প্রিয় পর্ব ২

“প্রিয়”

২.
সকালের দিকে ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসবশত রান্নাঘরের দিকেই যাচ্ছিলো পিহু। দরজার বাহিরে পা রাখতেই ওমনি ধমক দিলেন আনোয়ারা বেগম। পিহু চমকে পিছনে ফিরে তাকাতেই চোখ রাঙালেন তিনি। এরপর আর বের হতে দেয়নি রুম থেকে। এখন খাটে বসে অস্থির হয়ে আছে পিহু। ওদিকে মানুষটা কি করছে কে জানে? তাছাড়া ইশপিকে খাওয়ানোর সময় হয়ে গেছে। রাতে বাবা-মেয়ে দুটো কিভাবে ছিলো সেই চিন্তায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি বেচারি।

মনটা বারবার ছটফট করছে একটু গিয়ে দেখে আসার জন্য। কিন্তু শ্বাশুড়ির ভয়ে যেতে পারছে না। তিনি সোফায় বসে বই পড়ছেন। কঠিন স্বরে বলেছেন বাইরে গেলে খবর আছে পিহুর। পিহু এবার ইতস্তত করে বললো,

— “মা!”

আনোয়ারা বেগম বই রেখে মাথা তুলে পিহুর দিকে তাকালো। পিহু ঘাবড়ে গেছে। তবুও সাহস সঞ্চয় করে বললো,
— “হঠাৎ করে উনার কি হয়েছে? আর আপনিই বা কেনো উনাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন?”
— “আক্কল লোপ পেয়েছে। সেটাকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এই পথ বেছে নিতে হয়েছে আমার।”
— “মানে?”
— “তোর এতো মানে বুঝে লাভ নেই। রাতে তো ঘুমাস নি। এখন ঘুমিয়ে পর। ওহ নাস্তা করা তো বাকি আছে। নাস্তা করে তারপর ঘুমাবি।”

কথাগুলো বলতে বলতে তিনি উঠে দাড়ালেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাক ছেড়ে বললেন,
— “আজকে কি নাস্তা পাবো? নাকি উপোস থাকতে হবে?”

পিহু বোকার মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে শুধু। কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ইমন ঘেমে-নেয়ে নাস্তার প্লেট টেবিলে রেখে তার মাকে বললো,

— “নাস্তা রেডি। তোমরা খেতে এসো।”

আনোয়ারা বেগম পিহুকে নিয়ে গিয়ে টেবিলে বসলেন। পিহু একবার ইমনের দিকে একবার আনোয়ারা বেগমের দিকে তাকাচ্ছে। আনোয়ারা বেগম পিহুর প্লেটে পরোটা তুলে দিয়ে নিজেও নিলেন। ইমন একপাশে কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মা একবারো তাকে বসতে বলছে না তাই খারাপ লাগছে। ইমন অবচেতন মনেই নিজেকে প্রশ্ন করলো ‘পিহুকেও তো কখনো আমার পাশে বসতে বলি না। তখন কি ওর এইরকমই খারাপ লাগে?’ এসব ভেবে ইমন পিহুর দিকে তাকালো। মুখটা মলিন হয়ে আছে মেয়েটার। মনের মধ্যে একরাশ মায়া কাজ করলো ইমনের। অপরক্ষণেই আবার এসব ভাবনা চিন্তা ফেলে নিজের লক্ষ্যে ফোকাস করলো।

আনোয়ারা বেগম পরোটা মুখে দিয়ে মুখ কুচকে ফেললেন। চোখ রাঙিয়ে তাকালেন ইমনের দিকে। ইমন খানিকটা ভড়কে গেলো। আনোয়ারা ভেগম চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

— “কি ছাতার নাস্তা বানিয়েছিস লবণ হয়নি। এটাকে পরোটা বলে? তেলে ডুবিয়ে রেখেছিস। আর পরোটা একরকম মানচিত্র হয়ে গেলো কেমন করে? ভাজিতে ঝাল দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিস। লবণের ছিটেফোঁটা-ও নেই। মুখে বড় বড় কথা বলিস। কাজের বেলায় ফাঁপড়।”

ইমন একেবারেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। এটা তার মায়ের কোন রুপ দেখছে সে? এতোটা রুড ব্যবহার? খাবার যে খারাপ হয়েছে সেটাই দেখলো। এটা কেন দেখলো না সে অনেক কষ্টে এসব বানিয়েছে। ইশমিকে সামলে নাস্তা বানাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে এটা কেন বুঝতে চাইছে না? হঠাৎই ইমনের চোখে পানি চিকচিক করে উঠলো। খুব খারাপ লেগেছে তার মায়ের ব্যবহার। বললো,

— “মা ইশমিকে সামলে নাস্তা বানাতে হয়েছে। তাছাড়া ও একটু পরপর কেঁদে উঠছিলো। কি থেকে কি করেছি বুঝতেই পারিনি।”
— “একটা বাচ্চাও তোর দ্বারা সামলানো যায়না। সারাদিন তো শুয়ে বসেই কাটিয়ে দিস। এখন যতো নখড়া করছিস।”

ইমন এবার একেবারেই স্তদ্ধ হয়ে গেলো। এরকম ব্যবহার সে একদমই আশা করেনি। ভেবেছিলো তার মা বুঝবে রান্না খারাপ হওয়ার কারণ। কিন্তু তিনি তো বুঝতেই চাইছেন না।

এদিকে পিহু বোকার মতো তাকিয়ে আছে ইমনের দিকে। শ্বাশুড়ির ভয়ে কিছু বলতেই পারছে না। আর কেনোই বা তিনি নিজের ছেলের সাথে এমন ব্যবহার করছেন। পরোটা খাওয়া শেষে চা দিতে বললেন আনোয়ারা বেগম। মায়ের এমন ব্যবহার দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। অন্যমনস্ক হয়ে চা ঢালতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছে। এই নিয়ে দুবার পুড়েছে হাত। ছ্যাত করে উঠলো যেনো চামড়া। তাড়াতাড়ি সিংকের কল ছেড়ে পানির নিচে হাত ধরে রাখলো। চা নিয়ে তার মায়ের সামনে দিতেই তিনি বেশ বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন,

— “সামান্য চা আনতে এতোক্ষণ লাগে? কিভাবে যে সংসার সামলাবি কে জানে।”
— “আমার হাত পুড়ে গেছিলো মা।”
— “এই সামান্য চা ঢালতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছিস। তোকে দিয়ে সত্যিই কিছু হবে না। মুখে বড়বড় কথা আছে শুধু তাইনা?”

ইমনের এবার সত্যিই খারাপ লাগছে। এমন নির্দয়ের মতো ব্যবহার করছে কেনো তার মা? ইচ্ছে করে তো দেরি করেনি। কারণটা জানতে না চেয়েই প্রথমেই কথা শুনিয়ে দিলো। দুই দুইবার হাত পুড়েছে। তাও আবার একই জায়গায়। কিভাবে সহ্য করবে সে? কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলো না ইমন। কেমন যেনো ভেতর থেকে কথা আসছে না। কিছু বললেই এই বুঝি আরো কথা শুনতে হবে এই ভয়ে।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এক ঢোক মুখে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন আনোয়ারা বেগম। অগ্নিচোখে তাকালেন ইমনের দিকে। ইমন মনে মনে সত্যিই ভয় পাচ্ছে। আবার কি হলো? আনোয়ারা বেগম বললেন,

— ” কি বানিয়েছিস এটা? এটা চা নাকি শরবত? চিনির পুরো ডিব্বা উপর করে ঢেলে দিয়েছিস নাকি?”
— “চা বানানোর সময় ইশপি কাঁদছিলো তাই তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে চিনি বেশি পরে গেছে।”
— “আরো আগে ঘুম থেকে উঠে কাজ করতে পারিস নি?”
— “মা! ইশপি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে দেয়নি।”
— “সারাদিন তো পরে পরে ঘুমাস। কোন কাজটাই ঠিকমতো করিস?”

আনোয়ারা বেগম আরো কথা শুনিয়ে চলে গেলেন। ইমনের কান্না পেয়ে গেলো। চা কেনো খারাপ হয়েছে সেটা তো জানিয়েছে। তবুও কেনো এতো রুড হলো তার মা? কেনো একটুও বুঝতে চাইছে না?

ভিষণ ক্ষিদে পাওয়ায় ইমন তাড়াতাড়ি খেতে বসে গেলো। খাবার মুখে দিয়ে বুঝলো আসলেই খাওয়ার যোগ্য হয়নি। তবুও গিলে নিলো। এছাড়া তো উপায় নেই। অল্প খাওয়ার পরেই পেট জ্বলতে শুরু করলো। খালি পেটে ঝাল নাস্তা পরায় জ্বলে যাচ্ছে। ঢকঢক করে পানি খেয়েও কমলো না জ্বালা। যেনো আরো বেড়ে গেছে। রাগে, দুঃখে ইমন চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ঠোঁট পুড়িয়ে ফেললো। তার মধ্যে আবার ইশপি কেঁদে উঠলো। রাগটা আরো বেড়ে গেলো। নিজের রাগ দমন করে মেয়েকে কোলে নিয়ে দেখলো ইশপি হাগু করে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস নিলো এবার। কোনোরকমে মেয়েকে পরিষ্কার করে নিলো। এদিকে আবার দুপুর হয়ে আসছে রান্না চড়াতে হবে তো।

.
দুপুরের রান্নার জন্য সবজি কাটতে বসলো ইমন। আলু কুচি করতে গিয়ে বৃদ্ধাঙুলি কেটে গেছে। সেইসাথে কালো দাগ পরেছে আঙুলে। মাছ ভাজতে গিয়ে তেলের ছিটা হাতে পরতেই লাফিয়ে উঠলো ইমন। রাগ লাগছে তার। বেশ বিরক্ত-ও হলো। সামান্য একটা আবদার করেছিলো সে। তার বদৌলতে এসব পোহাতে হচ্ছে এখন। মেনে নিলে সমস্যাটা কই ছিলো? এসব চিন্তা করে রাগ করেই মাছ উল্টাতে গিয়ে অনেকখানি তেলের ছিটা পরলো হাতে। তাড়াতাড়ি করে বেসিনে পানি ছেড়ে হাতটা সেই পানির মধ্যে ধরে রাখলো। যাক একটু জ্বালা কমলো। তবে ফোসকা পরে গেছে হাতে।

রান্না চড়াতে গিয়ে এবার সত্যিই ইমন অসহায় হয়ে পরলো। রান্না কিভাবে করতে হয় সেটা না জেনেই এমন শর্ত কি করে মেনে নিলো সে? কতবড় গাধা হলে এমন করতে পারে মানুষ? নিজের উপর রাগটা তিরতির করে বাড়তে থাকলো। খুশির ঠ্যালায় তখন এসব কাজকে কাজই মনে হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই কাজ তার দ্বারা সম্ভব না।

দুপুরে খাবার খাওয়ার সময় মায়ের কাছ থেকে আরেকদফা কথা শুনতে হলো ইমনের। তবু চুপ ছিলো। নিজে খেতে গিয়ে বুঝতে পারলো এই খাবার খাওয়ার যোগ্য না আসলেই। তাই আর খেতে পারলো না। মেয়েকে খাইয়ে দিয়ে একটু ঘুমাতে চেয়েছিলো তখন মনে পরলো সকালের দিকে কারবারি করে কাপড় কতগুলো ভিজিয়ে রেখে এসেছে। ঘুমানো আর হলো না। সেই কাপড় ধুতে হলো। এরমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ইশমি চিৎকার করে কাঁদছে। ইশমিকে কোলে নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ হাটলো। এরমধ্যে দুইবার প্রস্রাব করে ভিজিয়ে দিয়েছে ইমনকে। সেসব পালটে নতুন কাপড় পরালো মেয়েকে। ঝুড়িতে উঁকি দিয়ে দেখলো ইশমির অনেক কাপড় জমেছে। চোখ বড়সড় করে নিলো ইমন। মেয়েটা একদিনে এতো কাপড় নষ্ট করে? আর সেসব পিহু প্রতিদিন ধোয়? একটা চাদর আর ইশমির দুইটা কাথা ধুতে গিয়েই তার নাজেহাল অবস্থা হয়েছে। সেখানে মেয়েটা কিভাবে এতো কাপড় একদিনে ধোয়?

এসব হাজারো চিন্তা ভাবনার মাঝে রাতের খাবার তৈরি করলো। ফের একচোট বকা শুনলো মায়ের কাছ থেকে। নিজের ঘরে নিজেকেই পর মনে হচ্ছে ইমনের। আর খেতে পারলো না সে। ইশমিকে সামলাতে গিয়ে। তখনই বুঝলো মেয়েটা রাতে বেশি জ্বালায়। দিনে ঘুমিয়ে থেকে রাতে আর ঘুমায় না। এভাবে করতে করতেই রাত অনেক পার হয়ে গেলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠলো মেয়ের চিৎকারে। উঠে দেখলো মেয়েটার ক্ষিদে পেয়েছে। কোনোরকমে হাত-মুখ ধুয়ে ইশমির খাবার বানালো। মেয়েকে খাইয়ে দিয়ে যেইনা একটু বসেছে ওমনি ইশপি বোমি করে দিলো। ইমন আহাম্মকের মতো মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে আসলে বুঝতে পারছে না এই মুহুর্তে তার অনুভূতিটা। তবে ভিষণ বাজে রকমের অনুভূতি অনুভব হচ্ছে। আবার এদিকে রাতে ঘুমাতে না পারায় মাথাটা ব্যাথায় টনটন করছে। চোখে ঝাপসা দেখছে। শুতে চাইলেও পারলো না। কারণ ইশমি দুষ্টামি করছে। হামাগুড়ি দিয়ে বারবার খাটের কিনারায় চলে যাচ্ছে। যার কারণে প্রহরীর মতো পাহাড়া দিতে হচ্ছে মেয়েকে।

সকালের নাস্তা বানাতে না পারার কারণে ইমন মায়ের কাছ থেকে বকা শুনলো। তবে স্বাভাবিক বকা নয়। যা-তা বকা। মায়ের এমন রুপ দেখে মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।

.
আজ রাতে ইশপি তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গেলো। আকাশটা আজ স্বচ্ছ৷ ইমন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনদিন পার হয়েছে তার শর্তের। গত তিনদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সে অনেক কিছু উপলব্ধি করেছে৷ আকাশে জ্বলতে থাকা মিটিমিটি তারাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ভাবছে অনেক কিছুই।

পিহুর বাবা-মা নেই। মামার বাসায় বড় হয়েছে। সেখানে কখনোই কদর পায়নি। যখন এ-বাড়ি এলো। মায়ের ভালো ব্যবহার দেখে মেয়েটা প্রায় খুশিতে গদগদ হয়ে যেতো। ইমনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে কতটা খুশি ছিলো। সারাদিন দৌড়ঝাপ করতো তার আর মায়ের পিছনে। বাসায় এলেই এটা সেটা এগিয়ে দিতো। ইমনের পছন্দের খাবারগুলো এনে সামনে দিয়ে মিষ্টি করে হাসতো। আসলে এটা ছিলো একটা বাহানা মাত্র ইমনের একটু কাছাকাছি থাকার। কারণ যখনই পিহু ইমনের পছন্দের কিছু রান্না করেছে তখনই সে অনেকখানি আদর করেছে পিহুকে। সেই আদর পাওয়ার আশায় এতো কিছু করতো মেয়েটা।

যেদিন বাবা হবে শুনেছিলো কি খুশিটাই না হয়েছিলো ইমন। ইমনের খুশি দেখে পিহু-ও অনেক খুশি হলো। মেয়েটা যেনো স্বামীর আনন্দেই আনন্দ খুজে পেতো। পিহুর খেয়াল রাখা আরো বেড়ে গেলো ইমনের। মেয়েটা হওয়ার পরতো পারলে পিহুকে কোলে নিয়ে হাটে এমন অবস্থা ছিলো। পিহু লজ্জায় গুটিয়ে যেতো। তবে মেয়েটা ভিষণ খুশি হতো।

ইমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার জীবনের সবচেয়ে বড়ভুল ইসলামি শারিয়াহ থেকে সরে যাওয়া। আল্লাহর প্রদত্ত দ্বীন থেকে সরে যাওয়ার পরপরই তো পিহুর সাথে সংসারটা জটিল মনে হলো। ভুলে গেলো রবের বাণী। ভুলে গেলো পরনারীর দিকে চোখ পরলেই দ্রুত নামিয়ে নিতে হবে। ভুলে গেলো পরনারীর সাথে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলা ঠিক নয়। কেউ আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বললে যদি সেটা মনে প্রভাব ফেলে তাহলে দ্রুতই নিজের স্ত্রীর দিকে মনোযোগী হবে। ভুলে গেছিলো এসব আদেশ। ভুলে গেছিলো ‘মানহায’। প্রবৃত্তির অনুসরণ করে বসেছিলো। তাইতো তিক্ততা এসে ভর করেছিলো মনে।

আসলেই হালাল এবং হারাম কখনো একসাথে থাকতে পারে না। যদি কোনো একটা মনে গেড়ে বসে তাহলে অপরটার সাথে দূরত্ব বাড়ে। যেই হৃদয় গান শুনে অভ্যস্ত সেই হৃদয় কখনোই কুরআনের তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হয়না। যেই পুরুষ অন্য নারীর রুপে মুগ্ধ সেই পুরুষ কখনোই নিজের স্ত্রীর রুপে মুগ্ধ হয়না।

মনটা কেঁদে উঠলো ইমনের সাথে ছটফট করে উঠলো। অনেক বড় ভুল করেছে সে। অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সে। ক্ষমা চাইতে হবে তার। আগে রবের কাছে তারপর পিহু এবং মায়ের কাছে।

ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো ইমন। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। গত তিনদিন একটানা রান্নাঘরে থাকায় ত্বকের উজ্জ্বলতা কিছুটা ম্লান হয়েছে। আর পিহুতো দিনের পর দিন রান্নাঘরে কাটায়। হৃদয়টা আর্তনাদ করে উঠে ইমনের। ওযু করতে গিয়ে দেখলো নখ বড় হয়ে ময়লা জমেছে। পুরনো কিছু সুন্দর মুহুর্ত মনে পরতেই চোখের কোণে চিকচিক করে উঠে ইমনের। মেয়েটা কতটা কেয়ার করতো তার। নখ একটু বড় হলেই নিজেই যত্ন করে কেটে দিতো। এতো সুখে থাকার পরেও সে অন্য কোথাও নাকি সুখ খুজতে যাচ্ছিলো। আসলে সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। কথাটা সত্যি হলো ইমনের ক্ষেত্রে।

দুই রাকাত সালাত পড়ে নিলো ইমন। এখন কিছুটা হালকা লাগছে। মাথা থেকে বিয়ের ভূতটা নেমে গেছে। সে এরকম কিছু করতে চেয়েছিলো এটা মনে হলেই নিজেকে কষে কয়েকটা থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করে। পিহুর কাছে ক্ষমা চাইলেই মনটা আরো শান্ত হবে। এবং মাকে বলতে হবে সে দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ে করবে না। এটা কোনোদিন মাথাই আনবে না।

_____________________________
সকালবেলা মায়ের রুমে নক করলো ইমন। আজ শর্তের পাঁচদিন। আনোয়ারা বেগম ছেলেকে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলেছেন। ইমন ইতস্তত করে বললো,

— “মা তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”
— “কি কথা?”
— “ইয়ে মানে..। শর্তের ব্যাপারে।”
— “এখন কোনো কথা শুনবো না। শর্ত মোতাবেক এক সপ্তাহ শেষ হলেই এসো।”
— “মা আসল..।”
— “বললাম তো যাও। এখন কিছুই শুনবো না।”

ইমন চুপচাপ প্রস্থান করলো। আনোয়ারা বেগম সোফায় বসে মাথাটা পেছনে এলিয়ে দিলেন। যাক অবশেষে ছেলেটার সুবুদ্ধি হয়েছে। তিনি জানেন ইমন আজ কি বলতে এসেছে। ইচ্ছে করেই শুনেননি সেসব। তিনি চান ইমন আরো উপলব্ধি করুক।

নাস্তার টেবিলে আজও বকা শুনলো মায়ের। আজ আর মন খারাপ হলো না ইমনের। শান্তভাবেই মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ মায়ের প্রতি ভিষণ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা কাজ করছে। খুব গর্ব হচ্ছে কারণ সে একজন আদর্শ মা পেয়েছে। সঠিক সময়ে যদি তার মা তার লাগাম টেনে না ধরতো তাহলে আজ জীবনটা নরকে পরিণত হতো। সত্যিই সে কৃতজ্ঞ তার মায়ের প্রতি।

পিহুর সামনে খিচুড়ির প্লেট রাখতেই বিষ্ময় নিয়ে ইমনের দিকে তাকালো পিহু। ইমন শান্ত নয়নে পিহুর দিকে তাকিয়ে আছে। পিহু কিছু বলতে চাইলো কিন্তু শ্বাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছুই বললো না। তবে মনে মনে খুশি সে। যদিও সে এখনো জানেনা এসবের কিছুই। খুশিটা পিহুর চোখে-মুখে ভেসে উঠেছে। আনোয়ারা বেগম আড়চোখে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। পিহু একচামচ খেয়ে ইমনের দিকে তাকালো। দেখলো ইমন করুন চোখে তাকিয়ে আছে। পিহু মুচকি হাসতেই ইমনের চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা বেড়ে গেলো।

.
দুপুরে চুপিচুপি বেড়িয়ে যাচ্ছিলো পিহু রুম থেকে। ওমনি আনোয়ারা বেগম ডাক দিলেন৷ পিহু সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আমতাআমতা করে বললো,

— “ওই একটু পানি খেতে যাচ্ছিলাম আরকি। হেহে।”

আনোয়ারা বেগম কিছু বললেন না। শ্বাশুড়িকে চুপ থাকতে দেখে পিহু বেরিয়ে গেলো। রান্নাঘরে এসে দেখলো ইমন হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে ইমনের কাছে গিয়ে হাতটা নিজের দুইহাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

— “ইশ কতখানি পুড়ে গেছে।”

ছুটে রুমে এলো পিহু। অয়েন্টমেন্ট নিয়ে দৌড়ে এলো ইমনের কাছে। যত্ন করে মলম লাগিয়ে দিয়ে বললো,

— “আপনি একপাশে দাড়ান। আমি করে দিচ্ছি বাকি কাজ।”
— “মা দেখলে বকবে।”
— “তাড়াতাড়িই করে দেবো। মা আসার আগেই।”

ইমন শান্ত হয়ে বসে রইলো। পিহুকে দেখছে। এই মেয়েটাকে এতো কষ্ট দেয়ার পরেও এতো ভালো ব্যবহার করে কিভাবে? পিহুর সাথে করা সেসব তিক্ত ব্যবহারগুলো মনে পরতেই ইমনের চোখ জ্বালা করে উঠে। সে আজ অনুতপ্ত। ভীষণভাবেই অনুতপ্ত। তার কথার জন্য, তার আচরণের জন্য, তার ওই সিদ্ধান্তটার জন্য।

___________________________
রাত দুটো বাজে। পিহু আস্তেধীরে উঠে পা টিপে টিপে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দরজা আস্তে করে চাপিয়ে দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। যাক মা টের পায়নি।

পিহু চলে যেতেই আনোয়ারা বেগম পাশ ফিরলেন। তিনি সবই দেখেছেন। মৃদু হাসলেন তিনি। মেয়েটা তার ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসে। গত কয়েকদিন পিহুর ছটফটানি দেখেছেন তিনি। ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি মেয়েটা। আনোয়ারা বেগম উঠে বসলেন।

পিহুর সাথে করা ইমনের প্রতিটা ব্যবহার তিনি লক্ষ্য করেছেন আগে থেকেই। শুধু চুপ ছিলেন সুযোগের আশায়। কারণ তখন ইমনের মন এমনিতেই বিগড়ে ছিলো। শাসন করলে আরো বিগড়ে যেতো। তাই সুযোগ বুঝেই কাজ করেছেন। তিনি ইচ্ছে করেই ইমনকে পিহুর জায়গায় এনে দাড় করিয়েছেন যাতে করে সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারে পিহুর পরিশ্রম। ছেলের সাথে এমন রুড ব্যবহারে তিনি নিজেও কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু কঠোর ছিলেন কারণ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন ছেলেকে, তার এমন রুড ব্যবহারে পিহুর ভেতরটা কতটা জর্জরিত হয়। পাশাপাশি রবের কাছে অসংখ্য দোয়া করেছেন ছেলেটার হেদায়েতের জন্য।

আনোয়ারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ইমনের বাবাও পিহুর মতো কেয়ারিং ছিলো। সবসময় হাসি-খুশি থাকতো মানুষটা। আর এতো দুষ্টামি এবং দুষ্টু কথা বলতো যেগুলো শুনলে হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হওয়ার উপক্রম। কিন্তু তিনি সবসময় বিরক্ত প্রকাশ করতেন স্বামীর প্রতি। কেনো যেনো মানুষটাকে পছন্দ হতো না। কিন্তু ওইপাশের মানুষটা কখনোই বদলায়নি৷ নিঃস্বার্থে ভালোবেসে গেছেন। যখন মানুষটার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারলো, অনুভূতি গুলো বুঝে উঠতে চাইলো তখনই মানুষটা ছেড়ে চলে গেছেন। আনোয়ারা বেগম চোখ বন্ধ করতেই একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। আজ নিজেকে খুব একা একা লাগে। মানুষটাকে খুব করে চায় পাশে। অথচ আজ সে পাশে নেই। নিজেকে খুব অপরাধী লাগে।

ঠিক একই ভুল করতে যাচ্ছিলো ইমন। পিহুর ভালোবাসার মূল্যায়ন না করে অন্য কোথাও ভালোবাসা, সুখ খুজতে যাচ্ছিলো। এইপাশের মানুষটার অনুভূতির সাথে পরিচিত না হয়েই দূরে ঠেলে দিচ্ছিলো। তাইতো আগেভাগেই তিনি ইমনের লাগাম টেনে ধরলেন। যাতে করে তার মতো করে আফসোস করতে না হয় ছেলেকে। ইমন নিজের ভুল বুঝতে পারলে সে তার বাবার মতোই হবে এটা আনোয়ারা বেগম বিশ্বাস করেন।

~ চলবে,,
® ‘নুরুন নাহার’

#মেঘমালার_গল্পকথা_নুরুন_নাহার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here