প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|২২|
দ্বিতীয় অধ্যায়
সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি হওয়ার পর পরই ভ্যাপসা গরম ছড়াল। হাওয়ায় ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। পরিবেশটা থমথমে, নিশ্চুপ। মাথার উপর ক্যাটক্যাট করে ঘুরছে আদিযুগের বৈদ্যুতিক পাখা। বাতাস পাওয়া যাচ্ছে না। হাড় জ্বালানো গরমে অতিষ্ঠ হয়েই গরম চায়ে চুমুক দিলো ধ্রুব। বিশ্রী স্বাদ। টেবিলের উপর জমে থাকা ফাইলের স্তুপে নজর বুলিয়ে তিতকুটে স্বাদটা টনক নাড়ল মস্তিষ্ক পর্যন্ত। পুঁথিগত বিদ্যা আওড়ে চাকরি পেলেও হাতে কলমে আইন সামলানো বেশ মুশকিলের কাজ। ধ্রুব এই মুশকিলের কাজটা করছে দাঁতে দাঁত চেপে। দুইদিন আগে ধ্রুবর অধীনস্থ এক উপজেলায় জমি সংক্রান্ত তর্ক-বিতর্কে হত্যাহত্যির কান্ড ঘটে গিয়েছে। দায়িত্বে থাকা এসপি গোটা বিষয়টা ধ্রুবর কাঁধে ছেড়ে দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। এদিকে ধ্রুবর জীবন যায় যায় অবস্থা। এই মামলা নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ির মাঝেই নতুন এক ঘটনা ঘটে গেল। টাঙাইল টু ময়মনসিংহ রোডে একটা বিবস্ত্র তরুণীর লাশ পাওয়া গিয়েছে। লাশের অবস্থা ভয়াবহ। টেলিভিশনে বড় বড় অক্ষরে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে, ‘ চলন্ত বাসে এক তরুণীর ধর্ষণ ও হত্যা। রাস্তায় পাওয়া গেল লাশ। স্থানীয় পুলিশ অপারগ।’ ধ্রুবর মেজাজ খারাপ হয়। অপারগ! অপারগ মানে কী? পুলিশ কী জানতো অমুক দিনে, অমুক তারিখে, অমুক সময়ে, অমুক নরপশু তার সেক্সিয়াল আর্জ নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পেরে এমন এক কান্ড ঘটাবে? আশ্চর্য! কাজের চাপে এমন এক নাভিশ্বাস অবস্থায় আবির জানাল, ‘ভাবী চলে গিয়েছে।’ ধ্রুবর মেজাজ খারাপটা এবার তরতর করে বাড়তে লাগল। ভাবী চলে গিয়েছে তো সে কী করবে? ভাবীর পা ধরে বসে থাকবে? যার চলে যাওয়ার সে যাবে, তাতে এতো অস্থির হওয়ার কী আছে? এতো আয়োজন করে তাকে জানানোরই বা কী প্রয়োজন? ধ্রুবর সবসময়ই চট করে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আজও হলো। কাজের চিন্তার সাথে সাথে আচমকা নিশুর জন্য চিন্তা হলো। টেবিলে স্তূপ হয়ে থাকা ফাইল ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ উপলব্ধি হলো, ধ্রুবর মন ভালো নেই। নিশুকে ব্যাপারটা যেভাবে বুঝাতে চেয়েছিল সেভাবে বুঝাতে না পেরে আফসোস হচ্ছে। নিশু নিশ্চয় তাকে দুশ্চরিত্র, লম্পট মনে করছে? মনে করুক। নিশুর মনে করা নিয়ে বিশেষ কিছু যায় আসে না ধ্রুবর। ধ্রুব ছোট থেকেই রিজার্ভড স্বভাবের ছেলে। আত্মগম্ভীর, আত্ম-অহংকারী। নিজের ইচ্ছা, আকাঙ্খার প্রতি সচেতন। তার এই আটাশ বছরের জীবনে নিজের কোনো চাওয়ায় সে অপূর্ণ রাখেনি। কোনো কিছুতেই কোনো সেক্রিফাইজ করেনি। আবিরকেও করতে দেয়নি। কিন্তু এবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
সাধারণ দৃষ্টিতে নিশু খুবই রূপবতী নারী। কাশ্মিরী আপেলের মতো টুকটুকে গাল। টসটসে ঠোঁট। একজন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ হিসেবে রূপবতী নিশুর প্রেমে পড়ে যাওয়া ধ্রুবর জন্য ছিলো ফরজ কাজের মতোই অবধারিত। এই অবধারিত কাজটা ধ্রুব করেনি। নিশুর প্রেমে পড়েনি। নিশুর প্রেমে পড়ে যাওয়াটা কাশ্মিনকালেও তার পরিকল্পনার মাঝে ছিল না। আদতে নিশু সম্পর্কিত কোনো কিছুই তার পরিকল্পনায় স্থান পায়নি কখনো। নিশুর সুন্দর মুখ সম্পর্কে প্রথম থেকেই সচেতন ছিল ধ্রুব। প্রথম দেখায় অবাক হয়েছে কিন্তু কোনো আকর্ষণ বোধ করেনি। পৃথিবীতে বহু রূপবতী নারী আছে। সবার রূপ দেখে পিছলে যাওয়া উচিত কাজ নয়। বন্ধুদের দুষ্টুমি করে ছড়িয়ে দেওয়া এই গুজবে প্রথমটায় খুব বিরক্ত হয়েছিল ধ্রুব। পরবর্তীতে নিশুর হতাশ, ভয়ার্ত চেহারা দেখে কৌতুকবোধ করেছে। সব থেকে মজা পেয়েছে, নিশুর প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে। নিশু ধ্রুবর প্রেমে আকন্ঠ ডুবে আছে বুঝতে পেরেই নিশুর প্রতি তুলতুলে মায়া এসেছিল ধ্রুবর। খুব আলতো হাতে তাকে প্রশ্রয় দিয়েছিল। কষ্ট না দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিধিবাম! ভার্সিটির পূনর্মিলন অনুষ্ঠানেই যা ঘটার ঘটে গেল। শাড়ি পরিহিতা নিশুকে দেখে ধ্রুবর মাথা ঘুরে গেল। তারপর থেকে মাথাটা দিনরাত ঘুরছে। সেই সাথে ঘুরছে নিশু নামের মেয়েটা। এই মেয়েটাকে এতো সুন্দর হতে হবে কেন? ধ্রুবর এই মুহূর্তে আলাওলের পদ্মাবতীর মতো নিশুর সৌন্দর্য নিয়েও লিখে ফেলতে ইচ্ছে করছে নারী সৌন্দর্যের মহাকাব্য। কিন্তু লেখা হচ্ছে না। ধ্রুব বিজ্ঞানের ছাত্র। এসব সাহিত্য টাহিত্য তার দ্বারা সম্ভব না। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাতের ফাইলটা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে চাইল, বারোটা দশ। প্রায় মধ্যরাত। বাড়ি ফেরা উচিত। অথচ ফিরতে ইচ্ছে করছে না। গত দুইদিন যাবৎ বাড়ির বাইরে সে। থানাতেই রাত কাটিয়েছে। এখানে মশার খুব উপদ্রব, ঘুম ভালো হয় না। সারাদিন দৌঁড়ঝাপ করে নির্ঘুম রাত শরীরেও সহ্য হচ্ছে না।
‘ স্যার কী আজ থানাতেই থাকবেন? রাতের খাবার দিব? পুলিশ কোয়াটারের বাবুর্জির রান্নার হাত ভালো।’
মধ্যবয়স্ক কনস্টেবলের প্রশ্নে চোখ তুলে চাইল ধ্রুব৷ তারপর চোখের সামনে ফাইলটা মেলে ধরে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিন তো।’
কনস্টেবল ঘাড় নাড়িয়ে সরে যেতেই আবারও ফাইল বন্ধ করল ধ্রুব। বাসায় ফিরবে কী ফিরবে না দু-টানায় শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ঘড়ির কাটায়। এই পৃথিবীতে মা সম্বোধিত মানুষটিকে সবথেকে বেশি ভালোবাসে ধ্রুব। নিজের থেকে, এই পৃথিবী, প্রিয়জন সবার থেকে বেশি ভালোবাসে। মায়ের একবিন্দু মানসিক কষ্টও তার বুকে তলোয়ারের মতো যুদ্ধ চালায়। রক্তাক্ত করে। সেই মা চাইছে ধ্রুব বিয়ে করুক। অতি অবশ্যই নিশুকে ব্যতিরেকে অন্য কাউকে বিয়ে করুক। বিয়ে করতে অবশ্য ধ্রুবর কোনো আপত্তি নেই। মায়ের কথায় যেকোনো মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি সে। সংসার করতেও কোনো বিবাদ নেই । কিন্তু একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা হলো নিশুকে নিয়ে। ধ্রুবর দেহ, মন ও মস্তিষ্ক অবিরল নিশুকে ভাবে। নিশুকে দেখার জন্য প্রাণ ফেঁটে যায়। মেজাজ খিটমিটে থাকে। এইযে দুইদিন ধরে নিশুকে দেখছে না এতেও তার মেজাজের পারদ ফেঁটে যায় যায় অবস্থা। থানায় রিমান্ডের আসামীদের অবস্থাও বেকাহিল। জীবন ওষ্ঠাগত। অধীনস্থ কর্মকর্তারাও শঙ্কায় অস্থির। সর্বোপরি, নিশুকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করলে ভয়াবহ ফ্যাসাদে পড়তে হবে ধ্রুবকে। দেখা গেল, ঘরে বউ রেখে তার নিশুর কথা মনে পড়ল। তাকে দেখতে ইচ্ছে করল। ছুঁতে ইচ্ছে করল। তাহলে ব্যাপারটা সরাসরি লম্পটের ক্যাটাগরিতে চলে যাবে৷ ধ্রুব নিজেকে আর যায়হোক লম্পট হিসেবে দেখতে চায় না। নিজের স্ত্রীর সাথে এমন অন্যায় আচরণ তার দ্বারা সম্ভব হবে না। ধ্রুব খুব অসহায়বোধ করল। ঠিক এই মুহূর্তে নিশুকে কাছে পেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু মা? ধ্রুবর মায়ের বয়স খুব বেশি নয়। ধ্রুবর থেকে বড়জোর ষোল বছরের বড়। ধ্রুবর মা যখন কেবল নবম শ্রেণীর ছাত্রী তখনই আচমকা সেনাবাহিনীর এক অফিসারের সাথে বিয়ে হয়ে গেল তার। ধ্রুবর বাবা তখন ধ্রুবর মতোই তাগড়া যুবক। বয়স গড়িয়ে আটাশের কুঠায়। বিয়ের তিনমাসের মাথায় এই আদুরে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা হলো। গর্ভে এলো ধ্রুব। তারপর শুরু হলো ভয়াবহ জীবন যুদ্ধ। সেই ভয়াল জীবন যুদ্ধ পেরিয়ে এতোটা পথ এগিয়ে আসা মাকে কী করে কষ্ট দেয় ধ্রুব? মা যদি নিশুকে শুধু অপছন্দ করতো তবুও সামলে নিতো ধ্রুব। কিন্তু সমস্যাটা তো মা-ছেলের বিশ্বাস আর আস্থায়৷ মায়ের এই প্রগাঢ় আস্থাটাই কী করে আঁচ আসতে দিবে ধ্রুব? ভাবতে গিয়েও কেঁপে উঠল ধ্রুব। বুকের ভেতর সুতীব্র এক ব্যথা খেলে গেল। চেয়ারের গায়ে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে কপাল চেপে ধরল। অতঃপর বিড়বিড় করে চলল, ‘নিশু, নিশু, নিশু, নিশু। তুমি আমায় শেষ করে দিয়েছ নিশু। ‘
ধ্রুব যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত গড়িয়ে শেষ প্রহর। পুরো বিল্ডিংয়ে কোনো জনারব নেই। চারদিক নীরব, বিষণ্ণ। ধ্রুব দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে চারতলায় এসে থমকাল। নিশুদের নিস্তব্ধ ফ্ল্যাটের ঝুলন্ত তালার দিকে সেকেন্ড কয়েকের স্থবির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবারও পা চালাল দ্রুত। কাজের মেয়েটা দরজা খোলে দিতেই বসার ঘরটাকে বসার ঘর বলার অযোগ্য করে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা কল্পকে চোখে পড়ল। ছেলেটা এখনও জেগে। চোখ-মুখ রাতের মতো অন্ধকার। অভিমানী। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বসার ঘরের এহেন দশা দেখে কাজের মেয়েটিকে শুধাল,
‘ কী ব্যাপার?’
ঘুমে ঢুলতে থাকা মেয়েটি অসহায় মুখ করে বলল,
‘ ছোট ভাইজানের লগে কাইজ্জা লাগছে। ভাইজানের কলেজের থারুমমিটার না কি-জানি নষ্ট কইরা ফেলছে। ভাইজান কল্প ভাইজানরে ধইরা মাইর লাগাইছে।’
ধ্রুব বিরক্ত মুখে চাইল। মেয়েটার কথা শতভাগ সত্য নয়। আবির যতই চিল্লাপাল্লা করুক কল্পকে কখনো আঘাত করে না। বড়জোর ধ্রুবকে ফোন দিয়ে বিচার দেয়। ভয় দেখায়। কল্প আবিরের থেকে বিশ বছরের ছোট হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঝগড়া কী করে চলে, এতো টপিক কোথায় পায়, বুঝে পায় না ধ্রুব।
‘ মা কোথায়?’
‘ খালাম্মা ঘুমায়। আমারে বলছে, বেশি চিক্কুর দিলে কল্প ভাইজানরে বাইরা ফেলাইয়া দরজা লাগায় দিতে। কল্প ভাইজান চিক্কুর না দিয়া মরার মতো পইড়া আছে বইলা বাইরে ফেলায় দিতে পারতাছি না। এখন কী করুম?’
ধ্রুব উত্তর দিলো না। সারাদিনের শারীরিক মানসিক পরিশ্রমের পর বিরক্তিতে কন্ঠে কথা জোগাচ্ছে না। ধ্রুব ধীর পায়ে কল্পর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হাঁটু গেড়ে বসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে সংযত করল। শান্ত কন্ঠে ডাকল,
‘ কল্প! ভাইয়া আসো।’
কল্প চোখ তুলে চাইল। অভিমানে ঠোঁট উল্টে চোখের পলকে ধ্রুবর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাইয়ের কাঁধে মুখ লুকিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল তার ছোট্ট দেহ। ধ্রুব সবল হাতে ভয়ার্ত ছোট্ট শরীরটি আগলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। চোয়াল শক্ত করে শীতল কন্ঠে শুধাল,
‘ মা মেরেছে?’
কাজের মেয়েটি মৃদু মাথা নাড়তেই হতাশ হলো ধ্রুব। মায়ের কিছু কিছু নিষ্ঠুরতা ধ্রুবর অসহ্য লাগে। ছেলেদের সাথে কঠিন হতে গিয়ে কাঠিন্যের সীমাও যেন ছাড়িয়ে যান মাঝেমাঝে। মায়েরা তো চির নমনীয়। মায়েদের কী এতোটা কঠিন হতে আছে?
‘ ভাইজান ভাত দিমু? খাইবেন এখন? কল্প ভাইজানও খায় নাই। রাইতের এগারোটা থাইকা এমনে পইড়া আছে। খাইতে কইলেও শুনে না।’
ধ্রুবর ক্ষুধা মরে গেল। অসহায় লাগল। কাজের মেয়েটিকে কঠিন একটা ধমক দিতে গিয়েও শীতল কন্ঠে বলল,
‘ খবরদার কখনো কল্পর গায়ে হাত দিবে না। যাও, ঘুমোতে যাও।’
মেয়েটিকে ফ্যাকাশে মুখে মাথা নেড়েই চোখের আড়াল হলো। আবিরের ঘরের আলো নেভানো। হয়তো ঘুমাচ্ছে। ধ্রুবর মেজাজ খারাপটা এবার সীমা ছাড়াল। কল্প তখনও শক্ত করে গলা ঝাপটে কাঁধে মুখ লুকিয়ে আছে। ধ্রুব নিজের ঘরে যেতে যেতে কল্পর পিঠে আলতো হাত বুলাল। মোলায়েম কন্ঠে ডাকল,
‘ কল্প? ভাইয়া?’
কল্প জবাবে আরও শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে দিল ঘাড়ে। অর্থাৎ সে কোল থেকে নামবে না। ধ্রুব কিছুক্ষণ পায়চারি করে কল্পর ভয় কাটানোর চেষ্টা করল। কাজ হচ্ছে না। কল্পর পায়ে লাল হয়ে যাওয়া জখম দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল ধ্রুবর। ছোট্ট, কোমল হাতেও তেমনই ছাপ। ইশ, এভাবেও কেউ মারে? নিজের অজান্তেই মোলায়েম হয়ে গেল ধ্রুবর কন্ঠস্বর,
‘ কল্প, ভাইয়া? উঠো। ক্ষুধা পায়নি? ভাইয়া চকলেট এনেছে।’
কল্প আগের মতোই শান্ত হয়ে পড়ে রইলো। ধ্রুব বলল,
‘ আমি ওদের সবাইকে বকে দেব। আর কেউ কল্পকে মারবে না। আচ্ছা?’
এবার কল্পর মান ভাঙলো। মুখ তুলে অভিমানে চোখে চাইল। কেঁদে কেটে ফুলিয়ে ফেলেছে বড় বড় দুটো চোখ। কল্পর মুখের দিকে চেয়ে থেকে নিজের মনেই হাসল ধ্রুব। একদম তার মতো দেখতে হয়েছে কল্প। নিশু কী একটা নাম বলেছিল? চিওমিও? ধ্রুব হেসে ফেলল। কল্পর নামটা চিওমিও-ই দেওয়া উচিত ছিলো। ফুলো ফুলো গালগুলোতে নামটা বেশ মানাতো। ধ্রুব আর নিশুর যদি কখনো বিয়ে হতো তবে নিশ্চয় তাদের ছেলে কল্পের মতোই দেখতে হতো? দাদি, বাবা, চাচা, ছেলে সবাই এক চেহারার মানুষ। নিশু নিশ্চয় মিনিটে মিনিটে বলতো? কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! নিশুর সদা বিভ্রান্ত ,আশ্চর্য চেহারাটা চোখে ভাসতেই শব্দ করে হেসে ফেলল ধ্রুব। পরমুহূর্তেই ঝুপ করে থেমে গেল সেই হাসি। খেয়াল হলো, এসব কী ভাবছে সে? আশ্চর্য!
রাতে আর ঘুম হলো না ধ্রুবর। ঘুমে নুইয়ে আসা চোখদুটোও হৃদয় পোড়ার যন্ত্রণায় খুব একটা স্বস্তি পেলো না। থেকে থেকে চাপা কষ্টে হাহাকার করে উঠল বুক। দীর্ঘশ্বাসের উপর দীর্ঘশ্বাস পড়তে পড়তেই পুবাকাশে লাল আভা ছড়াল। গলা ঝাপটে ধরে ঘুমিয়ে থাকা কল্পকে নিজের বুকের উপর থেকে নামিয়ে রাত ফুরিয়ে ভোরে এসে দু’চোখের পাতা এক করলো ধ্রুব। ঘুম ভেঙে তাড়াহুড়ো করে অফিসের জন্য তৈরি হতে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল আবির। মন খারাপ করে বলল,
‘ ভাবী চলে গিয়েছে, জানো?’
ধ্রুবর বুকে চাপা অনুভূতির হুল্লোড় বয়ে গেল। আয়নার ভেতর দিয়েই আবিরের দিকে চাইল। আগে নিশুকে ভাবি ডাকা হলে খুব একটা গা করতো না ধ্রুব। কোনো অনুভূতি হতো না। কিন্তু সেই পূর্ণমিলন অনুষ্ঠানের পর থেকে কেমন বুক কাঁপে। আবিরের মুখে ভাবী ডাক শুনলেই মনে হয়, এই মোমের মতো সুন্দর রমণীটি কেবল তার। শুধু, শুধু এবং শুধুমাত্র তার। ধ্রুব নিজের মনোভাব গোপন রেখে শীতল কন্ঠে বলল,
‘ হ্যাঁ, জানি। রাতের নিউজে দেখাচ্ছিল, স্বামীর সাথে রাগ করে আবিরের ভাবীর বাপের বাড়ি প্রর্ত্যাবর্তন। সে দুঃখে আবিরের শয্যাশায়ী প্রাণ।’
আবিরের খুব মন খারাপ হলো। মর্মাহত হয়ে বলল,
‘ ভাবী চলে গিয়েছে আর তুমি মজা করছ ভাইয়া?’
‘ তোর ভাবী ভাবী শুনে মনে হচ্ছে, সে সত্যিই আমার বিয়ে করা বউ। রাগ করে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি হানা দিয়েছে! এসব রাবিশ, বাচ্চামো কথাবার্তা আমার সামনে আর বলবি না আবির। আরেকবার ভাবী ভাবী শুনলে, এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব।’
ধ্রবর ধমকে খুব একটা হেলদোল দেখাল না আবির। কয়েক সেকেন্ড উশখুশ করে বলল,
‘ আমি ভাবীর সাথে দেখা করতে যাব৷ তুমি কী অফিসে যাওয়ার পথে আমায় ড্রপ করবে ভাইয়া?’
ধ্রুবর চোখদুটো ধক করে জ্বলে উঠল। চোয়াল শক্ত হলো। বিস্মিত হয়ে, জীবনের প্রথম সে উপলব্ধি করলো, নিজের ভাইকে সে প্রচন্ড ঈর্ষা করছে। নিশু আবিরের কাছাকাছি আসবে। কথা বলবে। ব্যাপারটা তার সহ্য হচ্ছে না। আবিরকে কষে একটা থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। ধ্রুব তার ইচ্ছেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে চোয়াল শক্ত করে বলল,
‘ আজকে তোর বাইরে যাওয়া নিষেধ। ঘরে বসে পড়াশোনা কর। বাইরে বের হলে ডিরেক্ট লকাপে পুড়ব।’
#চলবে….
[ রি-চেইক করা হয়নি।]