প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩২+৩৩

#প্রিয়দর্শিনী🍂
#সুমাইয়া_যোহা

পর্ব-৩২

সুইমিং পুলে পা ডুবিয়ে মাহিম আর তিথি বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে তিথি, পান্থ, তরুনিমার পুরো পরিবার সহ রিসোর্টে এসেছে। এখানে ওদের বাকি অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিয়েও হবে। যেহেতু দুই ছেলের একসাথেই বিয়ে হবে তাই একসাথে করাটাই ঠিক হবে। ওইদিনের ঘটনার পরই পান্থ এক সপ্তাহের ভিতরে বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে বলে। কারন পান্থ ধারনা তরুনিমার সাথে ওর বিয়েটা ভাঙার প্ল্যান অনেকেই করছে। কিন্তু সেও হেরে যাওয়ার পাত্র না। সে যেটা করবে সেটা সে করবেই। মাহিম তিথিকে আসিফ শিকদারের ব্যাপারটা পুরো খুলে বললে তিথি অবাক কন্ঠে বলে-

: এসব কি বলছো তুমি মাহিম? তরু আপু যেন কিছুতেই এগুলো না জানে। আপুর কাছে নিজের আত্মসম্মান অনেক প্রিয়। আপু এগুলো জানলে আপু এই বিয়ে ভেঙে দিতে এক সেকেন্ডও ভাববে না।

: হুমম জানি। তাই তো তরুনিমাকে কিছু জানাতে পান্থ নিষেধ করেছে।

: ইসস.. ফাইনালি তরু আপুর লাইফেও কেউ আসলো। কিন্তু আমার কপালটাই ফুটা।

তিথি নিজের কপালে চাপড় দিয়ে কথাটা বলল। মাহিম তিথির এমন হতাশ ভাভে কথাটা বলায় সে হন্তদন্ত হয়ে বলল-

: তোমার কপাল ফুটা হলো আবার কোনদিক থেকে?

: ফুটা হবে না! এই এমন একটা আনরোমান্টিক জামাই আমার কপালে জুটেছে।

: আমি আনরোমান্টিক? ব্যাড জোকস! হাহ..

: ব্যাড জোকস না। উচিত কথা বলেছি। ওই যে দেখো পান্থ কতো কি সুন্দর করে তরু আপু চুলগুলো ঠিক করে দিচ্ছে। নিজের ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু তো শিখতেও পারো।

: এহহহ… তোমার কপাল ফুটা হলে আমার কপাল মনে হয় স্বর্ণ দিয়ে বাধাই করা! তরুনিমা তো পান্থর জন্য পায়েস বানিয়ে এনেছে। আর তুমি আজ পর্যন্ত একটা কিছুই বানিয়ে খাওয়ালে না। হুহ…

: আহালে.. অনেক কষ্ট বুঝি। তাহলে একটা কাজ করো আমাকে বিয়ে করার দরকার কি? আমি তোমাকে বিয়ে করবো না! যাও…

তিথি মুখ ফুলিয়ে ওপাশ ফিরে হাত গুটিয়ে বসে রইল। তিথি ভেবেছিল মাহিম হয়তো ওর রাগ ভাঙাবে কিন্তু না তিথির সেই ভাবনাতে সুইমিং পুলের সব পানি ঢেলে দিয়ে মাহিম কলে গেল পান্থ আর তরুনিমার কাছে।

তরুনিমা আর পান্থ সুইমিং পুলের পাশে মোজাইকের ছোট গোল টেবিলের পাশে মোজাইকের টুলের উপর বসে আছে। তরুনিমা পান্থর সামনে একটা বক্স এগিয়ে দিলে পান্থ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তরুনিমার দিকে তাকালো। তরুনিমা পান্থকে বক্স খুলতে বললে পান্থ বক্সটা খুলেই খুশিতে গদগদ হয়ে তরুনিমার দিকে তাকালে তরুনিমা মৃদু হেসে বলল-

: টেস্ট করে দেখুন। আপনার ফেবারিট পায়েস।

: আমার পেট খারাপ হবে না তো? আর ইউ সিউর?

: এতোই যেহেতু সিউর লাগাচ্ছিস! তোর খেতে হবে না! আমি খাবো আমাকে দে!

টেবিলের সামনে এসে মাহিম কথাগুলো অকপটে বলল। পান্থ পায়েসের বক্সটা এক সাইডে সরিয়ে নিতে মাহিম ধমকের সুরে বলে উঠে-

: এই পান্থ! এখন সরাচ্ছিস কেন? তরুনিমা এতো কষ্ট করে পায়েস বানিয়ে এনেছে। সকাল বেলা আমি চাওয়াতে আমাকেও দেয় নি। এখন আবার তুই সন্দেহ করছিস। তোর খাওয়া লাগবে না। আমি খাবো।

তরুনিমা নিজের হাসি থামিয়ে রেখে পান্থর থেকে বক্সটা নিয়ে মাহিমের হাতে দিয়ে রাগান্বিত সুরে বলল-

: ঠিকই বলেছে মাহিম ভাইয়া। আপনার তো আমার খাবার খাওয়া নিয়ে ডাউট হচ্ছে, তাই না? তো আপানর খাওয়া লাগবে না। মাহিম ভাইয়াই খাবে। ভাইয়া এই নিন চামচ।

মাহিম চামচ দিয়ে পায়েস মুখে দিয়ে মধুর সুরে বলল-

: আহা…! উমমম…. অনেক মজা হয়েছে তরুনিমা। জাস্ট এক কথায় দুর্দান্ত! তবে একটু এলাচির ফ্লেভারটা দিলে আরো ভালো লাগতো। যদিও তুমি পান্থর খাওয়ার হিসেব মতো বানিয়েছো। কিন্তু আমার ভাই তো আর খাবে না। আমিই খাই। উমমম…

মাহিম টুলে বসে আয়েস করে পায়েস খেতে নিল। পান্থ এদিকে একবার তরুনিমার দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আবার মাহিমের পায়েসের খাওয়া দেখে। ওর যেন বড্ড লোভ হচ্ছে। কিন্তু মাহিম দুইচামচের বেশি আর খেতে পারে নাহ। মাহিমের পায়েস খাওয়ার মাঝে তিথি আগমন ঘটে। তিথি কোমরে হাত গুজে দিয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহিম তিথির ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিল। মাহিম একটা শুকনো ঢোক গিলে পান্থর হাতে পায়েসের বক্সটা দিয়ে বলল-

: নে ভাই তুই খা। আমার খাওয়া হয়ে গেছে। একটা ইমপর্টেন্ট কল করতে হবে আমি আসছি।

পান্থর মাথায় হাত বুলিয়ে তিথি দিকে তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে মাহিম পকেট থেকে ফোন বের করে আপাতত কেটে পড়ে। পান্থ বিষয়টা বুঝতে পারল না। এদিকে খেয়াল করে দেখল তরুনিমাও তিথির সাথে কাজের বাহানা দিয়ে চলে গেল। পান্থ কোনোকিছুই বুঝতে না পেরে পায়েস এক চামচ মুখে দিতেই নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। এই হাসিটা খুবই অদ্ভুদ, যার রহস্যটা পুরোই অজানা পান্থর নিকট।

————————————————————

তিথি আর আমি একসাথে বাড়ির ভেতরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। রিসোর্টের মাঝেই সুন্দর একটা বাংলো বাড়ি রয়েছে। সেখানেই আমাদের সবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করতেই এক চেনা পরিচিত কন্ঠসর শুনতে পেলাম। সেই কন্ঠসরটা শুনে যেন সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভেতরটা ধক করে উঠে আমার। তিথি আমাকে হালকা ঝাকাতেই আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি।

: কি হয়েছে তোমার তরু আপু? হঠাৎ থেমে গেলে যে। তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? পান্থকে ডাক দিব?

তিথি চিন্তা মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলে আমি ওকে আশ্বস্ত করে ঠোঁটে না চাইতেই সামান্য হাসি ফুটিয়ে বলি-

: আরেহ না। উনাকে ডাকতে হবে। আমি ঠিক আছি। চলো ভেতরে যাওয়া যাক।

আমি তিথির সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে যে আমার কান অবদি যে কন্ঠস্বরটা এসে পৌঁছেছে সেটা যেন ভুল হয়। অন্যকারো কন্ঠস্বর যাতে হয়। কিন্তু না আমার কান কোনো কিছু ভুল শুনেনি। সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে খারাপ লাগার থেকেও বেশি এখন ভয় লাগছে। কারন এই মানুষটা একসময় আমার বেস্টফ্রেন্ড বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। আবার নতুন করে কোনো কিছু ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে না তো আমার জীবন থেকে?

সৃষ্টিকে হুট করে দেখে তরুনিমা যেন থম মেরে সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর পা সামনে এগুচ্ছে না আবার পিছনেও না। সৃষ্টি তরুনিমার কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলে সবাই খুব অবাক হয়। সাথে তরুনিমা নিজেও। তরুনিমা নিজের হাত দুটো মুঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। সৃষ্টি তরুনিমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল-

: কিরে কেমন আছিস, তরু? মাই অন এন্ড অনলি ডিয়ার বেস্টফ্রেন্ড।

: বেস্টফ্রেন্ড?

আমি পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে পান্থ পকেট হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনিই সরাসরি প্রশ্নটা ছুড়ে মারেন। সৃষ্টি আমাকে পাশ কাটিয়ে পান্থকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলে আমি অবাকের শেষ পর্যায় চলে যাই।

: কেমন আছো ভাইয়া?

: আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। কিন্তু তুই কাকে বেস্টফ্রেন্ড বলছিস?

: আর কাকে বেস্টফ্রেন্ড বলব! আমার লাইফে তো তরুনিমাই আমার বেস্টফ্রেন্ড। আমরা একসাথে স্কুল কলেজ ভার্সিটি শেষ করলাম। কতো স্মৃতি.. আহা!

সৃষ্টি এমনভাবে আমাকে আজ ওর বেস্টফ্রেন্ড দাবি করছে যেন সত্যি সত্যিই আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড ছিলাম। হায়রে মানুষ! আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির ব্যবহার আর মধুর কথাগুলো শুনছি।

: আচ্ছা তরু আপু, এই সৃষ্টি মেয়েটা কি আসলেই তোমার বেস্টফ্রেন্ড?

তিথি আমার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কথাটা বলল। আমি ওকে কি জবাব দিব সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু এরচেয়েও বড় বড় অজস্র প্রশ্ন আমার মাথায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। মাহিম ভাইয়া সেখানে উপস্থিত হয়েই বলল-

: আরে সৃষ্টি যে! কেমন আছিস তুই? আর মামা-মামী, তোর শ্বশুর-শাশুড়ি এবং সবচেয়ে ইমপর্টেন্ট বিষয় তোর বর কোথায়?

মাহিম ভাইয়ার মুখে সৃষ্টির বরের কথা শুনে যেন এবার আমার ভেতরটা পুনরায় ধক করে উঠল। যতোই অতীতকে ভুলতে চাই, পুরোনো ক্ষতগুলো যতোই সেরে উঠতে খুব কি দরকার হয় সেগুলোকে নতুন করে আবার ক্ষতের সৃষ্টি করার। সৃষ্টি এসেছে তারমানে নুহাশও আসবে তাতে কোনো পরিমাণ সন্দেহ নেই। সৃষ্টি যে পান্থ আর মাহিম ভাইয়ার সম্পর্কে মামাতো বোন সেটাও আমার আর বুঝতে বাকি রইল। সৃষ্টি মাহিম ভাইয়া প্রশ্নে জবাবে বলল-

: আরেহ ভাইয়া আসবে আসবে। সব আসবে। শ্বশুর তো চারমাস হলো মারা গেছেন। তারপর থেকে শাশুড়ি মা একটু অসুস্থ থাকেন। যদিও বাকি সবাই থাকে কিন্তু তাও নুহাশ ওর মার জন্য অনেক সেনসেটিভ তাই নুহাশ উনার টেক কেয়ার করছে। এসে পড়বে ও ডোন্ট ওরি।

: তুই তো নুহাশের ওয়াইফ। তাহলে তোরও দায়িত্ব তোর শাশুড়ি মায়ের টেক কেয়ার তুই চলে এলি একাএকা।

পান্থ অকপটে কথাটা বলে দেয় সৃষ্টিকে। সৃষ্টি পান্থ কথার বিপরীতে কি বলবে তা যেন ওর ভাবতে হচ্ছে। অমায়িক হাসি দিয়ে বলে-

: আমি জোর করেছিলাম। কিন্তু নুহাশই বলল আমি যেন এসে পড়ি। বড্ড বেশি ভালোবাসে তো আমায়।

সৃষ্টির শেষের লাইনটুকু শুনে ভেতর একটা ছোট নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। তবে আজ যেন এসব কথায় কোনোরকম কষ্ট কিংবা ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না আমার। তবুও কিছুটা হলেও ভার ভার মনের উপর। মাহিম ভাইয়া তিথির সাথে সৃষ্টির পরিচয় করিয়ে দিলেন। সৃষ্টি যেন আজ পুরোটা দিন আমার সাথে আঠার মতো লেগে আছে। এটা ওটা নানান কথা বলে যাচ্ছে সে। আমি কোনো কথাই বলছি না প্রয়োজনের বাইরে।

সন্ধ্যার সময়ে সবাই মলে ড্রয়িং রুমে বসে বিয়ের সব কেনাকাটা আর রিচুয়ালসের ব্যাপারে আলোচনা করছে। অন্তু সৃষ্টির ব্যাপারে সব জানতো। সৃষ্টিকে দেখে অন্তুর রাগটাকে সামলে নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু পান্থ, উনি তো বলেছিলেন উনি সব জানেন। হুমম জানেন… তবে কতোটুকু জানেন উনি? আদৌ কি সব জানেন? সৃষ্টির এতো মধুরভাবে কথা বলা নতুন কোনো ঝড় বয়ে আনবে না তো?
#প্রিয়দর্শিনী
#সুমাইয়া_যোহা

পর্ব-৩৩

প্রচন্ড শীত আর সেই সাথে ঝিরঝির বাতাস বইছে। ব্যালকনির রেলিং এর পাশে ঠেস দিয়ে বসে আছে তরুনিমা। নিঘুর্ম একটা রাত কেটে গেছে তরুনিমার। মনকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছে না সে। ফজরের আযান দিতে এখনো কিছুটা সময় আছে। পাতলা একটা চাদর পুরো দেহে মুড়িয়ে দিয়ে আছে। ব্যালকনির বাইরে চোখ পড়তেই লক্ষ্য করে পান্থ হুডি পরে ডার্ক গ্রে কালারে টাউজার পরে বাইরে পায়চারি করছে। তরুনিমা কোনো কছু না ভেবে এক বার ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল তিথি পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। সে গুটিগুটি পায়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

পান্থর লনে পায়চারি করছে। ওর যেন ঘুম আসছে না। আজকের শীতটাও খুব প্রখর পড়েছে। কিন্তু গরম কাপড় পরে থাকায় শীতটা কমই লাগছে ওর। হাটার সময় ব্যালকনিতে তরুনিমাকে পান্থর লক্ষ্য করেছে ঠিকই যার ফলে পান্থর কিছু চিন্তা হচ্ছে। নিজের পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই পান্থ পিছন না ফিরেই সেই অজ্ঞাত মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল-

: এখনো ঘুমাও নি কেন তরু?

তরুনিমা খানিকটা বিস্মিত হলো কারন পান্থ ওর দিকে না ফিরে কিভাবে বুঝতে পারলো যে সেটা ও। কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে হলো পান্থ একসময়ের বলা সেই কথা-

: তোমাকে ভালোবেসেছি তরুনিমা আমি। তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ, হৃদস্পন্দন আমার চিনতে সময় লাগে না। তাই তুমি অনেক কিছু না বললেও বুঝি। তোমার উপস্থিতি আমার মনের এক কোণে অন্যরকম অনুভূতির কাজ করে যা অন্যক্ষেত্রে আমি অনুভব করি না। তাই তুমি যদি আমার আড়ালেও থাকো আমি বুঝতে পারবো।

: কি হলো? সারারাত ঘুমাও নি কেন?

পান্থর কথায় তরুনিমা হুশ আসলে তরুনিমা চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। ব্যালকনি থেকে পান্থর পিছনটুকুই সে দেখেছিল। সামননে থেকে যে মানুষটাকে এমন ভাবে আবিষ্কার করবে সে বুঝতে পারেনি। গ্রে কালারে হুডির ভেতর মানুষটাকে অন্যরকম লাগছে। চোখে আজও চশমা পড়েনি পান্থ। সেই চতখের অতই গভীরে ডুব দিতে মনে চাচ্ছে ওর। মাথায় পরে থাকা টুপিটার জন্য একগুচ্ছ চুল সামনে এসে পড়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠে এসে চুলগুলোও ঠিক করতে ভুল গেছে মি: শিমপাঞ্জি। পান্থ তরুনিমার অনেকটাই কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তরুনিমা নিজের অজান্তেই পান্থর কপালে হাতে দিয়ে চুলগুলো ঠিক করতে থাকে। পান্থ তরুনিমার এমন ব্যবহারে কিছুটা ভড়কে যায়। কিন্তু পান্থর বিষয়টা খুব ভালো লাগে। হুট করেই তরুনিমার বরফের মতো ঠান্ডা হাতগুলো ওর কপালে স্পর্শ পাওয়া সে কিছুটা বিরক্ত অনুভব করলেও বুঝতে দেয় না। সে তরুনিমার হাতগুলো ছুতেই তরুনিমা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে থতমত খেয়ে যায় একটু আগের ঘটনায়। পান্থ তরুনিমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে-

: ব্যাপার কি তরু? আমাদের বিয়ে ভাঙার কোনো প্ল্যান আছে নাকি তোমার?

পান্থর এমন প্রশ্ন তরুনিমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। তরুনিমা কাপাকাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে-

: এগুলো কি বলছেন আপনি? আমি এগুলো ভাবতেও চাই না।

: সিরিয়াসলি! তাহলে তোমার হাত এতো ঠাণ্ডা কেন? তুমি তো নিজেও অনেক কাপছো। উপর থেকে পাতলা একটা চিদর গায় দিয়েছো। জ্বর বাধাতেই চাও নাকি?!

অত্যন্ত রাগান্বিত সুরে পান্থ কথাগুলো তরুনিমাকে বলে। পান্থ তরুনিমাকে নিয়ে অনেকটা আতঙ্কে থাকে। আসিফ শিকদার আর রিন্তার কারনেই তরুনিমার সাথে ওর বিয়ের ডেট এতো এগিয়ে এনেছে ও। হুট করেই তরুনিমাকে নিয়ে পান্থ নিজের ঘরে নিয়ে আসে। তরুনিমা অনেক কাপছে। সে তরুনিমার উপর বেডে থাকা ভারি ব্ল্যানকেটটা দিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তরুনিমা বারন করলে কে শুনে কার কথা। তরুনিমা গুটিসুটি হয়ে পান্থ কাছে সাথে মিশে থেকে বলে-

: একটা কথা জিজ্ঞেস করি। সত্যি করে বলবেন তো?

পান্থ যেন তরুনিমার বলার আগেই বুঝে ফেলেছে ও কি বলতে চায়। পান্থ তরুনিমাকে আশ্বস্ত করে বলে-

: আমি জানি তরু তুমি কি জানতে চাও। তোমার অতীত সম্পর্কে আমি কতোটুকু জানি বা আদৌ কি আমি সঠিক জানি নাকি ভুল জানি সেগুলোর হিসেব মিলাতে হবে না তোমায়। তোমার বিয়ে হচ্ছে তুমি এনজয় করো। এসব চিন্তা করে শরীর খারাপ করার দরকার নেই। এতোটুকু জেনে রাখো পান্থ শাহিরিয়ার যাকে ভালোবাসে একমাত্র তাকেই ভালোবাসবে এবং সে যা বলেছে তাই করবে। সেটার হেরফের হবে না।

তরুনিমা চুপচাপ পান্থর কথাগুলো শুনছে। পান্থ তরুনিমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল-

: আমি তোমাকে কোনোভাবেই হারাতে চাই না তরু। যেভাবেই হোক এই অধম তার প্রিয়দর্শিনীকে তার ভালোবাসার মায়াজালে আবদ্ধ করে রাখতে চায় সারাজীবন। আর সেও তার প্রিয়দর্শিনীর মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চায়। ভালোবাসি তরু! ভালোবাসি!

পান্থর কথাগুলো আর এই উষ্ণতা তরুনিমার মনে এক প্রশান্তির দোলা দিয়ে গেল। সে আর কিছু ভাববে না এসব বিষয়ে। এই পান্থ নামক মানুষটা যে একান্ত তার সে আজকে তার প্রমাণ পেয়েছে। আর সে এই মানুষটাকেই আকড়ে ধরে বাকিটা সময় পেরিয়ে যাবে এটাই তার প্রত্যাশা।

——————————————————-

ঘড়িতে দশটা বেজে বিশ মিনিট। আসিফ শিকদার আর মিসেস আরিফা ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছেন। তাড়াহুড়ো করে সিড়ি বেয়ে রিন্তা নেমে এসে মিসেস আরিফাকে বিদায় দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে আসিফ শিকদার মেয়েক পিছ ডাকেন। বাবার কথায় রিন্তা থেমে গিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে-

: কিছু বলবে পাপা?

: এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো? তোমার তো আজকে অফ ডে তাই না?

: পান্থ ও আহসান আঙ্কেলে কাছে যাচ্ছি ক্ষমা চাইতে।

রিন্তা অকপটে কথাগুলো বলল। আসিফ শিকদার নিজের মেয়ের কথায় খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলেন-

: ক্ষমা চাইবে? কেন মামনি? তুমি তো কোনো ভুল করো নি তাহলে ওদের কাছে ক্ষমা চাইবে কেন?

: ক্ষমা এইজন্য চাইবো কারন আমার পাপা যেই প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল সেইটা ছিল ভুল। আর সেই ভুলটা আমার পাপা আমার জন্য করেছে। আমি দায়ী এর জন্য।

: এইসব কি বলছো তুমি রিন্তা? তুমি পান্থকে ভালোবাসো আর…

রিন্তা আসিফ শিকদারকে পুরো কথা শেষ করার আগেই সে বলল-

: হুম পাপা ভালোবাসি কিন্তু এতোটাও প্রখর নয় যে তাকে ভুলতে পারবো না।

রিন্তা একটু থেমে ওর পাপার হাত ধরে আবার বলল-

: পানি যেমন করে চাইলেও আমি আমার হাতের মুঠো ধরে রাখতে পারবো না, ঠিক একইভাবে যে মানুষটা আমার নয় তাকে আমি শত আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করলেও তাকে আমি নিজের করতে রাখতে পারবো না। সুযোগ পেলে সে একদিন না একদিন বেরিয়ে চলে যাবেই। পান্থ তরু আপুকে ভালোবাসে সেখানে আমি কেউ হই না তাদের সম্পর্ক ভাঙার। হ্যাঁ চেয়েছিলাম তরু আপু সাথে যাতে পান্থর বিয়ে না হয় কিন্তু পাপা এনগেজমেন্ট ডের দিনই লক্ষ্য করেছিলাম পান্থর খুশি তরু আপুর মাঝে সীমাবদ্ধ, যা এতো বছরে পান্থকে আমার সাথে দেখেও আমি অনুভব করেনি। সে শুধু আমাকে বন্ধুই ভেবেছে। আর এই বন্ধুত্বটাকে আমি নষ্ট হতে দিতে চাই না। রাগ আর জেদে আমার তখন কোনো কিছুই ভাবতে ইচ্ছে হয় নি। কিন্তু পরে বুঝতে পারি যে আসলে ঠিক কোনটা। তাই পাপা প্লিজ আজকে আর আটকিও না। আর আই এম স্যরি পাপা এন্ড মামা। অনেক জ্বালিয়েছি তোমাদের।

মিসেস আরিফা এতোক্ষণ বাবা আর মেয়ের কথোপকথন শুনছিলেন। তিনি মনে মনে অনেকটাই স্বস্তি পেলেন কারন তার মেয়ে তার কথাগুলো বুঝেছে। মিসেস আরিফা সময় করে মেয়ের ঘরে গিয়ে মেকে ঠান্ডা মাথায় সব বুঝান। একজন মা হিসেবে তিনি কখনোই তার কর্তব্য পালনে অকৃতকার্য হন আজ সেটা আবারও তিনি প্রমাণ করলেন। মিসেস আরিফা মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন-

: এসব কি বলছো তুমি রিন্তা? তুমি আমাদের মেয়ে ভুল হয়েছে বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক আর কিছু লাগবে না। বরং আমরাও যাবো তোমার সাথে আহসান ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাবো। আমাদের জন্য এমন একটা পরিস্থিতিতে তারা পড়েছে। কি লো আসিফ?

: হুমম.. আজকে অনেক খুশি লাগছে আমার বাচ্চা মেয়েটা যে অনেক বড় হয়ে গেছে। বুঝতে শিখছে সব। দোয়া করি ভালো থাকো। অনেক অনেক দোয়া রইল তোমার এই পাপার পক্ষ থেকে।

আসিফ শিকদার তার মেয়েকে নিয়ে গর্বিত বোধ করছেন। তারই সাথে এটাও বুঝতে পেরেছেন যে এসববের পিছনে তার স্ত্রীর ভূমিকা রয়েছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে সন্তানের ভালোমন্দ বুঝানো এবং লালন-পালনে মা-বাবা দুজনেরই দায়িত্ব রয়েছে।

#চলবে____

(।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here