#প্রেমের_মরা_জলে_ডুবে
#তানিয়া
পর্ব:২
.জিন্নাহ সাহেব মেয়ে আর ছেলের বউ নিয়ে একাই ফিরলেন।গাড়ির বাইরে তিমির বাড়িটা দেখছে।কতই না সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। এখনো পুরো বাড়িটা রং বেরঙের আলোতে ঝলমল করছে কিন্তু কোথাও যেন পুরো বিষাদে ছেয়ে গেছে বাড়িটা।তিমির ভাবছে, না জানি নিপা বেগম তাকে দেখলে কেমন আচরণ করে?আজকে যে কাজটা হলো এরপর তো তার ওপর সবাই খেপে থাকবে।এ তো আর পুতুল বিয়ে নয় যে চাইলেই এলোমেলো করে খেলা ভেঙে উঠে যাবে, এটা হচ্ছে জীবন মৃত্যুর মতোই ফরজ কাজ।মানুষের জন্মের পর তার জীবনের কিছু সময় পার হয় নিজের রক্ত সম্পর্কীয় মানুষের সাথে তারপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাটাতে হয় সেই মানুষটার সাথে যার সাথে আল্লাহ কপাল জুড়িয়ে দিয়েছে।তিমির জানে না, আজ যে পবিত্র বন্ধনে সে আবদ্ধ হয়েছে সেই বন্ধনের সাথে জড়িত অপর মানুষটার সাথে আধো তার সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে কিনা?
বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতে তিমির আর শুভা নেমে এলো সেই সাথে জিন্নাহ সাহেব।তিমির দরজার গোড়ায় পা রাখতে হইহই রইরই করে নিপা দৌড়ে এলেন।চোখ মুখ শক্ত করে গর্জে উঠলেন।
“তোমাকে বলেছি না এ-ই মেয়েকে আমি ঘরে তুলবো না।এক্ষুনি বিদায় করো ওকে।”
“নিপা ও এ বাড়ির বউ।তাছাড়া বেয়াইন ওকে ও বাড়িতে রাখবেন না।তাহলে কোথায় যাবে ও?”
“জাহান্নামের চৌরাস্তায় ছেড়ে আসো।নিজের পথ খুঁজে নিবে তবুও ওকে আমি এ বাড়িতে ঢুকতে দিব না।”
“পথ ছাড়ো নিপা।এতো ধকলের মাঝে এসব সিনক্রিয়েট ভালো লাগে না।সরে দাঁড়াও।”
জিন্নাহ সাহেব নিজেই তিমিরকে নিয়ে বাসায় ঢুকলেন।স্বামীর এমন অগ্রাহ্যতা হজম করতে পারলো না নিপা কিন্তু নিরুপায় সে, শান্তার বরের মতো তার বরটা এত নরম নয়।উপায়ন্তর না পেয়ে সোফায় ধপ করে বসে মাথায় আইসবার্গ লাগাচ্ছে। বাড়িতে আসার পর থেকে তিন ব্যাগ লাগিয়েছে এখন আরেক ব্যাগ তাও যেন মাথা থেকে দাউদাউ করে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে।
তিমিরকে রাখা হয়েছে শুভ্রর রুমে।শুভ্র সফেদের আরেক নাম।সফেদটা সার্টিফিকেট নাম হিসেবে গ্রহণ হলেও শুভ্র নামটা দৈনন্দিন জীবনে বেশি ব্যবহৃত।
মাথা ব্যাথায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম। প্রতি সন্ধ্যায় এক মগ চা খায় তিমির অথচ আজ সারাদিনের এত ধকলে সেটা পায় নি।তাছাড়া আজ তার বিয়ে হয়েছে দূর্ঘটনায় পড়ে তাই চা খাওয়ার সময় হয় নি।কিন্তু মাথাকে কেমনে বুঝায় এ পরিস্থিতিতে সে চা পাবে কোথায়?
তিমিরকে বসিয়ে সেই যে শুভা আর তার শ্বশুর গেলো এখনো কাউকে দেখা গেলো না।এ কেমন কথা,নতুন বউয়ের কতোকিছু লাগতে পারে সেইটা দেখার জন্য কেউ এলো না?আজব আজ তুরফা আপু থাকলে কি এমন হতো?
শুভা কাপড় ছেড়ে রুমে এসে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে বিছানায় চিৎপটাং হয়ে পড়লো।আজ যা হলো তাতে সে কিছুটা আশ্চর্য তো হয়েছেই তবে খুশিও হয়েছে খানিকটা কারণ প্রিয় বান্ধবীকে এখন সবসময় হাতের কাছে পাবে যখন তখন ঘুরতে যেতে পারবে এটাই বা কম কীসের?
“শুভা এই শুভা,মর*লি নাকি হারামি?এই শুভা?”
তিমিরের চিৎকারে শুভা ধড়াস করে বিছানা ছাড়লো।ভুলে গেছে এ প্রিয় বান্ধবীর যতগুলো ভালো গুণ আছে সেই সাথে অনেক ভয়াবহ গুণ আছে। সেগুলোও তাকে হজম করতে হবে ভেবে কোমায় চলে যাচ্ছে শুভা।আপাতত কোমা ছেড়ে দরজা খুললো।
“কিরে, হারামি কই মর*তে গেছোস?নতুন বউ ঘরে ফেইল্লা রাইখা যে নিজের ঘরে এসে এভাবে হাত পা ছড়ায় শুয়ে আছোস লজ্জা করে না?’
“কিসের লজ্জা রে,লজ্জা তো তোর হওয়া উচিত যে ঠকিয়ে আমার ভাইকে বিয়ে করেছিস।তা এভাবে চেচাচ্ছিস কেনো?”
“না চেচিয়ে কি করতাম?মাথা ব্যাথায় তো ম*রে যাচ্ছি। তুই তো জানিস সকাল বিকাল আমাকে এক মগ চা খেতে হয়।সন্ধ্যা তো শেষ হয়েছে সে কখন এক মগ তো দূরে থাক এক চামচ চাও কেউ দিলো না।আর এ শাড়ি কতক্ষণ পড়ে থাকবো?আমি তো এ পোশাকে চলে এসেছি কোনো কাপড় আনিনি তোর থেকে একটা কাপড় দে না?’
শুভা তিমিরের অবস্থাটা বুঝতে পারলো।আসলে ওকে অনেক ক্লান্ত এবং পরিশ্রমী লাগছে।শুভা ওর একটা কাপড় দিয়ে নিজেই চলে গেলো চায়ের জন্য।নিচে বসার রুমে মা এখনো বকে চলেছে জিন্নাহ আর তিমিরকে।শুভা নিরবে রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে ওপরে গেলো তার আগে মায়ের রুম থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে নিলো।
তিমির তো চা পেয়ে স্বর্গ হাতে নিয়েছে এমন ভাব দেখালো।এক চুমুক চা খায় একবার আহ্ করে শান্তি প্রকাশ করে।এদিকে তিমিরের নড়াচড়াতে শুভার ঔষধ লাগাতে সমস্যা হচ্ছে।
“কিরে তুই কি এভাবে নড়াচড়া করবি নাকি ঔষধ লাগাতে দিবি?কতটা ব্লাড বের হয়েছে দেখেছিস,ব্যাথা করছে না?”
“ওহ হ্যাঁ এরজন্যই তো মাথাটা আরো বেশি ঝিমঝিম করছিলো।খেয়ালই ছিল না আঘাতের কথা।আর হ্যাঁ তুই আমাকে তুই তুই করছিস কেনো,আমি এখন তোর ভাবি লাগি বড় ভাইয়ের বউ হয়।ভদ্রতার সাথে তুমি করে ভাবি ডাক”
“ওরে আমার ভাবিরে(মুখ ভেংচি কেটে)। এমন ভাই য়ের বউ আমার যে কিনা বিয়ের দিনে মা*ইর খেয়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। আচ্ছা এসব কীভাবে করলি আমাকে বলতো,আমার তো এখনো বিশ্বাস হয় না তুই শুভ্র ভাইকে বিয়ে করেছিস?”
“তুই কি বিশ্বাস করবি আমার নিজেরই সবটা অবিশ্বাসের লাগছে।তোর ঐ কুমড়ো পটাশ,হুতুম পেঁচা মার্কা ভাই য়ের বউ আমি।”
“আচ্ছা এ কাজটা কেনো করলি,মানে সত্যিই কি তুরফা আপুর সাথে তুই এমন করেছিস?”
তিমির দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এখন কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা বিশেষ করে তুরফা আপুর বিষয়টা নিয়ে।তিমির হঠাৎ শুভার ফোনটা চাইলো।শুভার ফোনটা থেকে কল করলো বাবাকে।কবির সাহেব কল ধরতেই তিমির কথা বললো,
“বাবা কেমন আছো?”
“মা তিমির,মা আমি ভালো তুই কেমন আছিস?”
“ভালো বাবা।মা আপু কেমন আছে? ”
“ওরাও ভালো।মা তোর শ্বাশুড়ি কি তোর সাথে কোনো বাজে ব্যবহার করেছে?”
“না বাবা তবে ঘরে ঢুকতে মানা করলে আমার শ্বশুর অমান্য করে ঢুকে পড়ে।এরপর এখনো অবধি দেখা হয় নি।বাবা তুরফা আপু কি তোমার কাছাকাছি আছে।”
“না হয়তো রুমে আছে, কেনো কথা বলবি?”
“না বাবা থাক। তুমি ভালো থেকো। ”
কথা শেষ করে ফোন রাখলো তিমির।
রাত ন’টা এখনো শুভ্র বাসায় ফিরে নি।নিপা ছেলেকে কল দিয়েছে সে ধরছেনা।প্রথম কয়েকবার কল গেলেও পরে সুইচ অফ শোনাচ্ছে। চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে পড়েছেন।বারকয়েক তিমিরকে গিয়ে কথা শুনিয়ে এসেছে। তিমির হা না কিছু বলেনি।সে নিজেও জানে, এ ব্যাপারটা কতটা প্রভাব ফেলেছে সবার ওপর।যতই হোক তার একজনের অপরাধে সবই এলোমেলো হয়েছে। তবে এ কাজে তো সে একা দোষী নয় তাহলে কাকে জানাবে সে কথা?
তিমির সবে শরীরটা বিছানায় এলাতে এসেছে কোত্থেকে ছুটে এলো নিপা।এসেই আবারও চিৎকার দিলো
“তুমি আমার ছেলের বিছানাতে কি করছো, উঠো উঠো বলছি?”
“আপনি এভাবে চিল্লান কেন আন্টি?অল্প বয়সে আমার কানটা তো আপনার জন্য ই বোধ হয় চলে যাবে।এতদিন শুধু মায়ের চিৎকারে তালা লাগতো এখন দেখি আপনার চিৎকারে কালা হওয়ার দশা হবে।”
“মুখে মুখে তর্ক, বেয়াদপ একটা।নির্লজ্জের মতো কাজ তো করেছই আবার আমার সামনে বড় বড় ভাষণ দিচ্ছো। বের হও আমার ছেলের রুম থেকে।”
“আন্টি এটা কি এখন শুধু ওনার একার রুম আমার না?বিয়ের পর তো স্বামী বউ একসাথে ঘুমায় তাহলে আমরাও তো স্বামী বউ তাই না?”
“একদম পাকা পাকা কথা বলবে না।কীসের স্বামী বউ? তোমার প্রতরণার শোকে আমার ছেলে এখনো বাসায় ফিরে নি।এদিকে ফোন অফ, সেই খবর আছে?আছো তো নিজেকে নিয়ে, ফাজিল মেয়ে একটা।”
নিপার চিৎকার এতবেশি ছিল যে ঘর থেকে শুভা আর তার বাবা বেরিয়ে এলো।
“কি হলো কি চিৎকার করছো কেনো? ”
“কি আমি চিৎকার করছি?”
“নিপা তুমি তো চিৎকারই করছো সন্দেহ আছে,মূল কথা বলো?”
“ও আমার ছেলের রুমে কি করছে জিজ্ঞেস করো? ”
“আশ্চর্য এটা তো এখন শুভ্রর একার রুম না,ও বিয়ে করেছে ওর বউও এ রুমে থাকবে তাতে তোমার সমস্যা কি?”
“আমার সমস্যা কি মানে, আমি ওকে আমার ছেলের রুমে থাকতে দিব না।ও অন্য কোথাও থাকুক।”
“তাহলে মা তিমির আমার সাথে থাকুক।”
হেসে জানতে চাইলো শুভা।
“এক চড় দিয়ে গাল ফাটাবো।বড় বার বেড়েছিস তুই। পইপই করে মানা করছিলাম এই মেয়ের সাথে যাতে না মিশতে, এবার দেখলি কি করলো মেয়েটা?’
তিমির বুঝতে পারলো নিপা কথা থামাবে না তাই নিজেই দরজার দিকে পা বাড়ালো।সেটা দেখে নিপা জিজ্ঞেস করলো,
“কই যাও এখন?”
“শুভার রুমে,আপনার ছেলের রুমে তো থাকতে দিবেন না তাই ননদের রুমে ঘুমাবো।তাছাড়া অন্য কোথাও যেতে বললে সোজা আপনার রুমে গিয়ে ঘুমাবো।অতএব ঘুম আসছে বাই।”
ঘুমের অলসতা দেখিয়ে তিমির সবার সামনে হেঁটে শুভার ঘরে চলে গেলো।এটা দেখে বাকিরা মিটিমিটি হাসলেও আগুনের মতো জ্বলতে লাগলো নিপা।
রাত তিনটায় বাসায় ফিরলো শুভ্র। আলোতে এখনি উজ্জ্বল করছে বাহিরটা।গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢুকে দেখলো সবটা নিস্তব্ধ।নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়লো।লং ড্রাইভে গিয়েছিল সে।একবারের জন্যও গাড়ি থামায় নি।ক্লান্ত লাগছে তার।বিছানায় পড়তে অন্য কিছু ভাবার আগেই ঘুমে তলিয়ে গেলো!
,
,
,
চলবে……
১