প্রিয়কাহন পর্ব -১৬+১৭

#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব – |১৬|

এক সুদর্শন যুবকের বাইকে ওঠার অভিজ্ঞতা প্রিয়তার এই প্রথম। আর এই যুবকটিও নাকি তার হবু বর। অভী যখন নির্বিকারে বললো, ‘বাইকে উঠো প্রিয়তা!’, মৃদু ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিলো প্রিয়তার দুর্বল হৃদয়। কোণঠাসা হয়ে উঠলো মন। একমুহূর্ত ইচ্ছে করেছিলো সমস্ত রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ ভেঙ্গে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু কেন করবে সে এমন? এইযে দু তিনদিন কেটে গেলো অভী কি একবারও প্রিয়তাকে সরি বলেছে? একবারও দুঃখ পেয়েছে মনে মনে? সরি তো দূরের কথা, প্রিয়তার ধারনা এই মানুষটা হয়তো অনুতপ্তও হয়নি৷ অথচ শুধু অভীই জানে প্রিয়তাকে নিয়ে সেদিনকার নিষিদ্ধ কল্পনার জন্য সেই খারাপ ব্যবহার কতটা তাকে বিদ্ধ করেছিলো।

অনিচ্ছা সত্বেও বাইকে উঠে বসলো প্রিয়তা। অন্যমনষ্কতার জন্য ওঠার সময় চেপে ধরলো অভীর কাঁধ। অভী হাসলো অগোচরে। বাইক স্টার্ট দিলো। প্রিয়তা মাঝখানে রেখেছে চীনের মহাপ্রাচীরের মতো দুরত্ব। অনায়াসে এখানে একটা নাদুসনুদুস মানব বসতে পারবে। অভী ভ্রু কুঁচকালো। পিছে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ মাঝখানে চীনের মহাপ্রাচীরের মতো বাংলাদেশ মহাপ্রাচীর স্থাপন করার পরিকল্পনা আছে? থাকলে বলো! প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে অধিবেশন করার জন্য আহ্বান জানাবো তাইলে।’

অভীর সুক্ষ্ম অপমানটা গায়ে গরম তেলের মতো ফটফট শব্দে ফুটে উঠলো প্রিয়তার৷ বিরাগ্য অনুভূতি বিদ্ধ করলো তাকে। চোখ ছোট ছোট করে বললো,

‘ ফালতু কথা বন্ধ করে বাইক স্টার্ট করুন!’

‘ ভেবে দেখো, এর আগেও পড়ে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ডিপার্টমেন্ট একাকার করেছো। আবার পড়ে হাত পা ভাঙলে এখানেই এতিম শিশুর মতো ফেলে চলে যাবো।’

রি রি করে উঠলো প্রিয়তার আত্মসম্মানে টুইটুম্বুর মন। নিজের কথা বজায় রাখার জন্য একচুলও অভীর কাছে ঘেঁষে বসলো না। অভী হতাশ হলো। এই মেয়েকে বশে আনতে বেগ পেতে হবে। অদ্রি থেকে ভালোই মিলিটারি ট্রেনিং নিয়েছে। অভীর মাঝে মাঝে রাগ হয় অদ্রির প্রতি৷ অসহ্য ধরনের রাগ৷ গল্প উপন্যাসের শালী সাহেবার মতো এই মানবীর মোটেও দুলাভাই ভক্তের অস্তিত্ব নেই। একে যে বিয়ে করবে, তার জীবন খণ্ডযুদ্ধে জর্জরিত থাকবে এটা নিশ্চিত।

প্রিয়তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাইক চালানোতে মগ্ন হলো অভী। প্রিয়তা হাফ ছাড়লো। অভী বিনাবাক্যে মেনে নেবে তা ভাবতে পারেনি। চট্টগ্রামের এলোমেলো পথ ধরে ছুটে চলছে বাইকটি। পথের বাঁকে বাঁকে চোখে পড়ছে ভুতূরে ধরনের পুরনো সেই ঐতিহ্যবাহী তরুগুলো। প্রিয়তার খেয়াল হলো পথটা একটু বেশিই আকাঁবাকা, বারবার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, দ্রুত যাচ্ছে বাইক। প্রিয়তার নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেতে হলো। এভাবে থাকলে নির্ঘাত সে পড়ে যাবে পেছন দিয়ে। অভীকে ধরার চিন্তা এলেও তা দ্রুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো। আচমকা রাস্তার মাঝে ব্রেক আসতেই প্রিয়তা সাথে সাথে থাকা খেলো অভীর পিঠের সাথে। ভয়ে খামচে ধরলো কাঁধ। অভীর তারপর বললো,

‘ আগেই বলেছিলাম! এবার বুঝলে তো!’

__________________

পুলকের ধারনা আসলেই সঠিক ছিলো। সে যে একেবারে বউ নিয়ে হাজির হবে এটা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়াই করে নি তেমন কেউ। যেন সবাই আগেভাগেই জানতো পুলকের দ্বারা সব সম্ভব। সাখাওয়াত ভিলাতে যখন সে ঢুকলো প্রথমেই মুখোমুখি হলো মানিকের মার। তাকে দেখিয়ে হাসিমুখে বললো,

‘ মানিকের মা! এই দেখো আমার সুন্দরী গিন্নিসাহেবা!’

তখনই হাতে থাকা থালা বাংলা ছায়াছবির মতো ঝনঝন শব্দ করে পড়ে গেলো নিচে। কাকের গলা হিসেবে এই লেনে মানিকের মার মতো ছুটা কাজের বুয়ার বেশ সম্ভ্রম আছে৷ সে আহাজারি কন্ঠে বললো,

‘ হায় হায়, ভাবিরা কই গো আফনারা? ও খালাম্মা- দেহেন আইপনার ভাইগ্না বিয়া কইরা বউ লইয়া আইসে!’

মানিকের মার ধারনা ছিলো অন্য চারপাঁচটা পরিবারের মতো বজ্রপাত পড়বে সাখাওয়াত ভিলাতে এবার। সবাই মিলে খুবই গম্ভীর সমাবেশ করবে একটা৷ বিচারে আসবে। তবে সে ভুলে গিয়েছিলো এ বাড়িতে এমন কিছু কখনোই হয়না। কারন নাটক এখন এখানকার নিত্যদিনের রুটিন।।প্রিয়তার দাদী যখন দেখলো তখন ছোট্ট করে ‘ওহ’ প্রতিউত্তর করে বিরক্তি সুরে বলেছিলো,

‘ বউ লইয়া খাম্বার মতো দাঁড়ায় আছোস ক্যান ব্যাটা? ভিতরে বয়।’

ঘটনা প্রিয়তা আর রুদ্র অদ্রির বাবার অফিসের ফোন পর্যন্তও গড়ালো। তবে তারাও এতটা হতভম্ব হলো না যতটা প্রিয়তা অদ্রি আর রুদ্র হয়েছিলো। রুদ্রর বাবা শুধু থমথমে গলায় বলেছিলো,

‘ বেকার থেকে বিয়ে করার খুব শখ হয়েছিলো মশায়ের তাই না? আমিও দেখবো কতদিন পা তুলে আরামে বসে খায়।’

অপমানটা হজম করে নিলো পুলক। খালার এই বড় ছেলের কাছ থেকে এমন শাসানো কথা শোনাটাই স্বাভাবিক। বরং স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেই অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াতো।

প্রিয়তা বসে আছে সোফার এককোণে। কিছুক্ষণ আগেই অভীর সাথে ফিরে এসেছে বাড়িতে। বউ – আদর করা হচ্ছে এখন তিথীকে। প্রিয়তা মা আর চাচী মিলে তিথীর সাথে শুরু করেছে রাজ্যের আলাপ। মানিকের মার মুখ ভার। আসন্ন ঝগড়াঝাঁটির কথা ভেবে মনে মনে পুষে রাখা নিষিদ্ধ আনন্দটা চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় মুখ পুদিনাপাতার মতো চুপসানো।
প্রিয়তা ডানদিকে তাকালো। অভী বসে আছে অরিনের পাশে। কি নিয়ে কথা বলছে বোধগম্য হলো না। অরিন প্রিয়তার ছোট বোন হলেও প্রিয়তার মতো না, পড়াশোনায় ভালো তবে কথা জমাতে বেশি ভালোবাসে। এখন অভীর সাথে এই তরুনি কি বিষয়ে আলাপ করছে কে জানে?

দাদী তখন বললো,

‘ এই প্রিয়তা অভীর জন্য শরবত নিয়া আয়? নাতজামাইটা কখন থেকে এভাবে বইসা আছে৷’

প্রিয়তা অপ্রস্তুত হলো। দাদীর অভীকে ‘ নাতজামাই’ বলাতে নিজের কাছেই অন্যরকম ঠেকালো। তাকালো সে অভীর দিকে। চমক খেলো। অভী তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ। ঠোঁটে চাপা হাসি। চোখে কাজ করছে কৌতুক। প্রিয়তা বুঝতে পারলে না অভীর এই আমূল পরিবর্তনের কারন। নতজানু হয়ে সে শরবত বানিয়ে নিয়ে এলো। এগিয়ে দিলো অভীকে। বললো,

‘ এই নিন!’

অভী নিলো। এক ঢোক গিলার পর সপ্রশ্নে তাকালো প্রিয়তার দিকে। ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘ শরবতে লবণ দেওয়া হয় জানতাম না তো?’

নয়ন জোড়া বিস্ফোরণে ফেটে পড়লো প্রিয়তার। লবণ মানে? অভীর ব্যবহারে অন্যমনষ্ক হয়ে শরবত বানানোর সময় সে কি সত্যি সত্যিই চিনির বদলে লবণ দিয়ে দিয়েছে? প্রিয়তার চাচী শুনে ফেললো এ কথা। প্রিয়তাকে চোখে পাকিয়ে বললো,

‘ শরবত বানানোর সময় মন কি চান্দে তুলে রেখেছিলি প্রিয়তা? ‘

সে শরবতের গ্লাস নিয়ে নিলো অভী থেকে। সলজ্জ হয়ে বললো,

‘ একটু অপেক্ষা করো অভী বাবা! ও হয়তো খেয়াল করে নি৷ আমি বানিয়ে আনছি।’

‘ প্রয়োজন নেই আন্টি। আপনি শুধু এক গ্লাস পানি দিন। আমাকে যেতে হবে একটু দ্রুত।’

অগত্যাই প্রিয়তাকে দিয়ে পানি পাঠালো বড় আম্মু। অভীর কাছে যাওয়ার পূর্বে প্রিয়তাকে শাসানো গলায় বললো,

‘ আর কোনো অকাজ করিস না কিন্তু। তোর মা এখনও খেয়াল করেনি তুই শরবতে চিনির জায়গায় লবণ দিয়েছিস। জানলে সবার সামনেই ধমকে বাড়ি তুলে ফেলত। এখন পানির গ্লাস দিয়ে চুপচাপ যা ছেলেটার কাছে। তাকে দরজা পর্যন্ত গিয়ে বিদায় দিয়ে আসবি। বুঝলি?’

‘ হুম।

‘যা তাহলে।

দরজায় কাছে অভীকে দিয়ে আসার সময় অভী হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। পকেট থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে ধরিয়ে দিলো প্রিয়তার হাতে। প্রিয়তা হতভম্ব হলো। বললো,

‘ কি এটা?’

‘চিনো না? এটা বাদাম।’

‘ বাদাম দিলেন কেন?’

অপ্রস্তুত হয়ে বললো প্রিয়তা। অভী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো না। গেটের বাইরে ভিড়ানো বাইকে বসে পড়লো। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দিলো গা জ্বালানো হাসি। বললো,

‘ বাদাম খেলে বু্দ্ধি খুলে ম্যাডাম। তোমার বুদ্ধি সহ মাথাটাও খুলবে। যখন তখন অন্যমনষ্ক হয়ে তাইলে চিনির জায়গায় লবণ দিতে পারবে না। বিয়ের আগে নিজের ফ্যামিলির মান ইজ্জত লুটলেও বিয়ের পর আমার মান ইজ্জত লুটার চিন্তাভাবনা করতে পারবে না।’

প্রিয়তা তিরিক্ষি মেজাজে তাকালো অভীর দিকে। বললো,

‘ আপনিও আমায় বিয়ে করার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিন। আপনাকে বিয়ে আমি করবো না। কিছুতেই করবো না৷ বিয়ে না করার জন্য যা করার সবই আমি করবো।’

‘ আর তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমার যা করা দরকার সেগুলো সবটাই আমি করবো। বুঝলে মিস.তাহমিনা প্রিয়তা? সো, অভিমানী মন নিয়ে আমায় ইগ্নোর করা যেমনটা তুমি করতে পারবে না তেমনি অদ্রির সাথে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী পদক্ষেপও নিতে পারবে না৷ অভী তার থেকেও দুই ডিগ্রি উপরে৷ হ্যাভ অ্যা নাইস ডে! ‘

শুকনো কাগজের মতো হয়ে গেলো প্রিয়তার তিরিক্ষি মুখ। হতভম্ব দৃষ্টি এড়াতে পারলো না। অভী তখন চলে গিয়েছে দৃষ্টিসীমানার বাইরে। লেন এখন নীরব, কোলাহলবিহীন৷ প্রিয়তা অদূরে দাঁড়ানো দেবদারু গাছের দিকে তাকালো। সেও যেন বিদ্রুপ করে বলছে,

‘ আশ্চর্য হচ্ছো কেন প্রিয়তা? ধৈর্য ধরো। আজ অভী ভয়াবহ দুটো কথা বলেছে। কাল চু’মুও খেয়ে ফেলতে পারে। অল দ্যা বেস্ট!’

.#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |১৭|

মাঝরাতের বর্ষণকে বলা হয় প্রেমের বর্ষণ। এসময় প্রকৃতি হয়ে যায় স্মিগ্ধ। চট্টগ্রামের মতো এলোমেলো পাহাড়ি শহরে সেই মুগ্ধতা যেন আরও চনমনে হয়ে ওঠে। বাতাসে হাসনাহেনার মতো প্রেমের ঘ্রাণ। প্রিয়তা নিভে যাওয়া আলোর মতো বারান্দার দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো। ঘড়ির কাটা বারোটায় হানা দিয়েছে। পেছনের খাটে স্তব্ধমূর্তির মতো বসে থাকা রুদ্র আর অদ্রি। অরিন নেই। সে পাশের রুমে গলা ফাটিয়ে ত্রিকোণমিতির সূত্রগুলো মুখস্থ করছে। কানে আসছে সেগুলো প্রিয়তার।

নীরবতার কাটিয়ে হঠাৎ অদ্রি বললো,

‘ অভী ভাইয়া সেদিন তোকে এত ভয়াবহ কথাগুলো বলে গেলো আর তুই জানাচ্ছিস এগুলো এখন?’

প্রিয়তা অবনত হলো। সবিস্ময়ে বললো,

‘ এগুলো আর যাই হোক তোকে বলার মতো কিছু না অদ্রি। তোকে আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই। পরে দেখা যাবে, এলাকার সদ্য ফুটে ওঠা বাচ্চারাও জানবে সেদিন উনি আমায় কি বলেছিলো।’

এমন কটুক্তি শুনে নাক ফোলালো অদ্রি। রুদ্র হাসছে। বললো,

‘ যাক! কাহিনী দেখি টার্ন খেলো মাম্মা। অভী ভাইয়ার মতো মানুষও পাল্টি নিলো। কত না বলতি, ব্যাটায় ঘাড়ত্যাড়া, নাকের ডগায় ইগো। কথা বলে না, হাসে না। আর সেই ব্যাটায় এখন তোকে যেভাবেই হোক, বিয়ে করবে বলে পণ করেছে। পুরাই জোস!’

‘ তোর জোসের মাথামুণ্ডু। শুন রুদ্র- আমি, এই অদ্রি থাকতে প্রিয়ুর বিয়ে ওই ঘ্যাড়ত্যাড়া ব্যাটার সাথে হবে না। তার সুদর্শন রূপ তুই ধুয়ে খা। কি পেয়েছে টা কি ওই শালায়? ইচ্ছে হলে সবার সামনে অপমান করে বেড়াবে, আর ইচ্ছে হলে ধরে বেঁধে বিয়ে করবে? মেয়েদের কি এরা মানুষ মনে করে না? তোরে কি বলবো? ছেলেমানুষদের জাতই হলো ছুইচ্চার জাত। একজন দিয়ে জীবনেও এদের পেট ভরবো না। আজ আমাদের প্রিয়ুরে তুলুতুলু করে রেখে ঠিকই তোর মতো অন্য মেয়েদের টাংকি মারবে।’

অদ্রির ছেলে বিদ্বেষী মনে এবার হানা দিলো ইতিহাসের রমনীর মতো বিদ্রোহ। আর অদ্রির প্রকোপে সায় দিলো প্রিয়তাও। রুদ্র হাজারটা বোঝানোর পরও প্রিয়তা কেন যেন সবকিছু ধাতস্থ করতে পারলো না। অদ্রি এবার বললো,

‘ শোন প্রিয়ু! আমি অভী ভাইয়ার ব্যাপারটা বুঝে শুনেই বলছি। অভী ভাইয়া ছেলে হিসেবে পার্ফেক্ট, বাট তোর জন্য না। যেই ব্যাটায় আমার জানুকে সবার সামনে ধমকে বেড়াবে তার সাথে কিছুতেই আমি বিয়ে হতে দিবো না। দরকার হলে বিয়ের দিন তাকে কিডন্যাপ করে বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে দিয়ে তার বন্ধু অন্তুর সাথে সুখের সংসার করবো, তবুও না।’

এভাবে কথা বলতে বলতে কেটে গেলো সময়। অদ্রির এখন যত সাহস দেখাচ্ছে, অভীর সামনে তা এক চুলও পারবে না এটা রুদ্র, প্রিয়তা দুজনেই ভালোমতো জানে। প্রিয়তা এবার পাশের রুমে গেলো। দেখলো অরিন পড়ছে এখন গভীর মনোযোগে, তারই পাশের রুমে যে ওরা তিনজনে বিরাট আলোচনার পর্ব শেষ করলো তার কোনো হদিস নেই। প্রিয়তা ঢুলুঢুলু হয়ে বললো,

‘ কিরে ঘুমাবি না?’

‘ এইতো আসছি। রুদ্র ভাইয়া চলে গিয়েছে? ‘

‘ হুম! ও এতক্ষণে ঘুমিয়েও গেছে মনে হয়।’

‘ অদ্রি আপু কই? আমি ওই রুমে পড়লে তো আপুর আর প্রেমালাপ হয় না ভালোমতো। তাই তো এ রুমে এসে পড়ছি রাতে। সেদিন কোন ছেলের সাথে নাকি কথা বলছিলো, আমি তখন টেবিলে বায়োলজি পড়ছিলাম। এসে কি ধমক! বললো, ‘ বায়োলজি এভাবে চিল্লিয়ে পড়বি না আমার সামনে!”

অরিনের অভীমানি কন্ঠে হেসে দিলো প্রিয়তা। বললো,

‘ আরে ওর কথা! এখন বই রেখে ঘুমাতে আয়। সন্ধ্যার পর থেকে দেখছি পড়েই যাচ্ছিস, এসএসসিতে গোল্ডেন পাইতে চাইলে পড়বি ভালো কথা। এজন্য নিজেকে এত হেয়ালি করবি?’

‘ আরে কাল পরীক্ষা আছে স্কুলে, বিকেলে তিথী চাচীর সাথে গল্প করার সময় তো মনেই ছিলো না একথা। জানলে এমন হতো না।’

লাইট অফ করে নিজেদের রুমে ঢুকলো দু’জনে। অদ্রি ঘুমুচ্ছে মরার মতো। ঘুমের মাঝে ভুত ভূত বলে চেঁচিয়েও উঠেছে। বৃষ্টির গতি কমেছে। পরিবেশ এখন শীতল, স্যাঁতসেতে। অরিন বললো,

‘ আপু, ঘুম আসছে না!’

‘ তোরও কি অদ্রির মতো প্রেম প্রেম পায় নাকি?’

‘ কি যে বলো? আমার দু’দিন বাদে পরীক্ষা আর এসবে সময় দিবো ভাবছো? আচ্ছা শুনো না? তোমার এরকম ফিলিং হয় না?’

‘ কি রকম?’

‘এইযে প্রেম প্রেম টাইপ ফিলিং? মাঝে মধ্যে অভী ভাইয়ার সাথে কথা হয়না লুকোচুরি করে?’

প্রিয়তার মনে বিস্ফোরণ ঘটলো। অরিন তো এমন মেয়ে নয়? তাহলে এসব কি বলছে?

‘ তুই কি মিথি নামের কাউকে চিনিস তোর স্কুলের? ‘

‘ চিনবো না কেন? তুমিই তো ওকে পড়াও। ‘

‘ ওর থেকে দশহাত দূরে থাকবি? কেন যেন মনে হচ্ছে ওর ভাইরাস তোর মাথায় ঢুকেছে।’

অরিন চোখ ছোটো ছোটো করে ফেললো। বুঝলো প্রিয়তা খানিকটা রেগে গেছে একথায়। ওর আগেই বোঝা উচিত ছিলো প্রিয়তা ওমন মেয়ে না৷ অদ্রি আপুর সাথে উঠেবসেও প্রিয়তার মধ্যে ওই ব্যাপারটা আসেনি। অরিন জড়িয়ে ধরলো আপুকে৷ বললো,

‘ আচ্ছা সরি। আর জীবনেও এমন প্রশ্ন করবো না। এখন চুলে বিলি কেটে দাও তো!’

প্রিয়তা হেসে আনমনে চুমু খেলো অরিনের কপালে।

________________

নন্দলাল সড়কে তুমুল ভীড়। স্কুল ছুটি হওয়াতে হুড়মুড় করে বেরোচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। কাঠফাটা রোদ। বিভৎস বাতাস। প্রিয়তা অপ্রতিভ হলো। ঘেমে নেয়ে একাকার হলো বেগুনি সুতির জামা। গাছের শুকনো পাতার ফাঁকফোকড়ে হানা দিয়ে আসা রোদ পড়ছে মুখ আর বাদামী চোখের ওপর। ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে ভেজালো বারকয়েক। তিক্ত লাগছে সময়। নাহ! মিথি তো বের হবার নামই নিচ্ছে না স্কুল থেকে।

জীবনে যতগুলো স্টুডেন্ট পড়িয়েছে, এই এক মিথিকে পড়িয়ে ওর জীবনের কষ্ট বেড়ে গেলো রেলইন্জিনের ধোঁয়ার মতো করে। আজ সকালে মিথির মা ফোন দিয়ে প্রিয়তাকে বলেছে স্কুলের অপজিটে বইয়ের দোকান থেকে ওর একটা বই কিনে দিতে। তিনদিন ধরে তিনি মিথিকে তাড়া দিচ্ছিলেন অথচ মেয়েটার কোনো রা শব্দ নেই।

বেশ কিছুক্ষণ পর এলো মিথি৷ প্রিয়তাকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসি দিলো। বই কিনতে সময় চলে গেলো আরও। তারপর মিথি হাহাকার কন্ঠে বললো,

‘ ও আপু একটা পেস্ট্রি টেস্ট্রি খাইয়ে দাও না? ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর ডিস্কো ডান্স করছে!’

প্রিয়তা ওকে নিয়ে মোড়েরই একটা শপে গেলো। কিনে দিলো চকলেট মিনি সাইজ কেক। তবে সেখানে গিয়ে আরও অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটলো। শান্তনু প্রিয়তাকে দেখে খুশিতে চেঁচিয়ে বললো,

‘ আরে বউমনি?’

কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। পেছনে ফিরে হতভম্ব হলো। শান্তনু দাঁড়িয়ে আছে, নাদুসনুদুস শরীরের পেছনে ঝুলানো স্কুল ব্যাগ। গাল গুলো লাল হয়ে আছে রৌদ্রে দৌড়াদৌড়ির কারনে। পাশে দাঁড়ানো তার হবু শ্বশুরমশায় ওরফে নুরুল স্যার। সবসময়ের মতো ফর্মাল লুক। চোখে চশমা। ভদ্রলোক রাগী মানুষ, কলেজে পড়াকালীন সকল ছাত্রছাত্রীরাই তাকে গম্ভীর বলে চিনতো৷ তবে প্রিয়তাকে দেখে তার ঠোঁটে প্রানবন্ত একটা হাসি। ঘটনা এখানেই শেষ হলেও পারতো। তবে প্রিয়তার ভাগ্য এখন চলমান উপন্যােসের পাতার মতো। অবাকতার রাজ্য হানা দিতে না দিতেই শপের দরজা দিয়ে ঢুকলো অভী। তার চোখের সানগ্লাস ইতিমধ্যে খুলে শার্টে ঝুলিয়ে রেখেছে। বিস্ময় ভাব অভীর চোখেমুখেও। তবে তার চেয়ে বেশি রম্য হাসি।

মিথি খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,

‘ বাব্বাহ! পুত্রবধূর ঠিকানা পেয়ে একই সাথে শ্বশুড় দেবর, বর সবগুলো উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। কাজি ডাকো আপু, এক্ষুণি বিয়ে সেরে ফেলো এই মুহূর্তকে স্মরণীয় বরণীয় রেখে। সাক্ষী নাহয় আমি থাকবো!’
.
.
.
.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here