তির পাট চুকিয়ে বাইরে গেলো। মানিকের মাকেও দেখা গেলো না আশেপাশে। সোফায় আয়েস ভঙ্গিতে বসে ফুপুকে বললো,

‘ এক কাপ চা দাও না ফুপু?’

রেডিও নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো দাদি। প্রিয়তার কথায় টিটকারী মেরে বললো,

‘ ওই প্রিয়তা তোর কোনো ভয় ডর নাই? এত বড় ঢিংরী মাইয়া কেমনে আমার মাইয়ারে চা বানাতে কস? নিজের টা নিজে বানায় খা।’

প্রিয়তার চোখ ছোটো হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘ তোমারে চা বানাতে বলি নাই বুড়ি। ভাঙা রেডিও নিয়ে নিজের কাজ সারো। ক’দিন পর টপকে যাবা এখন আল্লাহ আল্লাহ না কইরা আমার পিছে লাগসে।’

আরও কয়েকটা কথা শোনালো দাদি। তবে প্রিয়তা কি, কেউই পাত্তা দিলো না। ফুপু এসে চা দিয়ে গেলো প্রিয়তাকে। ভাইয়ের সংসারে থাকছে তাই খাপ খাইয়েই চলতে হয়। প্রিয়তার মাথায় হাতবুলিয়ে বললো,

‘ মাথা ধরেছে নাকি তোর?’

‘ আরে না। ঘুমটা কাটেনি তো……..তাই চা খাবো বললাম।’

‘ ওহ! প্রাণো এসেছে। তুশি রুশির সাথে বাগানে আছে।’

প্রাণোর মানটা চট করে স্নায়ুতে ধরতে পারলো না প্রিয়তা। পরন্তুই মনে পড়লো, প্রাণো।মিথির ভাই।বৃষ্টিস্নাত সেই সন্ধ্যায় সেদিন কি কান্ডটাই না করেছিলো অভী প্রাণোর সামনে। তারপর তো আর কথাই হয়নি ছেলেটার সাথে। কিন্তু আজ হঠাৎ সাখাওয়াত ভিলাতে এলো কেনো?

প্রাণো চুপচাপ বসে আছে বেতের চেয়ারে। রুশি তুশি নামের বাচ্চা দুটো মেয়ে তাকে টেনে নিয়ে এসেছে। সেই সুবাদে অস্বস্তিও হচ্ছে ওর। হাতে মিথির হ্যারি পটার সিরিজের বইগুলো। সেগুলো হয়তো প্রিয়তা চেয়েছিলো আজ মিথি তাই জোর করেই সকালে ওকে পাঠিয়েছে।

‘ চা নেও প্রাণো?’

প্রাণো তাকালো। দেখলো অদ্রি চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তার বোন হিসেবে যতটুকু চেনার, এর বেশি তাকে আর চিনে না প্রাণো। অদ্রির চুল গুলো ভেজা। টপাটপ পানিগুলো চা নেওয়ার সময় প্রাণোর হাতেও পড়লো। একবার ওর বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো,

‘আপু চুলগুলো ভালোমতো মুছে নিন।’

কিন্তু বললো না। অদ্রি মেয়ে হিসেবে কতটা ভয়ঙ্কর এটা ভালোমতই জানে। হয়তো শুনে গম্ভীর কন্ঠে বলবে,

‘ তুমি কি শেখর হতে চাও প্রাণো?’

‘ শেখর আবার কে?’

‘ শরৎচন্দ্রের পরিণীতা উপন্যাসের শেখর? প্রেমিক শেখররাই তো আদর করে তার প্রেয়সীর চুল ভালোমতো মুছতে বলে। তোমারও মনে হয় এমন কিছু হবে।’

প্রাণো তখন ভারসাম্য হারাবে। এসব সাংঘাতিক বদ মহিলাদের সাথে খুব সাবধানে কথা বলতে হয়। নাহলে প্রাণোর মতো হাজারো বেকায়দা ছেলেকে এরা গুবলেট বানিয়ে ছাড়বে।অদ্রি বসতে বসতে বললো,

‘ একি প্রাণো। মেয়ে মানুষদের মতো গাল লাল হয়ে যাচ্ছে কেনো? কোনো কারনে তুমি লজ্জা পাচ্ছো?’

প্রাণো তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ালো। কে জানে সত্যিই তার গাল লাল হচ্ছে কি-না।

‘ হাতে কি এটা?’

‘ হ্যারি পটার সিরিজের বই।’

‘ এসব বই কেউ বোনের টিচারকে দেয়?’

‘ আমি দেইনি। মিথি পাঠিয়েছে?’

‘ তূমি তাহলে কিছু দিতে পারোনা ওকে? একটা দুষ্টু মিষ্টি প্রেমের বই। একি……এই গাধা ছেলে লজ্জা পাচ্ছো কেনো? বড়দের প্রেমে পড়া পাপ না ‘

‘ প্রিয়তা আপুর বিয়ে অলরেডি ঠিক হয়ে গিয়েছে আপু।’

‘ ওহ তাইলে বুকিং জিনিস নিবে না। ওয়েট ওয়েট ওয়েট….এট এনি চান্স তুমি আমায় চাও না তো! তখনও দেখলাম কেমন করে তাকাচ্ছো? বললে বলে ফেলো। প্রিয়তার মত চড় থাপ্পড় মারবো না।’

‘ এমন কিছুই না আপু?’

‘ শোনো, বড় মেয়েদের প্রেমে পড়া লজ্জার কিছু না। আমার ভাইও পণ করেছে বিয়ে করলে বড় এক মেয়েকে করবে। প্রেম তো আর অপবিত্র কিছু না যদি তা বিছানা পর্যন্ত না গড়ায়।’

লজ্জায় প্রাণোর মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। তন্মধ্যেই এলো প্রিয়তা। যেন
ওকে বাঁচাতে এলো। কোনো মতে বইদিয়ে বললো,

‘ আজ বাসায় এসোনা আপু। আমরা চাচ্চুর বাসায় যাবো। মিথি পড়বে না।’

হড়বড় করে এসব বলে বাইরের দিকে পা বাড়ালো প্রাণো। যাওয়ার আগে অবশ্য একবার তাকিয়ে গেলো সাংঘাতিক মেয়ে অদ্রির দিকে। হাসছে সে। মাতাল করা সেই হাসি।

___________________

প্রাণো চলে যাওয়ার পর কেটে গেলে সকাল-দুপুর৷ পুরো বাড়িতেই রমরমা ভাব। কারন আজ ঢাকা থেকে পুলক চাচ্চু আসবে। পুলক হলো প্রিয়তার বাবার খালাতো ভাই। দাদীর আপন বোনের ছেলে। সম্পর্ক দূরের হলো প্রিয়তাদের সাথে তার বোঝাপড়া অনেক। ছোটবেলার খেলার সঙ্গী ছিলো পুলক চাচ্চু। ক্লাস ওয়ান টুতে পড়াকালীন রুদ্র অদ্রি বা প্রিয়তাদের কেউ যখন জ্বরে পড়তো তখন পুলক এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি বাদ দিয়ে রাতদুপুরে তাদের জন্য ওষুধ আনতে যেতো। বাউন্ডুলে ধরনের ছেলে। পড়াশোনায় কখনও মন ছিলো না, আজও নেই। তাই বেকার ঘুরে বেড়ায়। নিজেকে দাবি করে হুমায়ূনের অন্যতম চরিত্র ‘হিমু’।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তুমুল ভীড়। হকাররা হাক পাড়ছে। প্রিয়তা, অদ্রি আর রুদ্রকে নিয়ে অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আসছে আহ্বানিত ট্রেনের অপেক্ষায়৷ তখনই হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন এলো। অদ্রি বললো,

‘ এই প্রিয়ু তোর কি মনে চাচ্চু যে বলেছিলো সে একটা
সারপ্রাইজ আনছে সাথে। কি হতে পারে তা?’

বিরক্ত হলো রুদ্র। অদ্রি এপর্যন্ত কথাটা বহুবার বলে ফেলেছে। বিরক্ত হয়ে বললো,

‘ আল্লাহর ওয়াস্তে এবার তো থাম বইন। চাচ্চু আসছে, তারপর দেখিস কি সারপ্রাইজ দিবো। ‘

ভীড়ে আরও গমগমে হয়ে গেলো প্ল্যাটফর্ম। প্রিয়তা দ্বিধান্বিত হলো। বললো,

‘ এত ভীড়ের মধ্যে পাবো কিভাবে চাচ্চুকে?’

‘ ট্রেনে ঢুকে পড়। দেখি কোন বগিতে আছে।’

এখানে এত ভীড় দেখে রুদ্রের কথাটি যৌক্তিক মনে হলো। ভীড় ঠেলে এগিয়ে বগিতে উঠলো ওরা। কিন্তু আজ কপালটা প্রিয়তার নিছক খারাপ। ওঠতে না ওঠতেই এক লম্বাদেহী মানুষের সাথে এমন ধাক্কা খেলো যে নাক বোচা হয়ে গেলো। রাগ মাথায় উঠে বসলো প্রিয়তার। গর্জে বললো,

‘ সাবধানে হাঁটেন মামা!’

তৎক্ষনাৎ ঘুরে দাঁড়ালো ছেলেটি। সুঠাম গড়ন দেহে হালকা ছিপছিপে শার্ট, গলায় কালো সানগ্লাস ঝুলানো – তাকিয়ে আছে বিষ্ময়ে। প্রিয়তা হতভম্ব হলো। কথা বলতে ভুলে গেলো। অদ্রি রুদ্রও অবাক৷ জিজ্ঞেস করলো,

‘ এখানে কি করছেন আপনি?’

অভী সচকিত হলো৷ কথা বলা ভুলে গেলো প্রিয়তার হতভম্ব মুখ দেখে। গরমে ঘেমে গেছে মেয়েটা৷ নাকে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অভী জানতো না প্রিয়তার দেখা পাবে এই ব্যাস্ত প্ল্যাটফর্মে। মামা শব্দটা মানতে পারলো না অবরুদ্ধ মন। তখনই পেছন থেকে কেউ তেড়ে বললো,

‘ সাইড চাপেন ভাই! এমনিতেও তালগাছ, তারওপর বগিতে কেমন কইরা খাড়ায় আছে!’

চেপে গেলো অভী। প্রিয়তার মুখে চাপা রাগের আভাস। গতকাল অভী ফোন দিয়েছিলো কয়েকবার৷ প্রিয়তা ধরেনি৷ উল্টো নম্বর ফেললো ব্লকলিস্টে। আর আজ এখানে আসার মানেও কি তাই? রেগেমেগে বললো,

‘ পিছু নিচ্ছেন কেন আপনি আমার?’

ব্যাপারটা অভীর আত্নসম্মানে লাগলো। থমথমে কন্ঠে বললো,

‘ হোয়াট ননসেন্স, আমি কেন পিছু নিবো তোমার?’

‘ তাহলে এখানে কি মুড়ি ভাজতে এসেছেন?’

‘ আমার খালামনি আসছে ঢাকা থেকে। তাকেই নিতে এসেছি।’

প্রিয়তা বিশ্বাস করলো না। তবুও দু’চারটা কথা বলার আগ্রহও জাগলো না। কারন মন তখন পুলক চাচ্চুর আসার আনন্দে আনন্দিত। অভীকে সুনিপুনে এড়িয়ে রুদ্র অদ্রিকে বললো,

‘ চল তো! এখানে বিদ্যুৎ অফিসের খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকবি না।’

অভীকে পেছনে ফেলেই চলে গেলো ওরা। দু-তিন সেকেন্ড হাটার পরই পেয়ে গেলো তাদের কাঙ্খিত পুলক চাচ্চুকে। হৈ হৈ করে বলে উঠলো,

‘ বাচ্চাপোলাপানস! কি খবর তোদের?’

তিনজন খুশিতে একবারে ঝাপিয়ে পড়লো পাতলা ছিপছিপে গড়নের মানুষটার ওপর। আত্নহারা সবাই। পুলক ফ্যাসফ্যাসা কন্ঠে বললো,

‘ আরে মোটাহাতির দল! সর আমার থেকে। ভাইজানরা কি তোদের ভাত খাওয়ায় না পাথর খাওয়ায়? এত ওজন কেন? মরেই তো গেলাম বাবা!’

সরে এলো তিনজন। জিজ্ঞেস করলো,

‘ কেমন আছো?’

‘ বিন্দাস। তোরা?’

‘ আছি কোনোরকম?’

ভ্যাংচিয়ে বললো অদ্রি। বলাটাই স্বাভাবিক। বিগত কয়েকদিনে ওদের জীবনে যে ঝড় গেছে তা বলার মতো না। পুলক হাসলো। দাঁত কেলিয়ে বললো,

‘ আমার সারপ্রাইজ দেখবি না?’

‘কি?’

চোখ চকমক করে উঠলো ওদের। পুলক ইশারায় বললো,

‘ তোদের চাচীকে এনেছি দেখ?’

বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলো সবাই। কথা বলতে ভুলে গেলো। প্রিয়তা তাকালো মেয়েটির দিকে। সুতি সালোয়ার কামিজ পড়েছে। বয়সের ছাপ তাকলেও এতে অপ্সরী লাগছে তাকে। বয়স বেশি না হলেও কম না৷ মনে হচ্ছে পুলকেরই সমবয়সী৷ পুলক বললো,

‘ তোদের পুলক চাচ্চুর বউ তিথী। গতকালই আলাহর নামে কবুল পর্ব সারলাম। সালাম কর তাকে?’

সালাম দিলো তিনজনে। তবে প্রিয়তার মুখের আদলটা চেনা চেনা লাগলো। খুবই চেনা। কিন্তু ধরতে পারলো না। ইতিমধ্যেই পেছন থেকে এক তরুন কন্ঠ বলে উঠলো,

‘ খালামনি?’

পেছনে তাকালো প্রিয়তা রুদ্র অদ্রি। দেখামাত্রই আকাশ ভেঙে পড়লো। অভী দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে। তিথী নামের নারীকে খালামণি বলায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হলো সম্পর্কটি কি। অভীও জানতো না এ গোপন খবর। পরিবেশ বিধ্বস্ত। প্রিয়তা আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলো,

‘ তুমি অভীর খালামনিকে বিয়ে করেছো পুলক চাচ্চু?’
.
.#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |১৫|

‘ তুমি অভীর খালামনিকে বিয়ে করেছো পুলক চাচ্চু?’

প্রিয়তার নিজের কাছেই নিজের কন্ঠস্বরটা অচেনা মনে হলো। ঢোক গিললো ক্রমাগত। মনে মনে বলে চললো, বিধাতা যেন আর অবমাননা না করে তার ওপর। ‘দোহাই করো বিধাতা, দোহাই করো।’ কথাটা প্রিয়তা নিজেই মনে মনে আওড়ালো। কিন্তু হাজারো অনুনয় অনুরোধ সবকিছুকে উড়োবেগে উড়িয়ে পুলক চাচ্চু মাথা চুলকিয়ে বললো,

‘ আরে হ্যাঁ রে! পরিচয়টা তো সেভাবেই হয়েছিলো যখন জানলাম তিথী নুরুল স্যারের শালী। সেম ডিপার্টমেন্টের ছিলাম তখন আমরা, দেখতে সুন্দরী, হলো বন্ধুত্ব-বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, আর প্রেম থেকে বিয়ে।’

মনে মনে বিভৎসভাবে চাচ্চুকে উপহাস করতে ইচ্ছে হলো প্রিয়তার। দুনিয়াতে কত মেয়ে, হাজারো – লক্ষ কোটি মেয়ে। প্রেম আর বিয়ে করার জন্য কি তাকেই পেয়েছিলো? অভীর সাথে এখন প্রিয়তার বিয়ে হোক বা না হোক- আজীবন তার সামনে ঘুরঘুর করতে হবে। আর সেটা যে কতটা অস্বস্তির – প্রিয়তা তা ভাবতেই মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলো।

অভী এতক্ষণ ভূমিকা পালন করছিলো নীরব দর্শকের মতো। যেন গল্পের এই দৃশ্যপটে তার কোনো ভূমিকা দেওয়া হয়নি। তবে এখন মুখ খুললো সে। হাত ভাঁজ করে সংকীর্ণ কন্ঠে বললো,

‘ মা যদি জানে খালামণি যে তুমি না বলে কয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছো ভাবতে পারছো কি হবে?’

তিথী তাকালো ভাগ্নের দিকে। কথা বলার ধরন, চোখের দৃষ্টি অবিকল তার মায়ের মতো। বাবা তাহলে ঠিকই বলতো অভীর কথা। তিথী নিঃশ্বাস ফেললো। কথা পাল্টিয়ে বললো,

‘ সে নাহয় পরে দেখি। এখন এখান থেকে বের হই কেমন! তালপাকা গরমের মৌসুম না ; কিন্তু যেই গরম পড়েছে আমি নিজেই পেকে যাবো!’

তারপর হড়বড় করে নামলো সবাই। প্রিয়তা অদ্রি এখনও বিস্ময়ে, তবে সেই বিস্ময়ভাবের সীমারেখা রুদ্রর মধ্যে নেই। ছেলে হিসেবে সে খুব দ্রুতই এসব কাটাতে পারে। ওদের দাঁড় করিয়ে বেবিট্যাক্সি আনতে গেলো রুদ্র। পুলক তিথী ওদের সাথেই দাঁড়িয়ে আছে। তখনই মোবাইল নিয়ে ওদের পাশে দাঁড়ালো অভী। দৃষ্টি বিন্যস্ত মোবাইল স্ক্রিনে। পুলক এবার বললো,

‘ কিরে বুড়ী তোর নাকি নুরুল স্যারের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হলো? এটা সেই অভী না রে!’

হঠাৎ সবার সামনে ‘বুড়ী’ বলাতে ভীমড়ি খেলো প্রিয়তা। লজ্জায় কোনঠাসা হয়ে গেলো ওর মন। চাচ্চু এমন কেন? নতুন বউ, অভীর সামনে এভাবে এত বড় ধেড়ি মেয়েকে বুড়ী বললে তার বুঝি লজ্জা লাগে না? প্রিয়তা মিহি কন্ঠে প্রতিউত্তর দিলো,

‘ হুম।’

চোখে কৌতুহল জেগে উঠলো পুলকের। চকমক করছে অদ্ভুতভাবে। পকেট থেকে লাইটার বের করে একটা সিগারেট ধরালো সে। তিথী আগুন ধরিয়ে দিতে সাহায্য করলো। এজন্যই তিথীকে ভালোলাগে পুলকের। অন্য চার পাঁচটা মেয়ের মতো বিয়ের পর অধিকার দেখাতে আসে না। বললো,

‘ আগেই বুঝেছিলাম, ছোট ভাবি আই মিন তোর মা অভীর যেভাবে পাই টু পাই বর্ণণা দিয়েছিলো, ছেলেটা খাপে খাপ মিলে গেছে। তার ওপর আমার প্রাক্তন শিক্ষক নুরুল স্যারের ছেলে, চেনা জানা তো একটু হবেই।’

কথাটা মন্দ বলেনি পুলক। নুরুল স্যার আজ প্রায় ২০ বছর ধরে কলেজে পড়াচ্ছেন, পুলক আর প্রিয়তা অদ্রির মতো অজস্র স্টুডেন্ট সে পড়িয়েছে এই চট্টগ্রামে। বাবার জন্য অভীর আরও একবার গর্বে বুক ফুলে গেলো৷ তবে তাজ্জব হলেও এই যে অভী হয়েছে অবিকল তার মায়ের মতো। অল্পভাষী, চোখে প্রগাঢ়তা সবমিলিয়ে সবাই বলবে, ‘এ সেলিনার ছেলে!’

অভী দাঁড়ালো প্রিয়তার পাশে। বুক দ্রিমদ্রিম করে উঠলে মেয়েটার। অভীর কাছাকাছি থাকলেই এমন হয়, সবসময়ই হয় যখন সে কাছাকাছি থাকে। তবে শক্ত হলো প্রিয়তার চোখমুখ। তাকে দেখলেই অপমানগুলোর কথা মনে পড়ে বারবার। তিথী তা দেখে বললো,

‘ বাহ! অভী দেখি এখনই কেয়ার করা শিখে গিয়েছে। বলতে হবে প্রিয়তার সাথে দারুন মানাবে।।তাই না পুলক?’

অভী খেয়াল করলো প্রিয়তার মুখ। বিবর্ণ হয়ে আছে। তিথীর কথায় টু প্রতিশব্দ করলো না। অন্যসময় হলে প্রতিক্রিয়া দেখাতো। আরও একবার স্পষ্ট প্রতীয়মান হলো ঠিক কতটা হেয়ালি করার চেষ্টা করছে সে অভীকে। অদ্রি দেখলো অভীর কার্যকলাপ। কনুই দিয়ে তাকে গুঁতা মেরে বললো,

‘ শুনুন অভী ভাইয়া, আমার বোনকে এখন টু পরিমাণ জ্বালাবেন না। সেদিন ওর সাথে কি করেছিলেন ভুলিনি কিন্ত। ডিসিশন ফাইনাল, আপনি আমার কোনো দুলাভই টুলাভাই হবেন না। যত ভয়াবহ ধরনের ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানিরা পূর্ববঙ্গ হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিলো তার থেকেও ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করে প্রিয়তার সাথে আপনার বিয়ের ভাঙানী দিবো। ফেইস টু ফেইস থ্রেড। বুঝলেন?’

অভীর হঠাৎ হাসি এসে পড়লো অদ্রির গম্ভীর ধরনের কথায়। বোনের সাথে শালীসাহেবাও পাল্টি খেয়েছে। হাসিটা আড়ালে রেখে অদ্রির দিকে তাকালো অভী। তবে সমানতালে সংকীর্ণ কন্ঠে বললো,

‘ দেখা যাবে!’

রুদ্র এসে পড়লো বেবিট্যাক্সি নিয়ে। তিথীকে নিয়ে পুলক প্রথম যাবে সাখাওয়াত ভিলাতে। নিজের পরিবারকে মানাতে খুব বেশি কষ্ট হবে না পুলকের। মা হারা ছেলে, খালামণির কাছেই পেয়েছে মায়ের আদর, খালাতো ভাইগুলোও তাকে নিজের ভাই মনে করতো৷ প্রিয়তাদেরও তাই সে কম স্নেহ করেনি। আজও বেকার পুলক- সংসার চলবে তিথী ঢাকায় যে চাকরি করছে সেই বেতনে, তবুও পুলক জানে ওর হাত খরচ দিতে কেউ বিপত্তি করবে না। সর্বোচ্চ শাসিয়ে কথা শুনাবে সাখাওয়াত ভিলার যমদূত রুদ্র অদ্রির বাবা ওরফে শাহেদ সাখাওয়াত। এই লোকের ভয়াবহভাবে চটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বেকার ছেলের এভাবে বিয়ে করে বউয়ের টাকায় খাওয়াটা শুনে পুলককে সর্বোচ্চ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও পুলক আজ পরোয়া করবে না৷ খালা আছে, সে ঠিকই সামলে নেবে তার শর্ট টেম্পার্ড বুড়ো ছেলেকে।

অভী বললো,

‘ তাহলে বাসায় গিয়ে কি বলবো আমি?’

‘ কিছু বলতে হবে না। আপাকে ফোন করে বল ট্রেন আসতে দেরি হবে। ততক্ষণে বাসায় যাবি না। সন্ধ্যার আগেই তোর খালুকে নিয়ে চলে যাবো!’..

বেবিট্যাক্সিতে বসে পড়লো সবাই। প্রিয়তাও অভীকে এড়িয়ে গেলো নীরবে। আর সেই এড়ানোটা পুলকের চোখ ঢাকা দিলো না। ভাইয়ের এই মেয়েটাকে ভালোভাবেই চেনে সে। হয়তে এখনও সহজ হতে পারেনি। আর অভীকেও দেখলে বোঝা না এ এক্সট্রোভার্ট না, মনের অনুভূতি মনেই চেপে রাখবে সে। পুলক বুঝলো এই দুজনের রসায়ন করতে হলে যা করার তাকেই করতে হবে। এজন্যই প্রিয়তার মা ডেকে পাঠিয়েছে তাকে।

বেবিট্যাক্সিতে ওঠার সময় খেয়াল হলো আর সিট নেই। রুদ্র সামনে, অদ্রি, পুলক আর তিথী পেছনে। প্রিয়তার বসা একেবারেই অসম্ভব। এটা হওয়ারই ছিলো। ওদের ধারনা ছিলো চাচ্চু যেহেতু একা আসবে অনায়াসেই চারজন হয়ে যাবে। তাই স্টেশনে আসার সময় কোনো গাড়ি ভাড়া করেনি৷

তিথী বললো,

‘ এমা! প্রিয়তা কোথায় বসবে তাইলে? আরেকটা ট্যাক্সি ভাড়া নিতে হবে তো!’

চিন্তার ভাঁজ পড়লো সবার কপালে। আর সে দুশ্চিন্তা উড়িয়ে পুলক বললো,

‘ আরে কোনো ব্যাপার না গিন্নিসাহেবা! ব্যাবস্থা হয়ে গেছে। এই অভী? এদিকে আসো তো!’

চলে যাচ্ছিলো অভী। এমন গলা হাকানোতে পেছনে ফিরলো। দেখলো পুলক ডাকছে। অভী এগোলো তাদের দিকে। জিজ্ঞেস করলো,

‘ ডেকেছিলেন?’

‘ হ্যাঁ, তুমি কিভাবে যাবে এখন?’

‘ বাইক এনেছি।’

‘ তাহলে তো ভালোই। প্রিয়তাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও তো! জায়গা হবে না এখানে!’

অভী কিঞ্চিত অবাক হলো। আশা করতে পারেনি কাঙ্খিত সেই সুযোগটা অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে যাবে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দেখলো ভড়কে গেছে মেয়েটা। চট করে বললো,

‘ প্রয়োজন নেই চাচ্চু। আমি রিক্সা দিয়ে যাবো!’

‘ প্রয়োজন না হলে প্রয়োজন বানিয়ে নে। অভীর সাথেই যাচ্ছিস তুই। কোনো কথা শুনবো না। নাইলে তোরে বুড়ি ছাড়া আর যেই কয়টা বিশ্রি নামে ডাকতাম সবগুলা এখানে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ডাকবো!’

বাধ্য হলো প্রিয়তা। নতজানু হলো মন। কৌশলে এড়িয়ে যাওয়াটা ব্যার্থ হয়ে দাঁড়ালো। চরমভাবে ব্যার্থ। চোখের সামনেই তাকে ভর্ৎসনা করে সা সা করে ছুটে গেলো গাড়ি। স্টেশনের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে রইলো দুজনে। অভী হাসলো। হাসলো জয়ের হাসি। এত এড়িয়ে যাওয়ার পরও শেষমেশ তার কাছে ধরা দিতে হলো ভেবে তা যেন গা চাড়া দিয়ে উঠলো। রাগে ব্রহ্মতালু ফেটে পড়লো প্রিয়তার। তবে কিছুই করার নেই। অভী বাইক নিয়ে এলো। রোদের প্রকটতা এড়াতে চোখে পড়লো কালো চশমা। নির্বিকারে বললো,

‘ বাইকে উঠো প্রিয়তা!’
.
.
.
.
.
#চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here