প্রেমের পরশ পর্ব – ২৭ |লেখক -দিশা মনি

#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ২৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি

আমানের আজ অফিসে কিছু জরুরি মিটিং ছিল৷ সেই মিটিংগুলো শেষ করে হোটেলে ফিরে কিছু সময় বিশ্রাম। অতঃপর ছোয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল থাইল্যান্ডের পাতায়া শহরের দিকে। ব্যাংকক থেকে ১৫৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহর। শহরটি হানিমুন স্পট হিসেবে বেশি পরিচিত। আমানের কোন ইচ্ছা ছিল না সেখানে যাওয়ার। তবে আব্দুল হোসেন আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিলেন। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই পাতায়ার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলো দুজনে। ব্যাংকক থেকে ফ্লাইটে করে পাতায়া শহরে নামলো আমান ও ছোয়া।

পাতায়া শহরে পৌছে প্রথমে দু’জনেই তাদের বুক করে রাখা হোটেলে বিশ্রাম করে নিল। অতঃপর বেরিয়ে পড়লো পাতায়া শহরের মূল আকর্ষণ পাতায়া বিচের দিকে।

পাতায়া বিচে এসে অবাক হয়ে গেল ছোয়া। বিচের পরিবেশ কত সুন্দর, কোথাও কোন ময়লার চিহ্ন পর্যন্ত নই। সমুদ্রের পানিও কত পরিস্কার। যা দেখে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। ছোয়া আমানের উদ্দ্যেশ্যে বলেই ফেলে,
‘এখানকার মানুষ কত সচেতন। নিজেদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে যত্ন করে রাখতে জানে। অথচ আমাদের দেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত আমরা কতটা নোংরা করে রাখি। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি, আমাদের তো এখানকার মানুষদের থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ।’

আমানও সহমত জানিয়ে বলে,
‘তুই একদম ঠিক বলেছিস।’

এসবের মধ্যে ছোয়ার নজর যায় আকাশের দিকে। কিছু মানুষ প্যারাগ্লাইডিং এর মজা নিতে ব্যস্ত। যা দেখে ছোয়ার খুব ভালো লাগে। আমান ছোয়াকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই কি প্যারাগ্লাইডিং করতে চাস?’

ছোয়া খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে,
‘হ্যা অবশ্যই।’

আমান মুখ ভেঙিয়ে বলে,
‘থাক, তোর সাহস আমার জানা আছে। এসব তোর দ্বারা হবে না।’

ব্যাস, এটাই যথেষ্ট ছিল। ছোয়া ভীষণ অপমানিত বোধ করে এবং বলে ওঠে,
‘আমি প্যারাগ্লাইডিং করবোই। আপনি কি ভেবেছেন আমি ভয় পাই? আমার কত সাহস আজ দেখিয়ে দেব। ছোট থাকতে কতবার গ্রামের মেলায় নাগরদোলায় উঠেছি, আমার সব বান্ধবীরা ভয়ে চিৎকার দিত আর আমি টু শব্দ পর্যন্ত করতাম না। সেখানে এই প্যারাগ্লাইডিং আর এমন কি ব্যাপার।’

আমান ক্রুর হাসি দিয়ে বলল,
‘নাগরদোলায় চড়া আর প্যারাগ্লাইডিং এক কথা নয়। ওয়েল, দেখি তোর দম কত।’

আমান ছোয়ার প্যারাগ্লাইডিং এর সব ব্যবস্থা করে দিল। আমান ছোয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কিভাবে কি করতে হবে। কারণ সে আগেও প্যারাগ্লাইডিং করেছে। আমান বলল,
‘দেখ এটা হলো হারনেস৷ এখানে তুই বসে থেকে বা দাড়িয়ে প্যারাগ্লাইডার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবি। এই রেডিও, ভেরিয়োমিটার এবং জিপিএস নিজের সাথেই রাখ এগুলোর প্রয়োজন পড়বে। আর শোন এই প্যারাগ্লাইডার সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য তোকে তোর শরীরের ভর বা ওজন ডানার উপর সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আর এটা হলো স্পিড বার। এটা পা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে গতি বাড়াতে পারবি। আর ব্রেক কিভাবে করতে হবে সেটা তো জানিসই।’

ছোয়া মাথা ঝাকিয়ে হ্যা জানাল। এবার পালা তারা প্যারাগ্লাইডিং এর!

৫৩.
সাহস একটি প্রয়োজনীয় গুণ। ভয়কে জয় করার নামই সাহস। সাহস দেখানো ভালো হলেও দুঃসাহস দেখানো ভালো না, বিশেষ করে ভয়ানক কোন ব্যাপারে। এই বিষয়টা এতক্ষণে বুঝতে সক্ষম হয়ে গেছে ছোয়া। সাহস করে প্যারাগ্লাইডিং করতে চলে এসেছিল, এখন তার জীবন যায় যায় অবস্থা। নিচের দিকে তাকাতেই ভয়ে কেপে উঠছে ছোয়া। ভয়ে চিৎকার করে বলছে,
‘আল্লাহ বাচাও আল্লাহ। আমি আর কোনদিন প্যারাগ্লাইডিং করব না, এবারের মতো বাচিয়ে দাও আল্লাহ। ওহ, ওহ, মরে গেলাম। কি উচু।’

ছোয়ার অবস্থা এখন ছেড়ে দে মা কেদে বাচি টাইপ। কিছু সময়ের ব্যবধানেই সে নিচে অবতরণ করল। আমান ছোয়ার দিকে এগিয়ে এসে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিলো ছোয়াকে। ছোয়ার হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা ভয় পেয়েছে। তবুও আমান মজা নেওয়ার জন্য বলে,
‘কেমন মজা হলো?’

ছোয়া দাতে দাত চেপে বলল,
‘এমন মজা হয়েছে যে জন্মের মতো প্যারাগ্লাইডিং এর শখ মিটে গেছে।’

আমান আর নিজের হাসি আটকে রাখতে পারল না৷ বেশ শব্দ করেই হেসে ফেলল। ছোয়া ভ্রু কুচকে দেখতে লাগল আমানকে।

বিচ থেকে একটু দূরে এসে একটা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করল দুজনে। রেস্টুরেন্টের মেনু কার্ড হাতে নিয়ে চোখে সর্ষের ফুল দেখতে লাগল ছোয়া। কারণ সবকিছু থাই ভাষায় লেখা। যার কারণে ছোয়ার বোধগম্য হচ্ছিল না কিছুই।

আমান একজন ওয়েটারকে ডাক দেয়। অতঃপর তাকে ইংরেজিতে বলে,
‘আমাদের জন্য এক কাপ কফি আর চিকেন সাতায় নিয়ে আসুন।’

খাবার নিয়ে আসার পর দুজনে খেতে শুরু করল। আমানের খাওয়া একটু আগেই শেষ হয়ে গেল। ছোয়ার খাওয়া তখনো হয়নি। আমানের একটি জরুরি ফোনকল আসায় সে একটু বাইরে গেল। যাওয়ার আগে ছোয়াকে বলল,
‘আমি পাশেই আছি৷ তুই এখানেই থাক।’

আমান চলে যাওয়ার পর ছোয়া খেয়াল রেস্টুরেন্ট টিতে তাদের সামনের টেবিলেই কিছু একটার আয়োজন চলছে। ছোয়া ঠিক বুঝতে পারল না। কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছু সময় পরেই একটি ছেলে এবং মেয়ে এসে বসলো সেই টেবিলে৷ তাদের দেখে মনে হচ্ছে দুজনেই থাই। তারা নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলছিল যা ছোয়া বুঝতে পারছিল না। আচমকা ছেলেটি গোলাপের একটি বুকেট হাতে নিয়ে হাটু গেড়ে বসে মেয়েটির সামনে। অতঃপর বলে ওঠে,
‘ছান রাক খু’ন।'(আমি তোমাকে ভালোবাসি)

মেয়েটি কালবিলম্ব না করে লাজুক হেসে ফুলের বুকেটটি হাতে নিয়ে বলল,
‘ছান কে রাক খু’ন।'(আমিও তোমাকে ভালোবাসি)

ছোয়া যদিও কোন অর্থ বুঝল না। তবে এটুকু বুঝল যে, দুজন একে অপরকে নিজের মনের কথা জানিয়েছে থাই ভাষায়৷ ছান রাক খু’ন, শব্দটি বারবার জপ করতে লাগল সে। ততক্ষণে তার খাওয়ায় হয়ে গেছে। আমান এসে বিল পে করে ছোয়াকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো।

৫৪.
সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে অনেক আগেই৷ রজনী ধরা দিয়েছে পাতায়ার আকাশে। আজকে আমাবস্যার রাত। তবে এই আমাবস্যাতেও আলোয় আলোকিত পুরো পাতায়া।

আমান এবং ছোয়া পাশাপাশি হেটে চলেছে পাতায়ার অন্যতম আকর্ষণ ওয়াকিং স্ট্রিট এ। দিনের বেলা নিরব থাকা ওয়াকিং স্ট্রিট রাতে যেন এক অন্য রূপ ধারণ করেছে। বিনোদনের নানা উপকরণ তো রয়েছেই সাথে রঙিন আলোকসজ্জায় সেজে উঠেছে পুরো এলাকা।

এই সময় মানুষের ভীড়ও চোখে পড়ার মতো। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। সবাই হয়তো রঙিন রাত উপভোগ করতেই বেরিয়ে এসেছে এই চন্দ্রহীন রজনীতে।

আমান ছোয়ার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেন সে এই অচেনা যায়গায় হারিয়ে না যায়। আমানের হাতে হাত রেখে ওয়াকিং স্ট্রিট হেটে বেড়াচ্ছে ছোয়া। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতির মিশেল।

ভালো এবং খারাপ দুটোই যেন একে অপরের পরিপূরক। তাই তো, প্রবাদ আছে সুখের পরেই দুঃখ আবার দুঃখের পরেই সুখ।

ওয়াকিং স্ট্রিটে আচমকা জটলা পেকে গেল। কোথা থেকে যেন একটা গুজব রটে গেল যে ওয়াকিং স্ট্রিটে বো’মা লাগানো আছে। ব্যাস, ভয়ে সব মানুষ উন্মাদের মতো দৌড়াতে লাগল। আমান ছোয়ার হাতটা আরো শক্ত করে ধরল, যাতে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে না যায়। কিন্তু অনেক ভীড় এবং ধাক্কাধাক্কির মধ্যে দুজনে আলাদা হয়ে গেল। ছোয়া খুব ভয় পেয়ে গেল। ফোন বের করে দেখল ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেছে। এত মানুষের ভীড়ে আমানকে কোথাও দেখাও যাচ্ছে না।

আমানও ছোয়াকে খুজে না পেয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ছোয়াকে ফোন করলে নট রিচেবল বলছে। পরিস্থিতি যখন এমন তখন দুজনেই পাগলের মতো একে অপরকে খুজে বেড়াতে লাগল।

দূরত্ব বোধহয় আমাদের ভালোবাসার মূল্যটা আরো বেশি বুঝিয়ে দেয়। ঠিক যেমন এখন হচ্ছে ছোয়া ও আমানের সাথে। আমান ভাবছে একবার যদি ছোয়াকে খুজে পায় আর নিজের থেকে দূরে যেতে দেবে না। শক্ত করে ধরে রাখবে। অন্যদিকে ছোয়া ভাবছে, এবার আমানকে দেখা পেলে সবসময় তার সাথেই থাকবে।

একটানা পনেরো মিনিট এভাবেই একে অপরকে খুজতে লাগল দুজনে। অবশেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। সবাই জানতে পারে বো’মার ব্যাপারটা গুজব ছিল। জটলা কমে এবং আমান ও ছোয়া একে অপরের দেখা পায়। দুজনের চোখাচোখি হয়৷ ছোয়া আমানকে দেখামাত্রই কাদতে কাদতে দৌড়ে ছুটে আসে তার দিকে। আমানের কাছে এসে ঝাপিয়ে পড়ে তার বুকে। জোরে চিৎকার করে বলে,
‘ছান রাক খু’ন।’

আমান বাক্যটির মানে না বুঝলেও আশেপাশে থাকা থাইল্যান্ডের অনেক মানুষই বুঝতে পারে। তারা সবাই হাততালি দিয়ে তাদের দুজনকে চিয়ার আপ করে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here